শনকা – 3
শণকার হাতে একটা নেকলেস আর ক’গাছা চুড়ি দিয়ে বলল,এ গুলো পড়ে নাও। ওর মুখের ‘তুমি ‘ সম্বোধন টা শণকার চোখে জল এনে দেয়। তাকাতে পারে না সেই মানুষটার দিকে। হাত থেকে গহনাগুলো নিয়ে পড়ে নিল। সেই মানুষটার হাতে সিঁদূরের কৌটো এবং তাঁর চোখের গভীর দৃষ্টিতে শণকার চোখের জলের বাণ ডেকে যায় । গলার কাছে উথলে ওঠে কান্নার দানা । শণকা নিজেকে লুকানোর চেষ্টা করতে আয়নার দিকে ফিরে যায় । শণকা এটা বোঝে যে ওর ঐ দুর্বলতা ঐ মানুষটার চোখে ধরা পড়ে গেছে। পেছন থেকেই সে বলেছে। তোমায় কোন কষ্ট দেইনি তো?
উত্তরে মাথা নেড়েছে শণকা। যেন কিছুই হয় নি এমন ভাবেই বলেছে। কৈ,দিন কৌটো টা। কৌটো থেকে গাঢ় করে সিঁদূরের রেখা টেনে দিল সিঁথিতে । কপালে বড় করে একটা টিপ পড়ল। নিজেই নিজেকে দেখে মুগ্ধ শণকা । ও যে এত সুন্দর তা ওর জানা ছিল না।
— চলুন। বলে সেই মানুষটার দিকে ঘুরে দাঁড়াতেই ঐ মানুষটার মুগ্ধতায় হাবুডুবু খেতে খেতে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামে। সকলের ঔৎসূক দৃষ্টি । সকলকেই দেখিয়ে শণকার কাঁধে হাত রাখল সেই পুরুষ। মূহুর্তের মধ্যেই তার চেহারা পাল্টে গেছে! মনে হচ্ছে সদা হাস্য এক প্রেমিক স্বামী , তার স্ত্রীর প্রতি অনুরক্ত। ওরা ঘরে ঢুকতেই নার্স, আয়া ঘর থেকে সরে গেল। বিছানায় শায়িত এক বৃদ্ধা । তার কাছে গিয়েই শণকাকে বসায়। বলে—- দিদা, দেখ । কাকে এনেছি? দিদা বলেন——- কে?কাকে এনেছিস? তোমার নাত বৌ গো । পছন্দ হয়েছে তো? দিদা আস্তে আস্তে উঠে বসেন। নাতি কে বললেন।
– এ কি করেছিস ? কোথায় পেলি এমন লক্ষ্মী প্রতিমা! নত হয়ে শণকা প্রনাম করল দিদাকে। দিদা চিবুকে হাত দিয়ে চুমু খান শণকাকে। বলেন
– শাঁখা, সিঁদূর পড়ে বেঁচে থাক দিদিভাই। নাতির কানে কানে কি যেন বলেন। আর তখনই সেই মানুষ টা উঠে যায়। দিদা বলতে থাকেন। যে ক’টা দিন আমি বেঁচে আছি । আর কোথাও যাবি না । এবার থেকে ওর সব দায় তোকেই নিতে হবে। ঘরে ঢোকে দিদিমার নাতি। বলে।
– দিদা, এই নাও। বলে একটা লাল ভেলভেটের গহনার বাক্স দিদিমার হাতে দিল। দিদিমা সেটা খুলে একটা ভারি জড়োয়ার নেকলেস বার করে বলেন।
– নে, এটা তিতির কে পড়িয়ে দে। তিতির কথাটায় চমকে ওঠে শণকা । চোখে জল এসে যায় শণকার। তার মানে তিতিরের ব্যাপার টা দিদার জানা ! শণকা ভাবে দিদা জানে ও না যে তার নাতি দশ দিনের জন্য বৌ এনেছে দশ হাজার টাকায় । দিদা শণকাকে যেতে বললেও শণকা সরে যায় না । দিদার কাছে বসেই থাকে। দিদার মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। রাত ন’টা নাগাদ খাওয়ার ঘরে ডাক পড়ল। খাওয়ার পর শোওয়ার পালা । বুক দুর দুর করছে শণকার। সেই মানুষটাই শোওয়ার ঘরে নিয়ে এল তাকে । ভয় হল শণকার । এবার বুঝি দশ হাজারের শোধ তুলবে! তার চোখে চোখ ফেলতে পারে না শণকা। সেই মানুষটির কথা শুনে ভয়টা গেল।
– একটা কথা তোমাকে বলা দরকার। এ বাড়ির সবাই তোমাকে আমার স্ত্রী মনে করছে। তাই ও পাশের বসার ঘরে ই আমার শোওয়ার ব্যবস্থা করে নেব। কেউ যেন বুঝতে না পারে। তাহলে দিদিমা কষ্ট পাবে। ঐ মানুষটার পাশে দাঁড়িয়ে শণকার রক্তের পারা ওঠা নামা বাড়ছে। এই মানুষটির কাছে দশদিন থাকার লোভ সামলাতে পারে নি শণকা । প্রভাসের কাছে শুনেছিল, যে ডক্টর অরিন্দম চৌধুরীর স্ত্রী সেজে দশ দিন থাকতে হবে। প্রভাস অবশ্যই বোঝাতে চেয়েছে ,যে স্টেজ এ নাটক করা সহজ হলেও ব্যাক্তিগত জীবনে অভিনয় করা কঠিন। আরও বলেছিল প্রভাস যে, ডক্টর চৌধুরী এত সুন্দর যে তুই শেষে ওর প্রেমে পড়ে যাবি । মাঝখান থেকে তোর কষ্ট বাড়বে । শত হলেও সে তো “বিবাহিত পুরুষ”! এক রকম জোর করেই এসেছে শণকা তাকে দেখতে। মা কে বলেছে বাইরে বেড়াতে যাচ্ছে । পুজোর ছুটির সাথে আরও ক’দিন বাড়তি ছুটি নেওয়া । পাশের ঘরের আলো আসছে। ঘুম আসছে না । ভেবেছিল , চিনে নেবে তাকে। সে কত বড় দুঃশ্চরিত্র । প্রতিদিন যে হাজার টাকা রফা করে । রাতের বেলায় নিশ্চয়ই সুদে আসলে তুলে নেবে। এ ঘরে শুয়ে শণকার বার বার মনে হল, কৈ সে তো একবার ঘরে এল না ! তবে কি শণকাকেই ঘেন্না করছে সে ? টাকা আয় করতে এসেছে বলে। রাগটা চাড়া দিয়ে উঠল শণকার। উঠে গেল পাশের ঘরে । দেখল গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন সেই মানুষ । নিস্পাপ একটা মানুষ । নিজের অজান্তেই হাত লেগে ফুলদানী টা পড়ে গেল । জেগে গেল সে। তার দৃষ্টি শণকার ঢিলেঢালা পোষাকে । শণকার গালে লালের ছোপ। মানুষটা হিসহিসিয়ে বলে।
– হোয়াই ডিড ইউ কাম হিয়ার? শণকা থমকে যায় ওর দৃষ্টিতে ঘেন্না দেখে। ওর দৃষ্টি যেন বলছে,- ইউ স্লাট আই অ্যাম নট ইন দ্যা হ্যাবিট অফ বাইং দ্যা লেডিস ফর দ্যাট রিজন। মুখে বলল- গো, টু ইয়র রুম। শণকা বলল, আলোটা চোখে পড়ছিল তাই নেবাতে এসেছিলাম। এবার সে বলল- যান শুয়ে পড়ুন। গুড নাইট।
আলোটা নিবিয়ে চাবুক খাওয়া প্রাণীর মত পাশের ঘরে ছুটে গেল শণকা। ভীষণ ভুল করেছে শণকা । যে ধরনের কাজ নিয়ে এসেছে শণকা, তাতে কেউ বিশ্বাস করবে না ওকে। যে ওর কোন পুরুষের সঙ্গে সংশ্রব নেই। না এলেই বোধহয় ভাল করত । না । এখানে থাকা চলবে না । বালিশ ভিজে গেল চোখের জলে । যা জানার তা জানা হয়ে গেল । আর কিছুই জানার নেই । কাল ই চলে যাবে এখান থেকে।
প্রাতঃভ্রমণে বেড়িয়েছিল ডক্টর চৌধুরী । আট টায় ঘরে ফিরলেন। পরিচারিকা বলল।
– দাদা বাবু, বৌদিমনি কে কোথাও দেখতে পাচ্ছি না। অরিন্দম তাড়াতাড়ি ওপরের ঘরে গেল। দেখল কোন চিঠি পত্র আছে কিনা ? দেরাজ খুলে দেখল সব গয়না দেরাজেই রয়েছে । দেরাজের পাশে শণকার অ্যাটাচি টা রয়েছে । খুলে ফেলল অ্যাটাচিটা । কয়েক টা পোষাক ছাড়া আর কিছুই নেই। একটা ছোট্ট গয়নার বাক্স রয়েছে । খুলে ফেলল সেটা। তাতে একটা আংটি । ভেতরের আংটি দেখে একই সাথে হত বাক ও উত্তেজিত! এটা সেই হীরের আংটি । যেটা স্কুল ফাইনালের পর দিদা দিয়েছিল । সেটাই কালীঘাটে তিতির কে পড়িয়ে দিয়েছিল ওদের আউট হাউজে । উত্তেজিত অরিন্দম রিসিভার তুলে ডায়াল করল প্রভাসের নম্বরে । ও পাশে প্রভাসের গলা ।
– বলুন অরিন্দম দা । কি খবর?
– যে মেয়েটিকে পাঠিয়েছ তার ভাল নাম কি? শণকা কি ওর নাম?
– ভাল নাটক করে ও । নাটকের নাম শণকা । আসল নামটা হল তিতির । কেন কি হয়েছে ?
– প্রভাস তুমি ওর ঠিকানা বলো। আগে কি ওরা ডায়মন্ড হারবার এ থাকত?
– তাই তো বলেছিল । এখন দমদম বেদিয়া পাড়ায় থাকতো । অরিন্দম পাগলের মত চিৎকার করছে ।
– লিখে নিচ্ছি বল। কতো? সতেরো নম্বর আর এন ট্যাগোর রোড ?
– ডক্টর চৌধুরী ওর কিছু হয় নি তো ?
-আরে না না ।ও না বলেই চলে গেছে ! পরিচারিকা কে অরিন্দম বলল।
– দিদাকে বলিস আমি কাজে বেরুচ্ছি। আমরা দুজনেই বারো টা নাগাদ এসে পড়ব।
Khub bhalo laaglo