ধড়মড়িয়ে উঠে বসলাম
পরদিন সকালে ফেলুদা আমার কাঁধ ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে আমাকে ঘুম থেকে তুলল। আমি ধড়মড়িয়ে উঠে বসলাম।
কী ব্যাপার ফেলুদা?
ফেলুদার মুখ গম্ভীর।
জয়ন্তবাবু ফোন করেছিলেন। এক্ষুনি। শকুন্তলা দেবীর কণ্ঠহার মিসিং।
সর্বনাশ!
তুই চট করে তৈরি হয়ে নে; আমি লালমোহনবাবুকে খবরটা দিয়ে আসছি। আমাদের ব্রেকফাস্ট খেয়েই যেতে হবে ওখানে। শুধু মিঃ সুকিয়াস ছাড়া আর সকলেই এসেছে ওখানে। খবরটা পেয়ে।
পুলিশে খবর দেয়নি?
দিয়েছে, কিন্তু আমাকেও চায়।
আমরা সাড়ে আটটার মধ্যে জয়ন্তবাবুর বাড়ি পৌঁছে গেলাম। বাড়ির সবাই কেমন যেন পাথরের মতো চুপ। ফেলুদা ক্ষমা চাইল। কাল আমাদের দেখানোর জন্যই হারটা বার করা হয়েছিল। তার সঙ্গে এ চুরির কোনও সম্পর্ক আছে কি না জানি না, কিন্তু আমি নিজে খানিকটা অসোয়াস্তি বোধ করছি বলে কথাটা বললাম।
পুলিশের লোক আগেই এসে গিয়েছিল। তাদের মধ্যে যিনি কত তিনি ফেলুদার দিকে এগিয়ে হাত বাড়িয়ে বললেন, আমি ইনস্পেক্টর পাণ্ডে। আপনি তো বোধহয় প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর মিঃ মিটার?
আজ্ঞে হ্যাঁ, বলল ফেলুদা।
আই অ্যাম ফ্যামিলিয়ার উইথ ইয়োর নেম, বললেন পাণ্ডে। আপনার কয়েকটা সাক্সেসফুল ইনভেস্টিগেশনের কথা আমার মনে আছে। তা আপনি তো বোধহয় জেরা করতে চান।
আগে আপনার কাজ শেষ হয়ে যাক, বলল ফেলুদা। তারপর আমার।
থ্যাঙ্ক ইউ স্যার।
প্রশ্ন করে জানা গেল যে কাল রাত্রে সবাই চলে যাবার পর বারোটা নাগাদ জয়ন্তবাবুর স্ত্রী তাঁর বেডরুমে গিয়ে শুতে যাবার আগে কেন জানি আরেকবার হারটা দেখার ইচ্ছা অনুভব করেন। হয়তো কপালকুণ্ডলা ছবিতে শকুন্তলা দেবীকে হার পরা অবস্থায় দেখেই সে ইচ্ছেটা জাগে। ভদ্রমহিলা নিজেই বললেন, এটা একটা ভ্যানিটির ব্যাপার। আমার মা-র গলায় হারটা এত সুন্দর মানাত; সেটা দেখেই আমার মনে একটা ইচ্ছে হল হারটা একবার পরে আয়নায় নিজের চেহারাটা দেখি। মেয়েরা শুতে যাবার আগে বেশ খানিকটা সময় ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে কাটায়। সেই সময়ই দেরাজ থেকে চাবিটা বার করে সিন্দুক খুলে দেখি হারটা নেই। আমি তৎক্ষণাৎ আমার মেয়েকে ডাকি। মেয়ে জোর দিয়ে বলে যে সে সিন্দুকেই রেখে ছিল হারটা। সেখানে ছাড়া আর কোথায়ই বা রাখবে? সিন্দুকেই তো চিরকাল থেকেছে হারটা।
আপনারা ভাল করে খুঁজে দেখেছেন হারটা? পাণ্ডে জিজ্ঞেস করল।
কোথায় আর খুঁজব বলুন, বললেন সুনীলা দেবী, ওটা যে কেউ সিন্দুক থেকে বার করে নিয়েছে তাতে তো কোনও সন্দেহ নেই।
আপনাদের বাড়িতে কাল পার্টি ছিল, তাই না? পাণ্ডে প্রশ্ন করলেন।
হ্যাঁ, বললেন জয়ন্তবাবু।
কটা থেকে কটা পর্যন্ত?
আটটা থেকে পৌনে বারোটা।
মিসেস বিশ্বাস, আপনি কি পার্টির পরেই আপনার ঘরে চলে যান?
হ্যাঁ।
আর তার কতক্ষণ পরে আবিষ্কার করেন যে হারটা নেই?
মিনিট পনেরো।
এর মধ্যে আপনি ঘর ছেড়ে কোথাও বেরোননি?
না।
অর্থাৎ হারটা চুরি হয়েছে ডিউরিং দ্য পার্টি?
তাই তো মনে হয়, বললেন জয়ন্তবাবু। এখানে একটা কথা বলি—পাটির মধ্যে হারটাকে আমার মেয়ে একবার সিন্দুক থেকে এই ঘরে আনে—মিঃ মিত্ৰকে দেখানোর জন্য।
তার পরেই—তখনই কি আপনার মেয়ে হারটাকে আবার সিন্দুকে তুলে দেয়?
হ্যাঁ, বলল মেরি শীলা। আমি এক মুহূর্ত দেরি করিনি।
এখানে একটা জরুরি কথা বলা দরকার, বললেন জয়ন্তবাবু। হারটা তুলে রাখার কিছু পরেই এ ঘরে একটা দশ মিনিটের ফিল্ম দেখানো হয়।
তার জন্য তখন বাতি নেবানো হয়েছিল?
হ্যাঁ।
এ বাড়িতে চাকর কজন?
তিনজন। একজন রান্না করে। আর দুজন বেয়ারা।
কতদিনের লোক এরা?
কেউই পনেরো বছরের কম না। এরা অত্যন্ত বিশ্বাসী। সুলেমান তো আমার শ্বশুরের আমল থেকে আছে।
তা হলে একটাই সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যাচ্ছে, বললেন পাণ্ডে। জিনিসটা শুনতে খারাপ লাগবে, কিন্তু আমাকে বলতেই হবে। এই বাড়ির লোক সমেত এই পার্টিতে যাঁরা ছিলেন, তাঁদেরই একজন হারটা নিয়েছেন।
আমারও সেই কথাই মনে হচ্ছিল, আর আমার মনে হয় ফেলুদা আর লালমোহনবাবুরও তাই।
পাণ্ডে এবার ফেলুদার দিকে ফিরলেন।
মিঃ মিটার, আপনার সঙ্গে যে দুজন এসেছেন, তাঁদের পরিচয় পেতে পারি কি?
নিশ্চয়ই, বলল ফেলুদা। ইনি আমার কাজিন তপেশ মিত্র, আর ইনি আমার বন্ধু—বিখ্যাত লেখক লালমোহন গাঙ্গুলী।
এই লেখকটিকে আপনি কতদিন হল চেনেন?
বছর পাঁচ-ছয়।
আমি লালমোহনবাবুর দিকে দেখছিলাম। ভদ্রলোক ফ্যাকাশে হয়ে গেছেন। আমি ওঁকে কণ্ঠহার চোর হিসেবে কল্পনা করলাম। এই সংকটের অবস্থাতেও আমার হাসি পেয়ে গেল।
এরার পাণ্ডে অন্য প্রশ্নে গেলেন।
এখানে যাঁরা রয়েছেন তাঁদের মধ্যে কজন এ বাড়িতে থাকেন?
জয়ন্তবাবু বললেন, আমি, আমার স্ত্রী, আমার দুই ছেলেমেয়ে এবং আর্টিস্ট মিঃ সোম।
মিঃ সোম আজও দাড়ি কামাননি। তাই তাঁকে আরও অপরিচ্ছন্ন দেখাচ্ছে।
আর সকলেই বাইরের লোক? পাণ্ডে প্রশ্ন করলেন।
হ্যাঁ।
মিঃ সালডানহা থাকেন ক্লাইভ রোডে। উনি আমার ব্রাদার-ইন-ল। ওঁর স্ত্রী আমার স্ত্রীর বড় বোন।
আরেকজনকে দেখছি, রতনলালের দিকে দৃষ্টি দিয়ে বললেন মিঃ পাণ্ডে।
উনি রতনলাল ব্যানার্জি-আমার স্ত্রীর ছোট ভাই।
এ ছাড়া আর কেউ ছিল?
একজন ছিলেন। লাটুশ রোডের মিঃ সুকিয়াস। উনি অবশ্য নিমন্ত্রিতদের মধ্যে ছিলেন না, এমনিই এসে পড়েন। তিনি এসেছিলেন যখন ফিল্মটা দেখানো হচ্ছে তার মাঝখানে। আলো জ্বালার পরে আমি তাঁকে দেখি।
এই সুকিয়াসের প্রেফেশন কী?
হি ইজ এ কালেক্টর অফ আর্ট অবজেক্টস। তা ছাড়া তেজারতির কারবার আছে।
ইনি কি এই হারটা সম্বন্ধে কোনওদিন ইন্টারেস্ট দেখিয়েছিলেন?
উনি ওটা কিনতে চেয়েছিলেন। আমরা বিক্রি করিনি।
আই সি
ইনস্পেক্টর পাণ্ডে একটুক্ষণ গম্ভীর থেকে বললেন, এটা তো বোঝাই যাচ্ছে যে কাল এখানে যাঁরা ছিলেন তাঁদেরই মধ্যে একজন হারটা নিয়েছেন। এখন কথা হচ্ছে, সেই হারটা কোথায়।
জয়ন্তবাবু গলা খাঁকরে নিয়ে বললেন, আপনি যদি সার্চ করতে চান তা হলে করতে পারেন। এমনকী ব্যক্তিগত খানাতল্লাশিতেও আপনার সম্পূর্ণ স্বাধীনতা আছে।
পাণ্ডে বললেন, তা তো করতেই হবে। সার্চ থেকে মহিলারাও বাদ পড়বেন না। এবং তার জন্য আমি মেয়ে পুলিশের বন্দোবস্ত করছি। তা ছাড়া বাড়িটাও ভাল করে সার্চ করা দরকার।
সার্চের ব্যাপারে দেখলাম। কেউই আপত্তি করলেন না। খালি সালডানহা বললেন, আমার দোকান খুলতে হবে দশটার সময়। তার মধ্যে আমার সার্চটা হয়ে গেলে ভাল।
ফেলুদা এতক্ষণ চুপ করে সব শুনছিল। এবার বলল, এখানে সার্চ চলুক! আমি তা হলে এখন আসি। যদি হারটা পাওয়া যায় তা হলে আশা করি জয়ন্তবাবু আমাকে ফোন করে জানিয়ে দেবেন। না হলে আমি ও বেলা আবার আসব।
আমরা তিনজনে হোটেলে ফিরে এলাম। লালমোহনবাবুও আমাদের সঙ্গে আমাদের ঘরেই এলেন। ভদ্রলোক ঢুকেই বললেন, এ নিয়ে কবীর হল বলুন তো, যে আমরা বেড়াতে গিয়ে কেসে জড়িয়ে পড়েছি? এ জিনিস টেলিপ্যাথি ছাড়া হয় না।
ফেলুদা বলল, দেখি আপনার স্মরণশক্তি কতদূর। তোপ্সেকে তো এর আগে অনেকবার পরীক্ষা করেছি, আপনাকে কখনও করা হয়নি।
ভেরি ওয়েল স্যার, আই অ্যাম রেডি, বললেন জটায়ু।
আগে শকুন্তলা দেবীর ফ্যামিলি সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করি।
করুন।
ভদ্রমহিলার তিন সন্তানের নাম বলুন তো।
বড় মেয়ে সুশীলা–
তার আগে একটা ক্রিশ্চান নাম আছে।
ও হ্যাঁ-ক্রিশ্চান নাম…ক্রিশ্চান নাম…
তোপ্সে বলতে পারিস?
আমার মনে ছিল। বললাম, মার্গারেট।
ভেরি গুড। তার পরের মেয়ে, অৰ্থাৎ জয়ন্তবাবুর স্ত্রী? এই প্রশ্নটা কিন্তু লালমোহনবাবুকে করছি।
লালমোহনবাবু এটা ভোলেননি। বললেন, প্যামেলা সুনীলা।
গুড। তাঁর পরের ভাই?
ইয়ে–রতনলাল। অ্যালবার্ট রতনলাল।
এবার সুশীলা দেবীর স্বামীর নাম?
স্যামুয়েল সালডানহা।
ভেরি গুড! সুনীলা দেবীর ছেলেমেয়ে?
মেয়ে শীলা-মেরি শীলা। আর ছেলে প্রসেনজিৎ। ক্ৰিশ্চন নাম ভুলে গেছি।
ভিক্টর। আর কে ছিলেন কাল পার্টিতে?
সেই আটিস্ট ভদ্রলোক। নামটা মনে পড়ছে না।
তোপ্সে?
সোম। সুদৰ্শন সোম।
গুড।
কিছু মাইন্ড করবেন না মশাই, লালমোহনবাবু বললেন, ভদ্রলোককে কিন্তু আমার ভাল লাগল না।
কেন?
কীরকম পাগলাটে চেহারা। দাড়ি কামাননি।
আর্টিস্টরা সব সময় সমাজের নিয়মকানুন মেনে চলে না।
তা হতে পারে। মোট কথা, উনি আর আরেকজন আমার কাছে এই চুরির ব্যাপারে প্ৰাইম সাসপেক্টস।
আরেকজন কে?
জয়ন্তবাবুর ছেলে প্ৰসেনজিৎ? একেবারে কলকাতার পার্ক স্ট্রিটের বাউণ্ডুলেদের মতো চেহারা। অবশ্য মদ তো দেখলাম খায় না ছেলেটি।
খেলেও হয়তো বাপের সামনে খায় না।
এনিওয়ে, পার্টিতে কিন্তু আরেকজন ছিলেন।
মিঃ সুকিয়াস তো?
হ্যাঁ। এর কিন্তু হারটার উপর লোভ ছিল।
যে কোনও আর্ট কালেক্টরেরই থাকবে। সেটা কিছুই আশ্চর্য না। আর্ট কালেক্টর হলে কিনতে চাইবে। আর অভাবী লোক হলে হাতাতে চাইবে। এঁদের আর্থিক অবস্থা সম্বন্ধে আমরা কোনও কিছুই জানি না। কাজেই এখন অন্ধকারে হাতড়ে লাভ নেই। বিকেলে জয়ন্তবাবু ফোন করবেন, তার আগে পর্যন্ত আমরা ফ্রি। চলুন, আপনাকে কাইজার-বাগটা দেখিয়ে আনি।
ভেরি গুড আইডিয়া, বললেন লালমোহনবাবু। তদন্তের চাপে যদি লখ্নৌ শহরটা দেখা সম্পূর্ণ না হয় তা হলে খুব আপশোস থেকে যাবে।