Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ম্যাজিক মুনশি (২০১০) || Humayun Ahmed » Page 6

ম্যাজিক মুনশি (২০১০) || Humayun Ahmed

এশার নামাজ শেষ করে মুনশি এসেছেন

এশার নামাজ শেষ করে মুনশি এসেছেন। তার গায়ের চা-পাতা গন্ধি আতরের সুঘ্রাণ আগের চেয়েও বেশি। মনে হয় নামাজের সময় নতুন করে আতর মাখা হয়েছে। আমি বললাম, আরেকটা ম্যাজিক দেখান।

কঠিন ম্যাজিক দেখাব স্যার? অবশ্যই কঠিন ম্যাজিক দেখাবেন।

কেবিনের জানালা বন্ধ করে দেই? বন্ধ ঘর ছাড়া ম্যাজিক দেখানো যায় না।

জানালা বন্ধ করে দিন।

মুনশি জানালা বন্ধ করলেন। আমাকে বললেন দুহাতে দুটা মোমবাতি ধরে পাশাপাশি রাখতে। মোমবাতি দুটির দূরত্ব যেন ছয় ইঞ্চির বেশি না হয়। আমি তা-ই করলাম। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দপ করে বাঁ হাতের মোমবাতি আপনাআপনি জ্বলে উঠল। পরের ঘটনা অদ্ভুত। বাঁ হাতের মোমবাতি নিভে ডান হাতেরটা জ্বলে উঠল। ঘটনা অতি দ্রুত ঘটতে লাগল। মনে হচ্ছে আলো লাফালাফি করছে।

আমি মুগ্ধ হয়ে আলোর নাচানাচি দেখছি। এই আলো ঠিক মোমবাতির আলো না। হালকা নীলাভ দ্যুতি।

আধুনিক ম্যাজিশিয়ানরা আলোর নাচানাচি দেখাতে পারেন। আলো নাচানাচি করবে। এক কান দিয়ে ঢুকে অন্য কান দিয়ে বের হবে। এই আলোর নাচানাচি ম্যাজিকের কৌশল জটিল না। বুড়ো আঙুলের উপর নকল আঙুল পরতে হয়। বাইরে থেকে বোঝা যায় না হাতে নকল আঙুল পরা আছে। ম্যাজিকের ভাষায় নকল আঙুলকে বলে Thumb TIp. Aplastic flesh colored gimmick that fits over the magicians thumb for the purpose of concealing very small objects, liquids and so on.)

Thumb tip-এ ব্যাটারিচালিত বাল্ব থাকে। ব্যাটারিতে চাপ দিলেই আলো জ্বলে ওঠে। হাত নাড়ালেই মনে হয় আলো নড়াচড়া করছে। নিভে যাচ্ছে, আবার জ্বলছে।

মুনশির ম্যাজিকের সঙ্গে আধুনিক আলোর নাচনের ম্যাজিকের কোনো মিল নেই। আমি দুই হাতের দূরত্ব খানিকটা বাড়াতেই মোমবাতি নিভে গেল। আমি বললাম, অদ্ভুত। এ রকম আগে কখনো দেখি নি। আপনার সবচেয়ে জটিল ম্যাজিক কোনটা?

মুনশি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ছোট পুকুরে আমি পানির উপর হেঁটে পার হতে পারি। এটাই আমার সবচেয়ে জটিল ম্যাজিক। পূর্ণিমার চাঁদ যখন ঠিক মাথার উপর থাকে, তখন আমি এই ম্যাজিক দেখাতে পারি। অন্য সময়ে পারি না।।

আপনার এই ম্যাজিক কি কেউ দেখেছে?

জি-না। কারও সামনে এই ম্যাজিক করা যায় না।

আমি বললাম, যে ম্যাজিক কেউ দেখতে পারবে না সেই ম্যাজিক কোনো ম্যাজিক না।।

মুনশি সঙ্গে সঙ্গে বলল, কথা সত্য।

আপনি বিয়ে করেছিলেন?

করেছিলাম স্যার! ঝামেলার বিয়ে।

ঝামেলার বিয়ে মানে? পরী বিয়ে করেছিলেন নাকি?

মুনশি হেসে ফেলে বললেন, পরী কোথায় পাব স্যার! একটা হিন্দু মেয়ে বিয়ে করেছিলাম। তার নাম রেবতী। বিয়ের দুই মাসের মধ্যে মেয়েটা মারা যায়।

কীভাবে মারা যায়?

সাপের কামড়ে। রেবতীর মৃত্যুর পর কিছুদিনের জন্যে আমার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। পাবনা মানসিক হাসপাতালে ছয় মাস ছিলাম।

আমি বললাম, হাসপাতাল থেকে ফেরার পর আপনি হঠাৎ লক্ষ করলেন, ম্যাজিক দেখানোর কিছু ক্ষমতা আপনার মধ্যে হয়েছে। তাই না?

মুনশি চমকে উঠলেন, কিন্তু হ্যাঁ না কিছু বললেন না।

আমি বললাম, আমি যদি আমার কোনো ম্যাজিশিয়ান বন্ধু নিয়ে আসি, তাকে ম্যাজিক দেখাতে পারবেন?

মুনশি বলল, কেন পারব না? অবশ্যই পারব।

আমি যদি একটা ভিডিও ক্যামেরা রাখি, তার সামনে করতে পারবেন?

পারব।

আমি বললাম, পূর্ণচন্দ্র মাথার উপর নিয়ে পুকুর হেঁটে পার হওয়ার সময় কি আপনার মৃত স্ত্রী কোনো না কোনো কারণে উপস্থিত থাকেন?

মুনশি আবারও চমকাল। কোনো উত্তর না দিয়ে মাথা নিচু করল। আমি বললাম, আপনি কি আমার কোনো বই পড়েছেন?

জি-না স্যার। আপনি কি রামকৃষ্ণ পরমহংসের নাম শুনেছেন?

জি স্যার শুনেছি। আমার স্ত্রী ছিলেন হিন্দু ব্রাহ্মণের মেয়ে। তার কারণেই শুনেছি। তার কাছে পরমহংসের ছবিও ছিল।

আমি বললাম, পানির উপর দিয়ে হাঁটা নিয়ে পরমহংসের একটি সুন্দর গল্প আছে। গল্পটা বলি?

বলুন।

রামকৃষ্ণ পরমহংসের কাছে এক সাধু এসে বললেন, আমি কুড়ি বছর সাধনা করে একটা বিদ্যা পেয়েছি।

পরমহংস বললেন, কী বিদ্যা?

আমি এখন জলের উপর দিয়ে হেঁটে নদী পার হতে পারি।।

পরম হংস বললেন, এক আনা পয়সা দিলে মাঝি নৌকায় করে পার করে দেয়, এর জন্যে তুমি বিশটা বছর নষ্ট করলে?

মুনশি হো হো করে হেসে উঠল। গল্পটার ভেতর যে সূক্ষ্ম রস আছে তা সে ধরতে পারবে বলে আমি মনে করি নি।

আমার কাছে নলিনী বাবু B.Sc. উপন্যাসের একটা কপি ছিল। তাকে বইটা দিলাম। সে অত্যন্ত আগ্রহে হাত পেতে বইটা নিল যেন সাত রাজার ধন তাকে দেওয়া হয়েছে। তার এই বিনয়ও ভালো লাগল।

খাওয়ার ডাক এসেছে। আমি বললাম, চলুন খেতে যাই।

মুনশি বলল, জনাব গোস্তাকি মাফ হয়। আমি মাছ-মাংস খাই না। একবেলা আহার করি।

আপনি একাহারি?

জি জনাব। মাছ-মাংস খেলে শরীর ফুলে যায়। জ্বালাযন্ত্রণা হয়।

ম্যাজিক মুনশি চলে গেল।

সকাল আটটা।

ডিজেল পাওয়া গেছে। লঞ্চ ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এই বিশেষ ঘটনা দেখার জন্যে অঞ্চলের সকল শিশুকিশোর জড়ো হয়েছে। টাইটানিক প্রথম যাত্রা করার সময়ও তীরে এত মানুষ ছিল না।

মুনশি আমাকে বিদায় দিতে এসে বললেন, স্যার কাল রাতেই আপনার বইটা পড়ে শেষ করেছি। বইয়ের ঘটনা কি সত্যি?

আমি বললাম, আপনি যেমন কিছু কিছু প্রশ্নের উত্তর দেন না, আমিও দেই। এই প্রশ্নের উত্তর আমি দেব না।

জনাব, কোনো অসুবিধা নাই। আপনি আমার কাছে কিছু আতর চেয়েছিলেন। এই আতর আপনার স্ত্রীর কাছে আছে বলে দিলাম না।

আমার স্ত্রীর কাছে এই আতর আছে?

মুনশি উঁ-সূচক মাথা নাড়ল। কোনো কথা বলল না।

ঢাকায় এসে শাওনকে প্রথম যে প্রশ্ন করলাম, তোমার কাছে কি কোনো আতর আছে?

শাওন বিস্মিত হয়ে বলল, আমার কাছে আতর থাকবে কেন? আতর পুরুষদের ব্যাপার, মেয়েদের না।

আমি বললাম, চা-পাতার গন্ধ আছে এমন কোনো আতর?

শাওন বলল, আমার কাছে একটা পারফিউম আছে, নাম Elizabeth Arden, যার অবিকল চায়ের গন্ধ। এটার কথা বলছ?

হুঁ।

কী করবে?

কিছু করব না। কিছুক্ষণ গায়ে মেখে বসে থাকব।

ঢাকা শহর অদ্ভুত এক শহর। এই শহর তার বাসিন্দাদের গিলে পেটের ভেতর রেখে দেয়। বাসিন্দারা কিছুদিন বাইরে থেকে ফিরে আসামাত্র শহর তাদের নিজের মধ্যে টেনে নেয়, বাইরের স্মৃতি ভুলিয়ে দেয়।

ম্যাজিক মুনশির ব্যাপারটা আমি প্রায় ভুলেই গেলাম। ঢাকা শহরে এসে মুনশিকে আমার আর তেমন রহস্যময় মনে হলো না। তাকে নিয়ে আলাদা করে চিন্তাভাবনা করাও হয়ে উঠল না। আমি নানান ব্যস্ততায় জড়িয়ে গেলাম। ঘেটুপুত্র কমলা ছবির গান রেকর্ড করা, সেট বানানো, হাজারো সমস্যা।

তার চেয়েও বড় সমস্যা অর্থনৈতিক। যাঁরা এই ছবিতে অর্থলগ্নির কথা বলেছিলেন তাঁরা গা ঢাকা দিলেন! টেলিফোন করলে টেলিফোন ধরেন না। তাদের একজন (দেশ টিভির আসাদুজ্জামান নূর, নেতা এবং অভিনেতা) জার্মানি গিয়ে বসে রইলেন। মনে হয় আমার ভয়েই পালিয়ে যাওয়া।

এমন অবস্থায় তারানগরের ম্যাজিক মুনশি মাথায় থাকে না। থাকার কথাও। এই সময় মুনশি সাহেবের চিঠি পেলাম। চিঠি পেয়ে শুরুতে চমকালাম, কারণ আমি তাকে ঠিকানা দিয়ে আসি নি। চমকানো স্থায়ী হলো না। তাকে যে উপন্যাসটি দিয়ে এসেছিলাম সেই উপন্যাসের প্রকাশকের ঠিকানায় চিঠি এসেছে। মুনশি সাহেব কোনো আধ্যাত্মিক উপায়ে ঠিকানা বের করেন নি।

তিনি লিখেছেন–

শ্রদ্ধেয় স্যার হুমায়ূন আহমেদ সাহেব।।

আসসালামু আলায়কুম। জনাব, একটি বিষয় জানার জন্য আপনাকে পত্র লিখিয়াছি। আপনি আমাকে যে বইটি দিয়াছেন তা দ্বিতীয়বার পাঠ করিয়াছি। বইটির ঘটনা কতটুকু সত্য তা জানা আমার জন্য বিশেষ জরুরি।

আমার শরীর খুব খারাপ। এখন কিছুই খাইতে পারি। মসজিদের ইমামতি ছাড়িয়া দিয়াছি। এখন প্রায় চব্বিশ ঘণ্টাই বিছানায় থাকি।

জনাব, বইটির ঘটনা সত্য কি না আপনি আমাকে অবশ্যই জানাইবেন। বিনিময়ে আপনাকে আমি অতি গোপন অতি রহস্যময় বিষয় জানাই। ইহা মৃত্যুপথযাত্রীর ওয়াদা।

সালাম।
ইতি মুনশি রইসুদ্দিন

ম্যাজিক মুনশির নাম যে রইসুদ্দিন তা প্রথম জানলাম। তাকে সেদিনই চিঠি পাঠালাম। চিঠিতে লিখলাম—

মুনশি রইসুদ্দিন

প্রিয়জনেষু,

ভাই আপনার চিঠি পেয়েছি। আপনি অসুস্থ্য, কিছু খেতে পারছেন না জেনে খুব খারাপ লাগছে। আপনি চিঠি পাওয়া মাত্র ঢাকা আসার ব্যবস্থা করবেন। আপনার চিকিৎসার সমস্ত ব্যবস্থা আমি করব।

নলিনী বাবু B.Sc, বইটি সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন। বইটির গল্প বানানো। লেখকরা বিশ্বাসযোগাভাবে মিথ্যা গল্প লেখেন। তবে এই উপন্যাসে আমি যে প্যারালাল জগতের কথা লিখেছি বিজ্ঞান তা স্বীকার করে।।

আপনার শরীরের যে অবস্থা লিখেছেন তাতে আপনার পক্ষে একা ঢাকায় আসা সম্ভব হবে না বলেই মনে হচ্ছে।

আমি আমার প্রতিষ্ঠান থেকে একজনকে পাঠাচ্ছি। সে আপনাকে সঙ্গে করে নিয়ে আসবে। আপনি ভালো থাকবেন।

ইতি

হুমায়ূন আহমেদ

আমি নুহাশ চলচ্চিত্রের দুজন স্টাফকে আমার চিঠি সঙ্গে দিয়ে পাঠিয়ে দিলাম।

তারা মহা উৎসাহে রওনা হলো।

অনেক দিন পর মুনশি বিষয়ে আমি নিজেও উৎসাহী হলাম। বিশেষ কিছু ক্ষমতা তার অবশ্যই আছে। এই ক্ষমতার উৎস কী?

তিনি যা দেখাচ্ছেন তা হলো আসল ম্যাজিক। এই ম্যাজিক অন্যভুবনের বাসিন্দাদের সাহায্যে করা হয়। পৃথিবীর কোনো ম্যাজিশিয়ানই তা স্বীকার করবেন না। বিজ্ঞান তো কখনোই না।

আমরা কিন্তু শৈশব থেকেই ব্ল্যাক ম্যাজিকের ভেতর বাস করি। শিশুর প্রথম যখন দাঁত পড়ে এই দাঁত ফেলা হয় ইঁদুরের গর্তে, যেন তার ইঁদুরের মতো দাঁত হয়। এখান থেকেই ম্যাজিকের শুরু। নজর কাটানোর জন্যে শিশুর মাথায় কালো টিপ দেওয়া হয়। এটাও ম্যাজিক।

আমাদের সমাজে কিছু মানুষ বাস করেন, যাদের নজর নাকি খারাপ। তারা কোনো কিছুকে ভালো বললে সেই ভালোর দফারফা। নজরলাগা এই ব্যক্তিরা তাদের ক্ষমতা নিয়ে বিব্রত থাকেন না, বরং অহঙ্কারের মতো ভাব তাদের মধ্যে থাকে।

মানুষের নজরের পরে আসে জ্বিন-পরীর নজর। মানুষের নজর কাটান দেওয়া যায়। জ্বিন-পরীরটা যায় না। তখন তাবিজ কবচ দোয়ার আশ্রয় নিতে হয়। সেই মন্ত্রতন্ত্রের কাছে ফিরে যাওয়া।

মুসলমানরা চিঠির শুরুতে ৭৮৬ লিখেন। এর অর্থ বিসমিল্লাহের রহমানের রাহিম। এটা কি এক ধরনের গুপ্ত ম্যাজিক না? ৭৮৬ কেন বিসমিল্লাহের রহমানের রাহিম এর প্রতীক হলো তা জানার চেষ্টা করেছি। যা জেনেছি তা হলো আরবিতে প্রতিটি অক্ষরের সংখ্যামান আছে। বিসমিল্লাহের রহমানের রাহিম উনিশটি অক্ষর আছে। উনিশটি অক্ষরের যোগফল হয় ৭৮৬।

আরবি হরফের সংখ্যামান নিচে দেওয়া হলো–

আরবি হরফের সংখ্যামান

৬৬৬ আরেকটি ম্যাজিক নাম্বার। বাইবেলে (Revelation, ১৩:১৮) এই সংখ্যাকে বলা হয়েছে পশুদের সংখ্যা। বাইবেলের এই পশু উভলিঙ্গ। পশুটি এমন যে তাকে দেখলে মনে হয় সে সর্বক্ষণ নিজে নিজেই যৌনকর্ম করে যাচ্ছে (পশুটির নিতম্ব দুদিকে)। চার্চ পুরোহিতরা এই সংখ্যাটির সঙ্গে যৌনতা সম্পর্কিত বলে নীতিবর্জিত ঘোষণা করেছেন।

৬৬৬ সংখ্যাটিকে ব্যাপক পরিচিতি যিনি দেন তার নাম Aleister Crowly. তিনি নিজেকে একজন মহান পশু (The great beast) পরিচয় দিতেন। তাঁর সীলমোহরে ৬৬৬ সংখ্যাটি ছিল। তিনি গুপ্ত ম্যাজিকের একটি দল গঠন করেন। তাঁর সংগঠনের নাম ছিল Order of the Golden dawn. তার সময়ের (১৮৬৫-১৯৩৯) অনেক বিখ্যাত মানুষ এই গুপ্ত ম্যাজিক দলের সদস্য ছিলেন। একজনের নাম শুনলে পাঠক চমকাবেন। তিনি কবি W. B. Yeats.

পৃথিবীর সেরা গণিতবিদদের একজন ছিলেন পিথাগোরাস। তিনি জাদুবিদ্যায় বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁর সবচেয়ে বড় বিশ্বাস ছিল সংখ্যার জাদুতে। তার একদল অনুসারী ছিল। তারা সবাই গোপনে সংখ্যার জাদুর চর্চা করতেন। তারা তাদের জ্ঞান প্রকাশ করতেন না। পিথাগোরাস মনে করতেন মহাবিশ্বের সবকিছুর মূলে আছে সংখ্যা। তাঁর মতে সংখ্যারও নারী-পুরুষ আছে। জোড় সংখ্যা পুরুষ। বিজোড় সংখ্যা হলো নারী। তিনি মনে করতেন গ্রহরা যখন সূর্যের চারদিকে ঘুরে তখন মহান সঙ্গীত তৈরি হয়। এই সঙ্গীত সংখ্যা দিয়ে প্রকাশ করা সম্ভব।

সংখ্যার শুভ-অশুভ নিয়েও পিথাগোরাস এবং তার দলের চিন্তাভাবনা ছিল। তাঁদের মতে, সাত একটি শুভ সংখ্যা।

ধর্মীয়ভাবে সাত সংখ্যাটিকে শুভ ভাবা হয়। কারণ রঙ হলো সাতটি। মানুষের মাথার ছিদ্র সাতটি (দুই কান, দুই নাক, দুই চোখ এবং মুখ)। সুর সাতটি।

মধ্যযুগে সংখ্যার ম্যাজিকের চর্চা আরও প্রবলভাবে হতে লাগল। তখন আবিষ্কার হলো Cabala of the nine chambers. নয়টি কক্ষের প্রতিটিতে থাকত রহস্যময় সংখ্যা। যেমন—

এই নয় কক্ষের মধ্যমণি পাঁচ। উপরে, নিচে, কোনাকুনিভাবে সংখ্যাগুলির যোগফল সবসময় হবে ১৫।* (* সূত্র : মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকা। গণিত সংখ্যা।)

এই স্কয়ারের আরেকটি নাম হলো ম্যাজিক স্কয়ার। কৃষ্ণশক্তির আরাধনায় এই ধরনের স্কয়ার ব্যবহার করা হতো।

বাংলাদেশের মুসলমানদের বহুলপঠিত গ্রন্থের একটির নাম নেয়ামুল কোরআন। সেখানে অনেক তাবিজ দেওয়া আছে। একটি তাবিজ উদ্ধৃত করছি।

জ্বিন ভূত তাড়াবার তাবিজ

বদনজর, জ্বিন-ভূতের আছর এবং জাদুর আছর দূর করতে হলে এই তাবিজটি লিখে গলায় ঝুলিয়ে দিতে হবে।

পাঠক লক্ষ্য করে দেখুন, এটিও একটি স্কয়ার। (ম্যাজিক স্কয়ার কি?) এই তাবিজে নয়টি কলাম এবং নয়টি সমান্তরাল লাইন আছে। বর্গের সর্বমোট সংখ্যা ৮১, এর যোগফল আবার ৯ (৮+১=৯)।

বিজ্ঞানের কঠিন ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে ব্লাক ম্যাজিক এবং কালো বিপরীত শক্তির উপর মানুষের বিশ্বাস কিন্তু এখনো টিকে আছ। সারা পৃথিবীতে মুক্তবুদ্ধির মানুষ হিসেবে পরিচিত জ্ঞানীরাও এই অন্ধবিশ্বাসের বাইরে যেতে পারেন নি। আধুনিক কোয়ান্টামবিদ্যার জনক নোবেল পুরস্কার বিজয়ী নেইলস বোরের বাড়ির দরজায় আটকানো থাকত একটি ঘোড়ার খুর চুম্বক (Horse shoe magnet)। বিশ্বাস করা হয় এই চুম্বক সৌভাগ্য নিয়ে আসে। নেইলস ববারের এক সহকর্মী জিজ্ঞেস করলেন, আপনার মতো বিজ্ঞানী এইসব বিশ্বাস করেন?

নেইলস বোর বললেন, বিশ্বাস করি না, তবে সৌভাগ্য তো বিশ্বাস না করলেও আসতে পারে।

আরব ঐতিহাসিক আবু সাকের-এর লেখা ইতিহাস থেকে জানতে পারি, অ্যারিস্টটল মহাবীর আলেকজান্ডারকে কালো রঙের বাক্সে কয়েকটি মোমের তৈরি পুতুল উপহার দিয়েছিলেন। আলেকজান্ডারকে তিনি বললেন, এই পুতুলগুলি মন্ত্রপূত। তুমি কখনো পুতুলগুলি হাতছাড়া করবে না। হাতছাড়া করলেই মহা বিপদ।

অর্ধেক পৃথিবী জয়ের পর আলেকজান্ডার পুতুলের বাক্স হারিয়ে ফেললেন। তখন তার বয়স মাত্র ৩৩, সেই বয়সেই তার মৃত্যু হলো।

কালো ম্যাজিকে অতি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো সুগন্ধি। সুগন্ধি মানুষের মন পরিষ্কার করে। মন্দিরে ধূপ পোড়ানো হয়, আমরা আগরবাতি জ্বালাই।

ব্ল্যাক ম্যাজিকে নানান ধরনের সুগন্ধি গায়ে মেখে নিতে হয়। ইজিপ্টের গুপ্ত মাজিকে মৃতদের উদ্দেশে যা পাঠ করা হয় তার ইংরেজি অনুবাদ

The perfume of Arabia hath been brought to thee, To make perfect thy srnell through the scent of the God. Here are brought to thee, liquids which have come from Arabia to make perfect thy smell in the Halt.

কাছাকাছি বঙ্গানুবাদ—

আরব থেকে তোমার জন্যে সুগন্ধি আনা হয়েছে। তোমার ঘ্রাণ ত্রুটিহীন করে ঈশ্বরের ঘ্রাণের সঙ্গে যুক্ত করার উদ্দেশ্যে,..

তথা : Mysteries and Secrets of Magic, C.G.S, Thomson. প্রথম প্রকাশ ১৯২৭, বর্তমান মুদ্রণ ১৯৯৫, প্রকাশক Random House, UK.

আমার প্রশ্ন হচ্ছে, আরব থেকে যে সুগন্ধি আনা হয়েছে তা কি জয়তুন বৃক্ষের তেল থেকে তৈরি? ম্যাজিক মুনশির আতরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত?

রাতে ঘুমুতে গেছি, শাওন বলল, তোমার গা থেকে চা-পাতার কড়া গন্ধ আসছে। তুমি কি আবার আমার সেন্ট মেখেছ?

আমি বললাম, হুঁ।

শাওন বলল, তুমি দয়া করে মাথা থেকে ম্যাজিক মুনশি দূর করো। তুমি আধুনিক মানুষ, তোমার চিন্তাভাবনা হবে আধুনিক।

আমি বললাম, আমার চিন্তাভাবনা যথেষ্টই আধুনিক।

শাওন বলল, মোটেই না। তোমার মাথার কাছে টেলিভর্তি ব্ল্যাক ম্যাজিকের বই। প্রায়ই দেখছি তুমি বিড়বিড় করে কী যেন পড়ছ। কী পড়ছ?

আমি বললাম, মন্ত্র।

কিসের মন্ত্র?

বনসি নামানোর মন্ত্র।

বনলি কী?

এক ধরনের মহিলা ভূত। মন্ত্রটা শুনবে?

না।

আরে শোনো না,

It was the Banshees lonely wailing,
well I knew the voice of death,
In the night wind slowly sailing
over the bleak and gloomy heath.

শীওন বলল, তোমার এই মহিলা ভূতের চেহারা কেমন?

আমি বললাম, সে অতি রূপবতী। আমার উপন্যাসের নায়িকাদের চেয়েও তার রূপ বেশি।

মন্ত্র পাঠ করলে সে এখানে উদয় হবে?

হুঁ। শুধু যে উদয় হবে তা-না। পারিবারিকভাবেও সে আমাদের সঙ্গে যুক্ত হবে।

তার মানে?

আইরিশরা বিশ্বাস করে, তাদের প্রতিটি পরিবারের সঙ্গে একজন বনসি ভূত নারী যুক্ত। সে বিপদে আপদে দেখা দিয়ে সবাইকে সতর্ক করে।

শাওন বলল, তার মাঝে মাঝে উদয় হওয়ার দরকার কী? সে সারাক্ষণই উদয় হয়ে থাকুক। তুমি তাকে বিয়ে করে ফেল। তোমার একজন ভূতপত্নী থাকুক।

আমি বললাম, ওকে গ্রান্টেড।

শাওন বলল, আমার ঘরে দয়া করে বিড়বিড় করবে না। অন্য ঘরে যাও। ভূতনি দর্শন দিলে আমার কাছে নিয়ে এসো। আর দয়া করে মাথার কাছ থেকে ভূতপ্রেতের বই সরাও।

আমি বললাম, ম্যাজিক মুনশি ঢাকায় পৌছানোর আগ পর্যন্ত আমি বইগুলি পড়ব। সে এসে পৌছালেই পড়া শেষ।

পাঠকদের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি, বনসি ভূত নামানোর যে মন্ত্র আমি লিখেছি তা মন্ত্র না। বনসিদের নিয়ে লেখা প্রাচীন আইরিশ Ballad. এই ব্যালাড় মন্ত্রের মতো পড়লে কোনো কাজ হওয়ার কথা না।

কৃষ্ণশক্তির সাধনা ভারতবর্ষের সাধনার একটি ধারা। এই সাধনা যারা করেন তাদের বেশির ভাগ কালী সাধক। তাদের আরেক নাম তান্ত্রিক। তন্ত্রের (মন্ত্রের সাহায্যে সাধনী। এই সাধনায় সাধকরা কারণ বারি (দেশি মদ পান করেন। ভাংজাতীয় নেশার দ্রব্য গ্রহণ করেন। সিদ্ধিলাভের জন্যে একটা পর্যায়ে তাদেরকে শব সাধনা করতে হয়। শব সাধনা হচ্ছে নগ্ন মৃতদেহের বুকের উপর বসে (অল্পবয়েসী তরুণীর মৃতদেহ হতে হবে। মন্ত্র পাঠ। একটি পর্যায়ে মৃতদেহের মুখ থেকে নানান উপদেশ আসতে থাকবে। উপদেশমতো কাজ করতে হবে।

তান্ত্রিকরা কঠিন সাধনা করে শরীরের ভেতরে সুপ্ত সাত শক্তিচক্রকে উজ্জীবিত করেন। তাদের প্রধান চেষ্টা থাকে কুণ্ডলিনি জাগ্রত করা। কুণ্ডলিনি সাপের মতো। শরীরের সর্বনিম্ন চক্রে তার অবস্থান। কুণ্ডুলিনি জাগ্রত করার অর্থ হলো পৃথিবীর সর্বশক্তির কর্তৃত্ব নেওয়া।

বলতে ভুলে গেছি, সাধনার এক পর্যায়ে মৃত তরুণীর সঙ্গে যৌনাচারে লিপ্ত হতে হয়। নরবলি (শিশু) এই ধরনের সাধনার অংশ।

মহান ঔপন্যাসিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের তারানাথ তান্ত্রিনে তে এই সাধনার বিশদ বর্ণনা আছে।

আমি S.S.C পাস করি বগুড়া জেলা স্কুল থেকে (১৯৬৫)। সেই সময় চক্রের সাহায্যে প্রেত নামানোর একটা বই বাবার লাইব্রেরিতে খুঁজে পাই। বইয়ে পরকালের মানুষ এবং জীবজন্তুর সাক্ষাৎ পাওয়ার বেশ কিছু পদ্ধতি লেখা।

একটি পদ্ধতিতে বিজোড়সংখ্যক নারী-পুরুষকে হাতে হাত রেখে চক্র বানিয়ে কোনো এক নির্জন স্থানে বসতে হয়। একমনে পরকাল এবং সেখানকার অধিবাসীদের বিষয়ে চিন্তা করতে হয়। মাঝে মাঝে জিকিরের মতো (chanting) বলতে হয়, আয়রে! আয়রে!

পঠিত বিদ্যা কাজে লাগানোর জন্যে আমরা কয়েক বন্ধু মিলে ঠিক করি চক্রে বসা হবে। করতোয়া নদীর পাশে শ্মশানঘাট। শ্মশানঘাটে শ্মশানবন্ধুদের জন্যে বানানো একটা পাকা ঘর আছে। আমরা এক সন্ধ্যায় শশানঘাটে উপস্থিত হয়ে চক্রে বসি। আমার বন্ধুদের মধ্যে দুজনের নাম মনে আছে। একজন খালেকুজ্জামান ইলিয়াস। বর্তমানে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রধান। খালেকুজ্জামান নন্দিত কথাশিল্পী আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ছোট ভাই।

আমার আরেক বন্ধুর নাম চিশতি হেলালুর রহমান। সে ছিল ছাত্রলীগের নিবেদিত কর্মী। ১৯৭১ সালে পাকবাহিনী তাকে ইকবাল হলে হত্যা করে।

মূল ঘটনায় ফিরে যাই। আমাদের চক্র ছিল অসম্পূর্ণ। চক্রে মেয়েদের উপস্থিতি অতি আবশ্যকীয়। সুগন্ধি লাগবে। আমাদের মধ্যে দুটাই ছিল অনুপস্থিত। আসলে আমরা একত্রিত হয়েছিলাম ভূত ভূত খেলা করে মজা পাওয়ার জন্যে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘটনা অন্যরকম হয়ে গেল। চিশতির মুখ থেকে জন্তুর শব্দ বের হতে লাগল। শ্মশানঘর তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধে ভরে গেল (এখন মনে হচ্ছে Ammonia-র গন্ধ)। চিশতির শরীর কাঁপছে এবং সে কিছুক্ষণ পরপর বলছে, আমার সামনে এটা কী? আমার সামনে এটা কী?

একসময় সে অচেতন হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। বন্ধুদের বেশির ভাগ এইসময় দৌড়ে পালিয়ে গেল। আমি পালাতে পারছি না, কারণ সবকিছুর মূলে আমি। আমার অসহায় মুখ দেখে খালেকুজ্জামানও পালাল না। আমরা দুজন অনেক কষ্টে চিশতিকে টেনে টেনে করতোয়া নদীর পাশে নিয়ে আসি। তার চোখেমুখে পানি দিয়ে জ্ঞান ফেরাই। জ্ঞান ফেরার পর চিশতি বলে, ভয়ঙ্কর একটা মানুষের মতো প্রাণী দেখে সে জ্ঞান হারিয়েছে। এই প্রাণীটা তার সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছিল?

আমি এবং খালেকুজ্জামান ভয়ে অস্থির হয়ে গেলাম। চিশতির অসীম সাহস। সে আমাদের দুজনকেই বাসায় পৌঁছে দিয়ে নিজে একা ফিরে গেল শ্মশানঘাটে। অদ্ভুত প্রাণীটার সঙ্গে সে কথা বলবে।

ঐ রাতের ঘটনার পর থেকে চিশতির মনোজগতে একটা স্থায়ী পরিবর্তন হয়ে গেল। সে প্রায়ই একা শ্মশানঘাটে বসে থাকত। সে আমাকে বলেছে প্রাণীটার সঙ্গে তার কথা হয়েছিল। কী কথা হয়েছিল তা আমাকে বলে নি।

আমার পর চক্র নিয়ে উৎসাহিত হলো আমার ছোটভাই জাফর ইকবাল (লেখক, বিজ্ঞানী এবং আরও অনেক কিছু)। সে থাকে ফজলুল হক হলে। পড়ে Physics. প্রায়ই শুনি সে বন্ধুদের সঙ্গে চক্রে বসছে। ভূত-প্রেত নামাচ্ছে। এক রাতে ঘটনা তাদের হাতছাড়া হয়ে গেল। (কী হয়েছিল পরিষ্কার না) তারা বাধ্য হলো হলের মাওলানা সাহেবকে ডেকে আনতে। মাওলানা তাদের ঘরে পা দিয়েই আঁতকে উঠে বললেন, কী সর্বনাশ! আপনারা তো জ্বিন নামিয়ে ফেলেছেন! কীভাবে নামালেন?

জাফর ইকবাল তার বই রঙিন চশমা-তে ঘটনাটির বিশদ বর্ণনা দিয়েছে।

এখন আমি বিশেষ এক চক্রের পূর্ণ বিবরণ দিচ্ছি, তবে কেউ যেন এই ঝামেলায় না জড়ান তার জন্যে বিশেষভাবে অনুরোধ করছি। ভূত-প্রেত নামুক বা না-নামুক, এই পদ্ধতি এক ধরনের হিপনোটিক অবস্থার সৃষ্টি করবে। দৃষ্টিভ্রান্তি (Halliocination) ঘটার সমূহ সম্ভাবনা।

প্রস্তুতি

১. নয়জন সমবয়সী মানুষ একত্রিত হবেন (নয় সংখ্যাটি গুরুত্বপূর্ণ।

২. পাঁচজন ছেলে এবং চারজন মেয়ে।

৩. সবাইকে স্নান করে পরিষ্কার কাপড় পরতে হবে। শরীরে সুগন্ধি দেবেন। গলায় মিষ্টি গন্ধের ফুলের (বেলী, গন্ধরাজ, কামিনি) মালা পরবেন।

৪. পরিষ্কার করা (কয়েকবার ন্যাকড়া দিয়ে মোছা) একটি ঘরে সবাই একত্রিত হবেন। কর্মকাণ্ড শুরু হবে মধ্যরাতের পর যখন চারদিক নীরব হয়ে আসবে।

৫. ঘরের চার মাথায় চারটা মোমবাতি জ্বালাবেন।

৬. দরজা জানালা বন্ধ করে দিতে হবে যাতে বাতাসে মোমবাতি নিভে না যায়।

৭. ঘরের বাইরে উৎসুক কোনো দর্শক থাকতে পারবে না।

৮. মহিলা সদস্যরা চুড়ি পরবেন না। চুড়ির টুং টাং শব্দে সমস্যা হবে।

৯. সবাই থাকবেন খালি পায়ে।

১০. ভরাপেটে চক্র করা যাবে না। সামান্য খাদ্য গ্রহণ করা যেতে পারে। ফলমূল দুধ। এর বেশি কিছু না।

পদ্ধতি

১. একজন ছেলে একজন মেয়ে—এইভাবে সবাই গোল হয়ে দাঁড়াবেন।

২. সবাই পাশের জনের হাত ধরে চক্র বানাবেন। চক্র কোনো অবস্থাতেই ভঙ্গ করা যাবে না, অর্থাৎ হাত ছাড়া যাবে না।

৩. এখন নাচের ভঙ্গিতে সবাই কেন্দ্রের দিকে আসবেন এবং আগের জায়গায় ফিরে যাবেন। এরকম চলতে থাকবে যতক্ষণ না সবাই খানিকটা ক্লান্ত এবং অবসন্ন। পনের বা কুড়ি মিনিট। এই সময় কেউ কোনো কথা বলবেন না। ফিসফিস করেও না।

৪. এখন মূল অংশ। চক্র বড় করে ঘুরতে শুরু করবেন। chanting (জিকির) শুরু হবে। ক্ষীণ কিন্তু স্পষ্ট স্বরে বলতে হবে, আয় আয় আয়। যখন ছেলেরা বলবে তখন মেয়েরা চুপ করে থাকবে। যখন মেয়েরা বলবে তখন ছেলেরা চুপ করে থাকবে। ঘূর্ণনপ্রক্রিয়া (নাচের ভঙ্গিতে) চলতেই থাকবে।

এইসময় একটা দুটা মোমবাতি বা সবকটি মোমবাতি নিভে যেতে পারে, আবার নাও নিভতে পারে।

চক্র সফল হলে চক্রের মাঝখানে অলৌকিক উপস্থিতি লক্ষ করা যাবে। তাকে প্রশ্ন করলে সে উত্তর দেবে।

যারা চক্র করছে তাদের কেউ গাঢ় আবেশে অজ্ঞান হয়ে পড়লে চক্র বন্ধ করে দিতে হবে। জ্ঞান ফেরানোর জন্যে চোখেমুখে পানির ছিটা দেওয়া যেতে পারে বা স্মেলিং সল্টের গন্ধ শোকানো যেতে পারে।

কৃষ্ণশক্তির আরাধনা বা পরলোকের অনুসন্ধানে নৃত্য একটি বিশেষ অনুসঙ্গ। কেন এরকম তা জানি না। মৌলানা জালালুদ্দিন রুমি সুফিসাধনার সূত্রপাত করেন। এই সাধনায় ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতের বাইরের জগতের অনুসন্ধান করা হয়।

সুফিসাধকরা শুরুতে তাদের ডানহাত যেখানে পণ্ড তার উপর রাখেন। ডানহাতের উপর ক্রশ করে বাঁ হাত রাখা হয়। তারা সবাই দাঁড়ান বা পায়ের গোড়ালিতে ভর দিয়ে। একসময় ঘুরতে শুরু করেন। পৃথিবী যেমন তার অক্ষের উপর ঘুরে সেরকম ঘূর্ণন। তারা এইসময় জিকির শুরু করেন (আল্লাহু)। বেশকিছু সময় ঘূর্ণনের পর সমবেত নাচ শুরু হয়। তারা প্রবেশ করেন তাদের দাবি) অন্য এক অপার্থিব ভুবনে।

ক্রিশানদের মধ্যেও একসময় এই ধরনের নাচের প্রচলন ছিল। St. Jhon তার বর্ণনা দিয়েছেন। নাচের সময় সুর করে বলা হতো–

And we all circled round him and responded to him; Amen. The twelfth of the numbers pales the round aloft; Amen to each and all it is given to dance, Amen.* (*The Mystic Sprial; Jilt Pruce. Thames and Hudon.)

ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা পবিত্র কাবা শরীফের চারদিকে ঘুরেন। আরবিতে এই ঘূর্ণনকে বলে tafa. এর অর্থ to attain the summit of a thing by spiraling round it.

অনেক বকবক করে ফেলেছি। নিজের বকবকানিতে আমি নিজেই মুগ্ধ। এখন চুপ করা যাক। নীরবতা হিরন্ময়।

ম্যাজিক মুনশিকে ঢাকায় নিয়ে আসতে ছয়-সাত দিনের বেশি লাগার কোনো কারণ নেই। পনের দিন পার হয়ে গেল, আমার দুই কর্মচারীর কোনোই খোঁজ নেই। তারা সুনামগঞ্জ থেকে ইঞ্জিনের নৌকায় রওনা হয়েছে এই খবর পাওয়া গেল। কোন নৌকায় গিয়েছে নৌকার মাঝি ফিরেছে কি না তা জানা গেল না।

নৌকাডুবি হয়ে তারা মারা গেছে তাও মনে হচ্ছে না। মারা গেলে খবর পাওয়া যেত। এর মধ্যে খবর রটে গেছে আমি দুই কর্মচারীকে সেন্টমার্টিন আইল্যান্ডে পাঠিয়েছিলাম, পথে সমুদ্রে ডুবে এরা মারা গেছে।

এর মধ্যে শাওন স্বপ্নে দেখল, নুহাশপল্লীর দিঘিতে দুটা লাশ উপুড় হয়ে ভাসছে। তাদের মুখ দেখা যাচ্ছে না। গায়ের কাপড় দেখে মনে হচ্ছে এরা আমার দুই নিখোঁজ কর্মচারী।

তাদের দুজনের নামে দুটা মুরগি ছদগা দেওয়া হলো (এটাও কিন্তু ম্যাজিক)।

কুড়ি দিনের মাথায় আমি ধানমণ্ডি থানার ওসি কামরুলের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। কামরুল আমার অনেক নাটকে ওসির ভূমিকায় অভিনয় করেছে।

কামরুল বলল, স্যার, এরা কি টাকাপয়সা নিয়ে পালিয়ে গেছে?

আমি বললাম, না। অযথা টাকা খরচ করার বিষয়ে তাদের অসাধারণ দক্ষতা আছে, কিন্তু টাকা নিয়ে পালানোর মানসিকতা নেই।

কামরুল বলল, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। সাত দিনের মধ্যে আমি পাত্তা লাগাব।

এক মাস পার হলো কোনো পাত্তা লাগানো গেল না। আমি থানায় জেনারেল ডায়েরি করালাম।

একমাস ছদিন পর তারা ফিরল। দুজনের চেহারাই কাকলাসের মতো। কাপড় মলিন। একজনের পায়ে জুতা স্যান্ডেল কিছুই নেই। সে খুঁড়িয়ে হাঁটছে। তারা নাকি ভুল করে ইন্ডিয়ান বর্ডারে চলে গিয়েছিল। ইন্ডিয়ান বর্ডার পুলিশের হাতে ধরা পড়ে ওদের জেলে এতদিন ছিল।

আমার চিঠি মুনশির হাতে তারা দিতে পারে নি। চিঠি আছে ইন্ডিয়ান বর্ডার পুলিশের কাছে। এই চিঠি দিয়েই তারা নাকি শেষ পর্যন্ত প্রমাণ করতে পেরেছে বিশেষ একজনকে খুঁজতে এসে ভুলে বর্ডার ক্রস করেছে।

মুনশির সঙ্গে আমার আর যোগাযোগ করা হয় নি। সর্পরাজ আরজুর কাছে জানলাম, এক ভরাপূর্ণিমায় মুনশির মৃতদেহ দিঘির জলে ভেসে উঠেছে। মুনশির বিছানায় উঠে বসা বা নড়াচড়ার কোনো সামর্থ্যই ছিল না। দিঘি পর্যন্তু সে কীভাবে গেল সেটাই তারানগরের বর্তমান আলোচ্য বিষয়।

রহস্যময় এই জগতের বিপুল রহস্যের অতি সামান্যই আমরা জানি। আমাদের উচিত এই সামান্য জ্ঞান নিয়েই তুষ্ট থাকা। বেশি জানতে না চাওয়া। Ignorence is bliss.

Pages: 1 2 3 4 5 6
Pages ( 6 of 6 ): « পূর্ববর্তী1 ... 45 6

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress