রাধানগর (Radhanagar) : 16
সেই গল্প দেখি আর থামতে চায় না। খেতে খেতেও গল্প চলে। প্রধান বক্তা মন্দার। প্রশ্নকর্তা দিয়া আর মা। আমি শুধু মাঝে মাঝে ফোড়ন দিচ্ছি। রাধামাধবের মন্দিরের কথা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করছে দিয়া। কত বড় মূর্তি, মাধবের হাতে বাঁশি আছে কি না। কী ভাবে ঠাকুর সাজানো হয়। রাসের মেলা। দিয়া দেখলাম অনেক খবর রাখে। বলল—রাস হল একটা কমিউনিটি ডান্স। যেমন গরবা, যেমন সাঁওতালদের নাচ। বৃন্দাবনের গোপসমাজে এই নাচটা— চলতি ছিল। সব দেশেই পুরুষ-নারীর সমবেত নৃত্যের একটা প্রবণতা দেখা যায় লোকসংস্কৃতিতে। রাস-নৃত্যকে আধ্যাত্মিক অর্থ দিয়েছে বৈষ্ণব শাস্ত্র। আমরা তো এ সব জানি না। মন্দারও জানে না। বলল— আমি অত সুন্দর সুন্দর গানগুলোর রচয়িতা কারা তা পর্যন্ত জানি না সব। ‘চন্ডিদাস কয়’ কি ‘বিদ্যাপতি ভনে’ এই রকম ভনিতা থেকে কয়েকজন পদকর্তার নাম উদ্ধার করেছি এই পর্যন্ত।
কথকতা, যাত্রা, কীর্তনের আসর, প্রদর্শনী…। ওর বাবার মাছ ধরার গল্প বলছিল। মাছ ধরে ধরে না কি ছেড়ে দিতেন, বৈষ্ণব বলে। শেষ বেলায় মাটির দাওয়ায় বসে উচ্ছে-বেগুন থেকে কুমড়ো-বেগুনের অম্বল পর্যন্ত পঞ্চ ব্যঞ্জন দিয়ে ভাত খাবার গল্প, মাঠের মাঝখানে এক বটগাছ তলায় কাঠবেড়ালিদের সঙ্গে খেলতে খেলতে ঘুমিয়ে পড়ার গল্প, ‘অ’ লিখে ফেলবার অপরাধে ওর হাতে-খড়িতে ডিসকোয়ালিফায়েড হয়ে যাবার গল্প আরও কত কী! পূর্ণিমায় ও রকম জ্যোৎস্না না কি কোথাও হয় না।
আমি হাসতে ও বলল—সত্যি বলছি বুলা, ওরকম জোছনার কোয়ালিটি তুমি আর কোথাও পাবে না!
মা হেসে বলল ও রকম মালপোও কিন্তু সত্যিই আর কোথাও খাইনি। তিন রকমের হয়, না মন্দার?
—সুজির, ক্ষীরের আর প্লেইন ময়দার— মন্দার বলল।
—আর সেই থালার মতো লুচি? হয় এখনও?
—হবে না? ওটাই তো রীতি।
—একটা লুচি খেলেই পেট ভরে খায়, বুঝলি বুলা! ওদের ওখানে মোচ্ছবের সময়ে হয়।
দিয়া বলল—‘লুচি মালপোয়া দিয়ে তো রোজই বিগ্রহের সন্ধ্যাবেলার ভোগ দেওয়া হয়। শীতল বলে না! আর রসমুণ্ডি?
—আপনি তো অনেক কিছু জানেন।—মন্দার অবাক হয়ে বলল।
—এ সব রীতি-নীতির কথা শুনেছি তোমার দাদার কাছ থেকে। রসমুণ্ডির কথাও তিনিই বলতেন।
—রসমুণ্ডি খুব শৌখিন জিনিস, সুদ্ধু জন্মাষ্টমীতে হয় আমাদের ওখানে। দিয়া বলল—এত সুন্দর সুন্দর গল্প … ডলিও কোনওদিন বলেনি আমাকে।
মা বলল—স্মৃতি হিসেবেই মা সব অভিজ্ঞতা আমাদের কাছে বেশি সুন্দর লাগে। জানো তো! তখন যেতাম কোন পরিবেশ থেকে কোন পরিবেশে বলো! এখানে এত হই-চই, ফ্রিডম; যা-খুশি খেতে পারি, যেখানে খুশি যেতে পারি, কত রকমের গান চারিদিকে। আর ওখানে? মাটির ঘর, বোষ্টম বোষ্টম গন্ধ, মেয়েরা খালি গায়ে জাস্ট শাড়ি জড়িয়ে থাকে। ওদের জীবনযাত্রাটাই আমার কাছে খুব প্রাচীন, অবসোলিট মনে হত। সব এক ধার থেকে লাল পাড় ধুতি আর লাল পাড় শাড়ি। আমি ওদের ছোঁয়াচ বাঁচাতে চাইতাম। যদি ওরা আমাকে দাবি করে, যদি গিলে ফেলে! তা ছাড়া দেখো, তখন রাজেনকে… মন্দার কিছু মনে করবি না তো!
—উঁহু।
—তখন রাজেনকে কোনওমতে শহরমুখী, কাজ-কর্মে উৎসাহী করে তুলতে আমি আমার সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করছি। ওই পরিবেশ থেকে ওকে সরিয়ে আনাই আমার উদ্দেশ্য ছিল। আমিও যেমন ওঁদের পছন্দ করতাম না, ওঁরাও তেমনি আমাকে পছন্দ করতেন না।
—তোমাকে ওঁরা ‘মেম’ বলতেন। ‘মেম’ ও না, ‘ম্যাম’।—মন্দার হাসল।
—বলতেন বুঝি? হবে।—মাও হাসল—তবে এখন মা—মনে করলে একটা অদ্ভুত রোমাঞ্চ হয়। যেন একটা জায়গায় একটা আলাদা সভ্যতা বেঁচে আছে। ওদের জীবনযাত্রা, জীবনদর্শন একেবারে আলাদা। উত্তর আমেরিকার অ্যামিসদের মতো একটা চার্ম আছে, তাই না মন্দার? আসলে সব কিছু বোঝবার জন্যেই একটা পার্সপেকটিভ লাগে।
—তুমি মন্দারকেও নিয়ে এলে না কেন মা—আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
—ওরে বাবা, সে তো ওর বাবা-জ্যাঠামশায়রা ছাড়তেনই না। ওঁদের কনডিশনই ওই, ছ মাস বয়স হল কি না হল ওঁদের ওখানে নিয়ে যেতে হবে, রাধামাধবের প্রসাদ মুখে দিয়ে অন্নপ্রাশন হবে। সে হবে রাধামাধবের সন্তান। তারপর…
মন্দার বলল— তারপর আর কী? স্ট্রাগল ফর সারভাইভ্যাল… একটু চুপ করে থেকে মা প্রায় ফিসফিস করে বলল— বয়স অল্প ছিল, বুঝিনি অনেক কিছুই… মাদার ইনস্টিংক্টের থেকেও তখন অন্য ইচ্ছে, অন্যরকম তাগিদ জোরালো ছিল অনেক। এখানে এলেই এখানকার হুল্লোড়ে সব ভুলে যেতাম… ক্ষমা নেই সে সব অপরাধের, তবু মন্দার, পারিস যদি… ভুলে যাস… যদি পারিস…।
ওরা সবাই একে একে উঠে গেল। আমরা প্রত্যেকটা সভা আমাদের আরম্ভ করছি খুশি দিয়ে, শেষ করছি অবধারিত প্রশ্নে, বিষাদে। খালেদাকে টেবিল পরিষ্কার করতে সাহায্য করি। তারপর মন্দারের ঘরে ঢুকি। ফুলগুলোর সামনে ও চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। সাদা আর কমলা গ্ল্যাডিওলাস। এরই মধ্যে জল পেয়ে ফুলগুলো কত তাজা হয়ে গেছে।
—এগুলো কে আনল? তুমি?
—আর কে? ওগুলো তোমার পুরস্কার।
—পুরস্কার? কোন কৃতিত্বের জন্য? কী এমন করলাম?
—কৃতিত্ব দুটো। তাই দু’রঙের ফুল। কৃতিত্ব নাম্বার ওয়ান ‘বুলা’ আর কৃতিত্ব নাম্বার টু ‘তুই’। তবে এটা চালিয়ে যেতে হবে। গোঁত্তা খেয়ে যাচ্ছ।
প্রথমটায় ও বুঝতে পারেনি। বোধোদয় হতে হাসল। তারপরে একেবারে সিরিয়াস মুখ করে বলল— কিন্তু তোমার প্রশ্নের উত্তরটা পেলে?
—কী প্রশ্ন?
—ওই যে, ছেলে কার?
আমি বললাম— এ তো জলের মতো স্পষ্ট। ছেলে মায়ের আর মেয়ে মাসির।
—মা বলেছে?
—উঁহু। মা বলেছে আমরা দুজনেই মায়ের— এই না কি গডস ট্রুথ। এটাকে কোয়েশ্চন করা চলবে না।
—তবু প্রশ্ন থাকে। তাই না?
—রাইট।
—তা তুমি তোমার মতো করে একটা সমাধানে পৌঁছেছ। তোমার উত্তর শুনলাম। তোমার যুক্তি? আছে নিশ্চয় কিছু!
—রাধানগর চেয়েছিল তাদের সন্তানকে তাদের কাছেই জমা দিতে হবে। সুতরাং রাধানগরে যে জমা পড়ল সে-ই রাধানগরের…
যুক্তির ব্যাখ্যানে আমি যে একটা চালাকি করলাম মন্দার সেটা ধরতে পারল না। ওর সরলতার বর্মে আঘাত খেয়ে আমার যুক্তিটা ফেরত এল। ও বলল, মন্দারকে রাধানগরে রেখে আসা সত্ত্বেও যখন প্রশ্নটা আমরা একবার তুলেছি, তখন এ যুক্তি তো গ্রাহ্য হতে পারে না। বুলা, আগে কহো আর।
—আজকের অনুশোচনা, ভালবাসা, চোখের জল— এগুলোও প্রমাণ।
—মানুষ কি বোন, বোনের ছেলেকে ভালবাসে না?
—মা বাসত না, মন্দার, টেক ইট ফ্রম মি, বোনের সঙ্গে মার ভীষণ রেষারেষি ছিল। দুজনে এত ঝগড়া হত যে দিয়া ওদের দুজনকে দুজনের সঙ্গে কথা বলতেও বারণ করে দিয়েছিল। কথা বললেই না কি ঝগড়া হত। আর মন্দার, রাধানগরের রাজেন্দ্রনারায়ণকে নিয়েও ওদের দুজনের মধ্যে রেষারেষি ছিল।
—ওগুলো কিছু না। ওতে কিছু প্রমাণ হয় না। ঠিক আছে তোমার সমাধানের কথা বললে। এবার আমার কথা শোনো।
আমার শেষ কথাটা মন্দার গ্রাহ্যের মধ্যেই আনলে না।
—বলো। আমি বললাম।
—আমার সিদ্ধান্ত মন্দার মাসির ছেলে, মন্দাকিনী মায়ের মেয়ে।
—প্রমাণ?
—এক নম্বর প্রমাণ মন্দাকিনীর সঙ্গে মায়ের চেহারার মিল। এমনই নির্ভুল যে সেই মিলের ওপর নির্ভর করেই মন্দার তার মায়ের ঠিকানায় পৌঁছোয়।
—মাসির সঙ্গেও মানুষের মিল থাকে মন্দার। আগে কহো আর, আমিও মজা করে বললাম। খুব একসাইটেড হয়ে গেছি, আসলে, এটা যেন একটা মজার ধাঁধা সমাধানের খেলা, আমাদের জীবন-মরণ সমস্যা নয়।
—দু’নম্বর প্রমাণ ওই মাদার ইনস্টিংকট্ যেটা মা অস্বীকার করতে চাইল।— মন্দার বলল। আমার যুক্তি মাদার ইনস্টিংকটের অভাব নয়, প্রবল তাগিদেই ডলিকে ত্বরিত কিছু ডিসিশন নিতে বাধ্য করে। তার বাচ্চাকে রাধানগরে দিয়ে আসতে হবে, এটাই পূর্বশর্ত, কিন্তু বাচ্চাকে ছাড়া অত সোজা নয়, তাই বোনের ছেলেকেই সে নিজের ছেলে বলে চালায়। আর নিজের মেয়েকে বোনের মেয়ে বলে কাছে রেখে দেয়। তুমি যে বললে বোনের ওপর তার রাগ ছিল, —তো এটাতে সেই বোনের ওপর বিরাগটাও হয়তো কাজ করছিল।
আমি ভাবতাম ও সরল, অনভিজ্ঞ তাই ওর অনেক বোঝাই বোধহয় অসম্পূর্ণ। এ ধরনের বিশ্লেষণ ওর কাছ থেকে আমি একেবারেই আশা করিনি।
বললাম— আর কিছু?
—সবচেয়ে বড় প্রমাণ ওই চেহারাই। তবে এবার, তোমার নয়, মন্দাকিনী, আমার চেহারা।—বলতে বলতে মন্দার গ্ল্যাডিওলাসগুলোকে একধারে সরিয়ে দিল, মাসির ফটোগ্রাফটা পুরো আলোয় বেরিয়ে এল।
—যবে থেকে এখানে এসেছি বুলা কখনও দিয়া, কখনও খালেদা, আমার সঙ্গে দাদার চেহারার মিল নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেন। শেষবার অবাক হল মা। কিন্তু এঁদের কেউই ভেবে দেখেননি, বিনয়ভূষণের সঙ্গে কারও চেহারার মিল এই প্রথম দেখা গেল না। এর আগেও দেখা গেছে, তাঁর ছোট মেয়ের মধ্যে। মেয়ে বলে হয়তো মিলটা তত প্রকট বলে মনে হয়নি, ছেলে বলে আমার ক্ষেত্রে সেটা চট করে স্ট্রাইক করে। কিন্তু আসলে সত্য হল এই মিল আমি সরাসরি পাইনি। পেয়েছি ঘুরপথে, আরেকজনের মধ্য দিয়ে। সোজা কথায় বলতে গেলে আমি মাসির ছেলে। দেখো বুলা, ওই আমার মা।
ও সবগুলো আলো জ্বেলে দিয়েছে। স্পষ্ট লাইট পড়েছে মিলির ছবির ওপরে, তার দিক থেকে সন্ধানী আলো ঘুরিয়ে দিচ্ছে সব অস্পষ্টতা মিলির ছবি থেকে। মিলিই এই রাধা-কাহিনীর চন্দ্রাবলী। ডলির কাছে শেষ পর্যন্ত হেরেই গেছে মিলি। রাজেনকে ভালবাসল দুই বোনই। কিন্তু ডলিই পেল রাজেনকে। সেই বিষাদ মিলির কালো চোখে, কালো-চুলে, গালের ওপর চোখের পাতার কালো ছায়ায়। দিয়া বলেছিল মিলি হয়তো রাজেনের সঙ্গে সুখে ঘর করতে পারত। হয়তো বুঝেছিল বলেই বলেছিল। নিশ্চয় তার চাওয়া ছিল আরও তীব্র, আরও গভীর, নইলে সে জেনেশুনে কেন দিদির প্রণয়ীকে আত্মদান করল? কেন জন্ম দিল সেই সন্তানের? কেনই বা আত্মহত্যা করল তার পরে?
আমি যেন দেখতে পাচ্ছিলাম রাজেন তার বিয়ের পরই উদাস, অলস, কর্মবিমুখ হয়ে যাচ্ছে। সে বুঝতে পেরেছে সে ভুল করে ফেলেছে। মনে মনে সে-ও মিলিকেই চেয়েছিল। নিজের দুর্বল ইচ্ছাশক্তি নিয়ে ডলির ব্যক্তিত্বের সঙ্গে যুঝে উঠতে পারেনি। অতএব সে চলে যাচ্ছে রাধানগরে, সেখানে তাকে আর কোনও সংগ্রাম করতে হবে না। তার চেয়েও বড় কথা সেখানে চলে গেলে ডলি শেষ পর্যন্ত তাকে মুক্তি দেবে।
আমরা দুজনেই মিলিকে দেখতে লাগলাম। মিলির সঙ্গে আমার মায়েরও মিল নেই। দিয়ারও মিল নেই। মিলি খুব বাঙালি-বাঙালি দেখতে। কেমন ছায়াময়ী। কিন্তু দৃঢ় ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। দাদার সঙ্গে খুব মিল, মন্দারের দেখায় কোনও ভুল নেই। চৌকো ধরনের মুখ, যাকে বলে গ্রিসিয়ন কাট, চোখ বড় বড়। গভীর, বিষাদময়। ঠোঁটদুটো ভারী, ঢেউওলা, একেবারে বিনয়ভূষণের মতো। শুনেছি, আমার মা সব বিষয়ে চৌখস ছিল, পড়াশোনা, খেলাধুলো, ডিবেট…। মিলি ছিল ঘরকুনো, লাজুক অথচ জেদি। সিন্ডারেলা। রাজেন্দ্রনারায়ণকে জয় করাটাই বোধহয় ছিল দিদির ওপর ওর প্রথম জিত। তা-ও বিষ হয়ে গেল। সম্পূর্ণ হল কী? দিদির ঘরও তো শেষ পর্যন্ত রইল না! আর তারই সন্তান গিয়ে দিদির শ্বশুরবাড়িতে রাজেনের ছেলে বলে প্রতিষ্ঠা পেল। এর ভেতরে একটা আয়রনি তো দেখাই যায়।
মন্দার বলল—আর, এই সব সাক্ষ্য প্রমাণ ছাড়াও আর একটা প্রমাণ আছে বুলা, সেটা নির্ভর করে হৃদয়ের সাক্ষ্যের ওপর। মাসি যদি আমার মা হয় তা হলে আমার সেই হৃদয়ের সাক্ষ্যটাও মিলে যায়। সারা ছোটবেলা জুড়ে আমি খালি অন্য শিশুদের অন্য বালকদের দেখেছি আর আশ্চর্য হয়েছি। দেখেছি আর আশ্চর্য হয়েছি। আমার আশেপাশের লোকেরাও কম আশ্চর্য হয়নি। মা না থাকে তো সে অভাগা শিশুর হাড়ির হাল হয়, সবাই জানে। কিন্তু যার মা বর্তমান সে খিদেয় কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়ল, আবার খিদেয় কাঁদতে কাঁদতে উঠে পড়ল, তখন দৈবাৎ কারও মনে হল হয়তো এর খিদে পেয়েছে, তখন কেউ এক বাটি দুধ নিয়ে বসল, এটা তুমি ভাবতে পারো? আমার বন্ধু তারকের মা বলতেন স্কুলের পরীক্ষাটা হয়ে গেলে তুমি মায়ের কাছে চলে যেও মন্দার, এভাবে কি মানুষ বাঁচে? মা ছিল না আমার, জন্ম দিয়েই মারা গিয়েছিল তাই, তাই মাতৃহীন শিশুর যা দুরবস্থা হয় তাই আমার হয়েছিল।
ওর যুক্তি একেবারে নির্ভুল। মা বুঝতে পারেনি, কথার ফাঁদে পড়ে মা আমার সত্যি কথাটা বলেই ফেলেছিল। মা-ছাড়া গার্ল-চাইল্ডের বড় হতে অসুবিধে হয় তাই নাকি মা মেয়েটাকে রেখে ছেলেটাকে দিয়ে দিয়েছিল। মায়ের কন্যা-সন্তান হয়েছিল বলেই তো এ প্রশ্ন উঠল। মেয়েটা যদি মাসির হত, তা হলে তো তাকে রাধানগরে পাঠানোর প্রশ্নই উঠত না। মা আমার কাছে ধরা পড়ে গেছে। তবে তা ছাড়াও আমি মোটামুটি মন্দারের মতো করেই যুক্তি সাজিয়েছিলাম। মাসির সঙ্গে ওর চেহারার মিলটা বাদে। এটা আমি সেভাবে খেয়াল করিনি। পাছে ওর আঘাত লাগে বলে অন্যরকম বলেছিলাম। ওর একজন মা দরকার। এত করে অসাধ্যসাধন করে খুঁজে বার করে যদি বোঝে এই মা ওর মা নয় তা হলে ওর কেমন লাগবে? তাই মাকে দিয়ে দিয়েছিলাম ওকে। আমার দরকার একজন বাবার। একটা ফাদার ফিগার। কিন্তু আমার সেই আসল বাবা যিনি মিলিকে ভালবেসে ডলিকে বিয়ে করলেন, আবার ডলিকে বিয়ে করে মিলির সন্তানের পিতা হলেন, সেই চূড়ান্ত বিভ্রান্ত মানুষটিকেও তাই বলে বাবা হতে ডাকব না কোনওদিন। সুতরাং সেই পুরনো পিতৃকল্প মানুষটি ছাড়া আর আমার গতি নেই। আমি দাদার কথা বলছি। বিনয়ভূষণ।
এইবার মন্দার তার চূড়ান্ত বোকামিটা করল। বলল— মানলি তো আমার যুক্তি? বুলা দেখ, এখন বড় জ্যাঠামশাইয়ের দেওয়া এই হার নিয়ে আমি কী করব? আমি তো রাধানগরের কেউ নই?
কিছুক্ষণ আহাম্মকটার দিকে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম। ও তা হলে মিলির ছেলের পিতৃত্ব বিষয়ে কিছুই অনুমান করতে পারেনি। তখন রাজেনকে নিয়ে দুই বোনের রেষারেষির কথা বললাম, তাতেও না। ও তো এইবার আরেকবার গৃহত্যাগ করল বলে, এ দফায় সোজা রাধানগরে গিয়ে বলবে— ‘আজ্ঞে রাধানগরের দেবত্রে আমার বিন্দুমাত্র অধিকার নেই, আমি কি না মাসির ছেলে!’
কড়া গলায় সুতরাং বলতে বাধ্য হলাম— অনেক বকবক করেছিস। আমাদের কলেজে খুব ভাল নাটক হয়। নাম দিস এখন। ডায়ালোগ-টোগ ভালই দিতে পারবি। এখন ‘জয় রাধে’ বলে শুয়ে পড় দিকি। আর শোন, আমরা কিন্তু কাজিন নয়, ভাইবোনই রইলাম, সহোদর নয়, সহবীর্য বলতে পারিস।
—গুড নাইট।
একটা আলোর বল যেন ফেটে গেল ভেতরে। শেষ বলটা ছুড়ে দিয়ে একটা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে মন্দাকিনী বিদ্যুতের মতো চলে গেল। চলে গেল সমস্ত দুঃখ, দ্বিধা, অন্ধকার সঙ্গে নিয়ে। ক্রমশ রাতটা নিখাদ নিশুতি রাত হয়ে গেল, তখনও আমি জেগে। সামনে আমার প্রমাণ সাইজ তৈলচিত্রে আইলিন আর বিনয়ভূষণ। যেন রাধামাধবের মন্দিরের ভেতর দুয়ার খুলে গেছে। শুধু আমার জন্যেই নয়, বিনয়ভূষণের জন্যেও। কবে তিনি প্রেমের জন্য ত্যজ্য হয়েছিলেন, নির্বাসিত হয়েছিলেন এই রকমই কোনও রাধানগর থেকে। কে বলতে পারে হয়তো তিনিই সেই মানুষটি যাঁর আচরণে বিরক্ত হয়ে তাঁর বাবা তাঁকে বঞ্চিত করে ভাগনেদের তাঁর সম্পত্তির অছি করে যান। আজ তাঁর নাতি আমার মধ্যে দিয়ে উনি আবার ওই দেবত্রে ফিরে যাচ্ছেন। আমি যেমন জানতাম না রাধানগর এভাবে আমার রক্তের ভেতরে ঢুকে বসে আছে, তিনিও তেমনি জানতেন না ব্যাপারটা। যখন হারাতে হল, তখনই একমাত্র বুঝতে পেরেছিলেন। মুঠোয় করে সোনার কবচটা দেখতে লাগলাম আমি। এই কবচ আমাকে কেন দিয়েছিলেন বড় জ্যাঠামশাই? কেন? যাতে আমি তাঁদের কাছে বাঁধা থাকি? যত দূরেই যাই আমার বাঁধন, আমার টান যাতে না ঘোচে? এটা তো তা হলে শুধু একটা প্রাপ্তি, একটা স্বীকৃতিই নয়, তার চেয়েও বেশি কিছু। কে জানে একটা মন্ত্রশক্তি কিনা।
না, না। রাধানগরের সঙ্গে আমার সম্পর্ক মন্ত্রের নয়, রক্তের। ঘণ্টার সেই গম্ভীর নিনাদ, সেই উৎসব আর গান, আর সেই পেতলের মূর্তিদুটো! মানুষের মতো যাদের স্নান, আভরণ, আহার, বিহার, শয়ান, জাগরণ! তারাই আমাকে টেনে রেখেছে।
গ্ল্যাডিওলাসগুলো চমৎকার ফুটে উঠেছে। তাদের রঙিন আঙুলগুলো ক্রমাগত ইশারা করছে মিলির সাদা-কালো পৃথিবীটার দিকে। এত বাচ্চা যে ওকে মা বলে ভাবতে পারা যায় না। ও যেন মন্দাকিনীরই জুড়ি, আর একটা বোন আমার। বে-আক্কিলের মতো অসময়ে মরে গিয়ে ও তিরস্কারের যোগ্য হয়ে আছে। যদি ও ভাবে ও নিজেকে শেষ করে না দিত! আমি যেন চোখের সামনে দেখতে পাই আমার এক মা ফিরে আসছে আর এক মা যাচ্ছে। দেখতে পাই মিলি পুবপাড়া থেকে পশ্চিমপাড়ায় হেঁটে যাচ্ছে। আঁচল দিয়ে রোদ আড়াল করল। মিলি চলে যাচ্ছে হিজলবাগানে, মন্দিরতলায়, জ্যাঠামশায়ের সঙ্গে ফর্দ তৈরি করছে রাসের কি জন্মাষ্টমীর মেলার। দামোদরের তীরে জোছনারাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে মিলি, তার মুখ থেকে অন্ধকার সরে যাচ্ছে। মিলির সঙ্গে জোছনা মাখছে একটা ছোট্ট ছেলেও।
—কী দিয়ে আজ ভাত খেলে মন্দার?
—শুকতো, ডাল, ভাজা, অম্বল…
—বাব্বা, অত সকাল সকাল এত সব কে করল মন্দার?
—কেন? মা, আমার মা!
—ও কী! এখনই উঠছ কেন মন্দার। এই তো এলে।
—না, যাই, দেরি হলে মা খুব বকবে আমায় মাসিমা। পড়তে হবে আবার।
বাবা মানুষটাকে কোনওদিন তেমন ভাল লাগেনি আমার। ভালবাসতে পারিনি। অত আলগা-আলগা থাকলে কোনও মানুষকে ভালবাসা যায়? মানুষটা কি সব সময়ে বিবেকের দংশনে ভুগত? মিলির জন্যে? আহা, বাবা জানলও না, তার শুধু একটা ছেলেই নয়, মেয়েও আছে। আমার বদলে ও যদি রাধানগরে যেত তা হলে রাধানগরের রাজেন্দ্রনারায়ণের ইতিহাসটাই অন্যরকম হত।
শরতের ভোরবেলা এখন। মাঠে-ঘাটে কাশ ফুটে আলো করে রেখেছে সব। আর আমার আশেপাশে। এই কোয়ার্টার্সের বাগানে হলুদ, ব্রাউন ডালিয়া-চন্দ্রমল্লিকা। শুধু শীতের মরশুমি ফুলই নয়, সারা গ্রীষ্ম, সারা বর্ষা এখানে ফুল ফোটে। ফোটে সারা বছরের ফুলেরা। চা খেতে খেতে দেখছি অশীতিপর আইলিনকে নিয়ে ইরাবতী শিউলি কুড়িয়ে আনছেন। দুজনের হাতেই বেতের ঝাঁপি ভর্তি শিউলি ফুল। শিউলির গোড়ে মালা গাঁথবেন দুজনে, সেই মালা দিয়ে সাজানো হবে প্রয়াতদের ছবি—বিনয়ভূষণ আর মিলি। আইলিন এখন একটি টুকটুকে বুড়ি। কিন্তু তাঁর রাধা-রাধা ভাবটা বোধহয় কোনওদিন যাবার নয়। হাসলে এখনও মনে হয় ‘গোরোচনা গোরী নবীনা কিশোরী’। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস আমি দাদামশাই বিনয়ভূষণেরই ‘অবতার’। জন্মান্তর থেকে তাঁর রক্তের স্রোত বেয়ে বেয়ে বিনয়ভূষণ আবার দৌহিত্র বংশে ফিরে এসেছেন। এই বিশ্বাস যে তাঁর ক্রিশ্চান সংস্কারের বহির্ভূত, তাতেও আইলিনের কিছু যায় আসে না। বেশি কথা কী, বৃদ্ধা আজকাল বেশির ভাগ সময়েই আমাকে ‘বিনু’ বলেই ডাকেন। দাদামশায়ের ফটোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমারও একেক সময়ে মনে হয় ওটা আমারই ছবি। আমার জীবনে যে সমস্ত নাটকীয়, অবিশ্বাস্য, রোমাঞ্চকর ঘটনা ঘটে গেছে, তাতে করে বিনয়ভূষণের মন্দার হয়ে আইলিনের কাছে ফিরে আসাটা এমন কী আর অবাস্তব?
মায়ের অর্ধেক চুল পেকে গেছে। মুখে অভিজ্ঞতার আঁচড়। ষাট-টাটের কাছাকাছি হল বোধহয় মার। কিন্তু মা এখনও খেলোয়াড়। গটগট করে চলে, চটপট করে কাজ করে, কথায় চিন্তায় কোনও জড়তা নেই। এবং একটা কর্মহীন জীবন কাটিয়ে আমার বাবা যখন বাহান্ন-তিপ্পান্ন বছর বয়সে ফট করে মারা গেল, বাবা অনেক বুড়ো হয়ে পড়েছিল। আমি ওষুধ-ইনজেকশন নিয়ে পশ্চিম পাড়ায় যেতে যেতেই শেষ। বড় জ্যাঠামশাই তো আশি পার করেও দিব্যি খটখটে আছেন।
রাধানগরের দেওয়ানি হিসেবে আমারই অভিষেক হবার কথা। বড় জ্যাঠামশাইয়ের অভিজ্ঞ চোখ না কি কত কতদিন আগে থেকেই আমাকে বেছে রেখেছিল। কিন্তু আমি আমার ডাক্তারি কর্তব্যের দোহাই দিয়ে ব্যাপারটাকে ঠেকিয়ে রেখেছি। ইতিমধ্যে বড় হচ্ছে আমার চেয়ে ছোট যারা। এখন রাসের মেলা, হয় আরও অনেক বড়। দোলে, জন্মাষ্টমীতে শামিয়ানা খাটিয়ে বসে কীর্তনের আসর, কথকতার আসর। রায় বাড়ির অল্পবয়সীরা এই সব উৎসবে আগের চেয়ে অনেক বেশি দায়িত্ব পায়। যাত্রা হয়, প্রদর্শনী হয়। তবে এই সব উৎসবে গীত—ওস্তাদ কীর্তনিয়াদের গানের থেকেও প্রিয় আমার কাছে আমার দিদিমার গান। জ্যোৎস্নারাত্রে আকাশে যখন গোল চাঁদ ঠিক মাথার ওপর থেকে আলো ছড়ায় তখন উনি রাধামাধবের মন্দিরের বারান্দায় কখনও কখনও গান করেন। ‘কে বা শুনাইল শ্যাম নাম।’ কপালে চন্দনের টিপ, গলায় তুলসী বীজের মালা, চন্দনবসনা আইলিন যখন গান করেন, কে বলবে ইনি চণ্ডীদাস-বিদ্যাপতি-জ্ঞানদাস-গোবিন্দদাসের সেই বিরহিণী শ্রীরাধা নন! তবে সে সবও তো এখন অতীতের গর্ভে।
অনেকদিনই এখানে বিজলি এসে গেছে। পথগুলোতে সন্ধে হলেই আলো জ্বলে। দু-চারটে ছাড়া খড়ের চালের ঘরও আর নেই। সব পাকা হয়ে গেছে। রায় পাড়া এখন অনেক সুবিন্যস্ত। গাছপালা, ফলবাগান, ফুলবাগান, পুকুর, নলকূপ সবই একটা পরিকল্পিত ছক মেনে তৈরি। আমার ছোটবেলার সেই দু-তিনটে ঘরের ইউনিট এখনও আছে। কিন্তু পাকা সব। তাতে বিজলি-বাতি জ্বলে, পাখা চলে, রেডিয়োর আওয়াজ শোনা যায়। পূর্ণিমা রাতগুলোতে কিন্তু সব বিজলি-আলো নিভিয়ে দেওয়া হয়। চারদিক রিমঝিম করে জোছনায়। বৃষ্টির মতো জোছনা ঝরছে শব্দ পাওয়া যায় যেন। মুগ্ধ বিস্ময়ে সেই জোছনার দিকে তাকিয়ে থাকেন আইলিন, ইরাবতী, মন্দাকিনী যখন আসে, সে-ও।
—তুই ঠিকই বলেছিলি মন্দার। সারা পৃথিবীতে কোথাও তোর রাধানগরের জ্যোৎস্নার তুলনা নেই।।
—রাধানগর আমারও যতটা তোরও ততটা—আমি ওকে মনে করিয়ে দিই। মন্দাকিনীও ডাক্তার, তবে তার কাজ প্রধানত গবেষণা, থাকে তার স্বামীর সঙ্গে নরওয়ের শহর অসলোয়। অরোরার দেশে থাকে, জোছনার ভাল-মন্দের বিচার তার মতো আর কে পারবে?
কুড়ি কুড়ি বছরের পার। দুই দশক, মানে তো দুই যুগই! এখন মন্দার ডাক্তারের মনে হয় এতগুলো বছরের মধ্যে সবচেয়ে অকিঞ্চিৎকর ছিল তার ছোটবেলাটা। ইনকিউবেটরে থাকার মতো। শুধু টিঁকে থাকা, শুধু টিঁকে থাকা। তারপর কত শেখা হল, জানা হল, দেখা হল—মন, স্বাস্থ্য, শরীর, পরিস্থিতি। একটা সোঁদা শরীর, সোঁদা মন নিয়ে সে জীবনের বহুমুখী জটিলতার মুখোমুখি হয়েছিল, প্রত্যেকটি ঘটনা, প্রত্যেকটি অভিজ্ঞতা তাই তার কাছে অমন বিশেষ, অমন অসামান্য চেহারা নিয়ে হাজির হয়েছে। পৃথিবীর কত দেশ সে দেখল, কত মানুষ! বিচিত্র তাদের দুঃখ, বিচিত্র তাদের বিপন্নতা। সে সবের পাশে তার সেই অল্প বয়সের দুঃখ এখন মনে হয় যেন কিছুই না। সত্যিকারের অপ্রাপ্তি তার কিছুই ছিল না, ছিল না বিপদ কিংবা প্রতিকূলতাও। ভেবে দেখতে গেলে সবটাই তার মনে হওয়া। কোনও কামানের গোলা তার দিকে ছুটে আসেনি, যতই সে বারবার স্বপ্নে ভয় পাক, কোনও দুর্গ জয় করার বীরত্বও তার দরকার হয়নি। যখন সে ভাবছিল সে একটা ছন্নছাড়া ছোট ছেলে, তখন আড়ালে বড় জ্যাঠামশাই তার ওপরে লক্ষ রেখেছিলেন, অপেক্ষা করছিলেন সোনার কবচ নিয়ে, রাধানগরের দেওয়ানের সোনার কবচ। সে ভাবছিল কেউ তাকে দেখে না, দেখছিল কিন্তু ঠিকই কেউ না কেউ, হয়তো মায়ের মতো অতন্দ্র পাহারায় নয়, কিন্তু অভিজ্ঞতার নিরুদ্বিগ্নতা দিয়ে। সে দুঃখ পাচ্ছিল সে মাতৃপরিত্যক্ত অথচ সত্যি-সত্যি মাতৃহীন হওয়া সত্ত্বেও সে কিন্তু মাতৃস্তন্য থেকে বঞ্চিত হয়নি, আর এতগুলো বছর কেটে গেছে তবু ইরাবতী একদিনের জন্যেও তাঁর সেই ঘোষণা থেকে নড়লেন না— মন্দার মন্দাকিনী দুজনেই তাঁর সন্তান, এই-ই না কি গডস ট্রুথ। এটা কোয়েশ্চন করা চলবে না। এখন তো সে এই নিয়ে মাকে খেপায়। মোটা মালা পরিয়ে দেয় মিলির ছবির গলায়। বলে—‘দেখো মা, তোমার আবার হিংসে হচ্ছে না তো!’ —‘হিংসে কীসের? আমি মরে গেলে আমাকেও দিবি।’
তার মানে সে, মন্দার যখন নেই-নেই করে অভিমান করছিল, তার ভাগ্য তখন লুকিয়ে লুকিয়ে তার জন্য ঐশ্বর্য জমাচ্ছিল—আইলিন অপেক্ষা করছিলেন তাঁর অনন্যসাধারণ শিক্ষা, স্মৃতি ও স্বপ্ন নিয়ে, মন্দাকিনী অপেক্ষা করছিল তার সহৃদয় সৌহার্দ্য নিয়ে, ইরাবতী অপেক্ষা করছিলেন তাঁর অল্প বয়সের ভুল শোধরাবার ইচ্ছা নিয়ে, আর এঁদের সবার আড়ালে অপেক্ষা করছিলেন রাধামাধব।
কখনও কখনও তার মনে হয় রাধামাধব তাকে ফিরে পেতে চেয়েছিলেন কেন? সে তো যাকে বলে ভক্ত নয়! বৈষ্ণব ধর্মের বাণীগুলোই যে তাকে টানে তা তো নয়। কেবল হরিনাম করে যে কৈবল্য লাভ তার দিকেও তার কোনও আকর্ষণ নেই। তা ছাড়া রাধামাধব তো ঈশ্বর। সারা পৃথিবীই তো ঈশ্বরের ভূমি! মানুষ যেখানেই যাক না কেন তাঁর নাগালের মধ্যেই তো রয়ে যায়! তিনি কেন তফাত করবেন রাধানগরে আর কলকাতায়, কলকাতায় আর ভারতবর্ষে, ভারতবর্ষে আর বহির্পৃথিবীতে? অথচ চার হাত বাড়িয়ে রাধামাধব খালি তাকে টেনেছেন। চলে গেল মধ্য কলকাতার অ্যাংলো পাড়ায়, সেখানে মেমসাহেব সুদ্ধু গেয়ে উঠলেন— ‘মথুরানগরে প্রতি ঘরে ঘরে যাইব যোগিনী হয়ে।’ যে চুলোতেই সে যাক তিনি নাকি তাকে ঘরে ঘরে খুঁজে বেড়াবেন। পড়াশোনা করতে তো গিয়েছিল ইংল্যান্ড, জার্মানি, যোগ দিয়েছিল আমেরিকার হাসপাতালে। বড় জ্যাঠামশাই তাকে এখানে হাসপাতাল গড়ার প্রস্তাব দিয়ে পাঠালেন, অমনি সে চলে এল। ‘মাধব বহুত মিনতি করি তোয়’…এমন করে আর কোনও গানও তো তার মর্মে গিয়ে বাজল না।
অনেক ভেবে-চিন্তে তার মনে হয়েছে রাধামাধব ঈশ্বর নন, ঈশ্বরপদবাচ্য নন। তিনি এক রকমের দেবতা, রবীন্দ্রনাথ যাকে বলতেন নিভৃত প্রাণের দেবতা। কারও কারও। সমস্ত পৃথিবী নয়, যে ভূমিতে তাঁদের কল্পনাকে প্রতিদিনের স্মরণে মননে প্রাণ দেওয়া হচ্ছে, সৃষ্টি করা হচ্ছে, সেখানেই তাঁদের অধিষ্ঠান, তাঁদের ঘিরে চৌম্বক ক্ষেত্র। আর দেবতা জাগলেই তাঁর আকাঙক্ষাও জাগে, কল্পনাও জাগে, মন্দার এবং তার জীবন হয়তো সেই জাগ্রত দেবতার নতুন কল্পনা। সে হিসেবে শেষ পর্যন্ত সে মিলিরও না, রাজেনেরও না, রাধামাধবেরই সন্তান। পুরো অস্তিত্বটাই তার দেবত্র।