Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » শালীবাহন || Sharadindu Bandyopadhyay

শালীবাহন || Sharadindu Bandyopadhyay

শালীবাহনের আসল নামটা কি ছিল ভুলিয়া গিয়াছি। বোধ করি ধীরেন সুরেন গোছেরই একটা কিছু হইবে। গত বিশ বছর ধরিয়া ক্রমাগত নিজেকে ঐ নামে সম্বোধিত হইতে শুনিয়া তাহার নিজেরও সম্ভবত পিতৃদত্ত নামটা বিস্মরণ হইয়াছিল।

আশ্চর্য নয়। একেবারে ন্যালাক্যাবলা না হইলেও শালীবাহনের মতো গো-বেচারী সদা-বিকশিত-দন্ত নিরীহ মানুষ সচরাচর দেখা যায় না। আমাদের বিরাট বন্ধুগোষ্ঠীর মধ্যে সকলেই তাহাকে তাচ্ছিল্যভরে ভালবাসিতাম। আমাদের উপহাস পরিহাসের সে ছিল পরম সহিষ্ণু লক্ষ্যস্থল।

বছর কুড়ি আগে শালীবাহনের প্রথম বিবাহ হইয়াছিল। বিবাহ করিয়াই সে শ্বশুর পরিবারের সঙ্গে বেবাক মিশিয়া গেল। প্রায়ই ছোট ছোট শালীদের সঙ্গে লইয়া পার্কে বেড়াইতে যাইত; একটি শালীর বয়স আট-নয় বছর, দুটি একেবারে কচি। আমাদের মধ্যে কেহ একজন একবার শালীবাহনকে কোঁচার খুঁট দিয়া কচি শালীর নাক মুছাইয়া দিতে দেখিয়া ফেলিয়াছিল; কথাটা তৎক্ষণাৎ বন্ধুসমাজে রাষ্ট্র হইয়া গেল এবং তাহার অনিবার্য ফল দাঁড়াইল তাহার শালীবাহন খেতাব।

শালীবাহনের শ্বশুর গুণময়বাবু যে একজন অতি কুটবুদ্ধি লোক ছিলেন তাহার প্রথম প্রমাণ এই যে, জ্যেষ্ঠা কন্যার বিবাহের পরই তিনি জামাতার হাতে সংসার তুলিয়া দিয়া পরম আরামে তামাক টানিতে লাগিলেন। শালীবাহন তখন চাকরি করিতে আরম্ভ করিয়াছে, দন্ত বিকশিত করিয়া শ্বশুর ও তাঁহার চারিটি কন্যার ভার গ্রহণ করিল।

এইভাবে বছর পাঁচেক কাটিয়া গেল। শালীবাহন খুশি, গুণময়বাবু খুশি, শ্যালিকারাও খুশি—এক কথায় সকলেই খুশি কাহারো মনে কোনও দুঃখ নাই। এমন সময় শালীবাহনের জীবনের প্রথম ট্র্যাজেডি দেখা দিল।

তাহার স্ত্রী সহসা মারা গেল। শালীবাহন একে ভালমানুষ, তায় পত্নীর বড়ই অনুরক্ত হইয়া পড়িয়াছিল; এই ঘটনায় সে একেবারে মুহ্যমান হইয়া পড়িল। তাহার দাঁতের হাসি কেমন যেন ফ্যাকাসে হইয়া গেল; রুক্ষ মাথায়, অপরিচ্ছন্ন বেশে এখানে সেখানে ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিল।

একদিন আমাদের আড্ডায় বসিয়া স্ত্রীর শেষ রোগের কথা বলিতে বলিতে বেচারী একেবারে কাঁদিয়া ফেলিল। সুধাংশু আমাদের মধ্যে কুমার-ব্রহ্মচারী, বিবাহ করে নাই; সে সহানুভূতি প্রকাশ করিয়া বলিল, কি আর করবে শালীবাহন, দুঃখ করে লাভ নেই। কথায় বলে ভাগ্যবানের বৌ মরে, আর অভাগার ঘোড়া। তুমি দেখে শুনে আর একটি বিবাহ করে ফেল।

চোখ মুছিয়া শালীবাহন বলিল, আর ওসব ভাল লাগে না ভাই;—অফিসে যাই, তাও মনে হয় কার জন্যে।

শালীবাহনের উদাসীনতা এতদূর গড়াইল যে, সে শালীদের পর্যন্ত অবহেলা করিতে লাগিল। দেখিয়া শুনিয়া গুণময়বাবু অতিশয় শঙ্কিত হইয়া উঠিলেন।

এদিকে শালীবাহনের মেজ শালীটি উপযুক্ত হইয়া উঠিয়াছিল। গুণময়বাবু তাহার বিবাহ দিতে পারিতেছিলেন না, কারণ কন্যার বিবাহ দিবার পক্ষে যে বস্তুটি অপরিহার্য তাহা গুণময়বাবুর ছিল না। তিনি কয়েক ছিলিম তামাক পোড়াইয়া শালীবাহনকে সংসারের অনিত্যতা ও সংসারী মানুষের সর্ব অবস্থায় গৃহধর্মপালনরূপ মহাকর্তব্য সম্বন্ধে জ্ঞান-গরিষ্ঠ উপদেশ দিতে আরম্ভ করিলেন।

বৎসর ঘুরিবার পূর্বেই মেজশালীর সহিত শালীবাহনের বিবাহ হইয়া গেল।

আবার সকলেই খুশি। শালীবাহনের বিকশিত-দন্তে পূর্বতন হাসি দেখা দিল। বিবাহের বছরখানেকের মধ্যে সে দিব্য মোটা হইয়া উঠিতে লাগিল। আমাদের বন্ধু-সভার সিদ্ধান্ত হইল, এতদিনে শালীবাহনের গায়ে বিয়ের জল লাগিয়াছে।

তারপর একটি একটি বছর কাটিয়া চলিল। পিছু ফিরিয়া তাকাইবার সময় নাই, আশেপাশে তাকাইবারও সময় কম—স্রোতে ভাসিয়া চলিয়াছি। যে-স্রোতে প্রথম যৌবনে খেলাচ্ছলে সাঁতার কাটিয়া স্রোত তোলপাড় করিতাম, তাহাতে নাকানি-চোবানি খাইতেছি, কখন বা অতি কষ্টে নাক জাগাইয়া রাখিয়াছি। বন্ধুগোষ্ঠীর অনেকেই কে কোথায় ছিটকাইয়া পড়িয়াছে। দশ বছর আগে যাহারা হৃদয়ের কাছাকাছি ছিল, আজ তাহারা কোথায়?

শালীবাহন কিন্তু বিপুল বিক্রমে সাঁতার কাটিয়া চলিয়াছে। তাহার গণ্ড আরো স্ফীত হইয়াছে, হাসি আর প্রসারিত হওয়া অসম্ভব তাই পূর্ববৎ আছে। দশ বছর তাহার মনকে যেন স্পর্শ করিতে পারে নাই।

কিন্তু যে নিয়মে গাছের কাঁচা ফল পাকে, সেই নিয়মে তাহার কচি শালী দুটিও পাকিয়া উঠিয়াছে। শালীবাহন চাকুরি করিয়া যে টাকা উপার্জন করে তাহাতে শশুর পরিবারের ভরণ-পোষণ চলে, কিন্তু শালীদের সুপাত্রে ন্যস্ত করা চলে না। তাহারা লব্ধোদয়া চান্দ্রমসী লেখার ন্যায় দিনে দিনে পরিবর্ধমানা হইতে লাগিল।

অনূঢ়া কন্যা দুটির বয়স যখন যথাক্রমে উনিশ এবং কুড়ি, সেই সময় কূটবুদ্ধি গুণময়বাবু একটা মস্ত চাল চালিলেন। তিনি হঠাৎ শালীবাহনকে কোনরূপ নোটিস না দিয়া মরিয়া গেলেন।

শালীবাহনের জীবনের ইহা দ্বিতীয় ট্র্যাজেডি। শালী দুটি তাহার ঘাড়ে তো ছিলই, এখন আরো চাপিয়া বসিল।

শালীদের বিবাহ দিবার দায়িত্ব যতদিন শ্বশুরের সঙ্গে ভাগাভাগি ছিল ততদিন শালীবাহন বিশেষ গা করে নাই। কিন্তু এখন সে উঠিয়া পড়িয়া লাগিয়া গেল; দন্তবিকাশ করিয়া দ্বারে দ্বারে ঘুরিতে লাগিল। আমাদের বন্ধু নলিনাক্ষ সম্প্রতি বিপত্নীক হইয়াছিল, তাহার বাড়িতে গিয়া ধনা দিল; আমার বাড়িতেও ঘন ঘন যাতায়াত আরম্ভ করিল। আমার একটি অবিবাহিত ছোট ভাই আছে, লক্ষ্য তাহার উপর।

কিন্তু কিছুতেই কিছু ফল হইল না। শালীবাহনের শালীদের বিনা পারিশ্রমিকে তাহার স্কন্ধ হইতে নামাইয়া নিজ স্কন্ধে বহন করিতে কেহ রাজী নয়। শালীবাহনের হাসি ক্রমশ নিস্তেজ হইয়া আসিতে লাগিল; তাহার গোঁফের চুল দুএকটা পাকিয়া গেল। বুঝিলাম, সংসারস্রোত এতদিনে তাহাকেও কাবু করিয়া আনিয়াছে।

একদিন আমার বৈঠকখানায় তাহাকে কিছু সদুপদেশ দিলাম,

দ্যাখ শালীবাহন, ওসব ধান্ধা ছেড়ে দাও। টাকা থাকলে, মেয়ে না থাকলেও তার বিয়ে দেওয়া যায়, কিন্তু মেয়ে থাকলে—আর টাকা না থাকলে বিয়ে দেওয়া যায় না। এই সহজ কথাটা বুঝে নাও। আজকাল কত মাইনে পাচ্ছ?

পঁচাত্তর।

হুঁ। কিছু বাঁচিয়েছ?

কোত্থেকে বাঁচব ভাই। খেতে পরতেই কুলোয় না, তার উপর বাড়িভাড়া আছে। শ্বশুর যতদিন বেঁচে ছিলেন, তিনি তবু সতেরো টাকা করে পেন্সন পেতেন, কিন্তু এখন, আমরা চারটি প্রাণী, আর সম্বলের মধ্যে ঐ পঁচাত্তর টাকা। ভাগ্যে ছেলেপুলে হয়নি তাই কোনও রকমে চলে যাচ্ছে। বুঝতেই তো পারছ।

বুঝেছি। বিয়ে দেবার আশা ছেড়ে দাও; তোমার শালীরা এমন কিছু সুন্দরী নয় যে বিনা পণে কেউ নেবে। আজকাল অনেক মেয়ে স্কুল হয়েছে, দেখেশুনে তাইতে মাস্টারণী করে দাও।

কিন্তু ভাই, লেখাপড়াও তো এমন কিছু শেখেনি যে স্কুলে শেখাতে পারে। রামায়ণটা মহাভারতটা পড়তে পারে এই পর্যন্ত বিদ্যে; কি করি বল। বলিয়া অসহায়ভাবে আমার পানে তাকাইয়া রহিল।

বড় বিরক্তি বোধ হইল, অধীরভাবে বলিলাম, তবে আর কি করবে, শালী দুটিকে কাঁধে করে নিয়ে বসে থাক। বিয়ে ওদের হবে না, আমি লিখে পড়ে দিলুম। আর আমার ভায়ের কথা যে বলছ, জানো তো সে ভাল ছেলে, য়ুনিভার্সিটিতে ভাল রেজাল্ট করেছে। তার ইচ্ছে বিলেত যায়; কিন্তু আমার এমন টাকা নেই যে তাকে বিলেত পাঠাই, শ্বশুরের পয়সায় সে যাতে বিলেত যেতে পারে সে চেষ্টা আমার করা উচিত নয় কি? তুমিই বল।

শালীবাহন কিছুক্ষণ চুপ করিয়া বসিয়া রহিল, তারপর পাংশু হাসিয়া বলিল, হ্যাঁ, ঠিক কথা। আচ্ছা ভাই, আজ তাহলে উঠি। বলিয়া আস্তে আস্তে উঠিয়া চলিয়া গেল।

তারপর মাসছয়েক আর তাহার দেখা পাইলাম না। খবর পাইতাম সে এখনো আশা ছাড়ে নাই, এখানে ওখানে শালীদের জন্য চেষ্টা করিতেছে।

এইবার শালীবাহনের জীবনের তৃতীয় ট্র্যাজেডি। একদিন শুনিলাম, তাহার দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীটিও মারা গিয়াছে। তাহার জন্য মনে একটা বেদনা অনুভব করিলাম। পৃথিবীতে যে যত ভালমানুষ, শাস্তি কি তাহাকেই সব চেয়ে বেশী সহিতে হয়? সেদিন তাহার প্রতি রূঢ় ব্যবহার করিয়াছিলাম স্মরণ করিয়া একটু অনুতাপও হইল।

তারপর আরও বছরখানেক কাটিয়া গেল। শালীবাহনের সহিত দেখা সাক্ষাৎ নাই; তাহার খবরও পাই না। পুরাতন পরিচিতদের সংসর্গে সে আর আসে না; নলিনাক্ষের আশাও ছাড়িয়াছে।

অবশেষে পূজার সময় কলেজ স্ট্রীটের একটা বড় কাপড়ের দোকানে হঠাৎ শালীবাহনের সঙ্গে দেখা হইয়া গেল। আশ্চর্য হইয়া দেখিলাম, তাহার মুখে সেই পুরাতন বিকশিত-দন্ত হাসি ফিরিয়া আসিয়াছে। সানন্দে তাহার পিঠ চাপড়াইয়া বলিলাম, আরে শালীবাহন! কেমন আছ?

শালীবাহন এক জোড়া সস্তা সিল্কের জংলা শাড়ি দেখিতেছিল, সরাইয়া রাখিয়া হাসি মুখে বলিল, ভাল আছি ভাই।

তারপর, তোমার শালীদের খবর কি? বিয়ে হল?

সলজ্জভাবে শালীবাহন বলিল, হ্যাঁ ভাই, হয়েছে। মানে—আমিই তাদের বিয়ে করেছি। স্তম্ভিত হইয়া গেলাম।

বল কি! দুজনকেই?

হ্যাঁ ভাই, দুজনকেই। কি করি বল, কোথায় ফেলি ওদের? পয়সা নেই, পাত্র তো আর পেলুম না। স্ত্রীও মারা গেলেন। তাই শেষ পর্যন্ত

আমি আবার তাহার পিঠ ঠুকিয়া দিয়া বলিলাম, খাসা করেছ। বাহাদুর লোক বটে তুমি।

শালীবাহন স্মিতমুখে নীরব হইয়া রহিল। আমি বলিলাম, যাক, মোটের উপর ভালই আছ তাহলে। অন্তত শালী-দায় থেকে তো উদ্ধার পেয়েছ। তা তোমার শালীরা কোনও আপত্তি করলে না? আজকালকার মেয়ে

শালীবাহন বলিল, না, আপত্তি করেনি। আর করলেই বা উপায় কি ছিল বল। স্ত্রী মারা গেলেন; বাড়িতে আর দ্বিতীয় লোক নেই—আমি আর ওরা। ভাল দেখায় না—ওরা সোমত্ত হয়েছে, বুঝলে না? কাজেই

আমি সজোরে হাসিয়া উঠিলাম, তা বটে। যাক, শ্বশুর-কন্যার কোনটিকেই বাদ দিলে না। সাবাস শালীবাহন!

শালীবাহন চোখ টিপিয়া খাটো গলায় বলিল, আস্তে! ওরা রয়েছে।

চমকিয়া ফিরিয়া দেখিলাম। অদূরে দাঁড়াইয়া দুইটি যুবতী কাপড় পছন্দ করিতেছিল—লক্ষ্য করি নাই; এখন একযোগে তীক্ষ্ণ তীব্রদৃষ্টিতে আমার পানে তাকাইয়া আছে। থতমত খাইয়া গেলাম। শালীবাহন স্ত্রীদের লইয়া পূজার বাজার করিতে আসিয়াছে! লজ্জায় অস্পষ্টস্বরে শালীবাহনকে আমার বাড়িতে একদিন যাইতে বলিয়া তাড়াতাড়ি দোকান হইতে বাহির হইয়া গেলাম।

পথে যাইতে যাইতে যুবতী দুটির চোখের সেই দৃষ্টি আমাকে বিদ্ধ করিতে লাগিল। ভর্ৎসনা আর অভিমান! সত্যই তো, এ লইয়া হাসি তামাসা করিবার আমার কি অধিকার আছে? মনে হইতে লাগিল, ঐ ভর্ৎসনা আর অভিমানের সমস্তটাই আমার প্রাপ্য।

কিন্তু সে যাই হোক, শালীবাহনের শালী দুটি দেখিতে নেহাত মন্দ নয়। শালীবাহনকে ভাগ্যবান পুরুষ বলিতে হইবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress