রাঙ্গা পথের বাঁকে
আমাদের জঙ্গলমহলের রাঙ্গা পথের বাঁকে বাঁকে ছড়িয়ে রয়েছে নৈসর্গিক সৌন্দর্যের ডালি! খালি দুচোখ ভরে দেখার অপেক্ষা! মন্দির নগরী বিষ্ণুপুর থেকে পোড়ামাটির আঁতুড়ঘর পাঁচমুড়া যাওয়ার রাস্তার অপূর্ব দৃশ্য ভাষায় বর্ণনা করা যায় না! আমি আজ থেকে 30 বছর আগেকার কথা বলছি! আমার প্রথম পাঁচমুড়া যাওয়ার গল্প! পোড়ামাটি শিল্পের আঁতুড়ঘর এই পাঁচমুড়া গ্রাম টি। এটি কুম্ভকার বা কুমোর গ্রাম। প্রতি বাড়িতেই রয়েছে কুমোরের চাক। বংশপরম্পরায় এরা এই শিল্পকে বহন করে চলেছেন । এই গ্রাম দেখতে যাবার ইচ্ছে নিয়ে বিষ্ণুপুরে এসেছি। যোগাযোগ ব্যবস্থা সেরকম উন্নত নয় আর রাস্তাও খুবই দুর্গম। কাঁচা লাল রাস্তা গভীর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চলে গেছে। রাস্তায় লোকজন খুব কম খালি বনদপ্তর এর গাড়ি যাতায়াত করে। দিনের বেলাও জঙ্গলের ভেতরে যেতে গা ছমছম করে। ঘন আদিম জঙ্গল। কোন কোন জায়গায় গাছের চন্দ্রাতপ ভেদ করে আলোর প্রবেশ নিষেধ। নানা গাছগাছালিতে পাখির মেলা। হরিয়াল ঘুঘু বেনেবউ ফিংয়ের সাথে সাথে আরো কত নাম না জানা পাখি। তাদের কলকাকলিতে জঙ্গল মুখর। মাঝে মাঝে টাঁড জমিতে ঝামাপাথর এর চ্যাট্টানের এর মাঝে স্ফটিকস্বচ্ছ জলাশয় স্থানীয় কথায় বাঁধ। এখানে জলজ পাখিদের জটলা। কলমি লতা পদ্ম শালুকের লতায় জলতল ঢেকে আছে। পানিকাক বা পানকৌড়ি ভেসে বেড়াচ্ছে জলে— মাঝে মাঝে টুকটুক করে ডুব দিয়ে গুগলি ধরছে। জলপিপি শাপলা দলে পা পা করে হাঁটছে। তীব্র স্বরে শিস দিয়ে মাছরাঙ্গা তার উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। বনের মাঝে মাঝে দু একটা ক্ষেত। সবজিও সরষের সবুজ হলুদ এর মিনাকারি ।অপূর্ব দৃশ্য।
জঙ্গল প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর।
জঙ্গলের মাঝে মাঝে বিরাট বিরাট উই ঢিপি অবাক হয়ে যেতে হয় এর উচ্চতা ও গঠন বৈচিত্র দেখলে। শাল জঙ্গলের মাঝে সাপের খোলসের ওড়না জড়ানো উই ঢিপি গুলো যেন আদিম সৌন্দর্যের উদাহরণ। হরিয়াল এর ঝাঁক গাছের মাথায় বসে কলরব করছে। মানুষের সাড়া পেলেই উড়ে যাচ্ছে। আশ্চর্য পরিবেশ। দিনের বেলাতেই সবুজ অন্ধকারে ঝিঁঝিঁ র ডাকে যেন অকাল সন্ধ্যা নেমে আসছে। জঙ্গল চিরে লালমাটির রাস্তাটা এঁকেবেঁকে চলে গেছে দিগন্ত সীমার দিকে। এই জঙ্গল হাতি নেকড়ে ভাম বেজি উদবিড়াল খরগোশের লীলাস্হল। আর আছে বিভিন্ন বিষধর সাপ– শঙ্খচূড় এর অন্যতম। রুক্ষ্ম ডুংরি টিলা, শাল বা বাঁশ জঙ্গলে এদের বাস।
এই জঙ্গল লাগোয়া গ্রামে এক কবিরাজের বাড়ি দেখলাম। এখানে প্রাকৃতিক চিকিৎসা হয়। অনেক ছেলে মেয়ে দেশীয় পদ্ধতিতে ওষুধ তৈরি করছে দেখলাম। এই নিরাময় কেন্দ্র টি কে ঘিরে ছোট্ট একটা হট বসে সপ্তাহে একদিন। গ্রামীণ লোকজনের সাপ্তাহিক বাজার এটা। দেখতে দেখতে পৌছালাম পাঁচমুড়ায়। কুমোর গ্রামের সর্বত্রই শিল্পের সমারোহ। মাটির দাওয়ায় কুমোরের চাক। পোড়ামাটির শিল্পের সম্ভারের বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম। এই অঞ্চলের লোক দেবদেবীর থান বা আটনে” ছলন ” বা পোড়ামাটির মূর্তি উৎসর্গ করার রীতি !আর মানসিক করলে তো ছলন বাঁধতেই হয়। ছলনের বৈচিত্র্যে অবাক হয়ে গেলাম।কয়েক ইঞ্চি থেকে মানুষ প্রমাণ ঘোড়ার মূর্তি– পাঁচমুড়ার পোড়ামাটির ঘোড়া সারা পৃথিবী বিখ্যাত! এছাড়াও হাতি শুওর সাপ মনসার চালি —সম্ভারের আর শেষ নেই! মন ভরে যায়! বিভিন্ন রকম পোড়া মাটির টালি, ঘর সাজানোর জিনিস! পোড়ামাটির সুন্দর সুন্দর গয়না— বালা চুড়ি কানের গলার! দেখতে দেখতে সময় গড়িয়ে চললো—- রবি অস্তাচলের পথ ধরলেন! এবার তো ফিরতে হবে– অন্ধকার জঙ্গল পথে জংলি জানোয়ারের ভয়! জঙ্গল পথের রোমাঞ্চ আর জানোয়ারের ভয়ে মিলেমিশে একাকার। পাঁচমুড়া থেকে কয়েক কিলোমিটার আসার পর বনদপ্তর এর লোকজন আমাদের দাঁড় করালেন। কারণ জঙ্গলে হাতির দল রয়েছে। আমাদের প্রায় ঘন্টা দুয়েক অপেক্ষা করতে হলো। বনদপ্তর এর লোকেদের রাস্তা ক্লিয়ার গ্রিন সিগন্যাল পাওয়ার পর আবার যাত্রা শুরু হলো। ভোরবেলায় বিষ্ণুপুর পৌছালাম।
এরপর অনেকবারই পাঁচমুড়ায় গিয়েছি কিন্তু
প্রথমবারের সেই রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার কথা কখনো ভুলতে পারবো না— যা মনের মনিকোঠায় আতর মাখানো স্মৃতি হয়ে জমা আছে!