যারা গাড়ি জোরে চালায়
তাদের আমি ভীষণ ভয় পাই। সুকল্যাণদা হাত মুঠো করে সিগারেটটা পাকড়ে ছিলেন।
কথাটা বলেই শোঁ-শোঁ শব্দে দুটো ভীম টান দিলেন। তারপর ঘরের সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে ফুরফুর করে ধোঁয়া বের করলেন অনেকক্ষণ ধরে। ছোট করে বারতিনেক কেশে নিয়ে আমাদের তিনজনের দিকে চোখ নাচিয়ে তাকালেন। যার অর্থ হল : তোরা কি ভয় পাস?
হ্যাঁ, আমি ভয় পাই। তাতে কেউ আমাকে কাপুরুষ ভাবলেও কোনও ক্ষতি নেই। যারা গাড়ি জোরে চালায় তাদের আমি সত্যিই ভীষণ ভয় পাই। ওই সুকল্যাণদার মতোই।
হাড় কাঁপানো শীতে চাদর মুড়ি দিয়ে আমাদের আড্ডাটা দারুণ জমে উঠেছিল। চা কফি আর ফিঙ্গার চিত্স খেতে-খেতে হাজার কথার ফুলঝুরি ছোটাচ্ছিলাম আমরা। মনেই হচ্ছিল না, কলকাতা থেকে বহুদূরে হীরাপুরের গেস্টহাউসে বসে আছি।
কথায় আছে, পৃথিবীর যে-কোনও শহরে তিনটে বাঙালি কোনওরকমে একজোট হলেই সেটাকে কলকাতা বানিয়ে দেয়। এখানেও যেন তাই। কিন্তু আজ আমাদের আড্ডার শেষ দিন। আর ঘণ্টাখানেক পরেই রওনা হতে হবে কলকাতার ট্রেন ধরার জন্যে।
সুকল্যাণদার অফিস হীরাপুরে। ওঁদের কোম্পানি খনির কীসব যন্ত্রপাতি যেন তৈরি করে। বেশ বাঘা কোম্পানি। সুকল্যাণদাকে অনেক টাকার অফার দিয়ে কলকাতার এক ঘ্যাম কোম্পানি থেকে ছিনিয়ে এনেছে। আর আমাদের তাস খেলার টিমটার বারোটা বেজে গেছে। কারণ, আমরা চারজন ছিলাম যাকে বলে তাসতুতো ভাই।
এবারে শীতের শুরুতে সুকল্যাণদা আমাদের তিন মক্কেলকে নেমন্তন্ন করেছিলেন। ফোন করে তিনজনকেই বলেছিলেন, বুঝলে ভাই, কবে আছি কবে নেই তার কোনও ঠিক নেই। একটু খোঁজও তো নাও না, দাদা কেমন আছে! এখানে চলে এসো। দিব্যি আড্ডা দেবে, চিকেন কোর্মা কি মাটন কষা খাবে–আর চারজনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্রিজ খেলব। আসা চাই কিন্তু! তোমাদের ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছে।
তো আমরা তিনজনেই গিয়ে হাজির হয়েছি রামগিরি, তেজেন আর আমি।
আমরা তিন মক্কেল উত্তর কলকাতার কাছাকাছি থাকি। একই ব্যাচে মর্নিং কলেজে পড়েছি। পরে ছোটখাটো চাকরিবাকরিতে ঢুকলেও তাসের আড্ডায় হাজিরা দেওয়াটা বন্ধ করিনি। সেখানে সুকল্যাণদা ছিলেন আমাদের মধ্যমণি।
কথায় কথায় কী করে যেন আড্ডায় মোড় ঘুরে গিয়েছিল গাড়ি আর ড্রাইভারের দিকে। তখনই সুকল্যাণদা ওপরের মন্তব্যটি করেছেন। এখন তারই জের ধরে আমার দিকে আঙুল তুলে বললেন, নো-ট্রাম্প, তোর সুখদেওকে মনে আছে? সেই যে, আমরা একবার ইডেনে ওয়ান ডে দেখতে গিয়েছিলাম…।
ওরে ব্বাবা! মনে নেই আবার!
আমার নাম শোভন। কিন্তু ব্রিজ খেলতে বসলেই সবসময় আমার নো-ট্রাম্প কল করার ঝোঁক চাপে। তাই সুকল্যাণদা আমার নাম দিয়েছেন নো-ট্রাম্প।
আমার কথায় রামগিরি আর তেজেন অবাক হয়ে জিগ্যেস করল, কী ব্যাপার? কী ব্যাপার?
রামগিরি অবশ্য ব্যাপার বলতে পারে না বলে বেপার। অথচ ওর ধারণা কলকাতায় বহুদিন কাটিয়ে ও বাংলায় একদম চোস্ত হয়ে গেছে।
সিনেমার মতো সুখদেওর ঘটনাটা মনে পড়ে গেল। মনের কোন কোণে লুকিয়ে ছিল কে জানে! চট করে ভেসে উঠল।
সুকল্যাণদা সবসময় অফিসের গাড়ি পেতেন। সেই গাড়ি চালাত সুখদেও। বছর তিনেক আগে আমি আর সুকল্যাণদা ইডেনে ইন্ডিয়া-অস্ট্রেলিয়ার ওয়ান ডে দেখতে গিয়েছিলাম। তৈরি হয়ে বেরোতে একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল বলে আমরা বেশ চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম। যদি ইন্ডিয়া টসে জিতে ব্যাট নেয় তা হলে শচীনের ব্যাট শুরু থেকে দেখা যাবে না।
গাড়িতে বসে সে কথাটাই বোধহয় দুজনে আলোচনা করছিলাম। হঠাৎই গাড়িটা এক হ্যাঁচকা মেরে গা ঝাড়া দিয়ে বনবন করে ছুটতে শুরু করল।
সে ছোটা কাকে বলে!
পরপর গাড়ি ওভারটেক করে, বাস-ট্রামের ফাঁকফোকর দিয়ে গলে, সাইকেল ভ্যান আর অটোকে কিস করে সুখদেও যেন বুলেটের বেগে পক্ষীরাজ ঘোড়া ছুটিয়ে দিয়েছিল।
পেছনের সিটে লেপটে শুয়ে সুকল্যাণদা সুখদেও! সুখদেও! বলে মিহি চিৎকার করছিলেন। কিন্তু ওইটুকুই! তার পরে তিনি সুখদেওকে ঠিক কী যে বলতে চাইছিলেন সেটা আমি জানি না। কারণ, ওঁর মুখ দিয়ে আর কোনও কথা বেরোচ্ছিল না।
আমার অবস্থাও তখন হয়েছিল সুকল্যাণদার মতোই। পেছনের সিটে কাত হয়ে পড়ে গিয়ে হাসপাতালের ইমার্জেন্সির পেশেন্টের মতো ইষ্টনাম জপছি। চোখ-কান খোলা, কিন্তু বডিটা ডেডবডির মতন।
অন্যান্য বাস-গাড়ির ড্রাইভারদের মুখ খিচুনি দেখে বুঝতে পারছিলাম ওরা প্রাণভরে সুখদেওকে গালিগালাজ করছে, ওর পিণ্ডি চটকাচ্ছে।
কিন্তু সুখদেও যেন হিমালয়ের সন্ন্যাসী। হাজার গালাগালের ঊর্ধ্বে। ওর আর কোনও দিকে ধেয়ান নেই মনে শুধু একটিই চিন্তা ও আমাদের যেন লেট না হয়।
না, সেবার ইডেনে আমাদের লেট হয়নি।
দুটো গাড়ির হেডলাইট, একটা অটোর ব্যাকলাইট, আর আমাদের গাড়ির ডানদিকের হেডলাইট ভেঙে সুখদেও আমাদের পৌঁছে দিল ইডেনে। গাড়িটা জায়গামতো পার্ক করে দু-হাতে তালি দিয়ে হাত ঝাড়ল, বলল, লিন, স্যার, একদম টাইমে পৌঁছে দিয়েছি। শচীনের ব্যাট একেবারে স্টার্টিং থেকে দেখতে পাবেন।
আর শচীনের ব্যাট! আমি আর সুকল্যাণদা তখন সরষে ফুল দেখছি। সমস্ত গাঁটের খিল খুলে যাওয়া হাত-পাগুলোকে কোনওরকমে জড়ো করে গাড়ি থেকে নেমেছি। সুকল্যাণদা ভয় পাওয়া চোখে সুখদেওর পাকানো গোঁফের দিকে তাকিয়ে সরু গলায় বললেন, তুমি গাড়ি নিয়ে চলে যাও– আমরা ট্যাক্সি নিয়ে ফিরব।
সুখদেও অবাক হলেও কোনও কথা না বলে সেলাম ঠুকে চলে গিয়েছিল।
আমার মুখে সুখদেওর কাহিনি শুনে তেজেন তো হেসেই কাহিল! রামগিরি বিড়িতে দু তিনটে টান দিয়ে বলল, ও কি আর অ্যায়সেই গাড়ি তেজ চালিয়েসে! তোমাদের লেট হয়ে যাচ্ছে শুনতে পেয়ে তোমাদের ভালোর জন্যে একটু স্পিড় দিয়েছে।
একটু স্পিড! রামগিরি তো ও কথা বলবেই। দেশোয়ালি ভাই যে! তা ছাড়া রামগিরি সাহসী ছেলে। আমাদের মতো হাইস্পিডে গাড়ি চড়তে ভয় পায় না। ওর বাবা মিলিটারিতে ছিলেন।
সুকল্যাণদা বললেন, ওঃ, সুখদেওকে নিয়ে আমার যা প্রবলেম গেছে! অফিসের কোনও মিটিং-এ রওনা হওয়ার সময় ভুলেও কখনও বলতাম না যে, দেরি হয়ে যাবে। কারণ, ও একবার শুনতে পেলেই সর্বনাশ। বরং বানিয়ে বানিয়ে বলতাম : ওঃ, আজ বড্ড তাড়াতাড়ি রওনা হলাম। অত আগে মিটিং-এ পৌঁছে কী করব!
সে কথা শুনে সুখদেও গুনগুন করে গান ভাঁজত আর আরামে গাড়ি চালাত। আর মাঝে মাঝে পেছন ফিরে আমাকে বলত, স্যার, আপকো লেট তো নহি হোগা? আমি বলতাম, না রে, বাবা, না। তুই আরামে চালা…।
সুখদেওর চেহারাটা মনে পড়ে গেল আমার।
বেশ রোগা, তামাটে রং, ইয়া গোঁফ, মুখটা লম্বাটে। খইনি খেয়ে সামনের দাঁতে ছোপ পড়ে গেছে। মাথায় কদমছাঁট চুল। তার ভেতর থেকে উঁকি মারছে মিডিয়াম টিকি।
তবে সুখদেও যত জোরেই গাড়ি চালাক, ওর হাসিটা ছিল ভীষণ সরল, সুন্দর। ও কথায় কথায় সবাইকে সেলাম ঠুকত, আর গাড়ির প্রতিটি সওয়ারিকেই স্যার অথবা ম্যাডাম বলত।
সুখদেওর কাহিনি শুনে তেজেন গম্ভীরভাবে গলাখাঁকারি দিল। তারপর গুরুগম্ভীর গলায় বলল, যাই বলুন, সুকল্যাণদা–ড্রাইভিং মোটেই সহজ নয়।
তেজেনের কথা বলার ঢঙে একটা রবীন্দ্রসঙ্গীত গোছের ভাব আছে। ও যে আড়ালে আবডালে সঙ্গীত সাধনা করে সেটা আমরা জানি। আর রবীন্দ্রনাথকে সবসময় ও গুরুদেব বলে।
তেজেন বলল, আমি একসময় ড্রাইভিং শিখতাম…শোভন জানে। তখন ভেবেছিলাম, ট্যাক্সি ম্যাক্সি চালাব–পরে সেটা আর হয়নি। যাই হোক, শিখতাম যার কাছে, তার নাম ছিল বৃন্দাবন। খুব শান্ত টাইপের, ধার্মিক মানুষ, টকটকে ফরসা গায়ের রং। তো গাড়িতে ওকে পাশে বসিয়ে ভোরবেলা ভি. আই. পি. রোডে গিয়ে প্র্যাকটিস করছি…প্রথম দিন। রাস্তা ফাঁকা ছিল বলে হেভি স্পিডে গাড়ি চালাচ্ছি…জানলা দিয়ে হু-হু করে হাওয়া ঢুকছে। হঠাৎই পাশ থেকে বৃন্দাবন খুব শান্ত গলায় বলে উঠল : ভাইয়া, ওতনাহি জোরসে গাড়ি চালাবেন যেটা রুকতে পারবেন। ব্যস, ভুস করে গাড়ির স্পিড কমিয়ে দিলাম। তারপর থেকে জোরে কখনও গাড়ি চালালেই আমার বৃন্দাবনের কথাটা মনে পড়ে যায়। সুতরাং, যত জোরেই গাড়ি চালাও, থামাতে জানা চাই…।
রামগিরি মাথা নেড়ে তেজেনকে সায় দিল ও তেজেন কারেক্ট কথা বলেছে, সুকল্যাণদা। যত স্পিডেই চালাও রুকতে জানা চাই। আমাদের লাইফও তাই যত স্পিডেই চালাও থামতে জানা চাই।
সর্বনাশ করেছে। সুযোগ পেলেই রামগিরির একটু-আধটু দর্শন-বাতিক আছে–যদিও ও পড়াশোনা করেছে কেমিস্ট্রি নিয়ে। এই আড্ডার মাঝে জ্ঞানের বুলি আর ভাল্লাগে না।
তাই রামগিরির দর্শনকে ঠেকা দিতে তড়িঘড়ি বলে উঠলাম, সুকল্যাণদা, গাড়ি চালানো শেখানোর সময় আমাকেও একজন ড্রাইভার দারুণ একটা কথা বলেছিল। তখন বাবা বেঁচে ছিল। আমাদের একটা কালো রঙের ফিয়াট ছিল। কিষাণ সেই গাড়িটা চালাত। বাবাকে ও জান দিয়ে ভালোবাসত।
তো যেদিন আমি গাড়ি শেখার জন্যে প্রথম স্টিয়ারিং-এ বসেছি–পাশে কিষাণ–গাড়ি স্টার্ট দিতে যাব–হঠাৎই কিষাণ হাত তুলে আমাকে থামতে ইশারা করল। আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকাতেই ও বলল, একটা কথা বলি, ছোটবাবু। আমার গুরু প্রথমদিন একথাটা আমায় বলেছিল। আর আমার গুরুকে বলেছিল তার গুরু। কথাটা হল : স্টিয়ারিং-এ বসে সবসময় মনে রাখবেন, কলকাতা শহরে সবাই অন্ধ–শুধু আপনি দেখতে পান। তা হলে আপনার গাড়ি চালাতে সুবিধে হবে।
সুকল্যাণদা হেসে বললেন, দারুণ বলেছে! তবে ভাই যাই বলো, যতই বৃন্দাবন কি কিষাণের কাহিনি বলো, সুখদেও জিনিয়াস। ও যেখানে-যেখানে চাকরি করেছে সেখানকার সবাই ওকে রীতিমতো ভয় পায়–এবং শ্রদ্ধা করে।
তারপর সুকল্যাণদা সুখদেওর আরও কয়েকটা এপিসোড শোনালেন। কবে একবার গাড়ির পেছনের চাকা পাংচার হয়ে যাওয়ার পরেও সুখদেও গাড়িটা প্রায় এক কিলোমিটার টেনে গিয়েছিল। কোন এক ডেপুটি ম্যানেজারকে ঝড়ের বেগে মধ্যমগ্রাম পৌঁছে দেওয়ার পর দ্যাখে ভদ্রলোক সিটে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন। এইসব বিপজ্জনক কীর্তি আর কী!
আমরা আড্ডা দিচ্ছিলাম। লক্ষ করলাম, তারই ফাঁকে ফাঁকে সুকল্যাণদা দেওয়াল-ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছেন। কারণ, আটটা বাজলেই আমাদের রওনা হওয়ার কথা। এই গেস্টহাউস থেকে স্টেশন প্রায় একটি ঘণ্টার পথ। তারপর কলকাতার ট্রেন।
মিনিট-পনেরো সময় তখনও হাতে ছিল। সুকল্যাণদা কেয়ারটেকার ছেলেটিকে বলে আর এক রাউন্ড কফির ব্যবস্থা করলেন। বললেন, নে, সব মেন্টালি রেডি হয়ে নে। তোরা এসে তিনটে দিন আমার দারুণ জমিয়ে দিলি।
আমি জিগ্যেস করলাম, দাদা, এখন যে স্টেশনে রওনা হব, তো গাড়ি চালাবে কে?
সুকল্যাণদা বুঝলেন যে, সুখদেওর ভূত এখনও আমার মাথা থেকে যায়নি। তাই হেসে বললেন, কোনও চিন্তা করিস না, বাপ। তোদের জন্যে একজন দারুণ ড্রাইভার ফিট করেছি। একেবারে স্লো-মোশানে গাড়ি চালায়। দারুণ হাত। চেষ্টা করলেও ওকে দিয়ে কোনও অ্যাকসিডেন্ট করাতে পারবি না। নাম ব্রিজলাল।
রামগিরি নতুন একটা বিড়ি ধরিয়ে বলল, স্লো গাড়ি চললে আমার থোড়া বোরিং লাগে। লেকিন ঠিক আছে, আর সোকোলের সোয়ার্থে সহ্য করে নেবে।
আহা! কী দয়ালু! আর কী বাংলা!
আমি ওকে বাংলার জন্যে বাহবা দিলাম। ব্যাটা আওয়াজটা বুঝতেই পারল না–হেঁ-হেঁ করে হেসে কমপ্লিমেন্টটা নিল।
সুকল্যাণদা তাড়া দিলেন। আর সঙ্গে-সঙ্গে বাইরে থেকে গাড়ির প্যা-প্যা হর্ন শোনা গেল।
আমরা তৈরিই ছিলাম। যার-যার মালপত্র, গাঁটরি, পুঁটলি নিয়ে গেস্টহাউসের বাইরে এলাম।
বাব্বা! কী শীত! সেইসঙ্গে ব্যাপক কুয়াশা আর ঝিঁঝির ডাক।
একটা সাদা রঙের অ্যাম্বাসাডর নুড়ি-ঢালা চত্বরে দাঁড়িয়ে ছিল। তার ঘোলাটে হেডলাইট জ্বলছে। স্টিয়ারিং-এ যে কেউ একজন বসে আছে সেটুকু বোঝা যাচ্ছে।
আমরা তাড়াতাড়ি পায়ে শীত ডিঙিয়ে গাড়িতে গিয়ে উঠলাম। রামগিরি সামনে বসল। আর পেছনে একটা জানলার ধারে সুকল্যাণদা, ওঁর পাশে আমি, তারপর তেজেন।
শীত ঠেকাতে আমরা তিনজন সোয়েটার, কোট, মাফলার, চাদর জড়িয়ে বেশ মোটাসোটা হয়ে গেছি। দেখলাম, ড্রাইভার ব্রিজলালও মোটামুটি মাফলার কম্বলের স্তূপ। মাথায় মাংকি ক্যাপটা এতটাই কপালে নামানো যে, একটা ভাল্লুক-ভাল্লুক ভাব এসে গেছে।
সুকল্যাণদা রোগা চেহারার মানুষ। তা ছাড়া এখানে কয়েক বছর থেকে মোটামুটি মানিয়ে নিয়েছেন। তাই ওঁর গায়ে শীতের আয়োজন আমাদের চেয়ে অনেক হালকা।
শীতের জন্যে গাড়ির কাচ-টাচ সব তোলা ছিল। সুকল্যাণদাকে বললাম, এই একঘণ্টা সিগারেট ছাড়া আপনার তো অসুবিধে হবে।
তাতে সুকল্যাণদা হেসে বললেন, না রে, নো-ট্রাম্প, নো প্রবলেম। এখন সবই কমবেশি মানিয়ে নিয়েছি।
গাড়ি স্টার্ট দিয়েছিল। চাকার নীচে নুড়ির খড়মড়-খড়মড় শব্দ হচ্ছিল। তারপর গেস্টহাউসের কম্পাউন্ড পেরিয়ে যেতেই মসৃণ পিচের রাস্তা।
আমরা নিজেদের মধ্যে কথা বলছিলাম। হঠাৎই সুকল্যাণদা গাড়ির মধ্যে একটা বোমা ফাটাল। বললেন, তোদের আগে বলিনি সুখদের সঙ্গে আমার হীরাপুরে দেখা হয়েছিল।
সে কী! আঁতকে উঠলাম আমি।
হ্যাঁ রে। দেখি ছেঁড়া জামাকাপড়, মুখে খোঁচা-খোঁচা দাড়ি। আমাকে দেখেই স্যার, কেমোন আছেন? বলে সেলাম ঠুকল। সুকল্যাণদা কয়েকবার কাশলেন। তারপর ও আমি ওকে বললাম, কীরে, তোর এ অবস্থা কেন? তাতে ও বলল…।
জোরে বেপরোয়া গাড়ি চালানোর দোষে সুখদেও নাকি কোথাও টিকতে পারেনি। শেষ যে কোম্পানিটায় চাকরি করত তার এক এক্সিকিউটিভ নাকি একদিন গাড়িতে বসে ভুল করে বলে ফেলেছিলেন, এই রে, ফাইলটা বোধহয় বাড়িতে ফেলে এসেছি। ব্যস, আর যায় কোথায়! সঙ্গে-সঙ্গে গাড়ি ঘুরিয়ে সুখদের রাজধানী এক্সপ্রেস শুরু হয়ে গেছে। সুখদেও যখন সাড়ে সাত মিনিটে আট কিলোমিটার পথ পেরিয়ে তার বাড়িতে পৌঁছোয় ততক্ষণে ভদ্রলোকের বেশ বড় রকমের একটা স্ট্রোক হয়ে গেছে। আর তারপরই সুখদেওর চাকরি নট। সুতরাং ও তল্পিতল্পা নিয়ে দেশে চলে এসেছে। ওর দেশ মোতিহারি। কদিন হল দেশ থেকে এখানে হীরাপুরে এক চাচার কাছে নোকরির সন্ধানে এসেছে।
আমাকে দেখে সুখদেও তো মহা খুশি। ওর সেলাম আর থামতেই চায় না। তো ওকে দেখে আমার কেমন যেন মায়া হল। ফলে নিয়ে নিলাম।
নিয়ে নিলেন মানে! রামগিরি সামনে থেকে অবাক মন্তব্য ছুঁড়ে দিল পেছনে।
সুকল্যাণদা হাসলেন, বললেন, পুরোনো চেনা লোক…তাই ওকে আমার গাড়ির পাইলট করে নিলাম।
আমি তখন বললাম, এই যে তখন বললেন, যারা গাড়ি জোরে চালায় তাদের আপনি ভীষণ ভয় পান!
হ্যাঁ, ভয় পাই..মানে, পেতাম। কারণ, সুখদেও এখন পালটে গেছে–নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে। বললে পরে কথা শোনে।
কথা আর গল্পে মত্ত ছিলাম বলে খেয়াল করিনি গাড়িটা কখন যেন স্পিড নিয়েছে। জানলার কাচ দিয়ে বাইরের আঁধারে যে-বাতিগুলো দেখা যাচ্ছিল সেগুলো সা-সাঁ করে পেছনে ছুটে যাচ্ছে। গাড়ির ভেতরটা হঠাৎই যেন বেশ ঠান্ডা হয়ে গেছে।
তেজেন ভারী গলায় মন্তব্য করল, এ যে গুরুদেবের শান্তিনিকেতনের মতো ঠান্ডা পড়ে গেল রে।
সুকল্যাণদা হাসতে গিয়ে খকখক করে কাশতে শুরু করলেন। একেবারে ঠান্ডা লাগা কাশি।
আমি জানলার কাচগুলো খুঁটিয়ে দেখতে লাগলাম। কোথাও ফাঁক-টাক নেই তো!
গাড়ির স্পিড আরও বেড়ে গিয়েছিল। আমি ভয় পেয়ে সুকল্যাণদাকে বললাম, এ কী ব্যাপার দাদা! ব্রিজলাল যে স্লো মোশানে গাড়ি চালায় বললেন!
আগে তো তাই চালাত! পেছন থেকে একটা হেভি ট্রাক ওকে ধাক্কা মারার পর…।
আমি চমকে ব্রিজলালের দিকে তাকালাম। ওর মুখটা ঠাহর করার চেষ্টা করতে লাগলাম।
আমাদের গাড়ি তখন উড়ছে। বাইরের সব আলো অন্ধকারে হলদে রেখা এঁকে চলেছে। আর গাড়ির ভেতরটা আরও ঠান্ডা হয়ে গেছে। স্পিড বাড়ার সঙ্গে-সঙ্গে ঠান্ডাটাও যেন বাড়ছে।
আমি চেঁচিয়ে উঠলাম, ব্রিজলাল!
আমার দিকে যে ফিরে তাকাল সে সুখদেও।
অবাক হয়ে বললাম, এ কী! সুখদেও, তুমি!
আমার মাথা গুলিয়ে যাচ্ছিল। রামগিরি ভয় পেয়ে হায় রাম! বলে চেঁচিয়ে উঠল।
সঙ্গে-সঙ্গে সুখদেও সেলাম ঠুকে বলে উঠল, রাম নাম সত্য হ্যায়।
আমার পাশে তেজেন ভয়ে কাঠ হয়ে আমাকে আঁকড়ে ধরে গুরুদেব! গুরুদেব! করছিল।
সুকল্যাণদা আমার উরুতে আলতো চাপড় মেরে হেসে বললেন, ভয় পাস না, নো-ট্রাম্প। ব্রিজলালও যা সুখদেও-ও তাই। মরার পরে রামে-রহিমে কি আর তফাত থাকে রে! ব্রিজলাল মারা গেল ট্রাক চাপা পড়ে, আর সুখদেও..আমাকে নিয়ে বেদম স্পিডে গাড়ি চালাচ্ছিল…ব্রিজ থেকে আমরা সোজা ছিটকে গেলাম বরাকরের জলে। সব শেষ। তারপর থেকে সুখদেও আমার সবকথা শোনে, আর কেউ জোরে গাড়ি চালালেও আমার আর ভয়-টয় কিছু করে না। মরার পরে আবার ভয় কীসের বল! শুধু ওই বরাকরের জলে থেকে-থেকে ঠান্ডা লেগে এই বিচ্ছিরি কাশিটা হয়েছে।
আমরা তিনজন তখন পাথর। নড়াচড়ার কোনও ক্ষমতা নেই।
সুকল্যাণদা কাশলেন আবার। তারপর হেসে বললেন, শোন, ওই অ্যাকসিডেন্টে মারা যাওয়ার পর থেকে শুধু তেনারাই পালা করে আমার গাড়ি চালায়। ব্রিজলাল, সুখদেও, পরাশর, নরেশ…ওরা সবাই।
কথা শেষ করে হো-হো করে হেসে উঠেছিলেন সুকল্যাণদা। কিন্তু সে-হাসির সবটা আমার শোনা হয়নি। কারণ, বোধহয় ওই হাসির মাঝখানেই সেন্সলেস হয়ে পড়েছিলাম।