Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

চতুর্থ খণ্ড
সকলের কথা

প্রথম পরিচ্ছেদ : লবঙ্গলতার কথা

বড় গোল বাধিল। আমি ত সন্ন্যাসী ঠাকুরের হাতেপায়ে ধরিয়া, কাঁদিয়া কাটিয়া, শচীন্দ্রকে রজনীর বশীভূত করিবার উপায় করিতেছি। সন্ন্যাসী তন্ত্রসিদ্ধ ; জগদম্বার কৃপায় যাহা মনে করেন, তাই করিতে পারেন। মিত্র মহাশয় ষষ্টি বৎসর বয়সে যে, এ পামরীর এত বশীভূত, তাহা আমার গুণে, কি সন্ন্যাসী ঠাকুরের গুণে, তাহা বলিয়া উঠা ভার ; আমিও কায়মনোবাক্যে পতিপদসেবার ত্রুটি করি না, ব্রহ্মচারীও আমার জন্য যাগ, যজ্ঞ, তন্ত্র, মন্ত্র প্রয়োগে ত্রুটি করেন না। যাহার জন্য যাহা তিনি করিয়াছেন, তাহা ফলিয়াছে। কামারবউর পিতলের টুক‍্‍নী সোণা করিয়া দিয়াছিলেন-উনি না পারেন কি? উঁহার মন্ত্রৌষধির গুণে শচীন্দ্র যে রজনীকে ভালবাসিবে-রজনীকে বিবাহ করিতে চাহিবে, তাহাতে আমার কোন সন্দেহই নাই, কিন্তু তবু গোল বাধিয়াছে। গোলযোগ অমরনাথ বাধাইয়াছে। এখন শুনিতেছি, অমরনাথের সঙ্গেই রজনীর বিবাহ স্থির হইয়াছে।
রজনীর মাসী মাসুয়া, রাজচন্দ্র এবং তাহার স্ত্রী, আমাদিগের দিকে। তাহার কারণ, কর্তা বলিয়াছেন, বিবাহ যদি হয়, তবে তোমাদিগকে ঘটকবিদায়স্বরূপ কিছু দিব। কথাটা ঘটকবিদায়, কিন্তু আঁচটা দু হাজার দশ হাজার। কিন্তু তাহারা আমাদিগের দিকে হইলেও কিছু হইতেছে না। অমরনাথ ছাড়িতেছে না। সে নিশ্চয় রজনীকে বিবাহ করিবে, জিদ করিতেছে।
ভাল, অমরনাথ কে? মেয়ের বিবাহ দিবার কর্তা হইল, তাহার মাসুয়া মাসী-বাপ-মা বলাই উচিত-রাজচন্দ্র ও তাহার স্ত্রী, তাহারা যদি আমাদিগের দিকে, তবে অমরনাথের জিদে কি আসিয়া যায়? সে তাহাদিগকে বিষয় দেওয়াইয়া দিয়াছে বটে, কিন্তু তাহার মেহনতানা দুই চারি হাজার ধরিয়া দিলেই হইবে। আমার ছেলের বৌ করিব বলিয়া আমি যে কন্যার সম্বন্ধ করিতেছি, অমরনাথ কি না তাহাকে বিবাহ করিতে চায়? অমরনাথের এ বড় স্পর্ধা! আমি একবার অমরনাথকে কিছু শিক্ষা দিয়াছি-আর একবার না হয় কিছু দিব। আমি যদি কায়েতের মেয়ে হই, তবে অমরনাথের নিকট হইতে এই রজনীকে কাড়িয়া লইয়া আমার ছেলের সঙ্গে বিবাহ দিব।
আমি অমরনাথের সকল গুণ জানি। অমরনাথ অত্যন্ত ধূর্ত-তাহার সঙ্গে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইলে বড় সতর্ক হইয়া কাজ করিতে হয়। আমি সতর্ক হইয়াই কার্য আরম্ভ করিলাম।
প্রথমে রাজচন্দ্র দাসের স্ত্রীকে ডাকিয়া পাঠাইলাম। সে আসিলে জিজ্ঞাসা করিলাম, “কেন গা?__”
মালী বৌ-রাজচন্দ্রের স্ত্রীকে আমরা আজিও মালী বৌ বলিতাম, রাগ না হইলে বরং বলিতাম
না, রাগ হইলেই মালী বৌ বলিতাম-মালী বৌ বলিল, “কি গা?”
আমি। মেয়ের বিয়ে নাকি অমর বাবুর সঙ্গে দিবে?
মালী বৌ। সেই কথাই ত এখন হচ্চে।
আমি। কেন হচ্চে? আমাদের সঙ্গে কি কথা হইয়াছিল?
মালী বৌ। কি করিব মা-আমি মেয়ে মানুষ, অত কি জানি?
মাগীর মোটা বুদ্ধি দেখিয়া আমার বড় রাগ হইল-আমি বলিলাম, “সে কি মালী বৌ? মেয়ে মানুষে জানে না ত কি পুরুষ মানুষে জানে? পুরুষ মানুষ আবার সংসার ধর্ম কুটুম্ব কুটুম্বিতার কি জানে? পুরুষ মানুষ মাথায় মোট করিয়া টাকা বহিয়া আনিয়া দিবে এই পর্যন্ত-পুরুষ মানুষ আবার কর্তা না কি?”
প্রথম পরিচ্ছেদ : লবঙ্গলতার কথা
বোধ হয়, মাগীর মোটাবুদ্ধিতে আমার কথাগুলো অসঙ্গত বোধ হইল-সে একটু হাসিল। আমি বলিলাম, “তোমার স্বামীর কি মত-অমরনাথের সঙ্গে মেয়ের বিবাহ দেন?”
মালী বৌ বলিল, “তার মত নয়-তবে অমরনাথ বাবু হইতেই রজনী বিষয় পাইয়াছে-তাঁর বাধ্য হইতেই হয় |”
আমি। তবে অমরনাথ বাবুকে বল গিয়া, বিষয় রজনী এখনও পায় নাই। বিষয় আমাদের ; বিষয় আমরা ছাড়িব না। পার, তোমরা বিষয় মোকদ্দমা করিয়া লও গিয়া।
মালী বৌ। সে কথা আগে বলিলেই হইত। এতদিনে মোকদ্দমা উপস্থিত হইত।
আমি। মোকদ্দমা করা মুখের কথা নহে। টাকার শ্রাদ্ধ। রাজচন্দ্র দাস ফুল বেচিয়া কত টাকা করিয়াছে?
মালী বৌ রাগে গর গর করিতে লাগিল। সত্য বলিতেছি, আমার কিছুই রাগ হয় নাই। মালী বৌ একটু রাগ সামলাইয়া বলিল, “অমর বাবু আমার জামাই হইলেই বিষয় অমর বাবুর হইবে। তিনি টাকা দিয়া মোকদ্দমা করিতে পারেন, তাঁহার এমন শক্তি আছে |”
এই বলিয়া মালী বৌ উঠিয়া যায়, আমি তাহার আঁচল ধরিয়া বসাইলাম। মালী বৌ হাসিয়া বসিল। আমি বলিলাম, “অমর বাবু মোকদ্দমা করিয়া বিষয় লইলে তোমার কি উপকার?”
মালী বৌ। আমার মেয়ের সুখ হবে।
আমি। আর আমার ছেলের সঙ্গে তোমার মেয়ের বিয়ে হলে বুঝি বড় দু:খ হবে?
মালী বৌ। তা কেন? তবে যেখানে থাকে, আমার মেয়ে সুখী হইলেই হইল।
আমি। তোমাদের নিজের কিছু সুখ চাহি না?
মালী বৌ। আমাদের আবার কি সুখ? মেয়ের সুখই আমাদের সুখ।
আমি। ঘটকালীটা?
মালী বৌ মুখ মুচকিয়া হাসিল। বলিল, “আসল কথা বলিব মা ঠাকুরাণি? এখানে বিয়ের মেয়ের মত নাই |”
আমি। সে কি? কি বলে?
মালী বৌ। এখানকার কথা হইলেই বলে, কাণার আবার বিয়ের কাজ কি?
আমি। আর অমরনাথের সঙ্গে বিয়ের কথা হইলে?
মালী বৌ। বলে, ওঁ হতে আমাদের সব। উনি যা বলিবেন, তাই করিতে হইবে।
আমি। তা বিয়ের কন্যার আবার মতামত কি? মা-বাপের মতামত হইলেই হইল।
মালী বৌ। রজনী ত ক্ষুদে মেয়ে নয়, আর আমার পেটের সন্তানও নয়। আর বিষয় তার, আমাদের নয়। সে আমাদের হাঁকাইয়া দিলে আমরা কি করিতে পারি? বরং তার মত রাখিয়াই আমাদের এখন চলিতে হইতেছে।
আমি ভাবিয়া চিন্তিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম-“রজনীর সঙ্গে অমরনাথের দেখাশুনা হয় কি?”
মালী বৌ। না। অমর বাবু দেখা করেন না।
আমি। আমার সঙ্গে রজনীর একবার দেখা হয় না কি?
মালী বৌ। আমারও তাই ইচ্ছা। আপনি যদি তাহাকে বুঝাইয়া পড়াইয়া তাহার মত করাইতে পারেন। আপনাকে রজনী বিশেষ ভক্তি শ্রদ্ধা করে।
আমি। তা চেষ্টা করিয়া দেখিব। কিন্তু রজনীর দেখা পাই কি প্রকারে? কাল তাহাকে এ বাড়ীতে একবার পাঠাইয়া দিতে পার?
মালী বৌ। তার আটক কি? সে ত এই বাড়ীতেই খাইয়া মানুষ। কিন্তু যার বিয়ের সম্বন্ধ হইতেছে, তাহাকে কি শ্বশুরবাড়ীতে অমন অদিনে অক্ষণে বিয়ের আগে আসিতে আছে?
মর মাগী! আবার কাচ! কি করি, আমি অন্য উপায় না দেখিয়া বলিলাম, “আচ্ছা, রজনী না আসিতে পারে, আমি একবার তোমাদের বাড়ী যাইতে পারি কি?
মালী বৌ। সে কি! আমাদের কি এমন ভাগ্য হইবে যে, আপনার পায়ের ধূলা আমাদের বাড়ীতে পড়িবে?
আমি। কুটুম্বিতা হইলে আমার কেন, অনেকেরই পড়িবে। তুমি আমাকে আজ নিমন্ত্রণ করিয়া যাও।
মালী বৌ। তা আমাদের বাড়ীতে আপনাকে পাঠাইতে কর্তার মত হইবে কেন?
আমি। পুরুষ মানুষের আবার মতামত কি? মেয়ে মানুষের যে মত, পুরুষ মানুষেরও সেই মত।
মালী বৌ যোড়হাত করিয়া হাসিতে হাসিতে বিদায় গ্রহণ করিল।

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ : অমরনাথের কথা

রজনীর সম্পত্তির উদ্ধার জন্য আমার এত কষ্ট সফল হইয়াছে, মিত্রেরাও নির্বিবাদে বিষয় ছাড়িয়া দিয়াছে, তথাপি বিষয়ে দখল লওয়া হয় নাই, ইহা শুনিয়া অনেকে চমৎকৃত হইতে পারেন। তাহাতে আমিও কিছু বিস্মিত। বিষয় আমার নহে, আমি দখল লইবার কেহ নহি। বিষয় রজনীর, সে দখল না লইলে কে কি করিতে পারে? কিন্তু রজনী কিছুতেই বিষয়ে দখল লইতে সম্মত নহে। বলে-আজ নহে-আর দুই দিন যাক-পশ্চাৎ দখল লইবেন ইত্যাদি। দখল না লউক-কিন্তু দরিদ্রকন্যার ঐশ্বর্যে এত অনাস্থা কেন, আমি অনেক ভাবিয়া চিন্তিয়া কিছুই স্থির করিতে পারিতেছি না। রাজচন্দ্র এবং রাজচন্দ্রের স্ত্রীও এ বিষয়ে রজনীকে অনুরোধ করিয়াছে, কিন্তু রজনী বিষয়ে সম্প্রতি দখল লইতে চায় না। ইহার মর্ম কি? কাহার জন্য এত পরিশ্রম করিলাম?
ইহার যা হয়, একটা চূড়ান্ত স্থির করিবার জন্য আমি রজনীর সহিত সাক্ষাৎ করিতে গেলাম। রজনীর সঙ্গে আমার বিবাহের কথা উত্থাপিত হওয়া অবধি আমি আর রজনীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করিতে বড় যাইতাম না-কেন না, এখন আমাকে দেখিলে রজনী কিছু লজ্জিতা হইত। কিন্তু আজ না গেলে নয় বলিয়া রজনীর কাছে গেলাম। সে বাড়ীতে আমার অবারিত দ্বার। আমি রজনীর সন্ধানে তাহার ঘরে গিয়া তাহাকে দেখিতে পাইলাম না। ফিরিয়া আসিতেছি, এমত সময়ে দেখিতে পাইলাম, রজনী আর একটি স্ত্রীলোকের সঙ্গে উপরে উঠিতেছে। সে স্ত্রীলোককে দেখিয়াই চিনিলাম-অনেকদিন দেখি নাই, কিন্তু দেখিয়াই চিনিলাম যে, ঐ গজেন্দ্রগামিনী ললিতলবঙ্গলতা!
রজনী ইচ্ছাপূর্বক জীর্ণ বস্ত্র পরিয়াছিল, লজ্জায় সে লবঙ্গলতার সঙ্গে ভাল করিয়া কথা কহিতেছিল না। লবঙ্গলতা হাসিতে উছলিয়া পড়িতেছিল-রাগ বা বিদ্বেষের কিছুমাত্র লক্ষণ দেখা গেল না।
সে হাসি অনেকদিন শুনি নাই। সে হাসি তেমনই ছিল-পূর্ণিমার সমুদ্রে ক্ষুদ্র তরঙ্গের তুল্য, সুপুষ্প বসন্তলতার আন্দোলন তুল্য-তাহা হইতে সুখ, ভাঙ্গিয়া ভাঙ্গিয়া, ঝরিয়া পড়িতেছিল।
আমি অবাক হইয়া নিষ্পন্দশরীরে, সশঙ্কচিত্তে, এই বিচিত্রচরিত্রা, রমণীর মানসিক শক্তির আলোচনা করিতেছিলাম। ললিতলবঙ্গলতা কিছুতেই টলে না। লবঙ্গলতা মহান ঐশ্বর্য হইতে দারিদ্র্যে পড়িয়াছে-তবু সেই সুখময় হাসি; যে রজনী হইতে এই ঘোর বিপদ ঘটিয়াছে, তাহারই গৃহে উঠিতেছে, তাহার সঙ্গে আলাপ করিতেছে, তবু সেই সুখময় হাসি। আমি সম্মুখে-তবু সেই সুখময় হাসি! অথচ আমি জানি, লবঙ্গ কোন কথাই ভুলে নাই।
আমি সরিয়া পার্শ্বের ঘরে গেলাম। লবঙ্গলতা প্রথমে সেই ঘরে প্রবেশ করিল-নি:শঙ্কচিত্তে, আজ্ঞাদায়িনী রাজরাজেশ্বরীর ন্যায় রজনীকে বলিল, “রজনি-তুই এখন আর কোথাও যা! তোর বরের সঙ্গে আমার গোপনে কিছু কথা আছে। ভয় নাই! তোর বর সুন্দর হলেও আমার বৃদ্ধ স্বামীর অপেক্ষা সুন্দর নহে |” রজনী অপ্রতিভ হইয়া, কি ভাবিতে ভাবিতে সরিয়া গেল।
ললিতলবঙ্গলতা, ভ্রূকুটি কুটিল করিয়া, সেই মধুর হাসি হাসিয়া, ইন্দ্রাণীর মত আমার সম্মুখে দাঁড়াইল। একবার বৈ কেহ অমরনাথকে আত্মবিস্মৃত দেখে নাই। আবার আত্মবিস্মৃত হইলাম। সেবারও ললিতলবঙ্গলতা-এবারও ললিতলবঙ্গলতা।
লবঙ্গ হাসিয়া বলিল, “আমার মুখপানে চাহিয়া কি দেখিতেছ? তোমার অর্জিত ঐশ্বর্য কাড়িয়া লইতে আসিয়াছি কি না? মনে করিলে তাহা পারি |”
আমি বলিলাম, “তুমি সব পার, কিন্তু ঐটি পার না। পারিলে কখন রজনীকে বিষয় দিয়া, এখন স্বহস্তে রাঁধিয়া সতীনকে খাওয়াইবার বন্দোবস্ত করিতে না |”
লবঙ্গ উচ্চ হাসি হাসিয়া বলিল, “ওটা বুঝি বড় গায়ে লাগিবে মনে করেছ? সতীনকে রাঁধিয়া দিতে হয়, বড় দু:খের কথা বটে ; কিন্তু একটা পাহারাওয়ালাকে ডাকিয়া তোমাকে ধরাইয়া দিলে, এখনই আবার পাঁচটা রাঁধুনি রাখিতে পারি |”
আমি বলিলাম, “বিষয় রজনীর ; আমাকে ধরাইয়া দিলে কি হইবে? যাহার বিষয় সে ভোগ করিতে থাকিবে |”
ল। তুমি কস্মিন্‌কালে স্ত্রীলোক চিনিলে না। যাহাকে ভালবাসে, তাহাকে রক্ষার জন্য রজনী এখনই বিষয় ছাড়িয়া দিবে।
আমি। অর্থাৎ আমার রক্ষার জন্য বিষয়টা তোমায় ঘুষ দিবে।
ল। তাই।
আমি। তবে এতদিন সে ঘুষ চাও নাই, আমাদিগের বিবাহ হয় নাই বলিয়া। বিবাহ হইলেই সে ঘুষ চাহিবে।
ল। তোমার মত ছোটলোকে বুঝিবে কি প্রকারে? চোরেরা বুঝিতে পারে না যে, পরের দ্রব্য অস্পৃশ্য। রজনীর সম্পত্তি রাখিতে পারিলেও আমি রাখিব কেন?
আমি বলিলাম, “তুমি যদি এমন না হবে, তবে আমার সে মরণ কুবুদ্ধি ঘটিবে কেন? যদি আমার এত অপরাধ মার্জনা করিয়াছ, এত অনুগ্রহ করিয়াছ, তবে আর একটি ভিক্ষা আছে। যাহা জান, তাহা যদি অন্যের কাছে না বলিয়াছ, তবে রজনীর কাছেও বলিও না |”
দর্পিতা লবঙ্গলতা ভ্রূভঙ্গী করিল-কি সুন্দর ভ্রূভঙ্গী! বলিল, “আমি কি ঠক! যে তোমার স্ত্রী হইবে, তাহার কাছে তোমার নামে ঠকাম করিবার জন্য কি আমি তাহার বাড়ীতে আসিয়াছি?”
এই বলিয়া লবঙ্গলতা হাসিল। তাহার হাসির মর্ম আমি কিছু কখন বুঝিতে পারি না। লবঙ্গ বিলক্ষণ রাগিয়া উঠিয়াছিল-কিন্তু হাসিতে সব রাগ ভাসিয়া গেল। যেন জলের উপর হইতে মেঘের ছায়া সরিয়া গেল, তাহার উপর মেঘমুক্ত চন্দ্রের ন্যায় জ্বলিতে লাগিল। আমি লবঙ্গলতার মর্ম কখন বুঝিতে পারিলাম না।
হাসিয়া লবঙ্গ বলিল, “তবে আমি রজনীর কাছে যাই |”
“যাও |”
ললিতলবঙ্গলতা, ললিত লবঙ্গলতার মত দুলিতে দুলিতে চলিল। ক্ষণেক পরে আমাকে ডাকিয়া পাঠাইল। গিয়া দেখিলাম, লবঙ্গলতা দাঁড়াইয়া আছে। রজনী তাহার পায়ে হাত দিয়া কাঁদিতেছে। আমি গেলে লবঙ্গলতা বলিল, “শুন, তোমার ভবিষ্যৎ ভার্যা কি বলিতেছে! তোমার সম্মুখে নহিলে এমন কথা আমি কাণে শুনিব না |”
আমি বিস্মিত হইয়া বলিলাম, “কি?”
লবঙ্গলতা রজনীকে বলিল, “বল। তোমার বর আসিয়াছেন___”
রজনী সকাতরে অশ্রুপূর্ণলোচনে ললিতলবঙ্গলতার চরণস্পর্শ করিয়া বলিল, “আমার এই ভিক্ষা, আমার যে কিছু সম্পত্তি আছে, এই বাবুর যত্নে আমার যে সম্পত্তি উদ্ধৃত হইয়াছে, আমি লেখাপড়া করিয়া আপনাকে দান করিব, আপনি গ্রহণ করিবেন না কি?”
আহ্লাদে আমার সর্বান্ত:করণ প্লাবিত হইল-আমি রজনীর জন্য যে যত্ন করিয়াছিলাম-যে ক্লেশ স্বীকার করিয়াছিলাম-তাহা সার্থক বোধ হইল। আমি পূর্বেই বুঝিয়াছিলাম, এখন আয়ও পরিষ্কার বুঝিলাম যে, রমণীকুলে, অন্ধ রজনী অদ্বিতীয় রত্ন! লবঙ্গলতার প্রোজ্জ্বল জ্যোতিও তাহার কাছে ম্লান হইল। আমি ইতিপূর্বেই রজনীর অন্ধ নয়নে আত্মসমর্পণ করিয়াছিলাম-আজি তাহার কাছে বিনামূল্যে বিক্রীত হইলাম। এই অমূল্য রত্নে আমার অন্ধকারপুরী প্রভাসিত করিয়া, এ জীবন সুখে কাটাইব। বিধাতা আমার কি সেদিন করিবেন না!

তৃতীয় পরিচ্ছেদ : লবঙ্গলতার কথা

আমি মনে করিয়াছিলাম, রজনীর এই বিস্ময়কর কথা শুনিয়া, অমরনাথ আগুনে সেঁকা কলাপাতের মত শুকাইয়া উঠিবে। কই, তাহা ত কিছুই দেখিলাম না। তাহার মুখ না শুকাইয়া বরং প্রফুল্ল হইল। বিস্মিত হতবুদ্ধি, যা হইবার, তাহা আমিই হইলাম।
আমি প্রথমে তামাসা মনে করিলাম, কিন্তু রজনীর কাতরতা, অশ্রুপাত এবং দার্ঢ্য দেখিয়া আমার নিশ্চয় প্রতীতি জন্মিল যে, রজনী আন্তরিক বলিতেছে। আমি বলিলাম, “রজনী! কায়েতের কুলে তুমিই ধন্য! তোমার মত কেহ নাই। কিন্তু আমি তোমার দান গ্রহণ করিব না |”
রজনী বলিল, “না গ্রহণ করেন, আমি ইহা বিলাইয়া দিব |”
আমি। অমরনাথ বাবুকে?
র। আপনি উঁহাকে সবিশেষ চিনেন না; আমি দিলেও উনি লইবেন না। লইবার অন্য লোক আছে।
আমি। অমরনাথ বাবু কি বল?
আমি। আমার সঙ্গে কোন কথা হইতেছে না, আমি কি বলিব?
আমি বড় ফাঁপরে পড়িলাম; রজনী যে বিষয় ছাড়িয়া দিতেছে, তাহাতে বিস্মিত; আবার অমরনাথ যে বিষয় উদ্ধারের জন্য এত করিয়াছিল, যাহার লোভে রজনীকে বিবাহ করিবার জন্য উদ্যোগ করিতেছে, সে বিষয় হাতছাড়া হইতেছে, দেখিয়াও সে প্রফুল্ল। কাণ্ডখানা কি?
আমি অমরনাথকে বলিলাম, যদি স্থানান্তরে যাও, তবে আমি রজনীর সঙ্গে সকল কথা মুখ ফুটিয়া কই। অমরনাথ অমনি সরিয়া গেল। আমি তখন রজনীকে বলিলাম, “সত্যসত্যই কি তুমি বিষয় বিলাইয়া দিবে?”
“সত্যসত্যই। আমি গঙ্গাজল নিয়া শপথ করিয়া বলিতেছি |”
আমি। আমি তোমার দান লই, তুমি যদি আমার কিছু দান লও।
র। অনেক লইয়াছি।
আমি। আরও কিছু লইতে হইবে।
র। একখানি প্রসাদি কাপড় দিবেন।
আমি। তা না। আমি যা দিই, তাই নিতে হইবে।
র। কি দিবেন?
আমি। শচীন্দ্র বলিয়া আমার একটি পুত্র আছে। আমি তোমাকে শচীন্দ্র দান করিব। স্বামিস্বরূপ তুমি তাহাকে গ্রহণ করিবে। তুমি যদি তাহাকে গ্রহণ কর, তবেই আমি তোমার বিষয় গ্রহণ করিব।
রজনী দাঁড়াইয়াছিল, ধীরে ধীরে বসিয়া পড়িয়া, অন্ধ নয়ন মুদিল। তার পর তাহার মুদিত নয়ন হইতে অবিরল জলধারা পড়িতে লাগিল-চক্ষের জল আর ফুরায় না। আমি বিষম বিপদে পড়িলাম। রজনী কথা কহে না-কেবল কাঁদে। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “কি রজনী! অত কাঁদ কেন?”
রজনী কাঁদিতে কাঁদিতে বলিল, “সে দিন গঙ্গার জলে আমি ডুবিয়া মরিতে গিয়াছিলাম-ডুবিয়াছিলাম, লোকে ধরিয়া তুলিল। সে শচীন্দ্রের জন্য। তুমি যদি বলিতে, তুমি অন্ধ, তোমার চক্ষু ফুটাইব দিব-আমি তাহা চাহিতাম না-আমি শচীন্দ্র চাহিতাম। শচীন্দ্রের অপেক্ষা এ জগতে আর কিছুই নাই-আমার প্রাণ তাঁহার কাছে, দেবতার কাছে ফুলের কলিমাত্র-শ্রীচরণে স্থান পাইলেই সার্থক। অন্ধের দু:খের কথা শুনিবে কি?”
আমি রজনীর কাতরতা দেখিয়া কাতর হইয়া বলিলাম, “শুনিব |”
তখন রজনী কাঁদিতে কাঁদিতে হৃদয় খুলিয়া, আমার কাছে সকল কথা বলিল। শচীন্দ্রের কণ্ঠ, শচীন্দ্রের স্পর্শ, অন্ধের রূপোন্মাদ! তাহার পলায়ন, নিমজ্জন, উদ্ধার, সকল বলিল। বলিয়া বলিল, “ঠাকুরাণি, তোমাদের চক্ষু আছে-চক্ষু থাকিলে এত ভালবাসা বাসিতে পারে কি?”
মনে মনে বলিলাম, “কাণি! তুই ভালাবাসার কি জানিস! তুমি লবঙ্গলতার অপেক্ষা সহস্রগুণে সুখী |” প্রকাশ্যে বলিলাম, “না রজনী, আমার বুড়া স্বামী-আমি অত শত জানি না। তুমি শচীন্দ্রকে তবে বিবাহ করিবে, ইহা স্থির?”
রজনী বলিল, “না |”
আমি। সে কি? তবে এত কথা কি বলিতেছিলে-এত কাঁদিলে কেন?
র। আমার সে সুখ কপালে নাই বলিয়াই এত কাঁদিলাম।
আমি। সে কি? আমি বিবাহ দিব।
র। দিতে পারিবেন না। অমরনাথ হইতে আমার সর্বস্ব। অমরনাথ আমার বিষয় উদ্ধারের জন্য যাহা করিয়াছেন, পরের জন্য পরে কি তত করে? তাও ধরি না, তিনি আপনার প্রাণ দিয়া আমার প্রাণরক্ষা করিয়াছেন।
রজনী সে বৃত্তান্ত বলিল। পরে কহিল, “যাঁহার কাছে আমি এত ঋণী, তিনি আমার যাহা করিবেন, তাহাই হইবে। তিনি যখন অনুগ্রহ করিয়া আমাকে দাসী করিতে চাহিয়াছেন, তখন আমি তাঁহারই দাসী হইব, আর কাহারও নহে |”
হরি! হরি! কেন বাছাকে সন্ন্যাসী দিয়া ঔষধ করিলাম! বিবাহ ব্যতীতও বিষয় থাকে-রজনী ত এখনই বিষয় দিতে চাহিতেছে। কিন্তু ছি! রজনীর দান লইব? ভিক্ষা মাগিয়া খাইব-সেও ভাল। আমি বলিয়াছি-আমি যদি এই বিবাহ না দিই ত আমি কায়েতের মেয়ে নই। আমি বিবাহ দিবই দিব। আমি রজনীকে বলিলাম, “তবে আমি তোমার দান লইব না। তুমি যাহাকে ইচ্ছা, তাহাকে দান করিও |” আমি উঠিলাম।
রজনী বলিল, “আর একবার বসুন। আমি অমরনাথ বাবুর দ্বারা একবার অনুরোধ করাইব। তাঁহাকে ডাকিতেছি |”
অমরনাথের সঙ্গে আর একবার সাক্ষাৎ আমারও ইচ্ছা। আমি আবার বসিলাম। রজনী অমরনাথকে ডাকিল।
অমরনাথ আসিলে, আমি রজনীকে বলিলাম, “অমরনাথ বাবু এ বিষয়ে যদি অনুরোধ করিতে চাহেন, তবে সকল কথা কি তোমার সাক্ষাতে খুলিয়া বলিতে পারিবেন? আপনার প্রশংসা আপনি দাঁড়াইয়া শুনিও না |”
রজনী সরিয়া গেল।

চতুর্থ পরিচ্ছেদ : লবঙ্গলতার কথা

আমি অমরনাথকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “তুমি কি রজনীকে বিবাহ করিবে?”
অ। করিব-স্থির।
আমি। এখনও স্থির? রজনীর বিষয় ত রজনী আমাকে দিতেছে।
অ। আমি রজনীকে বিবাহ করিব-বিষয় বিবাহ করিব না।
আমি। বিষয়ের জন্যই ত রজনীকে বিবাহ করিতে চাহিয়াছিলে?
অ। স্ত্রীলোকের মন এমনই কদর্য।
আমি। আমাদের উপর এত অভক্তি কতদিন?
অ। অভক্তি নাই-তাহা হইলে বিবাহ করিতে চাহিতাম না।
আমি। কিন্তু বাছিয়া বাছিয়া অন্ধ কন্যাতে এত অনুরাগ কেন? তাই বিষয়ের কথা বলিতেছিলাম।
অ। তুমি বৃদ্ধতে এত অনুরক্ত কেন? বিষয়ের জন্য কি?
আমি। কাহারও সাক্ষাতে তাহার স্বামীকে বুড়া বলিতে নাই। আমার সঙ্গে রাগারাগি কেন? তুমি কি মুখরা স্ত্রীলোকের মুখকে ভয় কর না?
(কিন্তু রাগারাগি আমার আন্তরিক বাসনা।)
অমরনাথ বলিল, “ভয় করি বই কি? রাগের কথা কিছু বলি নাই। তুমি মিত্রজাকে ভালবাস, আমিও রজনীকে তেমনি ভালবাসি !”
আমি। কটাক্ষের গুণ নাকি?
অ। না। কটাক্ষ নাই বলিয়া। তুমিও কাণা হইলে আরও সুন্দর হইতে।
আমি। সে কথা মিত্রজাকে জিজ্ঞাসা করিব, তোমাকে নহে। সম্প্রতি তুমিও যেমন রজনীকে ভালবাস, আমিও রজনীকে তেমনি ভালবাসি।
অ। তুমিও রজনীকে বিবাহ করিতে চাও নাকি?
আমি। প্রায়। আমি নিজে তাহাকে বিবাহ না করি, তাহার ভাল বিবাহ দিতে চাই। তোমার সঙ্গে তাহার বিবাহ হইতে দিব না।
অ। আমি সুপাত্র। রজনীর এরূপ আর জুটিতেছে না।
আমি। তুমি কুপাত্র। আমি সুপাত্র জুটাইয়া দিব।
অম। আমি কুপাত্র কিসে?
আমি। কামিজটা খুলিয়া পিঠ বাহির কর দেখি?
অমরনাথের মুখ শুকাইয়া কালো হইয়া গেল। অতি দু:খিতভাবে বলিল, “ছি! লবঙ্গ!”
আমার দু:খ হইল, কিন্তু দু:খ দেখিয়া ভুলিলাম না। বলিলাম, “একটি গল্প বলিব শুনিবে?”
আমি কথা চাপা দিতেছি মনে করিয়া অমরনাথ বলিল, “শুনিব |”
আমি তখন বলিতে লাগিলাম, “প্রথম যৌবনকালে লোকে আমাকে রূপবতী বলিত___”
অ। এটা যদি গল্প, তবে সত্য কোন্ কথা?
আমি। পরে শোন। সেই রূপ দেখিয়া এক চোর মুগ্ধ হইয়া, আমার পিত্রালয়ে, যে ঘরে আমি এক পরিচারিকা সঙ্গে শয়ন করিয়াছিলাম, সেই ঘরে সিঁধ দিল।
এই কথা বলিতে আরম্ভ করায়, অমরনাথ গলদ্ঘর্ম হইয়া উঠিল। বলিল, “ক্ষমা কর |”
আমি বলিতে লাগিলাম, “সেই চোর সিঁধপথে আমার কক্ষমধ্যে প্রবেশ করিল। ঘরে আলো জ্বলিতেছিল-আমি চোরকে চিনিলাম। ভীতা হইয়া পরিচারিকাকে উঠাইলাম। সে চোরকে চিনিত না। আমি তখন অগত্যা, চোরকে আদর করিয়া আশ্বস্ত করিয়া পালঙ্কে বসাইলাম |”
অ। ক্ষমা কর, সে ত সকলই জানি।
আমি। তবু একবার স্মরণ করিয়া দেওয়া ভাল। ক্ষণেক পরে, চোরের অলক্ষ্যে আমার সঙ্কেতানুসারে পরিচারিকা বাহিরে গিয়া দ্বারবানকে ডাকিয়া লইয়া সিঁধমুখে দাঁড়াইয়া রহিল। আমিও সময় বুঝিয়া, বাহিরে প্রয়োজন ছলনা করিয়া নির্গত হইয়া, বাহির হইতে একমাত্র দ্বারের শৃঙ্খল বদ্ধ করিলাম। মন্দ করিয়াছিলাম?
অমরনাথ বলিল, “এ সকল কথা কেন?”
আমি। পরে চোর নির্গত হইল কি প্রকারে বল দেখি? ডাকিয়া পাড়ার লোক জমা করিলাম। বড় বড় বলবান আসিয়া চোরকে ধরিল। চোর লজ্জায় মুখে কাপড় দিয়া রহিল। আমি দয়া করিয়া তাহার মুখের কাপড় খুলাইলাম না, কিন্তু স্বহস্তে লোহার শলা তপ্ত করিয়া তাহার পিঠে লিখিয়াছিলাম,
“চোর!”
অমরবাবু, অতি গ্রীষ্মেও কি আপনি গায়ের জামা খুলিয়া শয়ন করেন না?
অ। না।
আমি। লবঙ্গলতার হস্তাক্ষর মুছিবার নহে। আমি রজনীকে ডাকিয়া গল্প শুনাইয়া যাই ইচ্ছা ছিল, কিন্তু শুনাইব না। তুমি রজনীর যোগ্য নহ, রজনীকে বিবাহ করিতে চেষ্টা পাইও না। যদি ক্ষান্ত না হও, তবে সুতরাং শুনাইতে বাধ্য হইব।
অমরনাথ কিছুক্ষণ ভাবিল। পরে দু:খিতভাবে বলিল, “শুনাইতে হয় শুনাইও। তুমি শুনাও বা না শুনাও, আমি স্বয়ং আজি তাহাকে সকল শুনাইব। আমার দোষ-গুণ সকল শুনিয়া রজনী আমাকে গ্রহণ করিতে হয়, গ্রহণ করিবে ; না করিতে হয়, না করিবে। আমি তাহাকে প্রবঞ্চনা করিব না |”
আমি হারিয়া, মনে মনে অমরনাথকে শত শত ধন্যবাদ করিতে করিতে, হর্ষবিষাদে ঘরে ফিরিয়া আসিলাম।

পঞ্চম পরিচ্ছেদ : শচীন্দ্রনাথের কথা

ঐশ্বর্য হারাইয়া, কিছু দিন পরে আমি পীড়িত হইলাম। ঐশ্বর্য হইতে দারিদ্র্যে পতনের আশঙ্কায় মনে কোন বিকার উপস্থিত হইয়াছিল বলিয়া, কি কিজন্য এই পীড়ার উৎপত্তি, তাহা আমি বলিবার কোন চেষ্টা পাইব না। কেবল পীড়ার লক্ষণ বলিব।
সন্ধ্যার পূর্বে রৌদ্রের তাপ অপনীত হইলে পর, প্রাসাদের উপর বসিয়া অধ্যয়ন করিতেছিলাম। সমস্ত দিবস অধ্যয়ন করিয়াছিলাম। জগতের দুরূহ গূঢ় তত্ত্বসকলের আলোচনা করিতেছিলাম। কিছুরই মর্ম বুঝিতে পারি না, কিন্তু কিছুতেই আকাঙ্ক্ষা নিবৃত্তি পায় না। যত পড়ি, তত পড়িতে সাধ করে। শেষ শ্রান্তি বোধ হইল। পুস্তক বন্ধ করিয়া হস্তে লইয়া, চিন্তা করিতে লাগিলাম। একটু নিদ্রা আসিল-অথচ নিদ্রা নহে। সে মোহ, নিদ্রার ন্যায় সুখকর বা তৃপ্তিজনক নহে। ক্লান্ত হস্ত হইতে পুস্তক খসিয়া পড়িল। চক্ষু: চাহিয়া আছি-বাহ্য বস্তুসকলই দেখিতে পাইতেছি, কিন্তু কি দেখিতেছি, তাহা বলিতে পারি না। অকস্মাৎ সেইখানে প্রভাতবীচিবিক্ষেপচপলা কলকলনাদিনী নদী বিস্তৃতা দেখিলাম-যেন তথা ঊষার উজ্জ্বল বর্ণে পূর্বদিক প্রভাসিত হইতেছে-দেখি, সেই গঙ্গাপ্রবাহমধ্যে সৈকতমূলে রজনী! রজনী জলে নামিতেছে। ধীরে, ধীরে, ধীরে! অন্ধ! অথচ কুঞ্চিত ভ্রূ ; বিকলা অথচ স্থিরা ; সেই প্রভাতশান্তিশীতলা ভাগীরথীর ন্যায় গম্ভীরা, ধীরা, সেই ভাগীরথীর ন্যায় অন্তরে দুর্জয় বেগশালিনী! ধীরে, ধীরে, ধীরে,-জলে নামিতেছে। দেখিলাম, কি সুন্দর! রজনী কি সুন্দরী! বৃক্ষ হইতে নবমঞ্জরীর সুগন্ধের ন্যায়, দূরশ্রুত সঙ্গীতের শেষভাগের ন্যায়, রজনী জলে, ধীরে-ধীরে-ধীরে নামিতেছে‌! ধীরে রজনী। ধীরে! আমি দেখি তোমায়। তখন অনাদর করিয়া দেখি নাই, এখন একবার ভাল করিয়া দেখিয়া লই। ধীরে, রজনী ধীরে!
আমার মূর্ছা হইল। মূর্ছার লক্ষণ সকল আমি অবগত নহি। যাহা পশ্চাৎ শুনিয়াছি, তাহা বলিয়া কোন ফল নাই। আমি যখন পুনর্বার চেতনাপ্রাপ্ত হইলাম, তখন রাত্রিকাল-আমার নিকট অনেক লোক। কিন্তু আমি সে সকল কিছুই দেখিলাম না। আমি দেখিলাম-কেবল সেই মৃদুনাদিনী গঙ্গা, আর সেই মৃদুগামিনী রজনী, ধীরে ধীরে, ধীরে জলে নামিতেছে। চক্ষু মুদিলাম, তবু দেখিলাম সেই গঙ্গা, আর সেই রজনী। আবার চাহিলাম, আবার দেখিলাম সেই গঙ্গা আর সেই রজনী! দিগন্তরে চাহিলাম-আবার সেই রজনী, ধীরে, ধীরে, ধীরে জলে নামিতেছে। ঊর্ধ্বে চাহিলাম-ঊর্ধ্বেও আকাশবিহারিণী গঙ্গা ধীরে, ধীরে, ধীরে বহিতেছে; আকাশবিহারিণী রজনী ধীরে, ধীরে, ধীরে নামিতেছে। অন্য দিকে মন ফিরাইলাম; তথাপি সেই গঙ্গা আর সেই রজনী। আমি নিরস্ত হইলাম। চিকিৎসকেরা আমার চিকিৎসা করিতে লাগিল।
অনেক দিন ধরিয়া আমার এই চিকিৎসা হইতে লাগিল, কিন্তু আমার নয়নাগ্র হইতে রজনীরূপ তিলেক জন্য অন্তর্হিত হইল না। আমি জানি না, আমার কি রোগ বলিয়া চিকিৎসকেরা চিকিৎসা করিতেছিল। আমার নয়নাগ্রে যে রূপ অহরহ: নাচিতেছিল, তাহার কথা কাহাকেও বলি নাই।
ওহে ধীরে, রজনী ধীরে। ধীরে, ধীরে, আমার এই হৃদয়মন্দিরে প্রবেশ কর! এত দ্রুতগামিনী কেন? তুমি অন্ধ, পথ চেন না, ধীরে, রজনী ধীরে! ক্ষুদ্রা এই পুরী, আঁধার, আঁধার, আঁধার! চিরান্ধকার! দীপশলাকার ন্যায় ইহাতে প্রবেশ করিয়া আলো কর,-দীপশলাকার ন্যায় আপনি পুড়িবে; কিন্তু এ আঁধার পুরী আলো করিবে।

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ : শচীন্দ্রের কথা

ওহে ধীরে, রজনী ধীরে। এ পুরী আলো কর, কিন্তু দাহ কর কেন? কে জানে যে, শীতল প্রস্তরেও দাহ করিবে-তোমায় ত পাষাণগঠিতা, পাষাণময়ী জানিতাম, কে জানে যে, পাষাণেও দাহ করিবে? অথবা কে জানে, পাষাণেও লৌহের সংঘর্ষণেই অগ্নুৎপাত হয়। তোমার প্রস্তরধবল, প্রস্তরস্নিগ্ধদর্শন, প্রস্তরগঠিতবৎ মূর্তি যত দেখি, ততই দেখিতে ইচ্ছা হয়। অনুদিন, পলকে পলকে, দেখিয়াও মনে হয়, দেখিলাম কই? আবার দেখি। আবার দেখি, কিন্তু দেখিয়া ত সাধ মিটিল না।
পীড়িতাবস্থায় আমি প্রায় কাহারও সঙ্গে কথা কহিতাম না। কেহ কথা কহিতে আসিলে ভাল লাগিত না। রজনীর কথা মুখে আনিতাম না-কিন্তু প্রলাপকালে কি বলিতাম না বলিতাম, তাহা স্মরণ করিয়া বলিতে পারি না। প্রলাপ সচরাচরই ঘটিত।
শয্যা প্রায় ত্যাগ করিতাম না। শুইয়া শুইয়া কত কি দেখিতাম, তাহা বলিতে পারি না। কখন দেখিতাম, সমরক্ষেত্রে যবননিপাত হইতেছে-রক্তে নদী বহিতেছে; কখন দেখিতাম, সুবর্ণপ্রান্তরে হীরকবৃক্ষে স্তবকে স্তবকে নক্ষত্র ফুটিয়া আছে। কখন দেখিতাম, আকাশমার্গে, অষ্টশশিসমন্বিত শনৈশ্চর মহাগ্রহ চতুশ্চন্দ্রবাহী বৃহস্পতির উপর মহাবেগে পতিত হইল-গ্রহ উপগ্রহ সকল খণ্ড খণ্ড হইয়া ভাঙ্গিয়া গেল-আঘাতোৎপন্ন বহ্নিতে সে সকল জ্বলিয়া উঠিয়া, দাহ্যমানাবস্থাতে মহাবেগে বিশ্বমণ্ডলের চতুর্দিকে প্রধাবিত হইতেছে। কখন দেখিতাম, এই জগৎ জ্যোতির্ময় কান্তরূপধর দেবযোনির মূর্তিতে পরিপূর্ণ, তাহারা অবিরত অম্বরপথ প্রভাসিত করিয়া বিচরণ করিতেছে ; তাহাদিগের অঙ্গের সৌরভে আমার নাসারন্ধ্র পরিপূর্ণ হইতেছে। কিন্তু যাহাই দেখি না-সকলের মধ্যস্থলে রজনীর সেই প্রস্তরময়ী মূর্তি দেখিতে পাইতাম। হায় রজনী! পাথরে এত আগুন!
ধীরে, রজনী, ধীরে! ধীরে, ধীরে, রজনী, ঐ অন্ধ নয়ন উন্মীলিত কর। দেখ, আমায় দেখ, আমি তোমায় দেখি! ঐ দেখিতেছি- তোমার নয়নপদ্ম ক্রমে প্রস্ফুটিত হইতেছে-ক্রমে, ক্রমে, ক্রমে, ধীরে, ধীরে, ধীরে, ধীরে, নয়নরাজীব ফুটিতেছে! এ সংসারে কাহার না নয়ন আছে? গো, মেষ, কুক্কুর, মার্জার, ইহাদিগেরও নয়ন আছে-তোমার নাই? নাই নাই, তবে আমারও নাই! আমিও আর চক্ষু চাহিব না।

সপ্তম পরিচ্ছেদ : লবঙ্গলতার কথা

আমি জানিতাম, শচীন্দ্র একটা কাণ্ড করিবে-ছেলে বয়সে অত ভাবিতে আছে? দিদি ত একবার ফিরে চেয়েও দেখেন না-আমি বলিলে বিমাতা বলিয়া আমার কথা গ্রাহ্য করে না। ও সব ছেলেকে আঁটিয়া উঠা ভার। এখন দায় দেখিতেছি আমার। ডাক্তার বৈদ্য কিছু করিতে পারিল না-পারিবেও না। তারা রোগই নির্ণয় করিতে জানে না। রোগ হলো মনে-হাত দেখিলে, চোখ দেখিলে, জিব দেখিলে তারা কি বুঝিবে? যদি তারা আমার মত আড়ালে লুকাইয়া বসিয়া আড়ি পেতে ছেলের কাণ্ড দেখত, তবে একদিন রোগের ঠিকানা করিলে করিতে পারিত।
কথাটা কি? “ধীরে, রজনী!” ছেলে ত একেলা থাকিলেই এই কথা বলে। সন্ন্যাসী ঠাকুরের ঔষধে কি এই ফল ফলিল? আমার মাথা খাইতে কেন আমি এমন কাজ করিলাম? ভাল, রজনীকে একবার রোগীর কাছে বসাইয়া রাখিলে হয় না? কই, আমি রজনীর বাড়ী গিয়াছিলাম, সে ত সেই অবধি আমার বাড়ী একবারও আসে নাই! ডাকিয়া পাঠাইলে না আসিয়া থাকিতে পারিবে না। এই ভাবিয়া আমি রজনীর গৃহে লোক পাঠাইলাম-বলিয়া পাঠাইলাম যে, আমার বিশেষ প্রয়োজন আছে, একবার আসিতে বলিও।
মনে করিলাম, আগে একবার শচীন্দ্রের কাছে রজনীর কথা পাড়িয়া দেখি। তাহা হইলে বুঝিতে পারিব, রজনীর সঙ্গে শচীন্দ্রের পীড়ার কোন সম্বন্ধ আছে কি না?
অতএব প্রকৃত তত্ত্ব জানিবার জন্য শচীন্দ্রের কাছে গিয়া বসিলাম। এ কথা ও কথার পর রজনীর প্রসঙ্গ ছলে পাড়িলাম। আর কেহ সেখানে ছিল না। রজনীর নাম শুনিবামাত্র বাছা অমনি, চমকিত হংসীর ন্যায় গ্রীবা তুলিয়া আমার মুখপ্রতি চাহিয়া রহিল। আমি যত রজনীর কথা বলিতে লাগিলাম, শচীন্দ্র কিছুই উত্তর করিল না কিন্তু ব্যাকুলিত চক্ষে আমার প্রতি চাহিয়া রহিল। ছেলে বড় অস্থির হইয়া উঠিল-এটা পাড়ে, সেটা ভাঙ্গে, এইরূপ আরম্ভ করিল। আমি পরিশেষে রজনীকে তিরস্কার করিতে লাগিলাম; সে অত্যন্ত ধনলুব্ধা, আমাদিগের পূর্বকৃত উপকার কিছুমাত্র স্মরণ করিল না। এইরূপ কথাবার্তা শুনিয়া শচীন্দ্র অপ্রসন্ন ভাবাপন্ন হইলেন, এমন আমার বোধ হইল, কিন্তু কথায় কিছু প্রকাশ পাইল না।
নিশ্চয় বুঝিলাম, এটি সন্ন্যাসীর কীর্তি। তিনি এক্ষণে স্থানান্তরে গিয়াছিলেন, অল্পদিনে আসিবার কথা ছিল। তাঁহার প্রতীক্ষা করিতে লাগিলাম। কিন্তু তাহাও মনে ভাবিতে লাগিলাম যে, তিনিই বা কি করিবেন? আমি নির্বোধ দুরাকাঙ্ক্ষাপরবশ স্ত্রীলোক-ধনের লোভে অগ্র পশ্চাৎ না ভাবিয়া আপনিই এই বিপত্তি উপস্থিত করিয়াছি! তখন মনে জানিতাম যে, রজনীকে নিশ্চয়ই পুত্রবধূ করিব। তখন কে জানে যে, কাণা ফুলওয়ালীও দুর্লভ হইবে? কে জানে যে, সন্ন্যাসীর মন্ত্রৌষধে হিতে বিপরীত হইবে? স্ত্রীলোকের বুদ্ধি অতি ক্ষুদ্র, তাহা জানিতাম না ; আপনার বুদ্ধির অহঙ্কারে আপনি মজিলাম। আমার এমন বুদ্ধি হইবার আগে, আমি মরিলাম না কেন? এখন ইচ্ছা হইতেছে মরি, কিন্তু শচীন্দ্রবাবুর আরোগ্য না দেখিয়া মরিতে পারিতেছি না।
কিছু দিন পরে কোথা হইতে সেই পূর্বপরিচিত সন্ন্যাসী আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তিনি বলিলেন, তিনি শচীন্দ্রের পীড়া শুনিয়া দেখিতে আসিয়াছেন। কে তাঁহাকে শচীন্দ্রের পীড়ার সংবাদ দিল, তাহা কিছু বলিলেন না।
শচীন্দ্রের পীড়ার বৃত্তান্ত আদ্যোপান্ত শুনিলেন। পরে শচীন্দ্রের কাছে বসিয়া নানাপ্রকার কথোপকথন করিতে লাগিলেন। তৎপরে প্রণাম করিবার জন্য আমি তাঁহাকে ডাকিয়া পাঠাইলাম। প্রণাম করিয়া, মঙ্গল জিজ্ঞাসার পর বলিলাম, “মহাশয় সর্বজ্ঞ ; না জানেন, এমন তত্ত্বই নাই। শচীন্দ্রের কি রোগ, আপনি অবশ্য জানেন |”
তিনি বলিলেন, “উহা বায়ুরোগ। অতি দুশ্চিকিৎস্য |”
আমি বলিলাম, “তবে শচীন্দ্র সর্বদা রজনীর নাম করে কেন?”
সন্ন্যাসী বলিলেন, “তুমি বালিকা, বুঝিবে কি?” (কি সর্বনাশ, আমি বালিকা। আমি শচীর মা!) “এই রোগের এক গতি এই যে, হৃদয়স্থ লুক্কায়িত এবং অপরিচিত ভাব বা প্রবৃত্তি সকল প্রকাশিত হইয়া পড়ে, এবং অত্যন্ত বলবান হইয়া উঠে। শচীন্দ্র কদাচিৎ আমাদিগের দৈববিদ্যা সকলের পরীক্ষার্থী হইলে, আমি কোন তান্ত্রিক অনুষ্ঠান করিলাম, তাহাতে যে তাঁহাকে আন্তরিক ভালবাসে, তিনি তাহাকে স্বপ্নে দেখিবেন। শচীন্দ্র রাত্রিযোগে রজনীকে স্বপ্নে দেখিলেন। স্বাভাবিক নিয়ম এই যে, যে আমাদিগের ভালবাসে বুঝিতে পারি, আমরা তাহার প্রতি অনুরক্ত হই। অতএব সেই রাত্রে শচীন্দ্রের মনে রজনীর প্রতি অনুরাগের বীজ গোপনে সমারোপিত হইল। কিন্তু রজনী অন্ধ, এবং ইতর লোকের কন্যা, ইত্যাদি কারণে সে অনুরাগ পরিস্ফুট হইতে পারে নাই। অনুরাগের লক্ষণ স্বহৃদয়ে কিছু দেখিতে পাইলেও শচীন্দ্র তৎপ্রতি বিশ্বাস করেন নাই। ক্রমে ঘোরতর দারিদ্র্যদু:খের আশঙ্কা তোমাদিগকে পীড়িত করিতে লাগিল। সর্বাপেক্ষা শচীন্দ্রই তাহাতে গুরুতর ব্যথা পাইলেন। অন্যমনে, দারিদ্র্যদু:খ ভুলিবার জন্য শচীন্দ্র অধ্যয়নে মন দিলেন। অনন্যমনা হইয়া বিদ্যালোচনা করিতে লাগিলেন। সেই বিদ্যালোচনার আধিক্য হেতু, চিত্ত উদ্ভ্রান্ত হইয়া উঠিল। তাহাতেই এই মানসিক রোগের সৃষ্টি। সেই মানসিক রোগকে অবলম্বন করিয়া রজনীর প্রতি সেই বিলুপ্তপ্রায় অনুরাগ পুন:প্রস্ফুটিত হইল। এখন আর শচীন্দ্রের সে মানসিক শক্তি ছিল না যে, তদ্দ্বারা তিনি সেই অবিহিত অনুরাগকে প্রশমিত করেন। বিশেষ, পূর্বেই বলিয়াছি যে, এই সকল মানসিক পীড়ার কারণ যে যে গুপ্ত মানসিক ভাব বিকসিত হয়, তাহা অপ্রকৃত হইয়া উঠে। তখন তাহা বিকারের স্বরূপ প্রতীয়মান হয়। শচীন্দ্রের সেইরূপ এ বিকার |”
আমি তখন কাতর হইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম যে, “ইহার প্রতীকারের কি উপায় হইবে।”
সন্ন্যাসী বলিলেন, “আমি ডাক্তার শাস্ত্রের কিছুই জানি না। ডাক্তারদিগের দ্বারা এ রোগ উপশম হইতে পারে কি না, তাহা বিশেষ বলিতে পারি না। কিন্তু ডাক্তারেরা কখন এ সকল রোগের প্রতীকার করিয়াছেন, এমন আমি শুনি নাই |”
আমি বলিলাম যে, “অনেক ডাক্তার দেখান হইয়াছে, কোন উপকার হয় নাই |”
স। সচরাচর বৈদ্যচিকিৎসকের দ্বারাও কোনও উপকার হইবে না।
আমি। তবে কি কোন উপায় নাই?
স। যদি বল, তবে আমি ঔষধ দিই।
আমি। আপনার ঔষধের অপেক্ষা কাহার ঔষধ? আপনিই আমাদের রক্ষাকর্তা। আপনিই ঔষধ দিন।
স। তুমি বাড়ীর গৃহিণী। তুমি বলিলেই ঔষধ দিতে পারি। শচীন্দ্রও তোমার বাধ্য। তুমি বলিলেই সে আমার ঔষধ সেবন করিবে। কিন্তু কেবল ঔষধে আরোগ্য হইবে না। মানসিক পীড়ার মানসিক চিকিৎসা চাই। রজনীকে চাই।
আমি। রজনী আসিবে। ডাকিয়া পাঠাইয়াছি।
স। কিন্তু রজনীর আগমনে ভাল হইবে, কি মন্দ হইবে, তাহাও বিবেচ্য। এমত হইতে পারে যে, রজনীর প্রতি এই অপ্রকৃত অনুরাগ, রুগ্নাবস্থায় দেখা সাক্ষাৎ হইলে বদ্ধমূল হইয়া স্থায়িত্ব প্রাপ্ত হইবে। যদি রজনীর সঙ্গে বিবাহ না হয়, তবে রজনী না আসাই ভাল।
সেই সময়ে একজন পরিচারিকা সঙ্গে রজনী আসিয়া উপস্থিত হইল। অমরনাথও শচীন্দ্রের পীড়া শুনিয়া স্বয়ং শচীন্দ্রকে দেখিতে আসিয়াছিলেন। এবং রজনীকে সঙ্গে আনিয়া উপস্থিত করিয়াছিলেন। আপনি বহির্বাটিতে থাকিয়া, পরিচারিকার সঙ্গে তাহাকে অন্ত:পুরে পাঠাইয়া দিয়াছিলেন।

Pages: 1 2 3 4 5

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress