রাতদুপুরে
যখনকার কথা বলছি তখন বাঁকড়া, শলপ প্রভৃতি জায়গাগুলো অজ পাড়াগাঁ ছিল। আর চারদিক ছিল বনজঙ্গলে ভর্তি। মার্টিন কোম্পানির রেলগাড়ি তখন লোকের উঠোনের ওপর দিয়ে, পুঁইমাচার পাশ দিয়ে ছাগলের মতো মুখ নেড়ে নেড়ে যেত। সেই সময় একবার কলেরার মহামারী দেখা দেয় ওই অঞ্চলে।
আমার মামা তখন শখের দলে যাত্রা করত। আর মাঝে মাঝে মড়া পোড়াতে যেত। সেদিন সকাল থেকে প্রচণ্ড বৃষ্টি হয়েছে। শলপের এক বুড়ি মারা গেছে মহামারীতে। বুড়ি খুব গরিব। তার ওপর কেউ কোথাও নেই তার। কাজেই সারাদিন পড়ে থাকা সত্ত্বেও সৎকার হয়নি। খবর পেয়ে মামা এবং আরও তিন সঙ্গী মিলে বুড়ির গতি করতে চলল।
সন্ধের পর খবর পেয়ে তারপর তোড়জোড় করে মড়া নিয়ে আসতে রাত্রি হয়ে গেল অনেক।
পথে কোনও জনপ্রাণী নেই। মাঝে মাঝে শেয়ালের ডাক ও সেইসঙ্গে কুকুরের ক্রুদ্ধ প্রত্যুত্তর শোনা যাচ্ছে। ঝিমঝিম করে বৃষ্টিও পড়ছে ক্রমাগত।
বাঁশতলার শ্মশান অনেক দূরের পথ। শববাহকেরা মাঝে মাঝে হরিধ্বনি দিয়ে মড়া নিয়ে আসতে লাগল।
মামা ছিল সামনের দিকে। আসতে আসতে হঠাৎ মনে হল কে যেন মুঠো করে চেপে ধরল মামার ডান হাতের কব্জিটাকে। হিমশীতল বরফের মতো সেই হাত। হাতটা ক্রমশ আরও জোরে চেপে ধরতে লাগল কব্জিটাকে। মামা বাঁ হাতে করে অনেক চেষ্টা করতে লাগল সেই হাতটাকে ছাড়াবার। কিন্তু না, সব চেষ্টাই বিফল হল।
এদিকে শববাহকেরা পথশ্রমে ক্লান্ত হয়ে পড়ল খুব। আমার মামার নাম চণ্ডী ব্যানার্জি। একজন বলল, “এবার মড়াটাকে নামিয়ে কোথাও একটু বসা যাক। কী বলো চণ্ডীদা? বড্ড হাঁফিয়ে পড়েছি।”
অন্যান্য সঙ্গীরাও বলল, “হ্যাঁ, সেই ভাল। অনেকক্ষণ হাঁটছি। পা ভেরিয়ে পড়েছে এবার।”
মামা দেখল, এই অবস্থায় যদি সত্যি সত্যিই মড়া নামাতে হয় তা হলে বিপদের আর শেষ থাকবে না। কেননা যে কোনও উপায়েই হোক মৃতের হাত কব্জিটাকে টিপে ধরে আছে এবং সে হাত যখন ছাড়ানো যাচ্ছে না তখন মড়া নামানোর পর সেই দৃশ্য দেখলেই সঙ্গীরা ভয়ে পালাবে। এবং ব্যাপারটা যদি ভৌতিক, মানে দানো পাওয়া গোছের কিছু হয়, তা হলে মামারও আর নিস্তার থাকবে না। এই রাতে বেঘোরে প্রাণ হারাতে হবে। তাই বুদ্ধি করে মামা বলল, “তোদের কি মাথাখারাপ হয়েছে? এই ঝিমঝিমে বৃষ্টিতে মড়া নিয়ে রাখবি কোথায়?”
“যে কোনও একটা গাছতলায়।”
“না। রাত্রিবেলা মড়া যেখানে-সেখানে নামাতে নেই।”
শববাহকেরা চলতে লাগল।
এদিকে হাতের মুঠোও ক্রমশ এমনই কঠিনতর হতে লাগল যে, মামার চোখ ফেটে জল আসতে লাগল তখন।
শববাহকেরা আবার বলল, “চণ্ডীদা, আর পারছি না।”
মামা বলল, “পারতেই হবে। কদমতলার মোড় পর্যন্ত যেতেই হবে যেমন করে হোক। এই তো শানপুরের কালীতলা পেরিয়ে এলুম, আর একটু চ’।”
“না। এখানেই নামাও। মড়াটা বড্ড ভারী হয়ে উঠেছে। তাই পা চলছে না আর।”
মামা ধমক দিয়ে বলল, “এত অধৈর্য তো এলি কেন? একে কলেরার মড়া, সারাদিন পড়ে আছে। তার ওপর শনিবার। সঙ্গে কোনও মোচা বা গোবর দেওয়া নেই। যেখানে-সেখানে মড়া নামিয়ে মরবি নাকি?”
এর পর আর কথা চলে না। অকাট্য যুক্তি। মামার কথা মেনে নিয়ে সবাই জোরে জোরে হরিবোল দিয়ে চলতে লাগল।
দেখতে দেখতে কদমতলা এসে গেল। রাতও শেষ হয়ে এসেছে তখন। কদমতলার মোড়ে একটা মিষ্টির দোকান ছিল। তারা তখন ঘুম থেকে উঠে যে যার কাজে লেগে পড়েছে।
শববাহকেরা দোকানের সামনে এসে দাঁড়াল।
মামা বলল, “এখুনি নামাস না। আগে একটা লোহা-টোহা কিছু দেওয়া হোক। তারপর মড়া নামিয়ে চা-টা খেয়ে আবার যাব।” বলে দোকানের ছোকরা চাকরটাকে ডাক দিল, “গনশা! এই গনশা—”
মামার গলা পেয়ে গনশা বেরিয়ে এল, “কে? চণ্ডীদা?”
“হ্যাঁ। শিগগির একবার আলোটা নিয়ে আয় তো ভাই।”
গনশা লণ্ঠন নিয়ে বেরিয়ে এল।
গনশা আসতেই মামা বাঁ হাতের তর্জনী দিয়ে ইঙ্গিতে ডান হাতটা দেখিয়ে দিল। দ্যাখামাত্রই গনশাও বুঝে নিল ব্যাপারটা। বলল, “একটু দাঁড়াও। মড়া নামিও না। এক মিনিট।” বলেই ছুটে ভেতরে গিয়ে কুডুলটা নিয়ে এসে বুড়ির হাতের ওপর বসিয়ে দিল এক কোপ।
মৃতের কঠিন হাত আলগা হয়ে খসে পড়ল। যেই না পড়া অমনই কেঁধোরা ভয়ে কাঁধের মড়া খাটিয়াসুদ্ধু ছুড়ে ফেলে দিয়ে দৌড়ে ঢুকে পড়ল দোকানের ভেতর। মামাও তখন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।
তারপর তো সে মড়া নিয়ে আর কেউ পোড়াতে যেতে রাজি হয় না। অবশেষে সবাই অনেক করে বোঝাতে পরদিন সকালে আরও দু-একজনকে সঙ্গে করে বুড়িকে নিয়ে চলল দাহ করতে। তবে আমার মামা কিন্তু সেই থেকে আর কখনও মড়া পোড়াতে যায়নি। মড়া পোড়ানোর নামে মামার সেই আতঙ্কটা এখনও রয়ে গেছে।