প্রথম পরিচ্ছেদ – তারার সহায়
অভাগিনী তারা সেই বিপদ-সঙ্কুল অবস্থায় হিতাহিতজ্ঞানশূন্যা হইয়া অনেকক্ষণ নানা বিষয়ে চিন্তা করিতে লাগিল; কিন্তু উপায় স্থির করিতে পারিল না। সে যতবার নিরুৎসাহ হইয়াছিল, যতবার মরিবার চেষ্টা করিয়াছিল, ততবারই কাহারও-না-কাহারও উত্তেজনায় তাহার যেন কতকটা সাহস হইয়াছিল। তারা আপনা-আপনি বলিল, “কে আমায় এ-বিপদে উদ্ধার করিবে? কেন এরা আমায় বাধা দেয়? কার আশায়, কি সাহসে বুক বাঁধিব?”
পশ্চাদ্দিক হইতে কে আবার বলিল, “কেন তুমি ভয় পাচ্ছ? তোমায় রক্ষা করবার জন্য চারিদিকে লোক রয়েছে! তোমার অনিষ্ট করে, কার সাধ্য?”
তারা পশ্চাদ্দিকে চাহিয়া দেখিল, সেই পূর্ব্বেকার মত শিবিরের পরদা একটু সরাইয়া সে লোক তাঁহাকে সাহস প্রদান করিতেছে।
তারা বলিল, “আপনি যেই হ’ন, জানেন না, আমি কত বড় বিপদে পড়েছি। এ রকম নিঃসহায় অবস্থায় রঘুর হাত থেকে কে আমায় উদ্ধার করবে? এ বিপদে কে আমার সহায় হবে?”
উত্তর। তোমার এখন কোন বিপদ ঘটে নি।
তারা। আপনি কে?
উত্তর। আমি একজন তোমার শুভাকাঙ্ক্ষী।
তারা। আপনি আমার সহায়তা করতে পারবেন? আমায় ঐ বিপদ্ হ’তে রক্ষা করতে পারবেন?
উত্তর। নিশ্চয়ই পারব; নইলে আমি এখানে দাঁড়িয়ে কেন? তোমার কোন ভয় নাই, তুমি নিশ্চিন্ত থাক। তুমি তোমার বিপদ্ যত নিকটবর্ত্তী ব’লে মনে করছ, রঘুনাথের বিপদ্ তার চেয়ে এগিয়ে এসেছে।
তারা। দস্যুদলের মধ্যে প্রতাপসিংহ-ই আমার একমাত্র আশার স্থল ছিলেন। তিনি যখন রঘুনাথের চক্রান্তে প’ড়ে অকালে মৃত্যুমুখে পতিত হ’লেন, তখন আর কার ভরসায়
উত্তর। তাতে আর কি হয়েছে?
তারা। তাঁরই ভালবাসায় আমি এতক্ষণ পর্য্যন্ত নিরাশ হই নি।
উত্তর। তিনি ছাড়া আরও লোক আছেন।
তারা। কে?
উত্তর। পরে জানতে পারবে। এখন তুমি সাবধান হও। এখনই রঘুনাথ ফিরে আসবে। তুমি যে ভয় পেয়েছ, সে ভাব তাঁকে কিছু দেখিও না। আর রঘুকে ভয় করবারও কোন কারণ নাই।
তারা। আশ্চর্য্য কথা!
উত্তর। কিছুই আশ্চর্য্য নয়। যখন সময় হবে, তখনই গুপ্ত-রহস্য বুঝতে পারবে।
তারা। যদি রঘুনাথ আমার উপর অত্যাচার করে? যদি আমায় তার সঙ্গে যেতে বলে?
উত্তর। যেতে বলে, যাবে। কোন ভয় নাই; রঘু তোমার কোন ক্ষতি করতে পারবে না।
তারা। তবে আপনি কখনই আমার হিতৈষী নন্, নিশ্চয়ই রঘুর চর।
উত্তর। না, তুমি ভুল বুঝেছ। আমি তোমার হিতকারী। তুমি আমার কথায় বিশ্বাস কর। রঘুনাথের চেয়েও বলবান্ অনেক লোক এই দলে আছেন। প্রতি মুহূর্ত্তেই তোমার উপরে তাঁরা নজর রাখছেন। রঘুনাথ যা’ ব’লে, তাই কর। ওর দিন ফুরিয়ে এসেছে। ঐ রঘু আসছে—
যেমন তারা অন্যদিকে মুখ ফিরাইল, ঈষদুন্মুক্ত যবনিকান্তরাল হইতেও সে মূৰ্ত্তি অন্তর্হিত হইল। তারা পুনরায় সেদিকে ফিরিয়া আর তাঁহাকে দেখিতে পাইল না।
পরক্ষণে রঘুনাথ আসিয়াই বলিল, “এস তারা, আমাদের বিবাহের সব প্রস্তুত। যাবে, না জোর ক’রে টেনে নিয়ে যাব?”
তারা বলিল, “না, আমি যাচ্ছি, তুমি আমার গায়ে হাত দিও না।”