রামায়ণ : লঙ্কাকাণ্ড – মকরাক্ষের যুদ্ধ ও পতন
ভগ্নপাইক নহে গিয়া রাবণ গোচর।
পড়িল নিকুম্ভ কুম্ভ শুন লঙ্কেশ্বর।।
কুম্ভ নিকুম্ভের মৃত্যু শুনিয়া রাবণ।
সিংহাসন হতে পড়ে রাজা দশানন।।
দেব দানব গন্ধর্ব্ব করিত রণে শঙ্কা।
কুম্ভ আর নিকুম্ভ পড়ে শূন্য হইল লঙ্কা।।
কুড়ি চক্ষে পড়ে ধারা রাজা লঙ্কেশ্বর।
মকরাক্ষ মহাবীরে আনিল সত্বর।।
মকরাক্ষ প্রণমিল রাবণের পায়।
কুড়ি হস্ত রাবণ তার অঙ্গেতে বুলায়।।
রাবণ বলে মকরাক্ষ তুমি যোদ্ধাপতি।
নর বানর মেরে রাখ লঙ্কার বসতি।।
সেই পুত্র সুজন কুলের অলঙ্কার।
পিতৃশত্রু বধ করে শোধে পিতৃধার।।
রাত্রি দিবা কান্দে শোকে তোমার জননী।
সে রামে রামের সাতী আমি হরে আনি।।
তাহার কারণে হৈল এত বিসম্বাদ।
রাম লক্ষ্মণেরে মেরে ঘুচাও বিষাদ।।
মকরাক্ষ বলে চিন্তা না কর রাজন।
এখনি মারিব শত্রু শ্রীরাম লক্ষ্মণ।।
রাবণ বলে বড় বীর তুমি মকরাক্ষ।
বড় প্রীতি পাইলাম শুনি তব বাক্য।।
এত বলি মকরাক্ষে পাঠায় যুঝিতে।
রণজজ্জা করে দেয় আপনার হাতে।।
মস্তকে মুকুট দিল অঙ্গে দিন সানা।
কাড়া পাড়া ঢাক ঢোল বাজায় বাজনা।।
মকরাক্ষ বলে, শুন প্রতিজ্ঞা রাজন।
নর বানর সংগ্রাম এড়াবে কোন্ জন।।
রাম লক্ষ্মণ সুগ্রীব রাক্ষস বিভীষণ।
চারি জনার রক্তে পিতার করিব তর্পণ।।
এত শুনি হরষিত যতেক রাক্ষস।
সবে বলে মকরাক্ষের বড়ই সাহস।।
মন্ত্রণাতে মন্ত্রী যে বলেতে বলবান।
লঙ্কাপুরে বীর নাহি তোমার সমান।।
মনে মনে মকরাক্ষ ভাবিছে তখন।
নর বানরের যুদ্ধে সংশয় জীবন।।
কুম্ভকর্ণ অতিকায় হইল বিনাশ।
শ্রীরামের সঙ্গে যুদ্ধ ছাড়ি প্রাণ-আশ।।
কিন্তু এক সুমন্ত্রণা আছয়ে ইহার।
শুনিয়াছি রঘুনাথ বিষ্ণু-অবতার।।
বড়ই ধার্ম্মিক রাম, ধর্ম্মেতে তৎপর।
অস্ত্রাঘাত না করেন গরুর উপর।।
এতেক ভাবিয়া মকরাক্ষ নিশাচর।
যুক্তি করে ধেনু বৎস আনায় বিস্তর।।
নব নব বৎস সব রথে লয়ে তোলে।
রথের চৌদিকে ধেনু বান্ধে পালে পালে।।
মনোহর হয় হস্তী দূর করে সবে।
রথের যোপান দিল চারিটা বৃষভে।।
গোচর্ম্মেতে ঢাকে রথ করিয়া মন্ত্রণা।
সর্ব্ব অঙ্গে ঢাকা দিল গোচর্ম্মের সানা।।
গোচর্ম্মের সানা ঢাকে সারথির অঙ্গে।
ঢাক ঢোল দামামা দগড় বাজে রঙ্গে।।
পাখোয়াজ সেতারা বাঁশী বাজে জগঝম্প।
ভয়ঙ্কর শব্দ শুনি সুরপুরে কম্প।।
মকরাক্ষ মহাবীর করিল সাজনি।
সঙ্গেতে কটক চলে তিন অক্ষৌহিণী।।
কেহ অশ্বে কেহ গজে কেহ চড়ে রথে।
ত্রিভুবন বিজয়ী ধনুকবাণ হাতে।।
এইরূপে যতেক প্রধান সেনাপতি।
সাজিয়া চলিল মকরাক্ষের সংহতি।।
হাতে ধনু মকরাক্ষ রথে গিয়া চড়ে।
রাক্ষসের কোলাহলে মহাশব্দ পড়ে।।
ঘন ঘন সিংহনাদ ধনুক-টঙ্কার।
পশ্চিম দ্বারেতে গেল করি মার মার।।
মকরাক্ষ এল রণে পড়ে গেল সাড়া।
অসংখ্য বানর উঠে দিয়া গাত্র ঝাড়া।।
রামজয় শব্দ করি ধাইল বানর।
বানর দেখিয়া রোষে যত নিশাচর।।
কেহ বলে কাট কেহ বলে মার।
রুষিয়া আইল রণে খরের কুমার।।
মকরাক্ষ সম্মুখে দাণ্ডায় হনুমান।
গোচর্ম্মেতে ঢাকা রথ দেখে বিদ্যমান।।
ধেনু বৎস পালে পালে রোধ কৈল পথ।
ভাবে মনে কি হইবে বৃষভে টানে রথ।।
রাক্ষসে মারিতে গেলে ধেনু বৎস মরে।
গো-হত্যার ভয়ে কপি যুঝিতে না পারে।।
মকরাক্ষ মারে বাণ বানর উপর।
অসংখ্য বানর পড়ে সংগ্রাম ভিতর।।
বানর-কটক ভয়ে পলায় অপার।
পশ্চাতে রাক্ষস ধায় করি মার মার।।
নল নীল সুষেণ অঙ্গদ মহাবল।
ভয়ে ভঙ্গ দিয়া যায় ছাড়ি রণস্থল।।
মহেন্দ্র দেবেন্দ্র আদি বীর হনুমান।
হাত হৈতে ফেলে বৃক্ষ পর্ব্বত পাষাণ।।
ভয়েতে পলায়ে যায় পশ্চাতে না চায়।
রণ ছেড়ে সুগ্রীব পলায় উভরায়।।
ভঙ্গ দিল কপিগণ মকরাক্ষে দেখে।
চালাইয়া দিল রথে রামের সম্মুখে।।
সন্ধান পূরিয়া বীর শ্রীরামেরে ডাকে।
আসিয়া করহ যুদ্ধ আমার সম্মুখে।।
দণ্ডক বনেতে বেটা মারিলি মোর বাপ।
ভুঞ্জিবি তাহার ফল, দেখাব প্রতাপ।।
পিতৃশত্রু পাইলাম বহু দিন পরে।
আমার পিতার কাছে পাঠাব তোমারে।।
পাড়িব তোমার মুণ্ড কাটি চোখা শরে।
খাইবে তোমার মাংস শৃগাল কুক্কুরে।।
এত বলি ধনুকে যুড়িল তীক্ষ্ণ শর।
বিন্ধিয়া কোমল অঙ্গ করিল জর্জ্জর।।
মনে মনে রঘুনাথ ভাবেন এই ভয়।
মরকাক্ষে মারিতে গো-হত্যা পাছে হয়।।
যত যত বীর সনে করিলা সংগ্রাম।
প্রতি যুদ্ধে তিন পদ আগু হৈলা রাম।।
পূর্ণব্রহ্মা নারায়ণ ভয় পাইয়া মনে।
হইলা ত্রিপদ ভঙ্গ মকরাক্ষ-রণে।।
তিন পদ পশ্চাৎ হইল রঘুবর।
মকরাক্ষ বাণে রাম অতীব কাতর।।
কেমনে জিনিব রণ ভাবিলেন মনে।
যুড়িল পবন-বাণ ধনুকের গুণে।।
পবন-বাণের তেজে ত্রিভুবন নড়ে।
পর্ব্বত কন্দর কত উড়াইল ঝড়ে।।
ব্রহ্মরূপী-বাণেতে পবন আর্বিভূত।
উড়াইল ধেনু বৎস বৃষভাদি যত।।
গোচর্ম্ম যতেক ছিল উড়াইল ঝড়ে।
যতেক বানর আসি মকরাক্ষে বেড়ে।।
রামজয় শব্দ করে যতেক বানরে।
অন্ধকার করি ফেলে বৃক্ষ আর পাথরে।।
মকরাক্ষ মহাবীর পূরিল সন্ধান।
গাছ পাথর কাটিয়া করিল খান খান।।
গাছ পাথর কাটিতে এড়িল পঞ্চশর।
দশ বাণে নীলবীরে করিল জর্জ্জর।।
সুগ্রীব সুষেণ আদি বড় বড় বীর।
দশ দশ বাণে বিন্ধে সবার শরীর।।
বিংশতি বাণেতে বিন্ধে অঙ্গদের অঙ্গ।
পলায় অঙ্গদ-বীর রণে দিয়া ভঙ্গ।।
ধেনু বৎস বৃষ সব উড়িল ঝড়েতে।
চারি অশ্ববর আনি যুড়িলেক রথে।।
দেবাংশী রথের তেজ চলে বায়ুবেগে।
বিক্রম করিয়া আসে শ্রীরামের আগে।।
গালি পাড়ে রঘুনাথে যত আসে মনে।
দশদিক অন্ধকার করিলেন বাণে।।
রাম বলে, মকরাক্ষ না কর বিলাপ।
আজি ঘুচাইব তোর মনের সন্তাপ।।
এখনি পাঠাব তোরে যমের সদন।
চিরদিন পিতা পুত্রে হবে দরশন।।
এত বলি ক্ষুরপার্শ্ব বাণে দিল টান।
মকরাক্ষ বাণ মারে পূরিয়া সন্ধান।।
আকাশে উঠিল গিয়া দুজনার বাণ।
শ্রীরামের বাণ কাটি কৈল খান খান।।
মকরাক্ষ বাণ এড়ে তারা হেন ছুটে।
শত শত বাণ মারে রামের ললাটে।।
ললাটে লাগিয়া যেন রক্ত-পদ্মমালা।
অন্ধকার হৈল বাণে নাহি চলে দৃষ্টি।।
খসিয়া পড়িল রামের ধনুকের মুষ্টি।
আপনা সারিয়া রাম দৃঢ় কৈলা বুক।
কাটিলেন মকরাক্ষের হাতের ধনুক।।
আর ধনু লয়ে করে বাণ বরিষণ।
বাণে বাণে মকরাক্ষ ঢাকিল গগন।।
খরের কুমার বীর নানা শিক্ষা জানে।
দশদিক অন্ধকার করিলেন বাণে।।
বাণে অন্ধকার বাণ ফেলে নিরন্তর।
বাণ ফুটে রঘুনাথ হইলা কাতর।।
রামেরে কাতর দেখি দুষ্ট নিশাচর।
সর্ব্বাঙ্গ বিন্ধিয়া রামে করিল জর্জ্জর।।
কত বাণ মারে রামে নাহি অবকাশ।
রামেরে জিনিনু বলি মনেতে উল্লাস।।
সর্ব্বাঙ্গ বিন্ধিয়া রামে করিল অস্থির।
রাম বলে এ বেটা বাপের হতে বীর।।
খরেরে মারিয়াছিলাম এক দণ্ড রণে।
দুই প্রহর হৈল বেটা যুঝে মোর সনে।।
সন্ধান পূরিয়া রাম চাহে চারিভিতে।
বাণে অন্ধকার করে না পান দেখিতে।।
রণেতে পণ্ডিত রাম বিষ্ণু-অবতার।
চিকুর বাণেতে দীপ্তি হরে অন্ধকার।।
এড়েন ঐষিক বাণ তারা যেন ছুটে।
হাতের ধনুক তার পাড়িলেন কেটে।।
মকরাক্ষ মহাবীর জাঠা লয় হাতে।
সে জাঠা কাটেন রাম দেখিতে দেখিতে।।
জাঠা যদি কাটা গেল শেল মাত্র তাড়া।
এড়িলেন শেলখান দিয়া অঙ্গ নাড়া।।
সূর্য্যের কিরণ যেন আসে শেল বাণ।
ঐষিক বাণেতে রাম কৈলা খান খান।।
সর্ব্ব অস্ত্র কাটা গেল মকরাক্ষ রোষে।
বজ্রমুষ্টি মারিতে পবন-বেগে আসে।।
দেখিয়াত রঘুনাথ পূরিলা সন্ধান।
অর্দ্ধচন্দ্র বাণে কাটে হস্ত দুইখান।।
হস্ত কাটা গেল, বেটা দন্ত কড়মড়ে।
ধাইয়া রামেরে যায় খাইতে কামড়ে।।
বদন বিস্তারি যায় অতি পরিতাপে।
অগ্নি-অস্ত্র রঘুনাথ বসাইলা চাপে।।
অগ্নিবাণ যুড়িয়া ধনুকে দিল টান।
অগ্নিবাণে মকরাক্ষের বাহিরায় প্রাণ।।
তিন প্রহর যুদ্ধ কৈল শ্রীরামের সনে।
সন্ধ্যাকালে মকরাক্ষ পড়ে অগ্নিবাণে।।
কৃত্তিবাসে পণ্ডিতের মধুর বচন।
লঙ্কাকাণ্ডে মকরাক্ষ হইল পতন।।