রামায়ণ : লঙ্কাকাণ্ড – সীতার অগ্নি-পরীক্ষা
শ্রীরাম ব্যাকুল অতি হরিষ বিষাদে।
সতী স্ত্রী ছাড়িতে চান লোক-অপবাদে।।
কারে কিছু না বলেন জানকী সভায়।
মনে মনে ভাবিছেন কি হবে উপায়।।
বহিছে চক্ষুর জল শ্রীরাম কাতর।
সীতারে বলেন কিছু নিষ্ঠুর উত্তর।।
আমার না ছিল কেহ সীতা তব পাশ।
ব্যবহার তোমার না জানি দশমাস।।
সূর্য্যবংশে জন্ম, দশরথের নন্দন।
তোমা হেন নারীতে নাহিক প্রয়োজন।।
তোমারে লইতে পুনঃ শঙ্কা হয় মনে।
যথা তথা যাও তুমি থাক অন্য স্থানে।।
এই দেখ সুগ্রীব বানর-অধিপতি।
ইহার নিকটে থাক যদি লয় মতি।।
লঙ্কার ভূপতি এই বীর বিভীষণ।
ইহার নিকটে থাক যদি লয় মন।।
ভরত শত্রুঘ্ন মম দেশে দুই ভাই।
ইচ্ছা হয় থাক গিয়া তাহাদের ঠাঁই।।
যথা তথা যাও তুমি আপনার সুখে।
কেন দাঁড়াইয়া কান্দ আমার সম্মুখে।।
থাকিতে রাক্ষস-ঘরে না হত উদ্ধার।
ত্রিভুবনে অপযশ গাহিত আমার।।
ঘুচিল সে অপযশ তোমার উদ্ধারে।
মেলানি দিলাম এবে সভার ভিতরে।।
যতেক বলেন শ্রীরাম তারে রুক্ষ-বাণী।
রোদন করেন তত শ্রীরামের ঘরণী।।
কেহ কিছু নাহি বলে স্তব্ধ সর্ব্বজন।
ধীরে ধীরে কন সীতা মুছিয়া নয়ন।।
জনক-রাজার বংশে আমার উৎপত্তি।
দশরথ শ্বশুর যে তুমি মম প্রতি।।
ভালমতে জান প্রভু আমার প্রকৃতি।
জানিয়া শুনিয়া কেন করিছ দুর্গতি।।
বাল্যকালে খেলিতাম বালক মিশালে।
স্পর্শ নাহি করিতাম পুরুষ-ছাওয়ালে।।
সবেমাত্র ছুঁইয়াছে পাপিষ্ঠ রাবণ।
ইতর নারীর মত ভাব কি কারণ।।
হনুকে আমার কাছে পাঠালে যখন।
আমারে বর্জ্জন কেন না কৈলে তখন।।
বিষ খাইতাম অগ্নি করিতাম প্রবেশ।
লঙ্কার ভিতরে এত না পাইতাম ক্লেশ।।
কটক পাইল দুঃখ সাগর বন্ধনে।
আপনি বিস্তর দুঃখ পাইলে যে রণে।।
এতেক করিয়া কর আমারে বর্জ্জন।
তুমি হেন স্বামী বর্জ্জ বৃথায় জীবন।।
ঋষিকুলে জন্মিয়া পড়িনু সূর্য্যকুলে।
আমার কি এই ছিল লিখন কপালে।।
বেশ্যা নটী নহি আমি পরে কর দান।
সভা বিদ্যমানে কর এত অপমান।।
কৃপা করি লক্ষ্মণ করহ এ প্রসাদ।
অগ্নিকুণ্ড সাজাও ঘুচুক অপবাদ।।
লক্ষ্মণ রামের স্থানে চাহেন সম্মতি।
শ্রীরাম বলেন কুণ্ড সাজাও সম্প্রতি।।
সীতার জীবনে ভাই কিছু নাহি কাজ।
অগ্নিতে পুড়ুক সীতা দূরে থাক্ লাজ।।
লক্ষ্মণ রামের বাক্যে সাজাইল কুণ্ড।
বানর-কটক বহু আনিল শ্রীখণ্ড।।
কাষ্ঠ পুড়ি উঠিল জ্বলন্ত অগ্নিরাশি।
প্রবেশ করেন তাতে শ্রীরাম-মহিষী।।
সাতবার রামের চরণে প্রদক্ষিণ।
প্রদক্ষিণ অগ্নিকে করেন বার তিন।।
কনক-অঞ্জলি দিয়া অগ্নির উপরে।
যোড়হাতে জানকী বলেন ধীরে ধীরে।।
শুন দেব বৈশ্বানর, তুমি সর্ব্ব আগে।
পাপ পুণ্য লোকের জানহ যুগে যুগে।।
কায়মনোবাক্যে যদি আমি হই সতী।
তবে অগ্নি তব ঠাঁই পাব অব্যাহতি।।
শিরে হাত দিয়া কান্দে সবে সবিশেষ।
সীতা সতী অগ্নিমধ্যে করেন প্রবেশ।।
অগ্নিতে প্রবিষ্ট মাত্র রামের মহিষী।
ঢালিয়া দিলেক তাহে ঘৃতের কলসী।।
অগ্নি ঘৃত পাইলে অধিক উঠে জ্বলে।
কুণ্ডের ভিতরে রাম সীতারে নেহালে।।
কুণ্ডমধ্যে চান রাম সীতারে না দেখি।
শ্রীরামের ঝরিতে লাগিল দুটি আঁখি।।
দেখেন সংসার শূন্য যেমন পাগল।
ভূমে গড়াগড়ি যান হইয়া বিকল।।
কি করি লক্ষ্মণ ভাই, সীতার কি হৈল।
সাগর তরিয়া নৌকা তীরেতে ডুবিল।।
সীতার বিহনে ভাই সকলি অসার।
অযোধ্যার ছত্রদণ্ড না ধরিব আর।।
অগ্নি হৈতে উঠ সীতে জনক-কুমারী।
তোমার বিহনে প্রাণ ধরিতে না পারি।।
তোমার মরণে আমি বড় পাই দুঃখ।
অগ্নি হৈতে উঠ প্রিয়ে দেখি চাঁদমুখ।।
চতুর্দ্দশ বর্ষ ভ্রমিলাম নানা দেশে।
সব দুঃখ ঘুচিত থাকিতে যদি পাশে।।
লঙ্কার রাবণ রাজা দশমুণ্ডধর।
কুড়ি হাতে যুঝে যেন যমের সোসর।।
তাহাকে মারিয়া তোমা করিনু উদ্ধার।
অগ্নিতে পুড়িয়া সীতা হৈলা ছারখার।।
রামের ক্রন্দনে কান্দে সর্ব্ব দেবগণ।
কান্দিছে বরুণ দেব শমন পবন।।
যত লোকপাল কান্দে দেব পুরন্দর।
জলের ভিতরে থাকি কান্দেন সাগর।।
নল নীল কান্দে আর সুগ্রীব বানর।
জাম্ববান সুষেণ যে বালিব কোঙর।।
হনুমান বলে কেন কান্দে হে লক্ষ্মণ।
আমি জানি সীতার যে নাহিক মরণ।।
শ্রীরামেরে ডাকিয়া বলেন দেবগণ।
না কান্দে না কান্দ সীতা পাইবে এখন।।
কান্দিতে কান্দিতে রাম ছাড়েন নিঃশ্বাস।
সীতার পরীক্ষা-গীত গান কৃত্তিবাস।।