রাধানগর (Radhanagar) : 08
ময়লাটে সন্ধেটা শেষ হয়ে আসছে এখন। এইবারে কালচে রাত শুরু হবে। আমি তাড়াতাড়ি পা চালাই। চাপা শীত এখন, ধোঁয়া। এটা কি রাধানগর? রাধানগরের রাস্তা দিয়েই তো আমি চলেছি। উজ্জ্বল আকাশে একটা রুপোর চাঁদ ধীরে ধীরে জেগে উঠছে। উত্তুরে হাওয়া বইছে। মাঠের মধ্যে জায়গায় জায়গায় একটা করে ধোঁয়ার শিষ, হয়তো আগাছা পোড়াচ্ছে চাষিরা, হয়তো গোয়ালে ভিজে খড় জ্বালানো হয়েছে। সেই ধোঁয়াই ছড়িয়ে পড়ছে গোটা রাধানগরে, ঢেকে দিচ্ছে এক রহস্যের গুণ্ঠনে ওখানকার বাড়িঘরদোর গাছপালা, মন্দির, মন্দিরটাও। শাঁখের আওয়াজ খোলা আকাশ-বাতাসে ছড়িয়ে যাচ্ছে। ঠাকুর বাড়ি থেকে ঘণ্টা বাজার আওয়াজ আসছে। ঢঙ্ ঢঙ্ ঢঙ্ ঢঙ্ ঢঙ্ ঢঙ্।
ধাক্কা লেগে গেছে কার সঙ্গে।
—দেখতে পাও না? আচ্ছা তো! বিরক্তি প্রকাশ করে লোকটি ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। বোধহয় দেখছে কানা-টানা কি না।
আরে! এ তো কলকাতার রাস্তা! রাধানগরে তো আমার কোনও পরিচয় ছিল না। তবু কেন রাধানগরে ফিরে যাচ্ছি বারবার? এ শহরে আমি আরও অপরিচিত, অজ্ঞাতকুলশীল, এ শহর কাউকে রেয়াত করছে না। কিন্তু তবু এ শহর আমাকে আমার নিজের মতো করে একটা অনুসন্ধানের সুযোগ দিয়েছে। এক ভীষণ জরুরি অনুসন্ধান। কে জানে হয়তো তদন্তও। যে ভাবে আমি মায়ের ঠিকানা পেলাম, তা রূপকথার চেয়েও অদ্ভুত। রোমাঞ্চকর।
জুলাই, অগস্ট, সেপ্টেম্বর তিনটে মাস কাটল আশ্রয়ের সন্ধানে। কোথাও জায়গা পাই না। হস্টেলে শুনলাম এখন যারা পার্ট-টু দেবে তাদের পরীক্ষার পর কিছু সিট খালি হতে পারে। এখন কোনও আশাই নেই। ওয়েটিং লিস্টে নামটা তোলালাম অনেক কষ্টে, তাও শিশিরদা ছিলেন বলে সম্ভব হল। সে সময়টা ছিলাম শিয়ালদার একটা বাসা বাড়িতে, শিশিরদার বন্ধু রাখালবাবুর ঘরে গেস্ট হয়ে। আমার অবস্থা দেখে উনিই বললেন—কদিন তো থাকলে এ ঘরে। যদি খুব অপছন্দ না হয় থেকে যেতে পারো যতদিন প্রয়োজন। আমার যা সিটরেন্ট লাগে তার হাফ দিয়ে দেবে। বাস। আমিও সেমি-অভিভাবক রইলুম। কী বলো শিশির।
আমার তো এ ছাড়া উপায়ও ছিল না। হাতে চাঁদ পেলাম।
খাওয়া-দাওয়া পড়াশোনার তখন দারুণ অসুবিধা। ওই বাসাবাড়িতে তো আর কোনও রান্না-টান্নার ব্যবস্থা নেই! রাখালবাবুর দুপুরের খাওয়াটা বোধহয় অফিস-ক্যান্টিনে হয়। কিন্তু আমার সকালবেলায় চা পাঁউরুটির পর আর বিশেষ কিছু খাওয়াই হয় না। চা খেতাম না, পাঁউরুটিও কোনওদিন খাইনি, কিন্তু অন্য জিনিসগুলো আরও বিশ্রী। দোকানের ভাতে, মাছ, পেঁয়াজ-রসুনের আঁশটে উগ্র গন্ধ পাই, চারদিকে নোংরা। বেশির ভাগ সময়েই পালিয়ে আসতে পথ পাই না। কলেজ ক্যান্টিনে ঘুগনি কি সিঙ্গাড়া, ছুটির পর দোকানে গিয়ে মিষ্টি খেয়ে কাটিয়ে দিই। ও সবে কি আর পেট ভরে? কিন্তু কী করা যাবে? আমি হন্যে হয়ে নিরামিষ ভাতের হোটেল খুঁজি, কোন দোকানে একটু দুধ পাওয়া যাবে খোঁজ করি, আর ফলটল খেয়ে পেটে কিল মেরে বসে থাকি। তা ছাড়া রয়েছে এক বিল্ডিং থেকে আরেক বিল্ডিং-এ ছোটাছুটি করে ক্লাস করা, অজস্র ছেলে-মেয়ের ভিড়ের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া। মায়ের খোঁজ করবার সময়ই পাইনি। সত্যি কথা বলতে কী মনেও ছিল না। অক্টোবরের প্রথমে পুজো, তখন বাড়ি গিয়ে বাবার সঙ্গে দেখা হল না। পরে নভেম্বরে রাসপূর্ণিমার সময়েও গেলাম, সে সময়ে বাবা ছিল বটে, কিন্তু রাত্রে এসে স্রেফ শুয়ে পড়ত। তখন বাবাকে ডেকে মায়ের ঠিকানা জিজ্ঞেস করা আমার সাহসেই কুলোত না। মায়ের কথাবার্তা, গল্প-গাছার পুরনো স্মৃতি হাতড়ে বার হল কয়েকটা সূত্র— মা কোথা থেকে খেলনা এনেছ? —নিউ মার্কেট। নিউ মার্কেট কোথায়? —আমাদের বাড়ি থেকে কাছেই। এইসব সুন্দর সুন্দর ছবি কোথায় পেলে? —পার্ক স্ট্রিট। সেটা কোথায়? আমাদের বাড়ির কাছেই। এ ছাড়া— এলিট সিনেমায় মা ‘থ্রি মাস্কেটিয়ার্স’ ছবি দেখেছিল, সেই গল্প আমি মুগ্ধ হয়ে শুনেছি, ‘লোটাস’ সিনেমাতে মা ‘কিংকং’ দেখেছিল, সে-ও আর এক রোমাঞ্চকর গল্প। এ হলটাও মায়ের বাড়ির কাছে। মা পড়ত সিস্টার নিবেদিতার প্রতিষ্ঠিত স্কুলে, সেটা কিন্তু মায়ের বাড়ি থেকে বেশ দূর।
এই সূত্রগুলো থেকে আমি একটা ম্যাপ আঁকতে চেষ্টা করি। এলিট থেকে লোটাস, লিন্ডসে থেকে পার্ক স্ট্রিট, ঘুরে ঘুরে বেড়াতাম, যদি মাকে হঠাৎ দেখা যায়! মা তো চাকরি করে, বেরোবে নিশ্চয়ই। এই অসম্ভবের অভিযান আমার হয়তো সারা জীবন ধরেই চলত, যদি না একদিন মাকে সত্যিই দেখতে পেয়ে যেতাম। দেখতে পেলাম, পার্ক স্ট্রিট বা লোটাস সিনেমার পাশে নয়, একেবারে আমার কলেজের মাঝ মধ্যিখানে।
সেদিন আমার একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল প্রায় ছুটছিলাম কলেজের করিডর ধরে। হঠাৎ দেখি সামনে খানিক দূরে মা চলেছে কয়েকটা মেয়ের সঙ্গে। ফুল ফুল ছাপ সিল্কের শাড়ি। পায়ে তেমনি পা-ঢাকা পাম্প শু’ পেছন থেকে দেখছি। বুঝতে পারছি অবশ্য ওটা মা নয়, মায়ের মতন ধরনটা। কিন্তু মেয়েটি যখন সামনে ফিরল আমি অবাক মায়ের সঙ্গে ওর মিল দেখে। মামার বাড়ির কথা আমি কিছুই তো জানি না, কিন্তু এই মেয়েটি কোনও না কোনওভাবে মামার বাড়ির পরিবারের সঙ্গে যুক্ত তো থাকতে পারে! এত মিল যখন! সেই থেকে আমি ক্রমাগত ওর পেছনে পেছনে ঘুরছি। ওর সঙ্গে আলাপ করে জানতে হবে ও আমার মাকে চেনে কি না। কিন্তু সাহসে কুলোয় না, তারকের বোন নমিতা ছাড়া আর কোনও এই বয়সের মেয়ের সঙ্গে কথা বলিনি আগে। রায় বাড়ির অল্প বড় দিদিরা আমাকে কোনওদিনই পাত্তা দেয় না। এমনকী গায়ত্রী বা তার দিদি সাবি বা সাবিত্রী আমার সমান সমান আর আমার থেকে সামান্য বড়, কিন্তু ওদের সঙ্গেও আমার কোনও কথাবার্তা হয় না। মহিলা বলতে ন’ জ্যাঠাইমা আর ফুলকাকিমা বাড়ির মধ্যে, আর বাইরে— মাসিমা, অর্থাৎ তারকের মা। এর বাইরে আমার কোনও মহিলা বা মেয়ের সঙ্গে কোনওরকম কথাবার্তারও সুযোগ হয়নি। এখানে এসে দেখছি রাশি রাশি মেয়ে। পথেঘাটে, ট্রামে-বাসে। কলেজটা তো মেয়েতে ভর্তি। ওদের কাছাকাছি হলেই আমার হাত পা পেটের ভেতর গুটিয়ে যেতে চায়। গলা শুকিয়ে যায়। কথা বলব কি? দূর থেকে আমি মায়ের মতো দেখতে মেয়েটির দিকে নজর রাখি। অন্য মেয়েদেরও দেখি। কোনও ভুল করছি না তো? হয়তো এক রকম দৈর্ঘ্য, দেহের গঠন, চুল ইত্যাদি হলেই মেয়েদের এক রকম লাগে। না, তা কিন্তু নয়, আমার মায়ের ছিল ছোট গোল করে কাটা চুল। মাথার চারপাশে চালচিত্রের মতো হয়ে থাকত। এ মেয়েটা দুটো বিনুনি করে, কখনও একটা বিনুনি। তা সত্ত্বেও ওকে দেখলেই মায়ের কথা মনে পড়বে। ওকে দেখতে দেখতে বুঝতে পারি হ্যাঁ, আমার মায়ের এইরকম একটু লম্বাটে মুখ ছিল বটে। এই রকম চেরা চেরা চোখ, পাতলা সরু নাক, ঠিক এইরকম ফুলো ফুলো ঠোঁট।
কিন্তু এত নজর করি বলে বুঝতেই পারছি মেয়েটা বিরক্ত হচ্ছে। অনেকেই বুঝতে পারছে। দু-চার বার কথা বলতে গিয়েও পিছিয়ে এলাম। এত সঙ্কোচ! কলেজে এত লোকের মাঝখানে জিজ্ঞাসাবাদ করাটাও বোধহয় ঠিক না। কী জিজ্ঞেস করব? আপনি কি আমার মায়ের কেউ হন।’ কিংবা ‘আমার মা ইরাবতী রায়কে চেনেন?’ ‘আমার মা হারিয়ে গেছেন, আপনি মনে হচ্ছে ওঁর কেউ হন, খুঁজে দেবেন, আমার মাকে?’ এই সব কিম্ভুত প্রশ্ন যদি আর কারও কানে যায়। আমাকে কি পাগল ভাববে না? একজন ছেলে তার মায়ের ঠিকানা জানে না। সুদ্ধু মুখের মিল দেখে একজন মেয়েকে ধরেছে মুশকিল আসান বলে। ভূ-ভারতে কেউ কখনও শুনেছে এমন কথা?
কলেজ নয়। অন্য কোনও জায়গায় মেয়েটাকে ধরতে হবে। কিন্তু যতবার ওর সঙ্গে বেরোই, এক ট্রামে বা বাসে উঠি, ও উল্টোপাল্টা জায়গায় নেমে পড়ে। বোধহয় ভয় পেয়েছে। অন্য রকম কিছু ভাবছে।
ইতিমধ্যে রাখালবাবুর ওখানে অবস্থা ঘোরালো হয়ে উঠেছে। উনি শিশিরদার কী রকম বন্ধু কে জানে! আমার ওপর রীতিমতো অত্যাচার শুরু করেছেন। যখন-তখন সিগারেট, পান, আনতে দেবেন। আমাকে দেখলেই ওঁকে ফরমাশে পায়। আমরা দুজনেই সকালে জলখাবার খেতে দোকানে যেতাম। উনি এক দিন বললেন- ‘আমারটা একটু নিয়ে আসবে মন্দার, শরীরটা ভাল লাগছে না।’
আমি যত্ন করে ওঁর জন্যে পাঁউরুটি মাখন, তার ওপর পুরু করে চিনি ছড়িয়ে রুমালে করে স্টিলের গরম গ্লাসের চা কোনও মতে ধরে নিয়ে এলাম। বাস, তারপর থেকে ওঁর সকালের জলখাবার নিয়ে আসাও আমার ডিউটি হয়ে গেছে। একটা ছোট্ট অ্যালুমিনিয়মের কেটলি কিনেছেন। তাইতে করে আমি চা এনে দিই। উনি বিছানায় বসে তারিয়ে তারিয়ে খান। রাত্তিরের খাবারটাও আমাকে আনতে হচ্ছে। প্রায়ই উনি রুটি-মাংস খান। মাংসের গন্ধে আমার অন্নপ্রাশনের ভাত উঠে আসে। তার পরে কালী মার্কা বোতল খুলে বিকট গন্ধঅলা মদ খান উনি। খেয়ে বেসামাল হয়ে যান, যা-তা কথা বলেন। এ সব ভাষা আমি আগে কখনও শুনিনি। এক ঢোঁক খাবেন, শয়তানি ভরা চোখে আমার দিকে পিটপিট করে চাইবেন আর বলবেন—কী ভাবছ ছোকরা? তোমার শিশিরদাকে বলে দেবে? তা শিশিরদা তোমার পদ্মপত্রে এক ফোঁটা শিশির বই তো নয়। কত গুণ জানো না তো আর! আমার মতো চারটে মাতালকে ও একা জব্দ করে দিতে পারে!
এ বাসাবাড়িতে ফেরবার পর সমস্ত সময়টা আমার কাটে বিভীষিকার মতো। পড়াশোনা তো দূরের কথা। একটু নিশ্চিন্তে নিজের মনে থাকতে পর্যন্ত পাই না। অথচ এমন তো হবার কথা নয়!
এইচ. এস. পাস করবার পর মনে হয়েছিল জীবনের একটা পর্ব আমার শেষ হয়ে গেল। অন্ধকার পর্ব। এবার হয়তো অন্যরকম দিনকাল শুরু হবে। তারকের বাবা প্রায়ই বলতেন কথাটা— ‘অ্যায়সা দিন নহি রহেগা। চিরকাল কখনও কারও এক রকম যায় না, খারাপ সময়টা আগে কেটে যাওয়া ভাল।’ পরীক্ষার ফল বেরোল। তারক হুগলিতে পড়তে যাবে। আরও কয়েকজন যাবে হুগলিতে। চন্দননগর, শ্রীরামপুরেও অ্যাপ্লাই করছে ওরা। কোথায় হবে তা তো বলা যায় না। হেড সার আমাকে বললেন— ‘কলকাতা চলে যাও মন্দার। আমি যতদূর জানি তোমার টাকা পয়সার অসুবিধে হবে না। তবে আর কী? বড় শহরে না গেলে চোখ খোলে না।’
শিশিরদা ইশারা করে আমায় ডেকে নিলেন স্কুলের মাঠে।
—তোমার বাবার সঙ্গে কথা হয়েছে মন্দার?
—না শিশিরদা, বাবা তো বাড়িতেই নেই। —আমার মুখ শুকিয়ে গেছে। শিশিরদার বোধ হয় দয়া হল। উনি বললেন— ঠিক আছে আমি আপাতত, যা লাগবে দিয়ে দিচ্ছি। ভর্তিটা তো হয়ে নাও। মার্ক শীট বেরোনো পর্যন্ত একটু অপেক্ষা করা তো যায়ই।
সেদিন সন্ধেবেলাতেই পঞ্চা এসে বলে গেল— বড় জ্যাঠামশাই নাকি আমাকে ডেকেছেন। আমাকে ডেকেছেন? বড় জ্যাঠামশাই? আশ্চর্য! পঞ্চাও আমার সঙ্গেই পাস করেছিল। ওকে নাকি ইতিমধ্যেই সেরেস্তার কাজে লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। মেজো জ্যাঠামশাইয়ের ছেলের কাছে ও কাজ শিখছে। আমাকেও কি তাই দেওয়া হবে, না কী? তেমন কিছু হলে আমাকে কিন্তু অবাধ্যতা করতে হবে। তার পরে? তার পরে নিশ্চয় রাস্তা দেখা ছাড়া আমার সামনে আর কিছু থাকবে না।
বড় জ্যাঠামশাই বসে ছিলেন ঠাকুর বাড়ির সেই ডান দিকের ঘরে। বাতি জ্বেলে কী সব লেখাপড়ার কাজই করছেন। আমি গিয়ে দাঁড়াতে, মুখ তুলে বললেন— কে? সোনা? এসো এসো।
আমি এত অবাক হয়ে গিয়েছিলাম যে কথা বলতে পারিনি গোড়ায়। ইনি আমার নাম জানেন? আমাকে নামে চেনেন? আমি তো রাজুর ছেলে, যে রাজু ম্যাম বিয়ে করেছে!
টেবিলটা ঘুরে গিয়ে আমি ওঁকে প্রণাম করলাম। উনি উঠে দাঁড়িয়ে আমার মাথার ওপর হাত রাখলেন, বললেন।
হরের্নাম, হরের্নাম, হরের্নামৈব কেবলং।
কলৌ নাস্ত্যেব নাস্ত্যেব নাস্ত্যেব গতিরন্যথা।।
উনি এভাবে আশীর্বাদ করেন কেন কে জানে!
—তুমি তো এবার পাশ করলে? কী করবে ঠিক করলে?
—পড়ব, কলকাতায়।।
—‘বেশ’, উনি কথা না বার্তা না একটা সোনার হার আমার গলায় পরিয়ে দিলেন। তাতে একটা মাদুলি গাঁথা, বললেন— এটা পরে থাকবে, বুঝলে বাবা?—তা কী পড়বে?
—সায়েন্স।
—ভর্তি হতে তো তোমায় কলকাতায় যেতে হয় তা হলে? যে কোনও কলেজে ভর্তি হলেও চলবে না, হস্টেল চাই। তোমাদের কোনও দাদাকে বলি তা হলে। কবে যেতে চাও?
আমি বললাম— মার্ক শীট বেরোলেই যেতে হবে। শিশিরদা নিয়ে যাবেন বলেছেন।
—শিশিরদা কে?
—আমাদের স্কুলের মাস্টার মশায়
—ভাল। দেখো তো এটা পছন্দ হয় কি না!
উনি একটা লম্বাটে বাক্স আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। দেখি স্টিল ব্যান্ডের কালো ডায়ালের একটা চমৎকার ঘড়ি। বেশ দামি মনে হয়।
—পরের পরীক্ষাগুলোতে তোমার কাজে লাগবে।
উনি কী করে জানলেন? পরীক্ষার সময়ে একটা ঘড়ির অভাবে কী কষ্টটাই পেয়েছি আমি। মুখ ফুটে বাবাকে বলেছিলাম, বাবা কোনও জবাবই দেয়নি! আমাদের এ বাড়ির পঞ্চা, সত্য, গায়ত্রী, আমার বন্ধু তারকের পর্যন্ত ঘড়ি আছে। আমি একাই খালি পনেরো মিনিট, আধ ঘণ্টা অন্তর সময়ের জন্য একে ওকে তাকে বিরক্ত করেছি। জ্যাঠামশাই বললেন, এখন তোমায় হাজার পাঁচেক দিচ্ছি। ভর্তি হয়ে এসো। বই পত্র কেনো, জামা কাপড় যা লাগে। এখন গিয়ে তোমার আর শিশির মাস্টারের কোথাও উঠতেও তো হবে! তারপর রেগুলার কলেজ শুরু হয়ে গেলে একটা মাসোহারার বন্দোবস্ত করে দেব। তখন একটা হিসেব দাখিল করতে হবে সেরেস্তায়। মানে এক্সট্রা কিছু লাগলে।
আমি বললাম— তখন না হয় আমি ট্যুইশনি করে… মানে নিজের খরচ নিজে…
জ্যাঠামশাই একটু অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন, বললেন তোমার মুখে এ কথা শুনে খুশি হলাম সোনা। এখানে তো সব সেই যাকে বলে— কাঁচা টাকা আর পাকা অন্ন এই দুইয়ে মতিচ্ছন্ন।
কিন্তু এ সব কৃচ্ছ্র শুধু শুধু করবে কেন? তোমার পড়াশোনার খরচ তো সব এস্টেটের! রাধামাধবের সন্তান তুমি। খুব ভাল মানুষ হবার চেষ্টা করো। ভালও আবার কৃতীও। আমরা তো তোমার তেমন দেখাশুনো কিছু করতে পারব না। নিজেই নিজেকে বাঁচিয়ে বর্তে রাখতে হবে তোমায়। গর্তে পড়ে যেও না। আর দেখো, সায়েন্স পড়বে ঠিক করেছ। তেমন বুঝেছ, নিশ্চয় পড়বে। কিন্তু এস্টেটের তোমার কাছে আর্জি সময় মতো আইনটা পড়ে নিও। আইনটা পড়া থাকলে আমরা তোমার কাছ থেকে অনেক সাহায্য পাব।
তা এর পরে বাবাও আমাকে সাহায্য করতে চেয়েছিল। নিজের ট্রাঙ্ক থেকে বাবা বালি-কাগজের খামে মুড়ে হাজার টাকা বার করেছিল। আমি যখন বললাম— লাগবে না, বড় জ্যাঠামশাই দিয়েছেন, তখন বাবা একেবারে হতভম্ব হয়ে যায়।
বাবাকে ঘড়িটা দেখালাম। বাবার টাকা ছিল অথচ বাবা জিনিসটা আমায় দেয়নি। ঘড়িটা দেখল বাবা। কিছু বলল না। হারটা খালি আমি দেখালাম না। আমার মন বলল— এটা উপহার নয়, এটা কোনও সম্মান, সম্মানটা পেয়েছি আমি বাবাকে টপকে। দেখলে হয়তো বাবা দুঃখ পাবে। বাবা আমার সুখ দুঃখের কথা না ভাবলেও আমি বাবার সুখ দুঃখের কথা ভেবে থাকি।
তা বাবা পরদিন ভোরে সেই যে বেরিয়ে গেল, তিন দিনের মধ্যে আর ফিরল না।
আমার পছন্দমতো কলেজে ভর্তি হতে পারলাম কই? হস্টেল তো দূরস্থান। রেকমেন্ডেশন ছাড়া ও সব না কি হয় না। আমরা কি অতশত জানি? শেষ পর্যন্ত রাখালবাবুর ঘর!
আজ কলেজে যাইনি। রথী আমাকে ওদের বাড়ি নিয়ে গিয়েছিল এনটালিতে। খাওয়াবে বলে। রথীই একমাত্র ছেলে যার সঙ্গে আমার একটু ঘনিষ্ঠতা হয়েছে। ও কিন্তু আমার সেকশনে পড়ে না। আমার পিওর সায়েন্স। ও ফিজিওলজি নিয়ে পড়ছে। ওর সঙ্গে আমার দেখা হয় কেমিস্ট্রি ক্লাসে।
একদিন কলেজের কাছাকাছি একটা মিষ্টির দোকানে ঢুকেছি, ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করছি ‘আপনাদের এখানে দুধ পাওয়া যায়?’ দুধের অভাবে আমার এত কষ্ট হচ্ছে যে বলার নয়। দোকানদার জবাবই দেয় না। এখানে এই কলকাতায় এইটা খুব দেখছি। বেশির ভাগ দোকানেই দোকানি ক্রেতার কথার জবাব দেয় না। তা, আমার পাশ থেকে কেউ বলে উঠল—‘যারা দুধ রাখে তারা কিন্তু একটা নোটিসও টাঙিয়ে রাখে।’ দেখি একটি চেনা ছেলে। চিনি কিন্তু নাম জানি না।
ও বলল— আমার নাম রথী, রথী দাশ।
—আমি মন্দার রায়।
—এখনও দুগ্ধ পোষ্য আছ? না না লজ্জা পাবার কিছু নেই। আমিও তোমার দলে। আসলে আমরা নিরামিষাশী তো, দুধ ছাড়া থাকতে পারি না।
ও-ও নিরামিষাশী জেনে ওর সঙ্গে আমার একটু ঘনিষ্ঠতাই হয়ে গেল। কথায় কথায় আমার খাওয়া-দাওয়ার কষ্টের কথা ও জেনে গিয়েছিল। ও-ই আমাকে দু-চারটে দোকান দেখিয়ে দেয় যেখানে দুধ ছানা ইত্যাদি পাওয়া যায়। আজ ও আমাকে খাওয়ার নেমন্তন্ন করেছিল। অনেকবার না-না করলাম ও শুনল না।
অনেক দিন পর রথীদের বাড়ি খুব ভাল করে পেট ভরে খেলাম। ওর মা, ঠাকুমা, এঁরা বসে আমাদের খাওয়ালেন। এগুলো অবশ্য আমার অভ্যাস নেই। কিন্তু ওঁরা তো ছাড়বেন না। তবে সুখের বিষয়, বাবা-মা সম্পর্কে তেমন কোনও কৌতূহল ওঁরা দেখাননি। ধরেই নিয়েছেন সকলেই রাধানগরে থাকেন। ওখানকার ঠাকুরবাড়ির ছেলে শুনে আমার খাতির বেড়ে গেল।
রথীদের বাড়ি থেকে বেরিয়েছি। রথীও আমার সঙ্গে আছে। হঠাৎ ও বলল— দেখো ট্রামে ওই মেয়েটি বসে আছে, ও আমাদের সঙ্গে পড়ে। ট্রামের দিকে চেয়ে আমি জানলার পাশে মায়ের মতো দেখতে মেয়েটির মুখটা দেখতে পেলাম। ও কারও সঙ্গে কথা বলছিল। সে ওর পাশে দাঁড়িয়ে ছিল।
তারপরেই রথী বলল— এ মেয়েটা এলিয়ট রোডে থাকে। একটা দোতলা লাল বাড়ি আছে, বারান্দায় অনেক ফুল, সেই বাড়িটা থেকে ওকে বেরোতে দেখেছি। আলাপ করলে হয়। তবে বড্ড ডেঁটো। ফর্সা-টর্সা হলেই ডেঁটো হয় মেয়েগুলো। আমি তখন ভেতরে ভেতরে ভীষণ উত্তেজিত। উল্টো দিকের স্টপে গিয়ে দাঁড়াই। বাস ট্রাম সব ভীষণ ভিড়। কিন্তু রথীকে কাটাতে হবে।
তাই ভীষণ ভিড় একটা ট্রামে কোনও রকমে উঠে পড়ি, অন্য যাত্রীদের গালাগাল খেতে খেতে। একটা স্টপ গিয়েই নেমে পড়ি। রাস্তা-ঘাট আমি তেমন কিছু চিনি না। সহজেই সব গুলিয়ে যায়। তবু সামনে যে গলিটা পেলাম ঢুকে পড়লাম। সার্কুলার রোড দিয়ে গেলে যদি রথীর সঙ্গে দেখা হয়ে যায়! সরু রাস্তাটা। নাম দেখি রিপণ স্ট্রিট। দোকানে-দোকানে জিজ্ঞেস করতে করতে এ মোড় ও মোড় ঘুরে এলিয়ট রোডে পৌঁছই। এবার বারান্দায় ফুলঅলা লাল বাড়ি। প্রচণ্ড নার্ভাস লাগছে। যদি পাই, আমি হয়তো মায়ের খুব, খুব কাছে এসে যাব, হয়তো। মায়ের কাছে এসে যাওয়া মানে অনেক প্রশ্ন, অনেক অনেক কৈফিয়ত। আর যদি না পাই? যদি সবটাই একটা মরীচিকার পেছনে দৌড়োনো হয়, তা হলে ওই ডাঁটিয়াল মেয়েটিকে কৈফিয়ত দিতে দিতে আমার প্রাণ যাবে। ও বিশ্বাসই করবে না, মায়ের সঙ্গে মিল দেখে ওর পিছু নিয়েছি আমি। কারও মা এরকম ভাবে নি-পাত্তা হয়ে যায় জীবন থেকে সে কথা কি কেউ বিশ্বাস করবে? এ জায়গাগুলো আমার সম্পূর্ণ অজানা, এ পাড়ার ছেলেদের হাতে বেধড়ক পিটুনি খাওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। এবং তার পরেও আছে আবার অনুসন্ধান, আবার আরেকটা জীবন লেগে যাবে হয়তো তাতে।
এই সময়েই আমার চোখ ঝলসে গেল হলুদ আলোর বন্যায়। কত ফুল? সূর্যমুখী, ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকা, গাঁদা, কসমস, কত? সমস্ত হলুদ রং। কী সুন্দর! কী অপূর্ব সুন্দর!