এখন কিছু করার নেই
সত্যি, এখন কিছু করার নেই। রাত্রে শুয়ে-শুয়ে ভাবছিল অর্জুন। বৃদ্ধ তারিণী সেনের ইচ্ছের ওপর সব কিছু নির্ভর করছে। তিনি যদি ওদের দিতে চান, তা হলে পুলিশ ব্যবস্থা নিতে পারে। মূর্তিসমেত ওদের ধরে ফেললে বিচারের ব্যবস্থা হতে পারে। কিন্তু যদি না দেন, তা হলে হাজার চাপ দিয়েও পুলিশ বৃদ্ধের কাছ থেকে খবর বের করতে পারবে না।
আজ রাত্রে তিব্বতি ভদ্রলোক ডরোথির কাছে সব শুনবে। ওরা মূর্তির জন্য এসেছে, তা ফাঁস হয়ে যাওয়ায় ওরা আরও সতর্ক হবে। ওরা নিশ্চয়ই জানে, পুলিশ ওদের কাছে মূর্তি পেলে ছাড়বে না। মূর্তি না পাওয়া পর্যন্ত ওদের কিছু করার ক্ষমতা পুলিশের নেই। এক্ষেত্রে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওরা মূর্তি নিয়ে সরে পড়তে চাইবে। এবং সেটা আজ রাত্রেই।
ময়নাগুড়ি থানা থেকে পুলিশ নিশ্চয়ই এর মধ্যে পূর্বর্দহে পৌঁছে গিয়েছে। পুলিশ থাকতে ওরা কী করে তারিণী সেনের কাছে পৌঁছবে? অর্জুন ভেবে পাচ্ছিল না। এই সময় মা ঘরে ঢুকলেন, কিরে ঘুমোসনি? সারাদিন কোথায় টো-টো করে ঘুরিস?
অর্জুন উঠে বসল, আচ্ছা মা, একটা ধাঁধা শোনো। কালোর মধ্যে লাল আর লালের মধ্যে কালো/ ভক্তিভরে তারে নমো করাই ভালো। মানে কিছু বুঝলে?
মা একটু ভাবলেন, এ কী রকম দেবতা রে?
দেবতা বলে মনে হচ্ছে?
হ্যাঁ। নমো করার কথা বলছে তো। নমো করা ভালো। তার মানে কেউ-কেউ নমো করে না তাই করতে বলছে।
কেউ-কেউ করে না, তাই করতে বলছে? অৰ্জুন লাফিয়ে উঠল। মাকে জড়িয়ে ধরে সে চেঁচাল, ইউরেকা! পেয়ে গেছি। আর তখনই টেলিফোন বাজল।
দৌড়ে গিয়ে রিসিভার তুলল অর্জুন, হ্যালো!
এত রাত্রে বিরক্ত করলাম। দুঃখিত। অবনীবাবুর গলা, একটা খারাপ খবর আছে।
বলুন।
তারিণী সেন হঠাৎ খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
আপনি কোথেকে খবর পেলেন?
এইমাত্র ময়নাগুড়ির পুলিশ জানাল। ওরা গ্রামে যাওয়ার পর ঘটনাটা ঘটে।
কোন হাসপাতালে আছেন?
সম্ভবত ময়নাগুড়ির হাসপাতালে।
খোঁজ নিন। হাসপাতালে যেন পাহারা থাকে।
আমি এস পি সাহেবকে বলেছি। উনিও ময়নাগুড়িকে নির্দেশ দিয়েছেন।
ভাল। অবনীবাবু, আমি এখনই বের হচ্ছি। আপনি যাবেন?
একটু দ্বিধা করলেন অবনীবাবু। তারপর বললেন, চলুন।
ময়নাগুড়ির হাসপাতালে ওরা যখন পৌঁছল, তখন রাত বারোটা। অবনীবাবুর জিপেই এসেছে অর্জুন। হাসপাতালে পৌঁছে ওরা অবাক! তারিণী সেনকে ওই হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নিয়ে আসা হয়নি। সঙ্গে সঙ্গে থানায় যাওয়া হল। ও সি ছিলেন না। একজন এস আই বললেন, সন্ধের পর যে দুজন পুলিশকে পূর্বহে পাঠানো হয়েছিল, তারাই ফিরে এসে খবর দিয়েছে ওঁর হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার কথা। সেই পুলিশ কনস্টেবলদের সঙ্গে কথা বলতে চাইল অর্জন। দুজনেই থানায় ছিলেন। প্রশ্নের জবাবে তাঁরা বললেন, হুচলুডাঙা থেকে পূর্বহে যাওয়ার পথে ওঁরা একটা গাড়ি দেখতে পান। কৌতূহলবশে গাড়িটি থামাতেই কয়েকজন মানুষ বলে ওঠে, পেশেন্ট আছে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। গাড়িতে একজন বৃদ্ধের পাশে মহিলাও ছিলেন। তারপর তাঁরা পূর্বদহে পৌঁছে শুনতে পান, তারিণী সেন বিকেলবেলায় হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। ডাক্তার তাঁকে ইঞ্জেকশন দেন। কিন্তু অবস্থা খারাপ হতে থাকে। এই সময় একটা গাড়ি হঠাৎই গ্রামে আসে। সেই গাড়িতে কবে ওঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
অর্জুন গম্ভীরমুখে বলল, দোষ মাল। গাড়িটা কি কালো অ্যাম্বাসাডার?
হ্যাঁ সার।
অর্জুন উঠে দাঁড়াল। অবনীবাবু জিজ্ঞেস করলেন, জলপাইগুড়ির হাসপাতালে খবর নেব?
নিন। কিন্তু লাভ হবে বলে মনে হয় না।
টেলিফোনে যোগাযোগ করা হল। থানার টেলিফোন বলে লাইন পেতে অপেক্ষা করতে হল না। জলপাইগুড়ির হাসপাতাল জানাল, তারিণী সেন নামের কোনও বৃদ্ধকে আজ বিকেলের পর ওখানে ভর্তি করা হয়নি। অর্জুন বলল, চটপট পূর্বদহে চলুন। দেরি করলে দুকূলই যাবে।
জিপে উঠতে-উঠতে অবনীবাবু জিজ্ঞেস করলেন, দুকূলই মানে?
তারিণী সেনের জীবন এবং মূর্তি।
পূর্বর্দহে তখন কোনও প্রাণী জেগে নেই। এমন কি গ্রামের কুকুরগুলোও গলা খুলছে না। অর্জুন সোজা ডাক্তারবাবুর দরজায় হাজির হল মন্দিরের সামনে গাড়ি রেখে। খানিকটা ডাকাডাকির পর ডাক্তারবাবু বেরিয়ে এলেন ঘুম-চোখে। অর্জুন অবনীবাবুর পরিচয় দিয়ে জিজ্ঞেস করল, আমি চলে যাওয়ার পর তারিণীবাবুর কী হয়েছিল?
উত্তেজনা। আর তা থেকে বুকে ব্যথা শুরু হয়ে গিয়েছিল। হার্ট অ্যাটাক বলব না, তবে যে কোনও মুহূর্তে হতে পারত। হয়নি যে তা বলব না, কারণ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর আমি কোনও খবর পাইনি। ভদ্রলোক ধাতস্থ হচ্ছিলেন।
আপনি ইঞ্জেকশন দিয়েছিলেন?
হ্যাঁ।
যারা ওঁকে হাসপাতালে নিয়ে গেল তাদের আপনি চিনতেন?
ওই যারা সকালে এসে টাকা দিয়ে গিয়েছিল, তারাই ফিরে এসেছিল।
আপনি জানতেন ওরা কী উদ্দেশ্যে আসা-যাওয়া করছে। জানতেন না?
ডাক্তার বললেন, দেখুন মশাই, আমি চাইব পেশেন্টের প্রাণ বাঁচুক। ওরা হাসপাতালে নিয়ে যেতে চাইল, তখন দ্বিতীয় কোনও উপায় নেই এই গ্রাম থেকে বৃদ্ধ মানুষটাকে নিয়ে যাওয়ার, মনে হয়েছিল ভগবানই ওদের পাঠিয়েছেন। তা ছাড়া আমি তারিণীবাবুর গার্জেন নই যে, ঠিক করব কার সঙ্গে যাবে বা না যাবে। মৃত্যুপথযাত্রীর কোনও পছন্দ থাকে না।
ওঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়নি।
সে কী!
অন্তত ময়নাগুড়ি বা জলপাইগুড়ির হাসপাতালে ওরা যায়নি। দ্রুত চিকিৎসার জন্যে এ-দুটো জায়গায় নিয়ে যাওয়া স্বাভাবিক ছিল। সঙ্গে কে গেছেন?
ওঁর দ্বিতীয় স্ত্রী।
প্রথমজন কোথায়?
বোধ হয় বাড়িতেই আছেন।
অর্জুন ওঁদের নিয়ে মন্দিরের সামনে এসে চারপাশে তাকাল। তারপর অবনীবাবুকে বলল, আপনি জিপটাকে এমনভাবে সরিয়ে রাখুন যাতে এখানে এসে কেউ দেখতে না পায়।
কেন?
যারা তারিণী সেনকে নিয়ে গেছে তাদের মনে হচ্ছে, আজই আবার এখানে আসতে হবে।
অবনীবাবু যখন জিপটাকে আড়ালে নিয়ে যাচ্ছিলেন তখন অর্জুন ডাক্তারবাবুকে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা, ওরা কেন ফিরে এসেছিল সে ব্যাপারে কিছু বলেছে?
হ্যাঁ। শিলিগুড়িতে ফিরে যাওয়ার আগে ওরা দেখে নিতে চায় উনি কেমন আছেন? আমরা তখন হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলাম। এখন… আচ্ছা, শিলিগুড়িতে নিয়ে যায়নি তো?
জানি না। ওরা তাই বলেছে?
না। শুধু জিজ্ঞেস করেছিল যে দোমহনিতে যাওয়ার কোনও শর্টকাট রাস্তা আছে কি না।
অর্জুন অবাক হল, দোমহনি?
হ্যাঁ।
তা হলে কি ভূল হল! রিচার্ড ম্যাকডোনাল্ড প্রায়ই তিস্তা পেরিয়ে দোমহনিতে আসতেন। কমলাকান্ত রায়কে ওখানেই অত্যাচারের শিকার হতে হয়েছিল। ওখান থেকেই তারিণী সেন তাঁকে বহন করে নিয়ে গিয়েছিলেন বার্নিশে। তারিণী সেনের হাতকাটা হয়েছিল দোমহনির লালকুঠিতে। সেখানকার খোঁজ নিয়েছে যখন, তখন…। অর্জুন বুঝতে পারছিল না। লালকুঠির রং নিশ্চয়ই লাল। ওই হেঁয়ালির ছড়া কি সেই লালকুঠিকে কেন্দ্র করে? ওখানেই কি মূর্তিটা রাখা আছে? এ কি সম্ভব হবে। তারিণী সেনের মতো মানুষ, যিনি ভাল করে হাঁটতে পারেন না, তিনি কাছাকাছি না রেখে অত দূরে লুকিয়ে রাখবেন? সে ধীরে-ধীরে লাল মন্দিরটার দিকে এগিয়ে যেতে অবনীবাবু তার সঙ্গ নিলেন। এখন আকাশে হাজার তারার ফিকে আলো। পৃথিবীতে অন্ধকার থাকলেও সেই আলোয় খানিকটা দৃষ্টি যায়। ছোট মন্দিরটাকে ঘুরে দেখল অর্জুন। কালোর মধ্যে লাল আর লালের মধ্যে কালো/ ভক্তিভরে তারে নমো করাই ভালো। লালের মধ্যে কালো দেখা যাচ্ছে, লাল মন্দিরের ভেতরে কালো শিবলিঙ্গ। কিন্তু কালোর মধ্যে লাল কোথায়? অবনীবাবু টর্চ জ্বেলে চারপাশে দেখে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কী খুঁজছেন?
ছড়াটা মনে আছে? কালোর মন, লাল…?
হ্যাঁ। কিন্তু এখানে কালো কোথায়?
কিন্তু লালের মধ্যে কালো আছে। ওই শিবলিঙ্গ। টর্চটা দিন তো। সে জুতো খুলে মন্দিরে ঢুকল। দেওয়ালে আলো ফেলতেই দেখতে পেল ঠিক মাঝখান বরাবর একটা মোটা কালো দাগ চারপাশে আঁকা রয়েছে। এরকম দৃশ্য অভিনব। ভেতরে একমাত্র শিবলিঙ্গ ছাড়া আর কিছু নেই। সে লিঙ্গের সামনে হাঁটু মুড়ে বসল। কিছু শুকনো ফুলপাতা ছড়ানো রয়েছে। সেগুলোকে সরিয়ে মূর্তির পূর্ণ অবয়ব দেখল। মন্দিরের মেঝে ভেদ করে যেন উঠে এসেছে। অন্তত দশ ইঞ্চি মোটা। ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আলো ফেলতে হঠাৎ স্থির হয়ে গেল অর্জুন। কালো শিবলিঙ্গের ঠিক নীচের দিকটায় যেন জোড়ের দাগ। জায়গাটায় রঙ করে দেওয়া হয়েছিল কি। সে একটা শক্ত কাঠি তুলে ঘষতে লাগল। কিছুক্ষণ পরে সেখানে জোড়ের দাগ স্পষ্ট হল। এই ব্যাপারটা হয়তো অধার্মিক হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বাবা বিশ্বনাথ নিশ্চয়ই ক্ষমা করবেন।
এই সময় ডাক্তারবাবুর গলা কানে এল, এটা আপনি কী করছেন?
অর্জুন উঠে দাঁড়াল। দেবমূর্তিকে নষ্ট করার কোনও বাসনা তার নেই। তবু…। সে জিজ্ঞেস করল, এই শিবলিঙ্গ কবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল?।
আমার জন্মের আগে।
অর্জুন ধীরে-ধীরে বেরিয়ে এল বাইরে, গ্রামের মানুষ মন্দিরটাকে গুরুত্ব দেয়?
শিবরাত্রির দিন অবশ্যই দেয়।
শিবরাত্রির দিন বটগাছের তলায় পড়ে-থাকা পাথরও তো গুরুত্ব পায়।
আপনি কী বলতে চাইছেন?
শিবলিঙ্গের নিচের দিকে একটা জোড় দেখতে পেলাম। তার মানে ওখানে কোনও মেরামতি হয়েছে। মন্দিরের বাইরের রঙ লাল, ভেতরে কালো দাগ, কালো দাগের মধ্যে আবার কালো শিবলিঙ্গ, এমন তো হতে পারে তারিণী সেন ছড়া মেলাতে ইচ্ছে করে শব্দ দুটো উলটে দিয়েছেন। লালের মধ্যে কালো না বলে কালোর মধ্যে লাল বলেছেন। শিবলিঙ্গের যেখানটা মেরামতি হয়েছে। সেখানে অল্প লাল রং মাখানো আছে। তা হলে অবশ্য কালোর মধ্যে লাল বলতে আপত্তি নেই। অর্জুন জোরে-জোরেই কথাগুলো উচ্চারণ করছিল। তারপর সে অবনীবাবুকে বলল, এই মন্দিরটাকে পাহারার ব্যবস্থা করতে হবে। আমরা পুরাতত্ত্ব বিভাগকে জানাব। যা ব্যবস্থা করার, তারাই করবে।
অবনীবাবু জিজ্ঞেস করলেন, আপনার কি সন্দেহ হচ্ছে মূর্তিটা ওখানেই লুকোন আছে?
আমি যদি নিঃসন্দেহ হতাম, তা হলে তো এখনই খুঁড়ে ফেলতাম। আপনি এক কাজ করুন। জিপ নিয়ে ময়নাগুড়ি চলে যান। ওখানে ফোর্স পাবেন। আজই দোমহনির লালকুঠিতে তল্লাশি চালান। মনে হয়, তারিণী সেনকে ওখানে পেয়ে যাবেন।
আপনি যাবেন না?
আমি এখানে পাহারায় থাকতে চাই, যতক্ষণ না সকাল হয়।
ডাক্তারবাবু বললেন, আপনি আমার ওপর ভরসা করতে পারেন। এটা আমার গ্রামের মন্দির। আমি এখনই লোকজনকে ডাকছি…।
না। লোকজন ডাকলে চলবে না। আমার সন্দেহ যদি সত্যি হয়, তা হলে ওরা এখানে আসবে। লোকজন দেখলে ওরা ধরা দেবে না।
অবনীবাবু চলে গেলেন। ওঁর জিপের আলো অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। ডাক্তারবাবু উসখুস করছিলেন। মন্দিরের চাতালে অর্জুন বসেছিল তাঁর পাশে। চারপাশ নিঃশব্দ, পাতলা অন্ধকারে মাখামাখি। ডাক্তারবাবু হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা অৰ্জুনবাবু, এসব করে আপনার কী লাভ হয়? এই কেসে তো আপনার কোনও ক্লায়েন্ট নেই যে, টাকা দেবে।
অর্জুন হাসল, টাকার চেয়ে অনেক বেশি পাব, যদি দেশের জন্যে মূর্তিটা বাঁচাতে পারি।
কিন্তু আপনারও তো টাকা দরকার।
তা তো অবশ্যই।
চলুন, শুয়ে পড়বেন। আমার ওখানে ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ালেন।
হঠাৎ অর্জুন প্রশ্ন করল, আপনাকে ওরা কত টাকা ফি দিয়েছে?
লোকটি যেন হকচকিয়ে গেল, মা-মানে?
আপনার সাহায্য ছাড়া ওরা তারিণী সেনকে নিয়ে যেতে পারত না।
হ্যাঁ। উনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন।
আমি বিশ্বাস করি না। আপনাকে আমি ওদের সম্পর্কে সচেতন করে গিয়েছিলাম, কিন্তু আপনি টাকার লোভে সেটা শোনেননি।
আপনি কি মনে করছেন তারিণী সেনের ক্ষতি করতে চেয়েছি আমি?
না। ওরা আপনাকে বুঝিয়েছে যে, ওঁকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে রোগ সেরে যাবে, আর এটা আপনি টাকার বিনিময়ে বুঝেছেন। তাই তো?
এবার ভদ্রলোকের গলার স্বর পালটাল, বিশ্বাস করুন, আমি ভাবতে পারিনি ওরা ওঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে না।
আপনি যান। শুয়ে পড়ন।
ডাক্তারবাবু মন্দিরটার দিকে তাকালেন। তারপর ধীরে ধীরে উঠে গেলেন।
রাত থাকতেই গাড়ির হেডলাইট দেখা গেল। অর্জুন একা বসে ছিল, এবার দৌড়ে একটা আড়ালে চলে গেল। ওরা যদি তারিণী সেনের কাছে খবর নিয়ে মূর্তির জন্য ফিরে আসে, তা হলে তা পক্ষে একা বাধা দেওয়া সম্ভব নয়। সঙ্গে কোনও অস্ত্রও নেই। এক্ষেত্রে একমাত্র উপায়, গ্রামের লোকদের জাগানো।
না, কালো অ্যাম্বাসাডার নয়। একটা পুলিশ ভ্যান থামল মন্দিরের সামনে। অর্জুন বেরিয়ে আসতেই ময়নাগুড়ি থানার এস আইকে চিনতে পারল। সে জানতে পারল, থানায় খবর দিয়ে অবনীবাবু ও সি-কে নিয়ে রওনা হয়ে গেছেন দোমহনির দিকে। ভদ্রলোককে কী করতে হবে বুঝিয়ে দিয়ে অর্জুন অনুরোধ করল তাকে ভ্যানে করে দোমহনিতে পৌঁছে দিতে।
দোমহনি এমন কোনও বড় জায়গা নয়। এক সময় বেঙ্গল ড়ুয়ার্স রেলপথের স্টেশন ছিল। তখন একটা রেলওয়ের কারখানাও এখানে অনেককে অন্ন দিত। এখন ওসব নেই, দোমহনির দিন গিয়েছে। অর্জুন যখন পুলিশ ভ্যানে চেপে দোমহনিতে পৌঁছল, তখন অন্ধকার অনেক হালকা। কিছু কিছু মানুষ এই সময় বিছানায় থাকতে পারে না, তাদের একজনকে জিজ্ঞেস করে ওরা লালকুঠিতে পৌঁছল। অনেকটা নির্জনে ব্রিটিশ আমলের প্রায় পোড়ড়া বাড়িটির সামনে অবনীবাবুর জিপ দাঁড়িয়ে আছে। দুজন পুলিশ পাহারায়। তাদের কাছে জানা গেল, সাহেবরা ভেতরে গিয়েছেন।
সাহেব শব্দটার অর্থ এখন বদলে গেছে। উচ্চপদস্থ মানুষকে সম্মান জানানোর জন্য সাহেব বলা হচ্ছে। অর্জুনের এটা পছন্দ হয় না। কেমন একটা কমপ্লেক্স আছে,যেন শব্দটিতে। অর্জুন গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই অবনীবাবুর সঙ্গে দেখা। তিনি ময়নাগুড়ির ও সির সঙ্গে বেরিয়ে আসছিলেন, না, মশাই। এখানে কেউ নেই। সমস্ত বাড়ি খুঁজেছি। সব খালি। কিছু লোক এখানে রাত্রে শোয়, তারা বলল কয়েক বছরের মধ্যে কেউ এখানে আসেনি।
অর্জুন মাথা নাড়ল। তাপপর বলল, চলুন, জলপাইগুড়িতে ফিরে যাই।
যাওয়ার আগে ময়নাগুড়ির ও সি-কে সে বিস্তারিত বলে গেল লাল মন্দিরটার সম্পর্কে। এস আই যে ওখানে পাহারায় আছেন তা যেন কখনওই তুলে নেওয়া না হয়।
তিস্তা ব্রিজ পেরিয়ে থানার দিকে যেতে-যেতে ভোর হয়ে এল। অর্জুন বলল, আমাদের একবার তিস্তা ভবনে যাওয়া উচিত।
কেন?
অনেকক্ষণ ডরোথির খবর নেওয়া হয়নি।
অবনীবাবু থানা পেরিয়ে গেলেন।
দূর থেকেই কালো অ্যাম্বাসাডারটাকে দেখতে পেল ওরা। তিস্তা ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ঠিক পেছনে জিপ দাঁড় করিয়ে অবনীবাবু রিভলভারটা বের করলেন। গাড়িতে কেউ নেই। ওরা গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকল। চৌকিদারটার দর্শন পাওয়া যাচ্ছে না। সোজা সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতেই নীচের লনে শব্দ হল। কয়েকজন যেন দ্রুত ছুটে যাচ্ছে। তড়িঘড়ি নেমে এলেন অবনীবাবু। দুটো মানুষ ততক্ষণে গেটের কাছে পৌঁছে গেছে। গুলি করবেন কি না চিন্তা করার আগেই ওরা কালো অ্যাম্বাসাডারে উঠে বসল। অবনীবাবু ছুটে গেলেন চিৎকার করতে করতে। গাড়িটি ততক্ষণে মুখ বদল করে ছুটে যাচ্ছে শহরের দিকে।
অবনীবাবু চিৎকার করলেন, চলে আসুন! ওদের ধরবই!
অর্জুন হাত নেড়ে না বলল। অবনীবাবু শুনলেন না। জিপ চালু করে অনুসরণ করলেন।
অর্জুন ওপরে উঠে এল। ডরোথির ঘরের দরজা খোলা। ঘরে ঢুকে সে অদ্ভুত দৃশ্য দেখতে পেল। তারিণী সেন তার বিছানায় শুয়ে আছেন। পায়ের কাছে ওঁর দ্বিতীয় স্ত্রী গালে হাত দিয়ে বসে আছেন। পাশের চেয়ারে বসে ডরোথি ওর দিকে তাকাল, উনি ঘুমোচ্ছন।
কেমন আছেন উনি?
ভাল।
ওঁকে এখানে নিয়ে এসেছ কেন?
উনি নিজের ইচ্ছায় এসেছেন। আমি জোর করে আনিনি। ওঁর স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করো।
ওঁকে তোমরা হাসপাতালে ভর্তি করবে বলে নিয়ে এসেছ!
আমি তো কিছুই জানি না। আমি কোনও প্রমিস করে ওঁকে আনিনি। উনিই আমার সঙ্গে সস্ত্রীক দেখা করতে এসেছেন। জিজ্ঞেস করো।
অর্জুনের মনে হল তারিণী সেনের দ্বিতীয় স্ত্রীকে প্রশ্ন করলে ওই জবাবই পাওয়া যাবে। সে জিজ্ঞেস করল, তোমার সঙ্গীরা পালাল কেন?
এর উত্তর ওরা দিতে পারবে। আমি নই।
মূর্তির সন্ধান পেয়েছ?
নাঃ। এই বৃদ্ধ বড় শক্ত মানুষ। কিছুতেই ভাঙবেন না। আমি ওঁকে শেষ পর্যন্ত দু লক্ষ টাকার প্রস্তাব দিয়েছিলাম। কিন্তু উনি ওই একই কবিতা বলে যাচ্ছেন।
অর্জুন বৃদ্ধাকে জিজ্ঞেস করল, দু লক্ষ টাকাতেও উনি বলতে রাজি নন?
বৃদ্ধা বিকৃত মুখ করে জবাব দিলেন, মাথাটা একদম খারাপ হয়ে গেছে।
এই সময় তারিণী সেন চোখ খুললেন। অর্জুনকে দেখে হাসলেন।
অর্জুন এগিয়ে এল, মূর্তিটার হদিশ দিলেন না?
যে পারো খুঁজে নাও।
আপনাকে এখানে জোর করে ধরে নিয়ে আসা হয়েছে?
তারিণী সেন ডরোথির দিকে তাকালেন, ছেলেমানুষ।
টাকার লোভেও ওদের মূর্তিটা দিলেন না? অর্জুন বিছানার পাশে দাঁড়াল।
হাত বাঁচাতে যখন দিইনি, তখন…।
কেন দিচ্ছেন না?
আমি ছিলাম ডাকাত। কমলাবাবু স্বাধীনতা সংগ্রামী। তাঁর কাছে কিছু। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, আমিও তো কিছু করতে পারি। দেশের জন্যে।
অর্জুন শিহরিত হল। তারপর বৃদ্ধের কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে কিছু বলল। বৃদ্ধ মাথা নাড়তে লাগলেন, হল না, হল না।
তা হলে?
কমলা খাও। বুদ্ধি খুলবে।
ঠিক এই সময় অবনীবাবু ফিরে এলেন। লোক দুটো ধরা পড়েছে। তাদের থানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ডরোথির ব্যাপারে কী করা হবে, তা নিয়ে ভাবনাচিন্তা করা দরকার। ওদের কারও বিরুদ্ধে সরাসরি কোনও অভিযোগ টিকবে না। মূর্তিটা পাওয়া না গেলে সেটাকে চুরি করার ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনা যাবে না। অর্জুনের মতে ডরোথিকে তার দেশে চলে যেতে দেওয়া উচিত। মেয়েটা কখনওই জাত-অপরাধী নয়। অপরাধীরা নিজের অন্যায় আগেভাগে স্বীকার করে না। তারিণী সেনকে পূর্বহে ফিরিয়ে দেওয়ার আগে জলপাইগুড়ির হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে ডাক্তার দেখাতে হবে।
অবনীবাবু একা বৃদ্ধকে পেয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি বলছেন লাল মন্দিরে মূর্তি নেই?
কিছুই বলিনি। বড্ড ঘুম পাচ্ছে।
অনুগ্রহ করে বলুন না!
কমলার রঙ লাল। কমলা খেয়েছ কখনও? বৃদ্ধ হাসতে লাগলেন।
ওঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল চেক-আপের জন্য। ওঁর স্ত্রীও সঙ্গে গেলেন। ডরোথির পাসপোর্ট নিয়ে গেলেন অবনীবাবু। সে রইল তিস্তা ভবনেই। সিদ্ধান্ত নিয়ে দুপুরের মধ্যে জানিয়ে দেবেন, ডরোথি ফিরে যেতে পারবে কি না!
সকালের রাস্তায় হাঁটছিল অর্জুন। বাবুপাড়ায় কমলাকান্ত রায়ের বাড়ির সামনে পৌঁছে সে বৃদ্ধকে দেখতে পেল। ভদ্রলোক একটি শিশুকে নিয়ে পায়চারি করছেন। অর্জুন তাঁকে নমস্কার করতেই তিনি বললেন, আসুন। আপনার চেহারা অমন কেন?
অর্জুন হাসল, রাত জাগতে হয়েছিল।
চা খাবেন?
আপত্তি নেই।
আসুন। একটু অপেক্ষা করতে হবে। পুজো শেষ হলেই প্রসাদও নেবেন।
আপনার বাড়িতে রোজ পুজো হয় নাকি?
হ্যাঁ। বাবা এটা চালু করেছেন। হরেক রকম দেবদেবী।
দেখা যাবে?
নিশ্চয়ই।
বৃদ্ধ ওকে ভেতরে নিয়ে এলেন। ঠাকুরঘরের সামনে এসে অবাক হল অর্জুন! দরজাটা কালো রঙ করা। ভেতরে একজন মহিলা পুজো করছেন। আসনে অনেক রকম ঠাকুর। রাধাকৃষ্ণ চোখে পড়ল। পাশে একটি লালচে অদ্ভুত মূর্তি।
ওটা কোন দেবতা?
জানি না। বাবা এনেছিলেন। বলেছিলেন ভক্তিভরে পুজো করতে; করা হচ্ছে।
কাছে যেতে পারি?
যান।
অর্জুন লালচে পাথরের মূর্তিটাকে দেখল। বুদ্ধের সঙ্গে মিল আছে। সে জিজ্ঞেস করল, এই মূর্তি উনি কোথায় পেয়েছিলেন?
তা তো জানি না। সাতচল্লিশের পনেরোই আগস্ট সকালে ওটাকে বাড়িতে এনে বলেছিলেন, লোকটা আমাকে অবাক করে দিল। এই দিনে এমন উপহার, আশা করিনি! যত্ন কোরো একে, আর সাবধানে রেখো। বাবাকে প্রশ্ন করার সাহস আমাদের ছিল না, তাই করিওনি। আসুন। পুজো হয়ে গিয়েছে।
আধঘণ্টা পরে অর্জুন করলা নদীর সামনে দাঁড়িয়ে ছিল একা। তারিণী সেন ডাকাত ছিলেন, কিন্তু সারাজীবনে তাঁর অর্থাভাব মেটেনি। শেষ সময়েও কিন্তু টাকার কাছে নিজেকে বিক্রি করলেন না। কমলাকান্তবাবুর প্রতি তিনি দুর্বল ছিলেন। নিজে যা পারেননি, তার জন্য হয়তো আফসোস ছিল; নইলে স্বাধীনতার দিনে ওই উপহার কেন কমলাকান্তকে দেবেন!
এমন মানুষ দ্রুত কমে যাচ্ছে ভারতবর্ষ থেকে। বৃদ্ধের হাসিমুখ মনে পড়ল। ফিক করে হেসে বলেছিলেন, কমলা খাও। বুদ্ধি বাড়বে।
বাড়েনি। রিচার্ড ম্যাকডোনাল্ড যে বিনা কারণে তারিণী সেন আর কমলাকান্তকে এক ব্র্যাকেটে রাখেননি, এটা সে যেমন বুঝতে পারেনি, তেমনই ডরোথি বা তিব্বতিরাও পারেনি।
অতএব এই রহস্য ফাঁস করে কোনও লাভ নেই।