রাধানগর (Radhanagar) : 14
মন্দাকিনী কলেজ গেছে। আমার এখনও বেরোবার অনুমতি মেলেনি। পড়াশোনার ভীষণ ক্ষতি হচ্ছে। মন্দাকিনী অবশ্য আশ্বাস দিয়েছে ওর টিউটর প্রদ্যুম্নদার কাছে আমাকে নিয়ে যাবে। উনি নাকি সব মুশকিলের আসান। দিয়া বিশ্রাম করছেন নিজের ঘরে। স্টিফেন আর খালেদাও তাই। আমার আর শুয়ে বসে থাকতে ইচ্ছে করে না। ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ি। বারান্দাটা যেখানে ঘুরে গেছে সেখানে দাদামশাইয়ের লাইব্রেরি। দিয়া নিজে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আমাকে এ সব ঘর দেখিয়েছেন। লাইব্রেরিতে গিয়ে সারি সারি আলমারিতে বইগুলো দেখি। রবীন্দ্র রচনাবলী, শরৎচন্দ্রের বা বিভূতিভূষণের রচনাবলী নেই, আলাদা আলাদা করে সব বই রয়েছে। বঙ্কিমচন্দ্র, বৈষ্ণব পদাবলী, কালিদাসের মেঘদূত/ কান্তিচন্দ্র ঘোষের অনুবাদ, সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কবিতাসংগ্রহ, নজরুলের ‘অগ্নিবীণা’ ‘বিষের বাঁশি’ … পুরো দুটো আলমারি ভর্তি বাংলা বই। ইংরেজি বইয়ের সংগ্রহ আরও ভাল। এগুলো পাওয়াও যেত তখন ভাল প্রকাশনার ভাল বাঁধাই-এ। শেকসপীয়র তো রয়েছেই। ডিকেন্স, এইচ. জি. ওয়েলস, স্টিভেনসন, বার্নার্ড শ এ সব পুরো সেট রয়েছে। বাংলা পড়া থাকলেও, ইংরেজি ক্লাসিক তো আমার তেমন কিছুই পড়া নেই। এখান থেকে নিয়ে পড়ব। আলমারি খুলতে গিয়ে দেখি চাবি দেওয়া। মন্দাকিনী বলেছিল বটে, দাদার জিনিসপত্র সম্পর্কে দিয়া খুব সাবধান। রকিং চেয়ারটাতে বসে দোল খেতে খেতে কাগজ পড়ি অগত্যা।
হঠাৎ দেখি সামনে একজন স্যুট টাই পরা ব্যক্তিত্ববান ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে। এত কাছে দাঁড়িয়ে যে প্রথমটা আমি ভাবতেই পারিনি এটা আমার দাদামশাই। দাদামশাই আর কী! শিশিরদাদের থেকেও বয়সে ছোট। উনি আমাকে ডাকলেন। ওঁর পেছন পেছন যাচ্ছি। উনি একটার পর একটা আলমারির চাবি খুলে দিচ্ছেন। ‘তোমার’ বলছেন মুখে শব্দটা ফুটছে না। কিন্তু বুঝতে পারছি। টেবিল থেকে হাতির দাঁতের কলমদানিটা তুলে উনি আমার হাতে গুঁজে দিলেন। তার পরে বেরিয়ে গেলেন। ঠিক দরজার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে একবার আমার দিকে ফিরে চাইলেন— কী যেন একটা বললেন— অমনই অস্ফুটে, ভাল বুঝতে পারলাম না। কী যেন একটা দেখতে বললেন, ‘দেখো’টা বুঝতে পারলাম। তারপরেই চটকা ভেঙে গেল। আলমারিগুলো যেমন বন্ধ ছিল তেমনই আছে। হাতির দাঁতের কলমদানিটা টেবিলের ওপর যেখানে ছিল সেখানেই রয়েছে।
উঠে পড়লাম চেয়ারটা থেকে। ঠিক ভয় নয়, কেমন একটা অস্বস্তি। যেন অনেকদিন আগে, একটা অতীত ইতিহাসের সময়ে ফিরে গেছি। সেই সময়টা আমার চেতনার ওপর থাবা বসাচ্ছে। ক্রমাগত বসিয়ে যাচ্ছে। সেই থাবাটা আমি হাজার চেষ্টা করেও নামিয়ে দিতে পারছি না।
ঘরটা ছাড়িয়ে কিছুটা এসেছি নীচে সদর দরজার বেলটা বেজে উঠল। আমি নীচে যাই। এদিকে ওদিকে কাউকেই তো দেখতে পাচ্ছি না। খিল দুটো আস্তে আস্তে নামাই। মনে হচ্ছে দরজা খুললে সেই ভদ্রলোককে দেখতে পাব, যিনি লাইব্রেরির বইগুলো আমাকে দাতব্য করে গেলেন। খিল নামিয়ে দরজার একটা পাল্লা ধরে আমি পেছনে সরে যাই। বাইরে সালোয়ার কামিজ পরা এক ভদ্রমহিলা, হাতে একটা পাতলা সুটকেস তুলে নিতে নিতে তিনি বলেন, ও স্টিফেন, ট্রেনটা যা লেট না! দীজ রেলওয়ে পীপ্ল… একটা শক খেয়ে উনি থেমে গেলেন। আমার দিকে চোখ বড় বড়, বিস্ফারিত করে তাকিয়ে আছেন। এগারো কি দশ বছর বয়সে আমায় উনি শেষ দেখেছেন। তখন বালক ছিলাম। ছোটখাটো, রোগা রোগা, খাকি হাফপ্যান্ট পরে থাকতাম, ছাই রঙের হাফশার্ট, দুটোই গ্রামগঞ্জের হাট থেকে কেনা, তখনও আমার শিশুর ত্বক, শিশুর মুখ। এখন সাত-আটটা বছর চলে গেছে। হু হু করে লম্বা হয়ে গেছি। গোঁফ দাড়ি গজিয়ে গেছে। কে জানে গত ছ-সাত মাস শহরের জল গায়ে লাগায়, আর গত একমাসের রোগভোগ রোগমুক্তি আর বিশেষ সেবাযত্নের ফলে আর কী পরিবর্তন হয়েছে আমার।
শক কি আমিই খাইনি? ছিলাম ঘোরের মধ্যে। ঘুম-ঘুম চোখে নেমে আসছিলাম, মাথার মধ্যে ছিলেন বিনয়ভূষণ চৌধুরী। ভেবেছিলাম মন্দাকিনী ফিরে এল বোধহয়; কী করে জানব যাঁকে আজ প্রায় ছ’ বছর ধরে হন্যে হয়ে খুঁজছি, যাঁর কাছে আশ্রয় নেবার জন্য আমার এই শহরে আসা, যাঁর জন্য আমার মাঝরাতে গৃহত্যাগ, সেই তাঁকেই আমি দরজা খুলে দেব? অবশ্য এ বাড়ি ওঁরই। উনি এখানে আসতেই পারেন। আমার চাওয়া-না-চাওয়ার ওপর ওঁর আসা নির্ভর করে না। আমিই বরং এখানে বহিরাগত। এখানে আমার উপস্থিতির কোনও সদুত্তর নেই। ইনি তো চাননি আমি এখানে আসি। কিন্তু দেখতে দেখতে এতগুলো দিন কেটে গেল মিসেস এলা চৌধুরী কি মন্দাকিনী কেউই কি চিঠি লিখেও ওঁকে জানায় নি আমি এখানে আছি?
স্টিফেন এসে দাঁড়িয়েছে। কী যেন বলছে হড়বড় করে। খোলা দরজা-পথে ওদের দুজনকে দাঁড় করিয়ে রেখে আমি চলে গেলাম। উঠোনটা পার হচ্ছি, সিঁড়ি বেয়ে উঠলাম, বারান্দা পেরিয়ে যাচ্ছি, এঁরা যে ঘরটায় আমায় থাকতে দিয়েছেন সে ঘরে ঢুকলাম। দরজাটা কি বন্ধ করে দেব? নাঃ, নাটকীয় হয়ে যাবে ব্যাপারটা। তা ছাড়া এ ঘরে ওঁর অধিকার তো আমার চেয়ে অনেক বেশি। ওঁর অনুমতি ছাড়া এ ঘরে থেকে আমিই বরং আইন লঙ্ঘন করেছি। পর্দাটা টেনে দিলে কি খুব দোষ হবে?
মাথার মধ্যেটা কী ভীষণ ভোঁ ভোঁ করছে। এই অসুখটা যে আমাকে কী করে ফেলল! কত হেলাফেলায়, কত অযত্নে বড় হয়েছি কই দু-এক দিনের জ্বর-টর ছাড়া বড় কিছু কখনও হয়েছে বলেও তো মনে পড়ে না। শরীর স্বাস্থ্যও ছিল খুব ভাল। কলকাতায় প্রথম আসার পর শেয়ালদায় কয়েক মাস যখন-তখন খেয়ে, না খেয়ে, যা তা খেয়ে, বাজে পরিবেশে অতগুলো দিন কাটালাম, তখনও কোনওদিন এমন মাথা ভোঁ ভোঁ করেনি, যেমনটা এই বাড়ির আরামে আয়েসে রাশি রাশি ফল, ভিটামিন, ডিম ইত্যাদি খেয়েও হচ্ছে। এদের এই বাড়ির এই পরিবারের জীবনযাত্রাতেই কোনও ভাইরাস, ব্যাকটিরিয়া আছে যা আমার সহ্য হয় না, আমি কাবু হয়ে যাই, এরা অবশ্য বেশ ভালই থাকে, হয়তো একটু বেশিই ভাল। মন্দাকিনীর কী স্বাস্থ্য। ও পাশ দিয়ে চলে গেলে মনে হয়, ওর গায়ের বাতাসেই আর্ধেক লোক পড়ে যাবে। যেন একটা জোরালো বাস্কেটবল খেলোয়াড়। পুঞ্জীভূত শক্তি সামর্থ্য নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর ইনি? এই মহিলা? আজ তাঁকে সম্পূর্ণ বাইরের একজন তৃতীয় ব্যক্তির চোখ দিয়ে দেখলাম। কারও মা বলে ওঁকে মোটেই মনে হয় না। উনিও একজন খেলোয়াড়। কাউকে কোথাও ত্যাগ করে আসার কোনও গ্লানি ওঁর চেহারায়, হাবে ভাবে নেই। হবে না-ই বা কেন। উনি তো লাইফ এনজয় করছেন। মন্দাকিনী বলছিল না?
ক’টা বাজে? খালেদাদিদি আমার বৈকালিক ফলাহারের আয়োজন হাতে করে উপস্থিত। যেন আমি ঠাকুর। টেবিলের ওপর টাইম-পীসটার ওপর রোদ পড়ে চোখ ঝলসে দিচ্ছে, সময়টা দেখতে পাচ্ছি না। চারটে হবে আর কী! খাচ্ছি, দাচ্ছি আর ঘুমোচ্ছি। সময় কাটছে না। আজই সন্ধে থেকে ওই লাইব্রেরির বই ধার করতে হবে। পৃথিবীর যেখানে যা-ই-ই ঘটুক, আমাকে স্থির থাকতে হবে নিজের লক্ষ্যে। আমাকে মনে রাখতে হবে আমি বাবা-মার পরিত্যক্ত সন্তান। সোজা সিধে ভাষায় বলতে গেলে বাপে-তাড়ানো, মায়ে-খেদানো। জীবনে যা পাচ্ছি সবই দয়ার দান, বিন্দুমাত্র অধিকার নেই আমার বড়জ্যাঠামশাইয়ের দেওয়া টাকা-পয়সার ওপর। দিয়ার এই আদর-যত্ন, মন্দাকিনীর সাহায্য এ সবই আমার অধিকার-বহির্ভূত পাওয়া, যার দাম ভবিষ্যতে আমায় চুকিয়ে দিতে হবে যেমন করে হোক। কী ভাবে দেব? যদি টাকা-পয়সা ভাল উপার্জন করতে পারি দিয়াকে আমি তীর্থ-ভ্রমণ করাব। ওঁকে কেদার-বদরি, অমরনাথ, সোমনাথ, সব দেখাব, দক্ষিণে তিরুপতি, মীনাক্ষী, কন্যাকুমারী সব ঘুরিয়ে নিয়ে আসব। আর মন্দাকিনী? মন্দাকিনীর বিয়েতে একটা খুব চমৎকার খুব দামি গয়না উপহার দেব। ওই ছবির আইলিন গলায় যেমন পরে রয়েছেন ওই রকম কিছু।
—সন্ধেবেলায় ঘুমোচ্ছ কেন? মন্দাকিনী আমায় অল্প অল্প ঝাঁকাচ্ছে। সত্যি তো! আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম!
উঠে বসে বললাম— দূর, কাল থেকে আমি কলেজ যাব।
—একদিন গিয়ে দেখো। তোমাদের ক্লাসের দু-একজনের সঙ্গে আলাপ হয়েছে। তেমন কিছু এগোয়নি। আসল তো প্র্যাকটিক্যাল? ধরো আড়াইটে থেকে চারটে। ওই সময়টায় যদি যাও তো…, অতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে? বললাম জাক সুপটা খাও, তিন চার দিনে খাড়া হয়ে যাবে। তা মাছ খাবে না, চিকেন খাবে না সারবে কী করে? এখন চলো, চা খাবে।
দোতলার সিঁড়ির মুখেই আমাদের চা খাওয়ার জায়গা। একটা গোল মাৰ্বল-টপ টেবিল আছে। এটাকে ঘিরে চারটে চেয়ার। আজকে চারটে চেয়ার ভরে যাবে।
কিন্তু বারান্দা দিয়ে যাবার সময়ে দেখলাম—ডলির ঘরের দরজা বন্ধ। যতক্ষণ এঁরা কিছু না বলছেন, আমিও কোনও কথা তুলব না। অনেক প্রশ্ন আসছে মনে, আগেও এসেছিল। আগে প্রশ্নগুলো চাপা পড়ে ছিল, আজ সেগুলো আবার সব বাধা ঠেলে উঠে আসতে চাইছে। কিন্তু এঁদের কোনও রকম সুবিধে করে আমি দেব না। আমার দিক থেকে নীরবতা-ই হবে এখন একমাত্র প্রশ্ন। আমি এসেছি এ খবর কি ওঁরা ডলিকে দেননি? না দিয়ে থাকলে—কেন? আমার যে এত বড় একটা অসুখ করেছিল সেটাও ওঁকে জানাবার প্রয়োজন ছিল না? হোক অবাঞ্ছিত সন্তান, তার কঠিন অসুখ বা মৃত্যুর সময়েও মা কি উদাসীন থাকতে পারে? এ সব প্রশ্ন আমি করব না, প্রশ্নগুলো ওঁরা যদি অনুভব করে থেকে থাকেন, তা হলে উত্তর দেবার তাগিদও ওঁদের ভেতর থেকেই আসবে। আর, যদি তা না আসে, তা হলে বুঝতে হবে এঁরা এতকাল যেমন এ সব এড়িয়ে ছিলেন, আজও তাই করতে চাইছেন। যে জেগে জেগে ঘুমোয়, কে তাকে জাগাতে পারে? সুতরাং কথাবার্তা এই রকম নিরীহ সব বিষয়ে হল:
আমি—আজ দুপুরে আমি লাইব্রেরিতে গিয়েছিলাম। বইয়ের আলমারিগুলো দেখলাম বন্ধ।
দিয়া—তোমার কিছু দরকার?
আমি—বইয়ের কালেকশন দেখলাম খুবই ভাল। আমি কি বইগুলো পড়তে পারি?
দিয়া—বাঃ বই তো পড়বার জন্যেই।
আমি—মন্দাকিনী পড়নি ওখান থেকে কিছু?
মন্দাকিনী—পড়েছি। তবে দিয়া লাইব্রেরির বই নিয়ে এত ফাস্ করে…। ওইখানেই বসে পড়তে হবে। অন্য কোথাও নিয়ে যাওয়া চলবে না। বইয়ের পাতা-টাতা মোড়া চলবে না। দাগ দেওয়া চলবে না। এত বিধিনিষেধ মেনে কি আর পড়া যায়? শেকসপীয়র টিয়র আমি যেটুকু পড়েছি, নিজে কিনে পড়েছি।
আমি—আছে বাড়িতে, তবুও কিনেছ?
মন্দকিনী—হ্যাঁ! খুঁটিয়ে পড়তে গেলে তো একটু দাগ দিতে হয়ই, হয় না?
আমি—শেকসপীয়র ছাড়া?
মন্দকিনী—ক্ল্যাসিকগুলো কী রকম মোটা মোটা হয় তো দেখেছই! সারাক্ষণ বসে বসে পড়া যায়? আমি শুয়ে শুয়ে পড়তে ভালবাসি। নিজের ঘরে, বারান্দায়, স্কুলের লাস্ট বেঞ্চে পড়তে ভাল লাগে। তাই স্কুল কলেজের লাইব্রেরি থেকে ধার নিতে হয়েছে। —হঠাৎ মন্দাকিনী হেসে উঠল।
—প্রদ্যুম্নদা যদি শোনেন আমাদের বাড়ি ‘আনা কারেনিনা আছে, তারাশংকরের ‘ধাত্রীদেবতা’-টেবতাও আছে, তো ওঁর ফিট হয়ে যাবে।
আমি—কেন?
—ওই বইগুলো আমাকে পড়াবার জন্যে উনি লাইব্রেরিগুলো চষে ফেলেছেন তো! এক বই রিনিউ করতে কতবার যেতে হয়েছে ব্রিটিশ কাউন্সিল, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ….
দিয়া এতক্ষণ চুপই করেছিলেন, বললেন—বইয়ের যত্ন করা কি খুব দোষের? বলো মন্দার?
মন্দাকিনী বলল—যত্ন করা দোষের নয়, তুমি যেটা করো সেটা হল আগলানো ‘যক্ষের’ মতো।
—মন্দার সব বই পড়তে পারে, যেখানে খুশি—দিয়া বললেন।
—‘আনা কারেনিনা?’ ওটা কার? আমি জিজ্ঞেস করি।
—টলস্টয়ের নাম শুনেছ?
টলস্টয়ের ‘শর্ট স্টোরিজ’ হল শেষ গল্পের বই যা আমাকে মা দিয়েছিল। জানি বই কী, টলস্টয়ের নাম ভাল করেই জানি।
—মন্দাকিনী আমাকে একটু ভাল ভাল বই বেছে দেবে?
—তুমি দিয়াকে বলো, দিয়া আমার চেয়ে অনেক বেশি পড়েছে।
দিমিত্রি, আইভান, আলিওসার গল্প পড়ছি আমি। এরা সকলেই এক পিতার সন্তান। কিন্তু দিমিত্রি এক মায়ের, আইভান আর আলিওশা আর এক মায়ের। কেউই এরা মাকে পায়নি। আত্মীয় বন্ধুদের দয়ায় মানুষ হয়েছে। এদের বাবা একটা আস্ত শয়তান। দিমিত্রি ছেলেটা ভীষণ রাগী জেদি, উচ্ছৃংখল। আইভান হল স্থিরবুদ্ধি, ভীষণ বুদ্ধি ধরে। আর আলিওশা সরল, নরম মনের ক্ষমাশীল…।
পৃথিবীতে দুটো পরিস্থিতি, দুটো সঙ্কট, দুটো মানুষ বোধহয় কখনও পুরোপুরি একরকম হয় না। আমার অবস্থাও এদের মতো। মা বাবা থেকেও নেই। অনাথ… আত্মীয়দের বদান্যতায় এত বড়টা হয়েছি। তবু আমার অবস্থা আর ওদের অবস্থা ঠিক এক নয়। কত বিভিন্ন রকমের অনাথ হয়, পড়তে পড়তে আমি ভাবলাম। দিমিত্রির মতো হতে পারতাম তো আমি! ওইরকম বন্য, উদ্দাম! বাবার উদাসীনতা দিনের পর দিন সহ্য করেছি কেন? দাবি করতে পারতাম তো! একদিন একটা কথা কাটাকাটিও তো হল না?
মা নিঃশব্দে ডিভোর্স করে চলে এল, না করল বাবা সে নিয়ে কোনও বিষোদগার, না করলাম আমি। জানলামই না। যে ভাবে লেখাপড়াটা চালিয়ে গেছি, মোটামুটি ভালই করছি। তাতে বলা যায় আইভানের পথে চলেছি আমি। কিন্তু অত চাতুর্য, অত বুঝে সুজে গুনে গেঁথে চলা আমার বুদ্ধিতে কুলোবে না। আর, আলিওশার মতো অমন দয়ালু, পরার্থপর, সাধু-সন্ত প্রকৃতির মানুষ আমি নই, হবার ইচ্ছেও নেই।
—মন্দার! আমার মাথায় একটা নরম হাতের ছোঁয়া।
—এত রাত পর্যন্ত পড়ছ? শরীরটা তো ঠিক নেই। শরীর খারাপ হবে যে!
—তাতে তোমার কী?
—তুমি কদিনেই কত বড় হয়ে গেছো!
ইনি কি ভেবেছিলেন আমি ক্রমশ ছোট হয়ে যাব? ছোট হতে হতে হাওয়ার সঙ্গে মিলিয়ে যাব? সেটা হলে অবশ্য ভালই হত এঁর। মুখোমুখি হতে হত না।
আমি বইটা রেখে পাশ ফিরে চোখ বুজলাম। মাথার কাছে বেড ল্যাম্পটা নিভে গেল। যখন উনি ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন তখনই আমি বুঝতে পারলাম—মা নয়, দিয়াই এসেছিলেন। এত তীব্র ছিল আমার মাকে প্রত্যাশা যে দিয়াকেই আমি মা ভেবে নিয়েছি। আর উনি, উনিও সেটা বুঝতে পেরেছেন।