ঊষাপতিবাবুও আসিয়াছিলেন
আমরা সদর দরজার বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইলাম। ঊষাপতিবাবুও আমাদের পিছন পিছন আসিয়াছিলেন, তাঁহার মুখের বিস্ময়াহত ভাব সম্পূর্ণ কাটে নাই। তিনি দ্বার বন্ধ করিয়া দিবার উপক্রম করিয়া বলিলেন, ‘আমাদের মানসিক অবস্থা বুঝে ক্ষমা করবেন। নমস্কার।’
দরজা প্ৰায় বন্ধ হইয়া আসিয়াছে, এমন সময় ব্যোমকেশ বলিল, ‘ওটা কী?’
আসিবার সময় চোখে পড়ে নাই, কবাটের
উচুতে একটি সোনালী চাকতি চকচক করিতেছে। ঊষাপতিবাবু দ্বার বন্ধ করিতে গিয়া থামিয়া গেলেন। চাকতিটা আয়তনে চাঁদির টাকার চেয়ে কিছু বড়। ব্যোমকেশ নত হইয়া সেটা দেখিল, আঙুল দিয়া সেটা পরীক্ষা করিল। বলিল, ‘রাংতার চাকতি, গদ দিয়ে কবাটে জোড়া রয়েছে।’ সে সোজা হইয়া ঊষাপতিবাবুকে জিজ্ঞাসা করিল, ‘এটা কী?’
ঊষাপতিবাবু দ্বিধাভরে বলিলেন, ‘কী জানি, আগে লক্ষ্য করেছি বলে মনে হচ্ছে না।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘সম্প্রতি কেউ সেঁটেছে। বাড়িতে ছোট ছেলেপিলে থাকলে বোঝা যেত। কিন্তু–আপনি একবার খোঁজ নেবেন?’
ঊষাপতিবাবু সহদেবকে ডাকিলেন, সে যথারীতি বলিল, ‘আমি কিছু জানিনে বাবু।’চুমকিও কিছু বলিতে পারিল না। শীতাংশু বলিল, ‘আমি কাল সন্ধের সময় যখন বাড়ি এসেছি তখন ওটা ছিল না।’
আমার মাথায় নানা চিন্তা আসিতে লাগিল। সত্যকামকে যে খুন করিয়াছে সে কি নিজের পরিচয়ের ইঙ্গিত এইভাবে রাখিয়া গিয়াছে? হরতনের টেক্কা! লোমহর্ষণ উপন্যাসে এই ধরনের জিনিস দেখা যায় বটে। কিন্তু–
কোনও হদিস পাওয়া গেল না। আমরা চলিয়া আসিলাম।
রাস্তায় বাহির হইয়া ব্যোমকেশ হাতের ঘড়ি দেখিয়া বলিল, ‘এখনও দশটা বাজেনি। চল, থানাটা ঘুরে যাওয়া যাক।’
থানার দিকে চলিতে চলিতে ব্যোমকেশ এক সময় জিজ্ঞাসা করিল, ‘বাড়ির লোকের এজেহার শুনলে। কী মনে হল?’
এই কথাটাই আমার মনের মধ্যে ঘুরপাক খাইতেছিল। বলিলাম, ‘কাউকেই খুব বেশি শোকার্ত মনে হল না।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘প্রবাদ আছে, অল্প শোকে কাতর, বেশি শোকে পাথর।’
বলিলাম, ‘প্রবাদ থাকতে পারে, কিন্তু ঊষাপতিবাবু এবং তাঁর স্ত্রীর আচরণ খুব স্বাভাবিক নয়। সত্যকাম ভাল ছেলে ছিল না, নিজের উচ্ছঙ্খলতায় বাপমা’কে অতিষ্ঠা করে তুলেছিল, সবই সতি্যু হতে পারে। তবু ছেলে তো। একমাত্র ছেলে। আমার বিশ্বাস এই পরিবারের মধ্যে কোথাও একটা মস্ত গলদ আছে।’
‘অবশ্য। সত্যকামই তো একটা মস্ত গলদ। সে যাক, দরজায় রাংতার চাকতির অর্থ কিছু বুঝলে?’
‘না। তুমি বুঝেছি?’
‘সম্পূর্ণ আকস্মিক হতে পারে। কিন্তু তা যদি না হয়—’
থানায় পৌঁছিয়া দেখিলাম, দারোগা ভবানীবাবু আমাদের পরিচিত লোক। বয়স্থ ব্যক্তি; ক্বশ-বেল্ট টেবিলের উপর খুলিয়া রাখিয়া কাজ করিতেছেন। আমাদের দেখিয়া খুব খুশি হইয়াছেন মনে হইল না। তবু যথোচিত শিষ্টতা দেখাইয়া শেষে খাটো গলায় বলিলেন, ‘আপনি আবার এর মধ্যে কেন?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘পকেচক্ৰে জড়িয়ে পড়েছি।’
ভবানীবাবু পূর্ববৎ নিম্নস্বরে বলিলেন, ‘ছোঁড়া পাকা শয়তান ছিল। যে তাকে খুন করেছে সে সংসারের উপকার করেছে। এমন লোককে মেডেল দেওয়া উচিত।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘তা বটে। আপনারা যা করছেন করুন, আমি তার মধ্যে নাক গলাতে চাই না। আমি শুধু জানতে চাই–’
ভবানীবাবু তাহাকে দৃষ্টি-শিলাকায় বিদ্ধ করিয়া বলিলেন, ‘সত্যান্বেষণ? কী জানতে চান বলুন।’
‘পোস্ট-মর্টেম রিপোর্ট এখনও বোধহয় আসেনি?’
‘না। সন্ধ্যে নাগাদ পাওয়া যেতে পারে।’
‘সন্ধ্যোর পর আমি আপনাকে ফোন করব-বন্দুকের গুলিতেই মৃত্যু হয়েছে?’
‘বড় বন্দুক নয়, পিস্তল কিম্বা রিভলবার। গুলিটা পিঠের বা দিকে ঢুকেছে, সামনে কিন্তু বেরোয়নি। শরীরের ভিতরেই আছে। পিঠে যে ফুটো হয়েছে সেটা খুব ছোট, তাই মনে হয় পিস্তল কিম্বা রিভলবার।’
‘পিঠের দিকে ফুটো হয়েছে, তার মানে যে গুলি করেছে সে সত্যকমের পিছনে ছিল।’
‘হ্যাঁ। হয়তো ফটকের ভিতর দিকে ঝোপঝাড়ের মধ্যে লুকিয়ে বসে ছিল, যেই সত্যকাম সদর দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে অমনি গুলি করেছে, তারপর ফটক দিয়ে বেরিয়ে গেছে।’
‘হুঁ। এ-পাড়ায় একটা ব্যায়াম সমিতি আছে আপনি জানেন? ‘জানি। তাদের কাজ নয়। তারা দু-চার ঘা প্রহার দিতে পারে, খুন করবে না, সবাই ভদ্রলোকের ছেলে।’
ভদ্রলোকের ছেলে খুন করে না, পুলিসের মুখে একথা নুতন বটে। কিন্তু ব্যোমকেশ সেদিক দিয়া গেল না, বলিল ‘ভদ্রলোকের ছেলের কথায় মনে পড়ল। সত্যকমের এক পিসতুতো ভাই বাড়িতে থাকে, তাকে দেখেছেন?’
ভবানীবাবু একটু হাসিলেন, ‘দেখেছি। পুলিসে তার নাম আছে।’
‘তাই নাকি! কী করেছে। সে?’
‘ছেলেটা ভালই ছিল, তারপর গত দাঙ্গার সময় ওর বোপকে মুসলমানেরা খুন করে। সেই থেকে ওর স্বভাব বদলে গেছে। আমাদের সন্দেহ ও কম-সে-কম গোটা তিনেক খুন করেছে। অবশ্য পাকা প্রমাণ কিছু নেই।’
‘ওর চোখের চাউনি দেখে আমারও সেই রকম সন্দেহ হয়েছিল। আপনার কি মনে হয় এ-ব্যাপারে তার হাত আছে?’
‘কিছুই বলা যায় না, ব্যোমকেশবাবু। সত্যকমের মত পাঁঠা যেখানে আছে সেখানে সবই সম্ভব। তবে যতদূর জানতে পারলাম যখন খুন হয় তখন সে বাড়ির মধ্যে ছিল। সহদেবের চীৎকার শুনে ওর মামা আর ও একসঙ্গে সদর দরজায় পৌঁচেছিল। সত্যকামকে পিছন থেকে যে গুলি করেছে তার পক্ষে সেটা সম্ভব নয়।’
ব্যোমকেশ প্রশ্ন করিল, ‘ছাতের ওপর থেকে গুলি করা কি সম্ভব?’
ভবানীবাবু বলিলেন, ‘ছাতের ওপর গুলি করলে গুলিটা শরীরের ওপর দিক থেকে নীচের দিকে যেত। গুলিটা গেছে। পিছন দিক থেকে সামনের দিকে। সুতরাং—’
এই সময় টেলিফোন বাজিল। ভবানীবাবু টেলিফোনের মধ্যে দু’চার কথা বলিয়া আমাদের কহিলেন, ‘আমাকে এখনি বেরুতে হবে। জোর তলব–’
‘আমরাও উঠি।’ ব্যোমকেশ উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, ‘ভাল কথা, মৃত্যুকালে সত্যকমের সঙ্গে কী কী জিনিস ছিল–’
‘ঐ যে পাশের ঘরে রয়েছে, দেখুন না গিয়ে।’ বলিয়া ভবানীবাবু কোমরে কেল্ট বাঁধিতে লাগিলেন।
পাশের ঘরে একটি টেবিলের উপর কয়েকটি জিনিস রাখা রহিয়াছে। সোনার সিগারেট-কেসটি দেখিয়াই চিনিতে পারিলাম। তাছাড়া হুইস্কির ফ্ল্যাসিক, চামড়ার মনিব্যাগ, একটি ছোট বৈদ্যুতিক টর্চ প্রভৃতি রহিয়াছে। ব্যোমকেশ সেগুলির উপর একবার চোখ বুলাইয়া ফিরিয়া আসিল। ভবানীবাবু এতক্ষণে কেল্ট বাঁধা শেষ করিয়াছেন, দেরাজ হইতে পিস্তল লইয়া কোমরের খাপে পুরিতেছেন। বলিলেন, ‘দেখলেন? আর কিছু দেখবার নেই তো? আচ্ছা, চলি।’
ভবানীবাবু চলিয়া গেলেন। তাঁহার ভাবগতিক দেখিয়া মনে হইল, তিনি আসামীকে ধরিবার কোনও চেষ্টাই করিবেন না। শেষ পর্যন্ত সত্যকমের মৃত্যু-রহস্য অমীমাংসিত থাকিয়া যাইবে।
আমরাও বাহির হইলাম। ব্যোমকেশ বলিল, ‘এতদূর যখন এসেছি, চল বাগের আখড়া দেখে যাই।’
‘এখন কি কারুর দেখা পাবে?’
‘দেখাই যাক না। আর কেউ না থাক বাগ মশাই নিশ্চয় গুহায় আছেন।’
বাঘ কিন্তু গুহায় নাই। গিয়া দেখিলাম দরজায় তালা লাগানো। একজন ভৃত্য শ্রেণীর লোক দাওয়ায় বসিয়া বিড়ি টানিতেছিল, সে বলিল, ‘ভূতু সর্দারকে খুঁজতেছেন? আজ্ঞে তিনি আজ সকালের গাড়িতে কাশী গেছেন।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘বল কি! একেবারে কাশী!-তুমি কে?’
লোকটি বলিল, ‘আজ্ঞে আমি তেনার চাকর। ঘর ঝাঁট দি, কাপড় কাচি, কলসীতে জল ভরি। আজ সকালে ঘর ঝাঁট দিতে এসে দেখনু সদার খবরের কাগজ পড়তেছেন। কলসীতে জল ভরে নিয়ে এনু, সদর সেজোগুজে তৈরি। কইলেন, আমি কাশী চক্ষু, সন্ধ্যেবেলা ছেলেরা এলে কয়ে দিও।’
বুঝিতে বাকী রহিল না, ভূতেশ্বর বাগ খবরের কাগজের সংবাদ পড়িয়াছেন এবং বিলম্ব না। করিয়া অন্তর্হিত হইয়াছেন।
বাসায় ফিরিলাম প্ৰায় সওয়া এগারোটায়। দেখি বন্ধ দরজার সামনে নন্দ ঘোষ প্রতীক্ষ্ণমাণভাবে পায়চারি করিতেছে। তাহার মুখ শুষ্ক, চোখে শঙ্কিত অস্বচ্ছন্দ্য। ব্যোমকেশ দ্বারের কড়া নাড়িয়া স্মিতমুখে নন্দকে জিজ্ঞাসা করিল, ‘কী খবর?’
‘আজ্ঞে স্যার…’ বলিয়া নন্দ ঠোঁট চাটিতে লাগিল।
পুঁটিরাম আসিয়া দরজা খুলিয়া দিল, আমরা নন্দকে লইয়া ভিতরে আসিয়া বসিলাম। নন্দ আরও দু’চার বার ঠোঁট চাটিয়া বলিল, ‘সত্যকমের খবর শুনেছেন?’
ব্যোমকেশ সিগারেট ধরাইতে ধরাইতে বলিল, ‘শুনেছি। তুমি কোথায় শুনলে?’
নন্দ বলিল, ‘সকালবেলায় ও-পাড়ায় এক বন্ধুর বাড়িতে গিয়েছিলাম, খবর পেলাম কাল রাত্তিরে কেউ সত্যকামকে গুলি করে মেরেছে। আমি কিন্তু কিছু জানি না। স্যার। কাল সন্ধ্যেবেলা সেই যে আপনার আখড়া থেকে চলে এলেন, তারপর আমি আরও ওদিকে যাইনি।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘বোস, তোমাকে দু-চারটে কথা জিজ্ঞেস করি। ও-পাড়ায় তোমার জানাশোনার মধ্যে কারুর পিস্তল কিম্বা রিভলবার আছে?’
‘না স্যার। থাকলেও আমি জানি না।’
‘তোমাদের আখড়ায় কারুর নেই?’
‘জানি না। তবে একটা লোক ভূতেশ্বরের কাছে চোরাই পিস্তল বিক্রি করতে এসেছিল।’
‘চোরাই পিস্তল?’
‘হ্যাঁ স্যার। শুনেছি। যুদ্ধের পর অনেক চোরাই পিস্তল কিনতে পাওয়া যেত।’
‘ভুতেশ্বর কিনেছিল?’
‘তা জানি না। আমাদের সামনে কেনেনি।’
‘আচ্ছা, ও-কথা যাক।–সত্যকাম ভদ্রঘরের মেয়েদের পিছনে লাগত। কীভাবে পিছনে লগত বলতে পার?’
নন্দ কিয়ৎকাল চুপ করিয়া রহিল, তারপর বলিল, ‘স্যার, সত্যকাম জাদুমন্ত্র জানত, দুটো কথা বলেই মেয়েগুলোকে বশ করে ফেলত। তারপর নিজের দোকানে নিয়ে যেত, ভাল ভাল জিনিস উপহার দিত, হোটেলে নিয়ে গিয়ে খাওয়াত—’ কুষ্ঠিতভাবে সে চুপ করিল।
‘বুঝেছি। মেয়েরাও নেহাত নির্দোষ নয়।’ গম্ভীর মুখে কিছুক্ষণ সিগারেট টানিয়া ব্যোমকেশ বলিল, ‘স্ত্রী-স্বাধীনতাও বিনামূল্যে পাওয়া যায় না। যাক, কোন কোন ভদ্রলোকের মেয়ের সঙ্গে সত্যকমের ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল, তুমি বলতে পোর?
নন্দ আরও কুষ্ঠিত হইয়া পড়িল, ‘সকলের কথা জানি না। স্যার, তবে ৭৩ নম্বরের অখিলবাবু আমাদের ব্যায়াম সমিতিতে নালিশ করেছিলেন, তাঁর মেয়ে শোভনা–। তারপর রামেশ্বরবাবুর নাতনী–সেও কিছু দিন সত্যকমের ফাঁদে পড়েছিল, ভীষণ কেলেঙ্কারি হবার যোগাড় হয়েছিল। যাহোক, তার বিয়ে হয়ে গেছে—’
‘আর কেউ?’
‘আর–ভবানীবাবুর মেয়ে সলিলা–’
‘কোন ভবানীবাবু?’
‘ও-পাড়ার থানার দারোগা ভবানীবাবু। তিনি মেয়েকে ঘরে বন্ধ করে রেখেছিলেন। তারপর এখন মামার বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন।’
ব্যোমকেশের সহিত আমার একবার চকিত দৃষ্টি-বিনিময় হইল। সে উঠিয়া দাঁড়াইয়া আড়মোড়া ভাঙিল, নন্দকে বলিল, ‘আচ্ছা নন্দ, তুমি আজ এস। অন্য সময় তোমার সঙ্গে আবার কথা হবে। ভাল কথা, তোমাদের ওস্তাদ পালিয়েছে। তুমি এখন কিছুদিন আর ওদিকে যেও না।’
নন্দ আবার ঠোঁট চাটিয়া বলিল, ‘আচ্ছা স্যার।’