একাদশ পরিচ্ছেদ – পূৰ্ব্বকথা
এই ঘটনার কিয়ৎক্ষণ পরে প্রতাপ পূর্ব্বে অজয়সিংহের বাড়ী হইতে আসিয়া যেখানে একটা ঘোড়া রাখিয়া আসিয়াছিলেন, পুনরায় তথায় উপস্থিত হইলেন। আবার সেই ব্যক্তি আসিয়া তাঁহাকে বসন-ভূষণ প্রদান করিল। ছদ্মবেশ পরিত্যাগ করিয়া, সেই সকল বস্ত্রাদি পরিধান পূর্ব্বক প্ৰতাপ রায়মল্ল সাজিলেন।
ঊষার চিহ্ন তখনও চারিদিকে সম্পূর্ণ দৃষ্ট হয় নাই। অল্প অল্প আলো, অল্প অল্প অন্ধকার তখনও বৰ্ত্তমান। ভগবান অংশুমালী তখনও গগনপটে অনুদিত। রায়মল্ল সাহেব ঘোটকে আরোহণ করিয়াই তীরবেগে অশ্বচালনা করিলেন। দিনমণি আকাশে পূর্ণজ্যোতিঃ প্রকাশ করিবার পূর্ব্বেই তিনি অজয়সিংহের বাটীতে পৌঁছিলেন। মঙ্গল আসিয়া সদর দরজা খুলিয়া দিল। নিঃশব্দে তিনি রোগীর শয্যাপার্শ্বে যাইয়া উপবেশন করিলেন।
অজয়সিংহ নানা প্রশ্ন করিলে, তিনি সংক্ষেপে সমস্ত কথা তাঁহাকে বিবৃত করিয়া তারার আদ্যোপান্ত ঘটনা বর্ণন করিতে অনুরোধ করিলেন। অজয়সিংহ বলিতে আরম্ভ করিলেন, “তারার পিতা অতুল সম্পত্তি রাখিয়া পরলোক গমন করেন। তারা তাঁহার একমাত্র কন্যা, অন্য উত্তরাধিকারী বা উত্তরাধিকারিণী কেহ ছিল না। তারার পিতা মৃত্যুকালে এই মৰ্ম্মে একখানা উইল করেন, যতদিন না তারার বিবাহ হয়, ততদিন তাহার বিমাতা তাহার অভিভাবিকা স্বরূপ থাকিবেন। তারার বিবাহ হইলে সেই জামাতা তাঁহার বিষয়ের অধিকারী হইবেন, এবং তারার বিমাতা খোরাক-পোষাক ও পাঁচশত টাকা মাসহারা পাইবেন। কিন্তু যদি দুরদৃষ্টক্রমে তারার মৃত্যু হয়, তাহা হইলে তারার বিমাতা পোষ্যপুত্র গ্রহণ করিবেন এবং সেই-ই তাঁহার বিষয়ের উত্তরাধিকারী হইবে। তাহাতেও তারার বিমাতা আজীবন মাসহারা ও খোরাক-পোষাক প্রাপ্ত হইবেন।
“তারার বয়ঃক্রম যখন পাঁচ বৎসর, তখন তারার বিমাতা তাহাকে তাহার মাসীর বাড়ীতে ছল করিয়া পাঠাইয়া দেন। সেখানে লোক লাগাইয়া একটা পুষ্করিণীতে তাহাকে ডুবাইয়া মারে।
“তারার পিতা আমার খুড়তুতো ভাই। আমাদের দুই ভায়ে বড় অসদ্ভাব ছিল। পূর্ব্বে আমাদের পৈতৃক-সম্পত্তি ভাগ হয় নাই; কিন্তু তারার পিতার সহিত আমার অসদ্ভাব হওয়াতে মোকদ্দমা করিয়া আমি বিষয়-সম্পত্তির ভাগ করিয়া লই।
“তারার পিতা ব্যবসা-বাণিজ্য করিতেন। আমিও ব্যবসা-বাণিজ্য করিতাম। তিন পুরুষ আমরা তাহাই করিতেছি। আমার পিতামহ হইতে কেহ কখনও দাসত্ব স্বীকার করেন নাই। অদৃষ্টগুণে তারারপিতা ব্যবসায়ে বিশেষ উন্নতি করেন। আমার দুর্ভাগ্যবশতঃ আমি ব্যবসায়ে সৰ্ব্বস্বান্ত হই। তাঁহার মৃত্যুর কিছু পূর্ব্বে আবার আমার সহিত তাহার সদ্ভাব হয়।”
“যখন আমি তারার পুকুরে ডুবে মরার সংবাদ পাই, তখন মৃতদেহ দেখিবার জন্য আমি তথায় যাই-“
রায়মল্ল সাহেব বলিলেন, “তারার মৃতদেহ! আপনি কি বলছেন? তারা ত এখনও জীবিত! “ অজয়সিংহ হাসিয়া বলিলেন, “ঐটুকুই ত কথা। তারার মৃত্যু হয় নাই বটে, কিন্তু ঠিক তারার মত আর একটি মেয়ের মৃত্যু ঘটিয়াছিল। তারার বিমাতা সেই মৃতদেহটিকে তারার মৃতদেহ বলিয়া লইয়া য়ায়। কাজেকাজেই লোক জানে তাহার মৃত্যু হইয়াছে। আমি তারাকে খুব কমই দেখিয়াছিলাম, মৃতদেহ দেখিয়া তাই পূর্ব্বে চিনিতে পারি নাই।”