Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

বাউল ও বৈষ্ণবী

এই ঘর ভঙিয়া বাউল ও বৈষ্ণবী একদিন পথে বাহির হইয়াছিল, সঙ্কল্প ছিল, আর কখনও ফিরিবে না। আবার পথের ফেরে সেইখানে ফিরিয়া দুইটা দিন থাকিবার জন্য গাছতলায় সংসার পাতিয়াছিল। সে সংসার আর তাহারা ভাঙিতে পারিল না। কমল যেন বাসা বাঁধিতে বসিল। রসিকদাসও বলিল না, চল, বেরিয়ে পড়ি। কয়েক মাস না। যাইতে ভাঙা ঘর পরম যত্নে তাহারা আবার গড়িয়া তুলিল। মায়ের কোলের মমতার জন্য, না পথের বুকেও সুখ পাইল না বলিয়া, সে-কথা তাহারাও হয়ত বেশ বুঝিল না।

পাশাপাশি দুইখানি আখড়া আবার গড়িয়া উঠিল। নীড় রচনার সমারোহের মধ্যে দিনকয়েক বেশ আনন্দেই কাটিয়া গেল। মহান্ত কাটিল মাটি, কমল বহিল জল, মহন্ত দিল দেওয়াল, কমল আগাইয়া দিল কাদার তাল। মহান্ত ছাইল চাল, কমল লেপিল রাঙা মাটি। মহান্ত বসাইল দুয়ার জানালী, কমল দুয়ার-জানালার পাশে পাশে রচনা করিল খড়ি ও গিরিমাটির আলপনা। নীড় সম্পূর্ণ হইল, সে নীড়ের দুয়ারে আবার অতিথি দেখা দিল। সেই পুরনো বন্ধু-ভোলা, বিনোদ, পঞ্চানন। সন্ধ্যায় কীর্তনের আসর বসে। তাহারা আনন্দ করিয়া চলিয়া যায়। কমল রাধিয়া বাড়িয়া ডাকে, মহান্ত!

মহান্ত তখন চলিয়া গিয়াছে। রসকুঞ্জে আসিয়া কমল বলিল, না খেয়ে যে চলে এলে?

কণ্ঠস্বরের মধ্যে প্রচ্ছন্ন ক্রোধ ও অভিমান।

রসিক হাসিয়া বলিল, শরীর ভাল নাই কমল।

কমলের কণ্ঠস্বরের ভঙ্গি পরিবর্তিত হইয়া গেল। সে আশঙ্কাভরে জিজ্ঞাসা করিল, কি হল গো? জ্বর-টর হবে না তো? কই, দেখি, গা দেখি?

কিন্তু নিত্যনিয়মিত ব্যাধি হইলে, সে ব্যাধির স্বরূপের সহিত মানুষের পরিচয় হইয়া যায়।

কয়দিন পর কমল সেদিন বলিল, দেহেই হোক আর মনেই হোক মহান্ত, ব্যাধি পুষে রাখা ভাল নয়। ব্যাধি তুমি দূর কর।

রসিকদাস শুধু তাহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। কমল বলিল, সেদিন তুমি বলেছিলে, বিদায় দাও। সেদিন পারি নাই। আমার যা হবে হোক মহান্ত, তোমাকে আমি বিদায় দিচ্ছি।

রসিক চমকিয়া উঠিল, বলিল, এ কথা কেন বলছি কমল?

ক্লিষ্ট হাসি হাসিয়া কমল বলিল, ব্যাধি তো তোমার আমি মহান্ত। ব্যাধিকে বিদায় করাই ভাল।

রসিক মাথা হেঁট করিয়া মাটির দিকে চাহিয়া বসিয়া রহিল। বহুক্ষণ পর সে ডাকিল, কমল, রাইকমল!

জনহীন প্রাঙ্গণ নিথর পড়িয়া, কমল বহুক্ষণ চলিয়া গিয়াছে। কথাটি বলিয়া সে আর অপেক্ষা করে নাই।

পরদিন হইতে রসিকদাস যেন উৎসব জুড়িয়া দিল। মুখে তাহার হাসির মহোৎসবআখড়ায় মানের মহোৎসব! ভোলা আসিলে মহান্ত আহবান করে, এস ভোলানাথ, গাঁজা তৈরি। ভোলা পরমানন্দে বলে, লোগাও মহন্ত, দম৷ লোগাও।

কলরবের স্পর্শ পাইয়া কমল মুখর হইয়া ওঠে। ভোলার তৎপরতা দেখিয়া তাহার হাসি উচ্ছল হইয়া ভাঙিয়া পড়ে। পঞ্চানন আসিলে সে বলিয়া ওঠে, তুমি নাম-গান কর পঞ্চানন।–বলিয়া সে নিজেই গান ধরিয়া দেয়। বাউলের সুরে–

গাঁজা খেয়ে বিভোর ভোলা–
পঞ্চাননে গায় হরিনাম-পঞ্চানন-ভোলা—

ভোলা ধরে খোল, মহান্ত করতাল লইয়া দোহারকি করে। দেখিতে দেখিতে কীর্তন জমিয়া ওঠে। এমনই করিয়া আবার দিনকয়েক বেশ কাটিয়া গেল। সেদিন কমল ভোলাকে বলিল, ভোলা, দুখানা কাঠ কেটে দে না ভাই।

ভোলা কুড়াল লইয়া মাতিয়া উঠিল। কাঠ কাটিয়া ভোলা বলিল, মজুরি দাও কমল।

এখন কুলের সময় নয় রে ভোলা, নইলে কুলের ঢেলা ছুঁড়ে মজুরি দিতাম। কথাটা শেষ করিয়া কমল খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিল। তারপর বলিল, মনে পড়ে তোর?

ভোলাও হাসিল। বলিল, খুব।

রাত্রিতে নামকীর্তনের আসর ভাঙিয়া গেল। সকলে চলিয়া গেলে ভোলা তামাক সাজিতে বসিল। মহান্ত খাওয়া শেষ করিয়া উঠিল। ভোলা তখনও তামাক টানিতেছিল।

মহান্ত বলিল, ভোলানাথ, এস!—বলিয়া সে চলিয়া গেল।

ভোলা পরম ঔদাস্যভরে বলিল, বসি আর একটু!

কিছুক্ষণ পর মহান্ত আবার ফিরিয়া আসিল, আমার কল্‌কেটা। কল্‌কে লইয়া মহান্ত কমলকে বলিল, রাত অনেক হল রাইকমল।

উত্তর হইল, জানি মহান্ত।

মহান্ত স্তম্ভিত হইয়া গেল। এমন উত্তর সে প্রত্যাশা করে নাই।

কমল এবার তাহার দিকে ফিরিয়া বলিল, ফুল মাথায় তোলবার আগে তাতে পোকা আছে কি না বেছে নিতে হয় মহান্ত। নইলে শিরে দংশন যদি হয়, তাতে আর ফুলেরই বা কি দোষ, পোকারই বা কি দোষ!

ফুল তো–কথাটা বলিতে গিয়া মহান্ত থামিয়া গেল। আবার সঙ্গে সঙ্গেই একমুখ হাসিয়া সে বলিল, গোবিন্দের নির্মাল্য রাইকমল, তাতে কীটই থাক আর কাঁটাই থাক, মাথা ভিন্ন রাখবার আর ঠাঁই নাই আমার!

কমল বলিল, কালি মাখিয়ে সাদা ঢাকা যায় মহান্ত, কিন্তু কালি মাখিয়ে আলো ঢাকা যায় না। ফুল তুমি নিজে মাথায় তোল নাই, সে কথা একশো বার সত্যি। আজ তোমায় জোড়হাত করে বলছি, আমায় রেহাই দাও।

মহন্ত কোনো উত্তর না দিয়া ধীরে ধীরে চলিয়া গেল। ভোলা গাঁজা খাইয়া বাম হইয়া বসিয়া ছিল। কমল ভোলাকে কহিল, বাড়ি যা ভাই ভোলা।

ওদিকে রুদ্ধ ঘরের মধ্যে মহান্ত প্রৌঢ় বাউল অন্তরবাসী গোবিন্দের পায়ে মাথা কুটিতেছিল, গলার মালা আমার মাথায় তুলে দাও প্রভু, মাথায় তুলে দাও।

কিছুক্ষণ পরে উন্মত্তের মত নির্জন ঘরখানি মুখরিত করিয়া বলিয়া উঠিল, না না, আমায় রূপ দাও। শ্যামসুন্দর, আমায় সুন্দর করে দাও। আমার সাধনা-পুণ্য সব নাও।

উন্মত্ততার মধ্যে এই একান্ত কামনা জানাইয়া সে শয়ন করিল।

প্রভাতে তখন তাহার সে উন্মত্ততা শান্ত হইয়া আসিয়াছে কিন্তু দুরাশার মোহ যেন কাটে নাই, প্রভাতের আলোকে আপনার অঙ্গপানে সে চাহিয়া দেখিল। তাহার সেই কুরূপ তাহার একান্ত প্রত্যাশিত দৃষ্টিকে উপহাস করিল।

পরদিন সমস্ত দিনটা সে কমলের আখড়া দিয়া গেল না। কি তাহার মনে হইল, কে জানে, বাহির করিয়া বসিল বাউলের পথ-সম্বল বড় ঝুলিটা। কয়টা স্থানে ছিড়িয়া গিয়াছিল, তাহাতে রঙিন কাপড়ের তালি দিতে বসিল।

ভোলা আসিয়া ডাকিল, কমল ডাকছে মহান্ত, এখনই চল।

মহান্ত গাঁজার পুরিয়া বাহির করিয়া দিয়া বলিল, তোয়ার কর।

কমলের আজ্ঞাপালনের তাগিদ ভোলানাথ ভুলিয়া গেল। গাঁজা খাইয়া সে কথা তাহার মনে পড়িল। সে ডাকিল, এস।

কাঁধে ঝোলাটা ফেলিয়া মহান্ত উঠিল। কিন্তু পথে বাহির হইয়া বিপরীত মুখ ধরিয়া সে বলিল, কমলকে বোলো, আমি ভিক্ষায় বেরুলাম।

ভোলা অবাক হইয়া বলিল, যাঃ গেল, গাঁজাখোরের রকমই এই।

সন্ধ্যায় আখড়াটা সেদিন কেমন মিয়ামাণ হইয়া ছিল। প্ৰদীপের আলোকে আড়ডার লোক কয়টি বসিয়া গল্প করিতেছিল। কমল ঘরের মধ্যে শুইয়া আছে। কীর্তনের আসর। আজ বসে নাই। রসিকদাস আসিয়া বলিল, একি ভোলানাথ, কীর্তনের আসর খালি যে?

ভোলা বলিল, বোষ্টুমীর অসুখ। মাথা ধরেছে।

বোষ্টম তো আছে, এস এস।

রসিকদাস মৃদঙ্গটা পাড়িয়া বসিল। কিন্তু তবুও আসার জমিল না। অল্পক্ষণের মধ্যেই আসর শেষ হইয়া গেলে মহান্ত আসিয়া ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিয়া ডাকিল, রাইকমল!

কমল নিস্তব্ধ হইয়া পড়িয়া ছিল–কোনো উত্তর করিল না। বিছানার পাশে বসিয়া মহান্ত আবার ডাকিল, কমল! রাইকমল!

আমার মাথা ধরেছে মহান্ত।

কমলের ললাটখানি স্পর্শ করিয়া মহান্ত বলিল, মাথায় হাত বুলিয়ে দেব রাইকমল?

রুদ্ধস্বরে কমল বলিয়া উঠিল, না না না। তোমার পায়ে পড়ি মহান্ত, আমায় রেহাই দাও।

বহুক্ষণ নীরবতার পর মহান্ত ধীরে ধীরে বলিল, পারছি না। রাইকমল। আজ গোবিন্দের মুখ মনে করে পথে বেরিয়েছিলাম। কিন্তু কিছুদূর না যেতেই গোবিন্দের মুখ ভুলে গেলাম। মনে পড়ল। তোমার কমল—মুখ। হাজার চেষ্টা করেও শ্ৰীমুখ মনে আর এল না।

কমল বলিল, এত বড় পাপ আমার মধ্যে আছে যে, আমার মুখ মনে করলে গোবিন্দের মুখ মনে পড়ে না মহান্ত?

মহান্ত নতমুখে বসিয়া রহিল। কমল বলিয়া গেল, তোমার আগুনে তুমি কতটা পুড়লে তা জানি না মহান্ত, কিন্তু পুড়ে ম’লাম আমি।

কিছুক্ষণ অপেক্ষা করিয়া মহান্ত উঠিয়া চলিয়া গেল।

কমল উঠিল পরদিন সকালে। সঙ্কল্প লইয়া শয্যাত্যাগ করিল, মহান্তের হাতেই আজ নিঃশেষে নিজেকে তুলিয়া দিবে। আর সে পারে না; এ আর তাহার সহ্য হইতেছে না। দুয়ার খুলিয়া বাহিরে আসিতেই তাহার নজর পড়িল, রঙিন কাপড়ের বাধা ছোট্ট একটি পোটলা দরজার পাশেই কেহ যেন রাখিয়া দিয়া গিয়াছে। একটু ইতস্তত করিয়া সেটি তুলিয়া লইয়া সে খুলিয়া ফেলিল। লাল পদ্মের পাপড়ির শুকনো একগাছি মালা। মালাগাছি হাতে করিয়া সে নীরবে নিস্তব্ধ হইয়া বসিয়া রহিল।

বেলা অগ্রসর হইয়া চলিল। ভোলা আসিয়া তামাকের সরঞ্জাম পাড়িয়া বসিল। তামাক সাজিতে সাজিতে সে প্রশ্ন করিল, কই, মহান্ত গেল কোথা? আখড়ায় তো নাই!

কমল বলিল, জানি না।

তামাক খাইয়া ভোলা উঠিয়া গেল, আসার জমিল না। স্নানের সময় কাদু আসিয়া ডাকিল, বউ!

সচকিতের মত উঠিয়া কমল বলিল, চল যাই।

ঘড়া-গামছা লইয়া সে কাদুর সঙ্গে চলিল। কাদু প্রশ্ন করিল, ওটা আবার কি বউ, রঙিন কাপড়ে জড়ানো?

কমল বলিল, মালা। জলে বিসর্জন দিয়ে আসব ভাই।

কাদু বিক্ষিতের মত কমলের মুখের উপর চাহিয়া রহিল। কথাটা সে বুঝিতে পারিল না। কমল বলিল, মহান্ত কাল রাত্রে চলে গেছে ননদিনী। এ মালা আমি তার গলায় দিয়েছিলাম।

কাদু বলিল, ছিঃ, মহান্তকে আমি ভাল মানুষ মনে করতাম। তার—

কমল বাধা দিল, কহিল, না না। তুই জানিস না নানদিনী, তুই জানিস না। চোখে তাহার জল আসিল। চোখ মুছিয়া আবার বলিল, তা ছাড়া সে আমার গুরু, তার নিন্দে আমায় শুনতে নাই।

নীরবে পথ চলিতে চলিতে কমল আবার বলিল, তোর সংসারের লক্ষ্মীর কৌটো যদি কেউ সিঁদ কেটে চুরি করে কাদু, তবে সে ঘরে সংসার পাততে কি সাহস হয়, না মন চায়?

কাদু বলিয়া উঠিল, ওসব কি অলক্ষুণে কথা বলিস তুই বউ-ছিঃ!

কমল হাসিয়া বলিল, বাউলের সংসারের গৃহদেবতা চুরি গিয়েছে ননদিনী।

আবার কিছুক্ষণ পর সে বলিল, সে পাক, তার শ্যামকে সে ফিরে পাক।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *