Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » রাধানগর || Bani Basu » Page 12

রাধানগর || Bani Basu

সত্যি আমি একটা ইডিয়ট, আহাম্মক মূর্খ। কোনও মা যে বিয়ে করতে পারে এ কথা অতি সুদূর কল্পনাতেও কখনও মনে স্থান দিতে পারিনি। মন্দাকিনী আমায় তোমরা বুঝতে পারবে না বোধহয়। কিন্তু, আঠারো বছর আমি রাধানগর নামে একটি জায়গায়, ঠাকুরবাড়ি নামক একরকম ধর্মীয় রীতিনীতির সংস্কৃতির ছকের মধ্যে বেড়ে উঠেছি। বেড়ে উঠেছি একা একা। কিছুই শেখাবার জন্য কেউ আমার পাশে কোনওদিন ছিল না। যা কিছু শিখেছি তা অনুমানে। অজানা হাতড়ে হাতড়ে বড় হয়ে উঠেছি। জন্ম, মৃত্যু, বিবাহ…জীবনের এই সব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে, রায়বাড়িতে, রাধানগরে। আমি দেখেছি দূর থেকে। অনুভব করিনি। এগুলো ঘটে গেছে যেন আমার বাইরে।

মেজো জ্যাঠামশাই মারা গেলেন। শুনলাম মাঠে, ভোরবেলায় বেড়াতে গিয়ে। ভোরে উঠে বইপত্র নিয়ে আমি চলে যেতাম, লোকবসতি অঞ্চল থেকে একটু দূরে। একটা বটগাছ ছিল আমার খুব প্রিয়। এই বটগাছটার তলায় ঘুমিয়ে পড়ে রাত্রে হঠাৎ ঘুম ভেঙে আমার একবার একটা অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হয়েছিল! বেড়াতে বেড়াতে আমি ওইখানে চলে যেতাম। শিশিরদারা আমাদের বলতেন শরীর তৈরি করতে বেশ কয়েক পাক ছোটা দরকার। বেশির ভাগ দিনই ওইখান থেকে আমি ছুটতে শুরু করতাম, কোনও কোনওদিন তারক এসে যোগ দিত। কিন্তু পরীক্ষা এসে যাওয়ায় ওই সময়টা রোজ পড়াশোনা করছিলাম। ওইখানেই একজন পথ চলতি লোক আমায় খবর দিয়ে গেল রায়বাড়ির বুড়োকর্তা দেহ রেখেছেন। ফিরে গিয়ে দেখি উঠোনে খাটিয়ায় মেজো জ্যাঠামশাইকে নামানো হয়ে গেছে। নতুন একটা কোরা ধুতি পরানো হয়েছে, গায়ে নামাবলী। কেউ কান্নাকাটি করছে না, কিন্তু সকলেই খুব গম্ভীর। ছোটরা সার বেঁধে প্রণাম করছে, পুরো দৃশ্যটা যেন একটা ছবি, আমি দেখছি। মনে হচ্ছিল মেজো জ্যাঠামশাই অনেকদিন আগেই মারা গেছেন। ওঁর হাত পা কেমন কাঠের মতো, খুব পাতলা কাঠ। তুলসীপাতার তলায় বুঝি চোখদুটো গলে গেছে। মৃত্যু, একে বলে মৃত্যু, আমি নিজেকে বললাম। কিন্তু নিজের মধ্যে কোনও থেমে-যাওয়া উপলব্ধি করলাম না। মৃত্যু একটা দৃশ্য হয়ে রইল। হয়তো খুব নিকটজনের মৃত্যু হলে সেটাকে আমি অনুভব করতে পারব, কিন্তু সে রকম নিকটজনই বা আমার কই? বাবা, মা এরা তো প্রায় অদৃশ্য অবাঙ্‌মনসোগোচর হয়েই রয়েছে। থাকলে আছে, চলে গেলেও সেটা কোনও আলাদা অভিজ্ঞতা নয়। এই যে মায়ের শেষবার কলকাতা চলে যাওয়া! তার পর থেকে দেখা নেই, চিঠিপত্র নেই, খবর নেই। এটা মৃত্যু ছাড়া কী? এটাকে সম্পূর্ণ করতে কি আবার একটা ফুল-সাজানো খাটিয়া আর তুলসীপাতা লাগবে?

জন্ম সম্পর্কে আমার অনুভূতি তো আরও ধোঁয়াটে। একগাদা ছোট ছেলেমেয়ে দল বেঁধে খেলছে। ওদের তেমন কোনও বিশেষ মুখ নেই। সংখ্যা আছে। সংখ্যায় হয়তো একদিন থেকে একজন বেড়ে গেল। সেই একজন খুব ছোট ছিল, আরেকটু বড় হয়ে গেল, কোনও একজন কাকিমা, কি বউদি, কি কাজের লোক কাঁথা জড়ানো একটা বাচ্চাকে নিয়ে হয়তো ঘুরে বেড়াচ্ছে। বুঝতে পারলাম রায়বাড়িতে লোকসংখ্যা বাড়ল। দাওয়া দিয়ে হামা দিচ্ছে একটা বাচ্চা, টলটল করে হাঁটছে, পায়ে রুপোর মল, চোখে কাজল, কোমরে ঘুনশি, আমার কোনওদিন মনে হয়নি—বাঃ বেশ তো বাচ্চাটা, কবে হল, কার বাচ্চা? ওরা কেউ হাত বাড়িয়ে আমার কাছে আসতে চায়নি। আমিও নিতে চাইনি ওদের।

আর বিয়ে? এই আঠারো বছরে কি আর কম বিয়ে হয়েছে রায়বাড়িতে? বেশির ভাগই মেয়েদের বিয়ে। দিদিদের, পিসিদের। এরা সবাই আমার কাছে অতিশয় দূরের মানুষ। এদের হাসি, কথাবার্তা, সবই আমার চিরকাল বিদেশি-বিদেশি লেগেছে। বিয়ের অনুষ্ঠানটা যেখানে হচ্ছে, যজ্ঞ বা সম্প্রদান, গায়ে-হলুদ বা এ রকম কিছু সে সব জায়গায় কখনও আমার ডাক পড়েনি, যাইওনি কখনও। লোকের মুখে শুনে শুনে অনুষ্ঠানগুলোর নাম আমার শেখা। সবচেয়ে কাছাকাছি থেকে বিয়ে দেখার অভিজ্ঞতা আমার খুব সম্প্রতি হল। আমার এক দাদার বিয়ে হল, তার ঘর তোলা হল আমাদেরই উঠোনে। আমাদের ঘরের উল্টোদিকে। দিনের পর দিন উঠোনে মাটি মাড়াই হত। মাটির সঙ্গে খড়ের কুচি, আলকাতরা এই সব মিশিয়ে সেই মাটি তৈরি হত। ইঁট এল। ইঁট দিয়ে ভিত তৈরি হল। তারপর চাপ চাপ মাটি দিয়ে দেওয়াল উঠল, তাতে কাঠের জানলা-দরজা বসল, মাথায় বসল টালির চাল। শেষ কালে পুকুরের তলার মাটির সঙ্গে আলকাতরা মিশিয়ে যখন পলেস্তারা পড়ল দেওয়ালের গায়ে মেঝেতে, তখন ভাল শানের মেঝের সঙ্গে তার আর কোনও তফাত রইল না। কী ভাবে চারদিকে চ্যাঁচারির বেড়া দিয়ে বাগানের জন্য জমি আলাদা করা হল, তাতে ফুল গাছ বসল এই সমস্ত পদ্ধতিটা খুব মনোযোগ দিয়ে আমি লক্ষ করেছিলাম, তার পরে একদিন লাল চেলি আর শোলার মুকুট পরে একটি বউ এসে ওই দুটি ঘরে বসবাস করতে লাগল। সেই সময়ে অনেক রাতে কখনও কখনও ঘুম ভেঙে ওদের প্রণয়লীলার টুকরো-টাকরা দেখতে পেয়ে গেছি। ঠিক যেন রাধা-কৃষ্ণের গল্পের অভিনয় হচ্ছে, আমার দেখা বারণ, এক জায়গায় কানাত উড়ে গেছে, সেই ফুটো দিয়ে দেখছি।

মা বিয়ে করেছে? মা তো বাবার বউ? একটা অমোঘ সম্পর্ক। সেই মা! জুটের ব্যাগ থেকে বিস্কুটের প্যাকেট বার করছে, দুজনে মিলে চাইনিজ চেকার খেলছি, একটা রঙিন ডুরে শাড়ি পরে মা পশ্চিম পুকুর থেকে চান করে আসছে, আমাদের খাবার বেড়ে দিল! ওই মা চলে যাচ্ছে, ফুল-ফুল ছাপ সিল্ক শাড়ি পরে, পা-ঢাকা জুতো পায়ে, মোড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে একবার পেছন ফিরে আমায় হাত নাড়ল। ব্যস, এবার মাকে আর দেখা যাবে না। আমার চোখ টনটন করছে, গলা ব্যথা করছে, কিন্তু ওই পর্যন্তই। আমি কাঁদব না তো! আমি কাঁদি না।

আমার বিমূঢ় ভাব দেখে মন্দাকিনী বোধহয় ভয় পেল, বলল—তুমি কি কখনও ডিভোর্স, রিম্যারেজ এ সবের কথা শোননি?

আমি কোনও জবাব দিলাম না।

—তোমার কাছে যখন রাধানগরে যেত মা কোথায় থাকত?

—আমার কাছে, আমার ঘরে।

—ঠিক কবে মা ডিভোর্স নিয়েছিল জানি না, তবে ডিভোর্সে বাবাকে রাজি করাবার জন্যেই বোধহয় মা রাধানগরে যেত।

এ-কথার মানে কী? আমি কেউ না? মা আমাকে দেখতে যেত না? উদ্দেশ্য, বাবাকে ডিভোর্সে রাজি করাবার উদ্দেশ্য নিয়ে যেত? কথাগুলো যেন বরফের কুচি, ঝরে পড়ছে আমার সমস্ত শরীরে, সমস্ত অস্তিত্বে। আমার যেন কেমন শীত করতে লাগল।

—তোমার জন্যে টানও নিশ্চয় ছিল—অপ্রস্তুত মুখে বলল মন্দাকিনী, আমি বললাম—আগে কহো আর।

—মানে?

—মানে, ও কথা থাক।

—মুসৌরিতে হোটেল ওবেরয়-এ রিসেপশনিস্ট হয়ে গেল মা, আমাকেও নিয়ে গিয়েছিল। বেশ ছিলাম। তারপরে মা বিয়ে করল। আমাদের বাড়ি কেমন বদলে গেল। অন্য লোকটাকে বাবা বলাবার চেষ্টা চলল কিছুদিন। পারিনি। তারপরে একদিন ডিসিশন নিলাম। মায়ের বাড়িতে যতদিন ছিলাম ঠিক ছিল। কিন্তু এখন মায়ের নতুন সংসার হয়েছে, ঠিক আছে মা এনজয় করুক। আমি চলে এলাম।

মায়ের নতুন সংসার, মা এনজয় করবে? নতুন তৈরি সেই মাটির ঘর। দাদা, লাল-চেলি পরা দাদার বউ, বউটির জায়গায় আমার মা, দাদার জায়গায়, একজন অপরিচিত রোমশ লোক, ঠিক রাখালবাবুর মতো মুখ, খালি রাখালবাবুর মতো বেঁটে নয়, পোশাক-পরিচ্ছদ আরও দামি, কেতাদুরস্ত।

আমার চারপাশে তাসের প্রাসাদ ভেঙে ভেঙে পড়ছে। আশে পাশে, মাথার ওপর। ছিল না, কিছুই ছিল না, শুধু জীবনের কেন্দ্রে একটা মূর্তি ছিল, মায়ের মূর্তি। মা, অন্য কেউ না ভালবাসলেও যে আমাকে ভালবাসে, ভাবতাম অনেক দুঃখেই মা আমাকে ছেড়েছে। মায়ের এই দুঃখটুকুই অদৃশ্য মা আর তার ছেলের মধ্যে যোগসূত্র ছিল। কী বোকা! কী আপাদমস্তক আহাম্মক আমি!

যতই ভাবি ততই মায়ের মূর্তি ক্লেদাক্ত হয়ে যায়। শেষে যখন মায়ের সঙ্গে রাখালবাবুর কোনও তফাতই রইল না, রাখতে পারলাম না, তখন শরীরটা এমন জ্বালা করতে লাগল যে সোজা বাথরুমে গিয়ে, বাথটবে জল ধরে, তার মধ্যে ডুবে শুয়ে রইলাম।

অনেকক্ষণ পরে মনে হল কারা ডাকছে। দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে,—মন্দার! মন্দার! কী করছ!

উঠে দরজা খুলে দিলাম। সামনে দিদিমা—এলা চৌধুরী, বা আইলিন। খুব ভদ্র ইনি, অমায়িক, সদাশয়। আমি এখানে কোনওদিন আসব ইনি ভাবেননি। মেয়ের ডিভোর্স করা স্বামীর ছেলে তো আমি! এঁর মেয়েও যথেষ্ট দক্ষতার সঙ্গে নিজের পায়ের ছাপ মুছে ফেলে চলে এসেছেন। ভাবেননি, কিন্তু এসেই যখন পড়েছি, তখন অসীম ভদ্রতায় ইনি আমাকে আশ্রয় দিয়েছেন। এই তো, চমৎকার একটি ঘর, একটা বাথরুম দিয়েছেন আমার ব্যবহারের জন্য। এমন ঘরে কি জীবনেও কখনও থেকেছি? আর এই বাথরুম? একটা ঘরের মতো বাথরুম? আমার মতো কাঙাল কি স্বপ্নেও ভেবেছিল এই রকম এক বাথরুমে সাদা ধবধবে বাথটবে শুয়ে শুয়ে সে তার মন-খারাপ ধুয়ে ফেলবার সুযোগ পাবে?

—এত রাতে তুমি চান করলে মন্দার? কী কাণ্ড! ঠাণ্ডা লেগে যাবে যে!—

আমার কোনও শীতবোধ কিন্তু ছিল না। আমি যে ওঁর সামনে শুধু একটা তোয়ালে পরে খালি গায়ে দাঁড়িয়ে আছি, আমার গলায় রাধানগরের সেই মাদুলি সুদ্দু হার পরে, সে খেয়ালও আমার হয়নি।

তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও— এবার আমরা খাব— আমি পাঁচ মিনিট পরে আসছি। উনি ঘর থেকে চলে গেলেন।

আমার আর একটুও থাকতে ইচ্ছে করছে না এখানে। এক মুহূর্তও না। কীসের আত্মীয়তা এঁদের সঙ্গে আমার? যে-মুহূর্তে মায়ের সঙ্গে সম্পর্ক চলে গেছে সেই মুহূর্তে তথাকথিত এই মামা-বাড়ি, থুড়ি, দিদিমার বাড়ির সঙ্গেও আমার আর কোনও সম্পর্ক থাকার কথা নয়।

মন্দাকিনীর আনা জামা কাপড়গুলো এখনও বিছানার ওপর পড়ে রয়েছে। আমি আলমারি থেকে আমার নিজস্ব সস্তার বেলবট্‌ম প্যান্ট আর স্ট্রাইপ দেওয়া শার্ট পরি। জীবনেও কখনও সোয়েটার পরিনি। রাধানগরে সম্বল ছিল একটা চাদর। এখানেও সেটাই নিয়ে এসেছি। রাতে যখন খাবার কিনতে বেরোতাম, এই চাদরই গায়ে জড়িয়ে যেতাম। দিনের বেলায় গরম জামাটামা আমার দরকার হত না। চাদরটা পাট করে কাঁধে ফেললাম। মন্দাকিনী নাক সিঁটকোবে। বলবে গাঁইয়া! আহাম্মক! বলুক। শীত করছে যখন চাদরটা আমায় গায়ে দিয়েই বেরোতে হবে।

সুটকেসটা গুছিয়ে নিতে সময় লাগল না। বইগুলো আরেক দিন এসে নিয়ে যাব এখন। গুনে দেখলাম— তিন হাজার চারশো আট টাকা রয়েছে, আমার ব্রাউন খামে। আজ রাতটা কোনও হোটেলে-টোটেলে কাটিয়ে দেব। কাল আমার প্রথম কাজ হবে— প্রিন্সিপ্যালের সঙ্গে আরেকবার দেখা করা। হস্টেলের ব্যবস্থা যদি না-ও করতে পারেন, কোথাও পেয়িং গেস্ট থাকবার ব্যবস্থা ওঁকে করে দিতেই হবে। একটা কাঙাল অনাথ পড়ুয়া ছেলের জন্য এইটুকু উনি করবেন না? প্রিন্সিপ্যাল হয়েছেন কেন তবে?

মিসেস চৌধুরী আবার ঢুকছেন। —আসব, মন্দার?

—ও কী? এখন সুটকেস গোছাচ্ছো কেন?

সুটকেসটা হাতে নিয়ে আমি উঠে দাঁড়াই। বলি— আমি যাই।

—কেন? কোথায়?

সত্যি কথাই বলি—কোনও হোটেলে আজকের রাতটা কাটিয়ে দেব।

—সে কী? কেন?

ওঁর ‘কেন’র উত্তর খুব লম্বা হয়ে যাবে। এত কথা ওঁকে শোনাবই বা কেন? মেমসাহেব মানুষ, অনেক ঝামেলা পুইয়েছেন, আমার জন্য। আর কেন?

উনি আমার হাত ধরলেন, কাঁদছেন, অনর্গল জল পড়ছে চোখ দিয়ে—বললেন —বিনু, বিনু! কোথায় যাবে? যেও না।—কাকে ডাকছেন উনি?

আমি কীরকম একটা ঘোলাটে পর্দার মধ্যে দিয়ে দেখতে পাচ্ছি ওঁকে। মেমসাহেব, কিন্তু শাড়ি পরেছেন। নাকে হিরের নাকছাবি। হাতে তিন-চার গাছা সোনার চুড়ি। কপালে একটা কালো টিপ। লাল চুলগুলো একটা বিনুনি করে পেছনে ফেলে রেখে দিয়েছেন।

হঠাৎ উনি গলা চড়িয়ে ডাকলেন— বুলা! বুলা! স্টিফেন! আমি বললাম, প্লিজ, কাউকে ডাকবেন না। আমি থাকব না।

সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে মনে হল স্টিফেনকে একবার তড়বড় করে আসতে দেখলাম। মন্দাকিনীর মুখটাও যেন একবার দেখা গেল। কিন্তু কোথায়, কখন অতশত বলতে পারব না।

এত নির্ভরশীল আমাদের মন যে এতগুলো দীর্ঘ বছর প্রায় কারও তত্ত্বাবধান বা পরামর্শ ছাড়া বাঁচার পরও আমি পাগলের মতো কারও সঙ্গে কথা বলতে চাইছিলাম। সোজা একটা হোটেলে চলে যাব, ঘর বুক করব— এই তো কথা! কিন্তু পারলাম না। আমি চলে গেলাম রথীদের বাড়ি। রথীকে নিয়ে কোনও হোটেলে যাব। যথেষ্ট রাত হয়ে গেছে, যদি কোথাও জায়গা না পাই, তো কী হবে! এমন একটা ভাবনা-ও হয়ে থাকবে।

আমাকে দেখে রথী অবাক! স্বাভাবিক! আমি শুধু বললাম— যেখানে ছিলাম সেখানে থাকতে পারছি না। কোনও একটা হোটেলে গিয়ে উঠব।

—হোটেলে? না, না, ও সব রিস্‌ক নিতে যেও না। দাঁড়াও একটু। রথী আমাকে বসিয়ে ভেতরে চলে গেল।

ওর মা কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে এসে বললেন— কী হয়েছে মন্দার? কী হল হঠাৎ?

ওঁর দিকে আমি নির্নিমেষে তাকিয়ে ছিলাম। উনি একটা রঙিন ছাপা পরেছিলেন। লাল শাল গায়ে জড়ানো। এত নিশ্চিন্ত মুখ! আমি ওঁকে কী বলব? শুধু বললাম— যে লোকটির ঘরে আমার থাকার ব্যবস্থা হয়েছে, সে কয়েক দিন ধরেই খুব খারাপ ব্যবহার করছে, টিঁকতে পারছি না মাসিমা।

—তাই ক’দিন কলেজে আসছ না? — রথী জিজ্ঞেস করল।

আমি ঘাড় নাড়ি।

রথীর মা চিন্তিত মুখে বললেন হোটেলে-টোটেলে ওঠার মতলব ছেড়ে দাও মন্দার, তুমি গ্রামের ছেলে, কোনও অভিজ্ঞতা নেই, কোথায় কী বিপদে পড়ে যাবে। আজকের দিনটা তুমি রথীর কাছে কাটিয়ে দাও। আমাদের বাড়িতেও তো খুব একটা জায়গা নেই। থাকলে…. আমি বললাম— না মাসিমা আমি কারও বাড়িতেই থাকতে চাই না। হোটেলেই যাব, কিন্তু আমি তো চিনি না কিছু তেমন, তাই রথী যদি….

—রথীও তো খুব চেনে। শোনো মন্দার, আমি রথীর সঙ্গে তোমার বিছানা করে দিচ্ছি। আজ খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়ো। কাল দেখা যাবে।

খেতে আমার ইচ্ছে করছে না। গা-বমি করছে। অদ্ভুত একটা স্থবিরতা সমস্ত শরীরে। এত গ্লানি যে বলার নয়। কেউ আমাকে চায় না, আমি কারও নই, নিজের অবাঞ্ছিত অস্তিত্বটাকে বারবার একজনের পর একজনের ওপর চাপিয়ে যাচ্ছি। কে রথী? কে-ই বা রথীর মা? একটা সুখী পরিবারের একজন ছেলে, একজন গৃহিণী, কী উটকো বিপদে আমি এঁদের ফেললাম! এত রাত্রে আমার মতো একটা ছেলেকে তো সত্যিই হোটেলে পাঠাতে এঁরা পারেন না! একটা দায়িত্ববোধও তো আছে! দয়া-মায়া-মমতা না হোক চক্ষুলজ্জাও তো আছে। নিজের ওপর প্রচণ্ড রাগ, তার চেয়েও বেশি ঘৃণা নিয়ে আমি রথীর পেছন-পেছন ওর চিলেকোঠার পড়ার ঘরে গেলাম।

এটা পড়ার ঘর, এখানে ও শোয় না। কিন্তু আজ মাসিমা এ ঘরেই দুজনের বিছানা করে দিয়েছেন। আমি বললাম— রথী, তুমি কেন আবার কষ্ট করবে? তুমি নীচে যেমন থাকো, তেমনিই থাকো না, আমি একা শুতে পারব।

রথী বলল— তুমি এত কিন্তু কিন্তু করছ কেন বলো তো? তুমি শুয়ে পড়ো, আমি খেয়ে তোমার জন্যে দুধ নিয়ে আসছি। শিওর খাবে না? আমি বললাম— একেবারে শিওর।

কখন ঘুমিয়ে পড়েছি। এত উদ্বেগ, এত চিন্তার মধ্যেও দিব্যি ঘুমিয়ে গেছি।

ঘুমিয়ে একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলাম। দেখি কী, আমার ভীষণ জ্বর হয়েছে। তাপমাত্রা ক্রমাগত এমন উঠে যাচ্ছে যে রথী ওর বাবা-মাকে ডেকে এনেছে। সেই সঙ্গে ওদের যৌথ পরিবারের আরও কেউ কেউ, তাঁদের আমি চিনি না, তাঁরাও এসে দাঁড়িয়েছেন। ওঁদের পারিবারিক ডাক্তার এসে ভাল করে পরীক্ষা করে দেখছেন। মাথায় আইস-ব্যাগ আর পায়ে হটব্যাগ লাগানো হয়েছে। উনি বলছেন জ্বরটা কমিয়ে রাখা ছাড়া এখন আর কিছু করবার নেই। রক্ত পরীক্ষা করতে হবে। রক্ত পরীক্ষার ফলাফলটা না পাওয়া গেলে কিছুই বলা যাচ্ছে না। ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া সন্দেহ করছেন উনি।

রথীর বাবা বললেন— পরের ছেলেকে নিয়ে কী বিপদে পড়া গেল, দেখো তো! রথী ওর বাড়ির ঠিকানা-টিকানা বার করো। খবর দিতে হবে।

এরপর বোধহয় ঘুমিয়েছি। সেই ঘুমটা পাতলা হয়ে এসেছে দেখি আরেকটা স্বপ্ন। আগেরটার সঙ্গে এ স্বপ্নটা দিব্যি জোড়া লেগে গেল। দেখি কী একটা স্ট্রেচার নিয়ে মাইকেল আর রুডি দাঁড়িয়ে আছে, ওরা আমায় স্ট্রেচারে তুলে নিল। একটা অ্যাম্বুলেন্সে করে আমাকে ওরা কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। ওরা কি আমাকে রাধানগরে নিয়ে যাবে? না রাখালবাবুর কাছে সেই শেয়ালদার বাসা বাড়িতে? না কি কোনও হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে ফেলবে!

কখনও দেখি রাধানগরের রাস্তা। চারদিকে শিশু আর শিরীষ গাছের ছায়া, দামোদর নদ সরু ঘোলাটে ধারায় বয়ে যাচ্ছে। ঝুরিঅলা সেই বট গাছটা। তার থেকে জোড়ায় জোড়ায় ছায়ামূর্তি বেরিয়ে আসছে। কিন্তু ওদের আর আমার ভয় করছে না। কোনও এক সময়ে ওদের ভয় পেয়েছিলাম মনে করেও আমার কষ্ট হচ্ছে। কেন না, ওরা যে আমারই মতো। একেবারে একরকম। ওরা নাম পরিচয়হীন পরিত্যক্ত কতগুলো অস্তিত্ব। ওরা আমার বন্ধু। আমার সঙ্গে সঙ্গে চলেছে। রাস্তায় বড্ড গর্ত, তার মধ্যে পড়তেই আমার অ্যাম্বুলেন্স আমার শরীর মন ঝাঁকানি খেয়ে কাতরে উঠছে, দূরে দেখতে পাচ্ছি একটা দুর্গ, দুর্গের প্রাচীর সব নিশ্ছিদ্র, খালি বুরুজে বুরুজে কামান কাঁধে নিয়ে গোলন্দাজ সৈনিকরা দাঁড়িয়ে রয়েছে। কালো কাপড়ে ওদের মুখ ঢাকা।

স্বপ্নের মধ্যেই আমি স্বপ্নের অর্থ বিশ্লেষণ করি। ওই দুর্গ ওটা মৃত্যু। ওইখানে যাবার জন্যই আমার এত আকুলিবিকুলি। জীবন ভেবে ওই মৃত্যুর দিকেই ক্রমাগত অভিযান চালিয়ে যাচ্ছি আমি। কামান হাতে মৃত্যুদূতরা দাঁড়িয়ে রয়েছে। ওরা গোলা ছুড়ছে, ওদের এড়িয়ে উল্লসিত হচ্ছি, কিন্তু মজা হচ্ছে, ওদের এড়িয়ে ওদের ঘাঁটির দিকেই ছুটে চলেছি ক্রমাগত। যাব, ওই দুর্গেই যাব, ঢুকব শেষ পর্যন্ত, কিন্তু এভাবে স্বপ্নের মধ্যে নয়, ঘুমের মধ্যে নয়, ঘুমের মধ্যে আমাদের নিজের ওপর কোনও নিয়ন্ত্রণ যে থাকে না, আমি তো ঢুকতে চেয়েছিলাম নিজের সিদ্ধান্তে টগবগে একটা ঘোড়ায় চেপে। তাই প্রাণপণে ঘুমটা ঝেড়ে ফেলে জেগে উঠতে চেষ্টা করি।

আর এই চেষ্টার ফলেই পিছলে চলে যাই আর একটা স্বপ্নে। সেখানে সাদা দেয়াল, সাদা পর্দা, আমার নাকে কী যেন আটকানো থাকে, হাতের মণিবন্ধেও যেন চিনচিনে ব্যথার অনুভূতির মধ্যে দিয়ে কিছু একটা আটকানো থাকতে দেখি, সাদা ক্যাপ-পরা মসৃণ মুখ মেয়েরা আমার চারপাশে ঘোরাফেরা করতে থাকে। এত অচেনা মুখ! এত সাদা ক্যাপ! এই স্বপ্ন আমার পছন্দ হয় না। কিন্তু স্বপ্ন যে কিছুতেই ইচ্ছে মতো বদলানো যায় না। তাই আত্মসমর্পণ করে দিই। হে স্বপ্ন, কী দেখাতে চাও আমাকে, কী-ই বা বোঝাতে চাও! রাধামাধবের মন্দিরে ঢং ঢং করে ঘণ্টা বাজে। বড় জ্যাঠামশাই কপালে চন্দনের তিলক এঁকে কী করুণ স্বরে গাইতে থাকেন ‘বল বল তোমার কুশল শুনি, তোমার কুশলে কুশল মানি।’

ক্রমে স্বচ্ছ হয়ে যায় ঘুমের অন্ধকার, স্বপ্নের পর্দা সাদা হয়ে যায়, দেখি সামনে মন্দাকিনীর মুখ, তার পাশে রথী, তার পাশে রথীর মা, তার পরে একেবারে পায়ের দিকে উনি দিদিমা। এটা স্বপ্ন নয়।

আমি একেবারে মূক।

—কেমন লাগছে এখন মন্দার! রথীর মা জিজ্ঞেস করলেন। ইনি কোথা থেকে এলেন? তার পরে মনে পড়ল রথীদের বাড়িতেই তো আমি গিয়েছিলাম! তা হলে মন্দাকিনী? দিদিমা? রথী— মন্দাকিনীর সঙ্গে কথা বলছে, ওরা কি পরস্পরকে চিনত?

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress