Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

সাতপুরা শৈলমালার জটিল আবর্তের মধ্যে এই সময় সাতটি ছোট ছোট রাজ্য ছিল। হয়তো সাতপুরা পর্বতের নাম এই সাতটি রাজ্য হইতে আসিয়াছে। অতি ক্ষুদ্র রাজ্যগুলি; কবে তাহাদের জন্ম হইয়াছিল এবং কবে তাহারা লুপ্ত হইয়া গিয়াছে ইতিহাস তাহা লক্ষ্য করে নাই। কিন্তু সুলতান আলাউদ্দিনের কালে তাহারা জীবিত ছিল এবং পরস্পরের সহিত কলহ না করিয়া পরম শান্তিতে বাস করিতেছিল। রাজ্যগুলির মাঝখানে পর্বতের ব্যবধান থাকায় লড়াই ঝগড়ার উপলক্ষ ছিল না।

একদিন ভাদ্রমাসের দ্বিপ্রহরে এক পথভ্রান্ত পথিক এই জটিলকুটিল গিরিসঙ্কটের মধ্যে ঘুরিয়া বেড়াইতেছিল। আকাশে মেঘ নাই। এখানে অল্পই বৃষ্টি হয়, যেটুকু হয় পাহাড় তাহা গায়ে মাখে না; বৃষ্টির জল সহস্র প্রণালীপথে নামিয়া উপত্যকাগুলিতে সঞ্চিত হয়। এই উপত্যকাগুলিতে মানুষের বাস।

পথিক এক গুহায় রাত্রি কাটাইয়া প্রভাতে লোকালয়ের সন্ধানে বাহির হইয়াছে, কিন্তু এখনও লোকালয় খুঁজিয়া পায় নাই। সে এ অঞ্চলের মানুষ নয়, দক্ষিণ দিক হইতে আসিয়াছে। দ্বিপ্রহরের প্রচণ্ড সূর্যতাপ চারিদিকের উলঙ্গ পর্বতে প্রতিফলিত হইয়া বহ্নিকলাপের মতো জ্বলিতেছে। কিন্তু সেদিকে পথিকের ভূক্ষেপ নাই।

পথিকের বয়স অনুমান বাইশ-তেইশ বছর। সুঠাম বেত্রবৎ দেহ, দেহের বর্ণও বেত্রবৎ। মুখের গঠন খঙ্গের ন্যায় শাণিত, কিন্তু মুখের ভাব শান্ত ও সহিষ্ণু। চোখের দৃষ্টি শ্যেনপক্ষীর ন্যায় সুদূরপ্রসারী, কিন্তু তাহাতে শ্যেনপক্ষীর হিংস্রতা নাই। মাথার চুল কাঁধ পর্যন্ত পড়িয়াছে; ঠোঁটের উপর অল্প গোঁফ। পরিধানে একখণ্ড বস্ত্র কটি হইতে জঙঘা পর্যন্ত আবৃত করিয়াছে, দ্বিতীয় একখণ্ড বস্ত্র উত্তরীয়ের আকারে স্কন্ধের উপর ন্যস্ত। হাতে ধনু এবং তিনটি বাণ।

পথিক দুইটি শৈলের মধ্যবর্তী লম্বা খাঁজের ভিতর দিয়া যাইতে যাইতে চারিদিকে দৃষ্টিপাত করিল; কোথাও জনবসতির চিহ্ন নাই, যেদিকে সে চলিয়াছে সেদিকে কোথাও নির্গমনের পথ আছে কি না তাহাও দেখা যায় না। সে তখন আকাশের দিকে চোখ তুলিল।

আকাশ শূন্য, কেবল বহু ঊর্ধ্বে বায়ু-কোণে এক জোড়া নিরালম্ব গুম্ফ উড়িতেছে। চিল কিংবা শকুন; পথিক অনুমান করিল, ঐদিকে চিল যেখানে উড়িতেছে তাহার নিম্নে লোকালয় থাকিতে পারে। সে অগ্রসর হইয়া চলিল।

ক্রোশেক পথ চলিবার পর হঠাৎ পাশের দিকে পাহাড়ের গায়ে একটি সংকীর্ণ ফাটল মিলিল। উপলবিকীর্ণ নিম্নাভিমুখী রন্ধ্র, এই পথে জল বাহির হইয়া নিম্নতর স্তরে গিয়াছে। দেখা যাক। পথিক রন্ধ্রমধ্যে প্রবেশ করিল।

আঁকাবাঁকা রন্ধ্রপথে কিছু দূর চলিবার পর এক ঝলক হরিদাভা পথিকের চোখের উপর দিয়া খেলিয়া গেল। তারপর সে রন্ধ্রমুখে আসিয়া দাঁড়াইল। সম্মুখে ঈষৎ নিম্নভূমিতে ক্ষুদ্র একটি উপত্যকা; তাহার মাঝখানে শুষ্পশয্যার উপর দর্পণের মতো জল সূর্যকিরণ প্রতিফলিত করিতেছে। এই তড়াগের চারিপাশে কয়েকটি তালবৃক্ষ শীর্ণ প্রহরীর ন্যায় দাঁড়াইয়া আছে; কিছু ঝোপঝাড়ও আছে। মানুষ দেখা যাইতেছে না বটে, কিন্তু অদূরে কয়েকটি ভগ্নপ্রায় শিলাকুটির দৃষ্টিগোচর হয়।

পথিক দ্রুত জলের কিনারায় গেল, নতজানু হইয়া গণ্ডূষ ভরিয়া জল পান করিল। জলপানে শরীর স্নিগ্ধ করিয়া সে উঠিয়া দাঁড়াইল। এবার কিছু খাদ্য সংগ্রহ করা প্রয়োজন, তাহার সঙ্গে যে সামান্য খাদ্য ছিল তাহা ফুরাইয়া গিয়াছে। কিন্তু গ্রামবাসীরা অতিথিবৎসল হইয়া থাকে, খাদ্য সংগ্রহ করা কঠিন হইবে না।

সে এদিক-ওদিক্‌ চাহিয়া পাড়ের উপর নিকটতম শৈলকুটিরের দিকে পা বাড়াইল। কুটিরের তালপাতার ছাউনি অদৃশ্য হইয়াছে, কেবল দেওয়ালগুলা দাঁড়াইয়া আছে। তবু ভিতরে নিশ্চয় মানুষ পাওয়া যাইবে।

দুই পা অগ্রসর হইয়া পথিক সহসা দাঁড়াইয়া পড়িল; দেখিল, একটি ঝোপের অভ্যন্তর হইতে জনৈক শীর্ণকায় ব্যক্তি হামাগুড়ি দিয়া বাহির হইতেছে। চোখাচোখি হইতেই লোকটি বলিয়া উঠিল—ওহে, তোমার কাছে খাদ্যদ্রব্য কিছু আছে?

পথিক নিকটে গেল, শীর্ণকায় লোকটি উঠিয়া দাঁড়াইল। পথিক দেখিল, লোকটির বয়স অনুমান পঞ্চাশ, বেশভূষা ভদ্র, পায়ে পাদুকা, মাথায় উষ্ণীষ। সে ঈষৎ হাসিয়া বলিল—আমার সঙ্গে তো খাদ্যদ্রব্য নেই, কেবল তীরধনুক আছে।

তীরধনুক তো খাওয়া যাবে না। হা হতোস্মি! এখন উপায়? বলিয়া শীর্ণ ব্যক্তি বুক চাপড়াইল। তাহার ভাবভঙ্গি ও বাচনশৈলীতে হতাশার সহিত ঈষৎ হাস্যরস মিশ্রিত আছে।

ধনুর্ধর যুবক একটু কৌতুক অনুভব করিয়া বলিল—আপনি কে?

প্রৌঢ় ব্যক্তি বলিলেন—আমার নাম ভট্ট নাগেশ্বর, আমি পঞ্চমপুরের রাজা শ্রীমৎ ভূপ সিংহের বয়স্য। রাজা আমাকে গোপনীয় দূতকার্যে সপ্তমপুরে পাঠিয়েছিলেন, একাই গিয়েছিলাম। সপ্তমপুরে কাজ সেরে ফেরার পথে এখানে দুপুর হয়ে গেল; ভাবলাম, মধ্যাহ্নভোজনটা এখানে সেরে নিয়ে ঝোপঝাড়ের ছায়ায় একটু বিশ্রাম করে বেলা তৃতীয় প্রহরে আবার যাত্রা করব; তাহলে সন্ধ্যার আগেই গৃহে ফিরতে পারব। জলের ধারে গিয়ে খাবারের পুঁটুলি খুলে বসেছি, মাত্র এক গ্রাস মুখে দিয়েছি, এমন সময় হা হতোস্মি! কোথাকার এক ফ্লেচ্ছপুত্র চিল ছোঁ মেরে খাবারের পুঁটুলি নিয়ে উড়ে গেল। সেই থেকে ঝোপের ছায়ায় বসে আছি, ক্ষুধায় পেট জ্বলে যাচ্ছে।

যুবক বলিল—কিন্তু গ্রামে লোক আছে, তাদের কাছে খাদ্য সংগ্রহ করা কি সম্ভব নয়?

ভট্ট নাগেশ্বর চক্ষু কপালে তুলিয়া বলিলেন—গ্রাম! গ্রাম কোথায়? হা হতোস্মি, বহু বৎসর আগে গ্রাম ছিল বটে, কিন্তু ম্লেচ্ছপুত্র আলাউদ্দিন সব শেষ করে দিয়ে গিয়েছে। এখানে আর মানুষের বাস নেই।

আলাউদ্দিনের নাম শুনিয়া যুবক একটু চকিত হইল। নামটা তাহার অপরিচিত নয়। সে বলিল—ম্লেচ্ছপুত্র আলাউদ্দিন!

নাগেশ্বর বলিলেন—নাম শোনোনি? দিল্লীর ম্লেচ্ছ রাজা। সতেরো বছর আগে সে এই পথে দাক্ষিণাত্যে অভিযান করেছিল, তার সেনাবাহিনীর পথে যেসব নগর জনপদ পড়েছিল সব শূন্য হয়ে গিয়েছে। পঞ্চমপুরেও এই মহাপিশুন পদার্পণ করেছিল। কিন্তু যাক, শূন্য উদরে স্লেচ্ছ-প্রসঙ্গ ভাল লাগে না। এস, ঝোপের ছায়ায় বসা যাক।

যুবক বলিল—কিন্তু খাদ্যদ্রব্যের কী হবে?

নাগেশ্বর বলিলেন—কি আর হবে। আপাতত পেটে মুষ্ট্যাঘাত করে ক্ষুধা নিবারণ করা ছাড়া গতি নেই। এখন তোমার পরিচয় দাও। কে তুমি, কোথায় যাচ্ছ?

প্রশ্নের উত্তর না দিয়া যুবক ঊর্ধ্বে দৃষ্টিনিক্ষেপ করিল। একটি তালগাছের শীর্ষে কিছুক্ষণ চক্ষু নিবদ্ধ রাখিয়া বলিল—তাল পেকেছে মনে হচ্ছে।

নাগেশ্বর বলিলেন—তা পেকেছে, আমি দেখেছি। কিন্তু তাল পাকলে আমার কী? আমি তালগাছে চড়তে জানি না, তালগাছও আমার প্রতি কৃপাপরবশ হয়ে ফল বিসর্জন দেবে না। আমি সবগুলা তালগাছের গোড়া খুঁজে দেখেছি, একটিও তাল নেই।

যুবক তালগাছের নিকটে গিয়া পর্যবেক্ষণ করিতে করিতে বলিল—তালগাছের ডগা ষাট হাতের বেশি হবে না। তাল পাড়া যেতে পারে।

নাগেশ্বর উত্তেজিত হইয়া উঠিলেন—পাড়া যেতে পারে! বল কি! তুমি তালগাছে উঠতে পারো নাকি?

যুবক বলিল—না, তীরধনুক দিয়ে তাল পাড়ব।

যুবক একটি তীর বাছিয়া লইয়া বাকি দুইটি তীর মাটিতে রাখিল, ধনুকে শরযোজনা করিয়া সাবধানে লক্ষ্য স্থির করিল, আকর্ণ ধনুগুণ টানিয়া উৰ্ব্বদিকে তীর ছাড়িয়া দিল। টঙ্কার শব্দে তীর ছুটিয়া গেল, মুহূর্তমধ্যে তীরবিদ্ধ পাকা তাল ধপ করিয়া মাটিতে পড়িল।

নাগেশ্বর ছুটিয়া গিয়া বৃহৎ তালটিকে কোলে তুলিয়া লইলেন, উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলিলেন—চমৎকার! তুমি দেখছি অর্জুনের চেয়ে বড় ধনুর্ধর। অর্জুন মৎস্যচক্ষু বিদ্ধ করে পেয়েছিলেন এক নারী, আর তুমি আকাশ থেকে আহরণ করে এনেছ সুপক্ক তালফল। ক্ষুধার সময় নারীর চেয়ে তালফল অনেক বেশি মুখরোচক। —এস এস, আর দেরি নয়, বসে যাওয়া যাক।

দুইজনে এক গুল্মের ছায়াতলে গিয়া বসিলেন। তাল হইতে শর বাহির করিয়া তালটি ভাগাভাগি করা হইল। উভয়ে আহার আরম্ভ করিলেন।

পেট কথঞ্চিৎ ঠাণ্ডা হইলে নাগেশ্বর বলিলেন—তোমার পরিচয় তো বললে না!

যুবক বলিল—আমার নাম ময়ূর।

ময়ূর! ময়ূর সিংহ, না ময়ূর বর্মা, না ময়ূর ভট্ট?

শুধু ময়ূর।

তা ভাল। ময়ূর যখন, তখন নামের পিছনে পুচ্ছের কী প্রয়োজন। তোমার দেশ কোথায়?

তাপ্তি নদীর দক্ষিণে।

কোথায় চলেছ?

শুনেছিলাম ওদিকে সাতটি রাজ্য আছে। তাই এসেছিলাম যদি কাজ পাই।

ভাল ভাল। বৎস ময়ূর, তুমি ঠিকই শুনেছ, এই পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে সাতটি রাজ্য আছে; প্রথমপুর থেকে আরম্ভ করে সপ্তমপুর পর্যন্ত। কিন্তু এই গোলকধাঁধার মধ্যে তুমি খুঁজে পাবে না। খোঁজাখুঁজির প্রয়োজনও নেই। তুমি আমার সঙ্গে চল, কাজ পাবে! তুমি যেরকম অব্যর্থ তীরন্দাজ, মহারাজ নিশ্চয়ই তোমাকে অনুগ্রহ করবেন।

ময়ূর শান্তস্বরে বলিল—ভাল।

তালফল যখন শেষ হইল তখন দেখা গেল দুইটি ক্ষুধিত মানুষের পেট ভরিয়াছে। তাঁহারা জলাশয়ে গিয়া হাত-মুখ ধুইলেন। ইতিমধ্যে সূর্য অনেকখানি পশ্চিমে ঢলিয়াছে, রৌদ্রের তেজ কমিয়াছে। ভট্ট নাগেশ্বর ময়ূরকে লইয়া পঞ্চমপুরের অভিমুখে যাত্রা করিলেন। তিনি গোলকধাঁধার পথ চেনেন, কুটিল গিরি-বয়ঁ ধরিয়া পথ দেখাইয়া চলিলেন।

ভট্ট নাগেশ্বর অতি সহৃদয় ব্যক্তি; কিন্তু তিনি জাতিতে ব্রাহ্মণ, উপরন্তু রাজবয়স্য; তাই বাক্‌-বাহুল্যের দিকে তাঁহার স্বাভাবিক প্রবণতা ছিল। সুবিধা পাইলেই তিনি কথা বলিতে আরম্ভ করিয়া দিতেন, একটি শ্রোতা থাকিলেই হইল।

চলিতে চলিতে তিনি হা হতোস্মি করিয়া আরম্ভ করিলেন—সপ্তপুরের আর বেশিদিন নয়। রক্তপিপাসু ম্লেচ্ছ জাতি দাক্ষিণাত্যের স্বাদ পেয়েছে, তারা আবার এই পথে আসবে। তখন সপ্তপুর ধুলো হয়ে উড়ে যাবে। এতদিন তারা আসেনি কেন এই আশ্চর্য। প্রথমবার ম্লেচ্ছ এসেছিল ঘূর্ণিবাত্যার মতো; এবার আসবে মহাপ্লাবনের মতো, সব ভাসিয়ে নিয়ে যাবে।

ময়ূর জিজ্ঞাসা করিল–প্রথমবার কী হয়েছিল?

ভট্ট নাগেশ্বর তখন মহা উৎসাহে গল্প বলিতে লাগিলেন—

সপ্তদশ বৎসর আগে নর্মদা ও তাপ্তি নদীর মধ্যবর্তী এই ভূখণ্ডে পরিপূর্ণ শান্তি বিরাজ করিতেছিল। সাতটি রাজ্যের সাত রাজা পরম সুখে প্রজাদের শাসন-পালন করেন, তাঁহাদের পরস্পরের মধ্যে বিবাদ-বিসম্বাদ নাই, বরং কুটুম্বিতা আছে। বহির্জগতের সহিত সম্পর্ক নামমাত্র; জিগীষু রাজারা এই শুষ্ক দেশের দিকে লুব্ধ কটাক্ষপাত করেন না। সাতটি রাজ্যের নামকরণেও অভিমানের চিহ্ন নাই; প্রথমপুর, দ্বিতীয়পুর ইত্যাদি নামেই তাঁহারা সন্তুষ্ট। যেন সাতটি কপোত-মিথুন পর্বতের খোপেখোপে সাতটি নিভৃত নীড় রচনা করিয়াছে।

হঠাৎ একদিন ঈশান কোণে মেঘ দেখা দিল। ম্লেচ্ছ সেনাপতি আলাউদ্দিন দক্ষিণবিজয়ে যাত্রা করিলেন। সঙ্গে বহু সহস্র অশ্বারোহী সৈন্য। আলাউদ্দিন সসৈন্যে বিন্ধ্যগিরি উত্তীর্ণ হইলেন, নর্মদার উত্তাল তরঙ্গমালা তাঁহার গতিরোধ করিতে পারিল না। তিনি দাক্ষিণাত্যের দ্বারমুখে উপস্থিত হইলেন।

আলাউদ্দিনের যাত্রাপথ পূর্ব হইতে নির্ণীত ছিল; তিনি পঞ্চমপুরের উপত্যকায় প্রবেশ করিয়া শিবির ফেলিলেন। এখানে কিছুদিন সৈন্যদলকে বিশ্রাম দিয়া আবার অগ্রসর হইলেন।

পঞ্চমপুর আলাউদ্দিনের যাত্রাপথে পড়িয়াছিল, ইহা পঞ্চমপুরের দুভাগ্য। অন্য ছয়টি রাজ্য বাঁচিয়া গিয়াছিল। আলাউদ্দিনকে প্রতিরোধ করিবার শক্তি পঞ্চমপুরের রাজা ভূপ সিংহের ছিল না; এমনকি সাত জন রাজা একজোট হইলেও আলাউদ্দিনের কোনও ক্ষতি করিতে পারিতেন। তাই ভূপ সিংহ নতমস্তকে আলাউদ্দিনের দুরভিযান সহ্য করিলেন।

পঞ্চমপুর রাজ্য একটি বিস্তীর্ণ উপত্যকায় অবস্থিত; উপত্যকার মাঝখান দিয়া ক্ষুদ্র নদী বহিয়া গিয়াছে। ক্ষুদ্র রাজ্যের ক্ষুদ্র রাজধানী, ক্ষুদ্র রাজপুরী, আশেপাশে গ্রাম জনপদ শস্যক্ষেত্র। আলাউদ্দিন পঞ্চমপুর জয় করিতে আসেন নাই, ইহা তাঁহার পথি-পার্শ্বস্থ পান্থশালা মাত্র। ভূপ সিংহ নিরুপায়ভাবে দিন গণিতে লাগিলেন, কতদিনে আপদ দূর হইবে।

ম্লেচ্ছ সৈন্যদল অবাধে গৃহলুণ্ঠন করিল, নারীধর্ষণ করিল, অকথ্য অত্যাচার করিতে লাগিল। এদেশের লোক পূর্বে কোনও ম্লেচ্ছ দেখে নাই, তাহারা হতবুদ্ধি হইয়া চাহিয়া রহিল। মানুষ যে এমন হইতে পারে তাহা তাহাদের ধারণার অতীত।

তারপর একদিন আলাউদ্দিনের শিবিরে ভূপ সিংহের তলব হইল। না যাইলে গলায় দড়ি দিয়া টানিয়া লইয়া যাইবে; ভূপ সিংহ স্নেচ্ছের দরবারে গেলেন। আলাউদ্দিন বলিলেন, তিনি জানিতে পারিয়াছেন রাজার একটি সুন্দরী কন্যা আছে, সেই কন্যাকে সেনাপতির কাছে সওগাত পাঠাইতে হইবে।

বক্ষে তুষানল জ্বালিয়া রাজা ফিরিয়া আসিলেন। রাজ্যের মন্ত্রী ছিলেন প্রবীণ ও বিচক্ষণ ব্যক্তি, তাঁহার সহিত পরামর্শ করিয়া রাজা এক চাতুরী অবলম্বন করিলেন; রাজপুরীতে সীমন্তিনী নামে এক নবযৌবনা রূপসী দাসী ছিল, তাহাকে রাজকন্যা সাজাইয়া দোলায় তুলিয়া শিবিরে পাঠাইয়া দিলেন। আসল রাজকন্যাকে পুরীর এক অন্ধকার প্রকোষ্ঠে লুকাইয়া রাখা হইল।

কিন্তু আলাউদ্দিনের চক্ষে ধূলি নিক্ষেপ করা সহজ নয়। সপ্তাহকাল পরে তিনি দাসী সীমন্তিনীকে ফেরত দিলেন এবং রাজপুরী তল্লাস করিয়া রাজকন্যাকে ধরিয়া লইয়া গেলেন। রাজকন্যার নাম ছিল শিলাবতী।

অতঃপর যবন সৈন্য বিশ্রাম শেষ করিয়া দক্ষিণ দিকে চলিয়া গেল। শিলাবতীকে আলাউদ্দিন সঙ্গে লইয়া গেলেন। তিনি আর এ পথে আসেন নাই, অন্য পথে প্রত্যাবর্তন করিয়াছিলেন; পিতৃব্যকে হত্যা করিয়া সুলতান হইয়াছিলেন। শিলাবতীর কি হইল কেহ জানে না। হয়তো তিনি বিষপান করিয়াছিলেন, হয়তো বা দিল্লীর হারেমে আলাউদ্দিনের অসংখ্য উপপত্নীর অন্তর্ভুক্ত হইয়া এখনও বাঁচিয়া আছেন।

সে-সময় ভূপ সিংহের পরিবারে ছিলেন তাঁহার রানী ঊষাবতী, যোড়শী কন্যা শিলাবতী, দ্বাদশ বর্ষীয় বালকপুত্র রামরুদ্র এবং সদ্যোজাত কন্যা সোমশুক্লা। আলাউদ্দিন যখন শিলাবতীকে হরণ করিয়া লইয়া যান তখন রানী ঊষাবতী সূতিকাগৃহে ছিলেন। তিনি এই দারুণ আঘাত সহ্য করিতে পারিলেন না, প্রসূতিগৃহেই তাঁহার মৃত্যু হইল। দাসী সীমন্তিনী শিশু সোমশুক্লাকে নিজের বুকে তুলিয়া লইল।

সীমন্তিনীর গর্ভাধান হইয়াছিল; যথাকালে সে একটি কন্যা প্রসব করিল। সে নুন খাওয়াইয়া কন্যাকে মারিতে উদ্যত হইয়াছিল, কিন্তু ভূপ সিংহ নিষেধ করিলেন—না, আলাউদ্দিনের কন্যাকে বাঁচিয়ে রাখো, হয়তো পরে প্রয়োজন হবে।

আলাউদ্দিনের কন্যা বাঁচিয়া রহিল, মাতার বিষদৃষ্টির সম্মুখে বাড়িয়া উঠিতে লাগিল। তার নাম হইল—চঞ্চরী।

ভূপ সিংহের বুকে যে শেল বিধিয়াছিল তাহা বিঁধিয়া রহিল। তিনি উদার ও মহৎ চরিত্রের পুরুষ ছিলেন, এখন তাঁহার চরিত্র সম্পূর্ণ বিপরীত মূর্তি ধারণ করিল। অপমান ও লাঞ্ছনায় জর্জরিত হৃদয়ে তিনি কেবল প্রতিহিংসা সাধনের জন্য জীবিত রহিলেন। কিন্তু দিল্লীর সুলতানের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসা সাধন সামান্য ভূস্বামীর পক্ষে সহজ নয়। দিন কাটিতে লাগিল।

আট বৎসর পরে ভূপ সিংহ পুত্রকে ডাকিয়া বলিলেন—রামরুদ্র, তোমার বয়স বিশ বৎসর পূর্ণ হয়েছে। কলঙ্কমোচনের সময় উপস্থিত।

রামরুদ্র বলিলেন—আমি প্রস্তুত আছি।

ভূপ সিংহ পুত্রের হস্তে ছুরিকা দিয়া বলিলেন—দিল্লী যাও, এই ছুরি দিয়ে নর-পিশাচকে গুপ্তহত্যা কর।

পরদিন রামরুদ্র পাঁচজন সঙ্গী লইয়া দিল্লী যাত্রা করিলেন। দীর্ঘ পথ; ভূপ সিংহের দীর্ঘ প্রতীক্ষ্ণ আরম্ভ হইল।

এক বৎসর পরে দুইজন সঙ্গী ফিরিয়া আসিল। জল্লাদের হাতে রামরুদ্রের মৃত্যু হইয়াছে। একদিন আলাউদ্দিন রক্ষীপরিবৃত হইয়া অশ্বারোহণে দিল্লীর রাজপথ দিয়া যাইতেছিলেন, রামরুদ্র ছুরিকা-হস্তে তাঁহার দিকে ধাবিত হন; কিন্তু আলাউদ্দিনের কাছে পৌঁছিবার পূর্বেই ধরা পড়েন। তাঁহার আক্রমণ ব্যর্থ হয়।–

এইবার ভূপ সিংহের চরিত্রে এক বিচিত্র পরিবর্তন দেখা দিল। পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়সে একমাত্র পুত্রকে হারাইয়া তিনি শোক করিলেন না। তাঁহার প্রকৃতি যেন দ্বিধাভিন্ন হইয়া গেল; একদিকে শুষ্ক কঠিন কুটিলতা, অন্য দিকে নির্বিকার ঔদাসীন্য। রানী ঊষাবতীর মৃত্যুর পর তিনি দারান্তর গ্রহণ করেন নাই, এখনও করিলেন না; কিন্তু কন্যা সোমশুক্লাকে তিনি জন্মাবধি অবহেলা করিয়াছিলেন, এখন তাহার প্রতি নির্লিপ্তভাবে ঈষৎ স্নেহশীল হইলেন। সপ্তপুরীর বাকি ছয়জন রাজার সহিত তাঁহার সম্পর্ক প্রায় ছিন্ন হইয়াছিল, এখন তিনি দূত পাঠাইয়া পূর্বর্তন প্রীতির সম্বন্ধ পুনঃস্থাপন করিলেন। মন্ত্রীর সহিত বসিয়া কখনও মন্ত্রণা করেন, কখনও বা বয়স্যদের সঙ্গে চতুরঙ্গ খেলেন। সপ্তমপুরের অধিপতি সূর্যবমা ভূপ সিংহের সমবয়স্ক মিত্র, তাঁহার সহিত দূর হইতে চতুরঙ্গের চাল চালেন। কখনও তিনি গম্ভীর কুটিল সন্দিগ্ধ, কখনও দায়িত্বহীন ক্রীড়াচটুল প্রগভ। সকলে তাঁহার কাছে সশঙ্ক হইয়া থাকে, কখন তাঁহার কোন্ রূপ প্রকাশ পাইবে কেহই বলিতে পারে না।

এইভাবে আরও নয় বৎসর কাটিয়াছে। কুমারী সোমশুক্লা এখন সপ্তদশী যুবতী। প্রথমপুরের যুবরাজ হিরণ্যবর্মার সঙ্গে তাঁহার বিবাহের একটা প্রসঙ্গ উঠিয়াছে; কিন্তু কোনও পক্ষেই ত্বরা নাই। হিরণ্যবর্মার দুইটি পত্নী বর্তমান, তাঁহারা পুরাতন না হওয়া পর্যন্ত যুবরাজ নূতন বিবাহ সম্বন্ধে নিরুৎসুক।

সীমন্তিনীর কন্যা চঞ্চরী এখন ষোড়শী। তাহার বুদ্ধি বেশি নাই, কিন্তু রূপের ছটায় চোখে ধাঁধা লাগে। সে রাজপুরীতে কুমারী সোমশুক্লার কিঙ্করীর কাজ করে। তাহার মা তাহার পানে মুখ ফিরাইয়া চাহে না, কিন্তু ভূপ সিংহ আলাউদ্দিনের কন্যার প্রতি বিদ্বেষভাবাপন্ন নয়। কেবল, কদাচিৎ যখন চঞ্চরীর উপর রাজার দৃষ্টি পড়ে তখন তাঁহার চোখে একটা ক্রুর অভিসন্ধি খেলা করিয়া যায়। তিনি যেন প্রতীক্ষ্ণ করিয়া আছেন; কিন্তু কিসের প্রতীক্ষ্ণ তাহা কেহ জানে না।–

ভট্ট নাগেশ্বরের মুখে রাজকাহিনী শুনিতে শুনিতে ময়ূর যেন আচ্ছন্নের মতো হইয়া পড়িয়াছিল, মনে হইয়াছিল সেও এই কাহিনীর সহিত নিবিড়ভাবে জড়িত। সুলতান আলাউদ্দিনের নামটাই সে জানিত, এখন একটা বিকৃত মনুষ্যমূর্তি চোখের সামনে দেখিতে পাইল। রাজা ভূপ সিংহের নিদারুণ ভাগ্যবিপর্যয় তাহার অন্তরে অঙ্গারের মতো জ্বলিতে লাগিল। কিন্তু তাহার প্রকৃতি স্বভাবতই অন্তর্মুখী, বাহিরে তাহার মনের উষ্ম প্রকাশ পাইল না।

কাহিনী শেষ করিয়া ভট্ট নাগেশ্বরও নীরবে চলিলেন। আর কোনও কথা হইল না। সূর্যাস্তের সময় তাঁহারা রাজধানীতে উপনীত হইলেন। নাগেশ্বর বলিলেন—আজ আর রাজার। সঙ্গে দেখা হবে না। তুমি চল, রাত্রে আমার গৃহে থাকবে। কাল প্রাতঃকালে তোমাকে রাজার কাছে নিয়ে যাব।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress