রাধানগর (Radhanagar) : 07
বিকেল হয়ে এসেছে। রোদটা আর নেই। কিন্তু রোদের আভাটা এখনও আছে। ডিসেম্বর মাস, অথচ শীতের কোনও কামড়ই নেই। এই রকম বিকেলের দিকটায় উত্তুরে হাওয়ার কতকগুলো ঝাপটা আসে। তাইতে একটু অস্বস্তি লাগে এই পর্যন্ত। সেটাকে শীত বলা যায় না। স্টিফেনকে দেখলে অবশ্য সেটা বোঝা যাবে না। ওকে দেখলে মনে হবে দেশটা নরওয়ে কি সুইডেন, রীতিমতো বরফ পড়ছে। একটা পাঁশুটে রঙের ফুলপ্যান্ট পরেছে স্টিফেন, গায়ে চাপিয়েছে একটা ওভারকোট। চেহারা দেখলে মনে হয় জিনিসটা কম্বলের। ওর টাক মাথায় একটা মাঙ্কি ক্যাপ। ক্যাপটা ও সারা শীতকাল মাথা থেকে নামায় না। নামালেই নাকি ওর জ্বর এসে যাবে। দেখি খুব অনিচ্ছুক মুখে ও উঠোনের কলের মুখে রবারের পাইপটা লাগাচ্ছে।
আমি বললাম— দাও, দাও আমি জল দিয়ে দিচ্ছি।
—তুমি তো একটু আগেই কলেজ থেকে এলে বেবি, টিফিন খেয়েছ?
—দেখো স্টিফেন— আমি বিরক্ত হয়ে বলি— যতই বলো, আমি কিন্তু আর বেবি নেই। টিফিন-ফিফিন খাই না, বুঝলে? দাও দিকি পাইপটা।
গজগজ করতে করতে পাইপটা আমার হাতে তুলে দিল ও। আসলে কিন্তু, বেশ খুশি হয়েছে। জল দিতে গিয়ে একটু আধটু জল তো হাতে পায়ে লাগেই। সেইটা থেকে বেঁচে গেল!
মনে হল দরজাটা কেউ ধাক্কাচ্ছে।
—কে দেখো তো স্টিফেন।
—কে আবার, কেউ না।
—বলছি, কেউ।
স্টিফেন বলল— বেল আছে তো, কেউ এলে বেল বাজাবে।
কলটা বন্ধ করে দিয়ে পাইপটা নামিয়ে রাখি আমি। দরজাটা খুলে দিতে যাই। বিরাট দরজা। তার ওপরে আবার দুটো খিল। একটা কাঠের, একটা লোহার। স্টিফেনের বোধহয় কষ্ট হয় আজকাল এত ভারী খিল খুলতে, তাই অত টালবাহানা।
দরজা খুলে আমি অবাক। সেই ছেলেটা দাঁড়িয়ে। —রাগে ব্রহ্মতালু পর্যন্ত জ্বলে গেছে।
—কী চাও? রুক্ষ, কর্কশ গলায় জিজ্ঞেস করি।
—একটা কথা— ছেলেটা ইতস্তত করে বলল… অনেক দিন ধরে…মানে তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব ভাবছি…তাই… আচ্ছা তুমি ইরাবতী রায় বলে কাউকে চেনো?
আমি হাঁ করে ওর দিকে চেয়ে রইলাম। বলে কী? পাগল, না কী?
বেশ কিছুক্ষণ পরে বলতে পারলাম—
—কেন? কেন বলো তো।
—চেনো কি না বলো না, নিশ্চয় চেনো, তাই না?
ছেলেটার মুখটা লালচে হয়ে উঠেছে। চোখ দুটো…কী বলব… ভীষণ কাতর…।
আমি বললাম— ইরাবতী রায় আমার মা। ওঁকে দিয়ে তোমার কী দরকার?
ছেলেটার মুখটা সাদা হয়ে গেছে, সে কোনওমতে বলল— দরকার? নাঃ। দরকার আর কী? উনি আমারও মা।
আমরা দুজনে দুজনের দিকে গবেটের মতো চেয়ে রইলাম।
শেষকালে আমি জিজ্ঞেস করলাম— তুমি কোথায় থাকো?
—রাধানগর।
—বাবা?
—রাজেন্দ্রনারায়ণ রায়।
আমি ডাকলাম—স্টিফে—ন! —আমার এখন ভীষণ শীত করছে।
স্টিফেন এলে বললাম— একে দিয়ার কাছে নিয়ে যাও। বলবে রাধানগর থেকে রাজেন্দ্রনারায়ণ রায়ের ছেলে দেখা করতে এসেছে। বলতে বলতে আমার ভেতর থেকে কেমন একটা কাঁপুনি আসতে লাগল।
ছেলেটা ভয়ে ভয়ে বলল— দিয়া কে? আমি তাঁকে চিনি না। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আমার মায়ের সঙ্গে একটু দেখা করিয়ে দেবে? একবার একটু দেখা করেই আমি চলে যাব। মাকে বলবে— মন্দার এসেছে।
—তোমার নাম মন্দার? মন্দার রায়?
—হ্যাঁ, তোমার?
—মন্দাকিনী। মন্দাকিনী রায়। দিয়া আমার দিদিমা। মা এখানে নেই। থাকে না। কেটে কেটে বললাম।
স্টিফেনের পেছন পেছন খুব দ্বিধাগ্রস্তভাবে ও আস্তে আস্তে ওপরে উঠে গেল।
এ আমার ভাই? মন্দার-মন্দাকিনী। বেশ মিলিয়ে মিলিয়ে নাম রাখা হয়েছে তো? অথচ ও খুঁজছে ওর হারানো মা-কে। আর আমি আমার বাবা রাজেন্দ্রনারায়ণকে এখনও পর্যন্ত চোখেই দেখিনি! ওর কথা আমাকে বলা হয়নি কেন? ছোটবেলায় মা মাঝে মাঝে রাধানগর যেত। প্রত্যেকবার আমি বায়না ধরতাম সঙ্গে যাব বলে, বাবাকে দেখবার ভীষণ লোভ ছিল আমার, প্রত্যেকবার মা ভয় দেখাত ওখানে গেলে আমাকে আটকে রেখে দেবে, আর আসতে দেবে না। রাগে আমার সমস্ত শরীর অবশ হয়ে আসছে। আমি নীচের পুরনো ড্রয়িংরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলাম।
শুনতে পাচ্ছি— খালেদা ডাকছে বুলা-আ-বুলা-আ! বুলাবাবা!
স্টিফেন বোধহয় দরজায় খটখট করে আওয়াজ করছে। আমি সাড়া দেব না। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে আমার অস্তিত্বের কথাও ও জানত না। কেন? কেন? দুই ভাইবোনের কাছে দুজনের অস্তিত্বের কথা গোপন করে কী মোক্ষলাভ হয়েছে এদের? হঠাৎ বিদ্যুচ্চমকের মতো একটা কথা মনে হল। আমরা দুজনে একই ক্লাসে পড়ি, তার মানে খুব সম্ভব আমাদের একই বয়স। এক বয়সের দুই ভাইবোন হয়? হতে পারে, যদি যমজ হয়। তবে কি আমরা যমজ? কিন্তু আমাদের মধ্যে সাধারণ ভাই-বোনেদের ভেতর যে চেহারার মিল থাকে সেটুকুও তো নেই! যদি যমজ হই, বা যদি আমাদের এক বয়স না হয়, তা হলে ঠিক আছে। কিন্তু বয়স যদি এক হয়, তা হলে আমরা ভাইবোন হতে পারি না। একজনকে মিথ্যে কথা বলা হচ্ছে। কে সে? কেন এত মিথ্যে?
মাকে এখন যদি সামনে পেতাম, আঁচড়ে কামড়ে মেরে ধরে শেষ করে দিতাম একেবারে।