রামায়ণ : লঙ্কাকাণ্ড – শ্রীরামচন্দ্রের রাজ্যাভিষেক
বাহির চৌতারায় রাম করেন দেওয়ান।
ছত্রিশ কোটি সেনাপতি দাণ্ডায় প্রধান।।
সবাকারে আসন যোগায় শীঘ্রগতি।
বসিল ছত্রিশ কোটি প্রধান সেনাপতি।।
ভরতে করান রাম সৈন্য-পরিচয়।
ঐ দেখ সুগ্রীব রাজা সূর্য্যের তনয়।।
যুবরাজ অঙ্গদ যে বালির কুমার।
সুগ্রীব দিলেন যারে সর্ব্ব অধিকার।।
দেখ গয় গবাক্ষ এই গন্ধমাদন।
মহেন্দ্র দেবেন্দ্র দেখ সুষেণ-নন্দন।।
ঋষভ কুমুদ দেখ পনস সম্পাতি।
নল নীল দেখ এই মুখ্য সেনাপতি।।
ঐ দেখ সুষেণ আরো জাম্ববান।
ঔষধে ও মন্ত্রণাতে উভয়ে সাবধান।।
এই দেখ হনুমান পবন-নন্দন।
যাহার বিক্রমে মারিলাম দশানন।।
ইহার গুণের কথা কি কব বিশেষ।
হনুমান করিলেক সীতার উদ্দেশ।।
হনুমান আমার সকল কার্য্যে দড়।
চারি ভাই হইতে মম হনুমান বড়।।
ঐ দেখ লঙ্কার রাজা মন্ত্রী বিভীষণ।
যাহার মন্ত্রণাগুণে মরিল রাবণ।।
কহিলেন রঘুনাথ যার যত গুণ।
সর্ব্বলোক তার পানে চাহে পুনঃ পুনঃ।।
রাক্ষস বানর সবে নানা মায়া ধরে।
রামের ইঙ্গিতে তারা নররূপ ধরে।।
ভরত বলেন সাক্ষী হও সর্ব্বজন।
প্রভুর চরণে আমি কর নিবেদন।।
ভরত প্রণাম করে রামের চরণে।
যোড়হাতে বলেন সবার বিদ্যমানে।।
স্থাপ্যধন মম ঠাঁই আছে পিতৃরাজ্য।
তোমার আজ্ঞাত করিয়াছি রাজকার্য্য।।
আজ্ঞা কর রাজ্য লহ বৈস সিংহাসনে।
সেবা করি থাকি রাম সীতার চরণে।।
মহারাজ্য রাখিতে আমার শক্তি নহে।
কেশরীর বিক্রম শৃগালে কোথা বহে।।
সবলের বোঝা কি দুর্ব্বল নিতে পারে।
মহারাজ্য মহাবীর রাখিবারে পারে।।
অদ্য হৈতে রাজ্যভার আমাকে না লাগে।
ক্রমাগত রাজ্য রাম ভুঞ্জ যুগে যুগে।।
ভরতের কথা শুনি শ্রীরাম হাসিয়া।
ভরতে কথা শুনি শ্রীরাম হাসিয়া।।
ভরতে করেন কোলে বাহু পসারিয়া।
বলেন ভরত পুনঃ বিনয় বচন।
ভরতের প্রতি রাম কহেন তখন।।
তব ব্যবহারে আমি হইলাম বশ।
পৃথিবী যুড়িয়া তব ঘুষিবেক যশ।।
জানাইল গণকে উত্তম তিথি বার।
কাটিতে মাথার জাটা হইল সবার।।
চারি ভাই বসিলেন কাঞ্চনের খাটে।
শুভক্ষণে নাপিত শিরের জটা কাটে।।
জটাজুট মণ্ডন করিল সুবিধান।
সুবাসিত গঙ্গাজলে করাইল স্নান।।
অতঃপর করিয়া বল্কল বিসর্জ্জন।
পরিধান করিলেন বিচিত্র বসন।।
জানকীরে স্নান করাইলা যত রাণী।
বৈকুণ্ঠ হইতে লক্ষ্মী আইলা আপনি।।
শ্রীরাম করিয়াছিলেন যেমত আচার।
বল্কল পরিয়া সব আছিল সংসার।।
অযোধ্যার মনুষ্য তপস্বী বেশধারী।
পরিল বসন সে বল্কল পরিহরি।।
শ্রীরামের দুঃখে লোক ছিল সব দুঃখী।
তাঁহার সুখেতে লোক হইলেন সুখী।।
আনন্দে কৌশল্যা দেবী করিলা রন্ধন।
চারি ভাই করিলেন অমৃত ভোজন।।
যজ্ঞস্থানে সীতাদেবী গেলেন আপনি।
ভোজন করিল সৈন্য সত্তর অক্ষৌহিণী।।
সুখে গেল বিভাবরী হইল প্রভাত।
আইল সকল লোক রামের সাক্ষাৎ।।
শ্রীরাম ভূপতি হন গিয়া অযোধ্যায়।
বাসনা করিয়া সবে চলিল তথায়।।
চলিল রামের সঙ্গে হস্তী ঘোড়া চড়ি।
দেখিবারে স্ত্রী পুরুষ আইল রড়ারড়ি।।
যে যেমন ভাবে ছিল সেই ভাবে ধায়।
বৃদ্ধ কাণা খোঁড়া শিশু কেহ নাহি রয়।।
কাণা খোঁড়া ধরিয়াত আনে অন্য জনে।
সর্ব্ব দুঃখ ঘুচে তার রাম-দরশনে।।
ঊর্দ্ধশ্বাসে ধাইয়া আইসে গর্ভবতী।
লজ্জা ভয় পরিহরি আইসে যুবতী।।
কি করিবে স্বামী, কি করিবে পরিজনে।
সর্ব্বপাপ ঘুচিবেক রাম-দরশনে।।
চল সবে দেখি গিয়া রামের বদন।
জুড়াইবে নয়ন সুতৃপ্ত হবে মন।।
মাতঙ্গ ছত্রিশ কোটি আইল দন্তাল।
বানর ছত্রিশ কোটি বিক্রমে বিশাল।।
ঘোড়া হস্তী চড়ি সবে অযোধ্যায় যায়।
শুষ্কগাছে ফল ফুল ছিঁড়ি সবে খায়।।
সুমন্ত্র যোগায় রথ জয় জয় নাদে।
রথোপরি চারি ভাই দিব্য পরিচ্ছদে।।
ধরেন ভরত যে ঘোড়ার কড়িয়ালী।
চামর ঢুলায় শ্রীলক্ষ্মণ মহাবলী।।
শত্রুঘ্ন রামের গাত্রে করেন ব্যজন।
বিরাজিত চারি অংশে রথে নারায়ণ।।
দুইদকে সর্ব্বলোক রামপানে চাহে।
শ্রীরামের যত গুণ সর্ব্বলোকে কহে।।
বহুপুণ্যে পাই প্রভু তোমা হেন রাজা।
জন্মে জন্মে রঘুনাথ করি তব পূজা।।
সর্ব্বক্ষণ দেখি যেন তব চন্দ্রানন।
সর্ব্বলোক মুক্ত হয় করিয়া দর্শন।।
দেখিয়া রামের রূপ ভুবনমোহন।
পুর-বনিতার মন মজিল নয়ন।।
শ্রীরামের মন নহে অন্যের যেমন।
যেমন সীতার প্রতি কে পায় সে মন।।
যেন রাম তেন সীতা শোভে দুইজন।
অন্যপানে শ্রীরাম না চান কদাচন।।
সীতার সৌভাগ্য তারা ভাবিয়া অন্তরে।
আপনা নিন্দিয়া সবে গেল ঘরে ঘরে।।
ঘরে গিয়া স্ত্রীলোকের প্রাণ নহে স্থির।
অযোধ্যায় প্রবেশ করেন রঘুবীর।।
ভরতের প্রতি রাম করেন আদেশ।
কটক রহিতে স্থান করহ উদ্দেশ।।
পাইয়া রামের আজ্ঞা ভরত সত্বর।
করিলেন নির্দ্দিষ্ট ছত্রিশ কোটি ঘর।।
এক বৃন্দ আওয়াসে সে দেখিতে রূপস।
চালে শোভা করিতেছে রত্নের কলস।।
রত্নময় ঘরখান ধরে নানা জ্যোতি।
এই ঘরে রহুক সুগ্রীব-কোপিপতি।।
আর যে আওয়াস দেখ নির্ম্মল কাঞ্চন।
তিন কোটি রাক্ষসে রহুক বিভীষণ।।
দেখ এই ঘরে মণি মাণিক্য-পাথর।
রহুক সৈন্যের সহ অঙ্গদ কুমার।।
আর যে আবাস দেখ মুকুতা গঠনি।
এই খানে হনুমান থাকুক আপনি।।
সিন্ধুনদ-তীরে আর সরযূর তীরে।
এতদূর চাপি বৈসে রাক্ষস বানরে।।
সিন্ধুনদ সরযূতে চল্লিশ যোজন।
এতদূর ব্যপিয়া রহিল সৈন্যগণ।।
স্বর্ণখাটে শুইল বানর শয্যাতলে।
দেবকন্যা লইয়া বঞ্চিল কুতূহলে।।
কহেন ভরত গিয়া সুগ্রীবের ঘর।
কালি ছত্রদণ্ড ধরিবেন রঘুবর।।
পুনর্ব্বসু নক্ষত্র যে পূর্ণ চৈত্রমাস।
শ্রীরাম হবেন রাজা আজি অধিবাস।।
অন্য দ্রব্য আনিব সে কোন্ কার্য্য গণি।
আনিতে নারিব চারি সাগরের পানি।।
দিলাম চারিটি রত্ন-নির্ম্মিত কলসী।
চারি সাগরের জল আন বহে কলসী।।
সাত শত নদী আছে পৃথিবী মণ্ডলে।
শ্রীরামের অভিষেক হবে সেই জলে।।
সাত শত স্বর্ণকুম্ভ দিলাম তব ঠাঁই।
সকল নদীর জল যেন কাল পাই।।
সুগ্রীব বানর পানে চাহে কটাক্ষেতে।
ধাইয়া বানর-সৈন্য কুম্ভ নিল হাতে।।
রাজা বলে সাগরের জলে চিহ্ন আছে।
খালিজুলির জল আনি ভাণ্ডাও যে পাছে।।
পাঠাইলা সুগ্রীব বানরে চতুর্ভিত।
অধিবাস রামের করেন পুরোহিত।।
বশিষ্ঠ নারদ মুনি করে বেদধ্বনি।
অখিল ভুবনে শব্দ রামজয় শুনি।।
রাম-সীতা উপবাসে রহেন দুজনে।
পুরীশুদ্ধ সকলে রহিল জাগরণে।।
রাম সীতা দুইজনে কহেন কাহিনী।
আর একদিন প্রভু ছিলাম এমনি।।
শুনিয়া সীতার কথা শ্রীরামের হাস।
মধুর বচনে তাঁরে করেন সম্ভাষ।।
পূর্ব্বদিনে রাম সীতা ছিলেন পরিমিত।
পরদিন রাম রাজা হন শাস্ত্রমত।।
প্রভাত হইল পূর্ব্বদিকের প্রকাশ।
বানর কলসী হাতে উঠিল আকাশ।।
অগ্নি হেন উড়ে যায় নীল সে বানর।
চক্ষুর নিমিষে গেল সে পূর্ব্ব সাগর।।
অযোধ্যা পূর্ব্বসাগর চারিশত যোজন।
রামের তেজে নীল বীর গেল ততক্ষণ।।
কলসী ভরিয়া রাখে সাগরের ঘাটে।
চিহ্ন চাহি নীল বীর বেড়ায় তার তটে।।
রক্তচন্দনের ডাল দিলেক ঢাকনি।
সুগ্রীবের কাছে থুইল প্রভাতা রজনী।।
জাম্ববান তার বাক্যে সাহসে করি ভর।
চক্ষুর নিমিষে গেল পশ্চিম সাগর।।
অযোধ্যা পশ্চিম সাগর আট-শ যোজন।
শ্রীরামের তেজেতে যে গেল ততক্ষণ।।
কলসী ভরিয়া থুইল সাগরের পাড়ে।
চিহ্ন অন্বেষিয়া বুড়া ভ্রমে উভরড়ে।।
দেবদারু ডাল ভাঙ্গি আচ্ছাদিল পানি।
সুগ্রীবের কাছে থুইল প্রভাতা রজনী।।
দক্ষিণ সাগরে গেল নল মহাবীর।
যেখানে সে বান্ধিয়াছে সমুদ্র গভীর।।
দক্ষিণসাগর পাঁচশত যে যোজন।
শ্রীরামের তেজে নল গেল ততক্ষণ।।
নলে দেখে সাগরের উড়িল জীবন।
আরবার নল বীর এল কি কারণ।।
সাগরের ত্রাস দেখি নলের হৈল হাস।
হাসিয়া সাগর প্রতি করিছ আশ্বাস।।
ছিলাম রামের সঙ্গে তেঁই মম বল।
কার শক্তি বান্ধিবারে পারে তব জল।।
শ্রীরাম হবেন রাজা অযোধ্যা-নগরে।
জল লইতে আসিয়াছি তোমার সাগরে।।
মনে তোলাপাড়া করে নল মহাবল।
রত্ন-কুম্ভে ভরিলেন সাগরের জল।।
কলসী ভরিয়া থুইল সেতুর উপরে।
চিহ্ন চাহি নলবীর ভ্রমে তীরে তীরে।।
সম্মুখে দেখিলা গাছ ধবল চন্দন।
ডাল ভাঙ্গি জলোপরি দিল আচ্ছাদন।।
শ্বেতচন্দনের ডালে আচ্ছাদিল পানি।
সুগ্রীবের কাছে থুইল প্রভাতা রজনী।।
উত্তর সাগর পথ হাজার যোজন।
কোন্ বীর যাইবে ভাবিছে মনে মন।।
শ্রীরাম সুগ্রীব দোঁহে করে অনুমান।
দুড় দুড় শব্দে যায় বায়ু করি ভর।
লেজের টানে উপাড়ে পাদপ পাথর।।
আকাশে থাকিয়া গাছ জলে স্থলে পড়ে।
বন্ধু অনুবর্জ্জি যেন বান্ধব বাহুড়ে।।
পবন গমনে যায় পবন-নন্দন।
মুহূর্ত্তেক মধ্যে গেল হাজার যোজন।।
কলসী ভরিয়া থুইল সাগরের পাড়ে।
চিহ্ন চাহি হনুমান ভ্রমে উভরড়ে।।
চন্দনের ডাল তাহে দিলেক ঢাকনি।
সুগ্রীবের কাছে থুইল প্রভাতা রজনী।।
সবাকার পাছে গেল বীর হনুমান।
আইল লইয়া জল সর্ব্ব আগুয়ান।।
গয় গবাক্ষ শরভ আর গন্ধমাদন।
কেশরী কুমুদ আর সুষেণ-নন্দন।।
মহেন্দ্র দেবেন্দ্র আর বানর পনস।
আনিল তীর্থের জল হাজার কলস।।
সীতাসহ শ্রীরাম বৈসেন সিংহাসনে।
অভিষেক করিল সুগ্রীব বিভীষণে।।
স্বর্গ মর্ত্ত্য পাতালেতে দু-রাজা সঞ্চারে।
দুই রাজা ছত্র ধরে রামের উপরে।।
পৃথিবীতে যত রাজা আছে চতুর্ভিত।
শ্রীরামের অভিষেকে দ্বারে উপস্থিত।।
স্বর্গলোক মর্ত্ত্যলোক আইল পাতাল।
অয্যোধ্যায় ত্রিভুবন হইল মিশাল।।
রহিবার স্থান নাই সৈন্য কলকলি।
নানা শব্দে বাজে বাদ্য আর করতালি।।
চারিভিতে চামর ঢুলায় রাজগণ।
রামের সম্মুখে স্থিত ভাই তিন জন।।
বিরিঞ্চি বলেন নাহি যাব রাম-স্থান।
দেবকন্যাগণে গিয়া করুক কল্যাণ।।
দেবতা তেত্রিশ কোটি রহে অন্তরীক্ষে।
দেবকন্যাগণ গেল রামের সম্মুখে।।
কৃত্তিবাস পণ্ডিত্বের কবিত্ব সুধাভাণ্ড।
রামরাজা গাহিলেন গীত লঙ্কাকাণ্ড।।