হোটেল রুমের বারান্দায়
০৭.
সন্ধ্যা মিলিয়েছে। আমি হোটেল রুমের বারান্দায় বসে আছি। বারান্দা থেকে সুইমিংপুল, নারকেল গাছের মাথা, মাখার ফাঁকে সমুদ্র দেখা যায়। রুমসার্ভিসে চায়ের অর্ডার দেওয়া হয়েছে। চা এখনো আসে নি। দুই পুত্রই সারা দিনের পরিশ্রমের পর ঘুমুচ্ছে। সহজে তাদের ঘুম ভাঙবে এরকম মনে হয় না।
সেহেরি এবং নাজমা ভাবিকে হাত ধরাধরি করে সুইমিং পুলের পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে দেখলাম। মনে হয় সমুদ্রের দিকে যাচ্ছেন। স্বামী-স্ত্রীর ভেতর যত বৈরী সম্পর্কই থাকুক বিদেশে তা প্রকাশ করা হয় না। বিদেশে ‘সখী ধরো ধরো’ অবস্থা থাকে।
চা এসেছে। শাওন টি-পট থেকে চা ঢালছে। আমি সিগারেট ধরালাম। শাওন আড়চোখে দেখল, কিছু বলল না। দেশের বাইরে বেড়াতে গেলে আমার উপরি পাওনা হলো বিনা বাধায় সিগারেট ফোঁকা। শাওন রাগারাগি করে ভ্রমণের আনন্দ নষ্ট করতে চায় না। সারা জীবন দেশের বাইরে থাকতে পারলে মন্দ হতো না। পায়ের উপর পা তুলে সিগারেট টানা।
শাওন বলল, আমি ছোট্ট একটা ভুল করেছি। ভুল শোধরাতে চাচ্ছি।
কী ভুল?
পুরো টুর প্রোগ্রাম আমার করা।
এটা ভুল হবে কেন?
তোমার নিজেরও তো কোথাও যেতে ইচ্ছা করতে পারে। এখনো সময় আছে, বলো, বিশেষ কোথাও কি যেতে চাও?
আমি চেয়ারে সোজা হয়ে বসতে বসতে বললাম, চাই।
কোথায় যেতে চাও?
লেনামা মাউনটেন।
সেটা কোথায়?
পূর্ব শ্রীলংকায়। জায়গাটার নাম পানামা পাটু। ঘন জঙ্গলে ঢাকা একটা জায়গা। জঙ্গলভর্তি বন্য হাতি আর লিওপার্ড।
ওখানে কেন যেতে চাচ্ছ?
ঘটনা আছে।
ঘটনা আগে বলো। আমি ইন্টারনেটে বসি। ড্রাইভার দিগায়ুর সঙ্গে কথা বলে দেখি কীভাবে যাওয়া যায়।
আমি আয়োজন করে ঘটনা বলা শুরু করলাম। শাওন চোখ বড় বড় করে শুনছে। চোখ দেখে মনে হচ্ছে সে যথেষ্টই আনন্দ পাচ্ছে।
জে আর টুলকিনের নাম শুনেছ?
না।
হবিটের নাম শুনেছ?
না।
হবিট হচ্ছে জে আর টলকিনের উপন্যাসের চরিত্র। এরা সম্পূর্ণ আলাদা মানবশ্রেণী। তিন ফুট উঁচু। এদের নিজস্ব ভাষা আছে, সংস্কৃতি আছে। দেখতেও মানুষের মতো। ‘লর্ড অব দ্য রিং’ ছবিটা তো দেখেছ?
হ্যাঁ। একসঙ্গে তো দেখলাম।
সেখানে হবিট আছে। মনে পড়েছে?
হ্যাঁ মনে পড়েছে। শ্রীলংকার জঙ্গলের সঙ্গে হবিটের কী সম্পর্ক?
আমি সাবধানে আরেকটা সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললাম, হবিট কোনো কাল্পনিক বিষয় না। নৃতত্ত্ববিদরা এখন মনে করছেন পৃথিবীতে একসময় সত্যি হবিট ছিল।
বলো কী?
ইন্দোনেশিয়ার লিয়াং বুয়া গুহায় খর্বাকৃতি মানুষের কিছু কংকাল পাওয়া গেছে। নৃতত্ত্ববিদদের মাথার চুল ছেঁড়ার অবস্থা। এদের বলা হয় ‘Ebu-gogo’। নৃতত্ত্ববিদরা এদের নাম দিয়েছেন Homo floresienis. হোমারের মহাকাব্য ইলিয়ডে এক জাতির কথা বলা হয়েছে, যারা সবাই বামুন। এ যুদ্ধে পারদর্শী।
শাওন মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, জ্ঞান না ফলিয়ে মূল ঘটনা বলো।
আমি বললাম, মূল ঘটনা বুঝতে হলে জ্ঞান ফলাতেই হবে। গ্রীক দার্শনিক প্লিনি (Pliny) আড়াই ফুট চার ইঞ্চি লম্বা মানবজাতির কথা লিখে গেছেন। তারা থাকত এশিয়া মাইনর, ভারতবর্ষ এবং নীলনদের আশপাশে।
শাওন বলল, তুমি বরং আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে শ্রীলংকার বেটে মানবজাতির কথা বলো।
আমি অতি আগ্রহে আরেকটি সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললাম, শ্রীলংকার এই মানবগোষ্ঠীর নাম নিতেয়ু (Nittaewo)। এদের মূল বাস ছিল পানামা পাটুতে। বাস করত পাহাড়ের গুহায়। এদের কথা প্রথম বলে গহিন জঙ্গলের জংলি মানুষেরা। জংলিদের নাম ভাস (Mass)। ভাসরা নিতেয়ুদের অত্যাচারে তটস্থ থাকত। নিতেয়ুরা ভাসদের শুধু যে খাবার চুরি করত তাই না, সুযোগ পেলেই জংলি মেয়েদের ধর্ষণ করত।
নিতেয়ুরা পাখির মতো কিচিরমিচির করে নিজেদের মধ্যে কথা বলত। ভাসরা তাদের কিছু কিছু কথা বুঝতে পারত। নিতেয়ুরা সাহসী ছিল, তবে কুকুর এবং বন্য মহিষ ভয় পেত।
ভাসরা এক পর্যায়ে অতিষ্ঠ হয়ে কুকুর এবং তীর-ধনুক নিয়ে এদের আক্রমণ করে। নিতেয়ুরা যুদ্ধে হেরে গিয়ে গুহায় আশ্রয় নেয়। তারা তাদের শিশুদের দু’হাতে উঁচু করে ধরে এদের জীবন রক্ষার আবেদন করে। ভাসরা কোনো কথাই শোনে নি। গুহার মুখে তিন রাত তিন দিন আগুন জ্বালিয়ে সবাইকে হত্যা করে।
শাওন বলল, ঘটনা কতদিন আগের?
বেশি দিন না, মাত্র দু’শ বছর আগে।
অদ্ভুত তো! এত কিছু জানলে কোথায়?
আমি ভারিক্কি ভাব নিয়ে বললাম, প্রদীপ এ জয়তুঙ্গা নামের এক স্কলার এদের উপর থিসিস করেছেন। থিসিসের নাম The Hobbits of Srilanka, An analy sis of the legend.
ড্রাইভারকে খবর দিয়ে আনা হয়েছে। আমরা পানামা পাটু যেতে চাই শুনে সে চোখ তুলে বলল, সেটা তো ভয়াবহ জঙ্গল। পুরো জঙ্গল ঘেরা আছে হাই টেনশান ইলেকট্রিক তার দিয়ে, যাতে বন্য হাতি বের হতে না পারে। তোমরা সেখানে যেতে চাও কোন দুঃখে? সেখানে তো থাকার মতো কোনো রেস্টহাউসও নেই।
আমি দিগায়ুর দিকে তাকিয়ে বললাম, আমরা সেখানে যাব না। আরামদায়ক ফাইভস্টার হোটেলের বারান্দায় বসে সমুদ্র দেখে সময় কাটাব। কারণ আমরা সভ্য মানুষ।
পুনশ্চ
সমুদ্র দর্শন করে সেহেরি এবং নাজমা ভাবি ফিরেছেন। নাজমা ভাবি ভয়ানক উত্তেজিত, কারণ তিনি তার হ্যান্ডব্যাগ হারিয়ে ফেলেছেন। হ্যান্ডব্যাগে পাসপোর্ট এবং ডলার। নাজমা ভাবিকে মনে হচ্ছে এক্ষুণি তার হার্ট অ্যাটাক হবে।
আমি বললাম, আপনারা কি হোটেলের রেস্টুরেন্টে চা-নাস্তা খেয়েছেন? সেখানে ব্যাগ ফেলে আসতে পারেন। নাজমা ভাবি উল্কার মতো রেস্টুরেন্টের দিকে ছুটে গেলেন।
সেহেরি হাসিমুখে বলল, খুঁজে মরুক। একটা শিক্ষা হোক।
শাওন বলল, বিদেশে পার্সপোর্ট, ডলার হারানো তো ভয়ংকর ব্যাপার। সেহেরি ভাই, আপনি এত নিশ্চিন্ত কেন?
সেহেরি মুচকি হেসে বলল, ব্যাগ আমি লুকিয়ে রেখেছি। উচিত শিক্ষা।