রাধানগর (Radhanagar) : 05
—ডেনিমের মিডি-স্কার্টটা খুঁজছিলাম। ডাইং-ক্লিনিং থেকে আনা হয়েছে কি না মনে নেই।
দিয়া বলল—কী খুঁজছিস? কোথাও বেরোবি?
—বাঃ আজ শনিবার না?
শনিবার শনিবার আমি প্রদ্যুম্নদার কাছে পড়তে যাই। এটা ভালই জানে দিয়া, তবু জিজ্ঞেস করবে,—কোথাও বেরোবি?
—আমার ব্লু শিফনটা পর না।
হ্যাঙার সুদ্ধু ব্লু শিফনটা বার করে আনি।
—এটা কবে কিনেছিলে দিয়া? নীল মেঘের মতো শাড়িটাতে হাত বুলোতে বুলোতে আমি জিজ্ঞেস করি।
—বিনু কিনে দিয়েছিল, তোর মাসি হওয়ার পর।—বিনু মানে বিনয়ভূষণ, দাদা।
—বাপ রে কবেকার জিনিস! ছিঁড়ে যাবে না তো।
—মনে তো হয় না।
কিন্তু দিয়ার ব্লাউজ আমার ফিট করল না। দিয়া মানুষটা ছোটখাটো। রোগাও ছিল বেশ। টেনেটুনে যদি বা ব্লাউজটা গলালাম, চার ভাগের তিন ভাগ পিঠ আমার খালি রইল।
আমার নিজের একটা কলার দেওয়া স্কার্টের ব্লাউজ পরে নিই অগত্যা। দিয়ার চেয়ে অনেক লম্বা চওড়া আমি।
—তাড়াতাড়ি আসিস। স্টিফেনকে পাঠাব না কি?
—কী যে বলো! খবর্দার স্টিফেনকে পাঠাবে না—আমি ঝাঁঝিয়ে উঠি। অন্য দিন এই দূরত্বটা আমি হেঁটে মেরে দিই। আজ দেরি হয়ে গেছে। —এমনিতে হাঁটবার কোনও দরকারই নেই। আমাদের রাস্তা থেকে সার্কুলার রোড ট্রামেই যাওয়া যায়, ঘুরে যাবে ট্রামটা। এন্টালির মোড়ে নেমে পড়তে হবে। এবার কনভেন্ট রোড পর্যন্ত এইটুকু পথ হাঁটতে হবে।
ট্রামেই সুপ্রিয়ার সঙ্গে দেখা। রোজ এটা হবে। ওকে আমি এড়াতে পারি না। আমরা দুজন দুজনকে দেখতে পারি না। দেখা হলেই কথা কাটাকাটি।
—ইসস্ আজ শিফন পরেছিস, তোকে যা লাগছে না!—ও বলল।
আমি কিন্তু ফিরে ওকে কোনও প্রশংসার কথা বললাম না। ও তো সেটাই চায় কিনা। ওকে ওবলাইজ করার কোনও ইচ্ছে আমার নেই। টুকটুকে করে লিপস্টিক মেখেছে ঠোঁটে, চোখে কাজল, কানে লম্বা দুল। আমার চেয়েও লম্বা-চওড়া চেহারা ওর, কিন্তু কখনও শাড়ি পরে না। সালোয়ার কামিজ পরেছে জর্জেটের।
ওর দিকে চেয়ে আমার ভেতরটায় কেমন জ্বালা ধরে। মনে হয় ঠাস করে একটা চড় কষিয়ে দিই। তা তো পারি না, কিন্তু গলায় নিমের রস ঢেলে দিয়ে বলি—যাচ্ছিস তো পড়তে। এত সাজ কীসের রে?
—তুইও তো সেজেছিস। শিফন-টিফন পরে…
—বাস ওইটুকুই। দিয়া বলল ওর এই শাড়িটা পরতে তাই। এটাকে সাজ বলে না।
—তোকে এতেই সাজ-সাজ দেখাচ্ছে। ড্রেসড্-আপ। আমাকে ততটা দেখাতে হলে মেকাপ নিতে হয়।
—তা হলে সেজেছিস স্বীকার করলি।
সুপ্রিয়া শ্রাগ করল। মেকাপ নিতে হয়-টয় কথাগুলো ও একদম ফালতু বলল। ও যথেষ্ট ফর্সা। চোখ-মুখও খুব কাটা-কাটা। সুন্দর যাকে বলে।
স্টপে নেমে দেখি রঙিন, অনিমেষ আর কাকলিও যাচ্ছে। ব্যস এই পাঁচ জনেই আমাদের ব্যাচ।
প্রদ্যুম্নদা আমাদের ফ্রেন্ড, ফিলসফার অ্যান্ড গাইড। শুধু ফিজিক্স ম্যাথসই বোঝান না, জীবনের অনেক সমস্যার সমাধান, অনেক রহস্যের উন্মোচন, অনেক দুর্বোধ্য জিনিস হৃদয়ঙ্গম করতেও সাহায্য করেন। ‘সাহায্য’, ওই ‘সাহায্য’ কথাটার বিশেষ গুরুত্ব। কাকলির বাবা ক্যানসারে মারা গেলেন। রোগটা ধরা পড়ার ঠিক এক মাসের মাথায় শেষ। কাকলির এত মন ভেঙে গিয়েছিল সে পড়াশোনা তো করতই না, পরীক্ষায় বসতেও ওর ইচ্ছে ছিল না। খালি বলে—কত রকমের চিকিৎসা আছে, বাবা চিকিৎসার আগেই চলে গেল।
প্রদ্যুম্নদা একদিন বললেন—কাকলি, চিকিৎসা চিকিৎসা তো করছ। চিকিৎসা মানে তো কেমোথেরাপি, আর রেডিয়েশান। তো এই চিকিৎসা যে রোগটার থেকেও কষ্টকর তা কি তুমি জানো? তার পরেও মৃত্যু কেউ আটকাতে পারত না, হয়তো কিছুটা পেছিয়ে দেওয়া যেত। আর সেই অতিরিক্ত আয়ুর প্রতিটি মুহূর্ত তোমার বাবা মৃত্যু-যন্ত্রণা পেতেন, ডাক্তারকে চিকিৎসাশাস্ত্রকে আর তোমাদের সবাইকে অভিশাপ দিতেন। একটা মানুষকে, তার প্রিয় শরীরকে টেনে হিঁচড়ে কুৎসিততম অবমাননার মধ্যে ফেলে তাকে নিঃস্ব করে তবে মারা। তোমার তো সান্ত্বনা পাওয়া উচিত যে তোমার বাবা অন্তত সেই কষ্ট থেকে রেহাই পেয়েছেন।
জীর্ণ বসন, একেবারে আক্ষরিক অর্থেই ওঁর শরীরটা জীর্ণ হয়ে গিয়েছিল। বয়সে নয়, রোগে জীর্ণ। সেই জীর্ণ বাস ত্যাগ করে উনি নতুন বস্ত্র পরেছেন। বুদ্ধ কী বলেছিলেন জানো?—এই দেহ জীর্ণ শকটের মতো হয়ে গেছে। একে দিয়ে আর কিছু করানো যাবে না, এই দেহ এবার আমি ত্যাগ করব। তোমার দিক থেকে আসলে খারাপ লাগছে কেন? মা-বাবা জীবনের সব বিপদ আড়াল করে তোমার পাশে দাঁড়িয়ে নেই। চিন্তাটা কতটা স্বার্থপর বুঝতে পারছ তো?
কাকলির সঙ্গে সঙ্গে আমরাও শুনলাম। প্রশ্নটার ভেতরে প্রবেশ করলাম। অন্য কে কতটা করল জানি না। আমি অন্তত করেছি। মাকে আমি আমার দায়িত্ব থেকে মুক্তি দিতে পেরেছি। দিয়াকে অবশ্য পাশে চাই। একসময়ে চাইতাম অভিভাবক হিসেবে, এখন চাই জাস্ট একটা ফ্রেন্ড হিসেবে।
প্রদ্যুম্নদা বলেছিলেন— প্রত্যেকের জীবনের দায়িত্ব আসলে তার নিজেরই। বাবা-মা ইত্যাদি অভিভাবকরা চারপাশে থাকেন বলে আমরা মনে করি দায়িত্বটা তাঁদের। তাঁরা চালনা করছেন বলে আমরা চালিত হচ্ছি। তাঁরা যেমন গড়বেন আমরা তেমন হব। আসলে কিন্তু আমরা যা হয়ে দাঁড়াই, সেটা আমাদেরই ভেতরকার ‘আমি’র তাগিদের ফল। দায়িত্বটা অন্যদের ওপর ন্যস্ত করে আমরা ভারমুক্ত হতে চাই। এটা এক ধরনের ভুল চিন্তা।
এই ব্যাপারটা আমি খুব ভাল বুঝি। কারণ, সেভাবে অভিভাবকদের চাপ আমার ওপর কখনও ছিল না। আমার মা নিজেকে নিয়ে, নিজের কেরিয়ার, নিজের জীবন নিয়েই ব্যস্ত, বাবার কথা তো ছেড়েই দিলাম। একমাত্র দিয়া, দিয়া হচ্ছে এমন একজন মানুষ আমার জীবনে, যাকে সব সময়ে পাশে পেয়েছি। মা কথায় কথায় বলে—একটু বড় হ, বিয়ে দিয়ে দোব। অর্থাৎ কিনা মা আমাকে ঝেড়ে ফেলতে চায়। আমার মনে আছে, যখন নতুন নতুন বড় হচ্ছি, পাড়ার মাইকেল, রুডি, সলোমন এদের সঙ্গে দৌরাত্ম করে বেড়াই তখন মা বলেছিল—ধুৎ, এগুলোকে দিয়ে কী হবে, বয়সে একটু বড়, আর চাকরি-টাকরি করে এমন ফ্রেন্ড জোগাড় কর। কষে প্রেম কর দিকি, একটা জম্পেশ বিয়ে লাগাই।
আর দিয়া? দিয়া তো সব সময়ে মুখিয়ে আছে, আমি প্রদ্যুম্নর সঙ্গে প্রেম করছি কি না জানতে। এই যে একটা শিফন শাড়ি লড়িয়ে দিল।
দেখো মা, দেখো দিয়া প্রেম হয়তো আমি করব। কিন্তু প্রেমটা আমার কেরিয়ার নয়। সরি, মাফ করতে হল। আমি কিছু একটা করব আমার নিজের জন্যে। অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিসে যেতে পারি। ব্যবসা করতে পারি—এখনও একেবারে ঠিক করে ফেলিনি সেটা। কিন্তু কবে কোন বিনয়ভূষণ আসবে, এসে আমায় উদ্ধার করবে, আইলিন থেকে নিজের পছন্দের এলা বানাবে আমাকে, —এ ধাত আমার নয়।
আমি কোনও ভাবেই কোনও দায়িত্ব ওদের ওপরে দিই না। যদি ব্যর্থতা আসে, কখনও বলব না, আমার মা আমাকে সে ভাবে দেখেনি তো, তাই আমি পারিনি। আমার দিদিমা তো এরকম, তাই আমিও অন্যরকম হতে পারলাম না। এ সব দোহাই পাড়ার দিকেই আমি যাই না। এইটুকু বুঝে নিয়েছি বাবা, স্বাস্থ্যটা ভাল আছে, ঘটে বুদ্ধিও মন্দ নয়, ব্যাঙ্কে মালকড়ি আছে, শূন্যে দোদুল্যমান অবস্থা আমার কোনওদিনই হবে না। এও বুঝি এই দিদিমা যতদিন বেঁচে থাকবে, এর দায়িত্ব আমার, মায়ের কথা বরং আমায় তত ভাবতে হবে না। ব্যস, এই আমার অ্যাসেট, আর এই আমার লায়েবিলিটি। এইবার চারপাশ থেকে অর্থাৎ বইপত্র স্কুলকলেজের লেকচার, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে মেলামেশার মধ্যে দিয়ে আর কী আহরণ করতে পারি, তার কোনটা নেব, কোনটা ফেলব, সেটা আমারই সিদ্ধান্ত, আমার খুশি।
অনিমেষ যেমন, নিজে হতে চায় পাইলট, বাড়ি থেকে চায় ও ইঞ্জিনিয়ার হোক। সুপ্রিয়া চায় সিনেমার হিরোইন হতে, ওর বাড়ি থেকে ওকে সি-এ কি এম.বি.এ. হবার জন্যে তৈরি করছে। সুপ্রিয়াটার কথা অবশ্য ধর্তব্যের মধ্যে নয়। ও একটা রাম বাজে মেয়ে। কিন্তু অনিমেষ বা রঙিন ওরাই কি ভাল করে জানে ওরা কী হতে চায়, বা হতে পারবে? আমার সন্দেহ আছে।
বেশ কয়েকটা অঙ্ক আমার মেলেনি। কয়েকটা পারিওনি। সুপ্রিয়াটার সুদ্ধু মিলেছে খালি আমার গুলোই…প্রদ্যুম্নদাকে বললাম—রঙিনকে বলুন না, আমাদের বাড়ি গিয়ে একটু দেখিয়ে দিয়ে আসবে একেক দিন। রঙিনের মাথা আমাদের মধ্যে সবচেয়ে পরিষ্কার। প্রদ্যুম্নদা বললেন—রঙিনকে সাব-কনট্র্যাক্ট দেব বলছ? ও সব ফাঁকিবাজির কারবার আমি করি না।
রঙিন একটু রেলা নিয়ে নিল এই সুযোগে। বলল—আজকে আর সময় নেই। নইলে আজই তোকে বুঝিয়ে দিতাম। ঠিক আছে যাব একদিন তোর বাড়িতে। ওই এলিয়ট রোডে তো? প্রদ্যুম্নদা মাইন্ড করবেন না তো?
প্রদ্যুম্নদা বললেন—সো লঙ অ্যাজ য়ু ডোন্ট ইনটারফিয়ার উইথ দা বেসিক্স্!
ওদের দলটা চলে গেলে প্রদ্যুম্নদা কয়েকটা বুঝিয়ে দিলেন বললেন—এইগুলো কষে ফেলো, আমি একটু ভেতর থেকে আসছি।
এই ঘরটা আগে বোধহয় বৈঠকখানা ছিল, এখন প্রদ্যুম্নদা কোচিং করবার জন্যে ব্যবহার করেন। এ ছাড়াও এঁদের আর একটা ড্রয়িং রুম আছে, সেটা ওপরে। এই ঘরটা থেকে ভেতরের দিকে বেরোলে একটা চওড়া প্যাসেজ, সেটা গিয়ে পড়েছে একটা গোল দালানে, দালান থেকে ওপরের সিঁড়ি উঠে গেছে। বাবা নেই প্রদ্যুম্নদার, মাকে দেখেছি, খুব ভালমানুষ। এ-ই ঘরটা বাকি বাড়ি থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন।
আমার গালের ওপর গরম গাল।
দরজাটা বন্ধ করেছেন তো? —আমি বুঝতে পেরেছিলাম এটা আসছে।
অঙ্কের খাতা হাত থেকে কেড়ে নিয়ে প্রদ্যুম্নদা আমাকে… আলতো করে বুকে হাত রেখেছেন… আহ এত ভাল যে কেন লাগছে? ঠোঁটের মধ্যে মুখ ডুবিয়ে আমার ব্লাউজের বোতাম খুলছেন প্রদ্যুম্নদা, আমি ডুবে যাচ্ছি, ভাল লাগায়, ভাল লাগার নেশায়, ভালবাসা? জানি না, জানি না ভালবাসা কি না, এখন এই নেশা, এই সর্বনাশ ভালবাসছি। বিহ্বল হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন প্রদ্যুম্নদা, মুখটা লালচে। চোখদুটো কালো, গভীর কালো। আমি দু হাতে ওঁর চুলের মুঠি ধরি, কান কামড়ে ধরি আলতো করে। তার পরে যখন উনি প্রায় পাগল, আমিও মাতাল, বে-হেড হবার আগের অবস্থা, ঠিক তখনই সমস্ত শক্তি সংগ্রহ করে উঠে পড়ি। ব্লাউজের বোতাম আঁটি।
—বুলা-আ—গোঙাতে থাকেন প্রদ্যুম্নদা—বুলা-আ—
কোমর থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত আমি মৎস্যনারী। আমার কটিতে চেসটিটি বেল্ট বাঁধা আছে, প্রদ্যুম্নদারা যাতে ভেদ করতে না পারেন। সলোমন, সলোমনের সঙ্গে অভিজ্ঞতা আমাকে এ সব শিখিয়েছে। তখন বালিকা ছিলাম, অসাবধান হওয়া মানাত, এখন বড় হয়ে গেছি, এখন এ সব উপেক্ষা করা যায় না। সলোমন যাতে আমাকে আর বাগে না পায়, তার জন্যে আমি মাইকেল আর রুডিকে নিয়ে চলি। এখন, প্রদ্যুম্নদাকে দূরে রাখবার জন্যে আমি কাকে নিয়ে চলব?
আমি ভেসে যেতে পারি, আবেগে আবেগে ভেতরের চোরা মত্ততায়, আবার ভেসে যেতে গিয়েও ফিরে আসতে পারি, এমনই নিয়ন্ত্রণ আমার শরীর যন্ত্রটার ওপরে। আমার ধমনীতে আইলিনদের রক্ত।
নীল শিফনটা কুঁচির কাছে ছিঁড়ে গেছে। মুচকে গেছে আরও কয়েক জায়গায়।
—কী করেছেন দেখুন প্রদ্যুম্নদা…
—কত দাম শাড়িটার? অমন ক’খানা শাড়ি কিনে দিতে হবে বলো!
—অনেক, অনেক প্রদ্যুম্নদা, তার ওপরে আবার মুক্তোর চোকার, তাতে হিরের সেন্টার পীস, সে রকম চোকার কুইন আলেকজান্দ্রার গলায় থাকে। —তেতো তেতো হাসি হাসতে হাসতে বললাম।
কথাগুলো বলতে আমার কষ্ট হচ্ছে খুব, উজানে ফেরা খুব সহজ কাজ তো নয়, আমার রক্তে এখনও জোয়ার, গলার স্বরে একটা খসখসে হিসহিসে ভাব, নিজেই চিনতে পারছি না নিজের স্বর।
প্রদ্যুম্নদা বুঝতে পেরেছেন, আমি শুধু একটা গহনাই চাইছি না। গহনাটা প্রতীক। কিন্তু কীসের। ওই উল্লেখ কোন পটভূমি থেকে উঠে এল তা উনি বুঝতে পারছেন না। চোখের চশমাটা খুলে কাচগুলো মুছতে লাগলেন উনি। সেই ফাঁকে আমি দরজা খুলে পালিয়ে এলাম। না না চলে এলাম।
আমার ফ্রেন্ড, ফিলসফার, গাইড হতে পারেন প্রদ্যুম্নদা। হতে পারে উনি আমাকে ‘আনা কারেনিনা’ এবং ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’ পড়িয়েছেন। হতে পারে উনি জীবন এবং মৃত্যু, মানুষ এবং প্রকৃতি এবং সম্পর্ক বিষয়ে অনেক কিছু শিখিয়েছেন, কিন্তু এই ঘনিষ্ঠতার অংশীদার হতে হলে প্রদ্যুম্নদাকে আরও পরীক্ষা দিতে হবে, নিজের ক্ষমতার পরীক্ষা, জীবনটাকে পৃথিবীটাকে যে হাতের মোয়ার মতো যেদিকে ইচ্ছে ঘোরাতে পারেন, এটা প্রমাণ করতে হবে, কয়েকজন উচ্চ মাধ্যমিক কি বি-এসসি পরীক্ষার্থীকে সপ্তাহে দুদিন অঙ্ক ফিজিক্স পড়ানোর পুঁজি দিয়ে এতটা কি করা যায়? প্রমাণ করুন প্রদ্যুম্নদা, প্রমাণ করতে করতে যদি অনেকদিন পেরিয়ে যায়? যদি আমি নিজেই বদলে যাই? যেতেই পারি। প্রদ্যুম্নদার জন্যে আমি শবরীর প্রতীক্ষা করে থাকব, এ গ্যারান্টিও দিতে পারছি না। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে কে মহা তালেবর আমি এলাম যে এত মূল্য চাইছি ওঁর কাছে? কীসেরই বা এত অহঙ্কার যে প্রতীক্ষা করার কথা পর্যন্ত দিতে পারছি না! এ-ও তো ঠিক যে এই রোম্যান্স আমার ভাল লাগে। ভাল লাগে বলেই এত দূর আসতে প্রশ্রয় দিয়েছি ওঁকে! সবই ঠিক। কিন্তু এ-ও বোধহয় ঠিক যে উনি আমার সেই স্বপ্নের মানুষ নন। হয়ে উঠতে পারেন কি না সেটা প্রমাণসাপেক্ষ। কিন্তু এই মুহূর্তে আমার ঠোঁটের ওপরে ওঁর ঠোঁট, আমার বুকের ওপরে ওঁর হাত উত্তেজনার তুঙ্গে আমাকে নিয়ে গেলেও তার বেশি তো কিছু পারেনি। আমি যেমন, উনিও তো তেমন ওই কয়েকমিনিটের উত্তেজনার কাছেই মাথা বিকিয়ে বসে আছেন! ব্যাস এর পরেই ওঁর পৌরুষ ফুরিয়ে যাবে। কোথায় সেই ঘোড়া যে আমাকে ছিনিয়ে নিয়ে যাবে এক দুর্গ থেকে আরেক দুর্গে, কোথায় সেই উষ্ণীষ যা আমার পায়ের তলায় নামিয়ে দেবে কেউ, সেই ভূ-স্বর্গ কোথায় যা আমারই জন্য কেউ রচনা করল? রোম্যান্টিক কল্পনাবিলাস! হতে পারে। কিন্তু এখন, এই বয়সে যদি রোম্যান্টিক কল্পনা করার সাহস না থাকে তো পরে কী হবে! তা ছাড়া, এ তো অসম্ভব নয়? আইলিনের জন্যে বিনয়ভূষণ কি ত্যজ্যপুত্র হওয়ার ঝুঁকি স্বীকার করে নেননি? পরিবার, পিতা, সম্পত্তি এ সব ত্যাগ করে আসা শুনতে যত সহজ, করতে কিন্তু তত সহজ নয়, আমায় যদি আজ কেউ বলে দিয়ার সঙ্গে সব সম্পর্ক ছেদ করতে, এই লাল বাড়ির ওপর দাবি ছেড়ে দিতে, দিয়ার গয়নাগুলো সব বিলিয়ে দিতে, আমি পারব? ওই গয়নাগুলো, এই বাড়ির প্রতিটি কোণ আমার জীবনের নানান সময়ের, ভাবনা-চিন্তা, অনুভূতির একেকটা অংশ, এগুলো ছাড়া মানে নিজেরই খানিকটা কেটে বাদ দেওয়া। তো বিনয়ভূষণ তাঁর কিছু অঙ্গ কেটে বাদ দিয়ে দিয়েছিলেন আইলিনের জন্যে। কাজটা বীরপুরুষের। সেখানেই থেমে থাকেননি তিনি। প্রকৃত বীরের মতো আরও অনেক যুদ্ধ জয় করে এসেছিলেন। কোনও দুঃখ, কষ্ট, দারিদ্র্য, সামাজিক অসম্মান সইতে দেননি আইলিনকে। মিসেস এলা চৌধুরী অনায়াসে গেছেন তখনকার সমাজের বাঘা বাঘা লোকেদের বাড়ির অনুষ্ঠানে, পার্টিতে। এই উদাহরণ আজও জীবন্ত হয়ে আমার চোখের সামনে ঘুরে বেড়াচ্ছে, আমি কী করে গতানুগতিকে তুষ্ট হব?
ঠিক আছে, যদি বলো আইলিনদের মতো রূপ আমার নেই। রূপ জিনিসটাই এদের সবচেয়ে মজায়, বড় বড় কাজ করতে, বড় বড় আত্মত্যাগ করতে উদ্বুদ্ধ করে, মানব না অবশ্য, তবু বলছি, তাই যদি হয়, তো বাস্তব পৃথিবীর বাস্তব জীবনে চলতে গেলে যা আবশ্যক হয় সেই নিরিখেই সাফল্য, নিরাপত্তা, সম্পদ উপহার দিক আমাকে। আমার সঙ্গে একটু আধটু সম্পর্ক হবার পর এক বছরেরও ওপর কেটে গেছে, প্রদ্যুম্ন পালিতকে তো উদ্যোগী হতে দেখিনি! ব্যাচের পর ব্যাচ ছেলে পড়িয়ে তাদের বন্ধুত্ব আর উপদেশ দিতে দিতে ক্রমে তোমার পৃথিবী বাসি, ছোট্ট হয়ে যাবে প্রদ্যুম্নদা, তুমি আমার থেকে যা চাইছ, আর আমাকে যা দিচ্ছ, তা তো কোনও স্বপ্ন নয়, যে কোনও মেয়ে ও পুরুষ পরস্পরের থেকে তা পেতে এবং দিতে পারে, এই আকর্ষণ তো সবচেয়ে সাধারণ সবচেয়ে সহজলভ্য, তাই দিয়ে আর তাই চেয়ে কতদূর পর্যন্ত পৌঁছনো যাবে? আর এই পড়ানোর ঘরে, কৃত্রিম ভাবে খানিকটা নির্জনতার ব্যবস্থা করে নিয়ে ছাত্রী শরীর খোঁজার এই উন্মাদনা, এ কিন্তু খুব গোলমেলে অভ্যাস প্রদ্যুম্নদা। প্রতি ব্যাচে তোমার কাছে কিছু ছাত্রী তো পড়তে আসেই। আসবেই। এই সোফায় যেখানে আমাকে নিয়ে মত্ত খেলা খেলেছ সেখানে আরও অনেক বুলা এসে বসে, বসবে। তারা, তাদের শরীরও তোমাকে ডাকবে, তোমারও লোভ হবে সে ডাকে সাড়া দিতে। এখনই, এখনই সোফার ওই জায়গায় সুপ্রিয়া যদি বসে, আমার ভেতরটা জ্বলতে থাকে, মনে হয়, তুমি, তুমিও জ্বলছ, বাসনায়। ভাবতে পারো আমি যদি তোমার দাঁড়ে বসা পোষা ময়না হয়ে যাই তা হলে শুধু আমাদের সেই প্রথম উন্মাদনার স্মৃতিই তোমাকে কতবার ওই সোফায় বসা নতুন মুখ, নতুন শরীরের ফাঁদে ফেলবে? সুতরাং, প্রদ্যুম্নদা ওই পর্যন্তই। তোমার আকর্ষণের ফাঁদে পড়ে আমার অমূল্য স্বপ্নের আকাশ আমি হারাতে চাই না। জীববিজ্ঞান আমরা জানি। জেনে গেছি।
সলোমন আমাকে বলত—ইউ আর আ নিম্ফ।
কী ভেবে কথাটা ও বলত জানি না, আমি কিন্তু বুঝি আমার মধ্যে একটা ওয়াটার নিম্ফ, একটা অপ্সরা আছে। আমি স্বেচ্ছাচারী। ইচ্ছে মতো আমার এর ওর তার ধ্যান ভাঙাতে ইচ্ছে করে। ধ্যান ভাঙার খেলায় আমি নিজেও মেতে যাই। কিন্তু তাড়াতাড়ি, খুব তাড়াতাড়ি, আমার নিজের জলের সাম্রাজ্য আমায় ডাকে। তখন রূঢ়ভাবে খেলা ভেঙে দিয়ে আমি জলে ফিরে যাই।