জেফরি বাওয়া
০৬.
আমরা বেনটোটায় এসেছি। হোটেলের নাম সেরেনডিপ। বলাই বাহুল্য, এই হোটেলের ডিজাইনও জেফরি বাওয়া করেছেন। সব সফরের থিম থাকে। আমাদের সফরের থিম হচ্ছে ‘জেফরি বাওয়া’।
খুব কাছেই জেফরি বাওয়ার বসতবাড়ি। এটা এখন মিউজিয়াম। দর্শকরা টিকিট কেটে মিউজিয়াম দেখবেন, ছবি তুলবেন। জেফরি বাওয়া নব্বই বছর বয়সে দু’হাজার তিন সালে মারা যান। মৃত্যুর আগে তিনি এই বাড়িতেই থাকতেন। দর্শনার্থীরা তাঁর সঙ্গে ছবি তুলতে পারত। তাঁর বইয়ে অটোগ্রাফ নিতে পারত।
তিনি নেই কিন্তু তার বসতবাড়িতে দর্শনার্থীদের ভিড় কমে নি, বরং বেড়েছে। শাওন ক্যামেরা নিয়ে তার ভাবগুরুর বাড়ি দেখতে গিয়েছে। সঙ্গে পুত্র নিষাদ। আমি ছোটটিকে নিয়ে সমুদ্রতীরে বসে আছি।
পাঠকদের অনেকেই হয়তো জানেন, পৃথিবীতে দু’ধরনের সমুদ্র সৈকত আছে। একটা সাধারণ–যেমন, কক্সবাজার সৈকত। অন্যটির নাম সোনালি সৈকত (Golden beach), যার বালি সোনালি।
আমরা সোনালি সৈকতে আছি। আমাদের উপর নারকেল গাছের সারি। প্রতিটি ডাব বা নারকেলের বর্ণ তামার মতো। সোনালি সৈকতের সঙ্গে এই তামা রঙ চমৎকার মানিয়েছে।
আমাদের সঙ্গে প্রচুর সাদা চামড়ার টুরিস্ট। মেয়েগুলোর গায়ে বিকিনি। এরা সূর্যস্নান করছে।
আমি এবং পুত্র নিনিত করছি ছায়াস্নান। আমরা বসে আছি নারকেল গাছের ছায়ায়। পুত্র নিনিত জেগেছে। খুব হাত-পা নাড়ছে। তার সঙ্গে কিছুক্ষণ একতরফা গল্প করলাম। যেমন
আমি : সমুদ্র কেমন লাগছে বাবা?
নিনিতঃ পা দিয়ে ঝাঁকি। অর্থ সম্ভবত আমি তো সমুদ্রে নামি নি। কী করে বলব!
আমি : গায়ে রোদ চিড়বিড় করছে না তো?
নিনিত : কুঁ ওয়া।
আমি : ছায়াতে বসে মজা পাচ্ছ?
নিনিত : অয়
[সিলেটি ভাষায় বলল, হ্যাঁ। বেশিরভাগ সময় সে চাইনিজদের মতো কিচমিচ শব্দ করে। এই প্রথম সিলেটি ভাষা।]
আমাদের কথাবার্তায় সাদা চামড়ার এক বুড়ি ক্যামেরা হাতে এগিয়ে এল। এই বুড়ির গায়েও বিকিনি। থলথলে শরীরে বিকিনি যে কী কুৎসিত দেখায় তা মনে হয় এই বুড়িকে কেউ বলে নি।
বুড়ি বিনয়ের সঙ্গে বলল, আমি কি এই শিশুটির একটি ছবি তুলতে পারি?
বেশিরভাগ পিতা-মাতাই বলত, অবশ্যই তুলতে পারো। আমি বললাম, ছবি তুলতে চাচ্ছ কেন?
বুড়ি বলল, আমার বড় ছেলের একটি ছেলে হয়েছে, দেখতে অবিকল এই শিশুটির মতো। আমি এই গল্পটা তাকে বললে সে বিশ্বাস করবে না। ছবি দেখালে বিশ্বাস করবে।
ছবি তোলো।
ছবি তোলা হলো। একটি ছবি আমাকে তুলতে হলো। সেখানে বুড়ি নিনিতকে কোলে নিয়ে নকল হাসি হাসল।
আমি বললাম, শ্রীলংকা কেমন লাগছে?
বুড়ি বলল, আমি তো শ্রীলংকা দেখতে আসি নি। আমি এখানকার রোদ গায়ে মাখতে এসেছি। আমার দেশ ফিনল্যান্ডে। সেখানকার তাপ এখন শূন্যের ৩০ ডিগ্রি নিচে।
আমি বললাম, তোমার দেশ ফিনল্যান্ড আমি বেড়াতে গিয়েছিলাম। সুইডেন থেকে জাহাজে করে।
বুড়ি অবাক হয়ে বলল, ফিনল্যান্ড কেন গিয়েছিলে?
আমার স্ত্রী এবং পুত্রকে বরফের দেশ দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলাম। তুমি যেমন রোদ দেখে আনন্দে আত্মহারা, তারাও বরফ দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়েছিল।
বুড়ি বলল, তুমি কী করো জানতে পারি।
আমি বললাম, আমি কিছুই করি না। আমাকে বেকার বলা যেতে পারে।
বুড়ি : তুমি কোনো কাজ করো না?
আমি : না।
বুড়ি নিজের জায়গায় ফিরে হাত-পা রোদে মেলে সিগারেট ফুঁকতে শুরু করেছে। আমি পুত্রের সঙ্গে কথোপকথনে মন দিয়েছি। আমি যা-ই বলছি সে তার উত্তরে কুঁ জাতীয় শব্দ করছে। সে এই মুহূর্তে কী ভাবছে, চারপাশের জগতটা তার কেমন লাগছে যদি জানা যেত!
সেহেরি এসে বলল আমার পাশে। তার হাতে আমের জুস (এই দ্বীপে সারা বছর আম হয়।) সেহেরির চোখমুখ উজ্জ্বল। আমি বললাম, ভাবি কোথায়?
সেহেরির মুখ আরও হাসি হাসি হয়ে গেল। সে বলল, নাজমা গেছে স্যুটকেসের তালা কিনতে।
আমি বললাম, তোমাকে খুব আনন্দিত দেখাচ্ছে। তালা কেনার সঙ্গে তোমার আনন্দের সম্পর্ক কী?
সেহেরি বলল, সে প্রতিটি দোকানে ঢুকবে। দোকানের সব তালা পরীক্ষা করবে। শেষে কিনবে না। আবারও প্রথম দোকান থেকে তালা দেখা শুরু করবে। দুপুরে খাওয়ার আগে সে ফিরবে না। আমি এইজন্যেই আনন্দিত।
সেহেরি লম্বা সৈকত চেয়ারে শুয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই নাক ডাকিয়ে ঘুমুতে শুরু করল। সে ঘুমাচ্ছে; তার পাশে গ্লাসভর্তি আমের জুস। সেখানে মাছি ভনভন করছে। সেহেরির নাক ডাকার শব্দে তারা খানিকটা বিভ্রান্ত। সেহেরির নাক ডাকা মাঝে মাঝে সমে এসে হঠাৎ নতুন উদ্যমে বিকট শব্দে শুরু হয়। তখন মাছির ঝাঁক পালিয়ে যায়। সেহেরি একটু ঠান্ডা হলে ভয়ে ভয়ে ফিরে আসে। দৃশ্যটা দেখতে ভালো লাগছে।
আমার হাতে বই। বইটার নাম Outlines of Ceylon History, বইটি প্রকাশিত হয় ১৯১১ সালে। লেখকের নাম Donald Obeyesekere. যথেষ্টই আনন্দ নিয়ে বইটি পড়ছি। এই বই পড়েই জানলাম কবি মিল্টন শ্রীলংকা নিয়ে একটি কবিতা লিখেছেন–
Embassies from regions far remote,
From India and the golden chersonese,
And from utmost India iste, Taprobane.
এখানে laprobane হলো শ্রীলংকা। শ্রীলংকার আদি নাম Taprobane.
শ্রীলংকায় প্রথম বসতি স্থাপন করেন Wijeya (বিজয়)। তিনি তার দলবল নিয়ে কোত্থেকে এসেছিলেন শুনলে পাঠক চমকে উঠবেন। তিনি এসেছিলেন বাংলাদেশ থেকে (Bengal). তার মা’র নাম শচিদেবী। শচিদেবী সেই সময়কার বাংলার রাজার বড় মেয়ে।
কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত এই বিজয় সিংহকে নিয়ে একটি কবিতা লিখেছেন। কবিতার প্রথম দু’টি চরণ–
“আমাদের ছেলে বিজয় সিংহ হেলায় লংকা করিয়া জয়
সিংহল নামে রেখে গেছে তার শৌর্যের পরিচয়।”
কবিতার দুটি চরণ আমাকে দিয়েছেন সাংবাদিক বন্ধু সালেহ চৌধুরী। তিনি যে-কোনো কবিতা একবার পড়লে বাকি জীবন মনে রাখতে পারেন, তবে নিকট মানুষজনের নাম মনে রাখতে পারেন না। তার নাতি-নাতনিদের কার কী নাম এই নিয়ে মাঝে মাঝেই তাকে বিভ্রান্ত হতে দেখা যায়
বিজয় সিংহ বিষয়ে একটি কুৎসিত জনশ্রুতি আমাকে বললেন আর্কিটেক্ট নাট্যকার ও নির্মাতা শাকুর মজিদ। তিনি বললেন, বিজয় সিংহের কোনো পিতা নেই। তার পিতা হলো মা শচিদেবীর পোষা সিংহ। মানুষ এবং সিংহের মিলনে বিজয় সিংহের জন্ম হয়। যে কারণে তার আচার-আচরণ ছিল সিংহের মতো।
এরকম কোনো তথ্য আমি পাই নি। বইপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করে আমি জেনেছি, বিজয় সিংহ তার দলবল নিয়ে অর্ধমৃত অবস্থায় শ্রীলংকায় পৌঁছেন। নারকেল খেয়ে কোনোরকমে তাদের জীবন রক্ষা হয়।
বিজয় সিংহ সিংহের মতো কোনো সাহসও দেখান নি। স্থানীয় নৃপতিকে দলবলসহ নিমন্ত্রণ করে কাপুরুষের মতো সবাইকে হত্যা করেছেন।
প্রাচীন শ্রীলংকা রাবণের দেশ বলে আমরা জানি। রাবণ রামপত্নী সীতাকে হরণ করেছিলেন। অনেক ঝামেলা করে লংকায় অগ্নিকাণ্ড করে সীতাকে উদ্ধার করা হয়।
আসলেই কি এমন কিছু ঘটেছিল? নাকি পুরোটাই গল্পগাথা? বলা কঠিন। শ্রীলংকার লিখিত ইতিহাস শুরু হয় বিজয় সিংহ থেকে। তার আগের ঘটনা মানুষের কল্পনা, জনশ্রুতি, মিথ এবং গল্পগাথা।
পণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়ণের আমার জীবনযাত্রা বই থেকে উদ্ধৃত করছি–
সকালবেলা আমরা সীতা এলিয়া দেখতে গেলাম। লংকা যখন রাবণের দ্বীপ তখন তার রাজধানী আর হরণ করে আনা সীতাকে রাখার একটা স্থান নিশ্চয়ই থাকবে। বাবু মথুরাপ্রাসাদ স্থানটির নির্জনতা আর রমণীয়তা–পাশে বয়ে যাওয়া স্বচ্ছতায়া ছোট নদী আর পাহাড়ের গায়ে ফুলে লাল অশোক গাছগুলো দেখে বললেন, ‘ঠিক, এটাই মহারানী জানকীর অশোকবন।’ বড় শ্রদ্ধাভরে তিনি অশোকের পাতা নিজের কাছে রাখলেন। আমি পাশের পাহাড়ের ঘাসের নিচে দেড় দু’ফুট মোটা কালো মাটি দেখিয়ে বললাম, ‘আর এই দেখুন সোনার লংকার দহন’।
লংকা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করায় আমি বললাম, ‘রাবণের কাহিনীর সত্যতা ব্যাপারে আমি দিব্যি গালতে রাজি নই।
তবে যদি কিছু থেকে থাকে, তো এই’।
সীতাকে সত্যি যদি অপহরণ করে লংকায় আনা হয় তাহলে তার নামে কিছু জায়গার নাম লংকায় থাকার কথা। তা কিন্তু আছে। যেমন, সীতা টালাওয়া (সীতাভূমি), সীতাএলা (সীতার নদী, রাহুল সাংস্কৃত্যায়ন এই জায়গায় এসেছিলেন।), সীতাকুণ্ড (সীতার দিঘি)।
বাল্মীকির রামায়ণ এবং কল্পপুরাণ দুটি গ্রন্থই শ্রীলংকাকে বিশাল মহাদেশ বলে উল্লেখ করেছে, তা কিন্তু না। এই দুই গ্রন্থের সঙ্গে শ্রীলংকার আয়তন মেলানো যায় না। তবে বলা হয়ে থাকে শ্রীলংকার বড় অংশই সমুদ্রে তলিয়ে গেছে। আগে মালদ্বীপও শ্রীলংকার সঙ্গে যুক্ত ছিল।
রাবণ-সীতার রহস্য কোনো একদিন দূর হয়ে যাবে এই আশায় রইলাম।
ইতিহাস চিন্তায় বিঘ্ন ঘটল। নিনিত জেগে উঠেছে। সে দুধ খাবে। একই সঙ্গে তার কান্না থামানো এবং তার জন্য দুধ বানানো দুরূহ কর্ম। ফিনল্যান্ডের মহিলা এগিয়ে এলেন। আমি তার কোলে নিনিতকে দিয়ে নিনিতের জন্যে দুধ বানাতে বানাতে বললাম, তুমি আমার বাচ্চাটির এত ছবি তুললে। এখন তার কান্না সামলাচ্ছ। একবারও তো জিজ্ঞেস করলে না, বাচ্চাটির নাম কী?
মহিলা বিব্রত গলায় বললেন এর নাম কী?
আমি বললাম, এর নাম নিনিত। নামের অর্থ Grace of God.
অবাক হয়ে দেখলাম মহিলাটির মুখ পাংশুবর্ণ হয়ে গেল। সে বিড়বিড় করে বলল, এর নাম নিনিত?
আমি বললাম, হ্যাঁ। ততক্ষণ নিনিতের মুখে দুধের ফিডার দেওয়া হয়েছে। সে কান্না থামিয়েছে। ফিনল্যান্ডের মহিলা অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছেন।
এমন কি হতে পারে যে তার নাতিটির নামও নিনিত! রহস্যময় প্রকৃতি মানুষকে নিয়ে নানান খেলা খেলে। এখানেও কোনো খেলা খেলছে!
আমি মহিলাকে কিছু জিজ্ঞেস করলাম না। সব রহস্য ভাঙতে হয় না।
পুনশ্চ-১
শাওন গুরুগৃহ দর্শন করে ফিরেছে। তার চোখমুখ আনন্দে উজ্জ্বল। জেফরি বাওয়া যে চামড়ার চেয়ারে বসতেন, সেখানে সে নিষাদকে বসিয়ে ছবি তুলেছে। লাইব্রেরি থেকে জেফরি বাওয়ার একগাদা বই কিনেছে। সে হাত নেড়ে নেড়ে বসতবাড়িটা কতটা যে সুন্দর এবং কেন সুন্দর তা বুঝানোর চেষ্টা করছে।
আমি মুগ্ধ হয়ে শুনছি এরকম অভিনয় করলাম। একবার ভাবলাম শাওনকে বলি, তোমার এই গুরু কিন্তু চিরকুমার এবং সমকামী। তারপর ভাবলাম দরকার কী এই প্রসঙ্গের! কথায় আছে–
“যদ্যপি আমার গুরু বেশ্যাবাড়ি যায়
তদ্যপি আমার গুরু নিত্যানন্দ রায়।”
গুরু বলে কথা।
পুনশ্চ-২
জেফরি বাওয়া
কলম্বো শহরে ১৯১৯ সনে জন্মগ্রহণ করেন। ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে পড়াশোনা করেন (১৯৩৮-১৯৪১)। লন্ডনে আইন পড়েন, ব্যারিস্টার হয়ে দেশে ফিরেন। আইন ব্যবসা শুরু করেন। হাতে কিছু টাকাপয়সা আসতেই লুনুগঙ্গায় তিনি পরিত্যক্ত একটি রাবার বাগান কিনে নেন। রাবার বাগানে ঘরবাড়ি তুলতে থাকেন নিজের মতো করে। এই হলো তার আর্কিটেক্ট জীবনের শুরু। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, স্থাপত্যবিদ্যায় তাঁর কোনো পুঁথিগত পড়াশোনা নেই।
তাঁকে বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ এশিয়ান আর্কিটেক্ট বলা হয়ে থাকে। তিনি Sustainable architecture শুরু করার অনেক পরে স্থাপত্যবিদ্যায় Sustainable architecture এর ধারণা আসে। বাওয়ার ডিজাইনের বিশেষত্ব হচ্ছে, ভেতর এবং বাহিরকে মিলিয়ে দেওয়া। বাসস্থানকে প্রকৃতির অংশ করে নেওয়া। মারা যান ২০০৩ সালে, নিজের ডিজাইন করা স্বর্গচারণ লুনুগঙ্গায়।