রজনী – ৩
তৃতীয় খণ্ড
শচীন্দ্র বক্তা
প্রথম পরিচ্ছেদ
এ ভার আমার প্রতি হইয়াছে-রজনীর জীবনচরিত্রের এ অংশ আমাকে লিখিতে হইবে। লিখিব।
আমি রজনীর বিবাহের সকল উদ্যোগ করিয়াছিলাম-বিবাহের দিন প্রাতে শুনিলাম যে, রজনী পলাইয়াছে, তাহাকে আর পাওয়া যায় না। তাহার অনেক অনুসন্ধান করিলাম, পাইলাম না। কেহ বলিল, সে ভ্রষ্টা। আমি বিশ্বাস করিলাম না। আমি তাহাকে অনেকবার দেখিয়াছিলাম-শপথ করিতে পারি, সে কখন ভ্রষ্টা হইতে পারে না। তবে ইহা হইতে পারে যে, সে কুমারী, কৌমার্যাবস্থাতেই কাহারও প্রণয়াসক্ত হইয়া বিবাহশঙ্কায় গৃহত্যাগ করিয়াছে। কিন্তু ইহাতেও দুইটি আপত্তি ; প্রথম, সে অন্ধ, সে কি প্রকারে সাহস করিয়া আশ্রয় ত্যাগ করিয়া যাইবে? দ্বিতীয়ত:, যে অন্ধ, সে কি প্রণয়াসক্ত হইতে পারে? মনে করিলাম, কদাচ না। কেহ হাসিও না, আমার মত গণ্ডমূর্খ অনেক আছে। আমরা খান দুই তিন বহি পড়িয়া, মনে করি, জগতের চেতনাচেতনের গূঢ়াদপি গূঢ় তত্ত্ব সকলই নখদর্পণ করিয়া ফেলিয়াছি, যাহা আমাদের বুদ্ধিতে ধরে না, তাহা বিশ্বাস করি না। ঈশ্বর মানি না, কেন না, আমাদের ক্ষুদ্র বিচারশক্তিতে সে বৃহত্তত্ত্বের মীমাংসা করিয়া উঠিতে পারি না। অন্ধের রূপোন্মাদ কি প্রকারে বুঝিব?
সন্ধান করিতে করিতে জানিলাম যে, যে রাত্রি হইতে রজনী অদৃশ্য হইয়াছে, সেই রাত্রি হইতে হীরালালও অদৃশ্য হইয়াছে। সকলে বলিতে লাগিল, হীরালালের সঙ্গে সে কুলত্যাগ করিয়া গিয়াছে। অগত্যা আমি এই সিদ্ধান্ত করিলাম যে, হীরালাল রজনীকে ফাঁকি দিয়া লইয়া গিয়াছে। রজনী পরমা সুন্দরী ; কাণা হউক, এমন লোক নাই, যে তাহার রূপে মুগ্ধ হইবে না। হীরালাল তাহার রূপে মুগ্ধ হইয়া, তাহাকে বঞ্চনা করিয়া লইয়া গিয়াছে। অন্ধকে বঞ্চনা করা বড় সুসাধ্য।
কিছুদিন পরে হীরালাল দেখা দিল। আমি তাহাকে বলিলাম, “তুমি রজনীর সম্বাদ জান?”-সে বলিল-“না |”
কি করিব। নালিশ, ফরিয়াদ হইতে পারে না। আমার জ্যেষ্ঠকে বলিলাম। জ্যেষ্ঠ বলিলেন, “রাস্কালকে মার |” কিন্তু মারিয়া কি হইবে? আমি সম্বাদপত্রে বিজ্ঞাপন দিতে আরম্ভ করিলাম। যে রজনীর সন্ধান দিবে, তাহাকে অর্থ পুরস্কার দিব, ঘোষণা করিলাম। কিছু ফল ফলিল না।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
রজনী জন্মান্ধ, কিন্তু তাহার চক্ষু দেখিলে অন্ধ বলিয়া বোধ হয় না। চক্ষে দেখিতে কোন দোষ নাই। চক্ষু বৃহৎ, সুনীল, ভ্রমরকৃষ্ণতারাবিশিষ্ট। অতি সুন্দর চক্ষু- কিন্তু কটাক্ষ নাই। চাক্ষুষ স্নায়ুর দোষে অন্ধ। স্নায়ুর নিশ্চেষ্টতাবশত: রেটিনাস্থিত প্রতিবিম্ব মস্তিষ্কে গৃহীত হয় না। রজনী সর্বাঙ্গসুন্দরী; বর্ণ উদ্ভেদ-প্রমুখ নিতান্ত নবীন কদলীপত্রের ন্যায় গৌর, গঠন বর্ষাজলপূর্ণ তরঙ্গিণীর ন্যায় সম্পূর্ণতাপ্রাপ্ত; মুখকান্তি গম্ভীর ; গতি, অঙ্গভঙ্গী সকল মৃদু, স্থির এবং অন্ধতাবশত: সর্বদা সঙ্কোচজ্ঞাপক ; হাস্য দু:খময়। সচরাচর এই স্থিরপ্রকৃতি সুন্দর শরীরে সেই কটাক্ষহীন দৃষ্টি দেখিয়া কোন ভাস্কর্যপটু শিল্পকরের যত্ননির্মিত প্রস্তরময়ী স্ত্রীমূর্তি বলিয়া বোধ হইত।
রজনীকে প্রথম দেখিয়াই আমার বিশ্বাস হইয়াছিল যে, এই সৌন্দর্য অনিন্দনীয় হইলেও মুগ্ধকর নহে। রজনী রূপবতী, কিন্তু তাহার রূপ দেখিয়া কেহ কখন পাগল হইবে না। তাহার চক্ষের সে মোহিনী গতি নাই। সৌন্দর্য দেখিয়া লোকে প্রশংসা করিবে ; বোধ হয়, সে মূর্তি সহজে ভুলিবেও না ; কেন না, সে স্থির, গম্ভীর কান্তির একটু অদ্ভুত আকর্ষণী শক্তি আছে। কিন্তু সেই আকর্ষণ অন্যবিধ ; ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে তাহার কোন সম্বন্ধ নাই। যাহাকে “পঞ্চবাণ” বলে, রজনীর রূপের সঙ্গে তাহার কোন সম্বন্ধ নাই। নাই কি?
সে যাহাই হউক-আমি মধ্যে মধ্যে চিন্তা করিতাম-রজনীর দশা কি হইবে? সে ইতর লোকের কন্যা, কিন্তু তাহাকে দেখিয়াই বোধ হয় যে, সে ইতর প্রকৃতিবিশিষ্ট নহে। ইতর লোক ভিন্ন, তাহার অন্যত্র বিবাহের সম্ভাবনা নাই। ইতর লোকের সঙ্গেও এতকালে বিবাহ ঘটে নাই। দরিদ্রের ভার্যা গৃহকর্মের জন্য, যে ভার্যার অন্ধতানিবন্ধন গৃহকর্মের সাহায্য হইবে না-তাহাকে কোন্ দরিদ্র বিবাহ করিবে? কিন্তু ইতর লোক ভিন্ন এই ইতরবৃত্তিপরায়ণ কায়স্থের কন্যা কে বিবাহ করিবে? তাহাতে আবার এ অন্ধ। এরূপ স্বামীর সহবাসে রজনীর দু:খ ভিন্ন সুখের সম্ভাবনা নাই। দুশ্ছেদ্য কণ্টক কানন মধ্যে যত্নপালনীয় উদ্যানপুষ্পের জন্মের ন্যায়, এই রজনীর পুষ্পবিক্রেতার গৃহে জন্ম ঘটিয়াছে। কণ্টকাবৃত হইয়াই ইহাকে মরিতে হইবে। তবে আমি গোপালের সঙ্গে ইহার বিবাহ দিবার জন্য এত ব্যস্ত কেন? ঠিক জানি না। তবে ছোট মার দৌরাত্ম্য বড় ; তাঁহারই উত্তেজনাতে ইহার বিবাহ দিতে প্রবৃত্ত হইয়াছিলাম। আর বলিতে কি, যাহাকে স্বয়ং বিবাহ করিতে না পারি, তাহার বিবাহ দিতে ইচ্ছা করে।
এ কথা শুনিয়া অনেক সুন্দরী মধুর হাসিয়া জিজ্ঞাসা করিতে পারেন, তোমার মনে মনে রজনীকে বিবাহ করিতে ইচ্ছা আছে কি? না, সে ইচ্ছা নাই। রজনী সুন্দরী হইলেও অন্ধ ; রজনী পুষ্পবিক্রেতার কন্যা এবং রজনী অশিক্ষিতা। রজনীকে আমি বিবাহ করিতে পারি না ; ইচ্ছাও নাই। আমার বিবাহে অনিচ্ছাও নাই। তবে মনোমত কন্যা পাই না। আমি যাহাকে বিবাহ করিব, সে রজনীর মত সুন্দরী হইবে, অথচ বিদ্যুৎকটাক্ষবর্ষিণী হইবে ; বংশমর্যাদায় শাহ আলমের বা মহ্লাররাও হুল্কারের প্রপরাপসং*0 পৌত্রী হইবে, বিদ্যায় লীলাবতী বা শাপভ্রষ্টা সরস্বতী হইবে ; এবং পতিভক্তিতে সাবিত্রী হইবে; চরিত্রে লক্ষ্মী, রন্ধনে দ্রৌপদী, আদরে সত্যভামা এবং গৃহকর্মে গদার মা। আমি পান খাইবার সময়ে পানের লবঙ্গ খুলিয়া দিবে, তামাকু খাইবার সময়ে হুঁকায় কলিকা আছে কিনা, বলিয়া দিবে, আহারের সময় মাছের কাঁটা বাছিয়া দিবে, এবং স্নানের পর গা মুছিয়াছি কিনা, তদারক করিবে। আমি চা খাইবার সময়ে, দোয়াতের ভিতরে চামচে পুরিয়া চার অনুসন্ধান না করি, এবং কালির অনুসন্ধানে চার পাত্রমধ্যে কলম না দিই, তদ্বিষয়ে সতর্ক থাকিবে; পিক্দানিতে টাকা রাখিয়া বাক্সের ভিতর ছেপ না ফেলি, তাহার খবরদারি করিবে। বন্ধুকে পত্র লিখিয়া আপনার নামে শিরোনামা দিলে, সংশোধন করাইয়া লইবে, পয়সা দিতে টাকা দিতেছি কি না, খবর লইবে, নোটের পিঠে দোকানের চিঠি কাটিতেছি কি না দেখিবে, এবং তামাসা করিবার সময়ে বিয়ানের নামের পরিবর্তে ভক্তিমতী প্রতিবাসিনীর নাম করিলে, ভুল সংশোধন করিয়া লইবে। ঔষধ খাইতে ফুলেল তৈল না খাই, চাকরাণীর নাম করিয়া ডাকিতে, হৌসের সাহেবের মেমের নাম না ধরি, এ সকল বিষয়ে সর্বদা সতর্ক থাকিবে। এমত কন্যা পাই, তবে বিবাহ করি। আপনারা যে ইনি ওঁকে টিপিয়া হাসিতেছেন, আপনাদের মধ্যে যদি কেহ অবিবাহিতা এবং এই সকল গুণে গুণবতী থাকেন, তবে বলুন, আমি পুরোহিত ডাকি।
1 প্রপরাসং-প্র পরা অপ সং
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
শেষে রাজচন্দ্র দাসের কাছে শুনিতে পাইলাম যে, রজনীকে পাওয়া গিয়াছে। কিন্তু রাজচন্দ্র দাস এ বিষয়ে আমাদিগের সঙ্গে বড় চমৎকার ব্যবহার করিতে লাগিল। রজনীকে কোথায় পাওয়া গেল, কি প্রকারে পাওয়া গেল তাহা কিছুই বলিল না। আমরা অনেক জিজ্ঞাসা করিলাম, কিছুতেই কোন কথা বাহির করিতে পারিলাম না। সে কেনই বা গৃহত্যাগ করিয়া গিয়াছিল, তাহাও জিজ্ঞাসাবাদ করিলাম, তাহাও বলিল না। তাহার স্ত্রীও ঐরূপ-ছোট মা, সূচীর ন্যায় লোকের মনের ভিতর প্রবেশ করেন, কিন্তু তাহার কাছ হইতে কোন কথাই বাহির করিতে পারিলেন না। শেষে রাজচন্দ্র ও তাহার স্ত্রীও আমাদিগের বাড়ী আসা পরিত্যাগ করিল। ছোট মা কিছু দু:খিত হইয়া তাহাদিগের অনুসন্ধানে লোক পাঠাইলেন। লোক ফিরিয়া আসিয়া বলিল যে, উহারা সপরিবারে অন্যত্র উঠিয়া গিয়াছে, সাবেক বাড়ীতে আর নাই। কোথায় গিয়াছে, তাহার কোন ঠিকানা করিতে পারিলাম না।
ইহার এক মাস পরে, একজন ভদ্রলোক আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করিতে আসিলেন। তিনি আসিয়াই, আপনার আত্মপরিচয় দিলেন। “আমার নিবাস কলিকাতায় নহে। আমার নাম অমরনাথ ঘোষ, আমার নিবাস শান্তিপুর |”
তখন আমি তাঁহার সঙ্গে কথোপকথনে নিযুক্ত হইলাম। কি জন্য তিনি আসিয়াছিলেন, আমি তাঁহাকে হঠাৎ জিজ্ঞাসা করিতে পারিলাম না। তিনিও প্রথমে কিছু বলিলেন না। সুতরাং সামাজিক ও রাজকীয় বিষয়ঘটিত নানা কথাবার্তা হইতে লাগিল। দেখিলাম, তিনি কথাবার্তায় অত্যন্ত বিচক্ষণ। তাঁহার বুদ্ধি মার্জিত, শিক্ষা সম্পূর্ণ, এবং চিন্তা বহুদূরগামিনী। কথাবার্তায় একটু অবসর পাইয়া, তিনি আমার টেবিলের উপর স্থিত “সেক্ষপিয়র গেলেরির” পাতা উল্টাইতে লাগিলেন। ততক্ষণ আমি অমরনাথকে দেখিয়া লইতে লাগিলাম। অমরনাথ দেখিতে সুপুরুষ; গৌরবর্ণ, কিঞ্চিৎ খর্ব, স্থূলও নহে, শীর্ণও নহে ; বড় বড় চক্ষু, কেশগুলি সূক্ষ্ম, কুঞ্চিত, যত্নরঞ্জিত। বেশভূষার পারিপাট্যের বাড়াবাড়ি নাই, কিন্তু পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন বটে। তাঁহার কথা কহিবার ভঙ্গী অতি মনোহর; কণ্ঠ অতি সুমধুর। দেখিয়া বুঝিলাম, লোক অতি সুচতুর।
সেক্ষপিয়র গেলেরির পাতা উল্টান শেষ হইলে অমরনাথ নিজ প্রয়োজনের কথা কিছু না বলিয়া, ঐ পুস্তকস্থিত চিত্রসকলের সমালোচনা আরম্ভ করিলেন। আমাকে বুঝাইয়া দিলেন যে, যাহা বাক্য এবং কার্যদ্বারা চিত্রিত হইয়াছে, তাহা চিত্রফলকে চিত্রিত করিতে চেষ্টা পাওয়া ধৃষ্টতার কাজ। সে চিত্র কখনই সম্পূর্ণ হইতে পারে না ; এবং এ সকল চিত্রও সম্পূর্ণ নহে। ডেস্ডিমনার চিত্র দেখাইয়া কহিলেন, আপনি এই ধৈর্য, মাধুর্য, নম্রতা পাইতেছেন, কিন্তু ধৈর্যের সহিত সে সাহস কৈ? নম্রতার সঙ্গে সে সতীত্বের অহঙ্কার কই? জুলিয়েটের মূর্তি দেখাইয়া কহিলেন, এ নবযুবতীর মূর্তি বটে, কিন্তু ইহাতে জুলিয়েটের নবযৌবনের অদমনীয় চাঞ্চল্য কই?
অমরনাথ এইরূপে কত বলিতে লাগিলেন। সেক্ষপিয়রের নায়িকাগণ হইতে শকুন্তলা, সীতা, কাদম্বরী, বাসবদত্তা, রুক্মিণী, সত্যভামা প্রভৃতি আসিয়া পড়িল। অমরনাথ একে একে তাঁহাদিগের চরিত্রের কথা বিশ্লেষ করিলেন। প্রাচীন সাহিত্যের কথায় ক্রমে প্রাচীন ইতিহাসের কথা আসিয়া পড়িল, তৎপ্রসঙ্গে তাসিতস, প্লুটার্ক, থুকিদিদিস প্রভৃতির অপূর্ব সমালোচনার অবতারণা হইল। প্রাচীন ইতিবৃত্ত-লেখকদিগের মত লইয়া অমরনাথ কোম্তের ত্রৈকালিক উন্নতিসম্বন্ধীয় মতের সমর্থন করিলেন। কোম্ৎ হইতে তাঁহার সমালোচক মিল ও হক্স্লীর কথা আসিল। হক্স্লী হইতে ওয়েন ও ডারুইন, ডারুইন হইতে বুকনেয়র সোপেনহয়র প্রভৃতির সমালোচনা আসিল। অমরনাথ অপূর্ব পাণ্ডিত্যস্রোত: আমার কর্ণরন্ধ্রে প্রেরণ করিতে লাগিলেন। আমি মুগ্ধ হইয়া আসল কথা ভুলিয়া গেলাম।
বেলা গেল দেখিয়া, অমরনাথ বলিলেন, “মহাশয়কে আর বিরক্ত করিব না। যে জন্য আসিয়াছিলাম, তাহা এখনও বলা হয় নাই। রাজচন্দ্র দাস যে আপনাদিগকে ফুল বেচিত, তাহার একটি কন্যা আছে?”
আমি বলিলাম, “আছে বোধ হয়।”
অমরনাথ ঈষৎ হাসিয়া বলিলেন, “বোধ হয় নয়, সে আছে। আমি তাহাকে বিবাহ করিব স্থির করিয়াছি |”
আমি অবাক হইলাম। অমরনাথ বলিতে লাগিলেন, “আমি রাজচন্দ্রের নিকটে এই কথা বলিতেই গিয়াছিলাম। তাহাকে বলা হইয়াছে। এক্ষণে আপনাদিগের সঙ্গে একটা কথা আছে। যে কথা বলিব, তাহা মহাশয়ের পিতার কাছে বলাই আমার উচিত ; কেন না, তিনি কর্তা। কিন্তু আমি যাহা বলিব, তাহাতে আপনাদিগের রাগ করিবার কথা। আপনি সর্বাপেক্ষা স্থিরস্বভাব এবং ধর্মজ্ঞ, এজন্য আপনাকেই বলিতেছি |”
আমি বলিলাম, “কি কথা মহাশয়?”
অ। রজনীর কিছু বিষয় আছে।
আমি। সে কি? সে যে রাজচন্দ্রের কন্যা।
অ। রাজচন্দ্রের পালিত কন্যা মাত্র।
আমি। তবে সে কাহার কন্যা? কোথায় বিষয় পাইল? এ কথা আমরা এতদিন শুনিলাম না কেন?
অ। আপনারা যে সম্পত্তি ভোগ করিতেছেন, ইহাই রজনীর। রজনী মনোহর দাসের ভ্রাতুষ্কন্যা।
একবার, প্রথমে চমকিয়া উঠিলাম। তার পর বুঝিলাম যে, কোন জালসাজে জুয়াচোরের হাতে পড়িয়াছি। প্রকাশ্যে উচ্চৈ:হাস্য করিয়া বলিলাম, “মহাশয়কে নিষ্কর্মা লোক বলিয়া বোধ হইতেছে। আমার অনেক কর্ম আছে। এক্ষণে আপনার সঙ্গে রহস্যের আমার অবসর নাই। আপনি গৃহে গমন করুন |”
অমরনাথ বলিল, “তবে উকীলের মুখে সম্বাদ শুনিবেন |”
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
এদিকে বিষ্ণুরাম বাবু সম্বাদ পাঠাইয়া দিলেন যে, মনোহর দাসের উত্তরাধিকারী উপস্থিত হইয়াছে-বিষয় ছাড়িয়া দিতে হইবে। অমরনাথ তবে জুয়াচোর জালসাজ নহে?
কে উত্তরাধিকারী, তাহা বিষ্ণুরাম বাবু প্রথমে কিছু বলেন নাই। কিন্তু অমরনাথের কথা স্মরণ হইল। বুঝি রজনীই উত্তরাধিকারিণী। যে ব্যক্তি দাবিদার, সে যে মনোহর দাসের যথার্থ উত্তরাধিকারী, তদ্বিষয়ে নিশ্চয়তা আছে কি না, ইহা জানিবার জন্য বিষ্ণুরাম বাবুর কাছে গেলাম। আমি বলিলাম, “মহাশয়, পূর্বে বলিয়াছিলেন যে, মনোহর দাস সপরিবারে জলে ডুবিয়া মরিয়াছে। তাহার প্রমাণও আছে। তবে তাহার আবার ওয়ারিশ আসিল কোথা হইতে?”
বিষ্ণুরাম বাবু বলিলেন, “হরেকৃষ্ণ দাস নামে তাহার এক ভাই ছিল, জানেন বোধ হয় |”
আমি। তা ত জানি। কিন্তু সেও ত মরিয়াছে।
বি। বটে, কিন্তু মনোহরের পর মরিয়াছে। সুতরাং সে বিষয়ের অধিকারী হইয়া মরিয়াছে।
আমি। তা হৌক, কিন্তু হরেকৃষ্ণেরও ত এক্ষণে কেহ নাই?
বি। পূর্বে তাহাই মনে করিয়া আপনাদিগকে বিষয় ছাড়িয়া দিয়াছিলাম। কিন্তু এক্ষণে জানিতেছি যে, তাহার এক কন্যা আছে।
আমি। তবে এত দিন সে কন্যার কোন প্রসঙ্গ উত্থাপিত হয় নাই কেন?
বি। হরেকৃষ্ণের স্ত্রী তাহার পূর্বে মরে; স্ত্রীর মৃত্যুর পরে শিশুকন্যাকে পালন করিতে অক্ষম হইয়া হরেকৃষ্ণ কন্যাটিকে তাহার শ্যালীকে দান করে। তাহার শ্যালী ঐ কন্যাটিকে আত্মকন্যাবৎ প্রতিপালন করে, এবং আপনার বলিয়া পরিচয় দেয়। হরেকৃষ্ণের মৃত্যুর পর তাহার সম্পত্তি লাওয়ারেশ বলিয়া ম্যাজিষ্ট্রেট সাহেবকর্তৃক গৃহীত হওয়ার প্রমাণ পাইয়া, আমি হরেকৃষ্ণকে লাওয়ারেশ মনে করিয়াছিলাম। কিন্তু এক্ষণে হরেকৃষ্ণের একজন প্রতিবাসী আমার নিকট উপস্থিত হইয়া, তাহার কন্যার কথা প্রকাশ করিয়াছে। আমি তাহার প্রদত্ত সন্ধানের অনুসরণ করিয়া জানিয়াছি যে, তাহার কন্যা আছে বটে।
আমি বলিলাম, “যে হয় একটা মেয়ে ধরিয়া হরেকৃষ্ণ দাসের কন্যা বলিয়া ধূর্ত লোক উপস্থিত করিতে পারে। কিন্তু সে যে যথার্থ হরেকৃষ্ণ দাসের কন্যা, তাহার কিছু প্রমাণ আছে কি?”
“আছে |” বলিয়া বিষ্ণুরাম বাবু একটা কাগজ দেখিতে দিলেন, বলিলেন, “এ বিষয়ে যে যে প্রমাণ সংগৃহীত হইয়াছে, তাহা উহাতে ইয়াদদাস্ত করিয়া রাখিয়াছি |”
আমি ঐ কাগজ লইয়া পড়িতে লাগিলাম। তাহাতে পাইলাম যে, হরেকৃষ্ণ দাসের শ্যালীপতি রাজচন্দ্র দাস; এবং হরেকৃষ্ণের কন্যার নাম রজনী।
প্রমাণ যাহা দেখিলাম, তাহা ভয়ানক বটে। আমরা এত দিন অন্ধ রজনীর ধনে ধনী হইয়া তাহাকে দরিদ্র বলিয়া ঘৃণা করিতেছিলাম।
বিষ্ণুরাম একটি জোবানবন্দীর জাবেতা নকল আমার হাতে দিয়া বলিলেন, “এক্ষণে দেখুন, এই জোবানবন্দী কাহার?”
আমি পড়িয়া দেখিলাম যে, জোবানবন্দীর বক্তা হরেকৃষ্ণ দাস। ম্যাজিষ্ট্রের সম্মুখে তিনি এক বালাচুরির মোকদ্দমায় এই জোবানবন্দী দিতেছেন। জোবানবন্দীতে পিতার নাম ও বাসস্থান লেখা থাকে; তাহাও পড়িয়া দেখিলাম। তাহা মনোহর দাসের পিতার নাম ও বাসস্থানের সঙ্গে মিলিল। বিষ্ণুরাম জিজ্ঞাসা করিলেন, “মনোহর দাসের ভাই হরেকৃষ্ণের এই জোবানবন্দী বলিয়া আপনার বোধ হইতেছে কি না?”
আমি। বোধ হইতেছে।
বি। যদি সংশয় থাকে, তবে এখনই তাহা ভঞ্জন হইবে। পড়িয়া যাউন।
পড়িতে লাগিলাম যে, সে বলিতেছে, “আমার ছয় মাসের একটি কন্যা আছে। এক সপ্তাহ হইল, তাহার অন্নপ্রাশন দিয়াছি। অন্নপ্রাশনের দিন বৈকালে তাহার বালা চুরি গিয়াছে |”
এই পর্যন্ত পড়িয়া দেখিলে, বিষ্ণুরাম বলিলেন, “দেখুন, কত দিনের জোবানবন্দী?”
জোবানবন্দীর তারিখ দেখিলাম, জোবানবন্দী ঊনিশ বৎসরের।
বিষ্ণুরাম বলিলেন, “ঐ কন্যার বয়স এক্ষণে হিসাবে কত হয়?”
আমি। ঊনিশ বৎসর কয় মাস-প্রায় কুড়ি।
বি। রজনীর বয়স কত অনুমান করেন?
আমি। প্রায় কুড়ি।
বি। পড়িয়া যাউন; হরেকৃষ্ণ কিছু পরে বালিকার নামোল্লেখ করিয়াছেন।
আমি পড়িতে লাগিলাম। দেখিলাম যে, এক স্থানে হরেকৃষ্ণ পুন:প্রাপ্ত বালা দেখিয়া বলিতেছেন, “এই বালা আমার কন্যা রজনীর বালা বটে |”
আর বড় সংশয়ের কথা রহিল না-তথাপি পড়িতে লাগিলাম। প্রতিবাদীর মোক্তার হরেকৃষ্ণকে জিজ্ঞাসা করিতেছে, “তুমি দরিদ্র লোক। তোমার কন্যাকে সোণার বালা দিলে কি প্রকারে?” হরেকৃষ্ণ উত্তর দিতেছে, “আমি গরীব, কিন্তু আমার ভাই মনোহর দাস দশ টাকা উপার্জন করেন। তিনি আমার মেয়েকে সোণার গহনাগুলি দিয়াছেন |”
তবে যে এই হরেকৃষ্ণ দাস আমাদিগের মনোহর দাসের ভাই, তদ্বিষয়ে আর সংশয়ের স্থান রহিল না।
পরে মোক্তার আবার জিজ্ঞাসা করিতেছেন, “তোমার ভাই তোমার পরিবার বা তোমার আর কাহাকে কখন অলঙ্কার দিয়াছে?”
উত্তর। না।
পুনশ্চ প্রশ্ন। সংসার খরচ দেয়?
উত্তর। না।
প্রশ্ন। তবে তোমার কন্যাকে অন্নপ্রাশনে সোণার গহনা দিবার কারণ কি?
উত্তর। আমার এই মেয়েটি জন্মান্ধ। সেজন্য আমার স্ত্রী সর্বদা কাঁদিয়া থাকে। আমার ভাই ও ভাইজ তাহাতে দু:খিত হইয়া, আমাদিগের মনোদু:খ যদি কিছু নিবারণ হয়, এই ভাবিয়া অন্নপ্রাশনের সময় মেয়েটিকে এই গহনাগুলি দিয়াছিলেন।
জন্মান্ধ! তবে যে সে এই রজনী, তদ্বিষয়ে আর সংশয় কি?
আমি হতাশ হইয়া জোবানবন্দী রাখিয়া দিলাম। বলিলাম, “আমার আর বড় সন্দেহ নাই |”
বিষ্ণুরাম বলিলেন, “অত অল্প প্রমাণে আপনাকে সন্তুষ্ট হইতে বলি না। আর একটা জোবানবন্দীর নকল দেখুন |”
দ্বিতীয় জোবানবন্দীও দেখিলাম যে, উহাও ঐ কথিত বালাচুরির মোকদ্দমায় গৃহীত হইয়াছিল। এই জোবানবন্দীতে বক্তা রাজচন্দ্র দাস। তিনি একমাত্র কুটুম্ব বলিয়া ঐ অন্নপ্রাশনে উপস্থিত ছিলেন। তিনি হরেকৃষ্ণের শ্যালীপতি বলিয়া আত্মপরিচয় দিতেছেন। এবং চুরির বিষয়সকল সপ্রমাণ করিতেছেন।
বিষ্ণুরাম বলিলেন, “উপস্থিত রাজচন্দ্র দাস সেই রাজচন্দ্র দাস। সংশয় থাকে, ডাকিয়া তাহাকে জিজ্ঞাসা করুন |”
আমি বলিলাম, “নিষ্প্রয়োজন |”
বিষ্ণুরাম আরও কতকগুলি দলিল দেখাইলেন, সে সকলের বৃত্তান্ত সবিস্তারে বলতে গেলে, সকলের ভাল লাগিবে না। ইহা বলিলেই যথেষ্ট হইবে যে, এই রজনী দাসী যে হরেকৃষ্ণ দাসের কন্যা, তদ্বিষয়ে আমার সংশয় রহিল না। তখন দেখিলাম, পিতামাতা লইয়া অন্নের জন্য কাতর হইয়া বেড়াইব!
বিষ্ণুরামকে বলিলাম, “মোকদ্দমা করা বৃথা। বিষয় রজনী দাসীর, তাঁহার বিষয় তাঁহাকে ছাড়িয়া দিব। তবে আমার জ্যেষ্ঠ সহোদর এ বিষয়ে আমার সঙ্গে তুল্যাধিকারী। তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করার অপেক্ষা রহিল মাত্র |”
আমি একবার আদালতে গিয়া, আসল জোবানবন্দী দেখিয়া আসিলাম। এখন পুরাণ নথি ছিঁড়িয়া ফেলে, তখন রাখিত। আসল দেখিয়া জানিলাম যে, নকলে কোন কৃত্রিমতা নাই।
বিষয় রজনীকে ছাড়িয়া দিলাম।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
রজনীকে বিষয় ছাড়িয়া দিলাম, কিন্তু কেহ ত সে বিষয় দখল করিল না।
রাজচন্দ্র দাস একদিন দেখা করিতে আসিল। তাহার মুখে শুনিলাম, সে শিমলায় একটি বাড়ী কিনিয়া সেইখানে রজনীকে লইয়া আছে। জিজ্ঞাসা করিলাম, টাকা কোথায় পাইলে? রাজচন্দ্র বলিল, অমরনাথ কর্জ দিয়াছেন, পশ্চাৎ বিষয় হইতে শোধ হইবে। জিজ্ঞাসা করিলাম যে, তবে তোমরা বিষয়ে দখল লইতেছ না কেন? তাহাতে সে বলিল, সে সকল কথা অমরনাথ বাবু জানেন। অমরনাথ বাবু কি রজনীকে বিবাহ করিয়াছেন? তাহাতে রাজচন্দ্র বলিল, “না |” পরে রাজচন্দ্রের সঙ্গে কথোপকথন করিতে করিতে আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “রাজচন্দ্র, তোমায় এতদিন দেখি নাই কেন?”
রাজচন্দ্র বলিল, একটু গা ঢাকা হইয়া ছিলাম |”
আমি। কার কি চুরি করিয়াছ যে, গা ঢাকা হইয়া ছিলে?
রা। চুরি করিব কার? তবে অমরনাথ বাবু বলিয়াছিলেন যে, এখন বিষয় লইয়া গোলযোগ হইতেছে, এখন একটু আড়াল হওয়াই ভাল। মানুষের চক্ষুলজ্জা আছে ত?
আমি। অর্থাৎ পাছে আমরা কিছু ছাড়িয়া দিতে অনুরোধ করি। অমরনাথ বাবু বিজ্ঞ লোক দেখিতেছি। তা যাই হৌক, এখন যে বড় দেখা দিলে?
রা। আপনার ঠাকুর আমাকে ডাকাইয়াছেন।
আমি। আমার ঠাকুর? তিনি তোমার সন্ধান পাইলেন কি প্রকারে?
রা। খুঁজিয়া খুঁজিয়া।
আমি। এত খোঁজাখুঁজি কেন? তোমায় বিষয় ছাড়িয়া দিতে অনুরোধ করিবার জন্য নয় ত?
রা। না-না-তা কেন-তা কেন? আর একটা কথার জন্য। এখন রজনীর কিছু বিষয় হইয়াছে শুনিয়া অনেক সম্বন্ধ আসিতেছে। তা কোথায় সম্বন্ধ করি-তাই আপনাদের জিজ্ঞাসা করিতে আসিয়াছি।
আমি। কেন, অমরনাথ বাবুর সঙ্গে ত সম্বন্ধ হইতেছিল? তিনি এত করিয়া রজনীর বিষয় উদ্ধার করিলেন, তাঁকে ছাড়িয়া কাহাকে বিবাহ দিবে?
রা। যদি তাঁর অপেক্ষাও ভাল পাত্র পাই?
আমি। অমরনাথের অপেক্ষা ভাল পাত্র কোথায় পাইবে?
রা। মনে করুন, আপনি যেমন, এমনই পাত্র যদি পাই?
আমি একটু চমকিলাম। বলিলাম, “তাহা হইলে অমরনাথের অপেক্ষা ভাল পাত্র হইল না। কিন্তু ছেঁদো কথা ছাড়িয়া দেও-তুমি কি আমার সঙ্গে রজনীর সম্বন্ধ করিতে আসিয়াছ?”
রাজচন্দ্র একটু কুণ্ঠিত হইল। বলিল, “হাঁ তাই বটে। এ সম্বন্ধ করিতেই কর্তা আমাকে ডাকাইয়াছিলেন |”
শুনিয়া, আকাশ হইতে পড়িলাম। সম্মুখে, দারিদ্র্য রাক্ষসকে দেখিয়া, ভীত হইয়া, পিতা যে এই সম্বন্ধ করিতেছেন, তাহা বুঝিতে পারিলাম-রজনীকে আমি বিবাহ করিলে ঘরের বিষয় ঘরে থাকিবে। আমাকে অন্ধ পুষ্পনারীর কাছে বিক্রয় করিয়া, পিতা বিক্রয়মূল্যস্বরূপ হৃত সম্পত্তি পুন:প্রাপ্ত হইবেন। শুনিয়া হাড় জ্বলিয়া গেল।
রাজচন্দ্রকে বলিলাম, “তুমি এখন যাও। কর্তার সঙ্গে আমার সে কথা হইবে |”
আমার রাগ দেখিয়া, রাজচন্দ্র পিতার কাছে গেল। সে কি বলিল, বলিতে পারি না। পিতা তাহাকে বিদায় দিয়া, আমাকে ডাকাইলেন।
তিনি আমাকে নানা প্রকারে অনুরোধ করিলেন,-রজনীকে বিবাহ করিতেই হইবে। নহিলে সপরিবারে মারা যাইব-খাইব কি? তাঁহার দু:খ ও কাতরতা দেখিয়া আমার দু:খ হইল না। বড় রাগ হইল। আমি রাগ করিয়া চলিয়া গেলাম।
পিতার কাছে হইতে গিয়া, আমার মার হাতে পড়িলাম। পিতার কাছে রাগ করিলাম, কিন্তু মার কাছে রাগ করিতে পারিলাম না-তাঁহার চক্ষের জল অসহ্য হইল। সেখান হইতে পলাইলাম। কিন্তু আমার প্রতিজ্ঞা স্থির রহিল-যে রজনীকে দয়া করিয়া গোপালের সঙ্গে বিবাহিত করিবার উদ্যোগ করিয়াছিলাম-আজি তাহার টাকার লোভে তাহাকে স্বয়ং বিবাহ করিব?
বিপদে পড়িয়া মনে করিলাম, ছোট মার সাহায্য লইব। গৃহের মধ্যে ছোট মাই বুদ্ধিমতী। ছোট মার কাছে গেলাম।
“ছোট মা, আমাকে কি রজনীকে বিবাহ করিতে হইবে? আমি কি অপরাধ করিয়াছি?”
ছোট মা চুপ করিয়া রহিলেন।
আমি। তুমিও কি ঐ পরামর্শে?
ছোট মা। বাছা, রজনী ত সৎকায়স্থের মেয়ে?
আমি। হইলই বা?
ছোট মা। আমি জানি, সে সচ্চরিত্রা।
আমি। তাহাও স্বীকার করি।
ছোট মা। সে পরম সুন্দরী।
আমি। পদ্মচক্ষু!
ছোট মা। বাবা-যদি পদ্মচক্ষুই খোঁজ, তবে তোমার আর একটা বিবাহ করিতে কতক্ষণ?
আমি। সে কি মা! রজনীর টাকার জন্য রজনীকে বিবাহ করিয়া, তার বিষয় লইয়া, তার পর তাকে ঠেলিয়া ফেলিয়া দিয়া আর একজনকে বিবাহ করা, কেমন কাজটা হইবে?
ছোট মা। ঠেলিয়া ফেলিবে কেন? তোমার বড় মা কি ঠেলা আছেন?
এ কথার উত্তর ছোট মার কাছে করিতে পারা যায় না। তিনি আমার পিতার দ্বিতীয় পক্ষের বনিতা, বহুবিবাহের দোষের কথা তাঁহার সাক্ষাতে কি প্রকারে বলিব! সে কথা না বলিয়া, বলিলাম, “আমি এ বিবাহ করিব না-তুমি আমায় রক্ষা কর। তুমি সব পার |”
ছোট মা। আমি না বুঝি, এমন নহে। কিন্তু বিবাহ না করিলে, আমরা সপরিবারে অন্নাভাবে মারা যাইব। আমি সকল কষ্ট সহ্য করিতে পারি, কিন্তু তোমাদিগের অন্নকষ্ট আমি চক্ষে দেখিতে পারিব না। তোমার সহস্র বৎসর পরমায়ু হউক, তুমি ইহাতে অমত করিও না।
আমি। টাকাই কি এত বড়?
ছোট মা। তোমার আমার কাছে নহে। কিন্তু যাহারা তোমার আমার সর্বস্ব, তাঁহাদের কাছে বটে। সুতরাং তোমার আমার কাছেও বটে! দেখ, তোমার জন্য আমরা তিন জনে প্রাণ দিতেও পারি। তুমি আমাদিগের জন্য একটি অন্ধ কন্যা বিবাহ করিতে পারিবে না?
ছোট মাও দম্ভ করিয়া বলিলেন, “তুমিও যাই বল না কেন, আমি যদি কায়েতের মেয়ে হই, তবে তোমার এ বিবাহ দিবই দিব |”
আমি হাসিয়া বলিলাম, “তবে বোধ হয়, তুমি গোয়ালার মেয়ে। আমায় এ বিবাহ দিতে পারিবে না |”
ছোট মা বলিলেন, “না বাবা, আমি কায়েতের মেয়ে |”
ছোট মা বড় দুষ্ট। আমাকে বাবা বলিয়া গালি ফিরাইয়া দিলেন।
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
আমাদিগের বাড়ীতে এক সন্ন্যাসী আসিয়া মধ্যে মধ্যে থাকিত। কেহ সন্ন্যাসী বলিত, কেহ ব্রহ্মচারী, কেহ দণ্ডী, কেহ অবধূত। পরিধানে গৈরিক বাস, কণ্ঠে রুদ্রাক্ষমালা, মস্তকে রুক্ষ কেশ, জটা নহে, রক্তচন্দনের ছোট রকমের ফোঁটা। বড় একটা ধূলাকাদার ঘটা নাই-সন্ন্যাসী জাতির মধ্যে ইনি একটু বাবু। খড়ম চন্দনকাষ্ঠের, তাহাতে হাতীর দাঁতের বৌল। তিনি যাই হউন, বালকেরা তাঁহাকে সন্ন্যাসী মহাশয় বলিত বলিয়া আমিও তাঁহাকে তাহাই বলিব।
পিতা কোথা হইতে তাঁহাকে লইয়া আসিয়াছিলেন। অনুভবে বুঝিলাম, পিতার মনে মনে বিশ্বাস ছিল, সন্ন্যাসী নানাবিধ ঔষধ জানে এবং তান্ত্রিক যাগযজ্ঞে সুদক্ষ। বিমাতা বন্ধ্যা।
পিতার অনুকম্পায় সন্ন্যাসী উপরের একটি বৈঠকখানা আসিয়া দখল করিয়াছিল। ইহা আমার একটু বিরক্তিকর হইয়া উঠিয়াছিল। আবার সন্ধ্যাকালে সূর্যের দিকে মুখ করিয়া সারঙ্গ রাগিণীতে আর্যাচ্ছন্দে স্তোত্র পাঠ করিত। ভণ্ডামী আর আমার সহ্য হইল না। আমি তাহার অর্ধচন্দ্রের ব্যবস্থা করিবার জন্য তাহার নিকট গেলাম। বলিলাম, “সন্ন্যাসী ঠাকুর, ছাদের উপর মাথা মুণ্ড কি বকিতেছিলে?”
সন্ন্যাসী হিন্দুস্থানী, কিন্তু আমাদিগের সঙ্গে যে ভাষায় কথা কহিত, তাহার চৌদ্দ আনা নিভাঁজ সংস্কৃত, এক আনা হিন্দি, এক আনা বাঙ্গালা। আমি বাঙ্গালাই রাখিলাম। সন্ন্যাসী ঠাকুর উত্তর করিলেন, “কেন, কি বকি, আপনি কি জানেন না?”
আমি বলিলাম, “বেদমন্ত্র?”
স। হইলে হইতে পারে।
আমি। পড়িয়া কি হয়?
স। কিছু না।
উত্তরটুকু সন্ন্যাসীর জিত-আমি এটুকু প্রত্যাশা করি নাই। তখন জিজ্ঞাসা করিলাম, “তবে পড়েন কেন?”
স। কেন, শুনিতে কি কষ্টকর?
আমি। না, শুনিতে মন্দ নয়, বিশেষ আপনি সুকণ্ঠ। তবে যদি কিছু ফল নাই তবে পড়েন কেন?
স। যেখানে ইহাতে কাহারও কোন অনিষ্ট নাই, সেখানে পড়ায় ক্ষতি কি?
আমি জারি করিতে আসিয়াছিলাম, -কিন্তু দেখিলাম যে, একটু হটিয়াছি-সুতরাং আমাকে চাপিয়া ধরিতে হইল। বলিলাম, “ক্ষতি নাই, কিন্তু নিষ্ফলে কেহ কোন কাজ করে না-যদি বেদগান নিষ্ফল, তবে আপনি বেদগান করেন কেন?”
স। আপনিও ত পণ্ডিত, আপনিই বলুন দেখি, বৃক্ষের উপর কোকিল গান করে কেন?
ফাঁপরে পড়িলাম। ইহার দুইটি উত্তর আছে, এক-“ইহাতেই কোকিলের সুখ”-দ্বিতীয়, “স্ত্রীকোকিলকে মোহিত করিবার জন্য |” কোন্টি বলি? প্রথমটি আগে বলিলাম, “গাইয়াই কোকিলের সুখ |”
স। গাইয়াই আমার সুখ।
আমি। তবে টপ্পা, খিয়াল প্রভৃতি থাকিতে বেদগান করেন কেন?
স। কোন্ কথাগুলি সুখকর-সামান্যা গণিকাগণের কদর্য চরিত্রের গুণগান সুখকর, না দেবতাদিগের অসীম মহিমাগান সুখকর?
হারিয়া, দ্বিতীয় উত্তরে গেলাম। “কোকিল গায়, কোকিলপত্নীকে মোহিত করিবার জন্য। মোহনার্থ যে শারীরিক স্ফূর্তি, তাহাতে জীবের সুখ। কণ্ঠস্বরের স্ফূর্তি সেই শারীরিক স্ফূর্তির অন্তর্গত। আপনি কাহাকে মুগ্ধ করিতে চাহেন?”
সন্ন্যাসী হাসিয়া বলিলেন, “আমার আপনার মনকে। মন আত্মার অনুরাগী নহে। আত্মার হিতকারী নহে। তাহাকে বশীভূত করিবার জন্য গাই |”
আমি। আপনারা দার্শনিক, মন এবং আত্মা পৃথক বলিয়া মানেন। কিন্তু মন একটি পৃথক, আত্মা একটি পৃথক পদার্থ, ইহা মানিতে পারি না। মনেরই ক্রিয়া দেখিতে পাই-ইচ্ছা, প্রবৃত্ত্যাদি আমার মনে। সুখ আমার মনে, দু:খ আমার মনে। তবে আবার মনের অতিরিক্ত আত্মা, কেন মানিব? যাহার ক্রিয়া দেখি, তাহাকেই মানিব। যাহার কোন চিহ্ন দেখি না, তাহাকে মানিব কেন?
স। তবে বল না কেন, মন ও শরীর এক। শরীর ও মনের প্রভেদ কেন মানিব? যে কিছু কার্য করিতেছ, সকলই শরীরের কার্য-কোন্টি মনের কার্য?
আমি। চিন্তা প্রবৃত্তি ভোগাদি।
স। কিসে জানিলে, সে সকল শারীরিক ক্রিয়া নহে?
আমি। তাহাও সত্য বটে। মন শরীরের ক্রিয়া*1 মাত্র।
স। ভাল, ভাল। তবে আর একটু এস। বল না কেন যে, শরীরও পঞ্চভূতের ক্রিয়া মাত্র? শুনিয়াছি, তোমরা পঞ্চভূত মান না-তোমরা বহুভূতবাদী, তাই হউক; বল না কেন যে, ক্ষিত্যাদি বা অন্য ভূতগণ, শরীররূপ ধারণ করিয়া সকলই করিতেছে? এই যে তুমি আমার সঙ্গে কথা কহিতেছ-আমি বলি যে, কেবল ক্ষিত্যাদি আমার সম্মুখে দাঁড়াইয়া শব্দ করিতেছে, শচীন্দ্রনাথ নহে। মন ও শরীরাদির কল্পনার প্রয়োজন কি? ক্ষিত্যাদি ভিন্ন শচীন্দ্রনাথের অস্তিত্ব মানি না।
হারিয়া, ভক্তিভাবে সন্ন্যাসীকে প্রণাম করিয়া উঠিয়া গেলাম। কিন্তু সেই অবধি সন্ন্যাসীর সঙ্গে একটু সম্প্রীতি হইল। সর্বদা তাঁহার কাছে আসিয়া বসিতাম ; এবং শাস্ত্রীয় আলাপ করিতাম। দেখিলাম, সন্ন্যাসীর অনেক প্রকার ভণ্ডামি আছে। সন্ন্যাসী ঔষধ বিলায়, সন্ন্যাসী হাত দেখিয়া গণিয়া ভবিষ্যৎ বলে, সন্ন্যাসী যাগ হোমাদিও মধ্যে মধ্যে করিয়া থাকে-নল চালে, চোর বলিয়া দেয়, আরও কত ভণ্ডামি করে। একদিন আমার অসহ্য হইয়া উঠিল। একদিন আমি তাহাকে বলিলাম, “আপনি মহামহোপাধ্যায় পণ্ডিত ; আপনার এ সকল ভণ্ডামি কেন?”
স। কোন্টা ভণ্ডামি?
আমি। এই নলচালা, হাতগণা প্রভৃতি।
স। কতকগুলা অনিশ্চিত বটে, কিন্তু তথাপি কর্তব্য।
আমি। যাহা অনিশ্চিত জানিতেছেন, তদ্দ্বারা লোককে প্রতারণা কেন করেন?
স। তোমরা মড়া কাট কেন?
আমি। শিক্ষার্থ।
স। যাহারা শিক্ষিত, তাহারা কাটে কেন?
আমি। তত্ত্বানুসন্ধান জন্য।
স। আমরাও তত্ত্বানুসন্ধান জন্য এ সকল করিয়া থাকি। শুনিয়াছি, বিলাতী পণ্ডিতের মধ্যে অনেকে বলেন, লোকের মাথার গঠন দেখিয়া তাহার চরিত্রের কথা বলা যায়। যদি মাথার গঠনে চরিত্র বলা যায়, তবে হাতের রেখা দেখিয়াই বা কেন না বলা যাইবে? ইহা মানি যে, হাতের রেখা দেখিয়া, কেহ এ পর্যন্ত ঠিক বলিতে পারে নাই। ইহার কারণ এই হইতে পারে যে; ইহার প্রকৃত সঙ্কেত অদ্যাপি পাওয়া যায় নাই, কিন্তু ক্রমে ক্রমে হাত দেখিতে দেখিতে প্রকৃত সঙ্কেত পাওয়া যাইতে পারে। এজন্য হাত পাইলেই দেখি।
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
আমি। আর নলচালা?
স। তোমরা লৌহের তারে পৃথিবীময় লিপি চালাইতে পার, আমরা কি নলটি চালাইতে পারি না? তোমাদের একটি ভ্রম আছে, তোমরা মনে কর যে, যাহা ইংরেজেরা জানে, তাহাই সত্য, যাহা ইংরেজ জানে না, তাহা অসত্য, তাহা মনুষ্যজ্ঞানের অতীত, তাহা অসাধ্য। বস্তুত: তাহা নহে। জ্ঞান অনন্ত। কিছু তুমি জান, কিছু আমি জানি, কিছু অন্যে জানে, কিন্তু কেহই বলিতে পারি না যে, আমি সব জানি-আর কেহ আমার জ্ঞানের অতিরিক্ত কিছু জানে না। কিছু ইংরেজে জানে, কিছু আমাদের পূর্বপুরুষেরা জানিতেন। ইংরেজেরা যাহা জানে, ঋষিরা তাহা জানিতেন না ; ঋষিরা যাহা জানিতেন, ইংরেজেরা এ পর্যন্ত তাহা জানিতে পারে নাই। সেই সকল আর্যবিদ্যা প্রায় লুপ্ত হইয়াছে ; আমরা কেহ কেহ দুই একটি বিদ্যা জানি। যত্নে গোপন রাখি-কাহাকেও শিখাই না।
আমি হাসিলাম। সন্ন্যাসী বলিলেন, “তুমি বিশ্বাস করিতেছ না? কিছু প্রত্যক্ষ দেখিতে চাও?”
আমি বলিলাম, “দেখিলে বুঝিতে পারি |”
সন্ন্যাসী বলিল, “পশ্চাৎ দেখাইব। এক্ষণে তোমার সঙ্গে আমার একটি বিশেষ কথা আছে। আমার সঙ্গে তোমার ঘনিষ্ঠতা দেখিয়া, তোমার পিতা আমাকে অনুরোধ করিয়াছেন যে, তোমাকে বিবাহে প্রবৃত্তি দিই |”
আমি হাসিয়া বলিলাম, “প্রবৃত্তি দিতে হইবে না, আমি বিবাহে প্রস্তুত-কিন্তু___”
স। কিন্তু কি?
আমি। কন্যা কই? এক কাণা কন্যা আছে, তাহাকে বিবাহ করিব না।
স। এ বাঙ্গালাদেশে কি তোমার যোগ্যা কন্যা নাই?
আমি। হাজার হাজার আছে, কিন্তু বাছিয়া লইব কি প্রকারে? এই শত সহস্র কন্যার মধ্যে কে আমাকে চিরকাল ভালবাসিবে, তাহা কি প্রকারে বুঝিব?
স। আমার একটি বিদ্যা আছে। যদি পৃথিবীতে এমত কেহ থাকে যে, তোমাকে মর্মান্তিক ভালবাসে, তবে তাহাকে স্বপ্নে দেখাইতে পারি। কিন্তু যে তোমাকে এখন ভালবাসে না, ভবিষ্যতে বাসিতে পারে, তাহা আমার বিদ্যার অতীত।
আমি। এ বিদ্যা বড় আবশ্যক বিদ্যা নহে। যে যাহাকে ভালবাসে, সে তাহাকে প্রায় প্রণয়শালী বলিয়া জানে।
স। কে বলিল? অজ্ঞাত প্রণয়ই পৃথিবীতে অধিক। তোমাকে কেহ ভালবাসে? তুমি কি তাহাকে জান?
আমি। আত্মীয়স্বজন ভিন্ন কেহ যে আমাকে বিশেষ ভালবাসে, এমত জানি না।
স। তুমি আমাদের বিদ্যা কিছু প্রত্যক্ষ করিতে চাহিতেছিলে, আজ এইটি প্রত্যক্ষ কর।
আমি। ক্ষতি কি?
স। তবে শয়নকালে আমাকে শয্যাগৃহে ডাকিও।
আমার শয্যাগৃহ বহির্বাটীতে। আমি শয়নকালে সন্ন্যাসীকে ডাকাইলাম। সন্ন্যাসী আসিয়া আমাকে শয়ন করিতে বলিলেন। আমি শয়ন করিলে, তিনি বলিলেন, “যতক্ষণ আমি এখানে থাকিব, চক্ষু চাহিও না। আমি গেলে যদি জাগ্রত থাক, চাহিও |” সুতরাং আমি চক্ষু মুদিয়া রহিলাম-সন্ন্যাসী কি কৌশল করিল, কিছুই জানিতে পারিলাম না। সন্ন্যাসী যাইবার পূর্বেই আমি নিদ্রাভিভূত হইলাম।
সন্ন্যাসী বলিয়াছিল, পৃথিবীমধ্যে যে নায়িকা আমাকে মর্মান্তিক ভালবাসে, অদ্য তাহাকেই আমি স্বপ্নে দেখিব। স্বপ্ন দেখিলাম বটে। কলকল গঙ্গাপ্রবাহমধ্যে সৈকতভূমি ; তাহার প্রান্তভাগে অর্ধজলমগ্না-কে?
রজনী
* * *
পরদিন প্রভাতে সন্ন্যাসী জিজ্ঞাসা করিলেন, “কাহাকে স্বপ্নে দেখিয়াছিলে?”
আমি। কাণা ফুলওয়ালী।
স। কাণা?
আমি। জন্মান্ধ।
স। আশ্চর্য! কিন্তু যেই হউক, তাহার অধিক পৃথিবীতে আর কেহ তোমাকে ভালবাসে না।
আমি নীরব হইয়া রহিলাম।