নাতাশার তৈরি হতে
নাতাশার তৈরি হতে পনেরো মিনিট দেরি হল। অর্জুন দেখল অনেকদিন পরে অমল সোম সাফারি সুট পরেছেন। মেজর জিন্সের ওপর জ্যাকেট, মাথায় ফেল্ট হ্যাট। অমল সোম গাড়ির সামনে উঠে বসেছিলেন। ওরা নীচে দাঁড়িয়ে নাতাশার জন্য অপেক্ষা করছিল। মালপত্র তোলা হয়ে গেছে। অর্জুন বলল, আপনার আলট্রাসোনোগ্রামের রিপোর্ট কি খুব খারাপ?
ওটা যে করা হয়েছে তা তো আমার জানা নেই। নির্জীব গলায় বললেন মেজর।
তা হলে নিশ্চয়ই রক্ত পরীক্ষা করিয়েছেন। তাতে লিভারের ফাংশন ঠিকমতো হচ্ছে না বলে জানা গেছে। অবশ্য লিভারের দোষ কী বলুন? যেভাবে আপনি পান করতেন!’ অর্জুন কপট শ্বাস ফেলল শব্দ করে!
হ্যাঁ। লিভার টেস্ট করিয়েছিলাম। রিপোর্ট বলছে কোনও ত্রুটি নেই।
তা হলে তো খুব সমস্যায় পড়বেন।
কীরকম?
ডাক্তাররা বলেন বহু বছর ধরে শরীর যদি নিকোটিন এবং অ্যালকোহলের সঙ্গে বাস করতে অভ্যস্ত হয়ে যায় তা হলে তার অভাব হয়ে গেলে কয়েক মাসের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখায়। ভয়ংকর পরিণতি হয়ে যায়। মুখ গম্ভীর করল অর্জুন।
কীরকম?
হার্ট অ্যাটাক তো হতেই পারে, স্ট্রোক হয়ে একটা দিক অবশ হওয়াও স্বাভাবিক।
বলছ?
হ্যাঁ। তার সিমটম আছে, প্রকৃতি আগেই জানিয়ে দেয়।
সেটা কীরকমের?
সব ব্যাপারে উৎসাহের অভাব, আলস্য, গলার স্বর মিইয়ে যায়, হইচই করতে একটুও ভাল লাগে না। একটা কাগজ জলে ভিজে গেলে যা হয়। অর্জুন বলল।
মাই গড!!’ মেজর চোখ বড় করলেন, তুমি এসব জানলে কী করে?
আমার বন্ধুর মামার ঠিক এই কেস হয়েছিল। অর্জুন বলল।
তারপর?
আর কী হবে! তিনি এখন নেই। মাথা নাড়ল অর্জুন।
মেজরের নাক দিয়ে শব্দ বের হল। হতাশার শব্দ। তারপর বললেন, নিউইয়র্কে একজন পঞ্জাবি সাধুর কাছে কয়েকদিন গিয়েছিলাম। খুব জাগ্রত সাধু। মুখের দিকে তাকিয়ে ভূত-ভবিষ্যৎ বলে দিতে পারেন। যেহেতু আমার মুখে দাড়ি আছে তাই বলতে পারছিলেন না। কপালের দিকে তাকিয়ে বললেন সেখানে ঘন মেঘ জমে আছে। যদি আমি চুরুট আর অ্যালকোহল ছয় মাস ছেড়ে দিই তা হলে ওই মেঘ কেটে গিয়ে কপাল পরিষ্কার হয়ে যাবে। মাত্র চার মাস হয়েছে হে। এর মধ্যে তুমি যা যা বললে তার সবক’টা সিমটম হুক হয়ে গিয়েছে। কী যে করি। মেজর তাঁর দাড়িতে হাত বোলালেন।
গত রাতে পাহাড়ি পাড়ার মোড়ের একটা দোকান থেকে গোটাছয়েক কাটা চুরুট আর লাইটার কিনেছিল অর্জুন। পকেট থেকে সেগুলো বের করে বলল, রেখে দিন।
এ কী! এখনও তো ছ’মাস বাকি। মেজর হতভম্ব।
তার আগেই যদি ছবি হয়ে যান, সেটা কি ভাল হবে? অর্জুন বলল, আমি মানছি সিগারেট স্মোকিং ইজ ডেঞ্জারাস ফর হেঙ্ক। পৃথিবীর সব ডাক্তার এই এক কথা বলবেন। কিন্তু একটু-আধটু ধোঁয়া শরীরে গিয়ে যদি প্রাণশক্তি ফিরিয়ে আনতে পারে তা হলে সেটা দোষের বলে মনে করি না। অর্জুন বলল।
নাতাশাকে দেখা গেল। হাবু তার সুটকেস বয়ে নিয়ে আসছে। কাছে এসে দেরি হওয়ার জন্য বারবার ক্ষমা চাইতে লাগল নাতাশা। অর্জুন বলল, না না ঠিক আছে। কখনও নেগেটিভ ব্যাপার থেকে পজিটিভ কিছু বেরিয়ে আসে!
গাড়ি চালু হল।
জলপাইগুড়ির রাজবাড়ির সামনে দিয়ে এগিয়ে ন্যাশনাল হাইওয়ে ধরে তিস্তা ব্রিজ পেরিয়ে ঢুকে পড়ল ডুয়ার্সে। ইঞ্জিনের আওয়াজ ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই। অর্জুন লক্ষ করেছে দূরযাত্রায় গাড়িতে বসে অসমবয়সি মানুষেরা কথা কম বলে। তার মানে এই নয় যে, এই সময় তারা কোনও গভীর চিন্তা করছে। মস্তিষ্ক ফাঁকা করে শুধু দেখার মধ্যে বাইরে প্রকৃতি দেখে যায় বেশিরভাগ।
মাদারিহাট পৌঁছোতে সকাল এগারোটা। অমল সোম বললেন, একটু নামা যাক। সকাল থেকে তো পেটে কিছু পড়েনি।
গাড়ি থামতেই নাতাশা জানতে চাইল, এটা কি ভুটান?
অর্জুন বলল, না। তবে খুব বেশি দূরে নেই আমরা। আসুন, ব্রেকফাস্ট করবেন তো! একটু দেরি হয়ে গেল।
দোকানে গরম পুরি-তরকারি আর জিলিপি পাওয়া যাচ্ছিল। মেজর মিনমিন গলায় বললেন, ওসব আমার পেট সহ্য করতে পারবে না। আমার আর নাতাশার জন্য কলা আপেল পাওয়া গেলে ভাল হয়।
অমল সোম দোকানের বেঞ্চিতে বসে পড়তেই নাতাশাও তাঁর সঙ্গী হল। অর্জুন মেজরকে নিয়ে খানিকটা হাঁটতেই ফলের দোকানের সন্ধান পেল। মেজর এক ডজন মর্তমান কলা হাতে ঝুলিয়ে বললেন, এতেই আমাদের দু’জনের হয়ে যাবে। অর্জুন আপেল আর সবেদা কিনে দাম মিটিয়ে যখন ফিরছে তখন আচমকা পেছনে হাঁটা মেজরের চাপা আর্তনাদ শুনতে পেল, নিয়ে গেল, নিয়ে গেল! সে মুখ ফিরিয়ে দেখল একটা বড়সড় চেহারার হনুমান মেজরের কলাগুলো হস্তগত করে দাঁত বের করছে মহা আনন্দে। মেজর নিরীহ স্বরে বললেন, এ কী কাণ্ড। আমি তো তোর কোনও ক্ষতি করিনি! উঃ!’
অর্জুনের মনে হল আগের মেজর এই অবস্থায় পড়লে এমন হুংকার ছাড়তেন যে, হনুমানটা কলা ফেলে পালাবার পথ পেত না। সে বলল, মেজর, আপনি একটা চুরুট কিছুক্ষণের জন্য ধরিয়ে দেখুন তো কেমন লাগে!
বলছ? যেন একেবারেই ইচ্ছে ছিল না এমন ভঙ্গিতে একটা চুরুট বের করে পাশের দোকান থেকে দেশলাই কিনে আগুন জ্বাললেন তাতে। দুটো টান, কিঞ্চিৎ ধোঁয়া, চোখ বন্ধ করে থাকার পর অদ্ভুত আওয়াজ বের হল মেজরের গলা থেকে। তারপরই হুংকার হুড়মুড়িয়ে বের হতে লাগল। বেল্লিক, বেবুন, বেহায়া হনুমান, তুই ব্যাটা মাকড়শার নাতি, হাতের কাছে তোকে পেলে একটা রেইনবো কিক মেরে আফ্রিকায় পাঠিয়ে দিতাম। এই শব্দগুলোর সঙ্গে তার দুটো হাত আকাশে আন্দোলিত হচ্ছিল। দাড়িগোঁফের ভেতর থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছিল, যেন জঙ্গলে আগুন লেগেছে।
ওই হুংকারে হনুমানটা এমন ভড়কে গেল যে, এক ডজন কলার মায়া ত্যাগ করে কয়েক লাফে উধাও হয়ে গেল। অর্জুন সেগুলো তুলে নিয়ে এসে বলল, দেখলেন তো কীরকম কাজ হল! এবার ওটা নিভিয়ে ফেলুন!
একটু কাশি সামলে নিয়ে চুরুটটা নিভিয়ে মেজর যখন কথা বললেন, তখন তার মিনমিনে গলা উধাও, আগের মেজাজে বললেন, থ্যাঙ্ক ইউ মধ্যমপাণ্ডব। যস্মিন দেশে যথাচার করাই উচিত। আমেরিকায় ফিরে গিয়ে না হয় মিনমিন করা যাবে।
অমল সোম পুরি আর তরকারি খাচ্ছিলেন খোশ মেজাজে। নাতাশা ছবি তুলছিল খানিকটা দূরে। কয়েকটা কলা তার হাতে দিয়ে দোকানের সামনে এসে মেজর গলা খুললেন, হাফ ডজন পুরি আর সেইমতো তরকারি, কুইক। বুঝলে অর্জুন, ইন দ্য ইয়ার নাইনটিন এইট্টি সিক্স আমরা সেরেঙ্গাটির জঙ্গলে যেতে নাইরোবি শহরে নেমেছিলাম। আজ সেখানে একজন ইন্ডিয়ানকে খুঁজতে ম্যাগ্নিফ্লাইং গ্লাস লাগাও। হঠাৎ একটা গলির মুখে দেখি দোকানে পুরি ভাজছে। জাস্ট ইমাজিন। কী বলব তোমাকে, ওরকম সুস্বাদু পুরি আমি জীবনে খাইনি।
অমল সোম পুরি খেতে খেতে মন্তব্য করলেন, এই তো ভাল। স্বধর্মে থেকে মৃত্যু অনেক স্বস্তিকর।
কিছু বললেন? মেজর চোখ ছোট করলেন।
আপনাকে এখন স্বাভাবিক লাগছে। নিন, শুরু করুন।
দেখা গেল কলাগুলো গাড়িতে রেখে নাতাশাও ওদের সঙ্গী হল। ঝাল না থাকায় চেটেপুটে খেল সে। তারপর মেজরকে জিজ্ঞাসা করল, আপনার কী হয়েছে। অমল সোম বললেন, উনি এখন স্বাভাবিক হয়েছেন।
.
খাওয়া দাওয়ার পর অর্জুন প্রশ্নটা তুলল, আমরা কেন ভুটানে যাচ্ছি?
অমল সোম বললেন, তুমি আর আমি বেড়াতে যাচ্ছি। ওঁরা ওঁদের কাজ করবেন। ওঁরা কী কাজ করবেন সে ব্যাপারে আমদের উদাসীন থাকাই উচিত।
কেউ কিছু বলল না। মিনিটখানেক পরে মেজর মুখ খুললেন, মিস্টার সোম, বাংলা ভাষায় কীভাবে কথা বলতে হয় তা আপনার কাছে শেখা উচিত।
.
রাস্তা খুব খারাপ। গাড়ি নয়, মনে হচ্ছিল নৌকো চলছে ঢেউ ভেঙে। মেজর চিৎকার করলেন, হোয়াট ইজ দিস? এই রাস্তা দিয়ে ইন্ডিয়ার মন্ত্রী বা এমপিরা যাতায়াত করে না? যা খেয়েছি তা লাফিয়ে লাফিয়ে গলা পর্যন্ত উঠে এসেছে যে! নাতাশা বসেছিল সিঁটিয়ে, শক্ত হাতে হাতল চেপে ধরে। শেষ পর্যন্ত হাসিমারায় পৌঁছে রাস্তা ভাল হল। দু’পাশে চায়ের বাগান। জয়গা এল। ভারতের শেষ শহর। এরপরেই ভুটানে ঢোকার গেট। এরকম ঘিঞ্জি বাজার এলাকা বিহার-উত্তরপ্রদেশে চোখে পড়ে।
ড্রাইভার বলল, আমাকে এবার ছেড়ে দিন। ভুটানে গাড়ি চালাবার পারমিট নেই।
মেজর চেঁচিয়ে উঠলেন, সে কী! আমাদের এই বাজারে নামিয়ে দেবে?
স্যার, আমার কিছু করার নেই। আমার গাড়িকে ঢুকতে দেবে না। প্রাইভেট গাড়িকে ওরা অ্যালাউ করে। আপনারা ভেতরে গেলে অনেক গাড়ি পেয়ে যাবেন। লোকটি হাতজোড় করল।
মেজর ওর ভাড়া মিটিয়ে দিলে ওরা চারজন মালপত্র নিয়ে খানিকটা এগোতেই একটা বড় তোরণ দেখতে পেল। ভুটানের প্রবেশদ্বার। সেখানে সশস্ত্র প্রহরীরা দাঁড়িয়ে আছে। তাদের সামনে পৌঁছে মেজর জিজ্ঞাসা করলেন, পাসপোর্ট দেখাতে হবে?
তার হিন্দি শুনে হেসে মাথা নাড়ল ভুটানি প্রহরী, না’
অর্জুন খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারল ভুটানের রাজধানী থিম্পুতে যাওয়ার জন্য বাস পাওয়া যায় সকাল ছ’টা থেকে আটটা পর্যন্ত। এখন এই ভরদুপুরে কোনও বাস সেখানে যাবে না। তা ছাড়া সাম্প্রতিক নিয়মে এখানকার সরকারি অফিস থেকে ভুটানের ভেতরে যাওয়ার জন্য পারমিট নিতে হচ্ছে। শুধু এই শহরটা, যার নাম ফুন্টশলিং, ভারতীয় টুরিস্টদের জন্য ছাড় দেওয়া হয়েছে।
অমল সোম বললেন, নাতাশাকে দেখলে যে কেউ বুঝবে ও বিদেশিনি। তাই পারমিটটা করে ফেলাই উচিত। আজ যখন যাওয়া যাবে না তখন হোটেলেই বিশ্রাম নেওয়া যাক। কাল ভোরে বের হওয়া যাবে।
পারমিট পেতে অসুবিধে হল না। নাতাশার সুবিধে হবে বলে জিজ্ঞাসা করে ওরা ডুক হোটেলে তিনটে ঘর নিল। চারতারা হোটেল। এক-একটা ঘরের ভাড়া ভারতীয় টাকায় দশ হাজার। অর্জুনের মুখের দিকে তাকিয়ে মেজর বললেন, ভাবনার কিছু নেই। আমাদের দুশো ডলার ভারতের দশ হাজার টাকার সমান। আর এসব খরচ নাতাশা ওর সংস্থা থেকে ফেরত পাবে।
অমল সোম বললেন, যথেষ্ট বেলা হয়ে গিয়েছে, লাঞ্চ সেরে একেবারে ঘরে যাওয়াই ভাল।
ওরা রেস্তোরাঁয় বসতেই বার কাউন্টারটা দেখতে পেল। মেজর মাথা নেড়ে বললেন, গুড স্টক। ব্যস, ওই পর্যন্ত। মেজর সুরার প্রতি আগ্রহ দেখালেন না। নাতাশা এবং মেজর ভুটানি খাবারের অর্ডার দিয়েছিলেন। অমল সোম আর অর্জুন চিনে খাবার। নাতাশা খুশিমুখে খেয়ে নিলেও অর্জুনের মনে হল মেজর গিলতে বাধ্য হচ্ছেন। প্রায় জোর করে খাবারের দাম দিলেন অমল সোম। এই দেশে ভারতীয় টাকা ভুটানি টাকা, ডলার একসঙ্গে চলে।
নাতাশা এবং অমল সোমের জন্য আলাদা ঘর, তৃতীয়টিতে অর্জুন এবং মেজর। ঘরে ঢুকে ব্যাগ রেখে মেজর বললেন, এতক্ষণে আরাম হল। যতবার কোনও অ্যাডভেঞ্চারে গিয়েছি ততবার তুমি আর আমি একসঙ্গে থেকেছি। বলতে বলতে থমকে গেলেন তিনি। এ কী! দেওয়ালে নো স্মোকিং সাইন টাঙানো কেন?
আজকাল বোধহয় বড় হোটেলের ভেতরে সিগারেট খাওয়া নিষিদ্ধ।
আর। কে বলেছিল বড় হোটেলে ঘর নিতে? এই শহরে কি সাধারণ হোটেল নেই? এই আমেরিকান মেয়েটার জন্য কত কী সেক্রিফাইস করতে হবে। শব্দ করে শ্বাস ফেললেন মেজর।
অর্জুন বলল, আপনি তো এতদিন কপাল ফেরানোর জন্য সাধনা করছিলেন সিগারেট, মদ না খেয়ে। অসুবিধে হবে কেন?
মেজর বললেন, কীসে সুবিধে হবে তা আমি বুঝব! আমি একটু বাইরে যাচ্ছি। শহরটাকে ঘুরে দেখব। তুমি কি ঘরে থাকবে। মেজর জিজ্ঞাসা করলেন।
অর্জুন মাথা নাড়তেই মেজর বেরিয়ে গেলেন।
স্নান সেরে পরিপাটি হয়ে অর্জুন ইন্টারকমে অমল সোমকে ফোন করে জানল যে তিনি এখন ঘরেই থাকবেন। সন্ধ্যার সময় নামবেন। আর নাতাশা তাকে একটু আগে জানিয়েছে যে, তার খুব ঘুম পাচ্ছে, তাই দরজার বাইরে ডোন্ট ডিসটার্ব বোর্ড ঝুলিয়ে দিয়েছে।
বাইরে বেরিয়ে এল অর্জুন। লন পেরিয়ে গেটের সামনে পৌঁছে চারপাশে তাকাল। খুব দ্রুত আধুনিক হয়ে উঠেছে ফুন্টশলিং শহর। মানুষের ভিড় যেমন বেড়েছে তেমনি ঝকমকে দোকানেও সেজেছে। এখন রোদ নেই। খানিকটা হেঁটে ওপরের রাস্তার দিকে তাকাল। খানিকটা গেলেই সেই বিখ্যাত বৌদ্ধ মন্দির এবং তখনই চোখে পড়ল লোকটা আসছে! পরনে ভুটানি জুব্বা। একটু টেনে হাঁটছে। রাস্তা থেকে সোম বালির ওপর দিয়ে সাজানো দোকানগুলোর দিকে যাচ্ছে। হ্যাঁ, ঠিক ওই লোকটা। একটা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কনফেকশনারির ভেতরে ঢুকে গেল লোকটা। অর্জুন দ্রুত এগিয়ে গেল বালির দিকে। লোকটা যেখানে যেখানে পা রেখেছিল সেখানকার বালিতে ছাপ পড়লেও বাঁ গোড়ালি অস্পষ্ট। অর্থাৎ ওর জুতোর বাঁ গোড়ালি খয়ে গিয়েছে। তা হলে তিস্তার চরের সেই লোকটা এখন ফুন্টশলিং-এ? লোকটার বাড়ি কি এখানে? অর্জুন দেখল কনফেকশনারি থেকে বেরুতেই লোকটা হাত নেড়ে ইশারা করলে একটা সাদা গাড়ি এসে দাঁড়াল সামনে, লোকটা পেছনের আসনে উঠে বসতেই গাড়ি বেরিয়ে গেল।
অর্জুন একটু দাঁড়াল। তারপর কনফেকশনারির দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল। দোকানে দুই খদ্দের, তিনজন সেলসে। একটি সুন্দরী ভুটানি মেয়ে কাউন্টারের ওপাশে দাঁড়িয়ে হেসে জিজ্ঞাসা করল, ইয়েস! কী দেব বলুন?
এই মুহূর্তে আমার কিছু লাগবে না। আপনার কাছে একটা অনুরোধ আছে। অর্জুন বলল।
বলুন। মেয়েটির হাসি মুছে গেল।
এই এক্ষুনি যে ভুটানি ভদ্রলোক আপনাদের দোকান থেকে বেরিয়ে গেলেন তিনি কি প্রায়ই এখানে আসেন? অর্জুন জিজ্ঞাসা করল।
না। উনি স্থানীয় মানুষ নন। কখনও দেখিনি। মেয়েটি কথা শেষ করতেই একজন কর্মচারী এসে জিজ্ঞাসা করল, তুমি কি একটা শূন্য বেশি লিখেছ?
মাথা নাড়ল মেয়েটি, না। একশোটা মিল্ক ব্রেড। ভুল লিখিনি। রাত্রে দোকান বন্ধ হওয়ার আগে এসে নিয়ে যাবে। পেমেন্ট করে গেছে। এমন করে প্যাক করে দেবে যাতে ক্যারি করতে সুবিধে হয়।
লোকটি ফিরে গেলে অর্জুন হাসল, অত রুটি, বাড়িতে উৎসব আছে বোধহয়।
জানি না। খদ্দেরদের বাড়ির খবর রাখা আমাদের কাজ নয়। রুটিগুলো যাতে কয়েক দিনের মধ্যে নষ্ট না হয় তার ব্যবস্থা করতে বলেছেন, করে দেব। কথা বলতে বিরক্ত হচ্ছিলেন সুন্দরী, অর্জুন বুঝতে পেরে বেরিয়ে এল।
সেই ভুটানি লোকটা যাকে তিস্তার চরে রিকশাওয়ালার সঙ্গে কথা বলতে দেখেছিল- সে অতগুলো রুটি নিয়ে কোথায় যাচ্ছে তা অনুমান করা সম্ভব নয়। কিন্তু রুটিগুলো কদিন ধরে খাওয়া হবে বলে নষ্ট হোক চাইছে। না। যেখানে যাচ্ছে সেখানে কি রুটি পাওয়া যায় না? অর্জুন রহস্যের গন্ধ পাচ্ছিল।
ছায়া ঘন হয়ে অন্ধকারকে টেনে আনছে। ফুন্টশলিং-এর বাজার এলাকায় হাঁটতে হাঁটতে অর্জুন শুনতে পেল মেজরের উদাত্ত গলা, তার নাম ধরে ডাকছেন। সে দেখল একটা বাড়ির সিঁড়ির তৃতীয় ধাপে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। কাছে যেতেই বললেন, পেয়ে গেছি। নাতাশা আমেরিকা থেকে জেনে এসেছে ফুন্টশলিং থেকে থিম্পু বাইরোড যাওয়া যায়। এ রাস্তায় কী কী দ্রষ্টব্য তা গুগলে গিয়ে জেনেছে। কিন্তু একটা বুড়ো ভুটানি ড্রাইভার আমাকে ম্যাপটা ডিটেলসে বলেছে আর আমি সেটা লিখে নিয়েছি। পকেট থেকে ভাঁজ করা কাগজ বের করলেন মেজর।
কোথায় পেলেন তাকে?
আর কোথায়? বাইরে থেকে দেখে পছন্দ হল। ভেতরে ঢুকে খুব ম্যাকি বলে মনে হলেও বসে পড়লাম। পাশের চেয়ারের লোকটার সঙ্গে আলাপ হল। ওঃ, ফাটাফাটি লোক। পাহাড়ি পথ থেকে ওর গাড়ি ছিটকে পড়েছিল দুই হাজার ফুট খাদের নীচে। সেই পড়ার সময় গাড়ি থেকে বেরিয়ে ও একটা ডাল ধরে ঝুলছিল দুই ঘণ্টা। ভাবতে পারো? মেজর কাগজটা দিলেন।
মেজরের মেজাজ এখন আগের মতো। বহুদিন পরে পেটে কয়েক পাত্র পড়েছে। কাগজটা খুলল অর্জুন। ফুন্টশলিং থেকে পঁচিশ কিলোমিটার দূরের জনপদের নাম গেদু। তারপর পঁয়তাল্লিশ কিলোমিটার পার হলে চুখা। ওখানে চুখা নদীর ওপারে হাইড্রোইলেকট্রিকাল প্রজেক্ট তৈরি হয়েছে।
মেজর বললেন, চুখার পরে সীমা লেক। দারুণ সুন্দর প্রকৃতি। বরফে মোড়া পাহাড়গুলো স্পষ্ট দেখা যায়। তার পরের জায়গাটার নাম চাপচা। ওখানে ইন্ডিয়ান আর্মির বড় ক্যাম্প আছে। আর চারধারে নীলচে পাইনগাছের জঙ্গল। এরপর বিদেশা হয়ে থিম্পু, ভুটানের রাজধানী। এখান থেকে যত এগুব তত রাস্তা উঁচুতে উঠবে। ফ্যান্টাস্টিক।
কথাগুলো বলেই চোখ বড় করলেন মেজর, সীমারেখা লেখা আছে, না?
কাগজ দেখে অর্জুন বলল, হ্যাঁ।
মাই গড। নাতাশা আমাকে একটা জায়গার নাম বলেছিল যার সঙ্গে এই সীমারেখার বেশ মিল আছে। ও বলেছিল, থিমারেখা। এই থিমারেখার কথা তো বলল না ড্রাইভারটা। দাড়ি চুলকালেন মেজর।
অর্জুন হাসল, আপনি যা সীমারেখা উচ্চারণ করছেন তাকেই নাতাশা থিমারেখা উচ্চারণ করেছে। কলমটা দিন।
মেজরের কাছ থেকে কলম নিয়ে এস এইচ আই এম এ-এর আগে একটা ইংরেজি টি বসিয়ে দিয়ে ফারাকটা দেখাল অর্জুন, এবার পড়ুন।
আরে! সত্যি তো নাতাশা এসটাকে সাইলেন্ট করে বলেছে!
হ্যাঁ। আসলে টি অক্ষরটাও সাইলেন্ট হবে। ভুটানি শব্দের আগে ইংরেজিতে টি শব্দের চল আছে, যা উচ্চারণে উহ্য থাকে। অর্জুন বলল।
আচ্ছা। হুম। মেজর কলমটা ফেরত দিলেন।
চলুন, সন্ধে হয়ে আসছে।
সন্ধের পরে জায়গাটা কি নিরাপদ নয়?
তা জানি না। অচেনা শহর, কী দরকার ঝুঁকি নেওয়ার।
অর্জুনের কথায় মাথা নেড়ে পা বাড়ালেও তখনই যাওয়া হল না মেজরের। একটা দোকানে ঢুকে দারুণ দেখতে ফেল্ট হ্যাট কিনলেন দরাদরি করে। সেটা মাথায় চাপাতেই তার চেহারা পালটে গেল। অর্জুন বলল, আপনাকে এখন টেক্সাস ফিমের হিরো বলে মনে হচ্ছে। একটা ঘোড়া থাকলে খুব মানাত।
মেজর কথা না বলে কয়েক পা এগিয়েই দাঁড়িয়ে গেলেন। পাশেই একটা বিলিতি মদের দোকান। সেখানে ঢুকে পড়লেন তিনি। অর্জুন বাইরে দাঁড়িয়ে বুঝল মেজর আবার তার আগের ফর্মে ফিরে আসছেন।
খালি হাতে মেজর বেরিয়ে এলেন যদিও তার প্যান্টের পকেট দুটো উঁচু হয়ে রয়েছে। হাঁটতে হাঁটতে বললেন, ইন দ্য ইয়ার নাইনটিন হান্ড্রেড অ্যান্ড এইট্টি ওয়ান, আই ওয়াজ ইন টেক্সাস। এখন লোকজন কোথায়? ছোট ছোট গ্রাম, সেখানে রেড ইন্ডিয়ানদের বাস। জলের খুব ক্রাইসিস। আমি গিয়েছিলাম একটা স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের হয়ে সেই রেড ইন্ডিয়ানদের স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন করতে। প্রথমে ওরা এড়িয়ে যাচ্ছিল কিন্তু আমি একটা বাচ্চাকে ওষুধ দিয়ে সারিয়ে দেওয়াতে ওরা কাছে এল। তখন ঘোড়ায় চড়েছিলাম। কী বলব তোমাকে, ওই ঘোড়া ঘণ্টায় দেড়শো মাইল স্পিডে ছুটেছিল, কিন্তু আমি পড়ে যাইনি। হেসো না, এটা ঘটনা, অবশ্য তোমার দাদাকে বলার দরকার নেই।
সামনেই একটা কেনটাকি চিকেনের দোকান। দোকানের দরজা আধাভেজানো। মেজর বললেন, আইডিয়া। অর্জুন, এদের বলি আমাদের জন্য একডজন প্যাক করে দিতে। ওই পাহাড়ে ঠিকঠাক খাবার পাওয়া যাবে কিনা তা তো জানি না!
কাল সকালে নেবেন। আমাদের বাস তো সাতটায় ছাড়বে!
বাস? হু ইজ গোয়িং বাই বাস? আমি তো লাস্ট পার্সন, ভোর ভোর বেরিয়ে যাব গাড়ি ভাড়া করে। বলে মেজর ঢুকে গেলেন দোকানের ভেতর।
একটু পর তার চিৎকার কানে আসায় অর্জুন এগিয়ে গেল, কী হয়েছে?
এরা বলছে স্টক যা ছিল, বিক্রি হয়ে গেছে অথচ আমি স্বচক্ষে দেখতে পাচ্ছি। আমাকে কেন বিক্রি করা হবে না জানতে পারি কি? মেজর কথাগুলো বললেন ইংরেজিতে।
দোকানের মালিক হাসলেন, ইংরেজিতেই বললেন, আপনি অযথা উত্তেজিত হচ্ছেন স্যার; সারাদিন বিক্রি হওয়ার পর যা স্টক ছিল তা একজন বুক করে গেছেন। রাতে দোকান বন্ধ হওয়ার আগে নিয়ে যাবেন।
সব স্টক?
হ্যাঁ। পেমেন্টও দিয়ে গেছেন। আমাকে রিকোয়েস্ট করেছেন যেন ভাল করে প্যাক করে রাখি। এগুলো যাবে চুখা ছাড়িয়ে সীমারেখাতে। মালিক বললেন, আপনাকে আমি কাল সকাল ন’টার সময় যা চাইবেন তা দিতে পারি। আজ আমি খুবই দুঃখিত স্যার।
অর্জুন ডাকল, মেজর চলে আসুন।
মেজর বাইরে বেরিয়ে বিড়বিড় করলেন, সীমারেখা! ধৎ, আমি উচ্চারণ করব থিমারেখা। বেশ পাহাড়ি জায়গা বলে শোনাবে।
অর্জুনের কপালে ভাঁজ পড়ল। বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না, যে লোকটা মিল্ক ব্রেডের অর্ডার দিয়েছে সে-ই এখানে এসেছিল। এত খাবার নিয়ে কেন যাচ্ছে লোকটা সীমারেখাতে? তিস্তার চরে দেখা লোকটার এই কার্যকলাপ সন্দেহজনক।
.
ডিনারের পর হোটেলের লবিতে বসা হল। অমল সোম বললেন, তোমরা যখন বেরিয়েছিলে তখন আমি আর নাতাশা কথা বলছিলাম। ফুন্টশলিং ছাড়ালেই পাহাড়ে ওঠা শুরু হবে। প্রথমে গেদু, তারপরে চুখা। ওখানকার জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রে অনেক ভারতীয় চাকরি করেন। আমার পরিচিত কয়েকজন আছেন। আমরা চুখা পেরিয়ে যাব।
ফুন্টশলিং থেকে রাজধানী থিম্পু পৌঁছোতে সময় লাগে সাত ঘণ্টা। ঠিক মাঝামাঝি জায়গা হল থিমারেখা বা সীমারেখা। ওই উচ্চতা এবং আবহাওয়ায় যে মানুষরা থাকেন তাদের নিয়ে সমীক্ষা চালাতে চাইছে নাতাশা। কিন্তু একটু ভাবলেই বুঝতে পারবে, নাতাশার কাজটা মোটেই সহজ হবে না। প্রথমত, পাহাড়ের মানুষের নানান কুসংস্কার আছে। কোনও মেমসাহেবকে তারা রক্ত পরীক্ষা করতে দিতে সহজে রাজি হবে না। দেখা যাক!
অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, আমরা ওখানে থাকব কোথায়?
নাতাশার ল্যাপটপ বলছে জায়গাটা ট্যুরিস্টদের আকর্ষণ করে। প্রচুর ঝরনা, সিনিক বিউটি, স্নো রেঞ্জ থাকায় মানুষের ভিড় লেগেই আছে। তাই থাকার জায়গা পেতে মনে হয় অসুবিধে হবে না। নাতাশা আমাকে একটা গ্রামের নাম বলেছে। থিমারেখা বা সীমারেখা থেকে বারো কিলোমিটার দূরে পাহাড়ের ভেতরে ওই গ্রাম। ল্যাপটপ বলছে, ওই গ্রামের মানুষেরা স্বজাতির বাইরে বিয়ে দেয় না। যতটা সম্ভব শহরের ওষুধ খায় না। নাতাশার কৌতূহলটা এদের নিয়ে। কারণ ওই মানুষদের রক্তে কোনও অ্যালোপ্যাথিক ওষুধের অস্তিত্ব নেই।
মেজর জিজ্ঞাসা করলেন, গ্রামের নাম কী?
থিমাসিলিং অথবা সীমাশিলিং। অমল সোম বললেন, মনে রাখতে হবে, আমরা সবাই যাচ্ছি ট্যুরিস্ট হিসেবে। বেড়াতে। কারও সঙ্গে জোরজবরদস্তি করে কোনও কাজ করব না।
আমরা কখন রওনা হব? হোটেলে বললে নিশ্চয়ই গাড়ি পাওয়া যাবে। মেজর পকেট থেকে চ্যাপটা বোতল বের করে গলায় ঢাললেন।
অমল সোম মাথা নাড়লেন, না। গাড়িতে নয়, আমরা বাসে যাব। হোটেল থেকে চারটি সিট রিজার্ভ করে নেওয়া হয়েছে।
মেজর বললেন, বাস? চোখ কপালে তুললেন মেজর।
চলুন না। খারাপ লাগবে না। তা ছাড়া আপনি তো এখন সেই পঞ্জাবি গণতকারের উপদেশ মানছেন না। আবার স্বধর্মে ফিরে এসেছেন, বাসে গেলে দেখবেন অনেক খোরাক পাবেন। অমল সোম বললেন।
সবাই যে যার ঘরে শুতে চলে গেলে অর্জুনের মনে হল অমল সোমের কানে কথাটা ভোলা দরকার। সন্দেহজনক একটি ভুটানি প্রচুর খাবার নিয়ে যাচ্ছে সীমারেখাতে। ওই লোকটির সঙ্গে তিস্তার চরে পাওয়া দুটো রক্তশূন্য শবের কোনও সম্পর্ক আছে কি না তা বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু এই লোকটি তার কাছে শুধু সন্দেহজনক, এর বেশি কিছু নয়। সঠিক প্রমাণ না পেলে পরে বোকা বনে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। অর্জুন সিদ্ধান্ত নিল, আর একটু অপেক্ষা করে দেখে তারপর অমল সোমের সঙ্গে কথা বলবে।
.
বাসের চেহারা দেখে ভক্তি এল। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। ভলভো বাস। সিটে বসে মেজর পর্যন্ত বললেন, ওয়ান্ডারফুল। এ দেখছি গ্রে-হাউন্ডের চেয়ে ভাল। নাতাশাও খুশি, খুব কমফর্টেবল। প্রায় ভরতি বাস ছাড়ল সকাল সাতটায়। চওড়া রাস্তা উপরের দিকে উঠে গেছে। নাতাশার পাশে বসেছিল অর্জুন। মোড় ঘুরতেই সে বলল, ওইদিকে একট ফরেস্ট্রি আছে। খুব সুন্দর।
নাতাশা বলল, তুমি যদি কাল বিকেলে বলতে দেখে আসতাম।
তুমি ইন্টারেস্টেড হবে কিনা তা বুঝিনি।
নতুন জায়গার সবকিছু দেখতে আমি ইন্টারেস্টেড।
জানা থাকল। অর্জুন বলল।
গেদু-তে বাস থামলে প্রত্যেক যাত্রীর হাতে টিফিন প্যাকেট ধরিয়ে দেওয়া হল।
খাবারের মান দেখে মেজর খুব খুশি, বললেন, ভুটান খুব ইমপ্রুভ করেছে হে।
চুখা নদী পার হয়ে যে জনবসতি দেখা গেল সেখানে অনেক ভারতীয়ের মুখ। অর্জুন লক্ষ করল তাদের মধ্যে বাঙালির সংখ্যা কম নয়। চুখা পার হওয়ার পর থেকেই প্রকৃতি বদলে যেতে লাগল। শীতশীত বোধ হওয়াতে জ্যাকেট বের করতে হল সবাইকে। দুই পাশের গাছগুলোর চেহারা অনেকটা কালিম্পং-এর ওপর দিকের। বাসের জানলা দিয়ে ছবি তুলে যাচ্ছিল নতাশা। বলল, আমেরিকায় তেমন বড় পাহাড় নেই। আমি দু’বার আল্পসে গিয়েছি। এরকম সবুজ এবং সুন্দর পাহাড় চোখে পড়েনি।
অর্জুন হাসল, গাছগুলোর জন্যই পাহাড়কে সবুজ মনে হচ্ছে।
তারপরে ঝরনাগুলো চোখে পড়ল। পাহাড় থেকে নাচতে নাচতে নেমে আসছে একের পর এক। বাসে বসে তাদের পাথরে ধাক্কা লেগে তৈরি হওয়া ফেনাও দেখা যাচ্ছে। নাতাশা বলল, আহা, এখানে যদি কিছুক্ষণ থাকা যেত।
তা হলে টেন্ট নিয়ে আসতে হত। অর্জুন বলল।
আমি একবার ভেবেছিলাম, খুব ভুল হয়ে গেল।
বাস বাঁক ঘুরতেই স্নো রেঞ্জ চোখে পড়ল। ক্যাটকেটে সাদা বরফে মোড়া পাহাড়ের চূড়াগুলো যেন কয়েক মাইল হাঁটলেই ধরা যাবে। অর্জুন মানতে বাধ্য হল, দার্জিলিং থেকে যে বরফের পাহাড় দেখা যায়, তার চেয়ে এগুলো মোটেই কম সুন্দর নয়। সীমারেখায় বাস থামল, ওরা নেমে পড়ল। অমল। সোম আর অর্জুনের দুটো ছোট ব্যাগ, মেজরের সুটকেসও বেশি বড় নয়, কিন্তু নাতাশার মালপত্রের সংখ্যা পাঁচ এবং বেশ ভারী। এতগুলো সে আমেরিকা থেকে প্লেনে করে নিয়ে এসেছে। আনতে অতিরিক্ত দক্ষিণা দিতে হয়েছে। কী আছে ওতে?
রাস্তার দুপাশে বেশ কিছু দোকান, রেস্টুরেন্ট। অমল সোম ঘড়ি দেখলেন, চলো, ওই রেস্টুরেন্টে বসে চা আর মোমো খাওয়া যাক।
জিনিসপত্রগুলো হাতে হাতে নিয়ে রেস্টুরেন্টে ঢুকে বসতেই একজন বয়স্ক ভুটানি মহিলা এসে অর্ডার নিলেন। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, সাহেবরা কি থাকার জায়গা ঠিক করে এসেছেন?
মেজর চুরুট ধরাচ্ছিলেন, বললেন, না। আমাদের আগে থেকে প্ল্যান করা থাকে না। খুব ভাল থাকার জায়গা এখানে আছে? টয়লেটে কমোড চাই।
বয়স্কা মহিলা হাসলেন, হোটেল আছে। অনেক টাকা নেবে। আপনারা বরং আমার গেস্ট হাউসে থাকতে পারেন। কমোড আছে। দুটো ঘর হলেই তো হবে।
এ খবরটা কে আপনাকে দিল? আমাদের তিনটে ঘর চাই।
ছয় হাজার টাকা দেবেন। পার ডে। ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ ডিনারের জন্য পার হেড পার ডে পাঁচশো, চা ফ্রি। খুব সস্তা।
মেজর কথাগুলো ইংরেজিতে নাতাশাকে বুঝিয়ে দিলে সে মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। অমল সোম বললেন, ঘর ভাল হলে তুমি এর চেয়ে সস্তায় এরকম জায়গায় আশা করতে পারো না। অর্জুন, তুমি ওর গেস্ট হাউসটা নিজে গিয়ে দেখে এসো আগে। ভাল হলে আমরা যাব।
নাতাশা রাস্তার দিকে তাকিয়ে ছিল, মুখ ঘুরিয়ে বলল, তোমাদের কথা আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। প্লিজ–!
অমল সোম ইংরেজিতে বললেন, খুব লজ্জিত। সবাই মনে রেখো, নাতাশা যখন সঙ্গে থাকবে তখন আমরা শুধু ইংরেজিতেই কথা বলব।
নাতাশা বলল, থ্যাঙ্কস।
অর্জুন এগিয়ে গিয়ে বয়স্কা মালকিনকে বলল, আগে গেস্ট হাউসটাকে দেখতে চাই। মহিলা একজনকে বলল দেখিয়ে দিতে। তাকে অনুসরণ করে পথে নামতে নাতাশা চেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করল, কোথায় যাচ্ছ।
অর্জুন গলা তুলে বলল, যে গেস্ট হাউসে আমরা থাকব সেটা কীরকম দেখতে যাচ্ছি। হাত তুলে তাকে অপেক্ষা করতে বলে নাতাশা মেজরকে। জিজ্ঞাসা করল, আমি ওর সঙ্গে একটু ঘুরে আসতে পারি?
শিয়োর!’ মেজর বললেন, যাও, জায়গাটাকে ভাল করে দেখে এসো।
খানিকটা হাঁটতেই একট মোড় দেখতে পেল ওরা। সোজা পথটা যদি থিম্পুর দিকে গিয়ে থাকে তা হলে ডানদিকেরটা কোথায় যাচ্ছে? দোকানের লোকটাকে জিজ্ঞাসা করেও জবাব পেল না অর্জুন। মিনিট দশেক হাঁটলে গেস্ট হাউস। এমন কিছু আহামরি নয়, আবার অপরিষ্কারও নয়। নাতাশা বলল, নট ব্যাড।
ফেরার পথে নাতাশাকে অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, তুমি কি প্রায়ই একা বেরিয়ে পড়ো?
হ্যাঁ। তবে বেশিরভাগ সময় কাজের জন্যই যেতে হয়।
ভয় লাগে না?
কীসের ভয়? বলে তাকাল নাতাশা, ও, আমি একটি মেয়ে বলে বলছ? আমি ক্যারাটে জানি। ওটা জানা থাকলে যে-কোনও ছেলের মতো আমিও নিরাপদ। হ্যাঁ, ভুটানে আসার আগে অনেকে বলেছিল, এটা অন্ধকারের দেশ। এখন পর্যন্ত সেটা মনে হচ্ছে না। তা ছাড়া আমি যাদের সঙ্গ পাচ্ছি, তারা খুব ভাল।
সবাই? অর্জুন চোখের দিকে তাকল।
অফকোর্স, ইনক্লডিং ইউ।
থ্যাঙ্কস।
ওরা যখন তেমাথার মোড়ে নেমে এল তখনই লম্বা গাড়িটাকে দেখতে পেল। ফুন্টশলিং-চুখার দিক থেকে উঠে আসছে কিন্তু থিম্পুর দিকে না গিয়ে গাড়িটা ডানদিকে বাঁক নিল। এক ঝলকে গাড়ির ড্রাইভারের পাশে বসা লোকটাকে দেখতে পেয়ে দাঁড়িয়ে গেল অর্জুন। তিস্তার চরের সেই লোকটা। গম্ভীর মুখে বসে আছে। গাড়ি চোখের আড়ালে চলে গেল।
অর্জুনের মুখের দিকে তাকিয়ে নাতাশা জিজ্ঞাসা করল, কী ব্যাপার? অর্জুন সহজ হওয়ার চেষ্টা করল।
.
মোমো খাওয়ার পর চা খেতে খেতে নাতাশা আর মেজর যখন গল্প করছিলেন তখন অমল সোমকে নিয়ে রেস্টুরেন্টের বাইরে এসে সংক্ষেপে লোকটার সম্পর্কে যা সে দেখল তা জানাল।
অমল সোম হাসলেন, ওকে নিয়ে এত ভাবছ কেন?
অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, লোকটাকে কি রহস্যজনক বলে মনে হচ্ছে না?
হয়তো। কিন্তু ও কোন রহস্যের সঙ্গে জড়িত, তা তুমি জানো না। তিস্তার চরে যে দুটো রক্তশূন্য মৃতদেহ পড়ে ছিল তাদের মৃত্যুর জন্য এ লোকটি দায়ী তাতে প্রমাণ করা যাচ্ছে না। ঘটনাচক্রে তুমি ওকে ফুন্টশলিং আর এখানে দেখতে পেয়েছ। এটা থেকে কোনও সিদ্ধান্তে আসা ঠিক নয়। অমল সোম বললেন।
কিন্তু এই লোকটাই একশো পাউন্ড পাঁউরুটি আর চিকেন কিনে নিয়ে এসেছে।
অর্জুন অমল সোমের কথাগুলো মানতে পারছিল না।
তাতে কী হয়েছে? সবাই মিলে খাবে বলে এনেছে।
.
গেস্ট হাউসের বারান্দায় বসলে স্নো রেঞ্জ দেখা যায়। লাঞ্চের পরে নাতাশা সেখানে বসে অমল সোমকে বলল, চলুন, এখানকার হাসপাতাল থেকে ঘুরে আসি।
ইচ্ছেটা কী?
এখানকার ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলি। ওরা পেশেন্টদের রক্ত পরীক্ষা এখানেই করেন না থিম্পুতে পাঠান, তা জানলে ভাল হয়। নাতাশা বলল।
ওঁরা কারণ জিজ্ঞাসা করবেন।
হ্যাঁ। খোলাখুলি বলব। জমে যাওয়া রক্ত আবার তরল করে ফেলার গবেষণা চলছে। এই গবেষণা সফল হলে মানুষের দারুণ উপকার হবে।
ধরো, ওঁরা এখানেই রক্ত পরীক্ষা করেন, তোমাকে কীভাবে সাহায্য করবেন?
খুব সহজ কাজ। যখনই কোনও পেশেন্টের শরীর থেকে রক্ত পরীক্ষার জন্য নেবেন তখন যে পরিমাণ নিতে ওঁরা অভ্যস্ত তার দ্বিগুণ নেবেন। তাতে কোনও পেশেন্টের ক্ষতি হবে না। সেই বাড়তি রক্ত যদি আমাকে দিয়ে দেন তা হলে সেটা প্রিজার্ভ করে রাখব গবেষণার জন্য।
নাতাশা বলল, আমি তার ব্যবস্থা সঙ্গে করে এনেছি।
আমরা কথা বলতেই পারি কিন্তু সেটা হাসপাতালের বড়কর্তার সঙ্গে বলা উচিত।
অমল সোম কথা শেষ করে দেখলেন রেস্টুরেন্টের মালকিন উঠে আসছেন।
বারান্দার নীচে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কোনও অসুবিধে হচ্ছে না তো?
অমল সোম মাথা নাড়লেন, একটুও না। আচ্ছা, আপনাদের এখানে হাসপাতালটা ঠিক কোথায়?
এখানে তো হাসপাতাল নেই। ওটা আছে চুখায় আর থিম্পু এবং পারোতে। এখানে ছোট্ট হেলথ সেন্টার আছে। মালকিন বলল।
তার মানে এখানে রক্ত পরীক্ষা অথবা অপারেশন হয় না।
না। তার জন্য চুখা বা থিম্পুতে যেতে হয়।
অনেক ধন্যবাদ।
আপনাদের কেউ কি অসুস্থ?
না না। এমনি, কৌতূহল হচ্ছিল। আর একটা কথা, কাছাকাছি একটা জায়গা আছে, শুনেছি খুব সুন্দর জায়গা। নাম থিমাশিলিং অথবা সীমাশিলিং। সেখানে কীভাবে যাওয়া যায়? থাকার জায়গা পাওয়া যাবে সেখানে? অমল সোম জিজ্ঞাসা করলেন।
মালকিন মাথা নাড়লেন, মানে জায়গাটা খুব সুন্দর, কিন্তু কিছুদিন আগেও ওখানে কেউ যেত না। তাই এখনও হোটেল টোটেল হয়নি। বেশি মানুষ দেখতে পাবেন না। গ্রাম আছে ওখান থেকে বেশ দূরে দূরে জঙ্গলের মধ্যে, পাহাড়ের গায়ে। তারা এখানে দুরের কথা, থিমাশিলিং-এও খুব কম আসে। ভুট্টা বা অন্য চাষবাস করে বেঁচে থাকে। মালকিন শ্বাস নিলেন, আপনাদের কি ওখানে যাওয়ার ইচ্ছে আছে।
আপনি যা বললেন, তাতে মনে হচ্ছে ইচ্ছে থাকলেও উপায় নেই। গিয়ে থাকব কোথায়? আর গাড়িতে করে গিয়ে কিছুক্ষণের জন্য জায়গাটা দেখে ফিরে আসার কোনও মানে হয় না।
অমল সোম কথা শেষ করলেন।
মালকিন একটু ভাবলেন, তারপর বললেন, একটা ব্যবস্থা করে দেওয়া যেতে পারে।
অমল সোম তাকালে মালকিন বললেন, আমি আপনাদের জন্য ভাল তাঁবুর ব্যবস্থা করে দিতে পারি। থিম্পুতে আজকাল যে নতুন ধরনের তাবু পাওয়া যায় তার ভেতরে ঝোলা বিছানা থাকে। অবশ্য তাবু সঙ্গে নিয়ে গেলে আপনাদের পোর্টারের দরকার হবে। তার ব্যবস্থাও হয়ে যাবে। ওরাই রান্না করে দেবে।
অমল সোম নাতাশাকে বুঝিয়ে বললে সে উত্তেজিত হল, ফ্যান্টাস্টিক। তবু আর লোক সঙ্গে থাকলে আমরা পাহাড়ের ওপাশের গ্রামগুলোতেও যেতে পারি।
অমল সোম মালকিনকে জিজ্ঞাসা করলেন, তাবুর ভাড়া, পোর্টারদের পারিশ্রমিক কীরকম দিতে হবে, যদি একটা আন্দাজ দিতে পারেন।
মালকিন হাসলেন, আপনারা আমাদের এই তিনটে ঘরের ভাড়া বাবদ যা দিচ্ছেন তার থেকে হয়তো কিছু বেশি খরচ হবে। একটা কথা খুলে বলছি। আমাকেও এসব জোগাড় করতে ছোটাছুটি করতে হবে, তাই আপনাদের কাছ থেকে আমিও কিছু আশা করব। আজ সন্ধ্যার আগেই খবর পেয়ে যাবেন।
সারাটা বিকেল নাতাশা তার ঘরে কাজ করে গেল ল্যাপটপ নিয়ে। অর্জুন মেজরের সঙ্গে বেরিয়েছিল। জায়গাটাকে বেশ ভাল লেগে গেছে অর্জুনের। অনেকটা ভারতের কালিম্পংয়ের মতন। ট্যুরিস্টরা দার্জিলিং কালিম্পং-এ ছুটে যায়। এখানে তেমনভাবে আসে না। এলে বুঝতে পারত কী থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
হাঁটতে হাঁটতে বড় রাস্তায় নেমে মেজরের চোখ বড় হল, জায়গাটা তো চমৎকার। দেখো, মেঘ না চাইতেই জল। ফুন্টশলিং থেকে একটাই কিনেছিলাম, এখান থেকে স্টকটা ভালভাবে নিতে হবে। মিস্টার সোম যখন আমাদের নিয়ে তাবুতে বাস করবেন বলে ঠিক করেছেন, তখন ওটা কাজে লাগবে। পাহাড়ের জঙ্গলে তো দোকান পাব না?
দাঁড়ান। অর্জুন বাধা দিল, কাল যাওয়ার সময়ও ওসব নিতে পারবেন।
বলছ? ছেলেবেলায় পড়েছিলাম, বিলম্বের দেরি করতে নেই। অর্জুন হেসে ফেলল। এতক্ষণে মেজর নিজের ফর্মে ফিরে এসেছেন। অর্জুন দেখল, যে লোকটি তাদের গেস্ট হাউস দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল সে হাত নেড়ে থামতে বলছে। কাছে এসে বলল, আপনাদের দোকানে আসতে বলছে।
অর্জুন মুখ তুলে দেখল খানিকটা দূরের দোকানের সামনে মালকিন দাঁড়িয়ে তাদের দেখছেন। অর্জুন বলল, একটু চা খাবেন নাকি? মেজর হুংকার ছাড়লেন, নো। তবে যেতে পারি।
মালকিন জানালেন, থিম্পু থেকে খবর এসেছে, কাল সকাল আটটার মধ্যে। তবু এসে যাবে। মোট পাঁচটা তাঁবু। সাহেবরা ছাড়া বাকি দুটোতে পোর্টাররা এবং মালপত্র। তিনজন পোর্টার নিলে ভাল হয়। ওরা থাকা-খাওয়া ছাড়া রোজ দুশো টাকা নেবে। রান্না থেকে সব কাজ করে দেবে। খুব বিশ্বস্ত। তাঁবুর ভাড়া বেশি নয়। পাঁচটার জন্য রোজ পাঁচ হাজার দিতে হবে। কিন্তু তবু ছিঁড়ে গেলে বা ফেরত দিতে না পারলে প্রতি তাবুর জন্য কুড়ি হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
মালকিনের কথা শেষ হলেই মেজর হাত নেড়ে বললেন, ভাল।
অর্জুন বলল, একবার অমলদাদের সঙ্গে কথা বললে হত না?
কোনও দরকার নেই, আমি তো মরে যাইনি। এতক্ষণে বেশ উত্তেজনার আঁচ পাচ্ছি। মেজর চুরুট ধরালেন।
মালকিন বললেন, এই তো এসে গেছে, আপনাদের যে পোর্টারদের দিচ্ছি তাদের ক্যাপ্টেনের নাম হল লিটু। গলা তুলে ভুটানিতে কিছু বলতেই একটি খাটো কিন্তু শক্তিশালী মধ্যবয়সি লোক এগিয়ে এসে কপালে আঙুল চুঁইয়ে সেলাম করল।
মালকিন বললেন, এই সাহেবদের নিয়ে যাবে তোমরা। দেখো যেন বদনাম না হয়।
এবারের সংলাপ হিন্দিতে। লিটু বলল, আপনি তো জানেন, লিটুর জান থাকতে মালিকের ক্ষতি হতে দেবে না।
অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, থিমাশিলিং নিশ্চয়ই তুমি চেনো। কিন্তু তার আশপাশের গ্রামগুলোতে কি গিয়েছ?
লিটু বলল, সব জায়গায় যে গিয়েছি তা বলব না। তবে অনেক জায়গায়ই গিয়েছি। কিন্তু সাহেবরা ক’দিনের জন্য যাবেন?
মেজর বললেন, নো আইডিয়া। যদ্দিন ভাল লাগবে। তা সাতদিন ধরে নাও।
তা হলে অন্তত আট দিনের চাল, ডাল, আটা, আলু, ডিম, সবজি এখান থেকে কিনে নিয়ে যেতে হবে। থিমাশিলিং-এ দাম বেশি আর তার ওপাশে গেলে কোনও দোকান পাবেন না। আর ওষুধ, ব্যান্ডেজ নিয়ে যাবেন। লিটু বলল।
মালকিন বললেন, কাল সকালে রেশন কিনতে হলে দেরি হয়ে যাবে। আপনারা যদি লিটুকে এখন টাকা দিয়ে দেন তা হলে ও সব কিনে রাখবে। আর সকালে ওরা তাঁবু, রেশন গাড়িতে তুলে আপনাদের কাছে পৌঁছে যাবে।
অর্জুন মেজরের দিকে তাকাল, মেজর বললেন, তুমি নিশ্চয়ই বলতে পারবে না ওগুলো কিনতে ঠিক কত টাকা লাগবে। আমরা চারজন আর তোমরা তিনজন অর্থাৎ সাতজনের জন্য যা যা প্রয়োজন কিনে নাও। মেজর পকেট থেকে পার্স বের করে কুড়িটা পাঁচশো টাকার নোট বের করে মালকিনের হাতে দিয়ে বললেন, আপনি ওকে সব বুঝিয়ে দিন।
ফেরার পথে অর্জুন না বলে পারল না, আপনার পরিবর্তন হয়েছে।
মানে?
আপনি টাকাগুলো লিটুকে না দিয়ে ভদ্রমহিলার হাতে দিলেন। যদি কোনও গোলমাল হয় তা হলে ভদ্রমহিলাকে দায়ী করা যাবে। এটা আগে করতেন না।
তার মানে তুমি বলতে চাইছ আমি এখন খুব প্র্যাকটিক্যাল হয়ে গেছি?
নিশ্চয়ই।
ছাই। বলেই মেজর আবার পেছন দিকে হাঁটতে শুরু করলেন।
আরে! কোথায় যাচ্ছেন?
চৌমাথায় না পৌঁছানো পর্যন্ত মেজর হনহনিয়ে হাঁটলেন। সেখানে একট মুদির দোকানের সামনে লিটুকে খুঁজে পেয়ে তাকে ইশারায় একটু দূরে ডেকে পার্স থেকে আরও কয়েকটা নোট বের করে হাতে ধরিয়ে দিলেন।
তারপর কিছু কথা বলে ফিরে এসে বললেন, বলো।
অর্জুন নির্লিপ্ত হয়ে হাঁটছিল। মেজর নিজেই বললেন, তোমার কথা শোনার পরে মনে হল আবার প্র্যাকটিক্যাল হওয়া উচিত। পাঁচ বোতল হুইস্কি আর দু’ ডজন চুরুটের টাকা দিয়ে এলাম লিটুকে। এসব তো পাহাড়ি গ্রামে পাব না। বলে ঘনঘন মাথা দোলাতে থাকলেন।
ঠিক সকাল সাড়ে আটটায় গাড়ি এসে গেল। থিমাশিলিং-এ ওদের নামিয়ে ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে ফিরে আসবে। ওদের ফেরার দিনে মোবাইলে জানালে আবার সে ওখানে যাবে। লিটুর দুই সহকারী বেশ শক্তপোক্ত। ওরা ভুটানিতে কথা বলে, হিন্দি বোঝে কিন্তু ভাল বলতে পারে না। গাড়ির পেছনে মালপত্র। ঠাসা। ড্রাইভারের পাশের সিট ছাড়া ঠিক পেছনে তিনটি সিট রয়েছে। মালকিনের লোককে টাকা মিটিয়ে দিয়ে পৌনে ন’টায় ওরা রওনা হল।
অমল সোম বলছিলেন, এই কিছুদিন আগেও ভুটানের সাধারণ মানুষের কাছে পৃথিবীর খবর পৌঁছোত না। রাজার আদেশই শেষ কথা, এখনও। কিন্তু তিনি আগের থেকে অনেক উদার হয়েছেন। তাই ভুটানের মানুষ এখন টিভি দেখার সুযোগ পাচ্ছে।
একসময় বলা হত ভুটানিরা নিজেদের সবার আড়াল রেখেছে। লক্ষ করো, ইংরেজরা এসে ভারতবর্ষ দখল করেছে, দার্জিলিং কালিম্পং-এর পাহাড়ও ভারতবর্ষের মানচিত্রে নিয়ে এসেছে কিন্তু ভুটানে কোনও অভিযান করেনি। ট্যুরিস্টদের ওপর এখন আর কোনও বিধিনিষেধ নেই কিন্তু ভুটানের সরকারি চাকরিতে যেসব ভারতীয় যোগ দেয় তাদেরও ভুটানি পোশাক পরা বাধ্যতামূলক। আমরা যেখানে যাচ্ছি সেখানে এখনও পুরনো ভুটানের কিছুটা আঁচ পাওয়া যেতে পারে।
এ দেশে আইনশৃঙ্খলা কীরকম? অর্জুন জিজ্ঞাসা করল।
শহরের সঙ্গে জঙ্গলের পার্থক্য তো থাকবেই। আমরা এমন কিছু করব না। যা ওদের সেন্টিমেন্টে আঘাত করে। অমল সোম বললেন।
গাড়ি উপরে উঠছিল। রাস্তা আচমকা খারাপ হয়ে গেল। কোথাও কোথাও তো রীতিমতো লড়াই। খুব ধীরে উঠতে হচ্ছিল। অথচ জানলার বাইরে তাকালেই তুষারে মোড়া পাহাড়ের চুড়োগুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। মেজর চুরুট ধরিয়ে বললেন, বিউটিফুল। আল্পসের কথা মনে পড়ছে।
অমল সোম হাসলেন, যেভাবে চুরুট খাচ্ছেন, ফুরোতে দেরি হবে না। তখন কী করবেন।
মেজর হো হো শব্দে হাসলেন, আমি বলব আলো জ্বলুক, জ্বলে উঠবে আলো। ভাববেন না।
রাস্তার দু’পাশে পাইন দেবদারুর শরীর জড়িয়ে বুনো লতার ঘন জঙ্গল। কোনও পাখির চিৎকার নেই। বেশ থমথমে ভাব জঙ্গলে। মেজর ড্রাইভারকে জিজ্ঞাসা করলেন, এই জঙ্গলে কী কী পাওয়া যায়?
কিন্তু তার হিন্দি এতই গোলমেলে যে অর্জুনকে সংশোধন করে দিতে হল।
ড্রাইভার গাড়ি চালাতে চালাতে বলল, সবকিছু। তাই রাতে এই রাস্তায় গাড়ি চালাই না।
কেন? মেজর চেষ্টা করলেন শুদ্ধ হিন্দি বলতে।
ভালুক আর সাপ। এই রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকে। কিছুদিন হল একদম কালো রঙের বাঘকে অনেকে দেখেছে। তবে ঠান্ডার সময় ভয় থাকে না। এখন জানোয়ারদের খুব কম দেখা যায়। ড্রাইভার বলল।
মেজর অমল সোমের দিকে তাকালেন, কালো বাঘ বলল না?
অমল সোম মাথা নাড়লেন, হ্যাঁ।
মাই গড, কালো বাঘ ভুটানে আসবে কী করে? ইম্পসিবল। ইন দ্য ইয়ার নাইনটিন নাইনটি ফাইভ, সেরেঙ্গিটির জঙ্গলে দুটো কালো বাঘকে লড়াই করতে দেখেছিলাম। আমাদের পোর্টার বলেছিল ওরা বাঘ নয়, বড় বেড়াল। একদম বাঘের সাইজের বেড়াল। নাম প্যান্থার। ভয়ংকর চোখ। উঃ মাথা নাড়লেন মেজর, সেই প্যান্থার তো সমুদ্র পেরিয়ে ভুটান চলে আসতে পারে না। এই ব্যাটারা কী দেখতে কী দেখেছে তা ওরাও জানে না।
থিমাশিলিং, জায়গাটা একটা ভ্যালির মধ্যে। চারপাশে বড় বড় পাহাড়। কিন্তু সেগুলো তুষারে ঢাকা নয়। বেশিরভাগ বাড়িই কাঠের, সিমেন্ট-ইটের একতলা রয়েছে। কয়েকটা দোকান, রাস্তায় কিছু গাড়ি দাঁড়িয়ে। ভুটানি পোশাকের লোকজন কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে আছে অর্জুনদের গাড়ির দিকে।
ড্রাইভার জিজ্ঞাসা করল, আপনাদের কোথায় নামাতে হবে?
অমল সোম জানালার দিকে তাকালেন, তোমার কাছে কি এখানকার ম্যাপ আছে? নাতাশা ল্যাপটপ খুলে বসেছিল, সেটা এগিয়ে দিল অমল সোমের দিকে। অমল সোম বললেন, চমৎকার। পৃথিবীর সব রহস্য জানতে আর বই ঘাঁটতে হবে না। বুঝলে অর্জুন, ছোট্ট জায়গা, প্যারালাল দুটো রাস্তা। একটা হোটেল আছে দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু সেখানে থাকাটা বোধহয় সুবিধাজনক হবে না। আমরা একেবারে উলটোদিকে গিয়ে যেখানে জঙ্গলের শুরু সেখানে টেন্ট খাটাই তা হলে নিরিবিলিতে থাকা যাবে।
মেজর বললেন, এখানে তো কোনও শব্দ নেই। পুরোটাই নিরিবিলি।
অর্জুন বলল, টেন্টের ভাড়া তো দিতেই হবে, এটাই ব্যবহার করা উচিত।
ড্রাইভারকে ম্যাপ দেখে দেখে বলে জঙ্গলের মুখে নিয়ে গেলেন অমল সোম। মালপত্র নামিয়ে নিজের মোবাইল নাম্বার লেখা কাগজ দিয়ে ড্রাইভার ফিরে গেল গাড়ি নিয়ে। বলে গেল, ফেরার সময় দু’পিঠের ভাড়া একসঙ্গে নেবে।
নাতাশাকে ব্যাপারটা বললে সে হেসে মাথা নাড়ল, কী সরল এখানকার মানুষ।
পোর্টাররা যখন তাঁবু খাটাচ্ছিল তখন অর্জুন বলল, ড্রাইভার বলেছে এই জঙ্গলে কালো বাঘ আছে। মেজর বললেন, ওটা প্যান্থার, বড় কালো বেড়াল। খুব হিংস্র। তাই কখনও একা জঙ্গলের ভেতরে ঘুরবেন না।
নাতাশা হাসল, প্যান্থার হল কালো লেপার্ড। বেড়াল নয়। খুব হিংস্র কিন্তু চট করে মানুষের কাছাকাছি আসে না। দক্ষিণ আমেরিকাতে ওদের বলা হয় পুমা। এই জঙ্গলে ওদের থাকার কোনও কারণ নেই। তার চেয়ে অনেক বেশি ভয় পাই সাপকে।
তাঁবু খাটানো হয়ে গেলে পোর্টাররা রান্নায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল। একটু আগে মেজর লিটুকে ডেকে বুঝিয়েছেন খাওয়ার জল যেন ভাল করে ফোঁটানো হয়। সেই জল ঠান্ডা হলে জিওলিন নামে একটা তরল ওষুধ কয়েক ফোঁটা মিশিয়ে সবাই যেন পান করে। তিনি এক বোতল জিওলিন লিটুকে দিয়ে দিলেন।
একটা তাবু বেশ বড়, অন্যগুলো তুলনায় ছোট। বড় তাবুতে দু’জনের শোবার ব্যবস্থা। অমল সোম সেখানে ঢুকে বললেন, বাঃ, এখানে বসেই কথা বলা যাবে। নাতাশা, তোমার তাঁবুটা কি পছন্দ হয়েছে?
আমার কোনও অসুবিধে হবে না। কিন্তু টয়লেটটা ওরা একটু দূরে করেছে। নাতাশা বলতেই মেজর হাত তুললেন, ওটা দূরে থাকাই ভাল। যেতে ভয় লাগলে আমাদের ডেকো, পাহারা দেব।
ধন্যবাদ। আমি একটু জায়গাটাকে ঘুরে দেখতে চাই। নাতাশা বলল।
বেশ তো। আমি সঙ্গে গেলে তোমার আপত্তি নেই তো। অমল সোম বললেন।
নট অ্যাট অল। আমার ভাল লাগবে, নাতাশা হাসল।
ওরা বেরিয়ে গেলে মেজর বললেন, মানুষের ঘরবাড়ির বদলে জঙ্গল আমাকে অনেক বেশি টানে। দুই পা গেলেই তো জঙ্গলে ঢোকা যায়, যাবে নাকি?
অর্জুন বলল, চলুন। এখন এখানে কিছুই করার নেই।