মামা-ভাগনে
মামা-ভাগনে বলতে আপনার বিশেষ কিছু মনে পড়ে? প্রশ্নটা জটায়ুকে করল ফেলুদা।
আমি অবিশ্যি উত্তরটা জানতাম, কিন্তু লালমোহনবাবু কী বলেন সেটা জানার জন্য তাঁর দিকে কৌতূহলী দৃষ্টি দিলাম।
আঙ্কল অ্যান্ড নেফিউ? চায়ে সশব্দ চুমুক দিয়ে পালটা প্রশ্ন করলেন লালমোহনবাবু।
নো স্যার। ইংরেজি করলে চলবে না। মামা-ভাগনে। বলুন তো দেখি কীসের কথা মনে পড়ে।
দাঁড়ান মশাই, আপনার এই দুম করে করা প্রশ্নগুলো বড় গোলমেলে। মামা ভাগনে…মামা ভাগনে…। উঁহু। আমি হাল ছাড়লুম, এবার আপনি আলোকপাত করুন।
অভিযান ছবিটা দেখেছেন?
সে তো বহুকাল আগে!–ও ইয়েস!–লালমোহনবাবুর চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে উঠল। সেই পাথর। একটা বিরাট চ্যাপটা চাইয়ের উপর আরেকটা বিরাট পাথর ব্যালান্স করা রয়েছে নাকের ডগায়। মনে হয় হাত দিয়ে ঠেলা মারলেই উপরের পাথরটা দুলবে। মামার পিঠে ভাগনে—তাই তো?
রাইট। ব্যাপারটা কোথায় সেটা মনে পড়ছে?
কোন জেলা বলুন তো!
বীরভূম।
ঠিক ঠিক।
অথচ ও অঞ্চলটায় একবারও ঢুঁ মারা হয়নি। আপনি গেছেন?
টু টেল ইউ দ্য টুথ-নো স্যার।
ভাবুন তো দেখি! –আপনি লেখক, তা যেরকম লেখাই লিখুন না কেন। অথচ রবীন্দ্ৰনাথ যেখানে তাঁর অধিকাংশ জীবন কাটিয়েছেন, সেইখানেই যাননি। কী লজ্জার কথা বলুন তো দেখি!
যাব যাব করেও যাওয়া হয়নি মশাই। আর সত্যি বলতে কী, আমরা তো ট্যাগোরের রাস্তা ছেড়ে অন্য রাস্ত ধরিচি কিনা, তাই শান্তিনিকেতন-টেন্তনকে তেমন আর পাত্তা দিইনি। হনলুলুতে হুলুস্থূল যে লিখছে সে আর কবিগুরু থেকে কী প্রেরণা পেতে পারে বলুন!
আপনি বীরভূম বলতে আশা করি শুধু শান্তিনিকেতন ভাবছেন না। বক্ৰেশ্বরের হট স্প্রিংস আছে, কেন্দুলিতে কবি জয়দেবের জন্মস্থান আছে, বামাক্ষ্যাপা যেখানে সাধনা করতেন। সেই তারাপীঠ আছে, মামা-ভাগনের দুবরাজপুর আছে, অজস্ৰ পোড়া ইটের মন্দির আছে–
সেটা আবার কী দেখবার জিনিস মশাই?
টেরা কোটা জানেন না? বাংলার এক বড় সম্পদ!
ট্যাড়া কোঠা? মানে, ব্যাক বাড়ি?
কেউ কোনও বিষয়ে অজ্ঞতা প্রকাশ করলে ফেলুদার স্কুলমাস্টার মূর্তিটা বেরিয়ে পড়ে। ও বলল–
টেরা-টি হুঁ আর আর এ-ল্যাটিন ও ইটালিয়ান কথা, মানে মাটি; আর কোটা-সি ও ডবল টি এ—এও ইটালিয়ান কথা, মানে পোড়া। মাটি আর বালি মিশিয়ে তা দিয়ে নানারকম মূর্তি ইত্যাদি গড়ে উনুনের আঁচে রেখে দিলে যে লাল চেহারাটা নেয়। তাকে বলে টেরা কোটা। যেমন সাধারণ ইট। যেটা বানানো হয় সেটা যে শুধু দেখতে সুন্দর তা নয়, টেকসইও বটে। এই টেরা কোটার মন্দির ছড়িয়ে আছে। সারা পশ্চিম বাংলায় আর বাংলাদেশে। তার মধ্যে সেরা মন্দির কিছু পাওয়া যাবে বীরভূমে। তার কোনও কোনওটা আড়াইশো-তিনশো বছরের পুরনো। কারুকার্য দেখলে মাথা ঘুরে যায়। বাংলার এ সম্পদ সম্বন্ধে যে ওয়াকিবহাল নয়। সে বাংলার কিছুই জানে না।
বুঝলাম। জানলাম। আমার ঘাট হয়েছে। কাইন্ডলি এক্সকিউজ মাই ইগনোরান্স।
আপনি জানেন না, অথচ একজন শ্বেতাঙ্গ অধ্যাপক এই নিয়ে যা কাজ করে গেছেন তার তুলনা নেই।
কার কথা বলছেন?
ডেভিড ম্যাককাচন। অকাল মৃত্যু তাঁর কাজ শেষ করতে দেয়নি, কিন্তু তাও যা করেছেন তার জবাব নেই। আপনি খবরের কাগজের হেডলাইন ছাড়া আর কিছু পড়েন না জানি—তাই আজ স্টেটসম্যানে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধ আপনার দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে তা অনুমান করতে পারি। না হলে ডেভিড ম্যাককাচনের উল্লেখ সেখানে পেতেন।
কী লেখা বলুন তো।
রবার্টসনস রুবি।
রাইট, রাইট। লেখার নামটা দেখে আর রুবির রঙিন ছবিটা দেখে পড়তে আরম্ভ করেছিলাম, কিন্তু ধোপা এসে সব মাটি করে দিল।
প্রবন্ধের লেখক পিটার রবার্টসন এখন এখানে। ভারতপ্রেমিক বলে মনে হল। ম্যাককাচনের লেখা পড়ে বীরভূমের মন্দির দেখতে চায়, তা ছাড়া ট্যাগোরের শান্তিনিকেতন দেখতে চায়।
কিন্তু রুবির ব্যাপারটা কীভাবে আসছে?
এই পিটারের এক পূর্বপুরুষ প্যাট্রিক রবার্টসন সিপাইদের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন। বেঙ্গল রেজিমেন্টে ক্যাপ্টেন ছিলেন। যুদ্ধ যখন শেষ হয় এবং ব্রিটিশদের জয় হয়, প্যাট্রিক তখন লখ্নৌতে। মোটে ছাব্বিশ বছর বয়স। ইংরেজ সেনা ছলেবলে নবাবের প্রাসাদে লুটতরাজ করে এবং মহামূল্য মণিমুক্তা নিয়ে পালায়। প্যাট্রিক রবার্টসন একটি রুবি পান যার আয়তন একটা পায়রার ডিমের সমান। সেই রুবি প্যাট্রিকের সঙ্গে ইংল্যান্ডে আসে এবং প্যাট্রিকের মৃত্যুর পর রবার্টসন পরিবারেই থেকে যায়। লোকে উল্লেখ করত। রবার্টসনস রুবি বলে। সম্প্রতি প্যাট্রিকের একটি শেষ বয়সের ডায়রি পাওয়া গেছে যার অস্তিত্ব আগে জানা ছিল না। তাতে প্যাট্রিক লখ্নৌয়ের লুটতরাজের উল্লেখ করে গভীর অনুশোচনা প্রকাশ করেছেন। প্যাট্রিক বলেছেন তাঁর আত্মা শান্তি পাবে শুধুমাত্র যদি তাঁর কোনও বংশধর ভারতবর্ষ থেকে লুট করে আনা এই রুবি আবার ভারতবর্ষে ফেরত দিয়ে দেয়। পিটার সেই পাথর সঙ্গে করে এনেছে, এবং যাবার আগে এখানে কোনও মিউজিয়ামে দিয়ে যাবে।
লালমোহনবাবু পুরো ব্যাপারটা শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, কেন্দুলিতে শীতকালে দারুণ মেলা হয় বলে শুনেছি।
ঠিকই শুনেছেন। দলে দলে বাউল আসে। সেই মেলাতে।
সেটা ঠিক কখন হয় মশাই?
এই এখন। মকর সংক্রাস্তিতে শুরু হয়েছে।
হোয়াট ইজ দ্য বেস্ট ওয়ে টু গো?
লালমোহনবাবুর মাঝে মাঝে একটা সাহেবি মেজাজ প্রকাশ পায়। উনি বলেন সেটা ওঁর গল্প লেখার জন্য অনেক ইংরেজি বই কনসাল্ট করতে হয় বলে।
ফেলুদা বলল, সত্যিই যেতে চাইছেন বীরভূম?
ভেরি ম্যাচ সো।
তা হলে আমি বলি কী, আপনি হরিপদবাবুকে বলুন সোজা আপনার গাড়ি নিয়ে বোলপুর চলে যেতে। আমরা সেদিনই শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেসে চলে যাব। যাবার আগে অবশ্য টুরিস্ট লজে বুকিং করে নিতে হবে। ফাস্ট ট্রেন; শুধু বর্ধমানে থামে; আড়াই ঘণ্টায় শান্তিনিকেতন পৌঁছে যাব।
ট্রেনেই যাব বলছেন?
তার কারণ আছে। শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেসে লাউঞ্জ করে বলে একটা ফাস্ট ক্লাস এয়ারকন্ডিশনড় বগি থাকে। এতে করিডর নেই, সেই আদ্যিকালের কামরার মতো চওড়া। পঁচিশ ত্ৰিশজন যায়, বৈঠকখানার মতো সোফা কাউচ টেবিল পাতা রয়েছে। এ সুযোগ ছাড়া উচিত নয়।
জিহ্বা দিয়ে লালাক্ষরণ হচ্ছে মশাই। তা হলে একটা কাজ করি। –শতদলকে একটা পোস্টকার্ড ড্রপ করে দিই।
শতদলটা কে?
শতদল সেন। এক স্কুলে এক ক্লাসে পড়িচি, এখন বিশ্বভারতীর ইতিহাসের অধ্যাপক। ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র ছিল মশাই, আমি ওকে কোনওদিন টেক্কা দিতে পারিনি।
তার মানে আপনিও ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র ছিলেন বলছেন?
তা বাংলার জনপ্রিয়তম থ্রিলার রাইটার সম্বন্ধে সেটা কি বিশ্বাস করা খুব কঠিন ব্যাপার?
—তা আপনার বর্তমান আই কিউ-৫ পর্যন্ত বলে ফেলুদা আর কথাটা শেষ করল না। বলল, লিখে দিন আপনার বন্ধুকে।
দুদিনের মধ্যে সব ব্যবস্থা হয়ে গেল। বোলপুর টুরিস্ট লজে একটা ডাবল আর একটা সিঙ্গল রুম বুক করা হয়েছে। গরম কাপড় বেশ ভালরকম নিতে হবে, কারণ এটা জানুয়ারি মাস, শান্তিনিকেতনে কলকাতার চেয়ে বেশি শীত। ইতিমধ্যে আমি ডেভিড ম্যাককাচনের বইটায় একবার চোখ বুলিয়ে নিয়েছি। দেখে অবাক লাগছিল যে একজন লোক কী করে এত জায়গায় ঘুরে এত খুঁটিনাটি তথ্য সংগ্রহ করেছে। বাংলার এই আশ্চর্য সম্পদ সম্বন্ধে আমার কোনও ধারণাই ছিল না।
শনিবার সকালে লালমোহনবাবুর সবুজ অ্যাম্বাসাডর নিয়ে হরিপদবাবু বেরিয়ে পড়লেন। পানাগড় অবধি গিয়ে ডাইনে ঘুরতে হবে, তারপর অজয় নদী পেরিয়ে ইলামবাজার দিয়ে বোলপুর।
আমরা সাড়ে নটায় হাওড়া স্টেশনে জড়ো হলাম। লালমোহনবাবু বললেন, আমার দুদিন থেকে ডান চোখটা নাচছে; সেটা গুড সাইন না ব্যান্ড সাইন, মশাই?
ফেলুদা বলল, আপনি খুব ভাল করেই জানেন আমি ও ধরনের কুসংস্কারে বিশ্বাস করি না, তাও কেন জিজ্ঞেস করছেন বলুন তো!
লালমোহনবাবু কেমন যেন মুষড়ে পড়ে বললেন, একবার ভাবলুম এটা হয়তো কোনও আসন্ন তদন্তের লক্ষণ; তারপর মনে হল ট্যাগোরের সঙ্গে ক্রাইমের কোনও রকম সম্পর্ক থাকা একেবারেই অসম্ভব। কাজেই ওটা আপনি মন থেকে দূর করে দিতে পারেন, ফেলুবাবু।