Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » রাধানগর || Bani Basu » Page 6

রাধানগর || Bani Basu

এন্টালির বাস স্টপে এসে দেখি স্টিফেন আসছে। এতবার বারণ করা সত্ত্বেও দিয়া ওকে পাঠাবেই।

রাগ করতে যেতেই, স্টিফেন হাত তুলে বলল—আহা আহা বেবি, শোনোই তো আগে আমার কথা। চিকেন কিনতে এসেছিলাম এন্টালি বাজারে, মনে হল তুমিও তো এদিক দিয়েই যাবে। যদি দেখা হয়ে যায়, আমার ট্রাম ভাড়াটা বেঁচে যাবে।

আমার হাসি পেয়ে যায়।

—কী সুন্দর শাড়ি পরেছ আজ বেবি। —বলতে বলতে স্টিফেনের চোখ দুটো কেমন হয়ে যায়।

—কী হল?

—শাড়িটা যে ছিঁড়ে ফেলেছ বেবি! —ওর চোখ অনুসরণ করে দেখি কাঁধের ওপর, বেশ খানিকটা ছিঁড়ে গেছে।

—এমা, অপ্রস্তুত হয়ে বলি— এত পুরনো শাড়ি, দিয়াকে বললাম পরব না। দেখো তো কী হল!

স্টিফেন বলল— ইসস্‌ —এখন কী করবে? এতটা ছেঁড়া পরে কি তুমি ট্রামে উঠতে পারবে?

আমি ততক্ষণে হাঁটতে শুরু করে দিয়েছি। প্রতিবার পা ফেলছি মনে হচ্ছে, অন্য মচকানো জায়গাগুলোও যদি অমনি ছিঁড়ে যায়!

বাড়ি ফিরতেই দিয়ার ডাক।

বুলা—অ, বুলা—আ।

আচ্ছা জ্বালালে তো বুড়ি?

আত্মরক্ষার সবচেয়ে ভাল উপায় হল আক্রমণ।

আমি ঝাঁঝিয়ে উঠি।

—দেখেছ তো, পুরনো পচা একটা শাড়ি আমায় জোর করে পরালে, পিঁজে গেছে, ছিঁড়ে ছিঁড়ে যাচ্ছে।

—কই দেখি? —বুড়ি ছাড়বে না। আমাকে কাছে ডেকে ছেঁড়াগুলো পরীক্ষা করে দেখল। এবার কি গোল্ডিকে দিয়ে আমায় শোঁকাবে না কি?

—তুই মুসৌরি চলে যা বুলা— কর্কশ গলায় বুড়ি বলল।

আমি খাচ্ছিলাম। টোম্যাটো সুপ করেছে আজ খালেদা। একেবারে টাটকা টোম্যাটো সুপ। টোস্ট খাচ্ছি কামড়ে, পেঁপে-মরিচ আছে। রাত্রে দিয়া এইরকমই খায়। আমিও খাই তাই। জিনিসগুলো তো খারাপ নয়! শেষকালে আমি একটা ফুট সালাড খাব। ক্রিম আর মধু দিয়ে, দিয়া ক্রিমটা বাদ দিয়ে খাবে। খাচ্ছিলাম, খেতে থাকলাম। আমি চুপ করে থাকলেই যাবতীয় বলার কথা বুড়ি বলে ফেলবে।

আমার চেয়ারের পাশে পা মুড়ে বসে আছে গোল্ডি। বাঁ হাত দিয়ে গোল্ডিটাকে একটা আদর করে দিই।

—কিছু বলছিস না যে?

—কী বলব?

—ওই যে বললুম মুসৌরিতে চলে যা।

—তুমি নিজেই জানো সেটা সম্ভব না। ফাইন্যাল পরীক্ষা দেখতে দেখতে এসে যাবে। প্র্যাক্টিকাল ক্লাসগুলো আছে।

—ঠিক আছে। পরীক্ষাটা হয়ে গেলে চলে যাস, আমি তোর ভার নিতে পারব না।

—আরে মেমসাব। একটা হাসির কথা বললে আজ। কে কার ভার নেয় এ বাড়িতে। —আমি হেসে বলি— তাছাড়া একটা ফাইন্যালের পর আর একটা ফাইন্যাল থাকে, তারপর আরেকটা ফাইনাল…।

—মুসৌরিতে মায়ের চোখের সামনে সুবিধে হচ্ছিল না, না?

—মায়েরও অসুবিধে হয়ে থাকতে পারে দিয়া।

—কী বললি?

—ঠিকই বললাম। মা তো এখন একটা কনে বউ। আমার মতো এত বড় একটা মেয়ে সর্বক্ষণ পাহারাদারের মতো ঘুরে বেড়ালে অসুবিধে হবে না?

—একেবারে গোল্লায় গেছিস।

—যাক গোল্লায় যখন চলেই গেছি, মুসৌরিতে আর যেতে হচ্ছে না। দুটো জায়গায় তো আর একসঙ্গে যাওয়া যায় না।

রাগ করে চামচটা হাত থেকে ছুড়ে ফেলে দিল দিয়া।

—কেন মেজাজ খারাপ করছ? কী বলতে চাও, বলো না। ঝেড়ে কাশো, ওল্ড গার্ল, ঝেড়ে কাশো।

—শাড়িটা ছিঁড়ল কী করে?

—আদ্যিকালের শাড়িটা গেছে বলে রাগ করছ? আরে বাবা আমি জানি শাড়িটার সেন্টিমেন্টাল ভ্যালু অনেক। কেন দিলে পরতে?

প্রশ্নটা করেই আমার মনে হল, ইচ্ছে করেই দিয়েছিল দিয়া। তারপর বুঝতে পারলুম স্টিফেনকেও ইচ্ছে করেই পাঠায়। যাতে বেশিক্ষণ না থাকি, স্টিফেন গিয়ে বন্ধ দরজায় ধাক্কা দেয়। সমস্তটাই পরিকল্পিত। তবু দিয়ার পরিকল্পনা আমি ভেস্তে দিয়েছি। তাই রাগ।

—এর পর থেকে তোকে আর ওই টিউটরের কাছে যেতে হবে না।

—বাঃ, না গেলে প্রবলেমগুলো কে সলভ্‌ করবে! ফেল করে যাব যে দিয়া।

—করো ফেল।

—তা হয় না। তুমি বরং স্টিফেনকে আরও একটু তাড়াতাড়ি পাঠিও। ও বসে থাকবে। ভালই। ওরও ফিজিক্স অঙ্কটা শেখা হয়ে যাবে।

আমার নিশ্চিন্ত ভাব দেখে বোধহয় দিয়া একটু আশ্বস্ত হল। আরেকটা চামচ দিয়ে খাওয়াটা শেষ করল। উঠতে উঠতে বলল —ইয়ার্কি করছ করো বুলা। এভাবে চললে পস্তাবে। ভীষণ বিপদে পড়বে। ভেবো না সব বিপদ-আপদ থেকেই আমি তোমায় বাঁচাতে পারব।

—আশ্চর্য দিয়া, আমি আর থাকতে পারি না, —তুমি চেয়েছিলে না প্রদ্যুম্নর সঙ্গে আমি প্রেম করি!

—কে বললে?—ফোঁস করে উঠল বুড়ি, —তাকে তো আমি চোখেই দেখিনি আজও।

—সেটাই কি তোমার আপত্তির কারণ?

—বাজে কথা বলিস না বুলা, প্রেম এক জিনিস আর… এ লোকটা একদম ভাল নয়।

এবার আমি হাসতে থাকি। হাসতে থাকি। দিয়া ভীষণ অস্বস্তি বোধ করতে থাকে। শেষকালে বলে— তুই আমার নাতনি… আমার নাতনি একটা সিনিক হয়ে গেছিস। আমি ভাবতেও পারি না।

দিয়া শুতে চলে যায়। আমি উচ্ছৃঙ্খল, আমি অপ্সরা, আমি আবার সিনিক হলাম।

দিয়াকে কষ্ট দিলাম। দিতে চাইনি। কেন দিলাম? আজ দিয়ার কথায় নিজের একটা নতুন দিকই আবিষ্কার করলাম। আমি তা হলে সিনিক? পৃথিবীর কোনও জিনিস, পবিত্র বলে মান পায় না আমার কাছে। সব কিছুর মূল্য সম্পর্কে আমি সন্দিহান। একটা তিক্ত তামাশার দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে দেখি জীবনটাকে। অথচ আমি এই আমিই স্বভাবে আবার একজন অপ্সরাও বটে, নিজের মধ্যে প্রচণ্ড সঙ্কল্পের নড়াচড়াও তো টের পাই। ঠিক বিপরীত প্রবৃত্তি না হলেও এগুলো তো একসঙ্গে একজনের মধ্যে পাওয়াও দুষ্কর। কেন এরকম উল্টোপাল্টা চরিত্র আমার?

একজন পুরুষ অভিভাবক আমার খুব দরকার ছিল। একজন বাবা, একজন দাদু। বাড়িটাতে শুধু মেয়ে, মেয়ে আর মেয়ে, নানান বয়সের মেয়ে। আর স্টিফেন? ও এতদিন ধরে মহিলাদের চাকরি করছে যে ও-ও মেয়েই হয়ে গেছে। আমার বন্ধুরা, পাড়ার বন্ধুরা তো ওকে স্টিফেন বুড়ি, হাই ওল্ড উওম্যান বলেই ডাকে।

শোবার সময়ে পা টিপে টিপে দিয়ার ঘরে ঢুকি। হালকা নীল আলোয় আমার নিজেকে একটা অলৌকিক প্রাণী বলে মনে হচ্ছে। মানুষ সমান আয়নায়, আমার প্রেতিনী শরীরের ছায়া পড়েছে। দিয়ার বিছানার কাছে এগিয়ে যাই। ঘুমোয়নি এখনও দিয়া? নিঃশব্দে কাঁদছে। মুখটা চোখের জলে মাখামাখি।

আমি ওর কপালে একটা চুমু খাই, আলতো করে গলা জড়িয়ে ধরে।

—তুই ঠিকই বলেছিস— ধরা ধরা গলায় দিয়া বলে— প্রেমের কথা বলবার অধিকার আমার নেই।

—কী বলছ দিয়া? ও কথা আবার আমি কখন বললাম? তুমি বলবে না তো কে বলবে প্রেমের কথা?

—ঠিক নয়। এ কথা ঠিক নয় বুলা। সে বলতে পারত, সে অনেক স্যাক্রিফাইস করেছিল আমার জন্যে। আমি কী করেছিলাম? বড়জোর সহ্য করেছিলাম। সিঁড়ির মতো ব্যবহার করেছিলাম তাকে। আমি যা যা চাই, —তা পাওয়ার জন্যে… আমার সৌন্দর্য ঠিকঠাক প্রকাশিত হতে পারবে এমন সব জায়গায় যাবার জন্য… দিয়া কাঁদতে লাগল।

আমি বললাম— এ ভাবে কেঁদো না দিয়া। সবাই দিতে পারে না, গ্রহণ করাও এক রকমের দেওয়া কিন্তু দিয়া। তুমি রবীন্দ্রনাথের ‘শেষের কবিতা’ পড়েছ? দাদা তোমাকে পড়িয়েছিল?

তোমারে যা দিয়েছিনু সে তোমারি দান।

গ্রহণ করেছো যত ঋণী তত করেছ আমায়।

দিয়া কিন্তু সান্ত্বনা পেল না। বলল— তোর দোষ কী? তোর শরীরে আমারই রক্ত বইছে।

—দাদার রক্তও বইছে দিয়া। আমার বাবার রক্তও বইছে।

অনেকক্ষণ কাঁদল দিয়া, তারপর ফোঁপাতে ফোঁপাতে ঘুমিয়ে পড়ল।

আজ এতদিন পর হঠাৎ আমার মনে হল বাড়িটা বড্ড বদ্ধ। এটাই সবচেয়ে ক্ষতিকর—এই বদ্ধতা। এই পুরনো পাড়ায় বাড়ি তৈরি করে ভাল করেনি দাদা। নিশ্চয় দিয়া চেয়েছিল বলেই এখানে বাড়ি করেছিল। ইচ্ছে করলেই তো অন্য কোথাও করতে পারত! আইলিনকে তার পুরনো পরিবেশ থেকে একেবারে তুলে নিয়ে গেল না কেন বিনয়ভূষণ? ভয় পেয়েছিল তুলে নিয়ে যেতে? এখানে রাখতে আরও ভয় পাওয়া উচিত ছিল। যতই এলা চৌধুরী হয়ে থাক, পাশের গলির আইলিনের কথা নিশ্চয় অনেকে ভুলতে পারেনি। ভুলতে দেয়ওনি। বড্ড বেশি মাংসের গন্ধ এ পাড়ায়। রক্ত-মাংস।

স্কুলের বন্ধুদের মধ্যে অনীতার সঙ্গে আমার খুব ভাব। উত্তর কলকাতার গড়পাড়ে ওর বাড়ি। কয়েকবার আমায় নিয়ে গেছে অনীতা। ওখানে ওর মা, বাবা, ভাই, বোন, বিধবা জেঠিমা, কাকা, কাকিমা এতজন থাকেন। ওদের বাড়ির আবহাওয়া একেবারে অন্যরকম। মনে হয় যেন অন্য দেশ। ওখানে ওরা অনেক মুক্ত, স্বচ্ছন্দভাবে বাস করে। ওদের তেমন কিছু লুকোবার নেই। অন্যদিকে আমি? আমাকে ভেবে-চিন্তে সাবধানে কথা বলতে হয়।

অনীতার বাবা জিজ্ঞেস করলেন—কোথায় থাকো?

রাস্তার নাম শুনে ওর মা বললেন— ওটা তো একেবারে অ্যাংলো পাড়া। অনীতার বাবা অসন্তুষ্ট চোখে ওর মায়ের দিকে তাকালেন।

—আমি তো তখন বলতেই পারতাম আমার দিদিমাই তো একজন অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান। কিন্তু বললাম না তো! আমার মা বাবার কথা জিজ্ঞেস করলে সংক্ষেপে মুসৌরির কথা বললাম। কিন্তু একবারও বললাম কি মুসৌরি থেকে কেন আমি চলে এসেছি। এই সমস্ত সামাজিক অনিয়ম ওঁরা কীভাবে নেবেন সেটা তো জানি না! ওঁদের উদারতার ওপর আমার ভরসা নেই।

অনীতাদের পরিবারের চেয়েও উদার, স্বাধীনচেতা রঙিনদের বাড়ি। রঙিনের বড়দা ইংল্যান্ডে থাকেন, ওদেশিই বিয়ে করেছেন। রঙিন আর ওর বোন সুবচনী একেবারে নিজেদের নিয়ে থাকে। ওদের মা-বাবা দুজনেই বড় চাকরি করেন। তাঁদের ছেলে-মেয়েদের বন্ধু বান্ধবের ব্যাপারে মাথা গলাবার অত সময়ই নেই। তবু, কল্পনা করতে পারি, যদি ওঁরা জিজ্ঞেস করতেন, সব সব কিছু আমি ওদেরও বলতে পারতাম না।

এখন রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে দুপাশের বাড়িগুলোর দিকে তাকালে আমার মনে হয় প্রত্যেকটা একটা দুর্গ, একটা আলাদা দুনিয়া। নিয়মকানুন, বোধ-বুদ্ধি-অনুভূতি, আবহাওয়া সব আলাদা। এ সব জায়গা থেকে নিজের বাড়িতে ফিরে একই সঙ্গে আমার একটা স্বস্তিও হয়। আবার খেদও হয়। স্বস্তির কারণটা বোঝা শক্ত নয়। জলের মাছ জলে ফিরলে স্বস্তি তো হবেই। কিন্তু খেদ কেন? স্বাভাবিক সাধারণ একটা পরিবারে জন্মাইনি বলেই কি খেদ? আপাতদৃষ্টিতে তো আমাদের পরিবারের অস্বাভাবিক কিছু নেই! কত ছেলে-মেয়েই তো মামার বাড়িতে মানুষ হয়। আসল কথা, ওপরের মাটি খুঁড়তে গেলেই, ভেতরকার জলকাদাওলা নরম মাটি বেরিয়ে পড়ে। যেমন আজ। দিয়ার এই কান্না, এই খেদোক্তি যে সে দাদার উপযুক্ত ছিল না, ভালবাসার কথা বলা তার সাজে না, আমার শরীরে তার রক্ত বইছে বলে আক্ষেপ, এ সব কেন? দিয়া আমার কাছ থেকে লুকোতে পারবে না, এর পেছনে কোনও গোপন কারণ আছে।

রহস্যভেদ করার জন্যে যতটা কৌতূহল থাকা দরকার, ততটা যেন আমার আর নেই। যত মাটি খুঁড়ছি জট বেরিয়ে পড়ছে, আরও জট, আরও জট। খুব ক্লান্ত লাগছে। মনে হচ্ছে কী সেই রক্তের অভিশাপ যা আমাকে শুধু শুধুই বহন করতে হবে। কেন মাঝে মাঝেই শুনতে হবে রক্ত তুলে এই তিরস্কার?

আমি চলে যেতে চাই। এই বাড়ি, এই ঘর ছেড়ে। এইসব আসবাব ছবি এখন যেন আমার বিষ মনে হচ্ছে। কী করে লোকে সারা জীবন এক বাড়িতে থাকে? আমি যদি কখনও চাকরি করি, এমন চাকরি করব যাতে আমাকে অনবরত এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় বদলি হতে হয়।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress