Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

সুখের লাগিয়া

কাদু সমারোহের সহিত জলখাবারের আয়োজন করিয়াছিল। দাওয়ায় বসাইয়া সে নিজে পাখার বাতাস দিতে বসিল।

তারপর মুখ টিপিয়া হাসিয়া বলিয়া উঠিল, শেষকালে এঁদোপুকুরে ড়ুবে মলি ভাই বউ! ওই বগ-বাবাজী-বুড়ো বগের গলায় মালা দিলি?

কমল মুখ তুলিল, ঠোঁট দুইটি তাহার থরথর করিয়া কাঁপিতেছিল।

সবিস্ময়ে কাদু বলিল, বউ!

লঙ্কা–আমার লঙ্কার বাড়ি! কান্নার আবেগে কমলের কথা শেষ হইল না। চোখের কোল দুটি তখন পরিপূর্ণ অশ্রুভারে উথলিয়া উঠিয়াছে।

দারুণ ঘৃণার সহিত কাদু বলিয়া উঠিল, তার নাম আমার কাছে করিস না। ছি—ছি—ছি!

কমল কিছু বুঝিতে পারিল না। কাদু আবার বলিল, পরীকে মনে আছে তোর? পরী বিধবা হল তোরা এখান থেকে যাবার কিছুদিন পরেই। সেই পরীকে নিয়ে রঞ্জন দেশান্তরী হল। রঞ্জনের বাবা, রঞ্জনের মা লজ্জায় ঘেন্নায় কাশী চলে গেল। সেইখানেই তারা মরেছে।

কমল মাটির দিকে চাহিয়া বসিয়া ছিল। চোখের সম্মুখে তাহার মাটি যেন পাক খাইয়া ঘুরিতেছিল। তাহার বুকের মধ্যে তুফান বহিতেছিল। হায়, এত বড় বঞ্চনায় সে বাঁচিবে কি করিয়া?

কাদু বলিল, তার জন্যে দুঃখ করিস না বউ। সে যে তোর মোহ এড়িয়েছে, সেই তোর ভাগ্যি। তার বাপ-মায়ের মৃত্যুর পর সে এখানে একবার এসেছিল বিষয় বিক্রি করতে। কি বললে আমাকে জানিস?

কমল মাটির দিকে চাহিয়া ছিল-মাটির দিকেই চাহিয়া রহিল। কাদু বলিল, দেখলাম রঞ্জন বোষ্টম হয়েছে। আমি একদিন ডেকে বললাম, আচ্ছা রঞ্জনদা, বোষ্টমই যদি হলে তবে কমলকে দেশান্তরী করলে কেন? তাকে তুমি ভুললে কি করে? আমায় উত্তর দিলে, কাদু, পরী খুব ভাল মেয়ে, তুমি জান না। আর সে ছেলেবেলার খেলাধুলার কথা ছেড়ে দাও। বয়সের সঙ্গে তফাত হলেই সব ভুলে যেতে হয়।-ও কি, ও কি ভাই, কিছুই যে খেলে না! না না, একটা মণ্ডা অন্তত খা।

হাসিবার চেষ্টা করিয়া কমল বলিল, রুচিছে না ভাই ননদিনী, ননদিনীর দেওয়া মিষ্টি মুখে রুচিছে না। তেতো নয়, বিষ নয়, ননদিনীর হাতের মিষ্টি কি মুখে ভাল লাগে! যে খবর দিয়েছিস, তাতেই পেট ভরেছে। তারপর গভীরভাবে সান্ত্বনা দিয়া বলিল, আজ থাক ভাই! পালাচ্ছি না তো। কত খাওয়াবি খাওয়াস পরে।

কাঁদু তাহার বুকের তুফানের সন্ধান পাইয়াছিল। সে আর জেদ করিল না। কমল উঠিয়া দীড়াইয়া ভিক্ষার ঝুলিটি মেলিয়া ধরিল। রহস্যের ভনে সে আত্মগোপন করিবার চেষ্টা করিতেছিল।

ভিক্ষার ঝুলিটি প্রসারিত করিয়া সে বলিল, ভিক্ষে পাই ননদিনী-ঠাকরুন।

কাদুর কিন্তু চোখে জল আসিল। সে বেদনাভরেই কহিল, শেষ-ভিক্ষে তো দিয়েছি বউ, ননদিনীর কাজ তো করেছি।

কমল হাসিয়া উঠিল। কিন্তু সে হাসি এত ব্যৰ্থ, এত মেকি যে তাহার নিজের চোখেই জল। আসিল।

কাদু বলিল, আমার কাছে লুকোচ্ছিস বউ? তা লুকোতে পারিস। আমাকে তা হলে তুই পর ভাবিস!

কমল তাহার হাত দুইটি ধরিয়া শুধু বলিল, কাদু!

মুখরা কাদুর মুখে ম্লান সকরুণ হাসিটি বিচিত্র শোভায় ফুটিয়া উঠিল। সে বলিল, তা হলে তুই আর আমার কাছে তোর দুঃখ লুকোতে চেষ্টা করতিস না। মা হস নাই তুই বউ, নইলে বুঝতে পারতিস খাঁটি ভালবাসায় মানুষের কাছে মানুষের কিছু গোপন থাকে না। কথা-না-ফোঁটা ছেলে কাঁদে। মা বুঝতে পারে, কোনটা তার ক্ষিদের কান্না, কোনটা রোগের কান্না, কোনটা রাগের কান্না। চোখের জল তোর গাল বেয়ে ঝরল না, কিন্তু আমি বেশ দেখতে পাচ্ছি, সে-জলে বুকের ভেতরে তোর সােয়র হয়ে গেল!

কমল নতমস্তকে এ তিরস্কার মাথা পাতিয়া লইল। এতক্ষণে চোখের জল মুক্তধারায় পায়ের তলার মাটি সুসিক্ত করিয়া তুলিল।

রসিকদাস বাহিরে বসিয়া পাঁচজনের সঙ্গে আলাপ করিতেছিল। সে আবার বাহির হইতে সাড়া দিয়া উঠিল, ননন্দ-ভাজে এত গলাগলি কিসের গো?

কমল তাড়াতাড়ি চোখের জল মুছিয়া ফেলিয়া বলিল, যাই আমি ননদিনী।

কাদু বলিল, আজ এইখানে রান্নাবান্না কর।

না, আজ নয়। বহুদিন পর ভিটের কোলে ফিরে এলাম ভাই। আজ ভিটের মাটিতেই পাতা পেড়ে খাব!

কাদু আর আপত্তি করিল না।

লতামণ্ডপের তলদেশটিতে কমল সেদিনের মত গৃহস্থালি পাতিল। মহান্ত মুদির দোকানে কয়টা জিনিস আনিতে গিয়াছিল। ফিরিয়া দেখিল, ইটের উনান তৈয়ারি করিয়া ঝরা পাতার ইন্ধনে কমল ফুঁ পাড়িতেছে। মুখখানি রক্তরাঙা, চোখের জলে নিটোল গাল দুইটি চকচক করিতেছে।

মহান্ত যেন কেমন হইয়া গেল। কমলের বুকের উজ্জ্বাসের সংবাদ তাহারও অজ্ঞাত ছিল না। একটা প্রবচন আছে, ‘ছেলে কোলে মরে জলে ফেলব; তবু না পোষ্যপুত্ৰ দিব’। বৈরাগীর অন্তরের স্বামিত্বটুকু এমনই একটি ঈর্ষার আগুনে জুলিয়া মরিতেছিল। তাহার জিহ্বাগ্রে কয়টা কঠিন কথা আসিয়া পড়িল। সে বলিয়া ফেলিল, বলি ও চোখের জল ধোঁয়ার, না মায়ার গো রাইকমল?

মুহূর্তে আহত ফণিনীর মত উগ্র ভঙ্গিতে কমল মুখ তুলিয়া মহান্তের দিকে স্থিরদৃষ্টিতে চাহিল। কিন্তু বিচিত্র রাইকমল, দেখিতে দেখিতে দৃষ্টিতে তীব্রতা তাহার কোথায় মিলাইয়া গেল। ছলছল চোখে সকরুণ হাসি হাসিয়া কমল ধীরে ধীরে কহিল, মায়াই বটে। মহান্ত।

মহান্ত বিষণ্ণ হাসি হাসিল, কোনো উত্তর দিল না। কতক্ষণ পরে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, আমাকে বিদায় দাও তুমি।

কমল স্থিরদৃষ্টি তুলিয়া তাহার দিকে চাহিল, তারপর আবার মুখ নামাইয়া কাজে মন দিল।

মহান্ত কমলের হাত ধরিয়া অতি কোমল কণ্ঠে কহিল, রাইকমল!

কমল হাতখানা টানিয়া লইল। বিদ্যুৎ-ঝলকের মত প্রখর হাসি কমলের অধীরে জাগিয়া উঠিয়া তখনই মিলাইয়া গেল। সে বলিল, আমার মধ্যে পাপ আছে মহান্ত।

অতি সুন্দর হাসি হাসিয়া মহান্ত বলিল, না না কমল। পাপ তোমার নয়, পাপ আমার। আমাকে বিদায় দাও তুমি।

কমল বলিল, না। আবার সে নীরবে উনানের ধূমায়মান আগুনে ফু পাড়িতে লাগিল। সেই দিকে চোখ ফিরাইয়া মহন্ত একসময় আপন মনেই গাহিতে লাগিল–

সুখের লাগিয়া এ ঘর বাঁধিনু
অনলে পুড়িয়া গেল।

গান থামাইয়া মহান্ত ডাকিল, রাইকমল!

কমল সে আহ্বান গ্রাহ্য করিল না। মহান্ত হাসিমুখেই বলিল, বৈষ্ণবী, একটা প্রাণের কথা শোন–

সখি, সুখ দুখ দুটি ভাই।
সুখের লাগিয়া যে করে পীরিতি
দুখ যায় তাঁর ঠাঁই।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress