Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » রাজা ওভিড্ডোর তরবারি || Anil Bhowmick

রাজা ওভিড্ডোর তরবারি || Anil Bhowmick

তখন সবে ভোর হয়েছে। ফ্রান্সিসদের জাহাজের চারপাশে কুয়াশার আস্তরণ। নজরদার পেড্রো মাস্তুলের ওপর থেকে চেঁচিয়ে বলল, ডাঙা দেখতে পাচ্ছি। কুয়াশা না কাটলে আর কিছু দেখা যাবে না।

ঘুম-ভাঙা চোখে কয়েকৰ্জন ভাইকিং কেবিনঘর থেকে জাহাজের ডেক-এ উঠে এলো। তখনই হঠাৎ একটা জোর হাওয়ায় সমুদ্রের ওপর ছড়ানো কুয়াশার আস্তরণ সরে গেল। পেড্রো চেঁচিয়ে বলল, বন্দর, একটা ছোটো বন্দর দেখা যাচ্ছে। ফ্রান্সিসকে ডাকো।

ভাইকিংদের কয়েকজন ছুটে সিঁড়ি বেয়ে একটা কেবিনঘরের দরজার সামনে এলো। এই কেবিনঘরে ফ্রান্সিস আর মারিয়া থাকে। দরজায় আঙুল ঠুকে একজন ভাইকিং গলা। চড়িয়ে বলল, ফ্রান্সিস, একটা ছোটো বন্দরের কাছে এসেছি আমরা। এবার কী করব?

দরজা খুলে গেল। ফ্রান্সিস বলল, চলো। আগে সব দেখি।

ফ্রান্সিসরা ডেক-এ উঠে এলো। ফ্রান্সিস জাহাজ চালক ফ্লেজারের কাছে এলো। বলল, ফ্লেজার, জাহাজ এখনই ওই বন্দরে ভিড়িও না। সবকিছু দেখেশুনে তারপর এগোব। ফ্লেজার জাহাজ ঘোরাল।

মারিয়া আর হ্যারি এলো। হ্যারি রেলিঙে ঝুঁকে বন্দরটা দেখল। বলল, ফ্রান্সিস, একটু ভেবেচিন্তে কাজ করতে হবে। লক্ষ্য করো যে দুটো জাহাজ বন্দরে ভেড়ানো, সেই দুটো জাহাজই যুদ্ধজাহাজ। ব্যবসায়ীদের জাহাজ নয়। তার মানে এই এলোকায় বোধহয় যুদ্ধের আয়োজন চলছে। কাজেই জাহাজ এখানেই থামালে ভালো হয়।

কথাটা ঠিকই বলেছ। ফ্রান্সিস বলল। তারপর ফ্লেজারকে বলল, জাহাজ এখানেই থামাও। তারপর শাঙ্কোর দিকে তাকিয়ে বলল, শাঙ্কো, এখানেই নোঙর ফেলো। আমরা আর এগোব না।

ঘরঘর শব্দে নোঙর ফেলা হল। জাহাজ দাঁড়িয়ে পড়ল।

কিছুক্ষণের মধ্যেই শাঙ্কো আর বিস্কো তৈরি হল। ফ্রান্সিস তলোয়ার সঙ্গে নিতে নিষেধ করলে। শাঙ্কো আর বিস্কো দড়িতে বেঁধে দুটো পিপে ছোটো নৌকোটায় নামাল। তারপর নিজেরাই নামল। নৌকো চালাল তীরভূমির দিকে। জাহাজঘাটার দিকে গেল না।

নির্বিঘ্নেই তীরে পৌঁছল। তারপর নৌকো থেকে পিপে দুটো নিয়ে চলল খাওয়ার জলের সন্ধানে। প্রথমে জানতে হবে খাওয়ার জল কোথায় পাওয়া যাবে। যাচ্ছে ওরা যখন তখন দেখতে পেল একটা বিরাট প্রান্তরের মধ্যে মাত্র একটা বাড়ি। ধারেকাছে আর কোনও বাড়ি নেই।

দু’জনে বাড়িটার কাছে এলো। বন্ধ দরজার আঙুল ঠুকল। দরজা খুলে গেল। এক বৃদ্ধ এসে দাঁড়ালেন। শাঙ্কো জিজ্ঞেস করল, এখানে জল কোথায় পাব বলতে পারেন?

বৃদ্ধ একটু চুপ করে থেকে বললেন, আপনারা বিদেশি?

হ্যাঁ। কিন্তু বিদেশি বলে কি আমাদের জলতেষ্টা পায় না? শাঙ্কো বলল।

বৃদ্ধ বললেন, সেকথা নয়। এটা পোর্তুগালের মধ্যে। এখানকার রাজা অপর্তো। উত্তরে আছে লরুল্লা। রাজার নাম ভিলিয়ান। সেটা উত্তর স্পেনের মধ্যে। দুই রাজ্যে চলছে যুদ্ধের প্রস্তুতি। এই সময় বিদেশি আপনাদের বিপদ হতে পারে।

শাঙ্কো বুঝল জল জোগাড় করা বেশ কষ্ট হবে। বৃদ্ধটি আঙুল তুলে উত্তর দিকটা দেখিয়ে বললেন, ওইদিকেই বন্দর এলাকা। ওই এলাকা পার হয়ে দেখবেন একটা উঁচু টিলা। তার নীচে আছে ঝরনা। সেই ঝরনার জলই আমরা খাই।

ঠিক আছে। দেখি জল আনতে পারি কি না। শাঙ্কো বলল।

দু’জনে চলল বন্দর এলাকার দিকে। যেতে যেতেশাঙ্কো বলল, এই বন্দর এলাকাটাই এড়াতে চেয়েছিলাম। কিন্তু হল না। এখান দিয়েই যেতে হবে ঝরনাটায়।

বন্দর এলাকায় এলো। দেখল, বেশ ব্যস্ত এলাকা। দোকানপাট। বাড়িঘর। রাস্তায় বেশ লোকজন। একজন লোক বাজার টাজার করে যাচ্ছিল। শাঙ্কো তাকে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা এখানে ঝরনাটা কোথায়? লোকটি আঙুল তুলে টিলাটা দেখাল।

দু’জনে টিলার দিকে চলল। টিলাটার নীচে পৌঁছবার আগেই চারজন সৈন্য ওদের দিকে ছুটে এলো। দু’জনকে ঘিরে দাঁড়াল। দাড়ি গোঁফওয়ালা সৈন্যটি বলল, দাঁড়াও। শাঙ্কোর দাঁড়িয়ে পড়ল। সৈন্যটি বলল, তোমাদের পরিচয়?

আমরা ভাইকিং। শাঙ্কো বলল।

এখানে কী করে এলে? সৈন্যটি বলল।

জাহাজ চালিয়ে এসেছি। বিস্কো বলল।

তোমরা লরুল্লার রাজা ভিলিয়ানের গুপ্তচর!

তোমরা লরুল্লার রাজা ভিলিয়ান, এসব নাম এই প্রথম শুনলাম। শাঙ্কো বলল।

সেসব বুঝি না। তোমাদের বন্দি করা হল। সৈন্যটি বলল।

আমাদের জাহাজে জলের অভাব হয়েছে। আমরা জল নিয়ে যেতে এসেছি। তাই পিপে এনেছি। শাঙ্কো বলল।

ওসব অজুহাত শুনব না। চলো। সৈন্যটি বলল।

পিপে দুটো? বিস্কো বলল।

এই দোকানে রেখে যাও। সৈন্যটি বলল। তারপর কাছের দোকানটার দোকানিকে ডাকল। দোকানি তো ভয়ে সারা। তাড়াতাড়ি ছুটে এলো। সঙ্গে ওর কর্মচারী। সৈন্য বলল, এই পিপে দুটো তোমাদের দোকানে রাখো দোকানদার আর তার কর্মচারী মিলে পিপে দুটো নিয়ে গেল।

সৈন্যটি বলল, আমাদের সঙ্গে এসো। পালাবার চেষ্টা করবে না। সৈন্যটি চলল।

একটু যেতেই সৈন্যটির সঙ্গী দু’জন বলল, আমরা টিলার নীচে নজর রাখতে যাচ্ছি। তোমরা যাও। দুজন সৈন্য চলে গেল। গোঁফদাড়িওয়ালা সৈন্যটি আর তার সঙ্গীটি চলল।

যেতে যেতে শাঙ্কো মৃদুস্বরে ওদের দেশের ভাষায় বলল, বিস্কো, দাড়িওয়ালা আমার, চিমসেটা তোমার। কিছুটা যেতেই দেখা গেল একটা মোড়। শাঙ্কো আবার বলল, ডান দিকের গলিটা দিয়ে। গোঁফদাড়িওয়ালা সৈন্যটি গলা চড়িয়ে বলল, কী বলছ তোমরা?

যিশুর নাম নিচ্ছি। শাঙ্কো বলল।

গোঁফদাড়িওয়ালা খ্যাক খ্যাক করে হেসে উঠল। শাঙ্কো হঠাৎ পেট চেপে বসে। পড়ল। গোঁফদাড়িওয়ালা এগিয়ে আসছে, তখনই শাঙ্কো দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে দাড়িওয়ালার পেটে মাথা দিয়ে লাগাল এক গুঁতো। দাড়িওয়ালা দু’হাত তুলে রাস্তায় চিৎ হয়ে পড়ে। গেল। বিস্কো অন্যটির পায়ে এমনভাবে নিজের পা জড়িয়ে টান মারল যে, সেই সৈন্যটিও রাস্তায় পড়ে গেল। বিস্কো পা দিয়ে ল্যাং মারতে ওস্তাদ। বন্ধুদের এভাবে ফেলে দেয়। দুজনেরই হাত থেকে তলোয়ার ছিটকে গেল।

জলদি। শাঙ্কো কথাটা বলেইডান দিকের গলিতে ঢুকে পড়ল। পেছনে বিস্কো। দুজনে ছুটল।

সৈন্য দু’জন উঠে দাঁড়াল। তাদের সারা গায়ে ধুলোবালি লেগেছে। দাড়িওয়ালার দাড়িতেও ধুলো লেগেছে। দু’জনে গা থেকে ধুলো ঝাড়তে লাগল। তারপর গলিটায় ঢুকে শাঙ্কোদের ধরতে ছুটল। তখন বেশ দেরি হয়ে গেছে।

শাঙ্কোরা ছুটছে তখন। একটু পরে বাঁ দিকে একটা পোড়ো বাড়ি দেখল। দরজা হাট করে খোলা। দু’জনেই খোলা দরজা দিয়ে ঢুকে পড়ল। শাঙ্কো দরজা বন্ধ করে দিল। দরজার খিলটা আধ ভাঙা। শাঙ্কো ঐ খিলটা চেপে ধরে রইল। দু’জনে কিছুক্ষণ দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে রইল। হাঁফাতে লাগল। কিছুক্ষণ পরেই দেখল, গোঁফদাড়িওয়ালা সৈন্যটি তার সঙ্গীকে নিয়ে রাস্তা দিয়ে ছুটে চলে গেল। দুজনে নিশ্চিত। বাড়িটার ছাত ভেঙে পড়েছে। পাথরের দেওয়ালে, থামে বুনো গাছ জন্মেছে। সামনের আধ-ভাঙা ঘরটায় দু’জনে ঢুকল। দেখল ঘরটার দরজা-জানালার চিহ্ন নেই। শুধু একটা জানলা অর্ধেকটা ভাঙা। লোহার ফ্রেম সবটা ভেঙে পড়েনি। ঘরটার মাঝামাঝি জায়গায় একটা খাট। খাটটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে একসময়ে খাটটা শৌখিন খাট ছিল। এখনও কাঠের গায়ে ফুল-লতাপাতার কাজ করা। খাটটার ওপরে জমা ধুলোটুলো ঝেড়ে নিয়ে দু’জনে বসল।

বেশ বেলা হয়েছে। খিদেয় পেট জ্বলছে। কিন্তু ওরা বাইরে বেরোতে সাহস পাচ্ছে না। খাওয়ার ব্যবস্থা করতেইহবে। শাঙ্কো উঠেদাঁড়াল। বলল, বিস্কো, আমি খাবার কিনে আনছি।

আবার ওই দাড়িওয়ালার পাল্লায় পড়বে। বিস্কো বলল।

না, না। দেখি চেষ্টা করে। শাঙ্কো বলল।

শাঙ্কো ভাঙা বাড়িটা থেকে বেরিয়ে এলো। চলল সদর রাস্তার দিকে। সদর রাস্তায় এসে হাঁটতে লাগল পুবমুখে। কিছুটা যায় আর চারপাশের লোকজন দেখে। সৈন্য দেখলেই কোনো দোকানে ঢুকে পড়ছে। সৈন্যরা চলে গেলেই বেরিয়ে আসছে। কপাল ভালো বলতে হবে, একটা ছোটো সরাইখানা দেখল। ও ঢুকে পড়ল। একটা লোক রুটি তৈরি করছে। দোকানের মালিক কাঠের বাক্স সামনে নিয়ে বসে আছে। শাঙ্কো রুটি, আলু আর নানা শাকের তৈরি তরকারি চাইল। যে-লোকটি রুটি তৈরি করেছিল সে এগিয়ে এলো। দুটো গোল পাতায় ভরে দিল রুটি-তরকারি। শাঙ্কো কোমরের ফেট্টি। আলগা করে ভাঙানি মুদ্রা দিল মালিককে। খাবার নিয়ে চলে এলো ভাঙা বাড়িটায়। দু’জনে রুটি তরকারি খেল। যা খিদে পেয়েছিল। কিন্তু জল নেই। জল খাওয়া হল না।

শাঙ্কো ভাঙ্গা খাটে শুয়ে পড়ল। রাত না হলে এখন আর কিছু করার নেই। রাত একটু বাড়লেই পালাবে। শাঙ্কো চোখ বুজে শুয়ে রইল। মাঝে মাঝে চোখ খুলছে। মাথার ওপর ভাঙ্গা ছাত দেখছে। আকাশ দেখছে। দেওয়াল দেখছে। কবেকার বাড়ি কে জানে! কারা থাকত এই বাড়িতে? পায়া ভাঙা খাটটা দেখে মনে হয় কোনো অবস্থাপন্ন পরিবারই এই বাড়িতে থাকত।

ঘরের এদিক-ওদিক দেখতে দেখতেশাঙ্কো হঠাই দেখল–পূবদিকের একটা জানালা প্রায় অটুট। অন্য জানালাগুলোর অস্তিত্বই নেই। জানালার জায়গাগুলোয় ফোকর; ভাঙা পাথর। সবগুলো জানলা ভাঙা। একটা জানালার ফ্রেম কী করে এতটা অটুট রইল। শাঙ্কো খাট থেকে উঠল।

জানালাটার কাছে এলে। জানালার কাছে এসে দেখল জানালার ফ্রেমটা লোহা দিয়ে তৈরি। শাঙ্কো দুহাতে জানলাটা ধরে টেনে দিল। ঝাঁকুনি দিল। কিন্তু জানালার ফ্রেম ভাঙা গেল না। শাঙ্কো হাল ছাড়ল না। অন্যসব জানালা নিষ্মই কাঠের তৈরি ছিল। শুধু এটাই কেন লোহার ফ্রেমের? নিশ্চয়ই এর কোনো কারণ আছে।

শাঙ্কো এবার শক্ত হাতে জানালার ফ্রেমটা ঝাঁকাতে লাগল। হাঠাৎই জানালার নীচের দিকে ফ্রেমের অংশটা ভেঙে বেরিয়ে এলো। ঝর ঝর করে পাথরের কুচি পড়ল। শাঙ্কো তখন হাঁপাচ্ছে। ফ্রেমের ভাঙা অংশটা ফেলে দিল। দেখল সেখানে একটা টানা গতমতো। তার মধ্যে একটা পার্চমেন্ট কাগজ। শাঙ্কো একটু অবাকই হল। কীসের কাগজ এটা? কাগজটা হলদে হয়ে গেছে। শাঙ্কো আস্তে আস্তে গোটানো কাগজটা ওর ছুরি দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বের করে আনল। গোল করে পাকানো কাগজটা আস্তে আস্তে খুলল। দেখল কাগজটার ওপর দিকে কী যেন লেখা। এক নজর দেখেই বুঝল লেখাটা পুরোনো স্পেনীয় ভাষায় লেখা। লেখাটার মাথায় লেখা রাজা ওভিড্ডোর তরবারি। শাঙ্কো কাগজটা ওলো। দেখল একটা নকশা।

শাঙ্কো কাগজটা নিয়ে খাটে এসে বসল। বিস্কো বলল–কী ব্যাপার? কাগজটা কী? কাগজটার একপিঠে একটা বিবৃতিমতো লেখা। অন্যপিঠে একটা নকশা আঁকা।

–কীরকম নকশা? শাঙ্কো বিস্কোকে কাগজটা দেখাল। বিস্কো কিছুই বুঝল না।

–গুপ্তধনের সন্ধান টন্ধান এই নকশায় আঁকা হয়েছে–এটাই আমার বিশ্বাস।

ঠিক আছে। আগে বিবৃতিটা পড়ি। এটা পড়লে অনেককিছু জানা যাবে। শাঙ্কো বলল।

শাঙ্কো থেমে থেমে পড়তে লাগল—

লিসবনের শহরতলিতে আমাদের বাড়ি। দারিদ্র্য আর অভাব ছিল আমাদের নিত্য সঙ্গী। আমি তাহা সহ্য করতে পারিলাম না। ভাগ্যান্বেষণে বহির্বিশ্বে বাহির হইয়া পড়িলাম। নানা দেশে ঘুরিয়া বেড়াইলাম। তারপর এই ভিগোনগরে আসিলাম। আশ্রয় পাইলাম। তখনই শুনিলাম রাজা ওভিড্ডোর লুক্কায়িত সাত হাত লম্বানিরেট সোনায় তৈয়ারি তরবারির কথা। লোকমুখে শুনিলাম,সাত হাত লম্বা সেইতরবারির কোষেনাকিমহামূল্যবান হীরামুক্তা চুনিপান্না বসানো। সম্পূর্ণ কোষটি মিনেকরা। লোকমুখে আরও শুনিলাম যে, সেই তরবারি এখানকার টিলায় নাকি গুপ্তভাবে রাখা হইয়াছে। আমি সেই তরবারির সন্ধানে জীবনের অধিকাংশ সময় ব্যয় করিয়া আজ আমি বৃদ্ধ অথর্ব। আমার জীবন শেষ হইয়া আসিয়াছে। একবার ভাবিলাম নকশাটি ছিঁড়িয়া ফেলি পুড়াইয়া ফেলি। কিন্তু রাখিলাম এই আশায়, যদি কেহ রাজা ওভিড্ডোর তরবারি খুঁজিয়া বাহির করিবার চেষ্টা করে।

রাজা ওভিড্ডোর তরবারি নকশা সম্পর্কে বলি, উহা আমি টিলার পশ্চিমদিককার গুহায় পাইয়াছিলাম। ইহাতে সেই গুহা, টিলা এবং টিলার নীচে চোটগাছের জঙ্গল অঙ্কিত আছে। একটি মৃত গাছের শুষ্ক কাণ্ডও অঙ্কিত আছে। ইহার অর্থ বুঝি নাই।

পড়া শেষ হল। শাঙ্কো কাগজটা বিস্কোকে পড়তে দিল। বিস্কো মনোযোগ দিয়ে নকশাটা দেখতে লাগল।

দু’জনে খাটে বসে রইল।

রাত হল। রাত বাড়তে লাগল। এবার কিছু খেতে হয়। শাঙ্কো আবার সেই সরাইখানা থেকে খাবার নিয়ে এলো। দু’জনে খেল।

দু’জনে খাটে শুল। শাঙ্কো ভাবতে লাগল এখন কী করে জাহাজে ফেরা যায়। ফ্রান্সিসকে এই লেখা আর নকশাটা দিতে হবে। এসব ভাবতে ভাবতে শাঙ্কো ঘুমিয়ে পড়ল। বিস্কো তার আগেই ঘুমিয়ে পড়েছে।

ওদিকে শাঙ্কো আর বিস্কো জাহাজেনা ফেরায় ভাইকিংরা বেশ দুশ্চিন্তায় পড়ল। ফ্রান্সিস রাতে ভালো করে ঘুমোতে পারল না। মাঝে-মাঝেই ডেক-এ উঠে আসতে লাগল। কিন্তু ওরা দু’জন ফিরল না। মারিয়া বলল, ফ্রান্সিস, অত দুশ্চিন্তা করছ কেন? শাঙ্কোদের কোনোও বিপদ হয়নি। বড়োজোর এখানকার কয়েদখানায় বন্দি হয়ে আছে। তুমি কাল সকালে যাও। কয়েদখানা খুঁজে বের করে ওদের কোনোও হদিস পাও কিনা দ্যাখো।

হ্যাঁ, কাল সকালে তো যেতেই হবে। খোঁজ করতেই হবে। ফ্রান্সিস বলল।

পরদিন সকালে বন্ধুরা কয়েকজন ফ্রান্সিসের কাছে এলো। শাঙ্কো আর বিস্কো সম্বন্ধে তাদের আশঙ্কার কথা জানাল। ফ্রান্সিস সকালের খাবার খেতে খেতে বলল, কিছু ভেবো না। আমি এক্ষুণি বেরোচ্ছি। ওদের ঠিক খুঁজে বের করব। বন্ধুরা চলে গেল।

ফ্রান্সিস উঠে দাঁড়িয়ে বলল, মারিয়া, লিসবনে যে এ-দেশের পোশাকটা কিনেছিলাম ওটা বের করে দাও।

ওই পোশাক দিয়ে কী হবে? মারিয়া বলল।

হবে, হবে। তুমি দাও পোশাকটা। ফ্রান্সিস বলল।

অল্পক্ষণের মধ্যেই ফ্রান্সিস ওই পোশাকটা পরে নিল। তারপর ডেক-এ উঠে এলো। বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে নিয়ে বলল, ভাইসব, আমি শাঙ্কো আর বিস্কোর খোঁজে যাচ্ছি। তোমরা কেউ তীরভূমিতে যাবে না।

ফ্রান্সিস দড়ি ধরে ধরে ওদের ছোটো নৌকোটায় নামল। জাহাজে বাঁধা দড়ি খুলে নৌকো ছেড়ে দিল। দেখল শাঙ্কোরা যে নৌকো চড়ে এসেছিল সেটা তীরে ভেড়ানো রয়েছে। কিন্তু নৌকোয় পিপে দুটো নেই।

ফ্রান্সিস এবার এক কাণ্ড করল। তীরভূমি থেকে ধুলোবালি নিজের মাথায়, মুখে, গায়ের পোশাকে ছিটিয়ে দিল। এক খ্যাপাটে মানুষের মতো চেহারা হল ওর।

প্রান্তর পার হয়ে জাহাজঘাটার কাছে বড়ো রাস্তাটায় এলো। তারপরে দুহাত তুলে বলতে লাগল, হে শাঙ্কো, হে বিস্কো, দেখা দাও। রাস্তায় একটু যায় আর দাঁড়িয়ে। পড়ে গলা ছেড়ে বলে, হেশাঙ্কো, হেবিস্কো দেখা দাও। অল্পক্ষণের মধ্যেই ফ্রান্সিসের ওপর সকলের নজর পড়ল। রাস্তার পথচারীরা, দোকানটোকানে কেনাবেচায় ব্যস্ত মানুষেরা অবাক হয়ে ফ্রান্সিসকে দেখতে লাগল। ফ্রান্সিস সেইভাবে বলেই চলেছে, হে শাঙ্কো, হে বিস্কো দেখা দাও।

ফ্রান্সিসের গায়ে এ-দেশের পোশাক দেখে ফ্রান্সিসকে কেউ বিদেশি বলে চিনতে পারল না। ফ্রান্সিস দু’হাত ওপরে তুলে বলে চলল, হে শাঙ্কো-হেবিস্কো দেখা দাও। এইভাবে যেতে যেতে ফ্রান্সিস ভাবল, গলিগুলোর মধ্যে ঢুকেও বলতে হবে। এবার ফ্রান্সিস গলিতে ঢুকল। চেঁচিয়ে বলতে লাগল। একটা গলি শেষ করে ডান দিকের গলিতে ঢুকল। একটু এগিয়েইদু’হাত তুলে বলতে লাগল। কিছুদুর গিয়ে পোড়ো বাড়িটার কাছে এলো। চিৎকার করে বলল, হে শাঙ্কো, হে বিস্কো দেখা দাও।

ঘরের মধ্যে শাঙ্কো আর বিস্কো চমকে উঠল। লাফিয়ে উঠল। ফ্রান্সিসের গলা শাঙ্কো দরজার কাছে ছুটে এলো। দরজা একটু ফাঁক করে দাঁড়াল। ফ্রান্সিস কাছাকাছি আসতেই শাঙ্কো দেশীয় ভাষায় বলে উঠল আমরা এখানে। ফ্রান্সিস সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে পড়ল। আস্তে আস্তে দরজার কাছে এলো। তারপর এক ঝলক এদিক-ওদিক দেখে দরজা ঠেলে ঢুকে পড়ল। দরজা বন্ধ করে দিল। দরজায় কোনো খিল নেই। শাঙ্কো বিস্কো ছুটে এসে ফ্রান্সিসকে জড়িয়ে ধরল। তিনজনই আনন্দে উদ্বেল। কিন্তু জোরে কথা বলতে পারছে না। দরজার পরেই রাস্তা। লোকজন যাচ্ছে আসছে।

তিনজনে বড়ো ঘরটায় এলো। খাটে বসল। শাঙ্কো সৈন্যদের হাতে ধরা পড়া, পালানো, সব ঘটনাই বলল। তারপর বলল, ফ্রান্সিস,এবার তো জাহাজেফিরতে হয়। কী করবে?

এখন কিছু নয়। খাওদাও, বিশ্রাম করো। রাতে জাহাজে ফিরতে হবে। ফ্রান্সিস বলল। তারপরেমাথারচুল, পোশাক থেকে ধুলোবালি ঝেড়ে ফেলতেলাগল। ফ্রান্সিসইএকসরাইখানা থেকে খবরকিনে আনল। দুপুরের খাওয়া হল। ফ্রান্সিস আবার বেরোল। সরাইখানারমালিকের কাছ থেকে এক হাঁড়ি জল নিয়ে এলো। শাঙ্কোরা এতক্ষণে জল খেতে পেল।

এবার শাঙ্কো সেই লেখাটা আর নকশাটার কাগজটা ফ্রান্সিসকে দিল। শাঙ্কো ওসব কীভাবে পেয়েছে তা বলল।

ফ্রান্সিস খাটে শুয়ে পড়ল। প্রথমে লেখাটা পড়ল। তারপর নকশাটা খুব মনোযোগ দিয়ে দেখল। বলল, শাঙ্কো, নকশায় দুটো জিনিস লক্ষ্য করো। এক, টিলার গায়ে গুহা; আর দুই, জঙ্গলের মধ্যে একটা শুকনো গাছ। ওই টিলার গুহাতেই লোকটি নকশাটা পেয়েছিল। এখন দেখতে হবে মরা শুকনো গাছটার কোনোও গুরুত্ব আছে কিনা।

তা হলে তো ওই বনে যেতে হয়। বিস্কো বলল।

তাই যেতে হবে। রাজা ওভিড্ডোর তরবারি ওখানেই কোথাও আছে, মানে রাজা ওভিড্ডো গোপনে রেখে গেছেন। ফ্রান্সিস বলল।

ওই জঙ্গলে এত খোঁজাখুঁজি করা সম্ভব? শাঙ্কো বলল।

সেটা ওই জঙ্গলে না গিয়ে বলতে পারছি না। ফ্রান্সিস বলল।

সন্ধে হল। ফ্রান্সিস বলল, এখন নয়। গভীর রাতে জাহাজে ফিরতে হবে।

রাত্রে খাবার ফ্রান্সিসই নিয়ে এলো। ওর পোশাক দেখে কেউবিদেশি বলে ভাবইেপারলনা। রাত গম্ভীর হল। নিস্তব্ধ রাত। একসময় ফ্রান্সিসরা খাট থেকে নামল। তৈরি হল। ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। দরজা খুলে রাস্তায় উঠল। রাস্তা জনশূন্য। ফ্রান্সিস বলল, রাস্তা দিয়ে যাওয়া চলবে না। ওখানে এখন যুদ্ধের প্রস্তুতি চলছে। সৈন্যরা সজাগ এখন। নিম্মই পাহারা জোরদার করা হয়েছে। আমরা ঝোপজঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যাব। ধরা পড়ার সম্ভাবনা কম।

রাস্তা পার হয়ে ফ্রান্সিসরা বুনো ঝোপজঙ্গলে ঢুকল। চাঁদের আলো উজ্জ্বল ঝোপ জঙ্গল মোটামুটি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। তিনজনে চলল।

যখন জাহাজঘাটার কাছে এলো, তিনজনেই হাঁপাচ্ছে। নিজেদের জাহাজ লক্ষ্য করে তীরভূমিতে হেঁটে হেঁটে আসতে দেখল ওদের নৌকো দুটো জলে ভাসছে। তিনজনেই নৌকোয় উঠল। দাঁড় টেনে চলল নিজেদের জাহাজের দিকে। নৌকো দুটো জাহাজের গায়ে লাগল। ফ্রান্সিসরা হালের কাছে দড়িদড়া ধরে ডেক-এ উঠে এলো। মাস্তুলের ওপর থেকে নজরদার পেড্রো চেঁচিয়ে বলল, ফ্রান্সিসরা এসেছে, ফ্রান্সিসরা এসেছে।

মারিয়া খুব দুশ্চিন্তায় ছিল। তখনও ঘুমোতে পারেনি। পেড্রোর ডাক শুনে মারিয়া ছুটল সিঁড়ির দিকে। ডেক-এ উঠে এসে ফ্রান্সিসদের দেখল। ওদিকে ভাইকিং বন্ধুরাও ছুটে এলো। ফ্রান্সিসরা ফিরে এসেছে। সবাই খুশি।

পরদিন সকালে রাঁধুনি বন্ধু ফ্রান্সিসের কাছে এলো। খাওয়ার জল খুব বেশি নেই। জল আনতে হবে। ফ্রান্সিস ডেক-এ উঠে এলো। শাঙ্কো আর বিস্কোকে বলল, তোমরা জল আনতে গিয়েছিলে। পিপে দুটো কী হল। শাঙ্কো তখন সবই বলল।

ওইটা দোকানটা চিনতে পারবে? ফ্রান্সিস বলল।

হ্যাঁ, হ্যাঁ। শাঙ্কো বলল।

তাহলে এখন চলো। তেমারসবচেয়ে ঘেঁড়া যে জামাটা আছে সেটা পরে এসো। ফ্রান্সিস বলল।

ফ্রান্সিস এ-দেশের পোশাকটা পরল। শাঙ্কো ওর ভেঁড়াখোঁড়া পোশাকটা পরে নিল।

দু’জনে নৌকো বেয়ে তীরে এলো। সদর রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলল। ফ্রান্সিস শাঙ্কোকে বলল, বেশ খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটো। শাঙ্কো সেভাবেই হাঁটতে লাগল। দোকানটার সামনে এলো। শাঙ্কো দোকানদারকে দেখিয়ে দিল। ফ্রান্সিস এগিয়ে গিয়ে শাঙ্কোকে দেখিয়ে বলল, একে চিনতে পারেন?

দোকানদার একটুক্ষণ শাঙ্কোর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, সৈন্যরা ধরে এনেছিল।

ওর এক বন্ধুও ছিল? ফ্রান্সিস বলল।

হ্যাঁ। দোকানি বলল।

এরা দুটো জলের পিপে রেখে গেছে।

হ্যাঁ, হ্যাঁ। দোকানদার দোকানের ভেতর থেকে পিপে দুটো বের করে দিল।

ফ্রান্সিস আর শাঙ্কো পিপে দুটো নিয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে এলো। ফ্রান্সিস বলল, খাবার জল কোথায় পাওয়া যাবে সেটা জেনেছিলে?

হ্যাঁ, ওই টিলাটার নীচে নাকি ঝরনা আছে। শাঙ্কো বলল।

ঠিক আছে। চলো সেখানে। ফ্রান্সিস বলল।

দুজনে চলল টিলাটার দিকে। দুজনের হাতে দুটো পিপে। দূর থেকে দেখল টিলাটা। ন্যাড়া মাথা টিলা। কিছুক্ষণের মধ্যে টিলাটার নীচে পৌঁছল। দেখল টিলাটার নীচে কিছু গাছগাছালি আছে। তারই মধ্যে দিয়ে ঝরনার জল পড়ছে। জলধারাটা খুব বেশি জোরে পড়ছে না। মাটির হাঁড়ি কাঠের গামলা নিয়ে বেশ কিছু লোক জল নিতে এসেছে। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হল তারপর ফ্রান্সিসরা পিপে বসাল। জল ভরল। বেশ কিছু লোক ফ্রান্সিসদের তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল। সহজেই বুঝল–ওরা বিদেশি। ফ্রান্সিস আর শাঙ্কো খাবার জল নিয়ে জাহাজে ফিরে এলো। হ্যরি বলল, ফ্রান্সিস, জলের সমস্যাটা তো মিটল। এবার জাহাজ চলুক দেশের দিকে।

ফ্রান্সিস একটু হেসে বলল, আজকের রাতটা এখানেই থাকতে হবে।

ব্যাপার কী বলো তো?

রাজা ওভিড্ডোর তরবারি খুঁজে বের করতে হবে।

হ্যারি দু’হাত ছড়িয়ে বলল, ব্যস, হয়ে গেল!

ফ্রান্সিস হেসে বলল, আমার কেবিনঘরে এসো। সব বলছি। নকশাটাও দেখবে।

দু’জনে ফ্রান্সিসের কেবিনঘরে এলো। ফ্রান্সিস লেখাটা দেখাল। নকশা দেখাল। সব বলল। শাঙ্কোরা কীভাবে নকশাটা পেয়েছে তাও বলল। হ্যারি বলল,হু। তা হলে কখন তরবারি খুঁজতে যাবে?

আজ রাতেই। ফ্রান্সিস বলল।

রাত হল। ফ্রান্সিস শাঙ্কোকে ডেকে পাঠাল। শাঙ্কো এলো। ফ্রান্সিস বলল, তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও। বিশ্রাম করো। তুমি আর আমি টিলার নীচের জঙ্গলে যাব। রাজা ওভিড্ডোর তরবারি উদ্ধার করব। তুমি দুটো মশাল, চকমকি পাথর নেবে।

রাত বাড়ল। শাঙ্কো ফ্রান্সিসের কাছে এলো। ফ্রান্সিস তৈরি হল। নকশাটা কোমরের ফেট্টিতে জড়িয়ে রাখল। তারপর দু’জনে জাহাজের ডেক-এ উঠে এলো।

সময়টা বোধহয় শুক্লপক্ষের কোনোও রাত। আকশে উজ্জ্বল চাঁদের আলো। দুজনে নৌকোয় নামল। ফ্রান্সিস নৌকো বেয়ে চলল তীরভূমির দিকে। তীরে পৌঁছল। চলল টিলার দিকে।

কপাল ভালো। পাহারাদার সৈন্যদের হাতে ধরা পড়তে হল না। সদর রাস্তাটায় সৈন্যরা পাহারা দিচ্ছিল। ফ্রান্সিস আর শাঙ্কো তখন একটা বাড়ির পেছনে আড়াল নিল। সৈন্যরা কিছুক্ষণ ওই এলাকায় ঘোরাঘুরি করল। তারপর উত্তর দিকে চলে গেল। সেই সময় ফ্রান্সিসরা রাস্তা পার হল।

টিলার তলায় দাঁড়িয়ে দেখল, ওখানে বুনো চোট গাছের জঙ্গল।

ফ্রান্সিসরা জঙ্গলে ঢুকল। চেস্টনাট গাছগুলো ছাড়া ছাড়া। তাই অনেক জায়গাতেই চাঁদের আলো পড়েছে। তবু ফ্রান্সিস শাঙ্কোকে মশাল জ্বালতে বলল। শাঙ্কো চকমকি ঠুকে দুটো মশাল জ্বালাল। ফ্রান্সিস বলল, শাঙ্কো, লক্ষ্য রাখো কোনও শুকনো মরা গাছ পাও কিনা।

দু’জনেই বুনো লতাগাছ আর ঝোঁপের মধ্যে দিয়ে খুঁজতে লাগল শুকনো মরা গাছটা। এভবে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ দেখল একটা শুকনো গাছের কাণ্ড। চারপাশে সব সজীব গাছ। ওই গাছটাই শুধু মরা শুকনো।

ফ্রান্সিস হাতের মশালটা একটা গাছের নিচু ডালে আটকে সেই গাছটার কাছে এলো। গাছটার কাণ্ড হাত দিল। কিছুটা ছাল উঠে এলো।

এইবার ফ্রান্সিসের চিন্তা হল, খুঁজে খুঁজে মরা গাছটা তো পাওয়া গেল। কিন্তু রাজা ওভিড্ডোর তরবারির সঙ্গে এই গাছটার সম্পর্ক কী? এইমরা গাছটার মধ্যেই কি তরবারিটা ঢোকানো আছে? গাছটার ভেতরটা কী ফাঁপা? তা হলে সেটা দেখতে হয়। ফ্রান্সিস বলল, শাঙ্কো, মশাল রেখে এসো। মরা কাণ্ডটায় ধাক্কা দিতে হবে।

শাঙ্কোর হাতের মশালটা মাটিতে পুঁতে ফ্রান্সিসের কাছে এলো। দুজনে মিলে কাণ্ডটায় ধাক্কা দিতে লাগল। গাছটা নড়তে লাগল। কিন্তু ভেঙে পড়ল না।

শাঙ্কো বলল, দাঁড়াও ফ্রান্সিস, আমি জাহাজ থেকে একটা বেলচা নিয়ে আসছি।

কিন্তু পাহারাদাররা যদি এখনও থাকে? ফ্রান্সিস বলল।

আমি সাবধানে যাব, সাবধানে আসব। তুমি ভেবো না।

শাঙ্কো লতাপাতা, ঝোপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে বেরিয়ে এসে রাস্তায় পড়ল। চাঁদের আলোয় দেখল পাহারাদার সৈন্যরা বেশ দূরে, ওরা বোধহয় সেনা আবাসে ফিরে যাচ্ছে। আর একদল আসবে।

শাঙ্কো দ্রুত পায় হামাগুড়ি দিয়ে রাস্তা পার হল। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে ছুটল নৌকো রাখার জায়গার দিকে।

ফ্রান্সিস ঘাসের উপর বসে রইল। একটু পরেই মরা গাছটায় পিঠ ঠেকিয়ে আরাম করে বসল। বেলটা না আনলে এখন আর কিছু করার নেই। ফ্রান্সিসের একটু তন্দ্ৰামতো এলো। টি ট্রি করে একটা রাতজাগা পাখি ডেকেই চলেছে।

হঠাৎ পট্‌পট্ শব্দে ফ্রান্সিসের তন্দ্রাভাবটা কেটে গেল। ও পেছন ফিরে তাকাল। দেখল–শাঙ্কোর রেখে যাওয়া মশালটা মাটিতে পড়ে গেছে। মশালের আগুন থেকে ঝরা পাতার মধ্যে আগুন লেগে গেছে। আগুন বাড়তে লাগল।

ফ্রান্সিস দ্রুত উঠেদাঁড়াল। একটা নিচুগাছ থেকে পাতাশুদ্বুডাল ভাঙল। সেইডালটা দিয়ে আগুন নেভাবার চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু আগুন বেড়েই চলল। সেইসঙ্গে ধোঁয়া উঠতে লাগল। ফ্রান্সিস বুঝল সে। ভীষণ বিপদে পড়ে গেছে। রাজা অপৰ্তের সৈন্যরা ধোঁয়া দেখতে পাবে। কী ব্যাপার? আবশ্য তার আগেই দেখতে ছুটে আসবে। পালাতে হবে।

ফ্রান্সিস পেছন ফিরে পালাবার জন্য ছুটল। কিন্তু কয়েকটা গাছ পেরোতেই দেখল সামনে রাজা অপৰ্তোর সৈন্যরা দল বেঁধে আসছে। ফ্রান্সিস বুঝল-পালানো অসম্ভব। ফ্রান্সিস দাঁড়িয়ে পড়ল। দাড়িগোঁফওয়ালা একটা সৈন্য ফ্রান্সিসের সমানে এসে দাঁড়াল। একটু হেসে বলল–তুমি পালাচ্ছিলে?

-হ্যাঁ।

–পারবে এত সৈন্যদের বন্ধনী থেকে পালাতে? গোঁফদাড়িওয়ালা বলল।

–চেষ্টা করতাম। ফ্রান্সিস বলল।

মরতে। দাঁড়িগোঁফওয়ালা হেসে বলল

ফ্রান্সিস চুপ করে রইল। দাড়িগোঁফওয়ালা জিজ্ঞেস করল–

–এত রাতে তুমি এখানে কী করছিলে?

–চেস্টনাট গাছের ফল কুড়োচ্ছিলাম। ফ্রান্সিস বলল।

কাল সকালে কুড়োতে পারতে। দাড়িগোঁফওয়ালা বলল।

–দেরি হয়ে যেত। কাল সকালের মধ্যেই তোক সব ফল কুড়িয়ে নিত। ফ্রান্সিস বলল।

যাক গে–তুমি নিজেও জানো যে তুমি মিথ্যে কথা বলছে। আমাদের হাত থেকে তোমার নিস্তার নেই। এটুকু বলে গলা চড়িয়ে বলল–চল।

–কোথায়? ফ্রান্সিস বলল।

–সৈন্যাবাসে–বাকি রাতটুকু ওখানেই থাকবে। কালকে সকালে রাজা অপৰ্তোর রাজসভায় যাবে। রাজা অপর্তো নিশ্চয়ই তোমাকে শাস্তি দেবেন। দাড়িগোঁফওয়ালা বলল।

আমার অপরাধ? ফ্রান্সিস চড়া গলায় বলল।

–তুমি গভীর রাতে লুকিয়ে আমাদের রণকৌশল জানার চেষ্টা করো। দাড়িগোঁফওয়ালা বলল।

–আমার লাভ? ফ্রান্সিস বলল।

বিনিময়ে প্রচুর অর্থ পাও লরুল্লার রাজা ভিলিয়ানের কাছ থেকে। দাঁড়িগোঁফওয়ালা বলল।

–রাজা ভিলিয়ান আমার মতো এক নগণ্য বিদেশির কথা বিশ্বাস করবেন কেন? ফ্রান্সিস বলল।

ভিলিয়ানই তোমাকে পাঠিয়েছে। নিশ্চয়ই বিশ্বাস করেই পঠিয়েছে। দাড়িগোঁফওয়ালা বলল।

–আমি রাজা ভিলিয়ানের নাম এই প্রথম শুনলাম। ফ্রান্সিস বলল।

–বাজে কথা। চলো। কালকে রাজা অপৰ্তোর রাজসভায় যা বলতে চাও বলো। বলা যায় না–রাজা অপৰ্তো তোমাকে মুক্তিও দিতে পারেন। গোঁফদাড়িওয়ালা বলল।

দাড়িগোঁফ আর দাঁড়াল না। সৈন্যদের দিকে তাকিয়ে বলল–এটাকে নিয়ে আয়।

কয়েকজন ফ্রান্সিসকে ঘিরে দাঁড়াল। তারপর ফ্রান্সিসকে নিয়ে চলল।

চেস্টনাটের বন শেষ হল। সবাই বাইরে রাস্তায় এসে দাঁড়াল।

দাড়িগোঁফওয়ালা বলল–পাঁচজন ওটাকে নিয়ে যা। সৈন্য আবাসে রাখবি। দুজন নজরে রাখবি যেন পালাতে না পারে।

পাঁচজন সৈন্য ফ্রান্সিসকে নিয়ে চলল। দাড়িগোঁফওয়ালার নির্দেশমতো ফ্রান্সিসকে সৈন্যাবাসের দিকে নিয়ে চলল।

ওদিকে শাঙ্কো জাহাজ থেকে বেলচা নিয়ে এলো। বড়ো রাস্তা পার হতে গিয়ে থমকেদাঁড়াল, দেখল ফ্রান্সিসকে বন্দী করে কয়েকজন রাজা অপৰ্তোর সৈন্য চেস্টাট গাছের জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসছে। পেছনে পেছনে আরো সৈন্য জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এলো। চলল জাহাজঘাটের দিকে।

পাঁচজন সৈন্য ফ্রান্সিসকে নিয়ে রাজবাড়ির দিকে চলল। উত্তরমুখো।

শাঙ্কো কী করবে বুঝে উঠতে পারছিল না। এখন ফ্রান্সিসকে উদ্ধার করতে লড়াইয়ে একা নেমে কিছুই করতে পারবেনা। তার জন্যে বন্ধুদের সাহায্য দরকার। শাঙ্কো ভাবল আগে দেখি ফ্রান্সিসকেওরা কোথায় বন্দী করে রাখে। সেই জেনে ওরা ফ্রান্সিসকেমুক্ত করতে চেষ্টা করবে।

আকাশ চাঁদের আলো। বেশ কিছুদূর পর্যন্ত সবই দেখা যাচ্ছে।

গাছগাছালির আড়ালে আড়ালে শাঙ্কো চলল বন্দী ফ্রান্সিসের পেছনে পেছনে।

ফ্রান্সিসকে নিয়ে সৈন্যরা এলো সৈন্য আবাসের সামনে। তারপর ফ্রান্সিসকে একটা ঘরে ঢুকিয়ে দিল।

দূর থেকে শাঙ্কো সবই দেখল। কিন্তু বুঝে উঠতে পারছে না কী করবে এখন। শাঙ্কো একটা গাছের নীচে বসল। পূর্বের আকাশে লালচে আলো ফুটে উঠল। অল্পক্ষণ পরেই সূর্য উঠল। শাঙ্কো তাকিয়ে রইল সেই দিকে। এখন দিশেহারা। একদিকে ফ্রান্সিস বন্দী। অন্যদিকে জাহাজে মারিয়া, বন্ধুরা, তারাও উদ্বিগ্ন। ফ্রান্সিস শাঙ্কোর কোনো খবর নেই।

শাঙ্কো উঠেদাঁড়াল। মারিয়া ও বন্ধুদের উৎকণ্ঠা দূর করতে হবে। তারপর ভাববেকী করবে।

বেলচাটা কাঁধে নিয়ে শাঙ্কো সদর রাস্তা এড়িয়ে ঝোপ জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চলল। একে গায়ে বিদেশি পোশাক তার ওপর হাতে বেলচা। সহজেই রাজা অপৰ্তোর সৈন্যদের চোখে পড়ে যাবে। আমি যাই বলে বোঝাইনা কেন ওরা আমাকে ছাড়বে না। আমার বন্দী জীবন। ফ্রান্সিস যে ঘরে বন্দী হয়ে আছে। ওকে যে সেই ঘরেই বন্দী করে রাখবে তার কোনো মানে নেই। হয়তো অন্য ঘরে বন্দী করবে। ফ্রান্সিসের ঘরে বন্দী করে রাখলে তবু দুজনে মিলে পালাবার পরিকল্পনা করতে পারতো। কিন্তু একা বন্দী হলে পালাতে গিয়ে ধরাও পড়তে পারি। একবার ধরা পড়লে মুক্তির কোনো আশা নেই মৃত্যু হওয়াও বিচিত্র নয়।

জংলা ঝোপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে শাঙ্কো হাঁটতে লাগল। গা হাত পা কাটা ঝোঁপের ঘষায় কেটে গেল। হাত পা জ্বালা করতে লাগল। কিন্তু শাঙ্কো দমল না। কাটা ফোপ জঙ্গলের মধ্যে দিয়েই চলল।

বেলা বাড়ছে। শাঙ্কো ক্ষুধা তৃষ্ণায় কাতর। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জাহাজে পৌঁছাতে হবে। শাঙ্কো দ্রুত চলল। এসে সারা গা হাত পা কাটাগাছে কেটে ক্ষত বিক্ষত হয়ে গেল। শাঙ্কো মুখ বুজে যন্ত্রণা সহ্য করতে লাগল।

সমুদ্রতীরে যখন পৌঁছল তখন বেশ বেলা হয়েছে। শাঙ্কো বালিয়াড়িতে নামল। দেখল নৌকোটা জলের কাছে ডাঙায় তোলা আছে। শাঙ্কো নৌকোটা টেনে টেনে জলের ওপর আনল। দেখল গলুইয়ে বৈঠেটা রয়েছে। শাঙ্কো বেলচাটা নৌকোয় রাখল। তারপর নৌকোটাকে এক ধাক্কায় সমুদ্রের জলে নামিয়ে বৈঠে বাইতে লাগল। নৌকো চলল জহাজের দিকে।

জাহাজের কাছে আসতে ভাইকিং বন্ধুরা ধ্বনি তুলল–ও-হো-হোশাঙ্কো নৌকোটা জাহাজের গায়ে ভেড়াল। দড়ি দিয়ে নৌকোটা বাঁধল জাহাজের সঙ্গে। ঝোলানো দড়িদড়া ধরে ধরে জাহাজের ডেক-এ উঠে এলো।

ভাইকিং বন্ধুরা ছুটে এসে শাঙ্কোকে ঘিরে দাঁড়াল। সকলেরই এক প্রশ্নফ্রান্সিস কোথায়? ও এলো না কেন?

শাঙ্কো আস্তে আস্তে সব ঘটনাই বলল। ফ্রান্সিস বন্দী শুনে বন্ধুদের মন খারাপ হল। একপাশে মারিয়া দাঁড়িয়েছিল। শুনল সব। কিন্তু কোনো কথা বলল না। রেলিঙের কাছে এসে দাঁড়াল। তীরভূমির দিকে তাকিয়ে রইল। চোখ ছলছল করছে।

হ্যারি এগিয়ে এলো। বলল রাজকুমারী আপনি চিন্তা করবেননা–মন খারাপ করবেন না। আর কয়েকটা দিন যেতে দিন। ফ্রান্সিস ঠিক বন্দী অবস্থা থেকে পলিয়ে আসবে। আমাদের বড়ো সান্ত্বনা যে ফ্রান্সিস একা। একা ফ্রান্সিসকে কেউ বন্দী করে রাখতে পারবে না। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। মারিয়া কিছু বলল না। তীরভূমির দিকে তাকিয়ে রইল।

ওদিকে পরদিন সকালে বন্দী ফ্রান্সিসকে খেতে দেওয়া হল দুটো পোড়া রুটি আর আনাজে তৈরি ঝোলমতো। ফ্রান্সিস খেয়ে নিল। দাড়িগোঁফওয়ালা ঢুকল। বলল চলো তোমাকে রাজা আপৰ্তোর রাজসভায় যেতে হবে।

–বেশ। চলুন। ফ্রান্সিস উঠে দাঁড়াল।

দুজনে চলল রাজার রাজসভায়। এদিকে ওদিকে পাথরের ঘরবড়ি ছাড়িয়ে একটা বড়ো বাড়িতে ঢুকল দুজনে। বাড়ির দরজায় সশস্ত্র প্রহরী। দুজনে ঘরটায় ঢুকল। ফ্রান্সিস দেখল–ঘরের দক্ষিণ দিকে রাজসিংহাসনে রাজা অপৰ্তো বসে আছে। সিংহাসনটা কাঠের। আসন পাখির পালকে তৈরি। নীলাভ সাটিন কাপড়ে ঢাকা। একপাশে বৃদ্ধ মন্ত্রী। অন্যপাশে সেনাপতি আর অমাত্যরা।

বিচার চলছিল। দাড়িগোঁফওয়ালা বলল–তুমি আমার সঙ্গে এসো। সে কিছুদূর এগিয়ে গেল। ফ্রান্সিসও পেছনে পেছনে এলো।

আর একটা বিচার আরম্ভ হল। দাড়িগোঁফওয়ালা চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। ফ্রান্সিস রাজসভার চারদিক দেখতে লাগল।

অল্পক্ষণের মধ্যেই বিচার শেষ হল। দাড়িগোঁফওয়ালা একটু এগিয়ে গেল। রাজা অপৰ্তোর নজরে পড়ল। রাজা অপৰ্তো বলল–তোমার কিছু বলার আছে? দাড়িগোঁফওয়ালা মাথা একবার একটু নুইয়ে মাথা তুলল। ফ্রান্সিসকে দেখিয়ে যা যা ঘটেছে সব বলল। রাজা ফ্রান্সিসের দিকে তাকিয়ে বলল–তোমরা ভাইকিং-বিদেশি। আমার রাজ্যে এসেছ গুপ্তচর হয়ে।

কাদের গুপ্তচর হয়ে এসেছি? ফ্রান্সিস বলল।

–খুবই সহজ। লরুল্লার রাজ্য ভিলিয়ানের হয়ে। রাজা বলল।

–আমি রাজা ভিলিয়ানের নাম এই প্রথম শুনলাম। ফ্রান্সিস বলল।

–তুমি বুদ্ধিমান। নিজেকে বাঁচাবার জন্যে তুমি মিথ্যে বলছো। রাজ বলল।

–আমি যা সত্য তাই বলছি। খুব দৃঢ়স্বরে ফ্রান্সিস বলল।

উঁহু। কিছু লুকোবার চেষ্টা করছে। রাজা বলল।

–আমার লুকোনোর কিছু নেই। যা সত্য তাই বললাম। ফ্রান্সিস বলল।

-তুমি শুধু ফল কুড়োবার জন্যে চেস্টাটের জঙ্গলে যাওনি। আমাদের যুদ্ধ আয়োজনের সংবাদ রাজা ভিলিয়ানকে পৌঁছে দেওয়ার কাজ তুমি নিয়েছো। রাজা বলল।

–মিথ্যে অপবাদ। আমি কেন গুপ্তচরবৃত্তি করতে যাবো। ফ্রান্সিস বলল।

–অনেক অর্থ পাবে সেই লোভে। রাজা বলল।

আমার সেই লোভ নেই। অনেক মূল্যবান গুপ্তধন আমি আবিষ্কার করেছি। কিন্তু সেই কাজেরজন্যে একটা স্বর্ণমুদ্রাও আমি নিইনি। আমি এখনও বলছি-আমি নির্দোষ। ফ্রান্সিস বলল।

রাজা অপৰ্তো ক্রুদ্ধ হল। বলল–থামো-তুমি দোষী কি নির্দোষ তার বিচার পরে। হবে। ততদিন তুমি সৈন্যাবাসে বন্দী থাকবে। বাইরের জগতের সঙ্গে তোমার কোনো যোগ থাকবে না। রাজা বলল।

আমাকে অন্যায়ভাবে বন্দী করে রাখা হচ্ছে। ফ্রান্সিস বলল।

–তোমাকে যে হত্যা করা হয়নি–এটাই যথেষ্ট। রাজা বলল।

–বিনা প্রমাণে? ফ্রান্সিস বলল।

–প্রমাণের দরকার নেই। আমার হুকুমই প্রমাণ। রাজা বলল।

ফ্রান্সিস আর কোনো কথা বলল না। বুঝল রাজাঅপর্তোর কাছেন্যায় বিচার পাওয়া অসম্ভব। বিনা বিচারে বন্দীদের হত্যা করা রাজা অপত্যের কাছে কোনো অপরাধই নয়। এর কাছে প্রমাণ টমানের কথা বলা অর্থহীন। রাজা অপৰ্তো রগচটা লোক। বেশি কথা বললে হয়তো বিরক্ত হয়ে ফাঁসির হুকুম দিয়ে বসতে পারে।

ফ্রান্সিস চুপ করে রইল।

রাজসভার কাজ শেষ হল। রাজা অপৰ্তো উঠে দাঁড়াল। মন্ত্রী অমাত্য সেনাপতি আর প্রজারাও উঠে দাঁড়াল। রাজা অপতো সভা থেকে চলে গেল।

দাড়িগোঁফওয়ালা ফ্রন্সিসের কাছে এলো। বলল–এবার চলো। ফ্রান্সিস দেখল বৃদ্ধ মন্ত্রীমশাই বেরোবার দরজার দিকে যাচ্ছে। ফ্রান্সিস দাড়িগোঁফওয়ালাকে বলল–আমি মন্ত্রীমশাইর সঙ্গে কথা বলবো।

–মন্ত্রীমশাই তোমাকে মুক্তি দিতে পারবে না। দাড়িগোঁফওয়ালা বলল।

–না–অন্য ব্যাপারে মন্ত্রীমশাইর সঙ্গে কথা বলবো।

–বেশ। যাও। পালাবার চেষ্টা করবে না। গোঁফদাড়িওয়ালা বলল।

ফ্রান্সিস মন্ত্রীমশাইর সামনে এসে দাঁড়াল। বলল–মন্ত্রীমশাই? মন্ত্রীমশাই দাঁড়িয়ে পড়ল। বলল কী ব্যাপার?

কয়েকটা ঘটনা জানতে চাই। ফ্রান্সিস বলল।

–বলো। মন্ত্রী বলল।

–আচ্ছা রাজা ওভিড্ডো কে ছিলেন? ফ্রান্সিস বলল।

প্রায় দেড়শো বছর আগে এখানকার রাজা ছিলেন। মন্ত্রী বলল।

–তিনি কি খুব ধনী ছিলেন? ফ্রান্সিস বলল।

-হ্যাঁ। শুনেছি–খুব খেয়ালি রাজা ছিলেন। ধনী ছিলেন তো বটেই। একটা প্রায় সাত হাত লম্বা তলোয়ার তৈরি করিয়েছিলেন। নিরেট সোনায় তৈরি। রাজবাড়ির কর্মকারেরা ঐ তলোয়ার তৈরি করেছিল। তলোয়ারের কোষের গায়ে হীরে মুক্তো মণিমাণিক্য গাঁথা ছিল। মন্ত্রী বলল।

–এটা কী করে জানলেন?-ফ্রান্সিস বলল।

–খেয়ালি রাজা ছিলেন তো। তলোয়ার তৈরি হবার পর সেটা প্রজাসাধারণের দেখার জন্যে একটা লম্বা কাঠের আসনে তলোয়ারটা রেখে রাজবাড়ির চত্বরে রেখেছিলেন। তলোয়ারের সামনে ভিড় লেগেই থাকতো। সন্ধেহলে তলোয়ারটা প্রাসাদের ভেতরে অস্ত্রাগারে রেখে দেওয়া হত। মন্ত্রী বলল।

–সেই তরবারিটার কী হল? রাজা ওভিড্ডো মারা যাবার পর আর কেউ ঐতরবারি চোখে দেখে নি? ফ্রান্সিস বলল।

-হা-মারা যাবার কিছুদিন আগে তরবারিটা অস্ত্রাগার থেকে বের করা বন্ধ হল। তারপর সেই তরবারি যে কোথায় কীভাবে ওভিড্ডো লুকিয়ে রাখলেন কেউ সেটা জানতে পারে নি। মন্ত্রী একটু থেমে বলল। রাজ ওভিড্ডোর পর তো আরো রাজা রাজত্ব করেছেন। তারা চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু কেউ খুঁজে পান নি।

ফ্রান্সিস আড়চোখে তাকিয়ে দেখলদাড়িগোঁফওয়ালা একটু দূরে দুই পাহারাদারের সঙ্গে গল্প করছে। এই সুযোগ। ফ্রান্সিস কোমরের ফেট্টি থেকে নকশাটা বের করল। মন্ত্রীমশাইকে দেখাল শুধু নকশাটা। মন্ত্রীমশাই নকশাটা দেখে বলল কীসের নকশা?

–রাজা ওভিড্ডো এই নকশাটা রেখে গিয়েছিলেন। ফ্রান্সিস বলল।

–এতে দেখা যাচ্ছে পুরানো নকশা। মন্ত্রী বলল।

–এটা দেখে আপনি কিছু বুঝতে পারছেন? ফ্রান্সিস বলল।

মন্ত্রীমশাই মাথা নেড়ে বলল–উঁহু। কিছুই বুঝতে পারছি না।

–ভালো করে দেখুন ফ্রান্সিস বলল।

–হ্যাঁ দেখছি তো একটা টিলা একটা গুহামতো গাছপালা।

–কী গাছ? ফ্রান্সিস বলল।

–বলতে পারবো না। মন্ত্রী বলল।

–আচ্ছা একটা মরা গাছ আছে লক্ষ্য করেছেন? ফ্রান্সিস বলল।

-হ্যাঁ। মন্ত্রীমশাই নকশাটা ফ্রান্সিসকে ফেরৎ দিয়ে বলল–মা মেরিই জানেন এই নকশার অর্থ কী? ফ্রান্সিস নকশাটা কোমরের ফেট্টিতে রেখে দিল।

ফ্রান্সিস সিংহাসনের বেদী থেকে নেমে এলো। দাড়িগোঁফওয়ালা এগিয়ে এলো। বলল–কী? ছাড়া পাবার কিছু উপায় দেখলে?

–না। আমি অন্য বিষয়ে কথা বলেছি। ফ্রান্সিস বলল।

দাড়িগোঁফওয়ালা আর একজন সৈন্য ফ্রান্সিসকে নিয়ে চলল। ফ্রান্সিস তখন ভাবছে মন্ত্রীমশাইও নকশার কিছু বুঝল না। বলতেও পারল না কিছু। শুধু জানা গেল বছর একশো দেড়শো আগে এখানে রাজত্ব করত ওভিড্ডো নামে এক খামখেয়ালি রাজা। নিরেট সোনা দিয়ে একটা তরবারি বানিয়েছিল। তাব মৃত্যুর পর থেকে আর সেই সোনার তরবারি খুঁজে পাওয়া যায়নি। খামখেয়ালি রাজা ওভিড্ডো কোথায় কীভাবে তরবারিটি গোপনে রেখে গেছে কেউ জানে না। তারপরে যারা রাজত্ব করেছে তাদের কেউ কেউ সোনার তরবারি খুঁজেছে। কিন্তু পায়নি।

ফ্রান্সিসকে পাহারা দিয়ে দাড়িগোঁফওয়ালা আর অন্য সৈন্যটি সৈন্যাবাসে ওর ঘরে পৌঁছে দিয়ে গেল।

সেদিন বিকেলে শাঙ্কো হ্যারির কেবিনঘরে এলো। বিছানায় বসল। বলল–হ্যারি আমি আজ রাতে সমুদ্রতীরে নামবো। বেলচাটাও সঙ্গে নেব। ঐ চেস্টাটের জঙ্গল যাবো। দেখি রাজা ওনোবিজ্ঞের তরবারির কোনো হদিশ করতে পারি কি না।

–কিন্তু ঐ জঙ্গলেই তো ফ্রান্সিস রাজা অপৰ্তোর সৈন্যদের হাতে ধরা পড়েছে। এখনও বন্দী রয়েছে। হ্যরি বলল।

–ফ্রান্সিসকে নিয়ে ভেবো না। ও একা। অতি সহজেই পালাতে পারবে। আমি অতি সাবধানে যাবো। পাহারাদার সৈন্যদের দৃষ্টি এড়িয়ে একবার চেস্টনাটের জঙ্গলে ঢুকতে পারলেই আর ভয় নেই। শাঙ্কো বলল।

ফ্রান্সিস নেই তার ওপর তুমি যদি বন্দী হও? আমাদের দুশ্চিন্তার শেষ থাকবে না। তুমি যেও না। হ্যারি বলল।

হ্যারি ঐ তরবারিটার খোঁজ করতেই হবে। কিচ্ছু ভেবো না। বিপদ দেখলেই এক ছুটে সমুদ্রের ধারে চলে যাব। তারপর সমুদ্রে নেমে পড়বো। নিঃশব্দে সাঁতরে আমাদের এই জাহাজে চলে আসবো। শাঙ্কো বলল।

–দেখো–যদি পারো। তবে তুমিও বন্দীহলে আমরা অসহায় হয়ে পড়বা। হ্যারি বলল।

–কিছুই ভেবো না। শাঙ্কো বলল।

রাত একটু বাড়তেই শাঙ্কো বেলচাট নিয়ে জাহাজের ডেক-এ উঠে এলো। দেখল হ্যারি দাঁড়িয়ে আছে। শাঙ্কো জাহাজের হালের দিকে গেল। দড়ির মইটা নামাল। বেলচাটা একহাতে ঘাড়ে তুলে মইয়ের কাঠের সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগল। নৌকোয় উঠল। অনুজ্জ্বল চাঁদের আলোয় হ্যারির দিকে চেয়ে হাত নাড়ল। নৌকো ছেড়ে দিল।

জ্যোৎস্না খুব উজ্জ্বল নয়। সমুদ্রেও জলের ওপরে কুয়াশার নীলচে আস্তরণ মতো। শাঙ্কো কুয়াশার আন্তরণের মধ্যে দিয়ে নৌকো চালাল। একটু বেশ ঠাণ্ডাহওয়া দিচ্ছে।

শাঙ্কো বৈঠে চালাল।

কিছুক্ষণের মধ্যেই নৌকো তীরভূমিতে পৌঁছল। নৌকো থেকে নেমে নৌকো থেকে বেলচা তুলে নিল। নৌকোটা ঠেলে বালিয়াড়িতে এনে রাখল।

বেলচাটা কাঁধে নিয়ে শাঙ্কো চলল বুনো চেস্টনাট গাছের জঙ্গল লক্ষ্য করে। ঝোপঝাপের মধ্যে দিয়ে শাঙ্কো চলল। সদর রাস্তার কাছে এলো। সাবধানে ঝোঁপের আড়াল থেকে সদর রাস্তার দিকে তাকাল। দেখল রাজা অপৰ্তোর একদল সৈন্য সারি বেঁধে জাহাজঘাটের দিকে চলেছে। কারো মুখে কথা নেই। ধুপ ধুপ পায়ের শব্দ হচ্ছে শুধু। সবার হাতে খোলা তলোয়ার! যুদ্ধের আবহাওয়া এখানে। তাই দিনরাত পাহারা চলেছে।

শাঙ্কো ভাবল এ সময়ে গোপনে কোনো কাজ করা যাবেনা। ভাবল–আমরা নকশা পেয়েছি। সোনার তরবারি কোথায় থাকতে পারে তারও একটা অনুমান করতে পেরেছি। এখন দরকার কাজে নামা।

একটু পরেই দেখল জাহাজঘাট থেকে একদল সৈন্য রাজবাড়ির দিকে চলেছে। ধুলোঢাকা পথে ওদের পায়ের শব্দ উঠছে ধুপ ধুপ।

শাঙ্কো অপেক্ষা করতে লাগল। রাস্তার দুই দিকে তাকিয়ে কিছুদূর পর্যন্ত দেখল। না। আর কাউকে দেখা যাচ্ছে না। শাঙ্কো রাস্তায় শুয়ে পড়ল। তারপর হিঁচড়ে হিঁচড়ে চলল। পথ শেষ। শাঙ্কো দ্রুত উঠে দাঁড়িয়েই এক ছুট দিল চেস্টনাট গাছের জঙ্গলের দিকে। কাঁধে বেলচা।

কয়েক মিনিটের মধ্যেই চেস্টনাট গাছের জঙ্গলে ঢুকে পড়ল। হাঁপাতে হাঁপাতে এবার অস্তে আস্তে চলল। অনুজ্জ্বল জ্যোৎস্না। তার ওপর জঙ্গল। জ্যোৎস্না পড়ছেও কম। ওর মধ্যেই সাবধানে পা ফেলে ফেলে চলল।

জঙ্গলের এদিক-ওদিক ঘুরতে ঘুরতে সেই মরা গাছটার কাছে এলো। দূর থেকে গাছের ফাঁক দিয়ে দেখল একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে গাছটার কাছে। গাছটাকে ধরে গাছের গোড়ায় যেন কিছু ঢালছে। শাঙ্কো এক ছুটে গিয়ে লোকটার সামনে দাঁড়াল। লোকটা চমকে উঠল। শাঙ্কো দেখল লোকটা বৃদ্ধ। গায়ে এই দেশীয় ঢোলাহাত জামা। হাতে একটা কাঠের পাত্র। বৃদ্ধটি কাঠের পাত্রটা সরিয়ে আনল। শাঙ্কো বৃদ্ধটির কাছে গিয়ে বলল–আপনি কে? ভাঙা ভাঙা গলায় বৃদ্ধটি বলল–আমি একজন বৈদ্য।

–এখানে মরা গাছটার গোড়ায় কী ঢালছিলেন? শাঙ্কো জানতে চাইল।

–ওষুধ। বৈদ্য বলল।

–কী ওষুধ? শাঙ্কো বলল।

–সেটা বললেও আপনি বুঝবেন না। তবুবলি ওষুধটার নাম উজিমা–গ্রীক শব্দ। অর্থ–জীবন। বৃদ্ধ বৈদ্য বলল।

–ঐ ওষুধ ঢাললেন কেন? শাঙ্কো জিজ্ঞেস করল।

–যাতে গাছটা বেঁচে থাকে। বৃদ্ধ বলল।

–গাছটা তো মরে গেছে। শাঙ্কো বলল।

–না। একেবারে মরে যায় নি। ওষুধ পেলে কোনোদিন মরবে না। বৈদ্য বলল।

–কেন ওষুধ দিচ্ছিলেন? শাঙ্কো বলল।

–আমরা বংশপরম্পরায় এই কাজটা করে আসছি। অবশ্যই গভীর রাতে এসে ওষুধটা দিই। বৃদ্ধ বৈদ্য বলল।

–ওষুধ কি প্রতিদিন দিয়ে থাকেন? শাঙ্কো জানতে চাইল।

–না। মাসে একবার। বৃদ্ধ বলল।

–তাতে কি গাছটা বেঁচে যাবে? শাঙ্কো জানতে চাইল।

–হ্যাঁ। বৈদ্য বলল।

–বেশ। কিন্তু গাছটাকে বাঁচিয়ে রাখতে চাইছেন কেন? শাঙ্কো বলল।

–সে অনেক কথা। যখন রাজা ওভিড্ডো এখানে রাজত্ব করতেন–তখন আমাদের পূর্বপুরুষ একজন রাজা ওভিচ্ছোকে কঠিন ব্যাধি থেকে চিকিৎসা করে সুস্থ করেছিলেন। রাজা সুস্থ হয়ে একদিন গভীর রাতে আমাদের পূর্বপুরুষ চিকিৎসককে একা এখানে নিয়ে এসেছিলেন। তিনি নাকি বলেছিলেন–আপনি কি এই গাছটাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারেন? আমাদের পূর্বপুরুষ বলেছিলেন–একটা ওষুধ আমি আবিষ্কার করেছি সেটা মাসে একবার করে এই গাছটার গোড়ায় দিলে গাছটি মরবে না। বৃদ্ধ বলল।

–তবে মানুষের ওপরও কি ওষুধটা প্রয়োগ করা যায় না? শাঙ্কো বলল।

–না। এটা শুধু গাছকেই চিরজীবী করতে পারে। বৃদ্ধ বলল।

–আচ্ছা–ওষুধ দিয়ে এই গাছটাকে বাঁচিয়ে রাখার পেছনে কি রাজা ওভিড্ডোর অন্য কোনো উদ্দেশ্য ছিল? শাঙ্কো জানতে চাইল।

বলতে পারবো না। বৃদ্ধ বলল।

–স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে গাছটা মরে গেছে। শাঙ্কো বলল।

না। মরে যায় নি। আপনার বেলচাটা দিয়ে গাছটার কাণ্ডে জোরে খোঁচা দিন। বৃদ্ধ বলল।

শাঙ্কো বেলচাটা দিয়ে গাছটায় জোরে খোঁচা দিল। একটু পরে শাঙ্কো খোঁচা দেওয়া জায়গাটায় আঙ্গুল দিয়ে ঘষল। দেখল ভেজা ভেজা। কী যেন লেগেছে। গাছের রস। তাহলে তো গাছটা বেঁচে আছে। এ তো অকল্পনীয়।

–দেখলেন তো গাছটা এখনও জীবিত। বৃদ্ধ বৈদ্য বলল।

—হ্যাঁ। তাই তো দেখছি। শাঙ্কো বলল।

হঠাৎ নিস্তব্ধ বনটায় ঝরাপাতা ভাঙার শব্দ হল। শাঙ্কো আর বৃদ্ধটি চমকে উঠল। শাঙ্কো একটা ঝোপে বেলচাটা ছুঁড়ে ফেলে ছুটল পশ্চিমদিক লক্ষ্য করে। বৃদ্ধটি পালাতে গিয়ে আর পারল না। রাজা অপৰ্তোর সৈন্যরা ওকে ঘিরে ধরল।

দাড়িগোঁফওয়ালা সেই দলনেতা এগিয়ে এলো। বলল তুমি কে?

–আমি একজন কবিরাজ। এখানেই থাকি। বৃদ্ধ বলল।

–এখানে কী করছো? দাড়িগোঁফওয়ালা জিজ্ঞেস করল।

–আমার এক বন্ধু আমাকে গভীর রাতে এখানে আসতে বলেছিল। বৃদ্ধ বলল।

–কেন?

–তা জানি না। বৃদ্ধ বলল।

বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়েছিল? দাড়িগোঁফওয়ালা জানতে চাইল।

–হ্যাঁ। কিন্তু আপনারা এসে পড়ায় বন্ধুটি পালিয়েছে। বৃদ্ধটি বলল।

–ঠিক আছে। আপনাকে বন্দী করা হল। দাড়িগোঁফওয়ালা বলল।

–কিন্তু আমি তো কোনো অপরাধ করি নি। বৃদ্ধ কবিরাজ বলল।

–এখন আমরা লড়াইয়ের মুখে। এসময় গভীর রাত–আপনার বন্ধু এই জঙ্গলে এসব সন্দেহজনক ব্যাপার। কে জানে। হয়তো শত্রুপক্ষকে নির্দেশ দিতে এসেছিলেন। দাড়িগোঁফওয়ালা বলল।

–দোহাই–আমি গুপ্তচর নই। বৃদ্ধ কবিরাজ বলল।

–সেসব পরে দেখা যাবে। চলুন। দাড়িগোঁফওয়ালা বলল।

দাড়িগোঁফওয়ালা দলনেতা বলল-চলো সব। সৈন্যরা ওর পেছনে পেছনে চলল।

ওদিকে শাঙ্কো চেস্টনাট গাছের জঙ্গলের মধ্যে যথাসাধ্য দ্রুত ছুটল সমুদ্রের দিকে।

শাঙ্কো হাঁপাতে হাঁপাতে দূরবিস্তৃত সমুদ্রতীরে এসে পৌঁছল। দেখল চাঁদের আলো অস্পষ্ট। সমুদ্রে ঢেউও তেমন নেই। খুবই শান্ত সমুদ্র। হাওয়া বেশ ঠাণ্ডা। বন্দরের দিকে তাকাল। দেখল দুটো জাহাজ অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ওদের জাহাজ দেখা যাচ্ছে না।

শাঙ্কো আস্তে আস্তে সমুদ্রে নামল। তারপর ছোটো জঙ্গলের ঢেউয়ের মধ্যে দিয়ে সাঁতার কেটে চলল।

দূর দিয়ে রাজা অপৰ্তোর যুদ্ধ জাহাজ পার হল। এবার ওদের জাহাজটা দেখা গেল।

শাঙ্কো সাঁতরে চলল। সাঁতরে এসে নিজেদের জাহাজের হালটা ধরল। হাঁপাতে লাগল। মুখ হাঁ করে। পুব আকাশে তখন সূর্য উঠছে।

শাঙ্কো হালের খাঁজে পা রেখে জাহাজে উঠল।

জাহাজের ডেক এ চার-পাঁচজন বন্ধু ঘুমিয়েছিল। তাদের মধ্যে দুতিনজন শাঙ্কোকে দেখে এগিয়ে এলো। বলল–কী ব্যাপার শাঙ্কো। একজন বললতুমি কি স্নান করলে?

–মুণ্ডু। শোন্–হ্যারিকে এখানে আসতে বল্। একজন চলে গেল হ্যারিকে ডাকতে। একটু পরেই হ্যারি এলো। শাঙ্কোর ঐ অবস্থা দেখে বলল

-কী ব্যাপার শাঙ্কো? জলে নেমেছিলে কেন?

শাঙ্কো আস্তে আস্তে সব বলল। হ্যারি বলল–খুব বেঁচে গেছো। যাক গে–বোঝা যাচ্ছে–ঐ মরা গাছটার গুরুত্ব আছে। এখন চাই ফ্রান্সিসের মুক্তি। ততদিন আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।

হ্যারি –কয়েকটা ব্যাপার ঠিক বুঝতে পারছি না। সব গাছ ছেড়ে মরা গাছটাকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে কেন? রাজা ওভিড্ডো কেন গাছটার গোড়ায় ওষুধ ঢালার ব্যবস্থা করেছিল। ঐ বৈদ্যরা বংশানুক্রমে ঐ মরা গাছটার গোড়ায় ওষুধ দিয়ে আসছে কেন? মরা গাছটা বেঁচে আছে এটাও একটা রহস্য। সত্যিই কি ওষুধে এখনও কাজ হচ্ছে? শাঙ্কো বলল।

–হ্যাঁ শাঙ্কো– আমার মনেও এই প্রশ্নগুলো আসছে। হ্যারি বলল। এখন আর এসব ভেবে কী লাভ? ফ্রান্সিসকে মুক্ত করে এখন দেশের দিকে জাহাজ চালাতে হবে। এ ছাড়া এখন আর কিছুই করণীয় নেই। হ্যারি বলল।

দু’দিন কেটে গেল। ফ্রান্সিস এলো না। হয়তো আবার পালাতে গিয়ে ধরা পড়েছে। ভাইকিং বন্ধুরা দুশ্চিন্তায় পড়ল। বিস্কো কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে হ্যারির কাছে এলো। বলল–তুমি রাজি হলে আমরা কয়েকজন ফ্রান্সিসের খোঁজে যেতে পারি।

–না না–হ্যারি বলল–শাঙ্কো অনেক কষ্টে পালিয়ে এসেছে। তোমরাও বন্দী হলে আমরা বিপদে পড়ে যাবো। তার চেয়ে ফ্রান্সিসের জন্য আমরা অপেক্ষা করবো।

আরো একদিন কাটল। ফ্রান্সিস এলো না।

সেদিন গভীর রাত। নজরদার পেড্রো গা এলিয়ে আকাশের দিকেমুখ করে নজরদারের বসার আসনে বসেছিল। একটু তন্দ্ৰামতোই এসেছিল। সমুদ্রের উত্তাল বাতাস সত্ত্বেও নীচে দু-একজনের গলার শব্দ শুনল। পেড্রোর তন্দ্রা ভেঙে গেল। ও নীচের দিকে তাকাল। সর্বনাশ! ও দেখল একটা যুদ্ধ জাহাজ ওদের জাহাজের গায়ে এসে লাগল। ঐ জাহাজ থেকে যুদ্ধসাজ পরা সৈন্যরা ওদের জাহাজে উঠে আসছে।

পেড্রো সঙ্গে সঙ্গে মাস্তুল বেয়েনামতে গেল। দেখল একজন সৈন্য ওরআসন ধরেউঠদৗঁড়াল। হাতে খোলা তলোয়ার। সৈন্যটি বলল–নেমে এসো। একটা কথা জোরেবললে তুমি মরবে।

পেড্রো আস্তে আস্তে নেমে এলো। দেখল–একদল সৈন্য ডেকে-এ জড়ো হয়েছে। পেড্রোকে ডেক-এর একপাশে বসিয়ে রাখা হল।

সৈন্যরা সব প্রথমে অস্ত্রঘরে ছুটে গেল। দুজন ভাইকিং প্রহরীকে আহত করল। ওখানে চারজন সৈন্য অস্ত্রঘর পাহারা দিতে লাগল।

সৈন্যরা কেবিনঘরে ঢুকে ঢুকে নিদ্রিত ভাইকিংদের তলোয়ারের খোঁচা দিয়ে ঘুম ভাঙাল। ভাইকিংরা চমকে জেগে উঠে দেখল খোলা তলোয়ার হাতে সৈন্যরা। কিছু করার নেই। খালি হাতে লড়াই চলে না। একজন ভাইকিং ঘর থেকে পালাল। গেল অস্ত্রঘরের কাছে। দেখল চারজন সৈন্য অস্ত্রঘর পাহারা দিচ্ছে।

ওদিকে ভাইকিংরা ডেক-এ উঠে এলেই ডেক-এর একপাশে তাদের বসিয়ে দেওয়া হতে লাগল। মারিয়াকেও বসিয়ে দেওয়া হল।

একজন সৈন্য ওদের জাহাজে সেনাপতিকে খবর দিতে চলে গেল।

কিছুক্ষণ পরে সেনাপতিভাইকিংদের জাহাজের ডেক-এ উঠে এলো। সেনাপতির দশাসই চেহারা। ইয়া গোঁফ। মাথার চুল ঝাঁকড়া আঁকড়া। কানের নীচে তলোয়ারের কাটা দাগ।

সেনাপতি ডেক-এর এপার ওপার পায়চারি করল। হ্যারিদের কাছে এসে দাঁড়াল। তখন হ্যারি উঠে দাঁড়াল। সৈন্যরা ছুটে এলো। সেনাপতি হাত তুলে ওদের থামাল। হ্যারি বলল–আমরা জানি না। আপনারা কারা?

সেনাপতি দাঁত বের করে হাসল। বলল–আমরানরুল্লার রাজাভিলিয়ানের সৈন্য। আমি সেনাপতি। তোমাদের কাউকে একটু বেচাল দেখলে মুণ্ডু উড়িয়ে দেব।

একটু থেমে সেনাপতি বলল তোমরা তো দেখছি বিদেশি তোমরা কারা? এখানে এসেছো কেন?

রাজা ওভিড্ডোর তরবারি –আমরা বিদেশি। আমরা ভাইকিং। দেশে দেশে দ্বীপে দ্বীপে ঘুরে বেড়াই, আর কোনো গুপ্তধনের কথা শুনলে সেটা বুদ্ধি খাঁটিয়ে উদ্ধার করি।

–এখানেও শুনেছি রাজা ওভিড্ডোর একটা সোনার তরবারি আর তার খাপ রাখা আছে। তোমরা খুঁজবে নাকি? কথাটা বলেই সেনাপতি হো হো করে হেসে উঠল। সৈন্যরাও কেউ কেউ হাসল।

যাক গে ওসব গুপ্তধনটনের কথা। তোমাদের দলপতি কে? সেনাপতি বলল।

হ্যারি এগিয়ে এসে বলল–এখন আমিই দলপতি। আসল দলপতি যে সে রাজা অপৰ্তোর হাতে বন্দী।

শোনো সেনাপতি বলতে লাগল–আমরা রাজা অপৰ্তোর এই দেশ দখল করতে এসেছি। কেউ কি নিজের সম্পত্তি ছাড়ে? ছাড়ে না। রাজা অপৰ্তোও ছাড়বে না। কাজেই যুদ্ধহবে। আমাদের যুদ্ধ করতে হবে। সেনাপতি থামল।

–এসবের সঙ্গে আমাদের কী যোগ? আমরা তো কারো পক্ষ হয়েই যুদ্ধ করতে যাচ্ছি না। হ্যারি বলল।

-কেন? আমাদের হয়ে তোমরা যুদ্ধ করতে পারো। সেনাপতি বলল।

–না। আমরা কোনো দেশেই যাবো না। হ্যারি বলল।

–ঠিক আছে। সেসব পরে দেখা যাবে। এখন এই যুদ্ধের জন্যে আরো জাহাজের প্রয়োজন। মাত্র দুটো জাহাজ নিয়ে এসেছি। অনেক সৈন্যকে ভিগোতে রেখে আসতে হয়েছে। সেই সৈন্যদের নিয়ে আসবো। এখনই তোমাদের জাহাজটা আমরা নেব। জাহাজ চালিয়ে ভিগোতে যাবো। আরো সৈন্য নিয়ে ফিরে আসবো। সেনাপতি বলল।

ঠিক বুঝলাম না। হ্যারি বলল।

–এ তো জলের মতো সহজ। তোমাদের জাহাজ আরো সৈন্য আনতে ভিগো যাবে তোমরাই চালিয়ে যাবে। আমাদের এক দলপতি তোমাদের সঙ্গে যাবে। তারপর ভিগো থেকে সৈন্য নিয়ে এই জাহাজে ফিরে আসবে। ব্যস। সেনাপতি বলল।

–কিন্তু আমাদের দলপতি এখনো রাজা অপৰ্তোর সৈন্যাবাসে বন্দী। সে যেকোনো মুহূর্তে এখানে আসতে পারে। হ্যারি বলল।

–পালিয়ে? সেনাপতি বলল।

–হ্যাঁ। হ্যারি বলল।

–অত সহজে পালাতে পারবে না। সেনাপতি বলল।

সহজ কঠিন যে অবস্থাই হোক না–সে পালাবে। হ্যারি বলল।

–ঠিক আছে। তাতে কী হল? সেনাপতি বলল।

–সে এসে আমাদের না দেখলে দুশ্চিন্তায় পড়বে। হ্যারি বলল।

তার ব্যবস্থাও আমরা করবো। আমি তো রয়েইছি। জাহাজ ভর্তি সৈন্য রয়েছে। আমরাই তাকে তোমাদের কথা বলবো। তাহলেই সে নিশ্চিন্ত হবে। কী? ঠিক আছে? হ্যারি কিছুক্ষণ ভাবলো। শাঙ্কোকে বলল কী করবে?

–এ ছাড়া তো কোনো পথ দেখছি না। শাঙ্কো বলল।

–ভেন তুমি কী বলো? হ্যারি ভেন-এর মতামত চাইল।

দ্যাখো হ্যারি এখানে যেকোনো মুহূর্তে লড়াই লেগে যেতে পারে। এখন এখানে থাকাটা খুবই বিপজ্জনক। ভিগোতে যেতে আসতে কত আর সময় লাগবে। ভেন বলল।

–বেশ। সেনাপতির দিকে তাকিয়ে হ্যারি বলল–ঠিক আছে। আমরা যাবো।

–এই তো বুদ্ধিমানের মতো কথা। তাহলে দেরি না করে কালকে সকালেই তোমাদের জাহাজ ছাড়ো। আর একটা কথা। দূরত্ব আর কুয়াশার জন্যে রাজা অপৰ্তোর সৈন্যরা আমাদের অবস্থান কিছু বুঝতে পারছে না। কুয়াশা কেটে গেলেই আমাদের দেখতে পাবে। আমাদের আর তোমাদের জাহাজ এখনই বেশ দূরে নিয়ে যেতে হবে। রাজা অপৰ্তোর সৈন্যদের নজরের বাইরে তোমরা নোঙর ফেলো। সেনাপতি বলল।

সেনাপতি নিজেদের জাহাজ নিয়ে চলে গেল। কিছুক্ষণ পরে দেখা গেল সেনাপতির জাহাজ দুটো গভীর সমুদ্রের দিকে যাচ্ছে। হ্যারি ফ্লেজারকে বলল–ওদের পেছনে পেছনে চলো। ফ্লেজার সেই হিসেবেই জাহাজ চালাতে লাগল।

অনেকটা দূরে গিয়ে সেনাপতির জাহাজ দুটো থামল। হ্যারি ও জাহাজ দুটোর পাশে নিজেদের জাহাজ লাগাতে বলল। ফ্লেজার জাহাজ লাগাল।

একটু পরেই ভোর হল। হ্যারি তখনও জাহাজের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে। দূরে। চেয়ে দেখল–কুয়াশ সরে গেলেও তীরভূমি দেখা যাচ্ছে না।

হ্যারিরা সকলেই খাবার খাচ্ছে তখনই দলপতি মারফত সেনাপতি জানিয়ে দিল যে দুপুরের খাওয়া খেয়ে হ্যারিদের জাহাজ ছাড়তে হবে।

দুপুরের খাওয়া হলে দলপতি এসে বলল–এখন তোমাদের জাহাজ ছাড়ো। মারিয়া হ্যারির কাছে এলো। বলল–ফ্রান্সিস কোনো বিপদ হবে না তো? হ্যারি বলল–চিন্তা করবেন না রাজকুমারী। আমরা কয়েকদিনের মধ্যেই ফিরে আসবো। তাছাড়া আপনি যাতে এখানেই সেনাপতির জাহাজে থাকতে পারেন তার ব্যবস্থা করছি।

হ্যারি দলপতির কাছে এলো। বলল আমি সেনাপতিরসঙ্গে একটা জরুরিকথা বলবো।

কী জরুরি কথা?

–সেটা তাকেই বলবো?

–বেশ। খোঁজ নিচ্ছি। দলপতি কথাটা বলে ওদের জাহাজের একজন সৈন্যকে বলল–দেখতো সেনাপতি কী করছেন। সৈন্যটা চলে গেল। একটু পরে ফিরে এসে বলল–সেনাপতি বিছানায় বসে আছেন।

তারমানে তাঁর বিশ্রাম করা হয়ে গেছে। দলপতি বলল। তারপর হ্যারিকে আসতে বলল।

দুজনে সেনাপতির জাহাজে গেল। সেনাপতির কেবিনঘরের সামনে এসে আস্তে দরজায় টোকা দিল। সেনাপতির গুরুগম্ভীর গলা শোনা গেল–কে?

–আমি দলপতি।

–এসো। সেনাপতি বলল।

দুজনে কেবনিঘরে ঢুকল। সেনাপতি দলপতির দিকে তাকিয়ে বলল–কী ব্যাপার। হ্যারিকে দেখিয়ে দলপতি বলল–এই ভাইকিং আপনাকে কিছু বলতে চায়।

-বলো। সেনাপতি হ্যারির দিকে তাকাল।

–বলছিলাম আমাদের সঙ্গে দেশের রাজকুমারী রয়েছেন। তাঁকে ভিগোতে নিয়ে যাবো না। তিনি আপনাদের জাহাজেই এখানে থাকবেন। আপনি এই অনুমতিটা দিন। হ্যারি বলল।

বেশ। থাকবে। সেনাপতি বলল।

–আপনাকে যে কী বলে–হ্যারি বলতে গেল। সেনাপতি থামিয়ে দিয়ে বলল যাও–তাকে আমাদের জাহাজে নিয়ে এসো। মারিয়াকে সেনাপতির জাহাজে নিয়ে আসতে সমস্যা হল। প্রথমে মারিয়া নিজেদের জাহাজ ছেড়ে আসতে চাইল না। হ্যারি আর ভেন অনেক করে বলেও মারিয়াকে রাজি করাতে পারছিল না। তখন ভেন বলল–এখানে জাহাজে থাকলে ফ্রান্সিস প্রথমে আপনাকেই দেখবে। ও কত খুশি হবে। এবার মারিয়া রাজি হল। দুটো জাহাজের মাঝখানে দুটো পাটাতন ফেলা হল। শাঙ্কো মারিয়াকে পাঁজকোলা করে পাটাতনের ওপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে সেনাপতির জাহাজে এলো। মারিয়াকে নামিয়ে দিল। সেনাপতির জাহাজ এলো। জাহাজ ছাড়ার উদ্যোগ আয়োজন চলল। পাল দরিদড়া সব দেখে নেওয়া হল। দলপতি সঙ্গে চারজন সশস্ত্র সৈন্য হ্যারিদের জাহাজে এলো।

জাহাজ ছাড়া হল। বাতাস বেগবান। পালগুলো ফুলে উঠল। এখন আর দাঁড় বাইতে হবে না। আকাশও নির্মেঘ। জাহাজ বেশ জোরেই সমুদ্রের ঢেউ ভেঙে চলল। হ্যারি জাহাজের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে রইল। কোথায় যাচ্ছি। বিপদ হবে না তো, এসব ভাবতে লাগল।

একদিন দুপুর নাগাদ জাহাজ ভিগো নগরের জাহাজঘাটায় পৌঁছল। দূর থেকে শহরটা দেখে হ্যারিরা খুব খুশি। কতদিন পরে মাটিতে হাঁটবে। লোকজন দোকানপাট দেখবে। শহরের ভিড়ে ঘুরে বেড়াবে। রাতে আলোর রোশনাই দেখবে।

জাহাজ ঘাটে ভিড়ল। দলপতি এগিয়ে এলো। বলল–সবাই নামো।

সবাই জাহাজ থেকে নামল। তারপর গিয়ে দাঁড়াল। দলপতি এগিয়ে এলো। বলল– তোমরা সার বেঁধে চলো। হঠাৎ আরো জনাদশেক সশস্ত্র সৈন্য কোথা থেকে এলো। হ্যারিদের ঘিরে দাঁড়াল। ভেন ইশারায় হ্যারিকে কাছে ডাকল। হ্যারি ভেন-এর কাছে এলো। ভেন বলল–হ্যারি আমরা বোধহয় বিপদে পড়লাম।

–তা কেন। আমরা তো বন্দি। এভাবেই তো নিয়ে যাবে। হ্যারি বলল। মাথা নেড়ে ভেন বলল–আমাদের পাহারা দেবার জন্যে এত সৈন্যের কি প্রয়োজন আছে?

–ঠিক বুঝতে পারছি না–এত সৈন্য কেন? হ্যারি বলল।

–তার মানে কিছু একটা ঘটবে যার জন্যে আমরা বিদ্রোহী হতে পারি। তাই এত সৈন্য। ভেন বলল।

হ্যারি ভাবল। বলল–ভেল আমি যেন এখন বুঝতে পারছি ঐ দলপতির কথা না শুনলেই হত।

–তারও তো উপায় ছিল না। হ্যারি। ভেন বলল।

–না। উপায় ছিল। আমরা বলতে পারতাম যে আমরা যাব না। আপনারা জাহাজ নিয়ে যান। হ্যারি বলল।

–হ্যাঁ এটাই করা উচিত ছিল। যাক গে–দেখি এরা আমাদের নিয়ে কী করে। ভেন বলল।

হ্যারিরা চলেছে। এই ভর দুপুরেও রাস্তায় বেশ লোকজন। হ্যারিরা যেমন রাস্তার লোকজন দেখছে তেমনি রাস্তার লোকজনও হ্যারিদের দেখছে। লোকেরা ভাবছে কারা এই বিদেশি। সৈন্যরা ঘিরে এদের নিয়ে যাচ্ছে কেন? কোথায় যাচ্ছে?

একটা বেশ বড়ো পাথরের বাড়ির সামনে হ্যারিদের থামতে বলা হল। বাড়িটার তুলনায় প্রবেশ দ্বার খুবই ছোটো একজন একজন করে ঢোকা যায়। প্রবেশ দ্বারের দুপাশে চার-পাঁচজন প্রহরী। হাতে বর্শা। কোমরে তলোয়ার গোঁজা।

হ্যারি ঘুরে দাঁড়াল। দলপতির কাছে গেল। বলল–এটা কয়েদখানা আমরা। এখানে এসে কয়েদখানায় থাকবো সেনাপতির সঙ্গে তো তেমনি কথা হয় নি।

–আমি নিরুপায়। এটা সেনাপতির হুকুম। দলপতি বলল। হ্যারি দুহাত তুলে চিৎকার করে বলল–আমরা এই কয়েদখানায় ঢুকবো না। আমাদের সরাইখানায় রাখা হোক। ভাইকিং বন্ধুরাও ব্যাপারটা এতক্ষণে বুঝতে পারলো। ভাইকিংরা ধ্বনি তুলল–ও– হোহো। ভাইকিংদের ক্রুদ্ধ চেহারা দেখে দলপতি একটু ঘাবড়ে গেল। হ্যারি উল্টেদিকে হাঁটতে লাগল। বন্ধুরাও ওর পেছনে এসে দাঁড়াল। বিস্কো চিৎকার করে বলে উঠল– এই বাড়িতে আমরা ঢুকবো না। আমাদের কোনো সরাইখানায় নিয়ে যেতে হবে। শুরু হল হৈ হল্লা। হ্যারিরা তখন সারি ভেঙে ফেলেছে। সেনাপতি গলা চড়িয়ে বলল সবাইকে ঘিরে রাখো। সৈন্যরা পরস্পর হাত ধরে হ্যারিদের আটকে রাখল। দলপতি দু’হাত ওপরে তুলে চিৎকার করে বলল–তোমরা শোনেনা। এটা সেনাপতির হুকুম। আমাকে মানতেই হবে। যদি না মানি তাহলে আমাকে মরতে হবে। তোমরা কি চাও আমার মৃত্যু হোক। আমিও তো তোমাদের সঙ্গে কখনও খারাপ ব্যবহার করি নি।

হৈ হল্লা কমল। হ্যারি ভেকে বলল ফ্রান্সিস নেই। আমি কী করবো বুঝে উঠতে পারছি না।

–বাধা দিয়ে লাভ নেই। ওরা সংখ্যায় বেশি। তার ওপর আমরা নিরস্ত্র। ওরা যদি তলোয়ার চালায় আমরা কেউ বাঁচবোনা। বন্দী জীবন মেনে নাও। এখন এটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। হ্যারিও সেটা বুঝতে পারছিল। জাহাজঘাটা থেকে আরো যে সৈন্য ওদের সঙ্গে এলো এটাও সেনাপতির ধূর্তামি।

হ্যারি গলা চড়িয়ে বলল–ভাইসব। এখন এভাবে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলে আমরই বিপদে পড়বো। আমরা নিরস্ত্র নিরুপায়। এখন বন্দীদশা মেনে নাও। আমার অনুরোধ শান্ত হও। সময় ও সুযেগ নিশ্চয়ই আসবে। তার জন্যে বেঁচে থাকতে হবে। সশস্ত্র সৈন্যরা যদি আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে আমরা কেউ বাঁচবো না। হৈ হট্টগোল থেমে গেল।

ভাইকিংরা অস্তে আস্তে লোহার দরজা দিয়ে ঢুকতে লাগল। ঢোকার আগে শাঙ্কো জোর গলায় বলে উঠল–সেনাপতি আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। হ্যারি জোরে বলে উঠল–শাঙ্কো–শান্ত হও। মাথা গরম করো না।

সবাই ভেতরে ঢোকার পর হ্যারি ঢুক। একটা চত্বরমতো পার হয়ে সারি সারি ঘর। প্রত্যেকটি ঘরের সম্মুখে প্রহরীরা পাহারা দিচ্ছে। প্রথম ও দ্বিতীয় ঘরটি ছেড়ে তৃতীয় ঘরটার সামনে এলো সবাই। দলপতি দাঁড়াতে হুকুম দিল। ভাইকিংরা দাঁড়িয়ে পড়ল। প্রহরী চাবি দিয়ে দরজা খুলল। বেশ শব্দ করে দরজাটা খুলল। ভাইকিংরা ঘরটায় ঢুকল। ঘরটা বেশ বড়ো। কাঠপাথর আর ঘাস দিয়ে তৈরি ছাতের কাছাকাছি দুদিকে দুটো জানালা। জানালা দুটোতে গরাদ নেই। মেঝেয় একটা মোটা কাপড় পাতা। কাপড়টায় সুতোর কাজ করা। দুদিকের দুটো পাথুরে দেয়ালে দুটো আংটায় লাগানো আছে দুটো মশাল। তার একটা এই দিনের বেলাতেও জ্বলছে।

মেঝেয় শুয়ে ছিল তিনজন বন্দী। হ্যারিদের দেখে দুজন উঠে বসল। হ্যারিরা ততক্ষণে বসে পড়েছে। পুরানো বন্দীদের একজন বলল–তোমরা কারা? দেখে মেনেহচ্ছে তোমরা বিদেশি।

হ্যাঁ ঠিকই ধরেছে। আমরা ভাইকিং। দেশে দেশে ঘুরে বেড়াই। কথাটা বলে হ্যারি মোটা কাপড়টায় শুয়ে পড়ল। মাথার পেছনে দুহাতের তেলো রাখল। তারপর চোখ পুঁজল। অনেক কিছু ভাবতে হচ্ছে। ফ্রান্সিস এখনও মুক্তি পেল না। পালাতেও পারল না। রাজকুমারী রইলেন সেনাপতির জাহাজে। ওরা নিজেরা এখানে বন্দী হয়ে রইল। এটা অপ্রত্যাশিত। এখান থেকে মুক্তি পাবো কবে। হয় তো এখানেই সবাই এক এক করে মরবো। ফ্রান্সিস, রাজকুমারীর সঙ্গে হয়তো আর দেখাই হবে না।

হ্যারি চোখ খুলল। তাকিয়ে রইল ছাতের দিকে। কাঠ পাথর আর শুকনো লম্বা লম্বা ঘাসে তৈরি ছাতটা। তারপর তাকালো জানালা দুটোর দিকে। জানালা পর্যন্ত উঠতে পারলে গরদহীন জানালা দিয়ে পালানো সম্ভব। সেটা কীভাবে। সম্ভব?

শাঙ্কো এসে হ্যারির কাছে বসল। ওপরের দুটো খোঁদল দেখিয়ে বলল–হ্যারি যদি ঐ খোদলটার কাছে কোনোরকমে পৌঁছানো যায় তবে আমরা মুক্ত হতে পারবো। হ্যারি খোদল দুটো ভালো করে দেখল মেঝে থেকে খোদল দুটোর উচ্চতা হিসেব করল। বলল–হ্যাঁ এটা সম্ভব। কিন্তু অত উঁচুতে পৌঁছোতে পারলে তবে তো।

–হু–অত উঁচুতে পৌঁছোনোটাই আসল সমস্যা। শাঙ্কো বলল।

–আগে সেটাই ভাবো। হ্যারি বলল।

— হু ভাবছি। শাঙ্কো থামল। তরপর বলল–হ্যারি, প্রথমেই চাই একগাছা দড়ি।

–এখানে দড়ি পাবে কি করে? হ্যারি বলল।

–পাবো। শোনো হ্যারি–আমরা নিজেদের মধ্যে মারপিট শুরু করব। গোলমাল থামাতে প্রহরীরা নিই ঘরের মধ্যে ঢুকবে। আমরা তবু মারপিট চালিয়ে যাবো। প্রহরী থামাবার চেষ্টা করবে। কিন্তু আমরা থামবো না। ওরা দলপতিকে খবর দেবে। দলপতি আসবে। জানতে চাইবে এরকম মারামারির কারণ কী? তুমি দলপতিকে বলবে এরা সবাই গুণ্ডা খুনে। সবাইকে দড়ি দিয়ে বাঁধুন। আবার মারপিট শুরু করবে। দলপতি প্রহরীদের দড়ি এনে বাঁধতে বলবে। প্রহরী দড়ি কেটে ছোটো করে হাত বাঁধবে। এইবার হল বুদ্ধির খেলা। তুমি প্রহরীদের বলবে বাঁধা হাতের মধ্যে দিয়ে একটা লম্বা দড়ি ঢুকিয়ে দাও। সবাই একসঙ্গে বন্দী হয়ে থাকবে। আর মারপিট করতে পারবে না। ঐ দড়ির সঙ্গে একটা পাথরের টুকরো বেঁধে কড়িকাঠের ফাঁকের মধ্যে দিয়ে দড়ি নিয়ে আসবো। এবার দড়ি বেয়ে উঠে ঐ খোদল দিয়ে বাইরে যাওয়া আর পালানো। হ্যারি শাঙ্কোর পরিকল্পনা ভেবে দেখল। হাসল। বলল–সাবাস শাঙ্কো। তুমি ফ্রান্সিসের মতোই সমস্যার সমাধান করতে শিখেছো। দেখো চেষ্টা করে।

শাঙ্কো উঠে দাঁড়াল। ফিস ফিস করে বলল–ভাইসব কাছে এসো। সবাই শাঙ্কোর কাছে এলো।

আমি এখান থেকে পালাবার জন্যে একটা পরিকল্পনা করেছি। হ্যারিকে বলেছি। সেই পরিকল্পনা তোমাদের বলি। একমাত্র এইভাবেই পালানো সম্ভব। শাঙ্কো থামল। তার পর হ্যারিকে যেমন বলেছিল তেমন করে চাপা গলায় সব বলে গেল। শাঙ্কোর কথা শেষ হলে ভাইকিং বন্ধুরা মৃদুস্বরে ধ্বনি তুলল–ও হো-হো।

শাঙ্কো বসল। বলল–হ্যারি, এবার সময়টা ঠিক করো। হ্যারি বলল–দিনে তো পারা যাবেই না। রাতে খাওয়াদাওয়ার পর।

–আজকেই, বলল শাঙ্কো।

বেশ আজকেই পালাবো। হ্যারি বলল।

দিন শেষ হল। রাতে হ্যারিদের খেতে দেওয় হল। খাওয়া শেষ করে সবাই শুয়ে পড়ল। শাঙ্কো বাদে। শাঙ্কো তখনও ঐ পরিকল্পনাটা ভাবছে। সম্ভাব্য ঘটনাও ভাবছে। মোটকথা শাঙ্কো সবদিক ভেবে স্থির সঙ্কল্পে এলো।

তখন রাত শেষ। হঠাৎ কয়েদঘরে হৈ চৈ শুরু হল। প্রথমেই শাঙ্কোরা রাজা অপৰ্তোর যে ক’জন সৈন্য বন্দী ছিল তাদের ওপর চড়াও হল রাজ অপৰ্তোর সৈন্যরা অবাক। শুরু হল ধাক্কাধাক্কি। ভাইকিংরা নিজেদের মধ্যেও মারপিট শুরু করল।

তিনজন প্রহরী ছুটে এলো। দরজার কাছে দাঁড়াল। মারামারি দেখল। গলা চড়িয়ে বলল প্রহরীরা মারামারি থামাও নইলে আমি দলপতিকে খবর দিতে যাচ্ছি। হ্যারি চাপা গলায় বলল–চালাও। ভাইকিংরা চিৎকার করতে করতে পরস্পরের ঘাড়ে লাফিয়ে উঠতে লাগল।

তিন প্রহরী সমস্যায় পড়ল। কী করবে বুঝে উঠতে পারলনা। একজন ছুটল দলপতির বাড়ির দিকে। মারামারি গোলমাল কিছুটা থামল।

অল্পক্ষণের মধ্যেই দলপতি এলো। আবার চিৎকার চ্যাঁচামেচি জোরে শুরু হল। দলপতি গলা চড়িয়ে বলল–এসব মারপিট এখানে চলবে না। থামো সব। কে কার কথা শোনে। হ্যারি বন্ধুদের কাছে এসে আস্তে বলে গেল–কয়েকজন মেঝেয় পড়ে যাও। সঙ্গে সঙ্গে তিনজন ভাইকিং পর পর মেঝেয় পড়ে গেল। দলপতি প্রহরীদের দরজা খুলতে বলল। দরজা খোলা হল। দলপতি এগিয়ে গেল। চিৎকার করে বলে উঠল–এসব গুণ্ডামি বন্ধ করো। নইলে চাবুকের মার খাবে।

মারামারি হৈহল্লা আরও বেড়ে গেল। হ্যারি দলপতির কাছে গেল। বলল–যদি আমার কথা শোনেন তো বলি।

-বলো। দলপতি বলল।

–এরা সবাই গুণ্ডা খুনে। এদের হাত বেঁধে দিন। তাহলে আরমারামারিকরতে পারবে না।

–ঠিক আছে। তাই করছি। সেনাপতি বলল। তারপর প্রহরীদের ডাকল। প্রহরীরা দলপতির কাছে এগিয়ে গেল। দলপতি বলল–সব কটার হাত বাঁধ। যদি তার পরেও মারামারি করে সবকটাকে চাবুক মার। কেউ যেন বাদ না যায়।

দলপতি চলে গেল।

এবার হ্যারি প্রহরীদের বলল–শক্ত দড়ি এনে বাঁধো সবকটাকে।

দুজন প্রহরী দড়ি আনতে ছুটল। একটু পরে লম্বা দড়ি আনল। দড়ি দিয়ে হ্যারি ভাইকিং বন্দীদের দুহাত বাঁধতে লাগল। রাজা অপৰ্তোর বন্দী সৈন্যরাও বাদ গেল না। দড়ি বাঁধা হলে হ্যারির হাতও প্রহরীরা দড়ি দিয়ে বাঁধল। হ্যারি দেশীয় ভাষায় বলল– গণ্ডগোল কমাও। ভাইকিংরা চুপচাপ মেঝেয় পাতা কাপড়ে বসে পড়ল।

হ্যারি প্রহরীদের বলল–ভাই একটা কাজ করো। প্রত্যেক দড়ি বাঁধা হাতের মধ্যে দিয়ে একটা লম্বা শক্ত দড়ি ঢুকিয়ে দাও। সবাই বাঁধা পড়ে যাবে। গণ্ডগোল কমবে।

প্রহরীরা তাই করল। এবার সব চুপ।

প্রহরীরা বেরিয়ে গেল। বাইরের বারান্দায় গিয়ে পাহারা দিতে লাগল।

রাতের খাওয়াদাওয়া মিটল। প্রহরীরা এঁটো কাঠের বাসন গ্লাশ নিয়ে চলে গেল। শাঙ্কো উঠে দাঁড়াল। গলার ঢোলা ফাঁক দিয়ে হাত ঢোকাল। ছোরাটা বের করল। তারপর সবাইর হাত বাঁধা দড়ি কেটে দিল। রাত বেশি হতে লাগল। ভাইকিংরা সবাই চুপচাপ শুয়ে রইল।

গভীর রাত তখন। শাঙ্কো আবার উঠে বসল। তারপর লম্বা দড়িটা একমাথা থেকে টেনে টেনে সবটা খুলে নিল। লম্বা দড়ির একটা মাথায় পাথরের টুকরো বাঁধল। তারপর দড়িটা দোলাতে লাগল। একবার বেশি করে দুলিয়ে নিয়ে উপরের দিকে কড়িকাঠ লক্ষ্য করে ছুঁড়ল। মাথাটা কড়িকাঠের আর ছাতের মধ্যে দিয়ে পাথর বাঁধা মুখটা নীচে পড়ে গেল। শাঙ্কো দড়ির মুখটা এবার কোমরে বেঁধে নিল। বন্ধুরা দড়ির অন্য মুখটা টেনে ধরল। শাঙ্কো এবার দড়ি ধরে ধরে আস্তে আস্তে উঠে কড়িকাঠটা ধরল। তারপর ঝুলতে ঝুলতে এগিয়ে চলল খোদলটার দিকে। তখনই হঠাৎকড়িকাঠের কাঠটায় মচ্ করে শব্দ হল। শাঙ্কো সাবধান হল। খুব আস্তে আস্তে ঝুলতে ঝুলতে খোদলটার কাছে এলো। তারপর মাথাটা খোঁদলে ঢুকিয়ে দিয়ে পার হল। ওধারে গিয়ে এবার থামতে লাগল। ঘরে তখন কয়েকজন বন্ধু দড়িটা টেনে ধরে রাখল। শাঙ্কো আস্তে আস্তে মাটিতে নেমে এলো৷ একবার দাঁড়িয়ে চারদিকে দেখল। একটা মাঠমতো জায়গা পরে পাথরের বাড়িঘর। কোনো বাড়িঘরেই আলো নেই। শাঙ্কো কোমরের বাঁধা দড়ি খুলল।

এবার প্রথমে দড়ি ধরে উঠতে লাগল ভেন। বেশ কসরৎ করেই ভেন খোঁদলে গিয়ে পৌঁছল। তারপর মাথা ঢুকিয়ে খোঁদলের বাইরে চলে এলো। শাঙ্কো দড়িটা টেনে ধরে রইল। ভেন আস্তে আস্তে নেমে এলো। ভেন তখন বেশ হাঁপাচ্ছে। রাজা অপৰ্তোর বন্দী সৈন্যরা একে একে বেরিয়ে এলো কয়েদঘর থেকে। একইভাবে সবাই কয়েদঘরের বাইরে চলে এলো। শাঙ্কো বলল–জাহাজঘাটে যাওয়ার রাস্তাটা কোনদিকে বুঝতে পারছি না।

–আমাদের দক্ষিণমুখে যেতে হবে। তারপর সেদিকে হাঁটতে লাগল। চাঁদের আলো খুব বেশি নয়। সেই আলোতে হ্যারিরা এগিয়ে চলল। মিনিট দশ-পনেরো হাঁটার পরই বাঁ দিকে দেখল বড়ো রাস্তা। চলেছে দক্ষিণমুখো। হ্যারি ঐ দিকেই চলল।

হ্যারিদের ভাগ্য ভালো। পথে কোনো সৈন্যের সঙ্গে দেখা হলনা। দেখা হলে ভাগ্যে ভোগান্তি ছিল।

হ্যারিরা যখন জনশূন্য পথ দিয়ে এসে জাহাজঘাটে পৌঁছল তখন পুব আকাশে লাল ছোপ ধরেছে। কিছু পরেই সূর্য উঠল।

হ্যারি যে ভয়টা পেয়েছিল তাই হল। জাহাজঘাটায় এসে ওরা দেখল ওদের জাহাজটা নেই। আট-দশটা জাহাজ রয়েছে এই বন্দর শহরে। কিন্তু ওদের জাহাজটা নেই।

হ্যারিরা সমস্ত জাহাজঘাটা এলোকা ঘুরে ঘুরে দেখল। কিন্তু কোথায় ওদের জাহাজ? হ্যারি জাহাজঘাটার পাথরের ঘাটে বসে পড়ল। বন্ধুরাও কেউ কেউ দাঁড়িয়ে রইল কেউ কেউ বসল। হ্যারি মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ বসে রইল। তারপর মুখ তুলে বলল– উপায় নেই। এখানেই একটা জাহাজ কিনতে হবে।

–কিন্তু বিক্রি করবে এমন জাহাজ কি এখানে পাওয়া যাবে? শাঙ্কো বলল।

–চেষ্টা তো করতে হবে। তরপর দেখা যাক। হ্যারি বলল। বন্ধুরাও এই প্রস্তাবে সম্মত হল। তখন হ্যারি শাঙ্কোকে বলল–শাঙ্কো তোমার কাছে ক’টা সোনার চাকতি আছে বলো। শাঙ্কো একবার আড় চোখে এপাশ-ওপাশ তাকিয়ে দেখে নিল। তারপর ফেট্টি থেকে সোনার চাকতিগুলো বার করে গুণল বলল–একশ চল্লিশটা স্বর্ণমুদ্রা আছে।

–দেখা যাক যারা বিক্রি করবে তারা কত চায়। হ্যারি বলল। হ্যারি উঠেদাঁ ড়াল। বলল সবাই দল বেঁধে বেরুলে সহজেই রাজা ভিলিয়ানের সৈন্যদের চোখে পড়ে যাবো। তা ছাড়া এতক্ষণে পাহারাদাররা নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছে আমার পালিয়েছি। কাজেই সবাই এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়ো। আমি আরশাঙ্কো একসঙ্গে থাকবো। জাহাজ কেনার জন্যে ঘণ্টাখানেক চেষ্টা করবো। তারপর জাহাজ পাই বা না পাই সবাই এখনে আসবো। ঠিক এক ঘণ্টা পরে তোমরাও একে একে এই ঘাটে আসবে। একসঙ্গে নয়। এইভাবে দল বেঁধেও থাকবো না। তোমরা এলে শাঙ্কো তোমাদের কাছাকাছি এসে জাহাজ কেনা হয়েছ কিনা সেটা ফিস ফিস করে বলবে। না কেনা হলে এখন কী করবো সেটাও শাঙ্কো বলে দেবে।

সবাইছড়িয়ে পড়ল। হ্যারি তীরে বাঁধা জাহাজগুলোয় উঠতে লাগল। বলতে লাগল– জাহাজটা বিক্রি করবেন কিনা। জাহাজের ক্যাপ্টেন মাথা নেড়ে বলল–না। অন্য জাহাজ দেখুন। প্রায় সবকটা জাহাজেই হ্যারি গেল। কিনতে চাইল। কেউ রাজি হল না।

একটা জায়গায় দেখল সমুদ্রের জল খড়ির মতো একটা জায়গায় ঢুকে গেছে। সেখানে জলে ভাসছে একটা ছোটো জাহাজ।

–চলো শাঙ্কো–এই ছোটো জাহাজটাও দেখা যাক। হ্যারি বলল।

দুজনে তীরে রাখা পাটাতনটা দিয়ে জাহাজে উঠল। তিনজন নাবিক ডেকটা ঘষে ঘষে পরিষ্কার করছিল। ওদের একজনকে হ্যারি বলল—এই জাহাজের মালিকের সঙ্গে দেখা করবো।

–মালিক কে আমরা জানি না। আমাদের ক্যাপ্টনইসব। তার সঙ্গে দেখা করতে পারেন। হ্যারিরা কথা বলছে তখনই ক্যাপ্টেন ওদের দেখল। ক্যাপ্টন কাছে এলো। বেশ ভারি গলায় বলল–আপনাদের পরিচয়?

–আমরা ভাইকিং। দেশে দ্বীপে ঘুরে বেড়াই। হ্যারি বলল।

–ও। ক্যাপ্টেন চিবুকের কাঁচাপাকা দাড়ি চুলকে বলল–আপনারা এই দেশে এসেছেন কেন।

–অল্প কথায় তা বলা যাবে না আসার কারণ–আপনারা যদি এই জাহাজটা বিক্রি করেন আমরা কিনতে পারি। শাঙ্কো বলল।

–দেখুন ক্যাপ্টেন বলল–এই জাহাজটা আমরা বিক্রি করবো। তারপর লিসবনে চলে যাবো। ক্যাপ্টেন বলল।

–তাহলে আপনারা বিক্রি করবেন? হ্যারি বলল।

–হ্যাঁ। অনেক ভেবেই স্থির করেছি জাহাজটা বিক্রি করে দেব। ক্যাপ্টেন বলল।

–কটা সোনার চাকতি লাগবে? হ্যারি বলল।

–সেটা পরে বলছি। আগে জাহাজটা ঘুরে দেখুন। ক্যাপ্টেন বলল।

–ঠিক আছে। হ্যারি বলল।

হ্যারি শাঙ্কোকে নিয়ে জাহাজটা ঘুরে ঘুরে দেখল। খুব দামি জাহাজ নয়। তবে মোটামুটি সব ব্যবস্থাই আছে। জাহাজের ডেক কেবিনঘর স্নানঘর খুবই নিকৃষ্টমানের। ভাইকিংদের ছেলেবেলা থেকেই দুটো জিনিস দেখে শেখে–এক সমুদ্রে দুই জাহাজ নৌকো। ওদের অর্থ বেশি নেই। কাজেই উমানের জাহাজের দাম দেওয়া ওদের পক্ষে সম্ভব নয়। কাজেই ছোটো জাহাজটা কেনার চেষ্টা করল। এসব ভেবে হ্যারি স্থির করল এই জাহাজটাই কিনবে।

দুজনে জাহাজ দেখোপ্টেনেরকাছে এলো। ন্যাপ্টেন বলল–কেমন দেখলেন জাহাজটা?

–ভালো। এখন আসল কথা কত সোনার চাকতিতে বিক্রি করবেন? হ্যারি বলল।

–আপনারা কীসে দাম দেবেন? ক্যাপ্টেন বলল।

–আমাদের কাছে স্থানীয় মুদ্রা নেই। এই সোনার চাকতিগুলো আছে। কথাটা বলে শাঙ্কোর দিকে তাকাল। শাঙ্কো ফেট্টির ভাজ খুলে দুটো স্বর্ণমুদ্রা বের করল। সোনার চাকতি দেখে ক্যাপ্টেনের চোখ দুটো লোভে চিকচিক্ করে উঠল।

–ঠিক আছে। দশটা চাকতি দেবেন। ক্যাপ্টেন বলল।

অত পারবো না। আটটা সোনার চাকতি দেব। শাঙ্কো বলল।

এত কমে কি হয়? ক্যাপ্টেন হেসে বলল।

–এর বেশি আমরা দিতে পারবো না। হ্যারি বলল।

–ঠিক আছে–একটা সোনার চাকতি কম দিন। মানে–নটা সোনার চাকতি দিন। ক্যাপ্টেন বলল।

হ্যারি আর কথা বাড়াল। শাঙ্কোকে ইঙ্গিত করল। শাঙ্কো গুণে গুণে ন’টা সোনার চাকতি ক্যাপ্টেনকে দিল।

–আপনারা কবে এই জাহাজে আসবেন? ক্যাপ্টেন বলল।

–আমরা বলতে গেলে এসেই গেছি। হ্যারি বলল।

তার মানে? ক্যাপ্টেন বলল।

এখন আমরা এই জাহাজেই থাকবো। শাঙ্কো বলল।

–ঠিক আছে। আমরা নেমে যাচ্ছি। ক্যাপ্টেন বলল।

ক্যাপ্টেন ওর কেবিনঘরে ঢুকল। সব গুছিয়েগাছিয়ে একটু পরেই বাক্স প্যাটরা হাতে বেরিয়ে এলো। তিনজন নাবিককে ডাকল। প্রত্যেককে কিছু মুদ্রা দিল। তারপর পাটাতন দিয়ে নেমে গেল। অল্পক্ষণের মধ্যেই সদর রাস্তায় ভিড়ে মিশে গেল।

হ্যারি বলল–শাঙ্কো এবার বন্ধুদের ডেকে নিয়ে এসো। শাঙ্কো জাহাজঘাটের দিকে চলল। সেখানে গিয়ে দেখল মাত্র কয়েকজন বন্ধু বসে আছে।

শাঙ্কো বন্ধুদের বলল–জাহাজ কেনা হয়ে গেছে। আঙ্গুল দিয়ে খাঁড়িমতো জায়গাটা দেখাল। বলল–ওখানেই জাহাজটা দেখতে পাবেন। যে ক’জন এসেছিল তারা চলে গেল।

শাঙ্কো বসল। অপেক্ষা করতে লাগল।

কিছুক্ষণ পর পর ভাইকিং বন্ধুরা আসতে লাগল। শাঙ্কো তাদের জাহাজ কেনার কথা জানাল। জাহাজটা কোথায় রয়েছে তাও আঙ্গুল দিয়ে দেখাল। শাঙ্কো আরো বলল একসঙ্গে যেও না। এক এক করে যাও।

শাঙ্কো হিসেব করে দেখল–আর দুজন বাকি। কিছুক্ষণের মধ্যে সেই দু’জনও এলো। শাঙ্কো উঠে দাঁড়াল। বলল–একসঙ্গে না। ছাড়া ছাড়া এসো। শাঙ্কো জাহাজের দিকে চলল।

সব ভাইকিংরা জাহাজে এসে উঠল এক এক করে। তোক ছোটো তবু জাহাজ দেখে সবাই খুশি। হ্যারি গলা চড়িয়ে বলল-জাহাজটায় বেশি খাবার জল নেই। আটা ময়দা চিনও আনতে হবে। শাঙ্কো, আর একজনকে নিয়ে খাবার জিনিসগুলো কিনে আনো। অন্য দুজন যাও, জলের পিপে নিয়ে যাও। জল ভরে আনন।

কিছুক্ষণের মধ্যেই দুজন খাবার জল নিয়ে ফিলে এলো। শাঙ্কোরা আটা ময়দা এসব কিনে আনল। সব মজুত করা হল। রাঁধুনি রান্না সারল। দুপুর নাগাদ সবাই খেল। খাওয়া শেষ হতে বিকেল হয়ে গেল।

সবাই কেবিনঘরে জাহাজের ডেক-এ শুয়ে বসে বিশ্রাম করছে তখনই হঠাৎ দুজন রাজা ভিলিয়নের সৈন্য তীরে এসে দাঁড়াল। তারপর জাহাজের পাতা পাটাতন দিয়ে জাহাজ উঠে এলো। দু’জন সৈন্য জাহাজে উঠে আসছে তখনই হ্যারি নিজেদের দেশীয় ভাষায় বলে উঠল–জাহাজ ছাড়ো–পালাতে হবে।

সঙ্গে সঙ্গে ভাইকিংরা জাহাজের পালগুলো খুলে দিল। পালগুলো বেগবান বাতাস পেয়ে ফুলে উঠল। সৈন্য দু’জন তলোয়ার খুলে এগিয়ে এলো। চিৎকার করে বলল তোমাদের দলনেতা কে? হ্যারি এগিয়ে এলো।

তুমিই দলনেতা? একজন সৈন্য বলল।

হ্যাঁ। হ্যারি বলল।

–তোমরা আমাদের কয়েদঘরে বন্দী ছিলে? সৈন্যটি বলল।

–ঠিক মনে করতে পারছি না। শাঙ্কো বলল।

তোমরা কয়েদঘর থেকে ঘুলঘুলি দিয়ে পালিয়েছে। সৈন্যটি বলল।

শাঙ্কো গলা চড়িয়ে ওদের দেশীয় ভাষায় বলল–নোঙর তোলো–যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পালাবো। একজন সৈন্য বলল–কী? তোমরা পাহারাদারদের ধোঁকা দিয়ে পালিয়েছে। তাই কিনা?

ততক্ষণে জাহাজটা তীরভূমি থেকে অনেকটা চলে এসেছে। একজন সৈন্য এতক্ষণে সেটা দেখতে পেয়ে বলে উঠল–জাহাজ থামাও। ভাইকিংরা কেউ কিছু বলল না। জাহাজ আরো দূরে চলে এলো। হ্যারিরা চুপ। হঠাৎ সৈন্যটি হ্যারির সামনে এসে দাঁড়াল। হাতের খোলা তলোয়ারটা হ্যারির গলায় ঠেকিয়ে বলল–জাহাজ থামাও নইলে মরবে। শাঙ্কো বলে উঠল–ভাই–এদিকে এসো।

–কেন? হ্যারির গলা থেকে তলোয়ার না সরিয়ে বলল সৈন্যটি।

–একটা গোপন কথা আছে। শাঙ্কো বলল।

–ওখান থেকেই বলল। সৈন্যটি বলল।

–তা বলা যাবে না। জাহাজের এদিকটায় এসে দেখো। সৈন্যটি শাঙ্কোর কাছে এলো। শাঙ্কো বিদ্যুৎগতিতে এগিয়ে এসে সৈন্যটিকে ল্যাঙ মারল। সৈন্যটি পাক খেয়ে ডেক-এর ওপর গড়িয়ে পড়ল। হাত থেকে তলোয়ার ছিটকে গেল। শাঙ্কো দ্রুতহাতে তলোয়ারটা তুলে নিল। সৈন্যটি আস্তে আস্তে উঠে বসল। উঠে দাঁড়াল। অন্য সৈন্যটি এবার শাঙ্কোর দিকে খোলা তলোয়ার হাতে এগিয় এলো।

শাঙ্কো বলল–এখন আমার হাতেও তলোয়ার।

বেশ তো। লড়াই হবে। সৈন্যটি আক্রমণোদ্যত হল। শাঙ্কো বলল

–আক্রমণ করার আগেই তুমি খতম হয় যাবে। ভালো কথা বলছি শোনো জাহাজ এখনও তীরের কাছেই আছে। প্রাণে বাঁচতে চাও তো জলে ঝাঁপিয়ে পড়ো। সাঁতরে তীরে গিয়ে ওঠো।

–না। আমরা লড়বো। সৈন্যটি বলল।

–তাহলে দেখো। লড়াই হোক। শাঙ্কো বলল।

সৈন্যটি তলোয়ার হতে এগিয়ে এলো। শাঙ্কো দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল তলোয়ার চালাল। সৈন্যটির ডান বাহু লম্বালম্বি কেটে গেল। রক্ত পড়তে লাগল। সৈন্যটি বসে পড়ল। কিন্তু হার মানল না। উঠে দাঁড়াল। তলোয়ার উঁচিয়ে এগিয়ে এলো। শাঙ্কো এক লাফে এগিয়ে এসে ওর তলোয়ারে নিজের তলোয়ার দিয়ে এত জোরে ঘা মারল যে সৈন্যটির হতের তলোয়ার ছিটকে গেল। শাঙ্কো এবার এসে সৈন্যটির পেট জড়িয়ে ধরল। তারপর ওকে এক ধাক্কায় রেলিঙের গায়ে ফেলল। তারপর কোমর ধরে সমুদ্রের জলে ছুঁড়ে দিল। সৈন্যটি কাটা হাত নিয়ে কোনোরকমে সাঁতরে চলল জাহাজঘাটের দিকে। শাঙ্কো ঘুরে দাঁড়াল। অন্য সৈন্যটির দিকে তাকাল। সৈন্যটি তখন ভয়ে কাঁপছে। শাঙ্কো বলল–এবার জলে ঝাঁপিয়ে পড়ো। সৈন্যটি আর কোনোদিকে তাকিয়ে রেলিঙ থেকে সোজা জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। জাহাজঘাটের দিকে সাঁতরে চলল দুজনেই।

হ্যারিদের জাহাজ চলল। ফ্লেজার জাহাজ চালাচ্ছিল। ওর মনের খুঁতখুঁতানি যায় না। এত ছোটো জাহাজ চালিয়ে কোনো আনন্দ নেই।

পরদিন দুপুর নাগাদ জাহাজ রাজা অপৰ্তোর রাজ্যের জাহজঘাটের কাছে এলো। দূর থেকে হ্যারিরা দেখল জাহাজঘাটে জোর লড়াই চলছে। হ্যারিরা দূর থেকেই অস্পষ্ট শুনতে পেল সৈন্যদের চিৎকার ধ্বনি হৈ হৈ। হ্যারি ফ্লেজারের কাছে এলো। বলল– আমরা বেশ দূরে থাকবো। এখানেই নোঙর ফেল। ঘর ঘর শব্দে নোঙর ফেলা হল।

ওদিকে রাজা অপৰ্তোর সৈন্যদের আবাসে ফ্রান্সিসের একঘেয়ে দিন কাটতে লাগল। ঘরটায় সৈন্যরা থাকে। তারা ফ্রান্সিসকে বলে–যুদ্ধ শেষ না হলে তোমার মুক্তির আশা নেই। তাই ফ্রান্সিসও দিন গোণে। কতদিন কেটেছে এখানে। ফ্রান্সিস সেই নকশা আর লেখার কাগজটা সাবধানে রাখে। সবসময় নকশার কাগজটা কোমরের ফেট্টির মধ্যে গুঁজে রাখে। দু-চারজন সৈন্য ফ্রান্সিসের কাছে আসে। ও নিশ্চয়ই মুক্তি পাবে এইসব বলে। কিতান নামে একটা সৈন্যের সঙ্গে ফ্রান্সিসের খুব ভাব হয়েছে। কিতানই ফ্রান্সিসকে সব খবর দেয়। আর কয়েকদিনের মধ্যেই যে লড়াই শেষ হবে কিতান এ বিষয়ে নিশ্চিত।

কয়েকদিন পরে সকালবেলা। সমুদ্রতীরে ভেড়ানো জাহাজ থেকে রাজা অপৰ্তোর সৈন্যরা দেখল–দূর থেকে তিনটি জাহাজ আসছে। তারমধ্যে একটা সাধারণ জাহাজ। বাকি দুইটি যুদ্ধ জাহাজ। রাজার সৈন্যাবাসে সেই সংবাদ পৌঁছল। সেনাপতি ছুটে এলো। বলল সবাই তৈরি হও। সেনানিবাসে সাজো সাজো রব উঠল। সৈন্যরা তলোয়ার নিল। শিরস্ত্রাণ বর্ম পরে সৈন্যাবাস থেকে বেরিয়ে এসে সামনের বড়ো মাঠটায় একত্র হল। সার বেঁধে দাঁড়াল। সেনাপতি এলো। সৈন্যরা সামনে দাঁড়াল। একটু পরেই রাজা অপৰ্তো ও এলো। সেনাপতি চিৎকার করে বলল

–আমার মহান রাজা অপৰ্তো এসেছেন। সবাই রাজার জয়ধ্বনি করো। সৈন্যরা চিৎকার করে ধ্বনি দিল–মহান রাজা অপৰ্তো দীর্ঘজীবী হোন।

এবার রাজা অপৰ্তো গলা চড়িয়ে বলল–আমাদের বীর সৈন্যরা নরুল্লার রাজা আমাদের দেশ আক্রমণ করেছে। তোমরা শৌর্যে বীর্যে অন্য কোনো দেশের চেয়ে কম। নও। নরুল্লার রাজা ভিলিয়ানকে পরাস্ত করো। ওদের এ দেশ থেকে তাড়িয়ে দাও। রাজা থামল। সৈন্যরা আবার ধ্বনি দিল–মহান রাজা অপৰ্তো দীর্ঘজীবী হোন।

রাজা অপৰ্তো দুজন অমাত্যর সঙ্গে চলে গেল। সেনাপতির নির্দেশে একদল সৈন্য তীরসংলগ্ন জাহাজে গিয়ে উঠল। সেই জাহাজ থেকে পরে অন্য জাহাজটায় উঠল। তখনই রাজা ভিলিয়ানের প্রথম জাহাজটা রাজা অপৰ্তোর জাহাজের গায়ে এসে লাগল। রাজা ভিলিয়ানের সৈন্যরা তৈরি হল। কিছু সৈন্য লাফিয়ে রাজা অপৰ্তোর জাহাজে উঠে এলো। শুরু হল তলোয়ারের লড়াই। চিৎকার আহতদের আর্তনাদ গোঙানিতে ভরে উঠল এলোকাটা।

জোর লড়াই শুরু হল। রাজা ভিলিয়ানের সৈন্যরা প্রথম ধাক্কায় হেরে গেল। আহত সৈন্যরা নিজেদের জাহাজে চলে গেল।

এবার রাজা অপরে সেনাপতি সমুদ্রতীরের কাছে এসে চিৎকার করে হুকুম দিল– সবাই মাঠে নেমে এসো। এবার মাঠে লড়াই হবে।

রাজা অপৰ্তোর সৈন্যরা তাদের দুটো জাহাজ থেকেই পাতা পাটাতন দিয়ে সমুদ্রতীরে উঠে আসতে লাগল। উঠে এসে সার বেঁধে দাঁড়াল।

রাজা ভিলিয়ানের সৈন্যরা জাহাজ থেকে নেমে সেই মাঠে চলে এলো। এবার লড়াই চলল বিস্তৃত প্রান্তরে।

ফ্রান্সিস যে ঘরে বন্দী ছিল সেই ঘরের সৈন্যরা সেনাপতির হুকুম শুনে বেরিয়ে গেল। ফ্রান্সিস একা। কিন্তু যে খবরটা দিয়ে চলে গেল সে বাইরে অপেক্ষা করতে লাগল। সব। সৈন্য বেরিয়ে গেলে ঘরটার দরজা তালা দিয়ে আটকে রেখে গেল।

ফ্রান্সিস চুপ করে বসেছিল। বুঝল এই সুযোগ। পালাবার এমন সুযোগ পরে নাও আসতে পারে।

ফ্রান্সিস দ্রুত উঠেদাঁড়াল। কান পাতল–রাজাঅপৰ্তোর বক্তৃতা শুনল। বুঝল কিছুক্ষণের মধ্যেই লড়াই শুরু হবে। ফ্রান্সিস বাইরে লাগানো তালাটা হাত বাড়িয়ে দরজার পাল্লার ফাঁক দিয়ে দেখল–তালাটা বেশ শক্ত তালা। তালা ভাঙা যাবেনা। কড়াটা ভাঙ্গতে হবে।

ফ্রান্সিস কিছুটা পিছিয়ে গিয়ে ছুটে এসে তালা কড়ার জায়গাটায় লাথি মারল। তালা ভাঙল না। কড়াও খুলল না। ফ্রান্সিস আবার লাথি মারল। তালা বা কড়া খুলল না। এবার ফ্রান্সিস গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে দরজায় লাথি মেরে চলল।

হঠাৎ কড়া ভেঙে ছিটকে গেল। দরজা খুলে গেল।

ফ্রান্সিস এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে ছুটে ঘরটা থেকে বেরিয়ে এলো। ঠিক তখনই একজন রাঁধুনি এলো। ফ্রান্সিসকে দেখে বললকী ব্যাপার? পালাচ্ছো নাকি?

-না-না। মরণপণ লড়াই করতে যাচ্ছি। ফ্রান্সিস বলল।

–খুব ভালো কথা। রাঁধুনি চলে গেল।

এই সুযোগ। বন্দীদশা থেকে তো পালাতে পার। কিন্তু খাব কী? ফ্রান্সিস পায়ে পায়ে রসুই ঘরে এলো। দেখল থরে থরে সাজানো সুস্বাদু গোল রুটি। ঘরে কোনো রাঁধুনি নেই। ফ্রান্সিস দ্রুত হাতে চারটে রুটি ঢোলা জামার গলার কাছ দিয়ে ঢুকিয়ে দিল। রুটিগুলো পেটের কাছে গিয়ে ফেট্টিতে আটকে রইল।

এবার ফ্রান্সিস এক ছুটে সৈন্যাবাসের বাইরে এলো। একটা মোটা ওকগাছের পেছনে দাঁড়াল। গাছের আড়াল থেকে দেখল জাহাজগুলোর মধ্যে প্রচণ্ড লড়াই চলছে। রাজা ভিলিয়ানের সৈন্যদের সঙ্গে রাজা অপৰ্তোর সৈন্যদের। সমস্ত এলাকা জুড়ে চলেছে। মরণোন্মুখ সৈন্যদের আর্ত চিৎকার গোঙানি। দু’দলেরই সৈন্যরা চিৎকার করছে। তলোয়ার চালিয়ে উভয়পক্ষের সৈন্যরা লড়াই করতে লাগল। ফ্রান্সিসেরও ইচ্ছা হল একটা তলোয়ার পেলে লড়াইতে নামা যেত। কিন্তু কার হয়ে লড়বোকথাটা ভেবে ফ্রান্সিস মনে মনে হাসল।

ফ্রান্সিস দ্রুতপায়ে ছুটল সমুদ্রতীরের দিকে। সমুদ্রের দিক থেকে জোর বাতাস ছুটছে। ধুলো বালি উড়ছে। ফ্রান্সিস চোখ কুঁচকে ছুটল।

সমুদ্রতীরে পৌঁছল। বালির ওপর বসল। দূর থেকে দেখল জাহাজঘাটে তখনও লড়াই চলছে। ও সমুদ্রের দিকে তাকাল। দেখল সবকটা জাহাজই সমুদ্রতীরে ভিড়িয়ে রাখা হয়েছে। ফ্রান্সিস দূরে তাকাল। নাঃ, ওদের জাহাজটা নেই। অনেক দূরে ছোট্ট একটা জাহাজ আবছা দেখল। কিন্তু সেটা ওদের জাহাজ নয়।

জাহাজঘাটায় জাহাজগুলো পালা করে দেখতে গিয়ে ওদের জাহাজটা দেখল। ওদের জাহাজ লড়াইয়ে কেন? ফ্রান্সিস কিছুই বুঝতে পারল না। হ্যারিরা বোকার মতো লড়াইয়ে যোগ দিয়েছে।

কী করবে ফ্রান্সিস বুঝে উঠতে পারল না। হ্যারিরা খুব বোকার মতো কাজ করেছে। অথবা এও হতে পারে রাজা অপৰ্তোই ওদের বাধ্য করেছে লড়াইয়ে নামার জন্যে। ওরা মারিয়াকেই বা কোথায় রেখেছে। ওরা সবাই কি আমাদের জাহাজেই আছে? এরকম নানা চিন্তা ফ্রান্সিসের মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল।

ফ্রান্সিস সমুদ্রের দিকে ভালোভাবে তাকিয়ে দেখল। দূরের জাহাজটা যুদ্ধ জাহাজ নয়। ঐ ছোট্ট জাহাজে যারা রয়েছে তারা যুদ্ধে যোগ দেয় নি। কে জানে ওটা কাদের জাহাজ? ফ্রান্সিস ভাবতে লাগল–এখন আমার প্রধান কর্তব্য মারিয়া আর বন্ধুদের সন্ধান করা। ওরা কোথায় থাকতে পারে। ভেবে পাচ্ছি না–ওরা কি যুদ্ধে কারো পক্ষ নিয়েছিল? আমাদের জাহাজটা তীরে ভেড়ানো আছে। হয়তো ওরা আমাদের জাহাজেই রয়েছে। কিন্তু যুদ্ধের এই ডামাডোল নিশ্চয়ই আমাদের জাহাজটাকেও কাজে লাগানো হয়েছে। তাহলে হয়তো মারিয়াকে বন্ধুদের জাহাজ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। হয়তো ওদের তীরভূমির কোথাও নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন ওদের জাহাজে না যেতে পারলে কিছুই বোঝা যাবে না।

বিকেলের দিকে যুদ্ধক্ষেত্রে চিৎকার হৈ হৈ শোনা গেল না। তার মানে যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। এখন কারা জয়লাভ করল ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।

বিকেলের দিকেই বোঝা গেল। রাজা ভিলিয়ানের সৈন্যদের বন্দী করা হতে লাগল। ওরই মধ্যে এবার রাজা ভিলিয়ানের সৈন্যরা একটা জাহাজে উঠে জাহাজ ছেড়ে দিল। রাজা অপৰ্তোর সৈন্যরা বাধা দেবার আগেই জাহাজটা বেশ দূরে ভেসে গেল। জাহাজের সব পাল খুলে দেওয়া হল। জাহাজ বেশ গতি পেল। বোধহয় ওরাদাঁড়ও বাইছে। অল্পক্ষণের মধ্যেই জাহাজ গভীর সমুদ্রে গিয়ে পৌঁছল। রাজা অপৰ্তোর সৈন্যরা আর ওদের তাড়া করল না।

রাজা অপৰ্তোর সৈন্যরা যুদ্ধজয়ের আনন্দে মেতে উঠল। খাওয়াদাওয়া হৈ হৈ চলল সৈন্যদের মধ্যে।

একটু রাত হতেই হৈ হৈ থেমে গেল। যুদ্ধক্ষেত্রে যেন শুনশান। নিস্তব্ধ চারিদিক। শুধু সমুদ্রের ঢেউ ভেঙে পড়ার একটানা শব্দ।

ফ্রান্সিস উঠে দাঁড়াল। বুকের কাছে জামার ভেতর থেকে একটা গোল করে কাটা রুটিটা বের করল। বসল। রুটি খেতে খেতে ভাবতে লাগল ও কী করবে এখন? প্রথমে আমাদের জাহাজে তো যাই, দেখি কিছু হদিশ পাই কিনা–মারিয়ার বন্ধুদের।

আজ গভীর রাত। রুটির শেষ টুকরোটা চিবুতে চিবুতে ফ্রান্সিস সমুদ্রের জলে নামল। গলা পর্যন্ত জলে এসে নিঃশব্দে সাঁতার কাটতে লাগল। আকাশের চাঁদ অনুজ্জ্বল। তবু কিছুদূর পর্যন্ত সবঅস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ফ্রান্সিস সাঁতরে চলল জাহাজঘাটের দিকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই জাহাজঘাটের কাছে এলে জাহাজগুলো অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ফ্রান্সিস জলে শব্দ না। করে ওদের জাহাজের কাছে এলো। হালটা ধরল। হাঁপাচ্ছিল। একটু থেমে দম নিল।

হালের খাঁজে খাঁজে পা রেখে জাহাজে উঠল। কিন্তু প্রথমেই ডেক-এ নামল না। হালের আড়াল থেকে ডেক-এর দিকে তাকাল। দেখল ডেক-এ দুজন সৈন্য শুয়ে আছে। ফ্রান্সিস নিঃশব্দে ওদের কাছে এলো। দেখল–দুজনই মারাত্মক আহত। জায়গাটায় শুকনো রক্ত ছড়িয়ে আছে। সৈন্যদের পোশাক দেখে বুঝল এরা নরুল্লার রাজা ভিলিয়ানের সৈন্য।

ফ্রান্সিস আস্তে সরে এলো। সিঁড়িঘরের কাছে এলো। তারপর সিঁড়ি দিয়ে আস্তে আস্তে নেমে এলো। প্রথম কেবিনঘরটা দেখল। আস্তে দরজা খুলল। কেউ নেই। পরেরটাতেও কেউ নেই। ফ্রান্সিস চিন্তায় পড়ল। তাহলে তো এই জাহাজে বন্ধুরা কেউ নেই।

এবার নিজের কেবিনঘরের সামনে এলো। দরজা বন্ধ। ফ্রান্সিস আশান্বিত হল। তাহলে মারিয়া নিশ্চয়ই এই ঘরে আছে। ফ্রান্সিস দরজা টোকা দিল। সঙ্গে সঙ্গে মারিয়ার গলা শুনল–কে? ফ্রান্সিস কিছু বলল না। এতক্ষণে যেন সহজে শ্বাস নিতে পারছে। দরজাটায় ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল অল্পক্ষণ। আবার মারিয়ার কিছুটা ভীত কণ্ঠস্বরকে ওখানে? ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে বলল–আমি ফ্রান্সিস।

মারিয়া চমকে উঠল। বলল–

–তুমি? মারিয়া ছুটে এসে দরজা খুলে দাঁড়াল। ফ্রান্সিসের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। চোখ বুজল। দুই গালে দুটো চোখের জল গড়িয়ে পড়ল। ফ্রান্সিস ঘরের মৃদু আলোয় দেখল সেটা। ফ্রান্সিস মারিয়ার কাঁধে হাত রাখল। মৃদুস্বরে বলল–কেঁদো না। এই তো আমি এসেছি।

ফ্রান্সিস মারিয়াকে ধরে ধরে নিয়ে গিয়ে বিছানায় বসাল। ফ্রান্সিস লক্ষ্য করল মারিয়ার মাথার চুল উস্কোখুস্কো চোখমুখ শুকনো। মারিয়ার শরীরের এই অবস্থা দেখে ফ্রান্সিসের মন যেন কেঁদে উঠল। মৃদুস্বরে বলল–মারিয়া তোমাকে এইসব দুঃসাহসিক কাজে না আনলেই বোধহয় ভালো হত। মারিয়া ম্লান হাসল। বলল–আমিই তো জোর করে তোমার সঙ্গে এসেছি। তোমার কোনো দোষ নেই।

–তবু। মন মানে না। ফ্রান্সিস বলল।

একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল–এবার কাজের কথা বলল। হ্যারির কোথায়?

মারিয়া অস্তে আস্তে সব বলল। সবশেষে বলল হ্যারিরা আমাদের এই জাহাজ নিয়ে নরুল্লার রাজা ভিলিয়ানের রাজধানী ভিগো গিয়েছিল। আমাকে এখানেই সেনাপতির জাহাজে রেখে গিয়েছিল। তারপর আমি আর কিছুই জানি না।

ওরা বেঁচে আছে তো? ফ্রাসিস কতকটা আপনমনেই বলল।

-না-না। বেঁচে আছে বৈকি। তুমি এই নিয়ে ভেবো না। মারিয়া বলল।

–মারিয়া খাবারদাবার কিছু আছে? ফ্রান্সিস বলল।

নিশ্চয়ই কিছু আছে। অমি প্রতিদিনই বেশি করে রাঁধছি। আশা যদি তুমি আসো। মারিয়া বলল।

–ঠিক আছে খেতে দাও! ফ্রান্সিস বলল।

মারিয়া ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল–

-ভেজা পোশাক ছাড়ো। আমি আসছি। ভেজা পোশাকে এতক্ষণে শরীরটা শিরশির করতে লাগল। ফ্রান্সিস তাড়াতাড়ি পোশাক পাল্টল। শুকনো পোশাক পরে শির শির ভাবটা কেটে গেল।

মারিয়া চিনে মাটির থালায় রুটি মাংসের ঝেল নিয়ে এলো। তারপর কাঠের গ্লাশে জল দিল। ফ্রান্সিস গ্লাশটা নিয়ে সবটুকু জল খেয়ে ফেলল। মারিয়া আরও এক গ্লাশ জল দিল।

ফ্রান্সিস আস্তেআস্তে খেতে লাগল। খাচ্ছে আর ভাবছ্যোরিদেরকথা। কোথায় আছে ওরা?

–এখন কী করবে? মারিয়া বলল।

–সেটাই তো ভাবনা। ওরা জাহাজে চড়ে রাজা ভিলিয়ানের রাজ্যে গিয়েছিল। তুমি তো এইটুকুই জানো।

–হ্যাঁ। কিন্তু মারিয়া লাফিয়ে উঠল–মনে পড়েছে আমাদের জাহাজটা কদিন পরেই ফিরে এসেছিল এখানে।

-হ্যারিরা সেই জাহাজে ফেরে নি–এই তো? ফ্রান্সিস বলল।

–হা হা। তুমি কী করে বুঝলে? মারিয়া বলল।

–এইসব সেনাপতি-টতি অনেক দেখেছি। নিজেদের ভীষণ ক্ষমতাধর প্রমাণের জন্যে সব করতে পারে। ফ্রান্সিস বলল।

-তাহলে এখন কী করবে? মারিয়া বলল।

–রাজা ভিলিয়ানের রাজ্যের ভিগো নগরে যাবো। ফ্রান্সিস বলল।

–সেকি! এই জাহাজ চালিয়ে যাবে মারিয়া বলল।

–হ্যাঁ। ফ্রান্সিস বলল।

–আমরা দুজন? মারিয়া বলল।

–না–আমরা চারজন। ফ্রান্সিস বলল।

–ওপরের ডেক-এদুজন রাজাভিলিয়ানের সৈন্য আহত অবস্থায় রয়েছে। ফ্রান্সিস বলল।

তারা কি আমাদের কোনোভাবে সাহায্য করতে পারবে? মারিয়া বলল।

–দু-একদিনের মধ্যে যতটা সাহায্য পাবো ততটাই নেবো। ফ্রান্সিস বলল।

–আমি কী করবো? মারিয়া বলল।

রান্না করবে খেতে দেবে। আর সেলাই ফেঁড়াই করবে। ফ্রান্সিস বলল।

–না, প্রয়োজনে আমি তলোয়ার নিয়ে লড়াই করবো। মারিয়া বলল।

–দোহাই লড়াইর ময়দানে তোমাকে আমি দেখতে চাই না। ফ্রান্সিস বলল।

–আমি প্রায় প্রতিদিন তলোয়ার চালানো অভ্যেস করি। মারিয়া বলল।

–শিখেছো কার কাছে? ফ্রান্সিস বলল।

–শাঙ্কো। মারিয়া বলল।

–শাঙ্কোটা তোমার মাথাটি খেয়েছে। ফ্রান্সিস বলল।

–আমিই শাঙ্কোকে বলেছি শেখাতে। মারিয়া বলল।

–ও প্রথমে আপত্তি করেছিল। আমি শুনি নি। ও তোমার কথাও বলেছিল। আমি বলেছি তোমাকে নিয়ে ভাবতে হবে না। আমিই তোমাকে বোঝাবো। মারিয়া বলল।

-ঠিক আছে বাবা। তুমি তলোয়ার চালানো শেখো, লড়াই করো। ফ্রান্সিস বলল। তাহলে আমি ত লড়তে পারবো। মারিয়া বলল।

–তা পারবে। ফ্রান্সিস বলল।

ফ্রান্সিস বিছানায় শুয়ে পড়তে পড়তে বলল–ঐআহত দুজন সৈন্যকে কে খেতে দেয়?

-আমিই খেতে দিই। তবে ওষুধ তো আর পড়ছেনা। জানি না কী করে শরীরের কাটাগুলো সারবে। মরিয়া বলল।

ভেন থাকলে চিকিৎসা হত। ফ্রান্সিস বলল।

–ফ্রান্সিস। এখন কী করবে? মারিয়া বলল।

রাজা ভিলিয়ানের রাজ্য ভিগোতে যাবো। ফ্রান্সিস বলল।

মারিয়া চোখ বড়ো বড়ো করে বলল–তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে? এই ক’জন আমরা এত বড়ো একটা জাহাজ চালিয়ে ভিগো নগরে যেতে পারবো?

পারবো। জাহাজের পালগুলো খাঁটিয়ে দেব। সবকটা পাল। জোর বাতাস পেলে জাহাজ দ্রুত চলবে। আমাদের কিছুই করার থাকবে না। জাহাজ আপনি চলবে। শুধু হুইল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দিকটা ঠিক রাখতে হবে। ফ্রান্সিস বলল।

মারিয়া কী বলতে গেল। ফ্রান্সিস ঠোঁটে আঙ্গুল দিয়ে ওকে থামিয়ে দিল। ফ্রান্সিস ফিস ফিস করে বলল-ডেক-এ কাদের চলাফেরারশব্দ শুনছি। মারিয়া কান পাতলা জুতোরশব্দ।

হঠাৎকার কান্না আর্তনাদ শোনা গেল। সেই সঙ্গে উচ্চ হাসি। তারপরে আরেকজনের গোঙানি শোনা গেল। সমুদ্রে কিছু পড়ার শব্দ শুনল ফ্রান্সিস। আবার হাসি শোনা গেল।

ফ্রান্সিস মৃদুস্বরে বলল–আহত সৈন্য দুজনকে সমুদ্রে ছুঁড়ে ফেলা হল। মারিয়া দু’হাতে বুক চেপে ফুঁপিয়ে উঠল। ফ্রান্সিস মৃদুস্বরে বলল–কেঁদো না। আমি যদি মারিয়া ফ্রান্সিসের হাত চেপে ধরল–না-না। ওরা কতজন আছে কে জানে।

–যতজনই থাক আমি সবকটাকে নিকেশ করবো। মারাত্মকভাবে আহত দুই সৈন্যকে জলে ছুঁড়ে ফেলা। কী নির্মম।

না–না। যেও না। মারিয়া গলা চেপে বলল।

–না মারিয়া। আমি যাবোই। দরকার একটা তলোয়ার। ফ্রান্সিস দ্রুত উঠে দাঁড়াল। মারিয়া বুঝলফ্রান্সিসকে আটকানো যাবেনা। ফ্রান্সিস চলল ওদেরঅস্ত্রঘরের দিকে। অস্ত্রঘরের দরজা খোলা। ফ্রান্সিস ঘরে ঢুকে অন্ধকারে দেখেই বুঝল–খুব বেশি অস্ত্র নেই। ওরই মধ্যে বেছে নিল একটা তলোয়ার। তুলে আনল। চলল ওপরে ওঠার সিঁড়ির দিকে।

আস্তে আস্তে নিঃশব্দে সিঁড়ি দিয়ে উঠল। সিঁড়ির শেষে সিঁড়িঘরে উঠে দাঁড়াল। দেখল যুদ্ধজয়ী রাজা অপৰ্তোর দুজন সৈন্য ডেক-এ বসে আছে। হাত খালি। তলোয়ার কোমরবন্ধে খাপে রাখা।

ফ্রান্সিসকে দেখেই দুজন সৈন্য লাফিয়ে উঠল। তলোয়ার কোষমুক্ত করল। ফ্রান্সিস এগিয়ে এসে বলল–আহত সৈন্য দুজন কোথায়?

জলে ফেলে দিয়েছি। একজন কথাটা বলে হেসে উঠল। অন্যজন বলল,আমাদের আর লড়াইও করতে হয়নি। হত্যা করতেও হয়নি।

–সোজা পথে ঝামেলা মিটিয়ে দিয়েছো। ফ্রান্সিস বলল। দুজনেই জোরে হেসে উঠল।

এবার আমার সঙ্গেও যে ঝামেলা মেটাতে হয়। ফ্রান্সিস খাপ থেকে তলোয়ার খুলল।

তুমি কি আমাদের সঙ্গে লড়বে? একজন সৈন্য বলল।

–হ্যাঁ। ফ্রান্সিস মাথা ওঠানামা করে বলল।

ফ্রান্সিস তলোয়ার ঘোরাতে ঘোরাতে এগিয়ে গেল। একজন সৈন্য তলোয়ার তুলে ফ্রান্সিসের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল ফ্রান্সিস এক পা সরিয়ে নিল। তারপর দ্রুত তলোয়ার চালাল। সৈন্যটি কোনোরকম সেই মার ঠেকালো। সৈন্যটি এবার ফ্রান্সিসের দিকে এগিয়ে গেল। শুরুহলো তলোয়ারের লড়াই। অল্পক্ষণের মধ্যেই সৈন্যটির হাতের তলোয়ার ছিটকে গেল। ও ডেক-এ বসে পড়ল। মুখ হাঁ করে হাঁপাতে লাগল। ফ্রান্সিস ঐ অবস্থাতেই তলোয়ার চালাল। সৈন্যটির গলায় লাগল তলোয়রের কোপ। সৈন্যটি উপুড় হয়ে ডেক এর ওপরে পড়ে গেল। আর উঠে দাঁড়াতে পারলো না।

ফ্রান্সিস এবার অন্য সৈন্যটির দিকে তাকাল। ক্রদ্ধস্বরে বলল–পারবে আমার সঙ্গে লড়তে। সৈন্যটি ভয়ে কয়েক পা পিছিয়ে গেল। ফ্রান্সিস বলল– তোমরা দুজন সৈন্যকে আহত দেখেও জলে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। আমার হাতে একজন মারা যায়। তুমিও রেহাই পাবে না। সৈন্যটি তলোয়ার ডেক-এর ওপর ফেলে দিয়ে সিঁড়িঘরের দিকে ছুটল। ফ্রান্সিস ওর চেয়ে দ্রুত দৌড়ে এসে সৈন্যটির সামনে এসে দাঁড়াল। মৃত্যুভয়ে সৈন্যটির তখন মুখ সাদা হেয়ে গেছে। ফ্রান্সিস বলল–আমি নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করি না। তুমি যাও তলোয়ার হাতে নাও। সৈন্যটি আস্তে আস্তে গিয়ে তলোয়ার তুলে হাতে নিল। ফ্রান্সিস সৈন্যটির সামনে এলো। বলল–এবার আমার সঙ্গে লড়ো।

ফ্রান্সিস তলোয়ার তুলে এগিয়ে এলো। তলোয়ার চালাল। সৈন্যটি মার ঠেকাল। অল্পক্ষণের মধ্যেই সৈন্যটির দম ফুরিয়ে গেল। ও কোনোরকম ফ্রান্সিসের মার ঠেকাতে লাগল। ফ্রান্সিস প্রচণ্ড জোরে তলোয়ার চালাল। সৈন্যটি যে মার ঠেকাতে পারল না। ওর হাত থেকে তলোয়ার ছিটকে গেল। ও চিৎ হয়ে ডেক-এর ওপর পড়ে গেল। মুখ হাঁকরোঁপাতে লাগল। ফ্রান্সিস হাঁপাতে হাঁপাতে বলল–মারাত্মক আহত দুজন সৈন্যকে দেখে তোমাদের মায়া হল না। বিনা দোষে ওদের জলে ছুঁড়ে ফেললে। ঠিক ঐভাবে আমিও তোমাদের দুজনকে জলে ছুঁড়ে ফেলবো।

কথাটা বলে ফ্রান্সিস সৈন্যটির বুকে তলোয়ার ঢুকিয়ে দিল। সৈন্যটি মাথা এপাশ ওপাশ করতে লাগল। ফ্রান্সিস তলোয়ার বের করে নিয়ে কোমরে গুঁজল। তারপর সৈন্যটিকে কাঁদে তুলে নিল। সৈন্যটি অনুনয় করতে লাগল-জলে ফেলো না। জলে ফেলো না। ফ্রান্সিস সে কথা শুনল না। রেলিঙে উঠিয়ে ধাক্কা দিয়ে জলে ফেলে দিল। তারপর অন্য আহত সৈন্যটিকেও একইভাবে জলে ফেলে দিল।

ফ্রান্সিস হাঁপাতে হাঁপাতে সিঁড়িঘরের দিকে চলল। দেখল মারিয়া সিঁড়িঘরের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। মারিয়া সবই দেখেছে। কিন্তু কিছুই বলল না।

কেবিন ঘরে এলো। মারিয়াও এলো। বলল–এখন কী করবে।

–এখান থেকে চলবে না। তুমি নোঙরটা তোলো। পারবে তো।

–হ্যাঁ হ্যাঁ পারবো। মারিয়া মাথা ঝাঁকিয়ে বলল।

–তাহলে যাও। আমি পালগুলো খুলে দিচ্ছি। এখন যে জোরে বাতাস বইছে পাল ভালো হাওয়া পাবে। যাও।

মারিয়া নোঙরের কাছে এলো। তারপর নোঙরের কাছি ধরে আস্তে আস্তে টানতে লাগল। নোঙরটা উঠেআসতে লাগল। কিছুক্ষণেরমধ্যেইমারিয়া নোঙারতুলে ফেলল। হাঁপাতে লাগল।

ডেক এ দেখল ফ্রান্সিস এর মধ্যে সব পাল খুলে দিয়েছে। বাতাসের তোড়ে। পালগুলো ফুলে গেছে। জাহাজও গতি পেয়েছে। বেশ জোরেই চলছে।

ফ্রান্সিস গোল হুইল-এর কাছে এলো। হুইল ঘোরাতে লাগল। জাহাজ চলল।

মারিয়া চলল রসুইঘরের দিকে। রান্না বসাল।

ফ্রান্সিস দিক ঠিক করে হুইলটা একটা কড়ার সঙ্গে আটকাল। তারপর ডেক-এ শুয়ে পড়ল। আকাশের দিকে তাকাল। ঝক্ঝক্ নীল আকাশ। মাঝে মাঝে সাদা মেঘ উড়ে আসছে। ফ্রান্সিস চোখ বুজল। এখন আকাশ দেখার সময় নয়। বন্ধুদের যে কোথায় খুঁজবে বুঝে উঠতে পারছে না। তাই মাথায় চিন্তা।

রাজা ভিলিয়ানের সেনাপতি নিশ্চয়ই হ্যারিদের ভিগোতে বন্দী করে রেখেছিল। তা না হলে ওদের ফিরিয়ে আনল না কেন? হ্যারিরা বন্দী হয়েছিল। নিশ্চয়ই পালাতে পারে নি। তাহলে তো ভিগো নগরে গিয়ে কয়েদখানায় খোঁজ করতে হয়। যদি সেখানে হ্যারি শাঙ্কোদের না পাই তাহলে বুঝবে যে ওরা অন্য কোথাও আছে।

মারিয়া এলো। বলল–খাবে এসো। ফ্রান্সিস উঠে বসল। দেখল জাহাজ বেশ দ্রুত গতিতেই চলেছে। হুইলের সঙ্গে কড়াটায় আটকানো। হাত দিয়ে দেখল ভালোভাবেই আটকানো আছে। ফ্রান্সিস সিঁড়িঘরের দিকে চলল। একবার সমুদ্রের চারদিকে তাকিয়ে দেখতে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। অনেক দূরে একটা ছোট্ট জাহাজ। যুদ্ধের সময় আমি কি ঐ জাহাজটাই দেখেছিলাম? এখন জাহাজটা আবার দেখা যাচ্ছে। ঐ জাহাজটা কি আমাদের জাহাজকেই অনুসরণ করছে? কিন্তু বিনা কারণে আমাদের অনুসরণ করবে কেন? ফ্রান্সিস এবার সবদিকেই তাকিয়ে নিল। না আর কোনো জাহাজ দেখা যাচ্ছে না।

খেতে বসে ফ্রান্সিস বলল–মারিয়া একটা অদ্ভুত ব্যাপার।

কী ব্যাপার? মারিয়া বলল।

ডেক-এ উঠে দেখবে এসো একটা ছোট্ট জাহাজ আমাদের অনুসরণ করছে। ফ্রান্সিস বলল।

কী যে বলো। ছোট্ট জাহাজটা আমাদের অনুসরণ করবে কেন? মারিয়া বলল।

নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। ফ্রান্সিস বলল।

–কী কারণ? মারিয়া বলল।

–সেটাই তো বুঝতে পারছি না। ফ্রান্সিস বলল।

–দেখি তো। মারিয়া বলল।

মারিয়া ডেক-এ উঠে এলো। চারদিকে তাকাল। দূরে দেখল–একটা ছোট্ট জাহাজ আসছে। এখান থেকে অবশ্য জাহাজের লোকজন দেখা যাচ্ছেনা। শুধু ছোট্ট জাহাজটাই দেখা যাচ্ছে। জাহজটায় কোনো নিশানাও উড়ছে না। কে জানে কোন্ দেশের জাহাজ।

মারিয়া ফ্রান্সিসের কাছে এলো। বলল–ছোট্ট জাহাজটা দেখলাম। লোকজন দেখা গেল না। মনে হয় আমদের অনুসরণ করছে। দূরত্বটা বেশ বেশি। কাছে গেলে অবশ্য ডেক-এ কারা আছে বোঝা যেত।

ওদিকে ভিগো নগরের জাহাজঘাট থেকে হ্যারিদের নতুন কেনা জাহাজটা ছাড়ল। চলল রাজা অপৰ্তোর দেশের দিকে। ফ্রান্সিস মারিয়াকে নিশ্চয়ই ওখানে পাওয়া যাবে। এই জাহাজের ছোট্ট মাস্তুলটার মাথায় নজরদারির জন্যে কোনো আসন রাখা নেই। নজরদার পেড্রোর মন খারাপ। ও মাস্তুলের গায়ে ঠেসান দিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওর নজরদারির কাজ করতে লাগল।

হ্যারিদের জাহাজ চলেছে। ছোট্ট জাহাজ। হুইলটাও ছোটো ফ্লেজারেরও মন খারাপ। এই ছোট্ট জাহাজ চালিয়ে যাওয়া। ফ্লেজারের মনে পড়ল ওদের বড়ো জাহাজের কথা।

হ্যারিদের জাহাজ চলেছে। ভাইকিং বন্ধুদের মন খারাপ। এখনও ফ্রান্সিস রাজকুমারীর কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।

একদিন পরে হ্যারিদের জাহাজ রাজা অপৰ্তোর রাজ্যের বন্দরের কাছে পৌঁছল। হ্যারি ফ্লেজারের কাছে এলো। বলল–অনেক দূরে জাহাজ থামাও।

ফ্লেজার বেশ দূরে জাহাজ থামাল।

ভাইকিংরা জাহাজের ডেক-এ এসে দাঁড়াল। হ্যারিরা দেখল রাজা ভিলিয়ান আর রাজা অপৰ্তোর সৈন্যদেরমধ্যে যুদ্ধ লেগে গেছে। জাহাজগুলোর ডেক-এদুপক্ষের সৈন্যদেরলড়াই চলছে। উভয়পক্ষের সৈন্যদের চিৎকার রণধ্বনি আর্তনাদ এত দূরেও শোনা যেতে লাগল।

ঐ জাহাজগুলোর মধ্যেই রয়েছে হারিদের জাহাজ। সেই জাহাজেও এতক্ষণ লড়াই চলেছিল। এখন লড়াই ছড়িয়ে গেল জাহাজের বাইরে–সবুজ ঘসের প্রান্তরে।

হ্যারি ভেবে পাচ্ছে না এখন কী করবে। একটা কথা বুঝল যে এখন এই যুদ্ধের ডামাডোলে ফ্রান্সিসদের খোঁজ করা যাবে না। এখন শুধু অপেক্ষা করা।

পরদিন শাঙ্কোরা বুঝতে পারল যুদ্ধ শেষ হয়েছে। সৈন্যদের পোশাক দেখে হ্যারি বুঝল রাজা ভিলিয়ানের সৈন্যরা হেরে গেছে। ঐ সৈন্যদের প্রান্তরে সারিবদ্ধ করে দাঁড় করানো হল। হাতে দড়ি বাঁধা হল। তার আগে রাজা ভিলিয়ানের সৈন্যরা অনেকে পালিয়ে গেল। সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়ল। সাঁতরাতে সাঁতরাতে পালিয়ে গেল।

হ্যারি নজরদার পেড্রোকে বলল–ভালো করে নজর রাখবে চারদিকে। বিশেষ করে ঐ ঘাটে আমাদের জাহাজটা নোক করে আছে। আর দু’একটা দিন যাক। তারপর এক আমাদের জাহাজটা নিয়ে পালাবো।

পরদিন কাটল। রাত হল। চাঁদের আলো অনেকটা উজ্জ্বল। পেড্রো হঠাৎ দেখল ওদের জাহাজটা ঘাট থেকে আস্তে আস্তে বেরিয়ে আসছে। পেড্রো সঙ্গে সঙ্গে ছুটল হ্যারির কাছে। হ্যরির কেবিনঘর খোলা ছিল।

পেড্রো হ্যারির বিছনার কাছে চলে এলো। ডাকল–হ্যারি হ্যারি। হ্যারি চোখ খুলে উঠে বসল–কী ব্যাপার?

–আমাদের জাহাজটা তীরের কাছে ছিল। পেড্রো বলল।

–হ্যাঁ। হ্যারি বলল।

জাহাজটা তীর থেকে বেশ দূরে আস্তে আস্তে ভেসে আসছে। পেড্রো বলল।

–তার মানে জাহাজে চড়ে সৈন্যটি পালাচ্ছে। হ্যারি বলল।

–তা হতে পারে। তুমি চলো। পেড্রো বলল।

–যাবো তো বটেই। আমরা ঐ জাহাজটার পিছু ছাড়বো না। চলো। হ্যারি বলল।

দুজনে ডেক-এ উঠে এলো। একটু আবছা দেখা যাচ্ছে, জাহাজের সব পাল খুলে দেওয়া হয়েছে। বেশ জোরে জাহাজ চলেছে সমুদ্রের ওপর দিয়ে।

–পেড্রো শিগগির যাও। শাঙ্কো বিস্কোদের ডাকো। অমরা এক্ষুণি জাহাজ ছাড়বো।

পেড্রো ছুটে চলল সিঁড়িঘরের দিকে। সিঁড়ি দিয়ে নামল।

অল্পক্ষণের মধ্যেই শাঙ্কো বিস্কো আর কিছু বন্ধু ডেক-এ উঠে এলো।

হ্যারি অঙ্গুলে দিয়ে দূরের চলন্ত জাহাজটা দেখল।

হ্যারি বলল–আমাদের জাহাজটা কে বা কারা উত্তর দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

–কী করবে এখন? শাঙ্কো বলল।

জাহাজটাকে দূর থেকে অনুসরণ করব, হ্যারি বলল।

–তাহলে তো এখুণি আমাদের জাহাজ ছাড়তে হয়। বিস্কো বলল।

–হ্যাঁ। শাঙ্কো বিস্কো তোমরা এক্ষুনি জাহাজ ছাড়ো। সব পাল খুলে দাও। যত দ্রুতবেগে সম্ভব জাহাজ চালাও। ঐ জাহাজকে অনুসরণ করো–দূর থেকে।

ওদিকে সেদিন বিকেলে ফ্রান্সিস বলল–আজই চলো কয়েদখানায় যাবো। বন্ধুদের খোঁজ করবো। দেরি করবো না। দুজনেই এই দেশীয় পোশাক পরবো।

কিছু পরে তীরে নামল। রাস্তায় বেশ ভিড়। দোকানপাটে বেশ ভিড়। কেনাকাটা চলছে। মারিয়ার মন খুশিতে ভরে উঠল।

ফ্রান্সিস এসব দেখছে না। হ্যারি শাঙ্কোদের দেখা না হওয়া পর্যন্ত মনে শান্তি নেই। লোকজনকে জিজ্ঞেস করতে করতে ওরা কয়েদঘরের সামনে এলো। দেখল ছোটো সদর দরজায় তিনজন করারক্ষী খোলা তলোয়ার হাতে পাহারা দিচ্ছে।

ফ্রান্সিস এগিয়ে গেল। একজন কারারক্ষীকে বলল–এই কয়েদখানার যিনি অধ্যক্ষ তার সঙ্গে একটু কথা বলবো। কারারক্ষী বলল দাঁড়ান–আমি খবর দিয়ে আসছি।

–বলবেন যে একজন ভাইকিং কথা বলবেন।

–ঠিক আছে। কারারক্ষী চলে গেল।

–মারিয়া ফিস্ ফিস্ করে বলল–ফ্রান্সিস আমরা ভাইকিং, দেখা করতে এসেছি এটা বললে কেন?

–এটা তো বলতেই হবে। ফ্রান্সিস বলল।

কারারক্ষী ফিরে এসে বলল–ভেতরে গিয়ে ডানদিকে একটা বড়ো ঘর দেখবে। সেখানেই কারা অধ্যক্ষ বসেন। আপনারা যান।

ফ্রান্সিস আর মারিয়া ঢুকল। ডানদিকের ঘরটার সামনে এলো। ঘরে ঢুকল। দেখল কারা অধ্যক্ষ একটা শ্বেতপাথরের টেবিলের ওপাশে বসে আছে। টেবিলের এপাশে একটা লম্বাটে সিটের আসন। ফ্রান্সিসরা সেখানে বসল। অধ্যক্ষ বলল–

–এদেশি পোশাক পরছো বটে–কিন্তু তোমরা বিদেশি সেটা বোঝা যাচ্ছে।

–হ্যাঁ –আমরা জাতিতে ভাইকিং। ফ্রান্সিস বলল।

–বলো কী বলতে চাও? কারা অধক্ষ্য বলল।

–এই কয়েদঘরে আমাদের দেশের কেউ বন্দী আছে কিনা। ফ্রান্সিস বলল।

–কিছুদিন আগে একদলভাইকিংকেআমরা বন্দী করে এখানে রেখেছিলাম। অধ্যক্ষ বলল।

–এখনও আছে ওরা? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।

–না। খুব বুদ্ধি খাঁটিয়ে পালিয়েছে। কারা অধ্যক্ষ বলল।

–এটা কতদিন আগের কথা? ফ্রান্সিস বলল।

–হবে–দিন দশ-পনেরো আগে। কারা অধ্যক্ষ বলল।

–ফ্রান্সিস মারিয়ার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল। কারা অধ্যক্ষের নজরে পড়ল তা।

— কারা অধ্যক্ষ বলল-খবরটা পেয়ে খুব খুশি হয়েছে মনে হচ্ছে।

–ওরা আমাদের বন্ধু। ফ্রান্সিস বলল।

–তোমার বন্ধুরা পালিয়েছে–তোমরা পালাওনি?

–কথাটার মানে? ফ্রান্সিস বলল।

কারা অধ্যক্ষ আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। গলা চড়িয়ে ডাকল–রক্ষীরা কে আছিস? দুজন কারারক্ষী ছুটে এলো। ফ্রান্সিস মৃদুস্বরে বলল–মারিয়া, চালে ভুল হয়ে গেছে। কারা অধ্যক্ষ বলল কিছুদিন আগে কয়েকজন ভাইকিং এখান থেকে পালিয়েছিল–মনে আছে?

–হ্যাঁ কারারক্ষী একজন বলল। ফ্রান্সিস আর মারিয়াকে দেখিয়ে কারা অধ্যক্ষ বলল–এই দু’জন তাদেরই বন্ধু। এদের কয়েদঘরে ঢোকা।

কথাটা শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে ফ্রান্সিস উঠে দাঁড়াল। বলল–এসবের মানে কী? আমাদের বন্দী করবেন কেন?

বন্ধুদের হয়ে তোমরা কয়েদ খাটবে।

–আমারা রাজি বন্ধুদের হয়ে কয়েদ খাটতে। কিন্তু সেটা কতদিন?

–সেটা বলবেন রাজা ভিলিয়ান। তবে যুদ্ধে হেরে গিয়ে রাজামশাইয়ের মন মেজাজ ভালো নেই। কতদিনের সাজা দেবে কে জানে। কারা অধ্যক্ষ বলল। আসনে বসল।

কারারক্ষী দুজন এগিয়ে এলো। মারিয়া বলল-ফ্রান্সিস–তাহলে আবার কারাবাস।

–উপায় নেই। তবে বন্ধুদের হয়ে কারাবাস করছি–এটাই আমার সান্ত্বনা। চলো আমরা যাচ্ছি। ফ্রান্সিস বলল।

ফ্রান্সিস ও মারিয়া কারারক্ষীদের পেছনে পেছনে চলল।

একটা ঘরের সামনে এলো সবাই। একজন কারারক্ষী চাবির তোড়া থেকে চাবি বের করল। দরজা খুলল। ফ্রান্সিস ও মারিয়া ঢুকল। ঘর অন্ধকার। কারারক্ষী একজন চকমকি পাথর ঘষে আগুন জ্বালাল। কারারক্ষী দুজনে চলে গেল।

এবার ফ্রান্সিস ঘরের মোটা নকশা আঁকা চাদরটার ওপরে শুয়ে পড়ল। মারিয়াও বসল। দেখতে লাগল চারিদিক। শক্ত পাথরের দেওয়াল। ওপর দিকে দুটো জানালা মতো। গরাদ নেই।

মারিয়া বলল তুমি তো বন্দী মেনে নিলে। এখন কতদিন এখানে পচতে হবে কে জানে!

কালকে তো রাজসভায় নিয়ে যাবে। দেখা যাকরাজা ভিলিয়ান কী বলে। ফ্রান্সিস বলল।

–যদি অনেকদিনের জন্যে বন্দী করে রাখে তবে কী করবে? মারিয়া বলল।

–তবে পালাবো। ফ্রান্সিস বলল।

–পারবে? মারিয়া বলল।

–পারতে হবে। সমস্যা একটাই–তোমাকে কী করে সঙ্গে নেব। ফ্রান্সিস বলল।

আমার জন্যে ভেবো না। তুমি মুক্ত হয়ে দেশে ফিরেও এটাই আমি চাই, মারিয়া বলল।

ফ্রান্সিস হাসল। বলল–এটা একটা কথা হল? এই বিদেশ বিভূঁইয়ে তোমাকে একলা রেখে পালিয়ে যাবো? এসব কখনো ভাববে না। আমার ভালো লাগে না। মারিয়া বলল–তুমি রাগ করো না। এসব তোমাকে আর বলবো না।

ফ্রান্সিস কিছু বলল না। চোখ বুজে শুয়ে রইল।

রাতে দুজন কারারক্ষী খাবার দিয়ে গেল। ফ্রান্সিস খেতে খেতে বলল- পেট পুরে খাও। ভালো না লাগলেও খাও। এই কথাটা ফ্রান্সিস বন্দীদশার সময় সবাইকে বলে। পাখির মাংস আর আনাজের ঝোল।

খাওয়া শেষ করে ফ্রান্সিস আবার শুয়ে পড়ল। মারিয়াও কিছুক্ষণ বসে থেকে শুয়ে পড়ল।

গভীর রাত তখন। ফ্রান্সিসের ঘুম আসে নি। নানা চিন্তা মাথায়। মৃদুস্বরে ডাকল– মারিয়া? মারিয়া বলল-বলো।

–সে কি? তুমি এখনও ঘুমোও নি? ফ্রান্সিস বলল।

–তুমি ঘুমোও নি আর আমি নাক ডাকিয়ে ঘুমোবো। মারিয়া বলল।

–ঠিক আছে আমি ঘুমাচ্ছি। এবার তুমিও ঘুমোও। ফ্রান্সিস বলল।

একসময় দুজনেই ঘুমিয়ে পড়ল।

সকালের খাওয়াটা শেষ হতেই দুজন কারারক্ষী এলো। বলল–

–চলো-রাজসভায় যেতে হবে।

ফ্রান্সিস আর মারিয়া উঠে দাঁড়াল। ঘরের বাইরে এলো। দেখল কারা অধ্যক্ষদাঁড়িয়ে আছে। কারা অধ্যক্ষ ফ্রান্সিসদের দেখে হাঁটতে লাগল। সদর দরজার বাইরে এলো সবাই। কারা অধ্যক্ষও ফ্রান্সিসদের সঙ্গে হেঁটে চলল। সঙ্গে সঙ্গে দুজন কারারক্ষী।

পথে অনেকেই দেখল দুজন বন্দীকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কিন্তু বন্দীরা কোন দেশের তা কেউ বুঝল না। যদিও বন্দী দুজন এ দেশীয় পোশাক তবুমুখে দেখে গায়ের রং দেখে বোঝা যাচ্ছে ওরা দুজন বিদেশি।

সবাই হাঁটতে হাঁটতে একটা লম্বাটে বেশ বড়ো পাথরের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। দেখল–প্রবেশ পথে পাথরের তোরণ। হাতে কুঁদেকুঁদে মশাল লাত পাতা পাল তোলা। দুজন রক্ষী দুপাশে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে লোহার বর্শা। ফ্রান্সিস বুঝল–এটাই রাজবাড়ি। রক্ষীরা কারা অধ্যক্ষকে মাথা একটু নুইয়ে সম্মান জানাল।

সবাই রাজসভাঘরে ঢুকল। এর মধ্যেই রাজসভায় বেশ ভিড়। লম্বাটে ঘরটার মাঝামাঝি রাজসভা। রাজা ভিলিয়ান তখনও আসেনি। ফ্রান্সিস দেখলদুটো সিংহাসন। ও ঠিক বুঝলো না আর একটি ছোটো সিংহাসন কার জন্যে। অল্প কিছু পরে রাজা ভিলিয়ান ঢুকল। পেছনে রানি। বড়ো সিংহাসনটায় রাজা বসল। ছোটোটায় রানি বসল। উপস্থিত সবাই উঠে দাঁড়িয়ে রাজারানিকে সম্মান জানাল।

রাজার মুখ বিমর্ষ। বোঝাই গেল যুদ্ধ পারজয়টা রাজা মেনে নিতে পারে নি। রানির কিন্ত হাসিমুখ। চারদিকে তাকিয়ে তকিয়ে দেখছে। ছেলেমানুষের মতো হাসছে।

দুটো বিচারের পর কারা অধ্যক্ষ মাথা নুইয়ে রাজারানিকে সম্মান জানিয়ে বলল– মহামান্য রাজা আমার একটা নিবেদন ছিল।

-বলো। রাজা বলল।

ফ্রান্সিস ও মারিয়াকে দেখিয়ে অধ্যক্ষ বলিল–এরা দুজন জাতিতে ভাইকিং। দিন সাত আট আগে এর বেশ কয়েকজন বন্ধুকে বন্দী করা হয়েছিল। আপনি তাদের গুপ্তচর সন্দেহে ছয়মাস করাবাসের হুকুম দিয়েছিলেন।

–হুঁ। বলো। রাজা বলল।

–দিন আট-দশ আগে ওরা কারাকক্ষের জানালা দিয়ে বেরিয়ে পালিয়ে গেছে। এখন এরা বন্ধুদের খোঁজে আমার কাছে এসেছিল। আমি আপনার কাছে আনলাম। এখন ওদের কী শাস্তি দেবেন দিন।

–এদেরও ছমাস কারাবাস। রাজা বলল।

মাননীয় রাজা–এই প্রসঙ্গে একটা কথা বলি–আমার মনে হয়–এদের গুপ্তচরবৃত্তির জন্যেই আমরা যুদ্ধে হেরে গেছি। অধ্যক্ষ বলল।

–ঠিক — ঠিক। এদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিলাম। রাজা বলল।

ফ্রান্সিস চমকে উঠল। তাড়াতাড়ি বলে উঠল –মাননীয় রাজা এত নিষ্ঠুর হবেন না। ভেবে দেখুন –আমরা বিদেশি ভাইকিং আপনাদের দেশে আমাদের কী স্বার্থ। গুপ্তচরবৃত্তির মতো ঘৃণ্য কাজ আমরা করি না।

না–না। রায় দেওয়া হয়ে গেছে। রাজা বলল।

এবার রানি মারিয়াকে জিজ্ঞেস করল–

–তোমার নাম কী?

–মারিয়া।

–তোমার স্বামী কোথায়?

মারিয়া ফ্রান্সিসকে আঙ্গুল তুলে দেখাল।

রানি হেসে উঠল বাঃ কী মজা। সারাজীবন একটা ঘরে শুধু তোমরা দু’জন এক সঙ্গে।

ফ্রান্সিস বলল–মাননীয়া রানি–মারিয়া আমাদের দেশের রাজকুমারী।

-বলো কি! রাজকুমারী? আঁ? কিন্তু চেহারা দেখে তো সেটা মহে হচ্ছে না।

আমরা দীর্ঘদিন নানা দ্বীপে দেশে ঘুরে বেড়াচ্ছি। রোদ বৃষ্টিঝড় অসহ্য গরম আবার ঠাণ্ডা–এতসবের ধকল পুইয়ে শরীর ঠিক রাখা যায় না। চেহারায় তার প্রভাব পড়ে।

—তা ঠিক। যাকগে তোমাদের মতো গুপ্তচরদের এরকম শাস্তিই হওয়া উচিত। রাজা ঠিক শাস্তিই দিয়েছেন। রানি হেসে বলল।

রাগে ফ্রান্সিসের বুক ফুলে ফুলে উঠতে লাগল। নাক দিয়ে জোরে শ্বাস পড়তে লাগল। মারিয়া ভয়ে বলে উঠল ফ্রান্সিস-শান্ত হও। ভাগ্যে যা আছে মেনে নাও। ফ্রান্সিস — শোনো—

ফ্রান্সিস রাজা রানিকে কোনোরকম সম্মান না জানিয়েই পেছন ফিরে সভাঘরের দরজার দিকে হাঁটতে লাগল। কারা অধ্যক্ষের গলা শোনা গেল–দ্যাখ দ্যাখ–পালিয়ে না যায়। দুজন করারক্ষী ছুটে এলো। ফ্রান্সিস পেছন ফিরে দাঁড়াল। কারা অধ্যক্ষের দিকে তাকিয়ে বলল–তোমার জন্যই আমাদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হল। শোনো–আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তোমাকে খুন করবো।

অধ্যক্ষ বেশ ভয়ে পেল। বলল–এই তোরা একে তাড়াতাড়ি নিয়ে চল্। এর মাথা খারাপ হয়ে গেছে। মারিয়া এগিয়ে এসে ফ্রান্সিসের হাত ধরল। বলল–ফ্রান্সিস শান্ত হও।

সবাই কারাগারে এলো। ফ্রান্সিস আর মারিয়া যে ঘরে ছিল সেদিকে চলল। কারা অধ্যক্ষ এগিয়ে এলো। হেসে বলল–তোমাদের তো অনেকদিন থাকতে হবে। তাই চার নম্বর ঘরটাতে তোমাদের রাখবো। শুকনো ঘাসের পুরু বিছানা। ঘরটা রোদ পায় বলে একটু গরমও। তাছাড়া তোমরা আর যা চাইবে পাবে। মারিয়া গলা চড়িয়ে বলল থাক –আমাদের সুবিধে দেখতে হবে না। যে ঘরে আছি আমরা সেঘরেই থাকবো।

কিন্তু আপনাদের তো কষ্ট হবে। কত বছর থাকতে হবে। কারা অধ্যক্ষ হেসে বলল। কথাটা শেষ হতেই ফ্রান্সিস ঘুরে দাঁড়াল। তারপর ছুটে গিয়ে কারা অধ্যক্ষের গলার কাছে জামাটা চেপে ধরল। তারপর ফ্রান্সিস একহঁচকা টানে উঁচুতে তুলল। অধ্যক্ষ বলে উঠল– এ্যাই ধর একে। তলোয়ার চালা। দুজন কারারক্ষকতরবারি কোষমুক্ত করল। মারিয়া গিয়ে ফ্রান্সিসের হাত ধরল। বলল–ফ্রান্সিস শান্ত হও। এভাবে আমাদের বিপদ বাড়বে। রক্ষী দুজন তলোয়ার উঁচিয়ে দাঁড়াল। ফ্রান্সিস দেখল সেটা। ও নিরস্ত্র। ও অধ্যক্ষকে এক হ্যাঁচকা টানে মাটিতে নামাল। মুঠো ছেড়ে দিল। কারা অধ্যক্ষ মুখ হাঁ করে হাঁপাতে লাগল। বলল–তোরা সাবধান। এই বন্দী যেন কখনও বাইরে আসতে না পারে।

ফান্সিস আর মারিয়া কারাকক্ষে ঢুকল। মারিয়া ঘাসের বিছানায় বসল। ফ্রান্সিস পায়চারি করতে লাগল। গরের তালাবন্ধ করল–বসো। ফ্রান্সিস চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। মারিয়া আবার বললশান্ত হয়ে বসো। ফ্রান্সিস বসল। তারপর শুয়ে পড়ল। দাঁত চাপাস্বরে বলল মারিয়া তুমি যদি না থাকতে আমি রাজা রানি আর ঐ কারার অধ্যক্ষকে মেরে ফেলতাম।

–আমি জানি আমার জন্যেই তোমাদের এত কষ্ট। মারিয়া ফুঁপিয়ে উঠল। ফ্রান্সিস সঙ্গে সঙ্গে উঠে বসল। মারিয়ার কাঁধে দু’হাত রেখে বলল–

-মারিয়া–কেঁদোনা। এভাবে কথাটা বলা উচিত হয়নি। তোমাকে কাঁদতে দেখলে আমি স্থির থাকতে পারি না। তুমি কেঁদো না। মারিয়া চোখ মুছল। আর কাদল না।

ফ্রান্সিস আর মারিয়ার দুপুরের খাওয়া শেষ হয়েছে তখনই কারার অধ্যক্ষ ঢুকল। কারারক্ষীরা তাকে মাথা নুইয়ে সম্মান জানাল। কারা অধ্যক্ষ মারিয়াকে বলল–আপনিই তো রাজকুমারী?

–হ্যাঁ। কিন্তু আমাকে ডাকছেন কেন? মারিয়া বলল।

–আমি না। রানিমা চিঠি দিয়ে তোক পাঠিয়েছেন। আপনাকে রানিমার কাছে যেতে হবে। উনি আপনাকে ডেকেছেন। কারা অধ্যক্ষ বলল।

–আমি যাব না। মারিয়া মাথা নেড়ে বলল।

–তার মানে? রানিমা স্বয়ং লোক পাঠিয়েছেন আপনাকে তার কাছে নিয়ে যেতে আর আপনি বলছেন যাবো না?

কী কারণে মারিয়াকে ডেকে পঠিয়েছেন সেটা কি জানানো হয়েছে? ফ্রান্সিস বলল।

–না –সেসব আমি জানি না। রানিমাও ঐ ব্যাপারে কিছু লেখেন নি। অধ্যক্ষ বলল।

–তাহলে কারণটা আপনি জেনে আসুন তারপর কারণের গুরুত্ব বুঝে মারিয়া যাবে। ফ্রান্সিস বলল।

-ওরে বাবা-রানিমার কাছে কে কারণ জানতে যাবে। কারা অধ্যক্ষ বলল।

–কেন? আপনি যাবেন? মারিয়া বলল।

–আমি? মরে যাবো। মরে যাবো কি আমি মরে গেছি। কারা অধ্যক্ষ বলল।

–কী আর হবে–যান। কারা অধ্যক্ষ বলল।

কারা অধ্যক্ষ চিৎকার করে বলল–আমাকে বেত মারা হবে। তারপর চাকরি থেকে বরখাস্ত।

–তাহলে তো আপনার খুবই বিপদ দেখছি। ফ্রান্সিস বলল।

–বিপদ বলে বিপদ। আমি শেষ–খতম। কারা অধ্যক্ষ বলল।

ফ্রান্সিস আর মারিয়া পরস্পরের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল। ব্যাপারটা ভালো জমেছে। গলা নামিয়ে ফ্রান্সিস বলল।

কারা অধ্যক্ষ এবারহাত জোড় করে মারিয়াকে বলল-রাজকুমারী শিগগিরি যান। এতে আপনাদের দুজনেরই উপকার হবে। কথাটা ফ্রান্সিসকে আগ্রহী করল। মনে মনে ভাবল– মারিয়া যাক। গিয়ে দেখুন রানি কী বলতে চান। হয়তো আমাদের মুক্তিও দিতে পারে।

ফ্রান্সিস বলল–মারিয়া যাও-রানি কী বলে সেটা শুনে এসো।

–রানির চোখে আমি কুটিল দৃষ্টি দেখেছি। উনি ভালো মানুষ নন। মারিয়া বলল।

–সংসারে ক’জন আর ভালো মানুষ আছে। এই যে কারাঅধ্যক্ষজঘন্য প্রকৃতির মানুষ। এর সঙ্গেও তো আমাদের কথা বলতে হয়। যাও–জেনে এসো রানি কী বলতে চান? ফ্রান্সিস বলল।

–বেশ। মারিয়া উঠে দাঁড়াল। বলল–আমাকে কে নিয়ে যাবে?

–আমার কাজের ঘরে এক মহিলা বসে আছে সেই নিয়ে যাবে। চলুন।

দুজনে কারাকক্ষ থেকে বেরিয়ে এলো। অধ্যক্ষের কাজের ঘরে এলো। মারিয়া দেখল একজন বয়স্কা মহিলা। কারাঅধ্যক্ষ তার দিকে তাকিয়ে বলল- এই যে রাজকুমারী মারিয়া। এঁকে নিয়ে যাও।

মহিলাটি ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। মারিয়া পেছনে পেছনে বেরিয়ে এলো।

সদর রাস্তায় এলো। মারিয়া চারদিকে চোখ মেলে লোকজন বাজার বাড়িঘর দেখতে লাগল।

কিছুক্ষণের মধ্যেই দুজনে রাজবাড়িতে পৌঁছল। স্ত্রীলোকটি রাজবাড়ির পেছন দিকে এলো। টানা পাথরের দেয়াল। মহিলাটি পাথরের দেয়ালের মধ্যে একটা কাঠের দরজায় হাত দিয়ে টুক টুক্‌শব্দ করল। দরজা খুলে গেল। দেখা গেল একজন স্ত্রীলোক পেতলের বর্শা হাতে দাঁড়িয়ে আছে। বোঝা গেল অন্তঃপুরে পাহারা দেয়। মারিয়ারা ঢুকতেই স্ত্রীলোকটি দরজা বন্ধ করে দিল।

এক পরিচারিকার সঙ্গে মারিয়া চলল। পরপর কয়েকটি বাগান। কত ফুল ফুটে আছে। ফুলের গন্ধ নাকে লাগল। কে জানে কোন্ ফুলের গন্ধ। দুটো ফোয়ার আছে। তারপর একটা চারকোণা চত্বর। তারপরেই পাথরের দরজা। এখানে কেউ পাহারা দিচ্ছে না।

দুজনে ঢুকল। দুধারের দেয়ালে ছবি বসানো। মারিয়া বুঝল এসব অতীতের রাজা রানিদের ছবি। দুজনে এগিয়ে চলল। দুধারে ঘর। পাখির পালকের বিছানায় শুয়ে আছে বসে আছে কথাবার্তা বলছে রানির সহচারীরা। এখানে সুগন্ধি কিছু দেওয়া হয়েছে। সুন্দর গন্ধ। সকলেই মারিয়াকে ঔৎসুক্যের সঙ্গে দেখতে লাগল।

এবার ডানদিকে একেবারে আলাদা দুটো ঘর। এখানে মেঝে মোজেক করা। স্ত্রীলোকটি বলল-দাঁড়ান। রানিমা কোন্ ঘরে আছেন দেখে আসছি। স্ত্রীলোকটি চলে গেল। মারিয়া তাকিয়ে চারদিক দেখতে লাগল। মারিয়াদেরও দেশে প্রাসাদ আছে। কাজেই এরকম অন্দরমহলও আছে। সেটাও বা এর চেয়ে কম কি। হঠাৎ মারিয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। ওদের প্রাসাদের কথা মনে পড়ল। ফ্রান্সিসদের সাজানো গোছানো বাড়ির কথা মনে পড়ল। চোখে জল এলো। মারিয়া সঙ্গে সঙ্গে হাত দিয়ে চোখ মুছল। এসব বেশি ভাবলে মন খারাপ হবে। ফ্রান্সিসও এটা পছন্দ করে না।

কিছু পরে পরিচারিকাটি ফিরে এলো। বলল–চলুন রানিমা সাজঘরে আছেন।

কিছুটা এগিয়েই ডানদিকে একটা ঘর। দরজায় মোটা কাপড়ের পর্দা। সুচিত্রিত।

পর্দা সরিয়ে ঢুকল। দেখল একটা বেশ বড়ো ঘর। একটা খাট রয়েছে মাঝখানে। রানি খাটে বসে আছে। পরিচারিকারা রানিকে সাজাচ্ছে। রানির পরনে ঢোলা হাতা সাধারণ পোশাক। মারিয়া মনে মনে হাসল। দামি ভালো কাপড়টা এখনও পরানো হয়নি। গয়নাগাটিও এখনও পরানো হয়নি।

রানি মারিয়াকে দেখে বলল–তুমি তো মারিয়া?

–হ্যাঁ। মারিয়া মাথা কাত করে বলল।

–এখানেই বসো। রানি বলল।

মারিয়া খাটে বসল। রানি বলল–ভালো হয়ে বসো। মারিয়া বলল–ঠিক আছে।

–আর বলো কেন। মাঝে মাঝেই মন্ত্রী সেনাপতি বড়ো বড়ো ব্যবসাদারের বাড়িতে নাচগানের আসর বসে। যেতে হয়। আচ্ছা–তোমরা তো শুনলাম পশ্চিম য়ুরোপের অধিবাসী। তোমরা তো ভালো সাজস জানো। রানি বলল।

–ঐ আর কি। মারিয়া হেসে বলল।

দ্যাখো তো আমার মুখের সাজ ঠিক আছে? রানি বলল।

মারিয়া রানির মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল। তারপর বলল–আপনার ভুরুর একটু মোটা হয়ে গেছে।

রানি সামনে বসা পরিচারিকাকে বলল–ভুরুটা ঠিক করে দে। পরিচারিকা ভুরুর ধারগুলো মুছে মুছে সরু করল। রানির সামনে আয়না ধরা হল। নিজের মুখ দেখে রানি মহা খুশি।

–মারিয়া তুমি এখানেই থাকো। আমাকে সুন্দরভাবে সাজিয়ে দেবে। রানি বলল।

–মাননীয়া রানি–তা হয় না। আমার স্বামী কয়েদ খাটছে। মারিয়া বলল।

–হুঁ। একটু সমস্যা। যাহোক আমি তোমার স্বামীর শাস্তিমুকুব করিয়ে দেবো। রানি বলল।

–না। আমি কয়েদঘরে থাকবো। মারিয়া বলল।

–মারিয়া কিছুতেই ভুলতে পারছে না। এই রানির রাজসভায় বলেছিল ঠিক শাস্তি হয়েছে। একটা বিতৃষ্ণায় মন ভরে উঠল। দয়ামায়া বলে কোনো বোধই এই রানির নেই। তাকে সাজগোজ করাতে আমি আসবো কেন। এই রানির সঙ্গে কী সম্পর্ক আমাদের?

–তাহলে তুমি এখানে থাকবে না? রানি একটু রেগেই বলল।

–না। আপনিই তো রাজদরবারে আমাদের গুপ্তচর বলাকে সমর্থন করেছিলেন। আপনি অনায়াসে পারতেন আমাদের যে অন্যায় শাস্তি রাজা দিয়েছিলেন সেটা মুকুব করাতে। মারিয়া বলল।

এবার মুকব করাবো। তবে দু’এক বছর না গেলে পারবো না। রানি বলল।

–ততদিন তো আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। মারিয়া বলল।

–তা তো হবে। রানি বলল।

–আমার স্বামী ঐকয়েদঘরেই থাকবেন বলেছেন। তবে যাবজ্জীবন নয়। মারিয়া বলল।

–তাহলে কী করবে? রানি বলল।

–পালাবে। মারিয়া বলল।

–পালাবে? রানি বলল।

অনায়াসে। মারিয়া বলল।

–আমাদের কত কারারক্ষী আছে জানেন? কারা অধ্যক্ষও আছে। রানি বলল।

আপনাদের যত কারারক্ষীই থাকুক আমার স্বামীকে বন্দী করে রাখতে পারবে না। মারিয়া বলল।

–তাহলে তো আর দেরি করা কেন? কাল পরশুই পালিয়ে যাক। রানি বলল।

–সেটা অনায়াসেই পারতো তার বুদ্ধি দিয়ে। কিন্তু সমস্যা হলাম আমি। আমাকে রেখে পালিয়ে যেতে তো পারবে না। মারিয়া বলল।

যাক গে–ওসব কথা। তুমি কয়েদঘরেই থাকো। দরকার পড়লে তোমাকে ডাকবো। রানি বলল।

–বেশ। মারিয়া বলল।

রানি তখন একজন পরিচারিকাকে ডাকল। বলল–যা সদর দরজায় একজন প্রহরীকে গিয়ে বল, ও যেন একে কয়েদঘরের কারাঅধ্যক্ষের কাছে নিয়ে যায়। যা

পরিচারিকা চলে গেল।

রাজকন্যা বলে তোমার একটু গোপন গর্ব আছে। রানি বলল।

না আমি রাজকন্যা বলেন। ফ্রান্সিসের মত স্বামী পেয়েছি বলে আমি গর্বিত। মারিয়া বলল। পরিচারিকা এলো। বলল রানিমা প্রহরীকে বলেছি। এখন এই রাজকুমারীকে নিয়ে যেতে হবে।

-বেশ। নিয়ে যা। একটু থেমে রানি বলল–আমাকে সাজগোজ করানোর কাজটা এ বোধহয় অপমানজনক মনে হয়েছে তোমার। রানি বলল।

না। ইচ্ছে হলে আমি প্রায় সব কাজই নিজের কাজ বলে মনে করি। মারিয়া বলল।

—ঠিক আছে ঠিক আছে। ডাকলে এসো। রানি বলল।

–আমি এখন ঠিক করতে পারিনি–আসবো কি আসবো না। মারিয়া বলল।

ভেবে দেখো। রানি বলল।

মারিয়া পরিচারিকার সঙ্গে অন্দরমহল থেকে বেরিয়ে এলো। প্রহরীটিকে ডেকে পরিচারিকা চলে গেল। প্রহরী এগিয়ে এলো। বলল-চলুন।

তখন রাত হয়েছে। সদর রাস্তায় লোকজনের ভিড়। বেশঠাণ্ডাবাতাস বইছে। কয়েদঘরে সারাদিন গরমেরমধ্যে কাটিয়ে মারিয়ার বাতাসটাভালোলাগল। বাইরে আলো দোকানপাটও ভালো লাগল। আর কোনোদিন মুক্তি পাবে কিনা। মারিয়া আকাশের দিকে তাকাল। ভাঙা চাঁদ। লক্ষ্য তারার ভিড়। এত সুন্দর পৃথিবী আর এক অন্ধ কুঠুরিতে আমরা পড়ে আছি। অল্পক্ষণের জন্যে হলেও আমি তো বাইরে আসতে পারলাম। ফ্রান্সিস অন্ধ কূপেই রইল। এসব ভাবতে গিয়ে মারিয়ার চোখে জল এলো। মারিয়া হাত দিয়ে চোখ মুছল।

কয়েদখানায় পৌঁছে দিয়ে প্রহরীটি চলে গেল। মারিয়া ঢুকতেই কারাঅধ্যক্ষ তার ঘর থেকে ছুটে এলো। হেঁ হেঁ করে হেসে বলল-রাজকুমারী–রানিমা কী বললেন।

–তেমন কিছু নয়। মারিয়া বলল।

–তবু? কারাঅধ্যক্ষ বলল।

মারিয়া চুপ করে রইল।

–বলুন না। আমার বিরুদ্ধে কিছু বলেন নি তো? কারাঅধ্যক্ষ বলল।

–উনি কি আপনাকে চেনেন? মারিয়া বলল।

–না–তা চেনেন না। কারাঅধ্যক্ষ বলল।

—তা হলে আর আপনার ভয় কিসের। মারিয়া বলল।

-হ্যাঁ–তাই তো। অধ্যক্ষ হেসে বলল।

ঐ লোকটার সঙ্গে কথা বলতে মারিয়ার বিশ্রী লাগছিল। কয়েদঘরের দরজা খোলা হল। মারিয়া ঢুকল। ফ্রান্সিস শুয়েছিল। উঠে বসল। মারিয়া বসল।

–কী ব্যাপার বলো তো? ফ্রান্সিস জিজ্ঞেস করল।

মারিয়া আস্তে আস্তে সব কথা বলল। ফ্রান্সিস বলল–এতো অদ্ভুত ব্যাপার। সাজসজ্জা করাবার জন্যে তোমাকে যেতে বলেছে!

–আসলে এদেশীয় মেয়েরা তো সাজগোজের ব্যাপারটা বোঝে না। এমন করে রানির ভুরুতে কালো রং করেছে যেন দুটো মোটা জোঁক আটকে আছে। মারিয়া বলল।

–হুঁ। মজার ব্যাপার। ফ্রান্সিস হেসে বলল।

–আসলে রানি চান যুরোপের মেয়েরা যারা নতুন নতুন সাজসজ্জা করতে পারে তাদেরই সে চায়।

–তাহলে কী করবে? ফ্রান্সিস বলল।

–যেদিন নাচ বা গানের আসরে রানিকে যেতে হবে সেদিন লোক পাঠিয়ে আমাকে নিয়ে যাবেন। মারিয়া বলল।

–তুমি সেদিন যাবে? ফ্রান্সিস বলল।

হ্যাঁ। যাবো। রানি কথায় কথায় একটা কথা বলেছে যে দু’এক বছরের মধ্যে আমাদের মুক্তির ব্যবস্থা করবে। মারিয়া বলল।

–আমরা তার অনেক আগেই পালাবো। একটু থেমে ফ্রান্সিস বলল–মারিয়া একটা কথা ভাবছি।

–কী কথা? মারিয়া বলল।

তুমি রাজবাড়িতেই রানির মহলে থাকো। ফ্রান্সিস বলল।

–রানির মহলে থাকবো? এখানে থাকলে অসুবিধেটা কোথায়? মারিয়া বলল।

–মারিয়া–তোমার শরীরটা বড়ো খারাপ হয়ে গেছে। এসব কয়েদখানা তোমার থাকার জায়গা না। ফ্রান্সিস বলল।

না–আমি তোমার সঙ্গেই থাকবো। মারিয়া বলল।

ফ্রান্সিস মাথা নেড়ে বলল–অবুঝ হয়ো না মারিয়া। আমাদের তো আয়না দেখার সুযোগ নেই কাজেই তোমার শরীর কতটা খারাপ হয়েছে জানোনা। বুঝতেও পারছো না। ফ্রান্সিস বলল।

–তুমি এখানে একা থাকবে? মারিয়া বলল।

–হ্যাঁ একাই থাকবো। তাতে আমার পালাবার সুবিধে হবে। ফ্রান্সিস বলল।

–বেশ। তাহলে কালকেই রানিকে খবর পাঠাবো যে আমি দেখা করতে চাই। মারিয়া বলল।

–হ্যাঁ। কালকেই দেখা করো। ফ্রান্সিস বলল।

গভীর রাত পর্যন্ত ফ্রান্সিস ঘুমোতে পারল না। বোধহয় মারিয়াও ঘুমোয় নি।

এক সময়ে দুজনেই ঘুমিয়ে পড়ল।

সকালের খাবার খেয়ে মারিয়া একজন প্রহরীকে কারার অধ্যক্ষের কাছে পাঠাল। বলল-বলো তো–আমি রানির সঙ্গে কথা বলতে যাবো। প্রহরীটি চলে গেল।

একটু পরেই কারা অধ্যক্ষমশাই প্রায় ছুটতে ছুটতে এলো। বলল কী ব্যাপার? কী ব্যাপার?

ব্যাপার তেমন কিছু নয়। আমি রানির সঙ্গে দেখা করবো। আপনি কোনো প্রহরীকে আমার সঙ্গে পাঠান। মারিয়া বলল।

নিশ্চয়ই নিই। কিন্তু আমার একটা কথা ছিল। কারাঅধ্যক্ষ বলল।

কী কথা। কারাঅধ্যক্ষ বলল। রানি যদি জানতে চান আমি কারাঅধ্যক্ষের কাজ কেমন করছি তাহলে অবশ্যই আমার কাজের প্রশংসা করবেন।

–আপনি মিছি মিছি ভয় পাচ্ছেন। মারিয়া বলল।

না–না। আমার কথা উঠলে অবশ্যই বলবেন। কারাঅধ্যক্ষ বলল।

–ঠিক আছে, বলবো। এখন কোনো প্রহরীকে পাঠান। মারিয়া বলল।

–আমি এক্ষুণি পাঠাচ্ছি। কারাঅধ্যক্ষ বলল। তারপর হাততালি দিয়ে একজন প্রহরীকে ডাকল। প্রহরীটি এলো।

–তুমি রাজবাড়ি যাও। অন্দরমহলে কোনো পরিচারিকাকে দিয়ে রানিকে বল যে বন্দিনী ভাইকিং রাজকুমারী রানির সঙ্গে দেখা করতে চান। যাও কারা অধ্যক্ষ বলল।

প্রহরীটি রাজবাড়ি গেল। ওখানকার এক প্রহরীকে বলল

–ভাই রানিকে একটা খবর পাঠাও।

–কী খবর?

–বল যে কয়েদঘরে বন্দিনী রাজকুমারী রানির সঙ্গে দেখা করতে চান।

–বেশ। প্রহরীটি চলে গেল।

কিছু পরে প্রহরটি ফিরে এলো। বলল রানিমা রাজকুমারীকে দেখা করবার অনুমতি দিয়েছেন।

তখন বেলা পড়ে এসেছে। একজন পরিচারিকা এলো। কারাঅধ্যক্ষ পরিচারিকাকে দেখে আসন থেকে লাফিয়ে উঠল। বলল–রানিমা কি আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন?

না। রাজকুমারীকে নিয়ে যেতে বলেছেন।

–ও। তাহলে আমার কথা কিছু বলেনি। পরিচারিকাটি বলল–না।

–ও। কারাঅধ্যক্ষ নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। ফ্রান্সিসদের ঘরের সামনে এলো। একজন প্রহরীকে ইঙ্গিতে বোঝাল দরজা খুলে দাও।

প্রহরীটি দরজা খুলে দিল। মারিয়া দরজার কাছে এসে পিছু ফিরে ফ্রান্সিসকে বলল তুমি দুশ্চিন্তা করো না। আমি ভালোই থাকবো।

পরিচারিকার সঙ্গে মারিয়া কারাকক্ষ থেকে বেরিয়ে এলো।

এবার ফ্রান্সিস পালাবার পরিকল্পনা করতে বসল। শুকনো ঘাসের বিছানায় শুয়ে পড়ল। রানি মারিয়াকে অন্তঃপুরে থাকতে বলবেন কিনা তার ঠিক নেই। দেখা যাক রানি কী করেন?মারিয়াকেমহলে থাকতে বলবেন না কয়েদঘরে ফেরৎ পাঠান। আজকের রাতটা থাক। কালকে রাতে খাওয়ার পর পালাবো।

রাতটা কাটল। ফ্রান্সিস ভালো করে বুঝতে পারেনি। অনেক চিন্তা মাথায়। হ্যারিরা কোথায় আছে? ওরা কি রাজা অপৰ্তোর রজ্যেই থেকে গেছে না এই ভিগোনগরে এসেছে। একটা স্বস্তি–হ্যারিরা কেউ এখানে কয়েদঘরে বন্দী হয়ে নেই। ওরা মুক্ত।

সন্ধের কিছু পরেই ফ্রান্সিস একজন প্রহরীকে ডাকল। বলল, আমাকে একটু তাড়াতাড়ি যেতে দেবে। প্রহরীটি একটু রসিকতা করে বলল–কেন? কেন নাচগানের আসরে যাবেন।

না আমি কয়েদঘরের বাইরে যাবো। ফ্রান্সিস বলল।

–পারবেন এখান থেকে বেরুতে? প্রহরীটা বলল।

–অনায়াসে। আমার ছক ভাবা হয়ে গেছে। এখন কাজে নামা। ফ্রান্সিস বলল।

ফ্রান্সিস বিছানায় শুয়ে পড়ল, পালানো আর তার পরের কাজগুলো ভাবতে লাগল। সবচেয়ে মুশকিল হবে মারিয়াকে অন্দরমহল থেকে বাইরে নিয়ে আসা। তার জন্যে কী করতে হবে সেসব ভাবতে লাগল।

ঢং ঢং-প্রহরী দরজা খুলে খাবার আনল। দরজাটা আধ ভেজানো। ফ্রান্সিস আর চোখে দেখল–দুজন ঘরে ঢুকছে দুজন ঘরের বাইরে পাহারা দিচ্ছে।

হঠাৎফ্রান্সিস দ্রুত উঠে দাঁড়িয়েই মাটির ভাড় রাখা তরকারি ঝোলটা একজন প্রহরীর মুখে চোখে ছিটিয়ে দিল। প্রহরীটি মেঝেয় পড়ে গেল। এবার যে প্রহরীটা কাটা রুটি কাঠের খালায় নিয়ে আসছিল সেই থালাটা তুলে ফ্রান্সিস প্রহরীর চোখ মুখে চাপা দিল। প্রহরীটি বসে পড়ল। তার কোমরে গুঁজে রাখা তলোয়ারটা ফ্রান্সিস এক টানে তুলে নিল। ছুটল বাইরে দিকে। বাইরে এসে দেখল-আরো দুজন প্রহরী খোলা তলোয়ার হাতে পাহারা দিচ্ছে।

ফ্রান্সিস ছুটে এসে একজন প্রহরীর খোলা তলোয়ারে এত জোরে তলোয়ার চালাল যে-তলোয়ার ছিটকে গেল।

ইতিমধ্যে ভেতরের প্রহরীর কয়েকজন ছুটে আসতে লাগল।

ফ্রান্সিস আর দাঁড়াল না। এক ছুটে রাস্তায় ওপাশে গেল। তারপর এক লাফ দিয়ে নর্দমাটা পার হল। তারপর ঝোপ জঙ্গলে ঢুকে পড়ল। ফ্রান্সিস এত দ্রুত কাজ সারল প্রহরীরা বোকা বনে গেল। ওরা তৈরি হওয়ার কোনো সুযোগই পেল না। সেই নর্দমা লাফিয়ে পার হল কয়েকজন প্রহরী। জংলা ঝোঁপের মধ্য দিয়ে আস্তে আস্তে কাটা গাছ সরিয়ে যেতে লাগল। ততক্ষণে ফ্রান্সিস ঝোপজঙ্গল পেরিয়ে বিস্তীর্ণ এক ঘাসে-ঢাকা প্রান্তর দিয়ে ছুটল। লক্ষ্য-রাজবাড়ি। তলোয়ারটা ফেলে দিল না। কোমরে গুঁজে রাখল। আজকে চাঁদের আলো অনেকটা উজ্জ্বল। চারপাশে সবই ভালো দেখা যাচ্ছে।

ফ্রান্সিস ছুটে চলল। একটু খুঁজতেই হল। পেয়ে গেল রাজবাড়ি।

রাজবাড়ির প্রধান প্রবেশদ্বারে এলো। দূর থেকে দেখল প্রবেশদ্বারের মাথায় অনেকগুলো মশাল জ্বলছে। প্রায় আট-দশজন সশস্ত্র প্রহরী রাজবাড়ি পাহারা দিচ্ছে।

ফ্রান্সিস বুঝল এখান দিয়ে রাজবাড়িতে ঢোকা অসম্ভব।

ফ্রান্সিস পেছন দিকে চলল। কয়েকটা ফুলবাগান আর ফোয়ারার পরে রাজবাড়ির দেওয়াল। দেওয়াল খুব উঁচু নয়। দেওয়ালে ওঠা যাবে। রাজবাড়িতে ঢোকাও যাবে।

দেওয়ালে একটা কাঠের দরজা। তার মানে এদিক দিয়ে রাজবাড়ির অন্দরমহলে যাওয়া যায়। ফ্রান্সিস বুঝল দেওয়াল টপকে ভেতরে যেতে হবে। তারপরমারিয়াকে খোঁজা।

ফ্রান্সিস দরজার কাছে এসে দাঁড়াল। কাঠের দরজার গায়ে চ্যাপ্টা লোহার দণ্ড। ফ্রান্সিস দরজার ওপরের দিকে তাকাল সহজেই ওঠা যাবে।

এবার ফ্রান্সিস লোহার চ্যাপ্টা দণ্ডগুলোর ওপর পা রেখে রেখে দরজার মাথায় উঠে এলো। তারপর দরজার ওপাশে লোহার চ্যাপ্টা দণ্ডগুলোর ওপর পা রেখে রেখে নীচে চলে এলো। একটু হাঁপচ্ছিল ফ্রান্সিস। দরজাটায় ভিতর থেকে তালা লাগানো। চাবিটা তালাটার ফুটোয় লাগানো। ফ্রান্সিস তালাটা খুলে ফেলল।

এবার চলল অন্দরমহলের দিকে। দেখল প্রথম দরজাটা কাঠের। ফ্রান্সিস দরজাটা ধরে আস্তে টানল কয়েকবার। এবার ভেতর থেকে তালা লাগানো।

ফ্রান্সিস এপাশ-ওপাশ তাকিয়ে দেখল বেশ কটা জানালা আছে। একটা জানালার কাছে এলো। জানালায় লোহার কাজ করা। জানালাটা কাঠের। ফ্রান্সিস জানালাটা ধরে আস্তে চাপ দিয়ে নিজের দিকে টানল। জানালার পাল্লা খুলে গেল। আর কোনো বাধা নেই। ফ্রান্সিস জানালার ভোলা পাল্লা ধরে এক লাফে জানালাটায় উঠল। তারপর পা বাড়িয়ে নিঃশব্দে ঘরটায় নামল। মোমের আলোয় দেখল–রাজবাড়ির পরিচারিকারা ঘুমিয়ে আছে।

যাতে কোনো শব্দ না হয় ওদের ঘুম না ভাঙে ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে ঘরটা পার হল। দরজার কাছে এলো। পরিচারিকাদের সঙ্গে এখানে মারিয়া থাকবে না, নিশ্চয়ই মারিয়াকে আলাদা ঘর দেওয়া হয়েছে।

দরজা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখল বাঁদিকে টানা বারান্দার মতো চলে গেছে। দুদিকে পরপর ঘর।

ফ্রান্সিস পরের ঘরটায় ঢুকল আরো কয়েকজন পরিচাকি ঘুমিয়ে আছে। মারিয়া এখানে নেই।

এবার অন্য ঘরটায় ঢুকল। পরিপাটি সাজানো গোছানো ঘর। মাঝখানে একটা অবশ্য বড়ো খাট। দেখল রানি ঘুমিয়ে আছে। বাতাসে সুগন্ধ। একটা কাঁচটকা মৃদু আলো। ঘরটা শুধু রানিরই।

পরের ঘরটা দেখল–বেশ সাজানো গোছানো। কাঁচে ঢাকা আলো জ্বলছে। রানির সহচরীদের সঙ্গে মারিয়া ঘুমিয়ে আছে।

ফ্রান্সিস এতক্ষণে স্বস্তির শ্বাস ছাড়ল।

ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে পা ফেলে মারিয়ার কাছে এলো। আস্তে কাঁধে ধাক্কা দিল। মারিয়া সঙ্গে সঙ্গে তাকাল। অল্প আলোয় ফ্রান্সিসকে দেখল। দ্রুত উঠে বসল। ফ্রান্সিস ইঙ্গিতে দরজাটা দেখাল। মারিয়া উঠে দাঁড়াল। পোশাক গুছিয়ে ফ্রান্সিসের হাত ধরল। দুজনে আস্তে আস্তে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।

এবার মারিয়াই পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল।

রাজবাড়ির পেছনের দরাজাটার কাছে এলো। দরজায় তালা ঝুলছে। মারিয়া তাড়াতাড়ি পাশে রাখা একটা কাঠের বাক্সে হাতে ঢুকিয়ে খুঁজে বলল–চাবিটা নেই। কয়েকদিন আগেদুজন পরিচারিকা রাতে এই দরজা খুলে পালিয়েছে। তাই এত কড়াকড়ি।

–ঠিক আছে। দেওয়াল ডিঙিয়ে যাব। এসো।

ফ্রান্সিস নিচু হয়ে দুটো হাত বাড়িয়ে বলল হাত দুটোয় দু’পা রাখো। মারিয়া কোনোরকমে দুটো হাতে পা রাখল। ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে তুলতে লাগল। বলল-দরজাটায় ভর রাখো।

একটু পরেই মারিয়া দরজার ওপরে উঠে এলো। এবার ফ্রান্সিস দরজায় পা রেখে দরজার ওপরে উঠল। তারপরে অনুজ্জ্বল জোৎস্নায় দেখল দরজার গায়ে চ্যাপ্টা লোহা লাগানো। ফ্রান্সিস বলল–ওগুলোর ওপর পা দিয়ে নেমে আসবে। আমি দাঁড়াচ্ছি।

ফ্রান্সিস নামল। এবার দু হাত বাড়িয়ে বলল-নেমে এসো। মারিয়া পা রেখে নামল কিছুটা। তারপরেই নামতে গিয়ে পা পিছলে গেল। মারিয়া পড়ে যাচ্ছিল। ফ্রান্সিস নীচে থেকে ওকে দুহাতে জড়িয়ে ধরল। মারিয়া আস্তে অস্তে নেমে এলো।

দুজনে নেমেই ছুটল। রাজার বাড়ির এলাকা থেকে সদর রাস্তায় এসে উঠল।

এবার ফ্রান্সিস দাঁড়িয়ে পড়ল। দুজনেই হাঁপাচ্ছেতখন। ফ্রান্সিস বলল–এখন দৌড়ে • যাওয়া ঠিক নয়। একে তো আমরা বিদেশি তার ওপর দৌড়ে যাচ্ছি দেখলে যে কারো সন্দেহ হবে। আমরা বিপদে পড়বো। অর্থাৎ আবার কয়েদঘর।

এবার দুজনে হটাতে লাগল জাহাজঘাটার দিকে।

একটু পরে পুব আকাশে থালার মতো কমলা রঙের সূর্য উঠল। চারদিকে আলো ছড়াল।

ফ্রান্সিস দূর থেকে দেখল কয়েদখানার দুই রক্ষী আসছে। ও সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে দাঁড়াল। চাপাস্বরে বলল–তুমি আমার কাছে থেকে সরে যাও। দুই রক্ষী।

মারিয়া সঙ্গে সঙ্গে সরে গেল। কিন্তু ফ্রান্সিসরা ধরা পড়ে গেল। সৈন্য দুজন ছুটতে ছুটতে এলো৷ ফ্রান্সিস বুঝতে পারলো পালানো যাবেনা। ও দাঁড়িয়ে পড়ল। নিজে পালাতে পারতো। তাহলে মারিয়াকে ধরতো ওরা। তাহলে ফ্রান্সিস দারুণ সমস্যায় পড়তো।

রক্ষী দুজন ফ্রান্সিস আর মারিয়ার কাছে এলো। একজন রক্ষী হাঁপাতে হাঁপাতে বলল–তোমরা দুজন কয়েদ খাটছিলে।

–হ্যাঁ। তাতে কী হল? ফ্রান্সিস বলল।

–তোমরা পালিয়েছিলে। রক্ষী বলল।

–আমি পালাই নি। রানি আমাকেঅন্দরমহলে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। মারিয়া বলল।

–বেশ। কিন্তু তুমি? রক্ষী ফ্রান্সিসের দিকে তাকিয়ে বলল।

–হ্যাঁ আমি পালিয়েছিলাম। ফ্রান্সিস বলল।

–কেন পালিয়েছিলে? রক্ষী বলল।

–সে তুমি বুঝবে না। ফ্রান্সিস বলল।

–যাগ গে–তোমরা দুজনেই কয়েদখানায় চলো। একজন রক্ষী বলল।

–আমরা যাবো না। ফ্রান্সিস বলল।

–তহালে তলোয়ারের ঘা খেয়ে মরবে। অন্য রক্ষীটি বলল।

–ঠিক আছে তলোয়ার চালাও। ফ্রান্সিস বলল।

দুজন রক্ষী তলোয়ার কোষমুক্ত করল।

ফ্রান্সিস তলোয়ার খুলে মারিয়ার হাতে দিল। মৃদুস্বরে বলল–আজকে তোমার পরীক্ষা। মারিয়া ঘাবড়াল না। তলোয়ারটা ভালো করে ধরে রুখে দাঁড়াল।

একজন সৈন্য বলল–এ তো মেয়ে। এর সঙ্গে লড়াই করতে গেলে ও তো মরে যাবে।

-কথা রাখো। তলোয়ার চালাও। মারিয়া বলল। রক্ষী তলোয়ার নিয়ে মারিয়াকে আক্রমণ করল। মারিয়া মার ঠেকাল। তারপর নিজে তলোয়ার চালাল। রক্ষীটা ঠেকালে শুরু হল লড়াই। ফ্রান্সিস লক্ষ্য রাখল মারিয়া যাতে আহত না হয়। লড়াই জমে উঠল। রক্ষীটি কিছুতেই মারিয়াকে হারাতে পারছে না। তলোয়ারের ঘায়ে মারিয়ার কাঁধের জামা কেটে গেছে। কিন্তু মারিয়া ভ্রূক্ষেপ করল না। তলোয়ার চালাতে লাগল।

ফ্রান্সিস চড়া গলায় বলে উঠল–এবার থামো। রক্ষীটি আর মারিয়া দুজনেই লড়াই থামাল। দুজনেইহাঁপাতে লাগল। ফ্রান্সিস বলল–একজন মেয়েকে তুমি হারাতে পারলে না। আমার সঙ্গে কী লড়বে?

অন্য রক্ষীটি এবার ফ্রান্সিসের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্যত হল। ফ্রান্সিস দ্রুত মারিয়ার হাত থেকে তলোয়ারটা নিল। শুরু হল ফ্রান্সিসের সঙ্গে ঐ রক্ষীটির লড়াই।

এই সকালেও ফ্রান্সিসদের ঘিরে মানুষের জটলা হল। চলল লড়াই। রক্ষীটি একটু পরেই বুঝতে পারল কার পাল্লায় পড়েছে। ফ্রান্সিস ঠিকই করেছিল সৈন্যটির শরীরে আঘাত করবে না। ওর দম ফুরিয়ে দেবে। সৈন্যটি আর তলোয়ারই তুলতে পারবে না। কিছুক্ষণ পরে তাই হল। সৈন্যটি মুখ হাঁ করে হাঁপাতে লাগল। ফ্রান্সিস ওর বর্মের চামড়ার ফিতে কেটে দিল। বর্ম খুলে পড়ল। সৈন্যটি দাঁড়িয়ে পড়ল।

–আর লড়াইয়ের ইচ্ছে আছে? ফ্রান্সিস হাঁপাতে হাঁপাতে বলল। সৈন্যটি কিছু বলল না। মুখ নিচু করে হাঁপাতে লাগল।

ফ্রান্সিস কোমরে তলোয়ার খুঁজতে খুঁজতে বলল–এখন এখান থেকে চলে যাও। আমরা তোমাদের বা তোমাদের দেশের কোনো ক্ষতি করিনি। করবোও না। আমরা কিছুক্ষণ পরেই জাহাজ ছাড়বো। তাহলে তোমরা আবার কেন আমাদের বন্দী করতে চাইছো। বিনা দোষে আমাদের কেন কয়েদ করা হবে?যাকগে–তোমরা কারা অধ্যক্ষকে গিয়ে বলো আমরা এদেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছি। মিছিমিছি রক্তপাত আমি চাই না। তোমার বন্ধুটিকে অনায়াসে মেরে ফেলতে পারতাম কিন্তু আমি মারিনি।

ফ্রান্সিস মারিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল-চলো।

দুজনে জাহাজ ঘাটের দিকে চলল। রক্ষী দুজন আস্তে আস্তে হাঁটতে হাঁটতে ফিরে গেল।

জাহাজঘাটায় এলো। দেখল যেখানে ওদের জাহাজটা নোঙর করে রেখে গিয়েছিল সেখানেই আছে। চুরি হয়ে যায় নি। ভাগ্য ভালো বলতে হবে।

দুজন পাতা পাটাতন দিয়ে হেঁটে গিয়ে জাহাজে উঠল। কোনো লোককে দেখল না। নীচে কেবিনঘরেফ্রান্সিসরা ঢুকল। দেখল কে একজন বিছানায় শুয়ে রয়েছে। বোধহয় ঘুমিয়ে আছে।

ফ্রান্সিস কিছু বলল না। অন্য ঘরগুলোতে দেখল আরো তিনজন বিছানায় শুয়ে ঘুমোচ্ছে। ফ্রান্সিস প্রথম ঘরটায় এলো। তলোয়ার খুলল। লোকটার বুকের ওপর দিয়ে তলোয়ার চেপে টেনে নিল। জামা কেটে দো-ফাল ও লাফিয়ে উঠে বসল। কাটা জায়গা থেকে রক্ত পড়তে লাগল। লোকটা বলল–তুমি আমার জামা কেটে দিলে কেন?

–শুধু জামা কেটেছি। এবার পালাও। নইলে এবার বুকে তলোয়ার বসাবো। লোকটা একটু ভয় পেলেও বেশ চেঁচিয়ে বলল–এই জাহাজ আমাদের।

–আমাদের মানে? ফ্রান্সিস বলল।

–অন্য ঘরে আমার দুই বন্ধু আছে।

–ও। হা হা, দেখলাম ওদের। সত্যি–ওদেরও তো দেখতে হয়। ফ্রান্সিস বলল। তারপর চলল অন্য দুটোর কাছে।

ঘরটায় ঢুকে দেখল–একজন হাই তুলে উঠে বসল। লোকটারনাকে জরুল। অন্যজন ঘুমে তখনও শুয়ে।

ফ্রান্সিস দেখে যে হাই তুলছিল সেই লোকটিকে বলল–তুমি কে হে? আমাদের জাহাজে উঠেছে?

–সত্যি–অন্যায় হয়ে গেছে। তা আপনাদের রাতে ভালো ঘুম হয়েছিল তো? ফ্রান্সিস বলল।

–হ্যাঁ-হ্যাঁ। লোকটি হেসে বলল।

কোনো অসুবিধে হয়নি তো? ফ্রান্সিস বলল।

–তুমি কে হে? এত কথা জনতে চাইছো? জড়ুলওয়ালা বলল।

আমি যে এই জাহাজের মালিক। ফ্রান্সিস বলল।

–এ্যা? লোকটা বিছানা থেকে নেমে দাঁড়াল। তারপর বলল-বাঃ! আমরা কত স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে কিনলাম সেই জাহাজ তোমার হয়ে গেল? জডুলওয়ালা বলল।

–বিক্রি করেছিল কে? ফ্রান্সিস বলল।

সুলেমান। ঐ যে মোড় ওখানে বিরাট দোকান সুলেমানের। একজন বলল।

–আচ্ছা–দেখছি। তোমরা উঠে রাস্তায় এসো। ফ্রান্সিস বলল।

যে লোকটা ঘুমোচ্ছিল, সে ততক্ষণে উঠে পড়েছে। ফ্রান্সিসদের কথাবার্তা শুনছে।

এবার চলো। ফ্রান্সিস বলল।

–কোথায় যাবো? ঘুম ভেঙে ওঠা লোকটা বলল।

সুলেমানের কাছে। ফ্রান্সিস বলল।

সুলেমানের কাছে যাবো কেন? লোকটি বলল।

-তোমরা ঐ সুলেমানের সামনে গিয়ে বলবে যে সুলেমানের কাছ থেকে তোমরা জাহাজটা কিনেছো। ফ্রান্সিস বলল।

–আমরা যাব না। আমরা এই জাহাজেই থাকবো। জডুল বলল।

ফ্রান্সিস বলল –ঠিক আছে। তোমরা এসো আমি বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। যদি সুলেনানের কাছে তোমার না যাও তাহলে এই যে তলোয়ারটা দেখছো তাই দিয়ে তিন বন্ধুর গলা কাটবো।

ফ্রান্সিস আর মারিয়া বাইরে এল। ফ্রান্সিস বলল–মারিয়া তুমি জাহাজেই থাকো।

-না-না। সুলেমানকে কী করে সামলাও তা দেখবো।

–বেশ চলো।

দুজনে তীরে উঠল। তিনজনের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল।

কিছুক্ষণ পরে তিন বন্ধু এল। সবাই চলল মোড়ের দিকে।

সুলেমানের বিরাট দোকানের সামনে এল। ফ্রান্সিস বলল– চলো সুলেমানকে দেখিয়ে দাও। একজন এগিয়ে গেল। ফ্রান্সিসও চলল। লোকটা পেছনে একটা টেবিলের কাছে গেল। টেবিলের ওপর ছোট কার্পেট। তার ওপর বসে আছে এক মধ্যবয়স্ক লোক। খুব ফর্সা সুলেমান। থুতনিতে অল্প দাড়ি। চোখে ধূর্ত দৃষ্টি। লোকটি ফ্রান্সিসকে বলল–

–ইনিই সুলেমান।

ফ্রান্সিস এগিয়ে এল। বলল –আপনি জাহাজটা কার কাছ থেকে কিনেছেন?

–তা আমি আপনাকে বলবো কেন? সুলেমান বলল।

–আমি আবার ঐ জাহাজটা এদের কাছ থেকে কিনতে চাইছি। কত স্বর্ণমুদ্রায় কিনেছিলেন? ফ্রান্সিস বলল।

–কিনেছিলাম একজন সওদাগরের কাছ থেকে। তাকে তো এখন পাওয়া যাবে না। সুলেমান বলল।

–আপনি আদৌ জাহাজটা কেনেননি। মুফতে পেয়েছেন। মানে চুরি করেছেন ফ্রান্সিস বলল।

–কে বলল আমি চোর? সুলেমান টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়াল।

-আমি বলছি। যাক গে–এই যে তিনজন কিনেছে তাদের বলু জাহাজটা আপনার নয়। আর ওদের স্বর্ণমুদ্রাগুলো ফিরিয়ে দিন।

— বা– জাহাজটা আমার। সুলেমান বেশ গলা চড়িয়ে বলল।

ফ্রান্সিস এক লাফে এগিয়ে গিয়ে সুলেমানের গলা চেপে ধরল। সুলেমান এই হঠাৎ আক্রমণে মেঝেয় কার্পেটে পড়ে গেল। ফ্রান্সিস সুলেমানের গলায় চাপ দিল। বলল– বল্ ধোঁকাবাজ– ঐ জাহাজ তোর নয়।

-না। আমার জাহাজ। সুলেমান বলল।

ফ্রান্সিস গলায় চাপ বাড়াল। বলল –এখনও বল্ ঐ জাহাজের মালিক তুই না। ব– নইলে গলা টিপে মেরে ফেলবো। সুলেমানের গলা বুজে এল। ও হাঁসফাস করতে লাগল। ফ্রান্সিস বলল- এবার সত্যি কথাটা বল্।

— জাহাজটা আমার নয়।

–বল কী দেখে জাহাজটা নিয়েছিলি?

–কিছুদিন নজর রাখলাম। দেখলাম কেউ জাহাজটায় থাকে না। আমি নিয়ে নিলাম। সুলেমান বলল।

ফ্রান্সিস তিনজন লোকের দিকে তাকাল। বলল– এইবার তোমাদের বিশ্বাস হল? ফ্রান্সিস উঠে দাঁড়াল। সুলেমান তখনও গলায় হাত বুলোচ্ছে।

ফ্রান্সিস দোকান থেকে বেরিয়ে এল। বাইরে তখন বেশ ভিড় জমে গেছে। লোকেরা তখন সেই রক্ষী দুজনকে ডেকে নিয়ে এল। দুই কারারক্ষী ছুটে এল। ফ্রান্সিস আর মারিয়াকে দেখল। একজন রক্ষী বলল–তুমি যে বললে তোমরা চলে যাচ্ছো।

– জাহাজের মালিকানা নিয়ে গোলমাল করল এই সুলেমান। অগত্যা তাকে গলা টিপে ধরতে হল। তখন সত্যি কথাটা বলল। ফ্রান্সিস বলল।

রক্ষী দুজন আর কিছু বলল না। চলে গেল।

ফ্রান্সিস আর মারিয়া জাহাজে এল। দুজনে নিজেদের কেবিন ঘরে এল। সব এলোমেলো। মারিয়া বলল– সব ঘরের ধুলো ময়লা দূর করতে সময় লাগবে। আমি হাত লাগাচ্ছি। তুমি ততক্ষণ রসুইঘরে দেখে এসো খাবার জল আটা চিনি ময়দা সব আছে কিনা।

ফ্রান্সিস সব দেখেশুনে ফিরে এল কেবিনঘরে। দেখল মারিয়া একটা ঝাটা দিয়ে সব পরিষ্কার করছে।

–আটা-ময়দা চিনির মধ্যে চিনিটা বেশি আছে। কিন্তু আটা ময়দা সাফ। ফ্রান্সিস বলল।

–ভেবো না। আমার কাছে আছে। মারিয়া বলল। তার পরে কোমরবন্ধনীতে চেপে রাখা একটা চোট চামড়ার ব্যাগমতো বের করল। ওটা থেকে পাঁচটি স্মৃর্ণমুদ্রা বের করে ফ্রান্সিসকে দিল। ফ্রান্সিস বিছানায় বসেছিল। উঠতে যাবে তখনই বাইরে থেকে ডাক শুনল– ফ্রান্সিস? ফ্রান্সিস চমকে উঠল। বলল –মারিয়া এত হ্যারির গলা। এক লাফ দিয়ে ফ্রান্সিস দরজার কাছে এল। টান মেরে দরজা খুলে ফেলল।

দেখল ঘরের কাঠের দেওয়ালে দুহাত রেখে হাতে মুখ চেপেহ্যারি ফুঁপিয়ে কাঁদছে। ফ্রান্সিস কিছু বলার আগেই হ্যারি ফ্রান্সিসকে দুহাতে জড়িয়ে ধরল। কান্নায় হ্যারির শরীর ফুলে উঠতে লাগল।

ফ্রান্সিস হ্যারিকে ধরে ধরে ঘরের মধ্যে নিয়ে এল। বিছানায় বসিয়ে দিল।

মারিয়া বলল –হ্যারি– তোমরা কোথায় গিয়েছিলে? তোমাদের খুঁজে খুঁজেও কোন হদিশ পেলাম না। তারপর মারিয়া সব ঘটনা বলল। হ্যারি বলল –আমরাও তোমাদের খুঁজে বেড়িয়েছি।

–তুমি কি এই জাহাজটা দেখে ফ্রান্সিস এখানে আছে ভেবেছিলে।

— না। ফ্রান্সিসকে আমি আগেই দেখেছি। তখন ফ্রান্সিস একজন দোকানদারের গলা চেপে ধরেছিল।

— তখন তুমি ওখানেই ছিলে? ফ্রান্সিস বলল।

–হ্যাঁ। ফ্রান্সিসের কয়েক হাত পেছনে। তখন আমি মুখ চোখে কাপড় চাপা দিয়ে কেঁদেছি। তারপরে এখানে এলা। এবার বন্ধুদের খবর দিতে যাবো। হ্যারি বলল।

— তোমরা জাহাজ পেলে কোথায়? ফ্রান্সিস জিজ্ঞেস করল।

–এখানেই কিনেছি। রাজা অপৰ্তোর দেশে যাবো বলে। হ্যারি বলল।

— ঠিক আছে। বন্ধুদের খবর দাও। ফ্রান্সিস বলল।

– সবাইকে একসঙ্গে আসতে দেব না। এখানকার কয়েদঘর থেকে আমরা পালিয়েছিলাম। তাই একসঙ্গে এতজন বিদেশি–সকলেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। সৈন্যও হয়তো আসতে পারে।

–ঠিক আছে –তোমরা একজন দুজনকে পাঠাও। কথাবার্তা হবে। এইভাবে সকলের সঙ্গেই কথাবার্তা হবে। এখানে যতক্ষণ থাকবো আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।

হ্যারি চলে গেল। একটু পরেই হ্যারি আর শাঙ্কো ঢুকল। শাঙ্কো ছুটে এসে ফ্রান্সিসকে জড়িয়ে ধরল। চোখে জল।

–ফ্রান্সিস–তেমাদের দেখবারজন্যে বন্ধুদেরমধ্যেহুড়োহুড়শুরুহয়ে গেছে। শাঙ্কো বলল।

তারপর দফায় দফায় বন্ধুরা এল। ফ্রান্সিসদের দেখে খুশি।

সবাই ফ্রান্সিস আরমারিয়াকে দেখে গেল। হ্যাঁব্রিা নিজেদের ছোট জাহাজটায় চলে গেল।

সন্ধে হল। ফ্রান্সিস বলল-মারিয়া– ঐ জাহাজে যাচ্ছি।

– আমিও যাবো। মারিয়া বলল।

— পরে যেও ফ্রান্সিস বলল।

–না না। এই জাহাজে আমি একা পড়ে থাকবো?

— আমার ফিরে আসতে কতক্ষণ আর লাগবে। ফ্রান্সিস বলল।

ঠিক আছে –একাই যাও। মারিয়া বলল।

–এটা তো রাগের কথা হল। তুমি না বললে আমি যাই কী করে? ফ্রান্সিস বলল।

–না। আমি আর কিছু বলবো না। তুমি যাও। মারিয়া বলল।

ফ্রান্সিস হাসল। বলল –এই ভিগো নগরে থাকা আমাদের পক্ষে বিপজ্জনক।

-তুমি ঘুরে এসো। আমি পরে যাবো। মারিয়া বলল।

ফ্রান্সিস জাহাজের বাইরে এল। রাস্তা দিয়ে হেঁটে গিয়ে ছোটো জাহাজটার কাছে গেল। তারপর পাতা পাটাতন দিয়ে জাহাজে উঠল। হ্যারি একটা ছোটো কেবিন ঘরে ফ্রান্সিসকে নিয়ে এল। ফ্রান্সিস বলল –এখন একটা কাজের কথায় আসি। আমাদের জাহাজে আধবস্তা চিনি ছাড়া কিছু নেই। আটা ময়দা চিনিও কিনে আনতে হবে। আর দুজন যাও পিপে দুটোয় জল ভরে নিয়ে এসো।

ফ্রান্সিসের কথামত কয়েকজন ভাইকিং কাজে নেমে পড়ল।

ফ্রান্সিস হ্যারিদের বলল–দুটো জাহাজই একসঙ্গে ছাড়বোনা। প্রথমে বড় জাহাজটা ছাড়বো। তার এক ঘণ্টা পরে ছোট জাহাজটা ছাড়বো। গভীর সমুদ্রে গিয়ে প্রায় সবাই বড় জাহাজে চলে আসবে। মাত্র তিন চারজন ছোট জাহাজে থাকবে। ফ্রান্সিস বলল।

– জাহাজ চালিয়ে কোথায় যাবো আমরা? হ্যারি বলল।

— আমরা রাজা অপৰ্তোর দেশে যাবো! ফ্রান্সিস বলল।

–তা কেন? আমরা তো ঐ দেশে না গিয়ে স্বদেশে ফিরে যেতে পারি। হ্যারি বলল।

–ঠিক এই কথাটাই বলতে আমি এসেছি। মাত্র একটা দিনের জন্যে অনায়াসে ঐ রাজ্যে থাকতে পারি। নকশা দেখে রাজা ওভিড্ডোর তরবারি উদ্ধার করবো। ফ্রান্সিস বলল।

– ঠিক আছে। একটা দিন আমরা ওখানে থাকবো। সেই দিন ও রাত্রের মধ্যে ওভিজ্ঞার তরবারি উদ্ধার করতে পারলে তো ভালোই। কিন্তু যদি ব্যর্থ হই তাহলে তার পরদিনই আমরা জাহাজ ছাড়বো। হ্যারি বলল।

–বেশ। ফ্রান্সিস বলল।

বড় জাহাজই অনেকটা দূরে এল। গভীর সমুদ্রে থামল। বেশ কিছুক্ষণ পরে ছোটো জাহাজ এল। এবার ছোটো জাহাজ থেকে বড় জাহাজে যাওয়া। ছোটো জাহাজটা গিয়ে বড় জাহাজের গায়ে লাগলো। ঢেউয়ের দুলুনির মধ্যে দিয়ে বড় জাহাজের ডেক-এ এক এক করে ভাইকিংরা উঠে এল।

দুটো জাহাজইচলল। বড়জাহাজটা চালাচ্ছিল ফ্লেজার। ও শাঙ্কোকে ডেকেবলল–তোমরা দাঁড়ঘরে যাও। জাহাজটার গতি বাড়াতে হবে। শাঙ্কো হ্যারিকে গিয়ে বলল। হ্যারি ডেক-এ উঠে এল। গলা চড়িয়ে বলল –ভাইসব জাহাজের গতি বাড়াতে হবে। দাঁড়ঘরে যাও।

ভাইকিং রেলিং ধরে ছোটো জাহাজে বন্ধুদের ডেকে বলল–বাতাস পড়ে গেছে। তোমরা দাঁড় টানো। জাহাজের গতি বাড়াও। ছোটো জাহাজের ভাইকিংরাও দাঁড়ঘরে গেল। দাঁড় বাইতে লাগল।

দুটো জাহাজই বেশ দ্রুতগতিতে চলল।

পরদিন বিকেলে জাহাজ রাজা অপৰ্তোর রাজ্যে পৌঁছল। দূর থেকে দেখা গেল ছোটো বন্দরটা তিনটে জাহাজ রয়েছে। ওর মধ্যে একটা জাহাজ রাজা ভিলিয়ানের। এখন রাজা অপৰ্তোর দখলে।

ফ্রান্সিস ফ্লেজারের কাছে এল। বলল –ফ্লেজার জাহাজ তীরের কাছে নিয়ে যেও না। দুরেই রাখো। ফ্লেজার জাহাজের গতি কমাল। তারপর আস্তে আস্তে জাহাজটা থামাল। ছোটো জাহাজটাও শাঙ্কোর চেঁচিয়ে বলা কথা শুনে থামাল।

শাঙ্কো ফ্রান্সিসের কাছে এল। বলল –আজকে রাতেই তো যাবে?

–হ্যাঁ। তাড়াতাড়ি রাতের খাবার খেয়ে নিতে হবে। ফ্রান্সিস বলল।

— ঠিক আছে। আমিই তোমাকে ডাকতে যাবো। শাঙ্কো বলল।

— বেশ। ফ্রান্সিস চলুন।

সন্ধের পর পরেই শাঙ্কো রাতের খাবার খেয়ে নিল। ফ্রান্সিস একটু পরে খেল।

কেবিন ঘরে গিয়ে পোশাক পরে নিল। কোমরে তলোয়ার গুজল। তারপর বিছানায় বসে শাঙ্কোর জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল।

–আজ রাতে যাচ্ছো? মারিয়া বলল।

–হ্যাঁ। হ্যারি বাড়ি ফেরার জন্য অস্থির হয়ে পড়েছে। আজ রাতটা আমাকে সময় দিয়েছে। আজ রাতে রাজা ওভিড্ডোর তরবারি উদ্ধার করতে হবে।

— তার মানে আজ রাতেই শেষ চেষ্টা করতে হবে। মারিয়া বলল।

–হ্যাঁ। ফ্রান্সিস বলল।

–নকশাটা সঙ্গে নিয়েছো? মারিয়া বলল।

–হ্যাঁ হ্যাঁ। এবার প্রথমে গুহাটা দেখতে হবে। তারপর চেস্টনাট গাছের বনভূমি।

কিছু পরে শাঙ্কো তৈরি হয়ে এল। বলল–মশাল নেবো?

–দরকার নেই। আজকে জোছনা উজ্জ্বল। দুজনে চলল জাহাজের পেছন দিকে। সেখানে দড়ির মইটা রাখা আছে। দুজনে দড়ির মইটা নিচে একটা নৌকোর ওপর নামিয়ে দিল। তারপর প্রথম ফ্রান্সিস পরে শাঙ্কো নৌকোটায় নামল। মই ছেড়ে দিল।

দুজনে নৌকায় নামল। দড়ির মইটা ওপরে উঠতে দেখে দুজনেই দেখল হ্যারি মইটা ওপরে তুলে নিল।

ফ্রান্সিস দাঁড় বেয়েচলল। আজ আকাশে জোছনার ছড়াছড়ি। কিছুটা পর্যন্ত ভালোই দেখা যাচ্ছে।

তীরভূমিতে পৌঁছল। নৌকো বালিয়াড়িতে তুলে রাখল। বন্দরের কাছে এসে দুজনে ঝোপ জঙ্গলে ঢুকল। কিছুদূর গিয়ে দেখল রাস্তার ওপাশেই বুনো চেস্টনাট গাছের জঙ্গল।

ফ্রান্সিস আস্তে বলল –চল– রাস্তাটা পার হই। দুজনে সদর রাস্তায় এল। দুদিকে তাকিয়ে দেখল সৈন্য বা পাহারাদার কেউ নেই। ফ্রান্সিস বলল-জলদি। দুজনেই দ্রুত সদ রাস্তাটা পার হল।

টিলার নিচে ফ্রান্সিস দাঁড়াল। বলল –টিলার গুহাটা দেখতে হবে।

– চল। শাঙ্কো বলল। ফ্রান্সিসনকটা বের করল। চাঁদের আলোয় দেখে নিল। গুহাটা পশ্চিমমুখী। দুজনে টিলাটায় উঠতে লাগল। ফ্রান্সিস হিসেব করে পশ্চিমের ঢাল ধরে উঠতে লাগল।

অল্পক্ষণের মধ্যেই গুহার মুখে এসে পৌঁছল। চাঁদের আলো তো গুহার ভেতরে ঢোকে নি। তাই অন্ধকার ভেতরটা। শাঙ্কো বলল– দাঁড়াও। আমি ঢুকছি।

শাঙ্কো বুকের পোশাকের ফাঁক দিয়ে হাত ঢুকিয়ে ছোরাটা তুলে নিল। ডানহাতে ছোরাটা ধরে আস্তে আস্তে অন্ধকার গুহাটায় ঢুকতে লাগল। একটু দূর পর্যন্ত মোটামুটি দেখা গেল। তাপরই একেবারে অন্ধকার। তার মধ্যে দিয়ে দুজনে সামনের দিকে হাঁটতে লাগল।

গুহার মুখটাতে পাথরের টুকরো ছিল। ভেত্রটা মোটামুটি পরিষ্কার। আবার কিছুটা যেতেই শাঙ্কো বলল- ফ্রান্সিস এখানেই গুহা শেষ। ফ্রান্সিস হাত দিয়ে পাথুরে দেওয়ালটা পেল। দেওয়ালটায় হাত বুলিয়ে বুলিয়ে কোষের পাথুরে দেওয়ালটা দেখল। না –দেওয়ালে মাত্র দুটো খোদল মতো। খোঁদলে হাত দিল। ফঁকা। কিছু নেই। ফ্রান্সিস বলল –শাঙ্কো –অন্ধকারে বিশেষ কিছু দেখা যাবেনা। কাল সকালে যদি সময় পাই আসবো। চলো।

দুজনে অন্ধকারে আস্তে আস্তে গুহার মুখে চলে এল। গুহার মুখ থেকে জোছনা পাওয়া গেল। নামতে লাগল দুজনে। টিলা থেকে নামল। বুনো চেস্টনাট গাছের জঙ্গলে ঢুকল।

জোছনা উজ্জ্বল। তাই সবকিছুই মোটামুটি পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। দুজনে মরা গাছটা খুঁজতে লাগল। পেয়েও গেল।

-শাঙ্কো– তুমি তো আগে এসেছিলে। বেলচা এনেছিলে?

–এনেছিলাম। কিন্তু রাজা অপৰ্তোর সৈন্যদের হাতে প্রায় ধরা পড়েছিলাম। তখন বেলচা এনেছিলাম। পালাবার আগে বেলচাটা ঐ কোষটায় ফেলে গেছি। দেখি খুঁজে। শাঙ্কো সেদিকেচলল। ঝোপে খুঁজতে খুঁজতে বেলচাটা পেল। তুলে আনল। শাঙ্কো ফ্রান্সিসের কাছে এল। তারপর সেই বৃদ্ধ কবিরাজের কথা বলল। ফ্রান্সিস একটু আশ্চর্য হল।

শাঙ্কো মরা গাছটার গোড়ায় বেলচা দিয়ে মাটি তুলতে লাগল। কিছুক্ষণ মাটি তোলার পর গাছের গোড়াটা বেরিয়ে এল। দুজনেই আশ্চর্য হল। দেখল শেকড়। ফ্রান্সিস বলল

–নকশাতেও শেকড় আঁকা আছে।

গাছটার গোড়া অনেকটা আলগা হল। দুজনে মিলে গাছটাতে কাত করল এপাশে। তারপর ওপাশে। গাছটা মাটি থেকে আলগা হয়ে গেল। এবার দুজনে মিলে গাছটাকে টানতে লাগল। আস্তে আস্তে গাছটা উঠে এল। গাছটা পাশে রেখে দিয়ে এবার যে গর্তটা হয়েছিল সেটা দেখতে লাগল ফ্রান্সিস। ও ভাবল- সোনার বারি কি এখানেই আছে? ফ্রান্সিস বলল শাঙ্কো– তোমার কী মনে হয়? সোনার তরবারি কি এখানেই আছে?

–ফ্রান্সিস– গর্তটা আরো নিচে বাড়ানো যাক। আরও নীচে কী আছে দেখা যাক।

–ঠিক বলেছো। চলো গর্তটা নিচের দিকে বাড়াই।

শাঙ্কো বেলচা দিয়ে মাটি তুলতে লাগল। একটু পরে ফ্রান্সিস বেলচা চালাতে লাগল।

হঠাৎ একটা মৃদু শব্দ হল — টং। ধাতব শব্দ। ফ্রান্সিস বলে উঠল — শাঙ্কো– নিশ্চয়ই তরবারিটা। আরো খুঁড়তে হবে। এবার শাঙ্কো বেলচাটা নিল। খুঁড়তে লাগল। একটা হাতল বেরিয়ে এল।

শাঙ্কো গর্তে নেমে হাতলটা ধরল। চাঁদের আলোয় দেখাই যাচ্ছে সোনার হাতল। শাঙ্কো হাতলটা ধরে টানতে লাগল। খাপের মধ্যে রাখা বোধহয়। শাঙ্কো ভাবল।

ফ্রান্সিস বলল–শাঙ্কো আমাকেও টানতেদাও। দেখাই যাচ্ছে সোনারহাতল। ফ্রান্সিস নামল। হাতলটা ধরে প্রাণপণে টানতে লাগল। তলোয়ারটা যেন অনেকটা নড়ল। ফ্রান্সিস আবার দুটো হ্যাঁচকা টান দিল। তরবারি উঠে এল চাঁদের আলোতেই তলোয়ারটা ঝিকিয়ে উঠল। নিরেট সোনায় তৈরি তরবারি। ফ্রান্সিসমৃদুস্ফরে ধ্বনি দিল –হোহোহো। শাঙ্কোও চাপা গলায় ধ্বনি তুলল–ও– হো- হোহাত সাতেক লম্ফা তরবারিটা।

তরবারিটা মাটিতে নামিয়ে রেখে ফ্রান্সিস বলল–শাঙ্কো–এবার খাপটা তুলতে হবে।

ফ্রান্সিস উঠে এল। শাঙ্কো নামল। মাটি সরাতেই দেখা দেখা খাপটা। শাঙ্কো খাপটা বার কয়েক এদিক ওদিক সরাতেই খাপটা বেশ আলগা হল। শাঙ্কো খাপ ধরে বারকয়েক হ্যাঁচকা টান দিতেই খাপটা উঠে এল।

চাঁদের আলোয় ওরা দেখল এক আশ্চর্য সুন্দর তলোয়ারের খাপ। সোনার ওপর কত মণিমাণিক্য বসানো। সুন্দর মিনেকরা। চাঁদের আলোয় সব মণিমাণিক্যগুলো এখানে ওখানে ঝিক দিয়ে উঠল। ফ্রান্সিস আর শাঙ্কো এরকম গুপ্তধন আগেও উদ্ধার করেছে। এসব ওদের চোখ সওয়া হয়ে গেছে। কিন্তু এরকম সূক্ষ্ম কারুকাজ করা তরবারির খাপ ওরা আগে কখনও দেখে নি।

ফ্রান্সিস বলল—শাঙ্কো পালাও। আর এক মুহূর্তও এখানে থাকা চলবে না। জলদি। ভারি তরবারটা ফ্রান্সিস নিল। খাপটা শাঙ্কো কাঁদে নিল।

বুনো চেস্টনাট গাছের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ছুটে থেমে ওরা দুজনে বেরিয়ে এল জঙ্গল থেকে। ততক্ষণে ভোর হয়ে গেছে। আকাশ সাদাটে। সদর রাস্তায় ওঠার আগে পশ্চিমদিকে তাকিয়ে দেখল। না–কোনো সৈন্য নেই। দুজনে দ্রুত সদর রাস্তাটা পার হল। তারপর চলল নৌকোর খোঁজে। বালিয়াড়িতে তুলে রাখা নৌকাটার কাছে এল। প্রায় ছুটে আসতে হয়েছে। দুজনেই হাঁপাচ্ছে তখন।

দুজনে নৌকোয় উঠল। ফ্রান্সিস দাঁড় টানতে লাগল।

সূর্য উঠল। আলো ছড়িয়েপড়ল। যে তিন-চারজন ভাইকিং ডেকে দাঁড়িয়েছিল তারা ফ্রান্সিসদের দেখল। চেঁচিয়ে বলে উঠল—ফ্রান্সিস শাঙ্কো এসেছে। ডেক-এ হ্যারি আর মারিয়া এসে দাঁড়াল।

ফ্রান্সিস আর শাঙ্কো হালের কাছে এল। বন্ধুরা ওপর থেকে দড়ির মইটা ঝুলিয়ে দিল। ফ্রান্সিস আর শাঙ্কো ওপরে উঠে এল। বন্ধুদের চেঁচামেচি থেমে গেল। ওরা তখন নির্বাক। দেখলে লাগল তরবারিটা আর তার খাপ। রোদ লেগে তরবারির খাপে বসানো হীরে মুক্তো চুনিপান্না থেকে আশ্চর্য আলোর ঝলকানি দেখা গেল। সোনার তরবারি রোদে ঝলসে উঠল। কারও মুখে কথা নেই।

কিছু পরে মারিয়া ধ্বনি তুলল –ও — হো –হো। এবার ভাইকিংরা সংবিৎ ফিরে পেল। চিৎকার ধ্বনি তুলল –ও –হো –হো। ভাইকিংরা কেউ হেঁড়ে গলায় গান ধরল। কেউ নাচতে লাগল।

ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে বলল –ভাইসব–পরে আনন্দ করবো। এখন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব — জাহাজ ছাড়ো। রাজা অপৰ্তো রাজা ওভিড্ডোর তরবারি আমরা পেয়েছি এটা জানলে আমরা ভীষণ বিপদে পড়ব। সবাই লেগে পড়ো। হাওয়ার তেমন জোর নেই। কিছু বন্ধু দাঁড় ঘরে যাও। দাঁড় টানো। সব পাল খুলে দাও।

ভাইকিংরা নিজেদের কাজে নামল। দ্রুত নোঙর তোলা হল। পাল খুলে দেওয়া হল। জলে উঠল ছছ দাঁড়ের শব্দ।

জাহাজ শান্ত সমুদ্রে ছোটো ছোটো ঢেউ চলল পূর্ণ বেগে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress