Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » রঙিন ধূসর || Pramit Mukherjee

রঙিন ধূসর || Pramit Mukherjee

ফার্স্ট ক্লাস এসি কম্পার্টমেন্টের কুপের দরজাটা পা দিয়ে চেপে ধরে সঙ্গের ঢাউস দুটো লাগেজ কোন মতে টেনে বের করে করিডোরে দাঁড়াতেই হঠাৎ গা-টা শিরশির করে উঠলো। কিন্তু এমন তো হওয়ার কথা নয়। আবহাওয়া যথেষ্ট গরম ছিল। এসি থেকে বের হলে যেখানে গরম লাগার কথা, সেখানে—। আবার একটা শিরশিরে অনুভূতি ছড়িয়ে গেল স্নায়ুতে। অদ্ভুত সব বদ খেয়াল কোথা থেকে যেন উঁকি মারতে লাগল। বাড়ির সবাই ঠিক আছে তো?

আজ ২৫ বছর পর বাড়ি ফিরছি বোম্বে থেকে। বাড়ির সকলের সঙ্গে একপ্রকার ঝগড়া করে ’৭৬-এর এক ভোরে পালিয়ে গিয়েছিলাম খড়্গপুর স্টেশনে। গন্তব্য বোম্বে, স্বপ্নের নগরী। সঙ্গে ছিল বাবার মানিব্যাগ থেকে চুরি করা ১০০টাকা। আগে কোনদিন বাবাকে না বলে তাঁর মানিব্যাগে হাত দিইনি, কিন্তু সেদিন কী যে হয়েছিল! গীতাঞ্জলি এক্সপ্রেসের জেনারেল কামরার বাথরুমের দরজার ধারে বসে যে হৃষীকেশ মজুমদার সেদিন বোম্বে গিয়ে পৌঁছেছিল, সেই হৃষীকেশ মজুমদার আজ ২৫ বছর পর বোম্বে ফিল্ম জগতের প্রথম সারির একজন পরিচালক। প্রথম ১০ বছর হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পর ১৫ বছরের কেরিয়ারে হৃষীকেশ মজুমদারের নামের পাশে জ্বলজ্বল করছে ১২টা জাতীয় পুরস্কার, ৯টা আন্তর্জাতিক পুরস্কার আর ৩৬টা ব্লকবাস্টার ছবি। বোম্বেতে এতদিন যেখানে স্টার-কাস্টের নামে ছবি চলত, সেখানে ‘রাইটার-ডিরেক্টর’ হৃষীকেশ মজুমদার একটা ব্র্যান্ডে পরিণত হয়েছে, স্টার মেকার। আজকে সেই গীতাঞ্জলি এক্সপ্রেসের ফার্স্ট ক্লাস এসি কম্পার্টমেন্টে বাড়ি ফেরাটা বোধহয় জীবনচক্রের পূর্ণতারই একপ্রকার ইঙ্গিত।

কিছুক্ষণ আগে একটা বেয়ারা এসে জানিয়ে গিয়েছিল যে খড়্গপুর আসছে, তাই ঢাউস লাগেজ দুটো নিয়ে কুপের করিডোর দিয়ে কোনক্রমে কম্পার্টমেন্টের মূল দরজার কাছে এসে দাঁড়ালাম। দরজাটা বন্ধ ছিল। লাগেজ দুটো মাটিতে নামিয়ে রেখে দরজাটা খুলে দিলাম। বাইরে চারিদিকে প্রচন্ড কুয়াশা। দিন না রাত বোঝার উপায় নেই। হাতঘড়ির দিকে তাকালাম। সে জানান দিল, সূর্যদেব ঘুম থেকে জেগে ওঠার তোরজোড় শুরু করেছেন, ৪টে বাজতে কয়েক মিনিট বাকি। হঠাৎ কুয়াশায় মোড়া একটা ছোট্ট স্টেশনে ট্রেনটা প্রচন্ড ঝাঁকুনি দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। ফাঁকা স্টেশনটিতে কোন লোকজন নেই। আমার কেমন যেন চেনা চেনা লাগল স্টেশনটা। ঠিক সেই সময়েই একটা শিরশিরে ঠান্ডা হাওয়া যেন কানে কানে ফিসফিস করে বলে গেল,
-“এই তো, তোমার গন্তব্য এসে গেছে। নেমে পড়ো। আর দেরি করোনা।”

আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত নেমে পড়লাম স্টেশনটাতে। আমার দুটো ঢাউস লাগেজের কথা মনেও রইল না। আমার পিছনে ট্রেনটা কখন যে নিঃশব্দে চলে গেল, টেরও পেলাম না। সেই অন্ধকার ভোরে জনহীন স্টেশনে আমি একা, আর আমায় ঘিরে একরাশ কুয়াশা। আমার সামনে একটা ল্যাম্পপোস্টের আলো দপদপ করছে। সেই আলোর নীচে একটা ফাঁকা বেঞ্চ। আমি বেঞ্চটা লক্ষ্য করে এগিয়ে যেতেই চোখে পড়ল বেঞ্চটার ডানদিকের কোণায় প্রায় আবছা হয়ে যাওয়া লেখাটা, ‘DURGANARAYANPUR 12’। সঙ্গে সঙ্গেই আমার চারিদিকের কুয়াশা কেমন করে যেন পাতলা হয়ে যেতে লাগলো। বুঝতে পারলাম এই-ই আমার শহর— দুর্গানারায়ণপুর। কিন্তু ২৫ বছর আগে ছেড়ে যাওয়া স্টেশনের সঙ্গে এই স্টেশনের কোন মিলই আমি খুঁজে পেলাম না। ২৫ বছরে অনেক কিছু বদলে যাবে সেটা প্রকৃতির নিয়ম। কিন্তু স্টেশনটা যেন কারো অপেক্ষা করতে করতে বুড়িয়ে গেছে। প্ল্যাটফর্ম ভর্তি শুকনো পাতার ছড়াছড়ি। হলুদের উপর কালো দিয়ে লেখা ‘মহিলা কামরা’ বোর্ডটা যে কৃষ্ণচূড়া গাছটায় লাগানো ছিল, সেটা আজও ফুলে-পাতায় ভর্তি; কিন্তু সবই শুকনো—ধূসর।

পূর্বদিকের আকাশ তখন সবে রক্তিম হয়েছে। সেদিকে তাকাতেই লক্ষ্য করলাম একটা বাচ্ছা ছেলে, বয়স বড়জোর ৪ কি ৫ —আমার দিকে এগিয়ে আসছে। ছেলেটি যে জায়গাতেই পা রাখছে তা ধীরে ধীরে রঙিন হতে শুরু করল। ছেলেটিকে আমার ভীষণ চেনা মনে হল, কিন্তু কোথায় দেখেছি মনে করতে পারলাম না। বাচ্ছাটি তার ডান হাতটা আমার দিকে তুলে আমাকে তার পিছন পিছন যেতে ইশারা করল। আমিও রঙের নেশায় ছুটে চললাম তার পিছনে, এই ধূসর পৃথিবীর উপর দিয়ে।

কখন প্ল্যাটফর্ম ছাড়িয়ে এগিয়ে এসেছি খেয়াল নেই, দেখলাম আমি একটা রিক্সায় করে কোনোদিকে চলেছি। চারপাশের পৃথিবী সেইরকমই ধূসর। যে রাস্তা ধরে রিক্সা চলেছে, সেই রাস্তায় অনেক লোক সার বেঁধে হেঁটে এগিয়ে চলেছে রিক্সার বিপরীতে কোন এক অজানার উদ্দেশ্যে। প্রত্যেকের পরণে সাদা পোশাক। সবার মাথা মাটির দিকে ঝুঁকে আছে। দেখে মনে হল ওঁরা যেন মাথা নত করে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করছেন আমার প্রতি। তাঁদের মধ্যেই একজন হঠাৎ মাথা আকাশের দিকে তুলে চেঁচিয়ে উঠলেন,
-“কর্মফল! কর্মফল নিজের জীবদ্দশাতেই ভোগ করতে হবে। কেউ পার পাবেনা।”

কথাটা আমাকে ভিতর থেকে নাড়িয়ে দিল। সত্যিই তো! আমি বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার পর থেকে কোনদিন ভুলেও বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ করিনি। টেলিফোন তো দূর, একটা চিঠি পর্যন্ত লিখিনি বাবা-মা কে। তাঁরা আদৌ বেঁচে আছেন না মারা গেছেন তা-ও জানিনা। শিরদাঁড়ায় আবার বয়ে গেল সেই ঠান্ডা স্রোত। রিক্সাওয়ালা আচমকা হাঁক দিল,
-“বাবু , এসে গেছি আপনার ঘর। নেমি পড়েন।”

রিক্সাওয়ালার ডাকে চমক ভেঙে দেখি আমার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে রিক্সাটা। বাড়িটার বয়স যেন দেখে মনে হচ্ছে প্রায় ২৫০ বছর। রিক্সা থেকে নেমে পকেট হাতড়ে আমার মানিব্যাগটা বের করে তার থেকে একটা ২০টাকার নোট রিক্সাওয়ালার দিকে এগিয়ে দিলাম। রিক্সাওয়ালা এক গাল হেসে হাত জোড় করে মাথা নেড়ে বলল,

-“আমার বাবা একটা কথা কইতেন জানেন বাবু। কইতেন, জীবনে কারুর পোঁয়ে কাঠি করতি গেলি সাতবার ভাববি যে উই ৭ইঞ্চির কাঠি ৭বচ্ছর পরে ৭ফুটির বাঁশ হয়ে তোর পোঁয়ে ফিরত আসবে।”

কথাটা বলেই রিক্সা সমেত লোকটা যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। কী আশ্চর্য! একটা গরীব, অশিক্ষিত রিক্সাচালক কি অবলীলায় বুঝিয়ে দিল কর্মফলের সারবস্তু।
বাড়ির জরাজীর্ণ লোহার গেটটা ঠেলে ঢুকলাম বাড়ির সামনেটায় আমার বাবার করা একফালি বাগানে। বাগানের গাছগুলোয় সেই আগের মত পাতা-ফুল সবই আছে, কিন্তু তাঁদের রং সেই ধূসর। বাগানের মধ্যে দিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে গেলাম বাড়ির দিকে। বাড়ির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কি মনে হতে পিছনে তাকালাম। অবিশ্বাস্য ব্যাপার! বাড়ির দরজা পর্যন্ত যতটা রাস্তা আমি এসেছি, তার পুরো পরিবেশটাই নিজের রং ফিরে পেয়েছে। স্বাভাবিক রঙিন হয়ে উঠেছে চারিপাশ। শুধু আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বাড়িটাই এখনও ধূসর। বাড়ির দরজার পাল্লাগুলোয় দু-হাতে ঠ্যালা দিতেই সশব্দে সেগুলো খুলে গেল, আর বাড়ির ভিতর থেকে আসা তীব্র আলোকদ্যুতি ধাঁধিয়ে দিল আমার চোখ…।

চোখটা কচলে দেখলাম ট্রেনের লোয়ার বার্থে শুয়ে আছি। মাথার কাছে জানলার পর্দাটা রাত্রে টানতে ভুলে গিয়েছিলাম, তাই বাইরে থেকে সূর্যের আলো বোম্বে-হাওড়া গীতাঞ্জলি এক্সপ্রেসের ফার্স্ট ক্লাস এসি কম্পার্টমেন্টের ৩ নম্বর কুপের জানলার কাঁচের মধ্যে দিয়ে সরাসরি আমার চোখে এসে পড়ছে। শুনতে পেলাম কুপের দরজায় ‘ঠক ঠক’ শব্দ। কোন মতে হাত বাড়িয়ে জানলার লাগোয়া বার্থের পাশে থাকা টেবিলের উপর থেকে আমার চশমাটা তুলে, চোখে পরে, বার্থের উপর বসে বার্থের নীচে সাজিয়ে রাখা হাওয়াই চটি জোড়া পায়ে গলিয়ে উঠে গিয়ে কুপের দরজাটা সরিয়ে খুলে দিতেই দেখলাম হাতে চায়ের ট্রে নিয়ে বেয়ারা দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখেই সে একগাল হেসে বলল,
-“গুডমর্নিং স্যার, আপনার বেড-টি। আপনি গতকাল রাত্রে আমাকে বলেছিলেন আজকে খড়্গপুর আসার আগে আপনাকে ডেকে দিতে তাই…। মিনিট ১৫র মধ্যেই ট্রেন খড়্গপুর ঢুকবে স্যার।
-“ওহ, থ্যাঙ্ক ইয়ু।”
বেয়ারা চায়ের ট্রে-টা টেবিলের উপর রেখে কুপের দরজাটা টেনে দিয়ে চলে গেল। আমি চা খেয়ে আমার লাগেজগুলো গোছাতে শুরু করলাম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress