রামায়ণ : লঙ্কাকাণ্ড – অতিকায়ের যুদ্ধ ও মৃত্যু
শ্রীরাম-বদনে শুনি এতেক বচন।
বিভীষণ তাঁহারে করেন নিবেদন।।
প্রভু বিশ্রবার পৌত্র রাবণ-নন্দন।
অতিকায় নামধারী হয় এই জন।।
জনম ইহার ধন্যা মালিনী উদরে।
আপন পিতার তুল্য এ হয় সমরে।।
জ্ঞাতিজন সেবনেতে বড় অনুরক্ত।
একবার শ্রুতিমাত্রে শাস্ত্রাভ্যাসে শক্ত।।
সাম দান ভেদ দণ্ড এ চারি উপায়ে।
অত্যন্ত নিপুণ আর মন্ত্রণা নিচয়ে।।
ধর্ম্মশাস্ত্র অর্থশাস্ত্র কামশাস্ত্রে ধীর।
অশ্বপৃষ্ঠে গজস্কন্ধে রতে মহাস্থির।।
ধনুক ধারণে আর বাণ বিমোচনে।
ইহার সমান নাই এ লঙ্কা-ভুবনে।।
ইহার বাহুর বল করিয়া আশ্রয়।
নিরবধি লঙ্কাপুরী আছয়ে নির্ভয়।।
ইহার প্রভাব প্রশংসয়ে সর্ব্বজন।
দেবতা দানব যক্ষ বিদ্যাধরগণ।।
এই ঘোর তপ করি অনেক বরষ।
বিধাতারে করিয়াছে আপনার বশ।।
তাঁর স্থানে পাইয়াছে এই দিব্য যান।
আর পাইয়াছে নানা অস্ত্র শস্ত্র বাণ।।
দিব্য এক অভেদ্য কবচ পাইয়াছে।
সুরাসুর নিকটে অবধ্য হইয়াছে।।
এই জিনিয়াছে বহু দেবতা দানবে।
যক্ষ বিদ্যাধর নাগ কিন্নরাদি সবে।।
এই করেছিল বাণে বজ্রের স্তম্ভন।
বরুণের পাশ করেছিল নিবারণ।।
এই লঙ্কা-মাঝে সব বীরের প্রধান।
দেব দৈত্য জয়ী শূর বীর বলবান।।
আদরেতে অতিকায় নাম রাখে বাপ।
কুমার ভাগেতে নাই এমন প্রতাপ।।
এই রণে যাবতীয় কপি ভল্লগণে।
সংহার করিবে শরজালে এইক্ষণে।।
অতএব ইহারে করিতে সংহরণ।
করিতে হইবে অতি শীঘ্র আয়োজন।।
এইরূপ বিভীষণ কন রঘুবরে।
অতিকায় প্রবেশিল সমর ভিতরে।।
সম্মুখেতে বিভীষণে করি নিরীক্ষণ।
প্রণাম করিয়া তাঁরে কহিছে বচন।।
অতিকায় বলে, খুড়া শুনহ উত্তর।
রাত্রি দিন সেব তুমি দেব গদাধর।।
তোমার সমান শ্রেষ্ঠ হবে কোন জন।
তোমা প্রতি বড় প্রীত দেব নারায়ণ।।
অতিকায় বলিছে খুড়া নিবেদি তোমারে।
মোরে যেন করেন দয়া দেব গদাধরে।।
এত কহি অতিকায় রাখি বিভীষণে।
চালাইয়া দিল রথ রাম বিদ্যমানে।।
অতিকায় বলে, শুন জগত-গোঁসাই।
মম প্রতি কএব কেন দয়া হয় নাই।।
অতিকায় বলে, শুন দেব নারায়ণ।
স্থান দিও শ্রীচরণে এই নিবেদন।।
স্তব শুনি স্তব্ধ হয়ে কন গদাধর।
পরম ধার্ম্মিক তুমি লঙ্কার ভিতর।।
তুমি আর তোমার পিতৃব্য বিভীষণ।
দুইজনে রাজ্য দিব মারিয়া রাবণ।।
অতিকায় বলে রাজ্য নাহি প্রয়োজন।
যুদ্ধ করি কলেবর করিব পাতন।।
এখন ও পদে করি এই নিবেদন।
আমার সহিত যুদ্ধ দিবে কোন্ জন।।
বানরের সঙ্গে আমি না করিবে রণ।
পশুজাতি যুদ্ধের কি জানে কপিগণ।।
বানরের সম্ভাবনা বৃক্ষ আর পাথর।
কটাক্ষে মারিতে পারি সকল বানর।।
সুগ্রীব রাজারে দেখি বকের সমান।
লক্ষ্মণ বালক রণে কি জানে সন্ধান।।
যোড়হাতে বলে বীর শুনহ শ্রীরাম।
তোমার সহিত আমি করিব সংগ্রাম।।
ধনুক পাতিয়া যান ঠাকুর লক্ষ্মণ।
হাসিয়া জিজ্ঞাসা করে রাবণ-নন্দন।।
কত যুদ্ধ করিয়াছ বয়ঃক্রম কত।
আমার সহিত যুদ্ধ না হয় উচিত।।
ইন্দ্র চন্দ্র কুবের আমারে করে ভয়।
আমার সহিত যুদ্ধ উচিত না হয়।।
কোপেতে লক্ষ্মণ দিল ধনুকে টঙ্কার।
দেখি অতিকায় বীরে লাগে চমৎকার।।
অতিকা বলে, শুন ঠাকুর লক্ষ্মণ।
বয়সে ছাওয়াল তুমি কিবা জান রণ।।
লক্ষ্মণ বলেন, তুই জাতি নিশাচর।
ভাল মন্দ না জানিস্ করিস্ উত্তর।।
কে কোথা দেখেছে হেন শুনেছে শ্রবণে।
বয়স অধিক যার সেই রণ জিনে।।
আমারে ছাওয়াল বল প্রবীণ আপনি।
প্রাণে যদি যাইতে পার তবে বীর জানি।।
আজিকার যুদ্ধে যদি তোরে নাহি মারি।
তবেত লক্ষ্মণ নাম বৃথা আমি ধরি।।
এত যদি দুজনে বচনে হৈল কক্ষা।
দুইজনে বাণ মারে যার যত শিক্ষা।।
অতিকায় বলে, শুন ঠাকুর লক্ষ্মণ।
তোমাতে আমাতে যুদ্ধ করিব দুজন।।
সংগ্রামের দোষ গুণ কাহার কেমন।
রামচন্দ্র সাক্ষী আর খুড়া বিভীষণ।।
মধ্যস্থ হইয়া দোঁহে করুন বিচার।
জয় পরাজয় রণে কি হয় কাহার।।
অতিকায় বচনে লক্ষ্মণ দিল সায়।
মহাযুদ্ধ বাজিল লক্ষ্মণে অতিকায়।।
অগ্নিবাণ অতিকায় করে অবতার।
লক্ষ্মণ বরুণবাণে করিল সংহার।।
দুই শত বাণ তবে অতিকায় এড়ে।
অবিলম্বে লক্ষ্মণ বাণেতে কাটি পাড়ে।।
হস্তিবাণ এড়ে অতিকায় মহাবল।
সিংহবাণে লক্ষ্মণ করিল রসাতল।।
মারিল পর্ব্বত-বান অতিকায় রোষে।
লক্ষ্মণ পবন-বাণে উড়ান বাতাসে।।
অমর্ত্ত সমর্থ বাণ বিকট-দশন।
ইন্দ্রজাল বিষ্ণুজাল ঘোর দরশন।।
এই সব বাণ দোঁহে করে অবতার।
দশদিক জল স্থল বাণে অন্ধকার।।
দুই জনে বাণ মারে অতি পরিপাটী।
অন্তরীক্ষে দুই বাণ করে কাটাকাটি।।
লক্ষ্মণ মারেন বাণ দিয়া বাহু নাড়া।
অতিকায়-রথের কাটেন শত ঘোড়া।।
আর বাণ এড়েন লক্ষ্মণ মহাবীর।
কাটিলেন তার পঞ্চ সারথির শির।।
যুদ্ধ করে অতিকায় হইয়া বিরথী।
চক্ষুর নিমেষে রথ জোগায় সারথি।।
রথ পাইয়া অতিকায় লাফ দিয়া চড়ে।
তিন কোট বাণ লক্ষ্মণের প্রতি এড়ে।।
সে বাণ লক্ষ্মণ সব কাটে অবহেলে।
স্বর্গেতে দেবতা সব সাধু সাধু বলে।।
লক্ষ্মণ এড়েন বাণ নামেতে অক্ষয়।
শাণাতে ঠেকিয়া বাণ পাইল পরাজয়।।
শাণায় ঠেকিয়া বাণ না করে প্রবেশ।
লক্ষ্মণের কানে বায়ু কহে উপদেশ।।
অক্ষয়-কবচ আছে অঙ্গেতে উহার।
অঙ্গে প্রহারিতে বাণ শক্তি আছে কার।।
সহজেতে না মরিবে রাবণ-কুমার।
ব্রহ্ম-অস্ত্র মারি ওরে করহ সংহার।।
উপদেশ কহিয়া পবন দেব নড়ে।
মন্ত্র পড়ি লক্ষ্মণ বীর ব্রহ্ম-অস্ত্র যোড়ে।।
লক্ষ্মণ এড়িলা বাণ পূরিয়া সন্ধান।
বাণ দেখে অতিকায়ের উড়িল পরাণ।।
মারে জাঠি ঝকড়া সে অস্ত্র কাটিবারে।
অতিকায়ে তবু তাহা ফিরাইতে নারে।।
অজয় অক্ষয় বাণ কেবা ধরে টান।
অতিকায় মাথা কাটি কৈল দুই খান।।
অতিকায় পড়িল রাক্ষস ভাগে ডরে।
ধাইয়া বানরগণ রাক্ষসেরে মারে।।
পলায় রাক্ষসগণ গণিয়া প্রমাদ।
রামজয় শব্দে বানর ছাড়ে সিংহনাদ।।
সমুকুট মুণ্ড পড়ে সহিত কুণ্ডলে।
অতিকায়-মুণ্ড গড়াগড়ি ভূমিতলে।।
ভূমিতে পড়িয়া মুণ্ড রাম রাম বলে।
প্রেমানন্দে বিভীষণ ভাসে অশ্রুজলে।।
ধন্য ধন্য পুত্র তুমি নিশাচর কুলে।
তিন কুল মুক্ত হবে তব পুণ্যফলে।।
হেন ভক্ত না দেখি না শুনি কোন কালে।
কাটামুণ্ড এইরূপে রাম রাম বলে।।
বানরেতে রামজয় শব্দ করে মুখে।
বজ্রাঘাত পড়ে যেন রাবণের বুকে।।
অতিকায় পড়ে যদি সংগ্রাম ভিতরে।
দূত যায় সমাচার দিতে লঙ্কেশ্বরে।।