মৈত্রেয় জাতক (Maitreya Jatak) – চণক ভদ্র
২৫
চণক ভদ্র! চণক ভদ্র!—বাতাসের সঙ্গে ক্ষীণ ডাক ভেসে আসে। যেন উত্তরের বাতাসই ডাকছে। চণকের এমনিই মনে হয়। উত্তর, তার দেশ, এখন সুদুর হয়ে গেছে। এক সময়ে তার দেশ তার কাছে বদ্ধ জলাশয়ের মতো মনে হয়েছিল। তক্ষশিলার গুরুকুলও সাধারণভাবে সেই বদ্ধতার দায়ভাগী। সমগ্র গান্ধার জুড়ে ব্রাহ্মণ উপাধ্যায় আচার্যর ঘরে, সম্পন্ন গৃহস্থর ঘরে, রাজন্য, রাজপুরুষদের ঘরে খালি যজ্ঞের ধোঁয়া কুণ্ডলীকৃত হয়ে উঠছে। বাতাসে কান পাতলেই শোনা যাবে ‘অগ্নে ব্রীহি বৌষট্’—অগ্নি তুমি খাও এবং দেবতার জন্য বহন করে নিয়ে যাও, ‘সোমস্য অগ্নে ব্রীহি বৌষট্’—অগ্নি, তুমি সোম ভক্ষণ করো, বহন করো। শুনতে শুনতে দেখতে দেখতে চণকের এক সময়ে মনে হয়েছিল—কী প্রয়োজন এই অতি বিশদ, জটিল পূজাপদ্ধতির? এগুলি কেন? কেন?
‘চণক ভদ্র! চণক ভদ্র! পেছনে ধুলোর কুণ্ডলী উড়িয়ে এক অশ্বারোহী আসছে। পাহাড়ের পথে অশ্বর ক্ষুরের শব্দ শোনাচ্ছে বৌ-ষট্ বৌ-ষট্ বৌ-ষট্। চণক ফিরে দাঁড়াল। অশ্ব থেকে এক লাফে নামছে অশ্বারোহী। এক সুন্দর যুবক। কেশগুলি মনোহরভাবে তরঙ্গায়িত হয়ে পড়েছে কাঁধের ওপর। উত্তরীয়র একপ্রান্ত কটিবন্ধে শক্ত করে বাঁধা। অন্য প্রান্তটি বাতাসে উড়ছে। পতাকার মতো। বুকে উপবীত দেখা যাচ্ছে। ছুটতে ছুটতে আসছে যুবক।
চণক ভদ্র আপনি এখানে? বালকের মতো উল্লাসে মুখ উদ্ভাসিত করে বলে উঠল যুবক—আমাকে একটুও স্মরণ করতে পারছেন না?
—কোথায় দেখেছি? কোথায় দেখেছি? মুখটি চেনা-চেনা। তক্ষশিলায়, না?
—আমি তিষ্য। গুরু সংস্কৃতির কাছে ছিলাম। শস্ত্রগুরু সুধন্বার ওখানে আপনাকে দেখেছি। দেখেছি অনেক স্থানেই। পরিচয় হয়নি। আচার্য দেবরাতের অন্ত্যেষ্টির সময়ে আমি উপস্থিত ছিলাম। এক নিশ্বাসে সাগ্রহে অনেক কথা বলে গেল তিষ্য। তার চোখে সম্ভ্রম, সে যেন কোনও মহৎ প্রাপ্তির প্রতীক্ষায় হাত পেতে আছে।
দু এক মুহূর্ত। তারপরেই তিষ্যকে আলিঙ্গন করল চণক। বলল—সুখী হলাম।
উদ্ভাসিত মুখে তিষ্য বলল—আমি সাকেতের রাজা উগ্রসেনের জ্যেষ্ঠকুমার। আপনি বন্ধুল মল্লর নাম শুনেছেন?
—শুনেছি।
—ওঁর কাছেও কিছুদিন অস্ত্র শিক্ষা, রণকৌশলের পাঠ নিয়েছি। এই সব পরিচয় এবং তথ্যকে সে যেন চণকের সঙ্গে আলাপিত হবার যোগ্যতা বলে নিবেদন করতে চায়। দুজনে গৃধ্রকূট বেয়ে উঠছে এখন। বড় বড় পায়ে, সামনে ঝুঁকে ঝুঁকে। চণক বলল, কোশল রাজসভায় কর্ম করেন?
—না। না। শুধু রণকৌশল শিখছিলাম।
—সাকেতে পিতার রাজ্যপাট দেখেন?
—তাও না। তিষ্য উজ্জ্বল মুখে বলল, চণক ভদ্র, আমি জানি না বুঝি না আমার বিদ্যা, অভিজ্ঞতা, দর্শন এসবের যথার্থ প্রয়োগ কোথায়, কীভাবে হতে পারে। আমি একটা বিভ্রান্ত বিমূঢ় অবস্থার মধ্য দিয়ে কালক্ষেপ করছিলাম, কাউকে খুঁজছিলাম, আপনার মতো কাউকে, যিনি আমায় পথ দেখাতে পারবেন, যাঁর সঙ্গে আমি এ বিষয়ে আলাপ করতে পারবো। চণক ভদ্র ‘আপনি’ বলবেন না আমায়। আমি আপনার অনুজের মতো। আপনি যখন সদ্য সদ্য সমাবৃত্ত হবার পরই দণ্ডনীতির বিশেষ পাঠ দিচ্ছিলেন তখন কোনও কোনও আলোচনাসভায় বিমুগ্ধভাবে উপস্থিত থেকেছি। আচার্য সংকৃতির অবমাননার ভয়ে আপনার শিষ্য হতে পারিনি। আমায় ভাই না হোক বন্ধুর স্থান অন্তত দিন। তিষ্য যে অত্যন্ত উত্তেজিত তার কথা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়।
মধ্যদেশ—চণক ভাবলো। এখানে রাজা থেকে কবি, রাজপুত্র থেকে বনের মানুষ পর্যন্ত কথা বলে অনেক। উচ্ছাস-আবেগ গোপন করে না। এক অর্থে আত্মাভিমান লক্ষণীয়ভাবে অল্প। দ্রুত বন্ধুত্ব করতে পারে। উত্তরের মানুষগুলি স্বল্পভাষী। নিজেকে অপরের কাছে প্রকাশ করে ধরার অভ্যাস তাদের নেই। এবং প্রচণ্ড দাম্ভিক। এভাবে দূর থেকে অল্প পরিচিত একজনকে দেখে উচ্ছ্বসিত হওয়া, সঙ্গে সঙ্গে পরিচয় করা, সখ্যে পৌঁছে যাওয়া—এ গান্ধারবাসীরা ভাবতেও পারে না। চণক নিজেও এর ব্যতিক্রম নয়। সে হেসে বলল—বন্ধু? আপনি আমার বন্ধুত্ব চাইছেন আমায় না জেনে?
—আমি আপনাকে জানি। কে না জানে তক্ষশিলায়? দৈবরাত চণককে? আপনি আচার্য দেবরাতের আরব্ধ-কর্ম সমাপ্ত করছেন। আপনি ভাবছেন সূক্ষ্মতর দণ্ডনীতি নিয়ে…আমি জানি। অনেক কাল থেকে আপনাকে বন্ধুরূপে পাবার বাসনা আমার।
চণক আকাশের দিকে তাকাল। তরল নীল আকাশ। সূর্য এখন উত্তরায়ণে। তির্যকভাবে রোদ পড়েছে গৃধকূটের মাথার ওপর। সঞ্চিত বারি শেষ করে দিয়ে মেঘগুলি এখন শ্বেত, লঘু। সে হঠাৎ কটি থেকে তরোয়াল খুলে ধরে সেটি আকাশের দিকে তুলে দাঁড়ালো। বলল, ভালো, তিষ্য, আকাশ সাক্ষী। রৌদ্র সাক্ষী। আজ থেকে চণক তিষ্যর বন্ধু, সাকেতক তিষ্যর, কেমন?
তিষ্য তরোয়ালের উপর ন্যস্ত চণকের মুঠির ওপর হাত রাখল। বাষ্পরুদ্ধ গলায় বলল, বন্ধু। মেঘগুলি সাক্ষী। গৃধ্রশিখর সাক্ষী। সাক্ষী রাজগৃহ।
—রাজগৃহ তোমার ভালো লেগেছে, তিষ্য?
—রাজগৃহ অনবদ্য। অনবদ্য!
—কেন?
—কেন?—চণকের পেছন পেছন উঠতে উঠতে তিষ্য চারিদিকে তাকিয়ে দেখে নিল একবার। বলল, একই সঙ্গে পাহাড়, অরণ্য। মধ্যদেশে তো পাহাড় সুলভ নয় ভদ্র, গয়া থেকে এদিকে এলে প্রচুর পাহাড় দেখা যায়, কিন্তু সে সব বড় রুক্ষ। এ পাহাড়গুলি পুরোপুরি শ্যামল না হলেও যেন অত কঠিন, নীরস নয়। পাহাড়ের সানুদেশে প্রচুর গাছ। দুরারোহও নয় পাহাড়গুলি, নগরীটি যেন দেবতারা সুরক্ষিত করে দিয়েছেন।
ভালো। আর কোনও কারণ?
এইটুকু পরিসর এ নগরের। তবু চোখ এবং মন ক্লান্ত হয় না। বৈচিত্র্য আছে। শুধু গৃহ, পথ এবং কানন বিন্যাসের বৈচিত্র্য নয়। আরও কিছু…আরও কী, তিষ্য ভাবতে লাগল।
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে চণক বলল, আর কী, বন্ধু তিষ্য?
তিষ্য চিন্তিত মুখে বলল, আছে কিছু। এখুনি তাকে বুদ্ধি দিয়ে বিশ্লেষণ করতে পারছি না ঠিক। কিন্তু কোশলের রাজধানী শ্রাবস্তীর ঐশ্চর্যও তো দেখেছি। রাজগৃহও রাজধানী। এখনকার সবচেয়ে বড় না হোক, সবচেয়ে সমৃদ্ধ না হোক, সবচেয়ে সম্ভাবনাময় রাজ্যের রাজধানী। এখানে সেই ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার পদধ্বনি শুনতে পাওয়া যায় বোধ হয়। যদিও প্রজাদের চোখে-মুখে শুধু সমৃদ্ধির চিহ্ন ছাড়া আর কিছু দেখতে পাইনি। তবু…
চণক বলল, সাধু, তিষ্য, সাধু। তোমার দেখার সঙ্গে আমার দেখা অনেকটাই মিলে যাচ্ছে। তোমার সঙ্গে যোগাযোগ কখনোই আকস্মিক নয়। আমাদের দেখা হওয়ার কথা ছিল। অবশ্যই কথা ছিল।
দুজনে উঠতে উঠতে পাথরের চন্দ্রাতপের তলায় ভিক্ষু অস্সজিকে দেখতে পায়। আজকাল এই সময়ে অস্সজি ধ্যানমগ্নই থাকেন। তিনি পাছে উত্ত্যক্ত হন, তাই ইদানীং চণক গিরিশিরে ওঠার এই সহজ পথটি এড়িয়ে যায়। আজ তিষ্যর সঙ্গে কথা বলতে বলতে ভুলে গিয়েছিল। তাকে অভ্যস্ত পথে চালিয়ে নিয়ে এসেছিল তার মন। সেই অঞ্চলটুকু পার হয়ে তিষ্য মৃদুস্বরে বলল, চণক ভদ্র, আপনার কখনও মনে হয় না সংসারত্যাগী সন্ন্যাসী, পরিব্রাজক এঁদের সংখ্যা এত কেন? সমগ্র কোশল, মগধ, উত্তরাঞ্চলও যেন দিনে দিনে ভরে যাচ্ছে শ্রমণে।
চণক চমকে তাকাল, বলল, এভাবে মনে হয়নি। তুমি বললে বলে মনে হয়। এর হেতু কী বলতে পারো?
তিষ্য লজ্জিত হয়ে বলল, প্রশ্নই আসে মনে। উত্তর দিতে পারি না। উত্তরে দেখতাম প্রব্রজ্যা নিলে সন্ন্যাসীরা একেবারে জনহীন দুর্গম হিমবন্তে গিয়ে থাকতেন। মাঝে মাঝে এসে লোকালয়ে কিছুদিন বাস করে যেতেন। কিন্তু আমাদের এদিকে পথে বেরোলেই কোনও না কোনও পরিব্রাজক শ্রমণের সঙ্গে আপনার ঠোকাঠুকি হয়ে যাবে। এঁরা যেমন পাহাড়ে বা কাননে বাস করেন, তেমনি লোকালয়েও নিত্য নেমে আসছেন।
—কিন্তু তিষ্য, তোমার জন্মেরও বহুকাল আগে থেকেই তো এই প্রকার চলে আসছে!
—তা আসতে পারে ভদ্র। কিন্তু তাই বলে তাকে প্রশ্ন করব না?
—তা বলছি না। শিশুকাল থেকে যা দেখে আসা যায়, মানুষ সাধারণত তাকে নিজের অজ্ঞাতেই মেনে নেয়। প্রশ্ন করে না। তুমি করছো। তোমার দৃষ্টির একটি বিশেষ ভঙ্গি আছে।
—কী জানি কেন চণক ভদ্র, শ্ৰমণ-সন্ন্যাসী এঁদের দেখলেই চিরকালই আমার কেমন একটা বিতৃষ্ণা হয়। বুঝতে বা বোঝাতেও পারি না কেন। তাই-ই হয়ত প্রশ্ন জেগেছে।
—বিতৃষ্ণা কেন। এ প্রশ্নের উত্তর আগে তোমাকে ভেবে বার করতে হবে তাহলে।
দুজনে নীরবে উঠতে লাগল। বেশ খানিকটা ওঠবার পর বসার স্থান ঠিক করে চণক বসল। তার মুখ দক্ষিণে। ওই দিকে বন, যে বনের চরিত্র জানবার জন্য তার পরিব্রজন-ব্রত নেওয়ার কথা ছিল। একটার পর একটা ঘটনা ঘটে তার এই ব্রতকে বিলম্বিত করে দিচ্ছে। রাজগৃহে আসবার আগে সে ছিল একজন বন্ধনহীন মুক্ত যুবক। তার জীবনের প্রধান কাজ তখন “রাজশাস্ত্র” সমাপ্ত করা। এই শাস্ত্র যথাযথ লেখবার জন্য যে চিন্তাই যথেষ্ট নয়, জীবনের সঙ্গে, বহু স্তরের মানুষের সঙ্গে ভাবনাকে মিলিয়ে মিলিয়ে নেওয়া প্রয়োজন এই কথা বুঝে সে গান্ধার থেকে বেরোবার জন্য অস্থির হয়ে পড়েছিল। রাজ্যগুলি দেখবে, বিশেষত মগধ, আদর্শ রাজা, রাজ্য এবং তন্ত্র কোথায় পাওয়া যায় অনুসন্ধান করবে, সেই সঙ্গে সমাজে বিভিন্ন শ্রেণীর বিন্যাস, শ্রেণীগুলির ধ্যান-ধারণার সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগে আসবে এমনটাই তার অভিপ্রায় ছিল। তার মনের সূক্ষ্ম পরিবর্তন হল ওই বনে। এই বন্যরা কোনও বিন্যস্ত শ্রেণীতে নেই। এদের আটবিক বলে উল্লেখ করা হয় এবং সেই উল্লেখের মধ্যে নিহিত থাকে সমাজের একটি মন্তব্যও—এরা উৎপাত। উপদ্রব। কিন্তু এদের কাছাকাছি বাস করে চণক বুঝেছে জম্বুদ্বীপের মাটিতে যদি তাদের, অর্থাৎ শ্বেতকায়দের অধিকার থাকে, যদি মিশ্রবর্ণ নাতিশ্বেত মানুষদের অধিকার থাকে, তাহলে ওই কৃষ্ণকায় মানুষগুলিরও পুরোপুরি অধিকার আছে। এই মাটিতে, এই অরণ্যেই ওরা যুগের পর যুগ, বংশের পর বংশ জন্মেছে, বড় হয়েছে, নিজেদের গোষ্ঠীর নিয়মগুলি মেনে জীবনযাপন করেছে, মরে গিছে, আবার জন্মেছে। এদের উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কোনমতেই না। এমন কি চণকের একেক সময়ে সংশয় হয় এই আটবিকরাই কি জম্বুদ্বীপের আদি অধিবাসী? তারা কি পরে এসেছে? তারা যে প্রথমে সপ্তসিন্ধু অঞ্চলে ছিল, তারপরে ছিল সরস্বতী-দৃষদ্বতীর মধ্যভাগে, তারও পরে এসেছে গঙ্গা-যমুনার অববাহিকায়, অর্থাৎ ক্রমশই উত্তর-পশ্চিম থেকে পূর্বে এবং দক্ষিণ-পূর্বে তারা ছড়িয়ে পড়েছে—এ কথা সে বেদ অধ্যয়ন করবার সময়েই বুঝতে পেরেছিল। তাহলে? যখন তারা শুধু সপ্তসিন্ধু অঞ্চলেই বসবাস করছিল, তখন এই মধ্যদেশ কী রূপ ছিল? এখন পুবদেশ, দক্ষিণদেশ যেমন ঘন অরণ্যে আবৃত তেমনই নিশ্চয়ই। কারা তখন এখানে বাস করত? তার যুক্তি তাকে বলে—আটবিকরা। বন্যরা। অর্থাৎ যেখানেই বন, সেখানেই এরা বসবাস করত। এখন কল্পনা করা যাক, শ্বেতকায় মানুষগুলি আরও ভূমির সন্ধানে অস্ত্র-শস্ত্র যন্ত্র নিয়ে ক্রমশই এই মহাবনের ভেতরে প্রবেশ করছে। কেটে ফেলছে গাছ। পরিষ্কার করে ফেলছে যতেক গুল্ম। হিংস্র জন্তুগুলিকে হত্যা করছে। আটবিকরা তাদের বিরাট সংখ্যা, উন্নত অস্ত্র-শস্ত্র, যন্ত্র দেখে ভয় পেয়ে যাচ্ছে। পালিয়ে যাচ্ছে, আরও গভীরে গিয়ে আশ্রয় নিচ্ছে। মাঝে মাঝে চোরের মতো আক্রমণ করে বিপর্যস্ত করে তুলছে শ্বেতকায়দের। কিন্তু তাড়াতে পারছে না। বিজয়ী এবং বিজিতের যে স্বাভাবিক সম্পর্ক তা-ও কিন্তু তাদের সঙ্গে আটবিকদের এখনও পর্যন্ত স্থাপিত হয়নি। এই যে মহারাজ বিম্বিসার অঙ্গ রাজ্য জয় করেছেন, তার অর্থ কি তিনি অঙ্গে বসবাসকারী সমস্ত মানুষকে তাড়িয়ে দিয়েছেন। তা তো নয়। তারা যেমন তাদের নিজ নিজ বৃত্তি অনুসরণ করে জীবনযাপন করছিল, তাই-ই করে যাচ্ছে। শুধু রাজশক্তির পরিবর্তন হয়েছে, হয়ত কতকগুলি নীতিও স্বতন্ত্র হয়ে গেছে। এই পর্যন্ত কিন্তু বন্যদের বেলায়, তাদের সমস্ত অধিকার যেন অস্বীকার করা হচ্ছে। হিংস্র জন্তুগুলিকে পর্যন্ত। এভাবে শেষ করে দেওয়া হয় না। শাকভোজী পশুগুলিকে তো বিচরণ করবার স্বাধীনতা দেওয়া হয়েই থাকে। নাঃ। আর্যমানুষের একটি প্রাচীনতম অপরাধ এই আচরণ। এরই জন্য অংশত জম্বুদ্বীপ কতকগুলি পরস্পর-বিচ্ছিন্ন নরগোষ্ঠীর সমষ্টি। একটি সুন্দর বস্ত্র যদি মাঝে মাঝেই ইদরে কেটে দেয় বস্ত্রটি যেমন তার মহিমা হারায়, অব্যবহার্য, অর্থহীন হয়ে পড়ে—জম্বুদ্বীপও তাই হয়েছে। কোনও অর্থ নেই এর।
চণক তার এই নতুন ভাবনায় কাউকে দীক্ষিত করতে পারেনি। মহারাজ বিম্বিসার তার কথা মন দিয়ে শুনেছেন। পুরোপুরি মেনে নিয়েছেন এমন কোনও লক্ষণ দেখাননি। তবে নতুন ভাবনার কাজ বাতাসে-ওড়া তুলোর বীজের মতো। উড়ে উড়ে বেড়াবে, তারপর পড়বে ভূমিতে কোথাও, ধীরে ধীরে প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় চলে যাবে মাটির গভীরে, তারপর অনেক রোদ, জল পান করে এক সময়ে অঙ্কুর মেলবে। লোকে নেবে কি নেবে না এই ভেবে চিন্তক কখনও তাঁর চিন্তাগুলিকে প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকবেন না। থাকা উচিতও নয়।
এই আটবিকদের, যদি আর্যমানুষদের আচরিত সমাজবিধির মধ্যে নিয়ে আসা না যায়, তাহলে আর্যমানুষরা এদের কোনদিন স্বীকার করবে না। বিম্বিসার রাজার প্রতিক্রিয়া থেকেই তা বোঝা যায়। অথচ…এদের…এই বন্যদের কি পরিবর্তিত করা যাবে? আদৌ? এদের জীবনযাত্রার গভীরে না-ঢুকলেও যেটুকু সে জেনেছে তাতে মনে হয় এদেরও সমাজ-বিধি আছে নির্দিষ্ট। সেই বিধি এদের আচরণ নিয়ন্ত্রিত করে। এদের আছে যথেষ্ট আত্মাভিমানও। আমানুষরা যেমন এদের অশুচি মনে করে এরাও তেমনি আমানুষদের অশুচি-অস্পৃশ্য মনে করে। এদের নিজেদের মতো ‘সু-সভ্য’ করা কঠিন কাজ মনে করেই কি দীর্ঘ সময় ধরে এদের মেরে নিঃশেষ করে দেওয়া হচ্ছে? এ কাজ কি সভ্যমানুষ সচেতনভাবে পরিকল্পনা করে করছে? না, না-ভেবেই করে যাচ্ছে? প্রথমে সমাজ ছিল শুধু বৈদিক। এখন বেদ-পন্থা অস্বীকার করেও তো বহু মানুষ চমৎকার জীবনধারণ করে আছে? সুতরাং বেদ মানা না মানার ওপর এখন মোটেই সভ্যতার পরিমাপ নির্ভর করছে না। অথচ একটি সূত্র চাই। একটা কিছু সামান্য সূত্র যাতে এই বিশাল দেশের সব নরগোষ্ঠীকে এক ও আপন করতে পারে!
অথচ, জীবনে এখন এমন জটিলতার উদ্ভব হয়েছে যে চণক বেরোতে পারছে না। জিতসোমা যদি পুরুষ হতে অনায়াসে তাকে নিয়ে এই দুরূহ যাত্রাপথে সে বেরিয়ে পড়তে পারতো। কিন্তু সোমাকে ফেলে সে কোথায় যাবে? কে জানে কী দুর্দৈব আবার নেমে আসবে ওই প্রিয় নারীর জীবনে, সে যদি তাকে একা এখানে রেখে যায়! সোমার ভাবনাও তার জীবনের একটা মূল ভাবনা। সোমা তক্ষশিলার রাজপুরে চলে যাবার পর সে গভীরভাবে বিষন্ন, ক্রুদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সে-ও বোধহয় একজন সুযোগসন্ধানী এবং কাপুরুষ। তার মধ্যে তেজের অভাব আছে। তা নয়ত সোমার এই রাজপুরী-যাত্ৰা সে মেনে নিল কেন? কোনক্রমেই কি সে সোমাকে নিয়ে পালিয়ে আসতে পারতো না? তার ভেতরের কাপুরুষটা দায়িত্ব নামিয়ে দিয়ে চলে এসেছিল। হ্যাঁ, কর্কশ লাগলেও এটাই সত্য কথা। এখানে, রাজগৃহে মহামাত্র দর্ভসেন যখন সোমাকে দান করে দিলেন, তখন? তখনও তো সে বিদ্রোহ করেনি! শুধু কৌশলে তাঁকে নিবৃত্ত করতে চেয়েছে। না পেরে,আবার নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে। সোমার বুদ্ধিতে এবং ঘটনাচক্রে মহারাজ বিম্বিসারের বদান্যতার কারণে সোমা মুক্ত হয়েছে। এখন সে প্রতিদিন নতুন করে অনুভব করছে নিজের অক্ষমতা।
তিষ্য দেখল অপরাহ্ণের ছায়া ক্রমশ দীর্ঘ হচ্ছে। ক্রমশ তা চণকের মুখের ওপর এক গাঢ় বিষন্নতার চক্র রচনা করল। তারা দুজনে বহুক্ষণ নীরবে বসে আছে। এই চণক তার কিশোর ও তরুণকালের আদর্শ। সে যখন নিজের সহাধ্যায়ীদের সঙ্গে তৃপ্ত হতে না পেরে আলোচনাসভায় বিতর্কসভায় ঘুরে বেড়াত অস্থির হয়ে তখন চণককে দেখেছে। দেখেছে খুব সংযতভাবে বিতর্কে যোগ দিতে, মন দিয়ে আলোচনায় যোগ দিতে, আলোচনা করতে। প্রথম প্রথম অতিশয় দাম্ভিক বলে মনে হত। তক্ষশিলায় তার শেষ বছরগুলিতে তিষ্য বুঝেছিল চণক কোনও চিন্তায় ডুবে থাকেন; আচ্ছন্ন থাকেন, সেই সব দুরূহ চিন্তার জগতে তিনি নিঃসঙ্গ। তক্ষশিলায় সবাই চণককে সমীহ করত। অনেকেই বলতেন—‘এ যুবক নিতান্ত অল্প বয়সে আচার্য হয়ে গেল। এটা ঠিক নয়। ও ধারাবহির্ভুত চিন্তা করছে।’ কেউ কেউ সংশয়ী মুখে বলতেন—‘ও বিদ্রোহী।’ কিন্তু তারজন্য চণকের সম্মান কখনও ক্ষুণ্ণ হয়নি। তিষ্য সে সময়ে স্বপ্ন দেখত সে চণকের সঙ্গে বসে নিজেদের একান্ত সমস্যা নিয়ে আলোচনা করছে, দেখত বসে আছে কোনও তরুমূলে সে ও চণক। কেমন করে সে স্বপ্ন সফল হল? সম্ভব হল? সে কি কখনও ভেবেছিল তক্ষশিলার বিদ্যা ও জ্ঞানের মণ্ডল ছেড়ে চণক এই ব্রাত্য মধ্যদেশে কোনদিন আসবেন? তার নিজেরই দেশে প্রায় চণকের সঙ্গে তার পথের বাঁকে দেখা হয়ে যাবে! যেন এ রূপ হয়েই থাকে। এ একটা সাধারণ ঘটনা! সে কি ভেবেছিল প্রথম দেখায় নিজের প্রীতির কথা সে এইভাবে স্বচ্ছন্দে বলতে পারবে এবং চণক এইভাবে তার সঙ্গে বন্ধুত্বের বন্ধন স্বীকার করে নেবেন? এইরূপ অস্ত্র, আকাশ, ভূমি সাক্ষী রেখে।
এই সময়ে চণক মুখ ফিরিয়ে বলল, কী তিষ্য? কী ভাবছো? তার মুখে একটু অস্পষ্ট হাসি।
সত্যি কথা কি বলতে চণকই ভাবছিলেন, তিষ্য তাঁকে চিন্তামগ্ন দেখে নীরব ছিল মাত্র। কিন্তু এখন সে সে-কথা উল্লেখ করল না। বলল সংসার ত্যাগী পরিব্রাজক ও সন্ন্যাসীর আধিক্যের একটা হেতুর কথা আমার মনে এসেছে ভদ্র।
—বলো, বলো। চণক উৎসাহিত হয়ে উঠল।
—আমাদের বৈদিক ভাবনাই তো সন্ন্যাসকে গুরুত্ব দিয়েছে। সন্ন্যাসকে মানুষের জীবনের শিখরে স্থান দিয়েছে। এই লোক নয়, লোকোত্তর কোনও সত্যই যে খোঁজা হচ্ছে এমন ইঙ্গিত কি বারবার আমরা যজ্ঞবিধির মধ্যেও পাই না?
—অথচ এই যজ্ঞবিধি বা সংহিতার সূক্তগুলির ঋষি যাঁরা, তাঁরা তো পরিপূর্ণভাবেই গৃহী ছিলেন? চণক বলল এমন কি ব্রহ্মবাদের প্রবক্তা যাঁরা। যেমন রাজা প্রবাহণ বা চিত্র গার্গ্যায়ন এঁরা তো রাজা ছিলেন। একই সঙ্গে রাজত্ব করা, রাজৈশ্বর্য ভোগ করা এবং লোকোত্তর রহস্যের চিন্তা করা যে সম্ভব তা-ই তাঁরা দেখিয়েছেন। তবু এত সংসার-বিরাগী, কেন?
তিষ্য বলল, তবে কি এই বিশাল সংখ্যার মানুষের সত্যিই সংসার ভালো না লাগবার কোনও কারণ ঘটে, চণক ভদ্র? এঁরা কি সংসারে কষ্ট পেয়েছে? প্রত্যেকে?
চণক বলল, ঠিক এই কথা, অর্থাৎ সংসার দুঃখের, জীবন দুঃখময়, এই কথাই তো.শ্ৰমণ গৌতম বলছেন।
—শ্ৰমণ গৌতম? তিষ্য উত্তেজিত হয়ে বলে উঠল, ওঁকে আমি দেখেছি, যেদিন প্রথম রাজগৃহে এলাম। তর্ক করতে পারেন, ভালো। অন্যান্যদের নিজের মতে নিয়ে আসার ক্ষমতা অসাধারণ।
—কী করে জানলে?
—আমার সামনেই তো কতকগুলি শ্রমণকে নিজের মতো আনলেন। তারা সব নিগণ্ঠ মত ত্যাগ করে বেলুবন নামক স্থানে চলে গেল।
চণক আশ্চর্য হয়ে বলল—তুমি দেখলে?
—দেখলাম। শুনলাম।
—আমিও দেখেছি। শুনেছি। দেবতার মতো সৌম্যদর্শন। অসাধারণ বুদ্ধিমান ইনি। কিন্তু তিষ্য, আমি যতদূর শুনেছি ইনি বেদ তো মানেনই না। তুমি যেভাবে সংসার-বিরক্ত হওয়ার কথা বলছো ইনি সেভাবে হননি। ব্যক্তিগত জীবনে এঁর মতো সুখী কেউ ছিল না। ধনবান, ক্ষমতাশালী পিতা, মমতাময়ী মা, সুন্দরী পত্নী যিনি ছিলেন একেবারে সঙ্গীর মতো। একটি পুত্রও হয়, তারপরই ইনি গৃহত্যাগ করেন। এখন নিজেকে সুখী বলেন, সুখী যে তা মুখভাবেই বোঝা যায়। এই সুখী অভিজাতপুত্র দুঃখবাদের কথা বলেন। নিবৃত্তি ও নির্বাণের কথা বলেন। অথচ তিষ্য, আমি চণক শৈশবে মাতৃহীন, যৌবনারম্ভে পিতৃহীন, সংসারে একা, এঁর মতো ধন-সম্পদ-বিলাসও আমার আয়ত্তে নেই, অথচ এই আমি পৃথিবীকে, জীবনকে আনন্দময় মনে করি। এতো আনন্দময় যে নির্বাণের কথা শুনলে আমার হৃৎকম্প হয়। তা ছাড়াও আমার মনে হয়, মনে হয়…জীবনকে সংসারকে আরও সুন্দর, সুশৃঙ্খল করাই আমার কাজ। শুধু আমার কেন, আমাদের সবার। তিষ্য, তুমি কি ব্যক্তিগত সুখের কথা ভাবো?
তিষ্য এক ধরনের গৌরববোধে দৃপ্ত মুখে বলল, সে-কথা ভাবলে গৃহত্যাগ করতাম না চণক ভদ্র। আমি ভাবি সুন্দর, সুষমাময়, সুবিচারশীল রাজ্যসৃষ্টির কথা।
—সত্য? তাহলে তিষ্য, সেই রাজ্যের সুবিচার তুমি কেমন কল্পনা করো? বলবে আমাকে? সেই রাজ্যের সমাজ নিয়েও তুমি নিশ্চয় ভাবো!
—ভাবি বই কি! সে রাজ্যের প্রতিটি গ্রামে, সব বৃত্তির লোক থাকবে। খাদ্য উৎপাদন, বস্ত্র উৎপাদন, যন্ত্র এবং তৈজসপত্র উৎপাদন, রথ প্রস্তুত। পথ সু-সমান এবং পরিষ্কার রাখা, পথ-ভয় দূর করা এ সমস্ত ব্যাপারেই সজাগ থাকবে সে রাজ্যের শাসনযন্ত্র।
—বিচারের কথা বলো।
ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সুবিচার যাতে পায়, তার ব্যবস্থা থাকবে। ধনী-দরিদ্র বলে যাদের নির্দেশিত করছে, তারা কারা, তিষ্য?
—অর্থাৎ?
—তারা কি আমাদের মতো মানুষ? সবাই?
—বুঝলাম না চণক ভদ্র।
—ধরো কৃষ্ণকায় মানুষ।
—তারাও তো প্রজা, তারাও সুবিচার পাবে!
—ধরো যারা বনে থাকে, তারা?
—নিষাদদের কথা বলছেন? নিষাদরাও অবশ্যই সুবিচার পাবে।
—নিষাদও নয়। যে-সব বন্যদের সঙ্গে আমাদের কোনও আদান-প্রদান নেই, তারা!
—ভদ্র আমি দক্ষিণে অর্থাৎ বিন্ধ্য পর্বতের ওপারের আদর্শ রাজ্য স্থাপনের কথা চিন্তা করি। শুনেছি সেখানে গভীর অরণ্য। হিংস্র নরখাদক যক্ষ ইত্যাদিতে পূর্ণ সে-সব। এরাই সবচেয়ে বড় বাধা। কিন্তু এদের সবাইকে হত্যা করবার মতো সৈন্যবল আমি কোথায় পাবো। যথাসম্ভব এদের সঙ্গে বন্ধুত্ব নীতিই গ্রহণ করতে হবে।
—তাহলে এই বন্যদের তুমি মানুষ বলেই মনে করো?
—মানুষই তো এরা। অশিক্ষিত, অসভ্য, কিছুটা হিংস্র এইমাত্র। আমরা শিশুকালে শুনতাম এদের মাথায় শিং আছে। দাঁতগুলি হাতির দাঁতের মতো বেঁকে বেঁকে বাইরে বেরিয়ে থাকে। কিন্তু আমাদের সাকেতের গৃহেই দুটি বন্য দাস আছে। তারা মোটেই এ রূপ নয়! শিশুকাল থেকে তাদের দেখছি। নিকটের বন থেকেই নাকি এক সময়ে তাদের ধরে আনা হয়েছিল। এখন তারা আমাদের অন্যান্য দাসেদের মতোই। কোনও প্রভেদ নেই।
চণক অবাক হয়ে শুনছিল। সে বলল, ধরো দক্ষিণে যেসব বন্য-মানুষের সংস্পর্শে তুমি আসবে তাদের সবাইকে তুমি দাস করে রাখবে?
—চাইলেই কি তা পারবো চণক ভদ্র? তাদের নিজেদের দেশে তারা আমাদের থেকে শক্তিশালী হবে। তা ছাড়া দেখুন, তাদের বুদ্ধিতে যদি সেবা ব্যতীত অন্য কোনও কাজ সম্ভব না হয়, তা তো তারা সেবক ছাড়া আর কী-বা হবে?
—কিন্তু যে বনে তারা বাস করছে তুমি রাজ্যস্থাপনের উদ্দেশ্যে সেখানে না-যাওয়া পর্যন্ত তারা স্বাধীন। তাদের কোনও বুদ্ধির পরীক্ষা দিয়ে প্রমাণ করতে হচ্ছে না তারা কোন কাজের যোগ্য। তিষ্য, ভালো করে ভেবে দেখো, তুমি তাদের কাছে অবাঞ্ছিত, উপদ্রব, তাদের শত্রু। তাদের স্বাধীনতা হরণ করবার অধিকার তোমাকে কে দিয়েছে?
অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে তিষ্য বলল, আপনার কথা আমি বুঝলাম, আবার বুঝলাম না। অর্থাৎ চণকভদ্র, আপনার যুক্তি আমি স্বীকার করছি, কিন্তু… কিন্তু… রাজ্য জয় করবার অধিকার কে-ই বা কাকে দেয়? যে মনে করে রাজ্য চাই, সে-ই রাজ্য জয় করে, তাই না?
চণক বলল, তাই-ই। কিন্তু তুমি ন্যায়ের কথা বলছিলে, সুবিচারের কথা বলছিলে, তাই এ সব কথা আমার মনে হল। তিষ্য, একদিনে এই জটিল সমস্যার সমাধান হবে না। চলো আমরা এবার নামি।
—নামতে নামতে তিষ্য ম্লানমুখে বলল—আপনি দণ্ডনীতির ওপর শাস্ত্র লিখছেন। রাজা, রাজ্য স্থাপন, রাজ্য বিস্তার এ সব না থাকলে দণ্ডনীতির প্রয়োজন কী ভদ্র? বন্যরা মানুষ, কিন্তু তারা বদ্ধ। তাদের যদি সে ভাবেই থাকতে দেওয়া হয় তো বিদ্যার অর্থ কী? সমাজ-জীবনে তো কোনও গতি থাকবে না সে-ক্ষেত্রে!
চণক বলল, তুমি ঠিকই বলেছ তিষ্য। কিন্তু এই সমস্ত ব্যাপারটার মধ্যে কোথাও একটা জটিল গ্রন্থি আছে বন্ধু। যেটি আমি মোচন করতে পারছি না, এবং তুমি বোধহয় দেখতে পাচ্ছো না। কোথায় থাকো তুমি?
—অতিথিশালায়।
—চলো, সন্ধ্যা হল। আমার একটি গৃহ আছে। তিষ্য, তুমি অতিথিশালা ছেড়ে সেখানে থাকতে পারো।
তিষ্য বলল, পরে ও কথা হবে। আপনার সঙ্গে কোথায় দেখা হবে বলে দিন। আমার অতিথিশালাটি উত্তর সীমান্তে। জম্বু-বীথিকার পথে।
চণক আশ্চর্য হয়ে বলল, আমার গৃহের কাছেই তো থাকো তুমি। এত কাছে ছিলাম আমরা। সর্ব অর্থে। অথচ এত দূরে! আশ্চর্য!
গৃধ্রধ্রকূটের সানুদেশ এখন নির্জন হয়ে এসেছে। পাহাড়ের দক্ষিণ দিকে কিছু দরিদ্র পল্লী। নগরের দিকে যেতে হলে এ পল্লী চোখে পড়ে না। কিন্তু বাইরের দিকে যেতে গেলে, পাশ দিয়ে যেতে হয়। চণক যে সময়ে অটবীতে আশ্রয় নিয়েছিল, তখন অনেকবার দেখেছে। আজ দুজনে ঘোড়ায় উঠছে। সেই পল্লীর দিক থেকে কয়েকটি রমণী ছুটে এলো। একজন উৎকণ্ঠিতভাবে বলল—অজ্জ, অজ্জ আপনারা কি একটি বালক ও একটি বালিকাকে এদিকে আসতে দেখেছেন?
—কই না তো? চণক এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল।
রমণী দুটি কপালে করাঘাত করে কাঁদতে লাগল।
—কী হয়েছে? বলো, আমরা সাধ্যমতো সাহায্য করব।
একটি রমণী বলল, এর মেয়ে আর আমার ছেলে বড় দুঃসাহসী। খেলতে খেলতে কখনো পাহাড়ে, কখনও বনের দিকে চলে যায়। বনে রাক্ষস আছে মানে না। পাহাড়েও শ্যেন পাখির উপদ্রব। এই গিজ্ঝকুট থেকে গতকালও ওদের সন্ধ্যার আগে ধরে নিয়ে গেছি। এদিকে যখন আসেনি, নিশ্চয় বনের দিকে গেছে। এখন কী হবে?
চণক বলল, সর্বনাশ! একটু পরেই তো প্রাকারের দ্বার বন্ধ হয়ে যাবে। তোমরা একজন কেউ আমার ঘোড়ার পিঠে উঠে এসো। তিষ্য, তুমি পাহাড়ের দিকটা অনুসন্ধান করো তো।
রমণীটি ঘোড়ায় চড়তে ইতস্তত করতে লাগল।
—বিলম্ব করো না— অসহিষ্ণু স্বরে বলল চণক। হাত বাড়িয়ে রমণীটিকে উঠতে সাহায্য করলেন। বেশ বাস রুক্ষ ধরনের হলেও এর স্বাস্থ্য চমৎকার। চুলগুলি কোনমতে জড়িয়ে নিয়েছে। ঘোড়ায় চড়তে কোনও অসুবিধাই হল না। বলল, অজ্জ আমরা হাটে শাক বেচি। গাম থেকে নিয়ে আসে আমার পতি। আমার ছেলে বড় দস্যি। এক নিমেষও তাকে এক স্থানে বসিয়ে রাখা যায় না। সাত বছর বয়স। আমাদের প্রতিবেশীর মেয়েটিও অতি চঞ্চল। দুজনে মিলে এমন দস্যিপনা করে! প্রহারও খায়! কিন্তু শিক্ষা হয় না। দেখুন না, আমাদের পতিরা গামে গেছে শাক আনতে, এসে যদি দেখে এই কাণ্ড!
চণকের ঘোড়া কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রাকার দ্বারে পৌঁছে গেল। রক্ষী জ্যেষ্ঠক তাঁকে চেনে। চণক বলল, এই রমণীটির পুত্র-কন্যা, দুটি সাত আট বছরের বালক-বালিকাকে তোমরা কেউ দেখেছ না কি?
প্রতিদিন এই বিশাল দ্বার দিয়ে কত মানুষ আসা-যাওয়া করছে, রক্ষী জ্যেষ্ঠক কী করে বলতে পারবে?
কিন্তু তার সহকারী একজন রক্ষী বলল, বালক-বালিকা বুঝিনি। দুটিই বালক। মাথায় চুড়া বাঁধা কী?
রমণীটি সাগ্রহে বলল—হ্যাঁ হ্যাঁ।
—চোখে কাজল?
—হ্যাঁ, ওই তো…
—প্রহর কয় আগে দ্বার দিয়ে বেরিয়ে গেল। আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম। কোথায় যাও? তা বললে—পিতা আছেন বাইরে। পিতার কাছে যাচ্ছি। এখনও ফেরেনি?
রমণী কাঁদতে কাঁদতে বলল, কোথায় পিতা সে বালক জানবে কী করে। নিশ্চয় পথ হারিয়েছে।
চণক বলল, শীঘ্র চলো। দ্বার বন্ধ করতে একটু তো বিলম্ব আছে?
—আর এক প্রহরের মতো। দেখে আসুন। রক্ষী বললো।
কিছুদূর এগিয়ে গেলেই একদিকে পথ চলে গেছে উরুবেলার দিকে। কিছুটা এগিয়ে এই পথ দুভাগ হয়ে যাবে। দ্বিতীয় শাখাটি যাবে অঙ্গের দিকে। ডান দিকে আরম্ভ হচ্ছে অরণ্য। প্রথমে ছাড়া ছাড়া গাছ, গুল্ম, ক্রমেই ঘন হয়ে উঠবে। কিছুদূর উরুবেলার পথে যেতেই ওদিক থেকে কয়েক জন লোক মাথায় বোঝা নিয়ে আসছে দেখা গেল। রমণীটি ত্বরিতে ঘোড়া থেকে নেমে সেদিকে ছুটে যেতে যেতে বলল, ওই তো আমার পতি।
চণক দাঁড়িয়ে রইল। রমণী তার পতিকে সঙ্গে নিয়ে এলো। উৎকণ্ঠিতভাবে বলল, গামের দিকে ওরা যায়নি অজ্জ।
পুরুষটি বনের দিকে দৌড়তে লাগল তার বোঝা ফেলে। চিৎকার করে ডাকছে, চুন্দ! চুন্দ! ঘোষা! ঘোষা!
পেছনে পেছনে তার স্ত্রীও ছুটছে। প্রাণপণে ডাকছে ঘোষা! ঘোষা! ঘোষা! চুন্দ! চুন্দ! বনভূমি তাদের উৎকণ্ঠিত ডাক যেন গিলে নিচ্ছে।
চণক ঘোড়া নিয়ে বনের মধ্যে খানিকটা অগ্রসর হয়ে গিয়েছিল। মানুষ চলাচলের একটি ক্ষীণ। পথ আছে। কিন্তু কোথাও সে কিছু চিহ্ন দেখতে পেল না। পরে ফিরে বলল, কিন্তু এই বনে তো হিংস্র পশু তেমন নেই! আর সাত আট বছরের বালক-বালিকাকে শৃগালে টেনে নিয়ে যেতে পারে না।
—এই বনে যক্ষরা থাকে। ভয়ে বিবর্ণ হয়ে পুরুষটি বলল।
রমণীটি উচ্চৈঃস্বরে কেঁদে উঠল।
নগরদ্বার থেকে ঘণ্টাধ্বনি ভেসে আসছে। দ্বার এবার বন্ধ হয়ে যাবে তারই ইঙ্গিত।
চণক পর্ণের বোঝা সমেত রমণীটিকে তুলে নিল, পুরুষটি পেছনে ছুটতে ছুটতে আসছে।
দ্বারের কাছে পৌঁছে রমণীটি আর্তগলায় চেঁচিয়ে উঠল, দ্বার বন্ধ করো না প্রহরী। বালক-বালিকা দুটি যদি ফিরে আসে, ঢুকতে পাবে না!
প্রহরীরা কথা না-বলে ঘড় ঘড় শব্দে লোহার দরজা বন্ধ করতে লাগল। রমণীটি সেখানেই লুটিয়ে পড়ল—চুন্দ! চুন্দ রে! কোথায় গেলি বাপা!
দিনটি যেভাবে আরম্ভ হয়েছিল, সেভাবে শেষ হল না। রমণীগুলির কান্নার শব্দ পেছনে মিলিয়ে গেল ধীরে ধীরে। কিন্তু হৃদয় থেকে মিলোল না। ওরা রাজসভায় বিচার প্রার্থনা করবে। এমন। সুন্দর নগরী, এত বড় রাজ্যের রাজধানী সেখানে শিশু বা বালক হারিয়ে গেলে রাজ্যের পক্ষ থেকে অনুসন্ধান করার কোনও ব্যবস্থা নেই? তিষ্য বলল, কী হয়েছে মনে হয়?
চণক বলল, বুঝতে পারছি না তিষ্য। যদি অরণ্যের মধ্যে পথ হারিয়ে থাকে, তাহলে রাত হলে ভয়েই শিশুদুটি মরে যাবে। যথেষ্ট সংখ্যক রক্ষী বা রাজভট সঙ্গে নিয়ে, অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে অরণ্যে আমাদের প্রবেশ করা উচিত ছিল। রক্ষীগুলি তো বলল সন্ধ্যার পর স্বয়ং রাজা আদেশ করলেও দ্বার ওরা খুলতে পারে না। কাল সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হবে।
তিষ্য বলল, দেখছেন তো, শাসনযন্ত্রে কত প্রকার ত্রুটি থাকে? যতক্ষণে সকাল হবে, রাজাদেশে রক্ষী ও রাজভটরা প্রস্তুত হবে, ততক্ষণে কি আর শিশু দুটি জীবিত থাকবে মনে করেন?
কিছুদিনের মধ্যেই রাজগৃহের প্রান্তবর্তী পল্লীগুলিতে দারণ আতঙ্কের সৃষ্টি হল। শিশু চুরি যায়। আর খুঁজে পাওয়া যায় না। রাত্রির অন্ধকারে কয়েকটি কালো কালো ছায়া দেখে কেউ। সে তাদের ভয়ের ছায়া না সত্য তা-ও বোঝা যায় না। অধিকাংশ শিশুই একেবারে শিশু। প্রাচীরের ও দিকের দরিদ্র, অন্ত্যজ পল্লীগুলিতে বাস করে। মহাভয়ে তারা রাত্রি জাগতে আরম্ভ করল। রক্ষীরা সতর্ক হল। রাজার কর্ণগোচর হল সংবাদ। জনশ্রুতি—নরমাংসাদ যক্ষ- যক্ষিণীর আবির্ভাব হয়েছে। যখের ভয়ে সন্ধ্যার পর নগরীর কেন্দ্র ব্যতীত অন্য সব স্থান জনবর্জিত হয়ে আসতে লাগল। আরও তাড়াতাড়ি নগরের দ্বার গুলি বন্ধ করবার ব্যবস্থা হল। নগরের বাইরে কিন্তু বিশেষ ব্যবস্থা করা গেল না। রাজভটগুলি রাজার ভয়ে গিয়ে দাঁড়ায় বটে। তাদের অস্ত্র হাতে নিয়ে সারারাত প্রহরা দেবার কথা। কিন্তু তারা চোর, দস্যু এদের ধরতে বা শাস্তি দিতে যথেষ্ট বীরত্ব দেখালেও অপ্রাকৃত প্রাণীর ভয়ে অন্ধকার হতেই গৃহস্থের দ্বারে দ্বারে হানা দেয়।
দুমদাম আঘাতে ভয়ে ভয়ে দরজা খুলে গৃহস্থ হয়ত মুখটি বার করল। রক্তবর্ণ বসন পরা, লাঠি, তলোয়ার ও ধনুবাণে সজ্জিত রাজভটটি বলবে, অনেকক্ষণ প্রহরা দিয়েছি। রাত হয়েছে একটু আশ্রয় দেবে?
গৃহস্থ—এটা চণ্ডালপল্লী কিন্তু ভদ্দ। আমরা অশুচি।
—তাতে কী হল? ঘরের একধারে বসে বসে রাতটা ঠিক কাটিয়ে দেবো।
—পাহারার কী হবে?
—আরে চণ্ডাল, নিজেদের শিশুগুলিকে ঘরের ভেতর বেঁধে রাখো না। আমি দ্বারের কাছে বসে রইলাম। ভয় কী?
চণ্ডাল হেসে বলবে, ভয়টিকে তো ধরতে হবে, ভদ্দ? ধরার জন্যই তো আপনাদের নিয়োগ করা হয়েছে!
—উঁহু হু। প্রেত কি ধরা যায়? হাত নেই, পা নেই, ধরবো কী করে?
—হাত নেই তো আমাদের ঘরের বচ্চগুলিকে ধরে কী করে?
—নিশ্বাসে উড়িয়ে নিয়ে যায় রে। নিশ্বাসের বাতাসে উড়িয়ে নেয়।
—তাহলে তো ঘরের মধ্যে থেকেও উড়িয়ে নিতে পারে।
—পারেই তো। তাই তো বলি শিশুগুলিকে বেঁধে-হেঁদে রাখ। ওরে বাপা, উহুহুহু।
চণ্ডাল হেসে বলে, শ্মশানে মশানে ঘুরি। কখনও প্রেত দেখলাম না, ভদ্দ। মড়ার মাথার খুলির ভেতর দিয়ে হাওয়া বয়, মনে হয় প্রেতে চিৎকার করছে। শিবা, তরক্ষুর ডাক শুনে মানুষ ভয় পায়। পাগল, পাগলিনী শ্মশানে ঘোরে, অদ্ভুত তাদের বেশ বাস, অদ্ভুত কথাবার্তা, লোকে বলে প্রেত। আমরা জানি পাগল।
—তবে যে তোরা ভূত-প্রেতের কথা বলে ভয় দেখাস!
চণ্ডাল হেসে বলে, ভয় না দেখালে আমাদের শ্মশানের রাজ্যটুকুও তো আর নিজের থাকবে না। লোভী লোকগুলি আমাদের প্রাপ্যেও ভাগ বসাবে। সাক্কপুত্তীয় সমনরা তো এখনই শ্মশান থেকে বস্তর নিতে আরম্ভ করেছে। এর পর শয্যা, রুপা, তামা, সোনা যা পাওয়া যায় সেগুলিও নিতে থাকবে হয়ত।
এইভাবে গল্প করতে করতে রাজভটটি প্রাচীরে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ে। গৃহস্থ ও তার স্ত্রী। সারারাত শিশুগুলিকে পাহারা দিয়ে জেগে থাকে। সকালের আলো ফুটলে, ক্লান্ত রক্তিম চোখ নিয়ে যে যার কাজে যায়।
কিন্তু, এরপর দিনে-দুপুরেও শিশু চুরি হতে লাগল। চোরেরা বনের দিকে থেকে আসে। বনে চলে যায়। শৃগালের মতো চতুরতার সঙ্গে কাজ সারে। রাজগৃহে আতঙ্ক, প্রান্তিক পল্লীগুলিতে কান্নাকাটি পড়ে গেল। নরমাংসাদ যক্ষিণী। অনেকেই নাকি তাকে দেখেছে। কৃষ্ণকায়, বিকৃত দর্শন। সঙ্গে যক্ষ। উভয়েই অতি ভয়ানক। নিমেষের জন্য দেখা দিয়েই অদৃশ্য হয়।
রাজাদেশ হল—এই যক্ষ-দম্পতিকে ধরতে হবে—জীবিত বা মৃত। যে ধরবে সে পুরস্কার পাবে।
একদিন সকালে তিষ্যর অতিথিশালায় এসে চণক দেখল সে বুকে লৌহজালিকা আঁটছে। অস্ত্রেশস্ত্রে সুসজ্জিত।
—কোথায় যাচ্ছো, তিষ্য?
তিষ্য হেসে বলল, যক্ষ ধরতে, চণক ভদ্র।
চণক বলল, একটু অপেক্ষা করো তিষ্য, আমিও যাবো।
চণক এতদিন কেন যায়নি! ওই মহাবন, অন্তত তার কিছু অংশ তো তার পরিচিতই! সেই পরিচয়ের ওপর নির্ভর করেই তো সে যক্ষের সন্ধানে যেতে পারতো! কেন উদ্যোগ নেয়নি চণক! সে কি নিজের প্রাণ বিপন্ন করতে চায়নি? না না। সে তো নিরস্ত্র ওই অরণ্যের মধ্যে দিনের পর দিন কাটিয়ে এসেছে? তবে? কী জটিল রহস্য তোমার চরিত্রে, তোমার আচরণে হে উদীচ্য ব্রাহ্মণ! যা কৃত্য কর্ম বলে মনে করো, যেসব বিষয়ে এতো গভীর চিন্তা করো, বিষগ্ন হও, চিন্তাগুলি লিপিবদ্ধ করে যাও লিপির এবং লেখনীর বহু অসুবিধা থাকা সত্ত্বেও, কেন তার কোনটাই করতে উদ্যোগ নাও না? তোমার কর্মোদ্যোগহীন, চিন্তক চরিত্র কি এইবার নির্দিষ্ট হয়ে যেতে আরম্ভ করল? দেখো তো, তিষ্যকুমার, ক্ষত্রিয়যুবা কেমন দ্রুত সিদ্ধান্তে পৌঁছে যেতে পেরেছে! কবচ আঁটছে এখন। তোমার মতো জ্ঞানী না-হলেও, সে-ও কিন্তু চিন্তা করে, সেই সঙ্গে কর্মোদ্যোগও তার চরিত্রে স্পষ্ট। সে যা ভাবে, তাই করে। একদিন তুমিই না এই রাজগৃহের পথে দাঁড়িয়ে এক মাগধকে বলেছিলে—তুমি আপাতত ব্রাহ্মণ কিন্তু বৃত্তির পরিবর্তনও হতে পারে। কী মনে ছিল তোমার চণক? কী ভেবেছিলে? কোন বৃত্তির কথা? রাজা বিম্বিসার তোমাকে উচ্চপদ দিতে চেয়েছিলেন রাজসভায়। তা-ও তো তুমি নাওনি? সে পদ নিলেও করার মতো কাজ অনেক করতে পারতে। তখন বলেছিলে তুমি মুক্ত থাকতে চাও। জম্বুদ্বীপ পরিক্রমা করে দেখবে কোথায় তার সীমা! যাবে পূর্ব দিকে। আবিষ্কার করবার চেষ্টা করবে জনমনের সেই মূল সূত্রটি, যা জম্বুদ্বীপকে সংহত করবে। হায় গ্রন্থকার, চিন্তক, ভাবক, প্রজ্ঞাবান ব্রাহ্মণ আর কতদিন! কত দিন এই দ্বিধা, এই দোলাচল চিত্ত নিয়ে তুমি কোন কর্তব্য সম্পাদন করবে?
তিষ্য বলল, তাহলে কবচ পরে নিন ভদ্র। আমার কাছে দ্বিতীয় তো নেই! চলুন আপনার গৃহে যাই।
—কবচ প্রয়োজন হবে না তিষ্য। তুমি সশস্ত্র চলো আমি তোমার সঙ্গে থাকবো। ভয় কী!
—কিন্তু বিষাক্ত তীর কোনওদিক থেকে যদি এসে বেঁধে?
—মাথায় উষ্ণীষ পরে নিচ্ছি। এই উর্ণার উত্তরীয় যথেষ্ট স্থূল।
—চণক ভদ্র আপনার জীবন মূল্যবান। এভাবে আপনাকে বিপন্ন হতে দিতে আমি পারি না।
—শ্ৰমণরা তো বিনা অস্ত্রেই সর্বত্র ঘুরে বেড়ান। কিছু তো হয় না!
—আপনি তো শ্ৰমণ নন!
তিষ্য কিছুতেই সম্মত না হওয়ায়, তার ভৃতক চণকের গৃহ থেকে কবচ ও ধনুর্বাণ এনে দিল।
বাহুবলে বলীয়ান ক্ষত্রিয়র পেছন পেছন চিন্তাবিদ ব্রাহ্মণ চলল অরণ্যের অন্ধকার জয়ের প্রথম অভিযানে।
তাদের জীবনে প্রথম হলেও, এ অভিযান সত্যিই প্রথম কী? বিস্মৃত অতীতে যাননি কি এভাবে ইন্দ্র, এবং ত্বষ্টা? পাণ্ডব এবং দ্ৰোণ? অর্জুন এবং কৃষ্ণ? সুদূর ভবিষ্যতেও এভাবে যাবেন না এঁরা? বীরপুরুষ এবং ভাবুক পুরুষ? কর্মী এবং তাত্ত্বিক?
যদি বলা যায় তিষ্যকুমার তো পুরোপুরি কর্মী ও বীর নয়। তার মধ্যে কমৈৰ্ষণার সঙ্গে মিলে আছে প্রশ্নোপনিষদ। প্রশ্নের কাছে নিরন্তর গতায়াত। যদি বলা যায় দৈবরাত চণকও তো নয় শুধু তাত্ত্বিক। তার কর্মের পরিকল্পনা অস্পষ্ট ভাবজগৎ থেকে স্পষ্টই নেমে এসেছে ভূমি স্পর্শ মুদ্রায়, তাহলে বুঝতে হবে ভেতরে ভেতরে মাটি ভেঙে দিক পরিবর্তন করছে যুগজীবন, যুগমানস। কতটা পারছে, পেরেছিল তার চেয়েও বড় কথা—চাইছে। তারা চেয়েছিল।
২৬
গৌতম বুদ্ধ বললেন—শিশুদুটিকে আগে খেতে দাও।
—কী দেবো, ভগবান? আমাদের তো কিছু সঞ্চয় নেই! —আনন্দ বললেন। তাঁর দু’চোখ থেকে অশ্রুধারার মতো করুণা ঝরে পড়ছে। যেন কাষায়ধারী শ্ৰমণ নয়, পিতা। কিন্তু গৃহস্থ পিতার চোখে কি এমন করুণা ঝরে? যেন শিশুটির সর্বাঙ্গ শুধু নয় তাদের অন্তর, তাদের বর্তমান, তাদের ভবিষ্যৎ—সবই তিনি অভিষিক্ত করে দিচ্ছেন।
শিশুদুটি জীবকের আম্রবনের গাছের ফাঁকে ফাঁকে খেলা করে বেড়াচ্ছে। কৃষ্ণবর্ণ দুটি ব্যাঘ্ৰশিশুর মতো। সুকুমার ত্বক দিয়ে স্বাস্থ্যের দীপ্তি ফুটে বেরোচ্ছে। পায়ের ভাঁজগুলি, কী সুন্দর! অবোধ শিশু। নিজেদের পরিবেশে যে নেই সে-কথা বুঝতে পারছে না। বা অস্পষ্টভাবে বুঝলেও তাদের কোনও ভাবান্তর নেই।
চণক বলল—আমরা যাচ্ছি। দুধ কিনে আনছি। যত তাড়াতাড়ি পারি আসব। কাননের প্রান্তে ঘোড়াদুটি বাঁধা ছিল। দু’জনে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল।
তিষ্য কৌতুকে মুখ উজ্জ্বল করে বলল—শিশুদুটিকে নিয়ে কী করবেন শ্রমণ গৌতম? ওদের ওপর কি ওঁর বিখ্যাত ইন্দ্রজাল খাটবে, চণকভদ্র?
চণক হেসে বলল—দুধ না খেয়েই ওরা যেভাবে মল্লযুদ্ধ করে যাচ্ছে, তাতে শ্রমণ গৌতম এবং তাঁর ভিক্ষুরা খুব শীগগীরই রীতিমতো পর্যুদস্ত হয়ে পড়বেন মনে হচ্ছে। এরপর উদরপূর্তি হয়ে গেলে কী করবে কে জানে!
আজ চণক ও তিষ্যর বড় বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়েছে। অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে, বর্ম এঁটে দু’জনে বনপথে হারানো শিশু এবং জনশ্রুতির যক্ষযক্ষিণীর সন্ধানে বেরিয়েছিল। যে চণ্ডাল-পল্লী থেকে সবচেয়ে অধিক সংখ্যায় শিশু চুরি গেছে, সেই পল্লীর কাছের বনাঞ্চলে ঢোকে তারা। ঝোপঝাড়, লতা এ সব ভেঙে পড়ে থাকায়, তাদের মনে হয় এটি একটি যাতায়াতের পথ। খানিক দূর যাবার পর তারা আশ্চর্য হয়ে দ্যাখে শ্ৰমণ গৌতম তাদের আগে আগে চলেছেন। দু’জনে দুদিক থেকে গিয়ে তাঁকে ঘিরে ধরে—ভদন্ত, কোথায় চলেছেন?
মুখে মৃদু হাসি খেলে গেল। গৌতম বললেন—বৃথা শব্দ করো না। রাক্ষস ধরতে যাচ্ছি।
তিষ্য বলে—আমরাই তো সে জন্যে আছি। সংসার-ত্যাগী শ্রমণের কষ্ট করবার প্রয়োজন কী?
—ত্যাগী কোথাও আবদ্ধ নয়, তার পক্ষেই ধরা সহজ আয়ুষ্মান।
তৃণগুল্ম এবং শুষ্ক পত্রাদির শব্দ হতে থাকে। সাবধানে উপানৎ হাতে ধরে দু’জনে শ্রমণের পেছন পেছন গিয়ে আবিষ্কার করে—একটি পরিষ্কৃত স্থান। মাটিতে অগভীর গর্তের মধ্যে নিভে যাওয়া আগুন। কাছেই একটি অপরিচ্ছন্ন পর্ণকুটির। সামনে দুটি কৃষ্ণকায় উলঙ্গ শিশু খেলা করছে।
শ্রমণ গৌতম বললেন—সম্ভবত এখানেই রাক্ষসীর বাস। আয়ুস্মন, কুটিরের মধ্যে এবং চারপাশে একটু দেখে এসো তো শিশুগুলির সন্ধান পাও কি না।
তিষ্য চলে যায়। এই সময়ে চণক অগ্নিকুণ্ডটির কাছে এগিয়ে গিয়ে একটি বৃক্ষশাখা দিয়ে ভস্মস্তূপটি পরীক্ষা করতে করতে একটি শিশুর কনুই পর্যন্ত আধপোড়া হাত দেখতে পায়। সেদিকে শ্রমণের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে তিনি সহসা বলেন—ওই শিশুটিকে তুলে নিয়ে এসো।
ততক্ষণে তিষ্য কুটির পরিক্রমা সেরে বেরিয়ে এসেছে। —‘কই, কাউকেই তো দেখতে পেলাম না। তবে এইগুলি পেয়েছি।’ সে পেতলের কয়েকটি ছোট ছোট বালা দেখাল। চণক নীরবে অগ্নিকুণ্ডের মধ্যে কেই শিশু-হাতটির দিকে আঙুল দেখায়। তিষ্য শিউরে চোখ বুজে ফেলল। চণক শিশুটিকে দু’হাতে তুলে নিতে তারা প্রথমটা তার হাত ছাড়াবার চেষ্টা করে। বড়টি তাকে কামড়েও দেয়। সেই সময়ে হঠাৎ শ্ৰমণ গৌতম এগিয়ে এসে দুই বাহুতে দুটি শিশুকে শক্ত করে কক্ষের কাছে চেপে ধরে, দ্রুত নগরীর দিকে ফিরে যেতে থাকেন।
সেই শিশুদুটিই এখন আম্রবনে নিশ্চিন্তে পরস্পরের সঙ্গে মল্লযুদ্ধ করছে। এবং চণক ও তিষ্য তাদের জন্য দুধের সন্ধানে পোপ-পল্লীর দিকে যাত্রা করেছে।
যথেষ্ট পৰিমাণে দুধ এবং কিছু খেলনা কিনে আম্রবনে ফিরে এসে ওরা দেখল বড় শিশুটি শ্রমণ গৌতমের কোলে বসে তার বিস্মিত চোখ দিয়ে শ্রমণের মুখ নিরীক্ষণ করছে। কচি কচি আঙুল দিয়ে তাঁর কান টানছে। গালে হাত বুলোচ্ছে, চীবর নিয়ে টানাটানি করছে।
ওদিকে ছোটটি ঠোঁট ফুলিয়েছে। আনন্দ নামে শ্রমণ তাকে তাড়াতাড়ি কোলে তুলে নিতে সে আনন্দর একটি আঙুল মুখে পুরে চুষতে লাগল।
বর্ষার অন্তে অনেক ভিক্ষুই এদিক ওদিক ভিন্ন গ্রামে, জনপদে বেরিয়ে গেছেন প্রচার কর্মে। অল্প কয়েকজনই আছেন। তাঁদের মধ্যে অল্পবয়স্করা শিশুদুটির কাণ্ড দেখে হাসছেন। একজন প্রৌঢ় ভিক্ষু আরেকজনকে মৃদুস্বরে বললেন—রাহুল জন্মাবার পর শিশুর মায়া কাটাবার জন্যেই তো ভগবান আরও সত্বর গৃহত্যাগ করলেন। রাহুই বটে। তা এখন কী করবেন? নিজপুত্রকে কখনও কোলে করেননি। এখন এই বন্যশিশুকে কেমন খেলা দিচ্ছেন দেখো!
অন্য ভিক্ষুটি বললেন—আমি দেখেছি, বেলুবনে একদিন ধ্যানভঙ্গ হবার পর উনি রাহুলের পরিবেণের কাছে বহুক্ষণ পদচারণা করতে থাকলেন। রাহুলের ঘুম ভাঙার সময় হলে যেন বুঝতে পেরে ধীরে ধীরে সেখান থেকে চলে গেলেন।
—দেশনা করবার সময়ে ওঁর চোখ যখন রাহুলের ওপর পড়ে, আমি দেখি যেন স্নেহ টলটল করছে! ভগবান তীর্থিক কি আজীবিকদের মতো শুকনো সন্ন্যাসী তো নন!
—তা যদি বলো, রাহুলকে দেখলে আমারই করুণা হয়। রাজার পুত, রাজার বংশ ধর; ভালো করে কিছু বোঝবার আগেই ভিক্ষাপাত্র ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
—শ্রমণ হয়ে এ কথা বলছো?
—আমি তো শ্ৰমণ হয়েছি পরিণত বয়সে। পুত্ৰদুটি অকালে মারা গেল। পত্নী কেমন যেন শোকবিহ্বল হয়ে গেলেন। আমার মনে হল এই দুঃখই সত্য। এতদিন যা ভোগ করেছি সে সবই মায়া, মিথ্যা! একদিন ভগবানের দেশনা শুনতে বেলুনে গিয়েছিলাম উভয়ে। ফিরে এসে দু’জনেই স্থির করলাম প্রব্রজ্যা নেবো। তা দেখো ধর্মশীল, সন্তানের অকালমৃত্যুর শোক কী আমি জানি। সন্তান-স্নেহ কী বস্তু তা-ও আমি ভুলিনি। কিন্তু রাহুল ওই বালকটি জন্ম থেকে পিতৃস্নেহ জানল না। মাতৃস্নেহই কি জেনেছে? পাঁচ সাত বছরের শিশুকে যখন দেবী রাহুলমাতা পিতৃধন চাইবার জন্য ভগবানের কাছে পাঠালেন তিনি কি জানতেন না পার্থিব ধন বলতে কিছুই তাঁর কাছে নেই? তিনি বুদ্ধিমতী নারী। চেয়েছিলেন পুত্রের দায়িত্ব পিতা নিক। সে যেভাবেই হোক। পিতৃহীন শিশু মায়ের স্নেহচ্ছায়ে বড় হতেও তো পেল না। রাহুল খেলা জানল না, বিচিত্র খাদ্যরস জানল না। পিতামাতার স্নেহ জানল না। দুঃখভোগের আগেই তাকে দুঃখনিরোধের কঠিন পথে ঢুকিয়ে দেওয়া হল। উপরন্তু, রাহুল বন্ধনস্বরূপ এইরূপ নাম দিয়ে তাকে চিরদিনের জন্য কলঙ্কিত করা হল।
—আপনি কি ভগবানকে নিন্দা করছেন ভিক্ষু ধর্মরক্ষিত?
—নিন্দা করি না। বুঝতে পারি না তাঁর সব কিছু এটাই বলেছি। আর রাহুলের প্রতি করুণা। প্রকাশ করেছি।
—ওকে দেখলে কি আপনার মৃত পুত্রদের কথা মনে হয়?
—হয় ধর্মশীল, হয়। বলতে বলতে ভিক্ষু দ্রুত স্থান-ত্যাগ করলেন।
চণক অদূরে দাঁড়িয়ে ভিক্ষুদের আলোচনা শুনছিল। তিষ্য একটি শ্রমণের সঙ্গে শুকনো ডাল-পাতা জ্বালিয়ে দুধ গরম করছে। দেখতে দেখতে, এবং শ্রমণদের কথা শুনতে শুনতে কেন কে জানে তার শ্রীমতীর কথা মনে পড়তে লাগল। শ্রীমতী তাকে সযত্নে খাওয়াচ্ছে। ব্যজন করছে। শ্ৰীমতী তার হাতে জল দিল। ওই শ্রীমতী তার বীণা নিয়ে তাকে, একমাত্র তাকেই গান শোনাবার জন্য বসেছে। এতে ধীর, এতো নম্র, করুণ! সে বহুদিন শ্রীমতীর কাছে যায়নি, তার সংবাদ রাখে না। অথচ এক গভীর আত্মিক সঙ্কটে শ্ৰীমতীই তাকে সঙ্গ দিয়েছিল। সে তার কাছে প্রার্থী হয়ে গিয়েছিল। আত্মসমর্পণ করেছিল। শ্রীমতী তাকে পুরোপুরি সাহায্য করেছে। সে কিছু দেয়নি ওই নারীকে। গৃহস্থ, বিবাহিত পুরুষের মতো গন্ধ, মাল্যবস্ত্র ইত্যাদি কিনে নিয়ে গিয়েছিল একদিন। অভিমান ভরে শ্রীমতী বলেছিল—‘মূল্য দিচ্ছেন নাকি?’ চণক কিন্তু তাকে বোঝাবার চেষ্টা করেননি—এ ঠিক মূল্য দেওয়া নয়। তার হৃদয়ের প্রীতিরই প্রকাশ এ। সে শুধু ক্ষান্ত হয়েছিল। আর ওইসব বস্তু কেনেনি। সহসা তার জিতসোমার কথাও মনে হল। জিতসোমা আর সাজ-সজ্জা করে না। অতি সাধারণ রমণীর মতো বেশ করে। শ্রদ্ধাভরে চণকের রাজশাস্ত্রর প্রতিলিপি করছে সে। চোখের সামনে সে যেন দেখতে পেল জিতসোমা হাতে পালকের লেখনী নিয়ে লিখতে লিখতে মুখ তুলে তাকাল। কেমন বিষগ্ন দৃষ্টি। কী ভবিষ্যৎ জিতসোমার? চণক অস্পষ্টভাবে চিন্তা করে কিন্তু জিতসোমার প্রতিই কি তার কর্তব্য পালন করতে পারছে সে?
শিশুদুটি দুধ খেতে খেতেই ঘুমিয়ে পড়ল। মাটির পাত্র দুহাতে ধরে ঢকঢক করে খেয়ে নিল। তারপর চোখ বুজে আসতে লাগল তাদের। বুদ্ধ বললেন—আনন্দ, ওদের ভিক্ষুণীদের উপাশ্রয়ে দিয়ে এসো। বলবে, ওদের পালন করতে, যতদিন না আবার চাই।
আনন্দ বললেন—যাই, ভগবান।
আনন্দ একজনকে কোলে নিলেন, আরেকজন ভিক্ষু বড়টিকে নিলেন।
মধ্যাহ্ন পার হয়ে যাচ্ছে। দু’জনে গৃহের দিকে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল। তিষ্যকে আজও নিজের গৃহে আপ্যায়ন করতে পারেনি চণক। যবে থেকে সে বুঝতে পেরেছে চণকের গৃহে একজন রমণী থাকেন, সে কোন মতেই কোনও নিমন্ত্রণ গ্রহণ করতে চায় না। থাকা তো দূরের কথা।
প্রধান পথ রাজগৃহে মাত্রই দুটি। কতকগুলি উপপথ দক্ষিণে এবং বামে চলে গেছে শাখা-প্রশাখার মতো। বৈভার গিরির কোল ঘেঁষে চণকের গৃহে যাবার পথটি। দু’ধারে সমান ব্যবধানে ছায়াতরু। ফাঁক দিয়ে পাহাড়ের ঢাল দেখা যায়। দক্ষিণের পথটি ক্রমে রাজপুরীর প্রাচীরে পৌঁছেছে। বামের পথটি ধরে যেতে যেতে ক্রমশই জামগাছ বাড়তে থাকে। মহীরুহ সব। তারপর উত্তর প্রান্তে গিয়ে বাঁদিকে আরও একটি বাঁক নিলে শুধুই জামগাছ। পথটি এমন ছায়াময় হয়ে থাকে যে মধ্যাহ্ন-সূর্যও যেন একে তপ্ত করতে পারে না। এখন বর্ষা চলে গেছে। হিমঋতু এলো বলে। এ পথ দিয়ে যাতায়াতের সময়ে উত্তরীয়টি ভালো করে গায়ে জড়িয়ে নিতে ইচ্ছে হয়। চণক এবং তিষ্যর এখনও বর্ম পরা রয়েছে। যোদ্ধৃবেশ। এই বেশও নগরীর মধ্যে অতি সুলভ নয়। সেনারা বাস করে নগর থেকে অদূরে সেনানী গ্রামে। নগরের মধ্যে অল্পস্বল্প অস্ত্রধারী যাদের দেখা যায় তারা হল রাজভট এবং রক্ষী। রক্ষীদের আগার রয়েছে নগরের উত্তর ও দক্ষিণ প্রাকারের দ্বারের কাছে। রাজপুরীতেও অবশ্য আছে তারা যথেষ্ট সংখ্যায়।
পথে লোক অল্প। যারা চলছে, কৌতূহলের দৃষ্টি নিয়ে দুই অশ্বারোহীকে দেখছে। হয়ত রক্ষী ভাবছে। বিশেষত তারা চলেছে উত্তর সীমান্তের দিকে। তিষ্য তার অতিথিশালার দিকে বেঁকে যাবার সময়ে বলে গেল অপরাহ্ণে সে জীবকাবনে যাচ্ছে। চণক বলল—সে-ও যাবে।
কাননে ঢোকবার পর তার দাসেদের হাতে অশ্বটি দিয়ে চণক গৃহের দিকে চলল। মুক্ত বাতায়নপথে দেখা যাচ্ছে জিতসোমা রোদে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার পায়ের শব্দ শুনে ফিরে দাঁড়াল। সন্ধানী দৃষ্টি নিয়ে চণক দেখছে—না জিতসোমা হাসছে। সে দ্বার দিয়ে ঢুকে দাঁড়াতে এগিয়ে এসে তার বর্ম খুলতে খুলতে বলল—কী? যক্ষ-রক্ষ ধরতে পারলেন?
চণক হেসে বলল—আমরা ধরিনি, তবে শ্রমণ গৌতম ধরেছেন মনে হচ্ছে? সোমা অবাক হয়ে বলল—শ্ৰমণ গৌতম? যক্ষ ধরেছেন? ইন্দ্রজাল জানেন, না কী?
চণক বলল—কিছুই বুঝতে পারছি না। যক্ষিণীর শিশুপুত্ৰদুটিকে ধরে নিয়ে এসেছেন। এই দ্যাখো, একটি শিশু আমাকে কীভাবে কামড়ে দিয়েছে!
সোমা শিউরে উঠে হাতটি পরীক্ষা করতে করতে বলল—‘সর্বনাশ! যক্ষের শিশু! দাঁতে যদি বিষ থাকে।
চণক বলল—ভয় নেই গাছের পাতার নির্য্যাস দিয়ে ভিক্ষুরা মনোরম চিকিৎসা করেছেন। আর শিশুটি, যক্ষের ঘরের হলে হবে কি, অবিকল আমাদের ঘরের শিশুদের মতো দেখতে। শুধু অমাবস্যার আকাশের মতো ধুম্রবর্ণ। তার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দাঁতগুলিও অবিকল মানব-শিশুর দাঁতের মতো। দুধও খায়। যদিও আমাকে কামড়ে দিয়েছে, তবু রক্তপিপাসু বলে ঠিক মনে হল না। আজ অপরাহ্ণে যাবো। দেখি শ্রমণ গৌতমের কী পরিকল্পনা।
সোমা তার উষ্ণীষটি নিতে নিতে বলল—‘শ্ৰমণ গৌতম কেমন?’
—তোমার-আমারই মতো। আবার স্বতন্ত্র। সোমা শ্ৰমণ গৌতম অদ্ভুত মানুষ। এই দেখবে আকাশের চাঁদ, আবার পরক্ষণেই দেখবে পথের পাশে তোমার প্রতিদিনের দেখা তরু। তোমার দেখতে ইচ্ছা হয়?
—আগে হয়নি। আজ হচ্ছে। অপরাহ্ণে আপনার সঙ্গে যাবো।
চণক সাগ্রহে সম্মত হল। এই প্রথম সোমা বাইরে যেতে চাইল। কোনও বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করল।
এতদিনে এখানে এসেছে, কিন্তু সোমা রাজগৃহ চেনে না। এক অন্তঃপুর থেকে আরেক অন্তঃপুরে যাতায়াত করেছে শুধু। তক্ষশিলার পথ-ঘাট তবু চেনা ছিল। নিজস্ব যান তো ছিলই। পায়ে হেঁটে চলাফেরাও সম্ভব ছিল। রাজগৃহে সে বিদেশিনী। তাকে দেখলেই বিদেশিনী বলে চেনা যায়। এখানে সে বড় বেশি অপরের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।
অপরাহ্ণে সে দেখল দ্বারের কাছে একটি চারঘোড়ার রথ এসে থামল। চণক বলবামাত্র দাসেরা গিয়ে রাজপুরী থেকে রথ নিয়ে এসেছে। অতঃপর এই রথটি তাদের কাননেই থাকবে—রাজ-অশ্বশালার প্রধান বলে পাঠিয়েছেন।
আজ সোমা প্রথম এ নগরের পথঘাট দেখল। নিজেদের কাননে সে অবসর সময়ে ঘুরে বেড়ায়। তখন দেখে দূরের পাহাড়। কিন্তু সারাপথই যে এইভাবে পাহাড় সঙ্গে সঙ্গে যাবে সে জানত না। চণক তাকে দেখায়—‘ওই যে দূরে যে পাহাড় দেখছ। ওর ওপরে আছে তপোদারাম। পাহাড়ের অভ্যন্তর থেকে তপ্ত বারি বেরিয়ে আসছে। সর্বরোগহর।’
সোমা আশ্চর্য হয়ে বলল—‘এই নগরীর ওপর দেখি দেবতাদের অশেষ কৃপা! মহারাজ বিম্বিসার মহাত্মা বলেই কি অগ্নিদেব, বরুণদেব এভাবে তাঁকে আশীবাদ করছেন। আর্য?
চণক হেসে বলল—‘মহারাজ বিম্বিসারকে দেবতারা তপোদারামগুলি দেননি। এগুলি এবং অন্যান্য নানা সুবিধাগুলি আছে বলেই, চতুর রাজাটি এইখানে তাঁর রাজধানী স্থাপন করেছেন।
—কিন্তু এতো শ্ৰমণ! সন্ন্যাসী! দেখুন দেখুন!
পাহাড়ের দিকে দু’জন শ্ৰমণ চলে যাচ্ছেন সোমা দেখাল। তারপর বলল—আমি কানন থেকেও দেখি, আর্য। বহু শ্ৰমণ বাস করেন এখানে। এ-ও তো মহারাজের একটা পুণ্যফল!
—পাহাড়গুলি দেখেছ সোমা? শ্ৰমণ ও সন্ন্যাসীরা পাহাড়ে থাকতে ভালোবাসেন। তাই ওঁরা এতো অধিক সংখ্যায় আছেন এখানে। মহারাজও সব মত সব পথের সন্তদের সমাদর করেন। এদিকে শ্ৰমণ গৌতমকে তথাগত বুদ্ধ বলে প্রণাম করছেন, ওদিকে আবার নির্গ্রন্থ জ্ঞাতপুত্রকে জিন বলে সমাদর করছেন। অজিত কেশকম্বলীর নাম শুনেছ?
—কই না তো!
—উনি একজন অদ্ভুত শ্ৰমণ। সর্বাঙ্গে ভল্লুকের মতো রোম। নাস্তিক। কোনও দেবতায় বিশ্বাস করেন না। মনে করেন মৃত্যুর পর জীব চার মহাভূতে মিশে যায়, পুনর্জন্ম নেই। যতদিন জীবিত আছে, সৎভাবে সুখে বাঁচো।
—আশ্চর্য তো! আর্য চণক, এরূপ কি সম্ভব?
—কী সম্ভব সোমা?
—এই…দেবতা নেই। ব্রহ্মা প্রজাপতি নেই। মৃত্যুর পর দেহ মাটির সঙ্গে মিশে যাবে, এ-ও কি সম্ভব?
—দেবতারা আছেন কি না, প্রজাপতি আছেন কি না, কোনও মানুষ মৃত্যুর পর আবারও কোথাও জন্মগ্রহণ করেছে কি না তা-ও তো আমরা দেখিনি, জানি না সোমা। কোনও প্রমাণ নেই। কোথাও কেউ বলেছে সে ইন্দ্রকে দেখেছে? অগ্নির শিখার মধ্য থেকে কোনও দেবতাকে বেরিয়ে আসতে দেখেছে?
—তাহলে যজ্ঞে যে আমরা হবিঃ দান করি, সে কাকে, আর্য? পশুমাংস, যবের পুরো ডাশ আহুতি দিই, সে কি কোথাওই পৌঁছয় না?
—এঁরা বলছেন এইসব যাগযজ্ঞ, তিনবেদ, অগ্নিহোত্র, কিম্বা ত্রিদণ্ডধারণ, ভস্ম মাখা এগুলি সব পৌরুষ ও বুদ্ধিহীন মানুষের জীবিকা-অর্জনের উপায় মাত্র।
—কী আছে তাহলে? কোন আচরণই বা ঠিক আর্য!
—এখনও জানি না সোমা। তবে এতদিন যা পালন করে আসছি, বিশ্বাস করে আসছি তার ভেতর কোথাও একটা বিরাট ভুল বোঝা আছে যা এই মধ্যদেশের শ্রমণরা নাকি ধরতে পেরেছেন। আজ যে শ্রমণ গৌতমের কাছে যাচ্ছি, উনিও যাগযজ্ঞ মানেন না। তোমার যদি আগ্রহ থাকে, আজ যদি ওঁর কথা ভালো লাগে, তাহলে আমরা মাঝেমাঝেই ওঁর কাছে যেতে পারি।
সোমা বলল—মহারাজ বিম্বিসার জটাজুটধারী বেদবিৎ সন্ন্যাসীদেরও পূজা করেন কিন্তু। একইসঙ্গে বিপরীত মতবাদে বিশ্বাস করা যায়?
চণক হেসে বলল—মহারাজের সঙ্গে দেখা হলে, এরপর কথাটা তুমি নিজেই জিজ্ঞেস করো। তবে আমার মনে হয় রাজা-মহারাজাদের ক্ষেত্রে বিশ্বাসটাই বড় কথা নয়। নানা মতের চিন্তকদের সমর্থন পাওয়ার জন্যই এঁরা এরূপ করে থাকেন। এটা ধর্ম নয় সোমা, রাজনীতি। তুমি যে পুঁথির প্রতিলিপি করো সেখানে এ কথা পাবে। পিতা স্বয়ং লিখে গেছেন।
সোমা বলল—তাহলে আপনারা এতো চিন্তা করে যা স্থির করলেন, মহারাজ বিম্বিসার সহজাত বোধেই তা বুঝে গেলেন? ইনি তো সাধারণ রাজা নন!
চণক বলল—ইনি কোনমতেই সাধারণ রাজা নন। এ কথা একশবার সত্য। তবে ভুলো না, রাজনীতির পাঠ ইনি নেন আচার্য দেবরাতের কাছে।
—আর্য চণক, রাজশাস্ত্রে আপনি যে একরাট্ এর কথা বলেছেন, চক্রবর্তীর কথা বলেছেন, এই রাজা তা হতে পারেন না?
—ক্ষমতা আছে, অভিরুচি নেই বোধহয় সোমা।
—তাহলে সমগ্র জম্বুদ্বীপ জুড়ে এক চক্রবর্তীর রাজ্য যা আপনারা একান্ত প্রয়োজন বলে মনে করেন, তা কীভাবে সম্ভব হবে?
—অহিংসার পন্থ যেভাবে প্রচারিত হচ্ছে, তাতে ব্যাপারটা ক্রমশই কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। মৌলিক বেদপন্থা আমাদের বীরপুরুষ হতে বাধা দেয়নি। এই শ্রমণদের উপদেশ লোকে গ্রহণ করতে থাকলে কয়েক পুরুষের মধ্যেই আমরা নিবীর্য অস্ত্রভীরু হয়ে যাবো। রক্ত দেখলে মুর্ছা যাবো। —চণকের মুখ ক্রমশ গম্ভীর, চিন্তাকুল হয়ে উঠতে লাগল। —সে কিছুক্ষণ পরে বলল—কিন্তু এ-ও সত্যি যে বেরে কর্মকাণ্ড এখন এতো বিশদ হয়ে গেছে, সাধারণজনের জীবন থেকে এতো সরে গেছে যে বহু সৎ চিন্তাশীল মানুষের মধ্যেও প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। বেদের মন্দর সঙ্গে বেদের ভালোও এঁরা অস্বীকার করতে চাইছেন?
—কিন্তু বেদ তো অপৌরুষেয় আর্য। তাকে অস্বীকার করতে চাইছেন?
—বেদ অপৌরুষেয় কী অর্থে সোমা? আমি অনেক ভেবেছি। বেদ যে ধ্রুব নয়, সে-কথা কিন্তু প্রতিদিন প্রমাণ হয়ে যাচ্ছে, প্রমাণ করে দিচ্ছেন শ্রমণ গৌতম, যাদের দেবতা বলা হয়েছিল তারা যে প্রাকৃতিক বস্তু ও শক্তি এ বিষয়ে অনেকেই এখন নিঃসংশয়। তারপরে দেখো, বেদ ঋষিদের কাছে প্রকাশিত হয়েছিলেন এই কথাটি ধরেই আমি বলতে পারি আমার পরিচিত এক কবি বোধিকুমারের বর্যা-শ্লোকও তাঁর কাছে স্বপ্রকাশ হয়েছিল। এই কবি আমাকে বললেন তিনি আম্রকুঞ্জে বসেছিলেন, এমন সময়ে বৃষ্টি এলো। বৃষ্টি দেখতে দেখতে শ্লোকগুলি পরপর তাঁর সামনে যেন উদ্ভাসিত হল। সোমা এই শ্লোকসমূহকেও তাহলে অপৌরুষেয় বললা। ঋষি বামদেব তো এই অভিজ্ঞতার কথাই বলছেন, মনে পড়ছে?
সোমা বলল—“এতা অর্ষন্তি হৃদ্যাৎ সমুদ্ৰাৎ
শতব্রজা রিপুণা নাবচক্ষে।
ঘৃতস্য ধারা অভি চাকশীমি
হিরণ্যয়ো বেতসো মধ্যে আসাম্…”
—‘তবে?’ চণকের চোখদুটি হর্ষে জ্বলছে। সে বলল—এই যে শতধারায় উজ্জ্বল রসের ধারা হৃৎ-সমুদ্র থেকে বইছে, যার মধ্যে ঋষি সোনার বেতসের মতো দুলছেন—এ কি বোধিকুমারের মতো কোনও কবির অভিজ্ঞতা নয়? আবার দেখো ঋষির নিজেরও যে কিছু কর্তৃত্ব আছে ঋক্রচনায় তারও নির্ভুল প্রমাণ রয়েছে তক্ষ ধাতুর ব্যবহারে। অগ্নির উদ্দেশে ঋভুরা বাণীতক্ষণ করছেন, ইন্দ্রর জন্য মন্ত্ৰতক্ষণ করছেন নোধা গৌতম। অর্থাৎ সবটাই স্বতোৎসারিত নয়। সযত্নে কেটে-হেঁটে মসৃণ করে তবে মন্ত্র নির্মাণ হচ্ছে।
—তাহলে? আপনি কী বলতে চান? বেদ-বিদ্যাকে আমরা ত্যাগ করবো?
তা কেন সোমা! এতৎ সত্ত্বেও বেদ কিন্তু এক মৌলিক, বিশ্বজনীন চিন্তার অবয়ব নির্মাণ করে দিয়েছেন। যত বিচিত্র পথেই তোমার চিন্তা যাক না, তার সঙ্গে বেদের সম্পর্ক রয়েই যায়। বৈদিক চিন্তাই নানান নতুন মতের জন্ম দিচ্ছে ঠিক যেমন এক সিন্ধু পাঁচ নদীর জন্ম দিয়েছিল। যেমন এক গঙ্গা থেকে শত শাখানদী কত দিকে চলে যাচ্ছে।
—কিন্তু এই নাস্তিক্যবাদ?
—নাস্তিকরা যে চতুর্মহাভুত অর্থাৎ পৃথিবী, জল, অগ্নি ও বায়ুর কথা বলেছেন, সে চারটি তত্ত্ব তত বেদেই রয়েছে। ধরো আমি যদি বলি, যাকে এঁরা বস্তু বলে উপস্থিত করছেন, বেদের ঋষি তাকেই দেবতা বলে স্তুতি করেছেন, মানুষের জীবনে তার অশেষ প্রভাবের কথা স্মরণ করে?
—কিন্তু শেষ পর্যন্ত বেদ তো দেবলোক, অমৃতলোকে বিশ্বাস করেন।
—সোমা, তুমি ব্রহ্মবাদের কথা শুনেছ নিশ্চয়ই। জৈবলি প্রবাহণ থেকে বাজসনেয় যাজ্ঞবল্ক্য পর্যন্ত সবাই ব্রহ্মের কথা বলছেন।
—শুনেছি। আমি ঠিক বুঝতে পারি না।
—ঋক্ সংহিতার দশম মণ্ডলে নাসদীয় সূক্ত ব্যাখ্যা করেছিলাম। মনে আছে সোমা?
নাসদাসীন্ নো সদাসীত্ তদানীং নাসীদ্ রজো নো ব্যোমা পরো যৎ
কীমাবরীবঃ কুহ কস্য শর্মন্ অম্ভঃ কিমাসীদ্ গহনং গভীরম্…?
তখন অসৎ ছিল না, সৎ ছিল না, কোনও লোক ছিল না, সব লোকের পারে যে ব্যোম তা-ও ছিল। কে কাকে আবৃত করবে? কার আশ্রয়ে? গহন গভীর যে সলিল, তা-ও তো ছিল না।
সোমা বলল—মৃত্যু ছিল না। অমৃত ছিল না। দিনরাত্রির কোনও চিহ্ন ছিল না। আপন শক্তিতে নিবায়ু অবস্থাতেও নিঃশ্বাস নিচ্ছিলেন সেই একম্।
চণক স্মিত মুখে বলল—এই তো, তোমার স্মরণে আছে!দেখো, এই যে নেই, আবার প্রাণন কার্য করছে, এই ধরাছোঁয়ার বাইরে বিশ্বের আদি প্রাণ—এর থেকে যেমন ব্রহ্মবাদ, তেমন নাস্তিক্যবাদও এসেছে বলে আমার মনে হয়। এই অজ্ঞেয়তার মধ্যে, জীবনের মূল কোথায় এই প্রশ্ন করতে জীবনের পরিণতি সম্পর্কেও জিজ্ঞাসা জাগে। নাস্তিকরা এই অজ্ঞেয়তাবাদের মধ্য থেকে সংশয়টুকু তুলে নিয়েছেন। তাকেই পুষ্ট করেছেন। এখন বলছেন প্রত্যক্ষ ব্যতীত কোনও প্রমাণ মানব না। শ্ৰমণ গৌতম কিন্তু পুনর্জন্ম মানেন। তিনি কী বলতে চান দেখা যাক।
জীবকাম্রবনে আজ শ্রোতার সংখ্যা অন্যান্য দিনের মতো নয়। অন্য দিন ভরা দিঘির মতো লাগে শ্ৰমণ গৌতমের দেশনাস্থল। চণক ইতস্তত দৃষ্টিপাত করে দেখল কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তি রয়েছেন। যেমন রাজগৃহ-শ্রেষ্ঠী অহিপারক, রক্ষী-জেষ্ঠক, কয়েকজন পরিচিত রাজপুরুষ, ভিক্ষুরা এবং ভিক্ষুণীরা। শ্ৰেষ্ঠীদের গৃহ থেকে রমণীরাও এসেছেন। জিতসোমা তাঁদের কাছে গিয়ে বসল।
বর্ষার অন্তে বুদ্ধ পরিব্রজন করেন। করেন অন্যান্য ভিক্ষুরাও। ভিক্ষুণীদের মধ্যে যাঁরা ইচ্ছা করেন, তাঁরাও যান। রাজগৃহের বুদ্ধভক্ত সাধারণজন অনেকেই জানে না বুদ্ধ এখন ঠিক কোথায়। চণকের পাশে বসা এক বর্ষীয়ান কুলপুত্র পাশের জনকে জিজ্ঞেস করলেন—ভগবান আর কতদিন রাজগৃহে থাকবেন, জানো না কি? দ্বিতীয় ব্যক্তি বললেন—উনি তো ঠিক রাজগৃহে নেই। সেনানীগ্রাম ছাড়িয়ে চলে গিয়েছিলেন। কোনও কারণে আবার এসেছেন। হয়ত কালই দেখবেন, চলে গেছেন।
তিষ্য এসে চণকের পাশে বসল। চণক দেখল মহারাজ বিম্বিসার আসছেন। নিজস্ব কুটি থেকে শ্ৰমণ গৌতম বেরোলেন। সংঘাটিতে ভালোভাবে সারা দেহ আচ্ছাদিত। পেছনে পেছনে আনন্দ আসছেন। সকালে দেখা সেই শ্ৰমণ দুটিকেও বসে থাকতে দেখল সে।
তিষ্য মৃদুস্বরে বলল—আনন্দ নামে ওই শ্ৰমণটির কথা কিছু জানেন?
—উনি শ্ৰমণ গৌতমের কেমন ভাই হন।
—তাই এত মিল! অর্থাৎ ইনিও শাক্য! শাক্যদের কী দুর্দিন চণকভদ্র! একেই তো ওরা কোশলের পদানত হয়ে গেছে। তার ওপর এঁদের মতো সক্ষম, প্রতিভাবান পুরুষরা সব সংসার ত্যাগ করলেন।
—শুধু ইনি নন তিষ্য, চণক বলল, শাক্যদের আরও রাজকুমাররা নন্দ, অনিরুদ্ধ, ভদ্রিক, ভৃগু, কিম্বিল এঁরা, শ্ৰমণবুদ্ধের মা, পত্নী পুত্র, বহু শাক্যরমণী সংঘে প্রবেশ করেছেন।
তিষ্য বলল—শ্ৰমণ গৌতমের মা ও পত্নী, কিংবা শাক্যরমণীদের প্রব্রজ্যা নেওয়া বুঝতে পারি। কিন্তু যুবক রাজকুমাররা কেউ স্বদেশ স্বজাতির প্রতি তাঁদের কর্তব্যের কথা ভাবলেন না? একেই তো স্বাধীনতা হারিয়েছেন।
—হয়ত সেটাই কারণ তিষ্য। দীর্ঘদিন ধরে পরসেবী থাকতে থাকতে একটা জাতির মধ্যে গভীর আত্মগ্লানি জমা হতে পারে, আত্মগ্লানি থেকেই দুঃখবাদ, ঔদাস্য, সংসার-বিরাগ।
—কিন্তু চণকভদ্র, হৃত স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের চেষ্টাও তো এঁরা করতে পারতেন।
—তার আগে বলো, বিজিত জাতি রূপে কোশলের কাছে এঁরা কী ব্যবহার পান?
তা যদি বলেন, কোশলরাজ এঁদের যথেষ্ট সম্মান করেন। কপিলবস্তু এবং সন্নিহিত অঞ্চলে রোহিণী নদীর ওপারে শাক্যরা নিজেদের মতো থাকেন। কুলগৌরব অত্যন্ত বেশি। অহঙ্কারী বলা যায় এঁদের। কেননা, অন্যান্য বিজিত জাতির মতো এঁরা শ্রাবস্তীর রাজসভায় কোনও কাজ নেননি এসে। বন্ধুল, কোশলের সেনাপতি মল্ল জাতীয়। বজজি ও শাক্যদের মতো মল্লদেরও এক সময়ে সমৃদ্ধিশালী রাজ্য ছিল। কিন্তু এখন সে সব ভেঙে গেছে খুব সম্ভব অন্তর্কলহের ফলে। পাবা আর কুশীনারায় ওঁদের দুটি শাখা রয়েছে কোনওক্রমে টিকে। বন্ধুল বলেন, বদ্ধ জলের মতো সে-সব মল্লরাজ্য। তিনি তো কোশলরাজ্যের কাছে কাজ নিয়েছেন। সৈনাপত্য করেন বলে তবু খানিকটা সম্মান, প্রতিষ্ঠা ও সন্তোষ পেয়েছেন।
সামনের পঙ্ক্তিতে বসা একজন সম্রান্ত ব্যক্তি মুখ ফিরিয়ে বললেন—কী তখন থেকে বকবক করছেন? দেখছেন না ভগবান তথাগত সভায় এসে গেছেন।
তিষ্য আরক্ত মুখে নীরব হয়ে গেল। তার কপালে ভ্রূকুটি।
ওদিকে মহারাজ বিম্বিসার উঠে দাঁড়ালেন বলে উঠলেন—আপনার কাছে কিছু নিবেদন ছিল ভন্তে।
বুদ্ধ নিজের আসন থেকে বললেন—বলুন মহারাজ।
—আমি সংবাদ পাচ্ছি বহু সৈনিক নাকি পব্বজ্জা নেবার উদ্যোগ করছে। এ কথা কী সত্য ভন্তে?
—হতে পারে, ধীর গলায় বললেন তথাগত। মহারাজ, সেনানী গ্রামে কদিন দেশনার পর উত্তরোত্তর ভিড় বাড়ছিল।
—কিন্তু ভন্তে, সৈনিকরা যদি সন্ন্যাসী হয়ে যায়, রাজ্য রক্ষা করবো আমি কাদের দিয়ে? বুদ্ধ স্তব্ধ হয়ে রইলেন।
সমস্ত সভাও সেই সঙ্গে স্তব্ধ।
—মহারাজ, বুদ্ধর গম্ভীর অনুরণনময় কণ্ঠ শোনা গেল—মানুষ বদ্ধ জীব। জীবনের বন্ধন। কর্মের বন্ধন। সমাজ পরিবার পরম্পরার বন্ধন। সর্বত্রই শুধু অধিকার হরণের খেলা। একমাত্র পব্বজ্জা গ্রহণের অধিকার কেউ কেড়ে নিতে পারে না।’
—কিন্তু ভগবান, জাতির প্রতি, দেশের প্রতি দায়িত্ব বলেও তো কিছু আছে! আজ আমি যদি পব্বজ্জা নিয়ে চলে যাই, মগধবাসীর প্রতি তা সুবিচার হবে কী?
—তবু আপনার সে অধিকার আছে মহারাজ।
অধিকার থাকুক। আমার দায়িত্ববোধ আমাকে উপাসকত্ব নির্বাসন করতে বলে। মগধবাসীর মুখ চেয়ে।
—হয়ত আপনার মনে পূর্ণ বৈরাগ্য উদয় হয়নি, মহারাজ।
—এ কথা বহু সৈনিকের সম্পর্কে, আরও বহু পব্বজ্জাকামী মানুষের পক্ষেও সত্য হতে পারে ভগবন। বৈরাগ্য উদয় হয়নি। কিন্তু কর্মত্যাগ করার সুযোগ অনেকেই ছাড়তে চায় না। যুদ্ধক্ষেত্র, সংগ্রাম, প্রাণ যাবার সম্ভাবনা, এ সবের চেয়ে শ্ৰমণ-জীবন যাপন করা অনেক নির্ঝঞাট ব্যাপার।
কিছুক্ষণ সব স্তব্ধ। তারপর বুদ্ধ বললেন—তাই হবে। সৈনিকরা সংঘে প্রবেশ করতে পারবে। তিনি স্তব্ধ হয়েই বসে রইলেন। ধীরে ধীরে তাঁকে নমস্কার করে অধিকাংশ লোকই চলে গেল! আজ দেশনা হবে না, বুঝতেই পারা যাচ্ছে।
মহারাজ বিম্বিসার মাথা নত করে বসে আছেন। সভা প্রায় শূন্য হয়ে এলে তিনি বললেন—আমার উপায় ছিল না ভগবন্। তথাগতের পথ আর রাজকর্তব্যের পথ, দুটির মধ্যে একটা সামঞ্জস্য থাকা প্রয়োজন…
—সামঞ্জস্যের চেষ্টা যে তথাগত করছেন না, এ কথা তো সত্য নয় মহারাজ! আপনার অনুরোধেই উপোসথ প্রবর্তিত হয়েছে প্রতি পূর্ণিমাতে, অমাবস্যায় শুধু লোর্করীতির প্রতি শ্রদ্ধাবতশই, নয়তো সংঘবাসী ভিক্ষুরা তো সর্বদাই সংযম পালন করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, স্বতন্ত্রভাবে উপপাসথের সংযমের কোনও প্রয়োজন নেই।…
এই সময়ে বিপরীত দিক থেকে একটা ক্রুদ্ধ চিৎকার, কিছু বাদ-প্রতিবাদের শব্দ শোনা গেল। অচিরেই সভাস্থলে ঝড়ের মতো প্রবেশ করল এক নারী। কৃষ্ণকায়। চুলগুলি পিঙ্গলবর্ণ, অপরিচ্ছন্ন, মাথার চারপাশে যেন বিষধর সাপের মতো ফোঁস ফোঁস করছে। ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত। সামান্য একটি মলিন, ছিন্ন বসন কোনমতে কটিতে জড়ানো।
—আমার ছেলে দুটো কে হরেছে, কে হরেছে? বলতে বলতে সে তার লাল চোখ চারদিকে ঘোরাতে লাগল।
বুদ্ধ ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছেন। বললেন—কে তুমি, জননী!
—হারিটি, আমি হারিটি। আমার ছেলে কে হরেছে? তুই? বলে যক্ষিণী বুদ্ধর দিকে ধেয়ে গেল। দীর্ঘ নখ সমেত তার হাতগুলি সামনে প্রসারিত। তিষ্য এবং চণক সবিস্ময়ে দেখল, যক্ষিণী বুদ্ধের বেদীর ওপর আছড়ে পড়েছে। বুদ্ধ সরে গেছেন। যক্ষিণী আবার উঠে ক্রোধে অন্ধ হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল। পেছনের আম গাছের কাণ্ডে এবার আছড়ে পড়ল সে। বুদ্ধ সরে গেছেন। এইভাবে সে ডাইনে ঝাঁপালে বুদ্ধ বাঁ দিকে সরেন, সে বাঁ দিক ঝাঁপালে তিনি চকিতে ডাইনে সরে যান, কিছুক্ষণের মধ্যেই হারিটির মুখে, বুকে রক্ত দেখা দিল। সে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে ক্ষান্ত হল। গর্জনের সঙ্গে কান্না মিশিয়ে সে বলল,—আমার ছেলে দে! জাদুকর!
বুদ্ধ বললেন—আমাদের শিশুগুলি দাও আগে।
—তোদের ছেলে আমি জানি নে, জানি নে।
—তোমার শিশুদের কথাও আমি জানি না।
তখন যক্ষী কাঁদতে লাগল। সে কী ভয়ানক কান্না! ঝড়ের পরে যেন প্রচণ্ড বৃষ্টি নেমেছে।
—ও যতি, আমার ছেলে দে। ও জাদুকর, আমার ছেলে দে। আমি ওয়াদের না দেখে থাকতে পারি নে। ও যতি, আমার বুক টনটনাচ্ছে। কতক্ষণ ওয়ারা এসে দুধ খায়নি। —কাঁদে আর দাঁত কড়মড় করে সে।
আরও একটি কালো ছায়া প্রবেশ করল ধীরে ধীরে। একটি নগ্নপ্রায় পুরুষ। এতক্ষণ সম্ভবত গাছের আড়ালে লুকিয়েছিল। সে এগিয়ে আসতে তিষ্য এক দিক থেকে, চণক এক দিক থেকে তাকে শক্ত করে ধরল। যক্ষিণীটি এমন অতর্কিতে এসে হানা দিয়েছিল, যে তারা কিছু বোঝবার আগেই সে বুদ্ধকে আক্রমণ করে।
যক্ষ বলল—আমি কিছু করব না, আমাকে ছেড়ে দিন। আমি পাঞ্চি। হারিটি আমার বউ। ও জ্ঞান হারিয়েছে দুঃখে। ওকে নিয়ে যাবো।
বুদ্ধ বললেন—পাঞ্চি রাজগৃহের শিশুগুলিকে ফিরিয়ে দাও। তাদের মায়েরা ঠিক তোমার পত্নীর মতোই শোকে জ্ঞান হারিয়েছে।
পাঞ্চি বলল—কী করে ফিরিয়ে দেবো? সেগুলিকে তো হত্যা করে খেয়ে ফেলেছি।
অমনি চারদিক থেকে একটা হুতাশের ধ্বনি উঠ। সমবেত ভিক্ষুরা, উপস্থিত রমণীরা যে যেখানে ছিলেন সবাইকার বুক চিরে একটা আর্তনাদ। কোনও কোনও রমণী অজ্ঞান হয়ে গেলেন। আম্রবনে একটা যেন সাড়া পড়ে গেল, কে জল আনছে। কে কাকে ডাকছে প্রাণপণে।
এরই মধ্যে বিম্বিসার তাঁর রক্ষীদের ইঙ্গিত করলেন, তারা গিয়ে হারিটিকে ধরল।
বুদ্ধ বললেন—এখানে যাঁরা রয়েছেন কেউ শিশুগুলির মাতা বা পিতা নয়, তবু এঁরা দুঃখে মূৰ্ছিত হয়ে পড়ছেন। হারিটি তুমি কি ভেবেছিলে, তুমি একাই মা? তোমার শিশুই শিশু? আর কেউ মা নয়, অন্য মায়েদের শিশুগুলিকে তাদের মায়েরা স্নেহ করে না?
হারিটি তীব্র স্বরে বলল—অজ্জদের আমরা আমাদের মতো ভাবি না! ভাবি না। তারা আমাদের বন নিয়ে নিয়েছে। পশুগুলো মেরে শেষ করে দিয়েছে। আমরা ভিক্ষে করে খাই। তাও এই নগরের লোকেরা মুখের ওপর দোর বন্ধ করে দেয়। বলে বন্য, ঘৃণ্য, কুৎসিত, কদাকার। কী করে জানব অজ্জরা ছেলেদের ভালোবাসে!
বিম্বিসার রুক্ষ কণ্ঠে বললেন—রক্ষীন, এই যক্ষ-যক্ষী দুটিকে বন্দীশালায় নিয়ে যাও।
—একটু অপেক্ষা করুন মহারাজ, বুদ্ধ বললেন—হারিটি, পাঞ্চি—কান্না থামাও! শুনতে পাচ্ছো? শুনতে পাচ্ছো! তাঁর কণ্ঠ যেন জলভরা মেঘের ডাকের মতো সজল, গম্ভীর।
চণক দেখল রমণীরা সকলেই কাঁদতে কাঁদতে ক্রমশ উত্তাল হয়ে উঠছে। ভিক্ষুদের চোখ দিয়ে দরদর ধারে জল পড়ছে।
আনন্দ মুখ ঢেকে বসে আছেন। ভিক্ষু ধর্মরুক্ষিত হাহাকার করে বললেন—তোমরা আমাকে নিয়ে গেলে না কেন? আমাকে হত্যা করে ক্ষুণ্ণিবৃত্তি করতে পারতে, আর্যদের ওপর তোমাদের এত রাগ! আমাদের মতো সংসার-বিরক্ত পরিব্রাজকের হত্যা করে শোধ তুলতে পারতে। শিশুগুলি, আহা অবোধ শিশুগুলি তো কিছুই জানে না, কিছুই করেনি। পাপ কী, এখনও তা জানে না! কী করলে তোমরা! এ কী করলে! বলতে বলতে ভিক্ষু ধর্মরক্ষিত কাঁদতে লাগলেন।
তখন একটি অদ্ভুত দৃশ্যের সৃষ্টি হল। বুদ্ধ দাঁড়িয়ে আছেন অম্ব বৃক্ষতলে বেদীর ওপর। মুখের ভাব অসাধারণ কোমল, করুণ। চোখ দুটি ভরা দীঘির মতো। মহারাজ বিম্বিসার বসে আছেন প্রস্তরমূর্তির মতো। রক্ষীগুলি হাতের পাতা দিয়ে চোখ মুছছে। তিষ্য প্রাণপণে আত্মসংবরণের চেষ্টা করছে, পারছে না। চণক আরেক প্রস্তর মূর্তি। ভিক্ষুগুলি অস্ফুটে হাহাকার করছেন। ওদিকে রমণীদের মধ্যে মুর্ছা, পতন, হাহাকার চলছেই, চলছেই।
হঠাৎ হারিটি ভূমিতে সাষ্টাঙ্গ পড়ে গেল। উপুড় হয়ে। সে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। পাঞ্চিও বসে পড়েছে। দু হাতে সে নিজের বুকে আঘাত হানছে। —উঃ, শিশুগুলিকে আমরা খেয়েছি। শিশুগুলিকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে খেয়েছি। আমাদেরই শিশু তারা। আমাদেরই..আমাদেরই…
পাঞ্চি দু হাত বাড়িয়ে বলল—ধরো, বাঁধো, আমাকে নিয়ে যাও গো রক্ষীরা। মেরে ফেলো।
হারিটি বলল—ও জঙ্গল-মা, জঙ্গল-মা, ও বেলগাছের দেবতা, বটগাছের দেবতা আমি সইতে পারছি নে। আমাকে মেরে ফেলল। মেরে ফেললা গো!
বুদ্ধ মৃদু, দৃঢ় স্বরে বললেন—মহারাজ ওদের ধরার, বন্দী করার প্রয়োজন নেই।
তিনি ধীরে ধীরে বেদী থেকে নেমে নিজের কুটির দিকে চলে যেতে লাগলেন। তাঁর পেছন পেছন চলে গেলেন ভিক্ষুরা, ভিক্ষুণীরা। সবাই স্তব্ধ, যেন এক শোকযাত্রা চলেছে। আম্রবনের পত্ৰজাল যেন শোকে ধূসর হয়ে গেছে।
মহারাজ বিম্বিসার রক্ষীসহ বেরিয়ে এলেন। চণক ও তিষ্য বেরিয়ে এলো। সোমা বেরিয়ে এলো। নিস্তব্ধ মানুষগুলি যে যার গৃহের দিকে চলে গেল। যেন সবাই একটা গভীর বিষাদের ঘোরের মধ্যে রয়েছে।
তিষ্য আজ আর নিজের আবসাথাগারের দিকে গেল না। চণকের সঙ্গে জম্বুবনে প্রবেশ করল।
আসনশালায় বসে চণক মদৃস্বরে জিজ্ঞাসা করল—সোমা, কেমন দেখলে?
সোমার চোখ দুটি এখনও অরুণবর্ণ হয়ে রয়েছে। সে বল—বুদ্ধ তথাগত যে মানববেশী দেবতা তাতে কোনও সংশয়ই নেই।
চণক বলল—বড় তৃষ্ণা, সোমা, কিছু পানীয়ের ব্যবস্থা করো।
দুজন দাসী এসে দাঁড়িয়েছিল, সঙ্গে সঙ্গে ভেতরে চলে গেল। স্ফটিকের পাত্রে পানীয় এলো। সোমা পাত্র তুলে দুই বন্ধুর হাতে দিল।
চণক বলল—তুমি নাও সোমা। সে তিষ্যর দিকে ফিরে বলল—তুমি কি সোমার সঙ্গে একমত? শ্ৰমণ গৌতম মানববেশী দেবতা?
তিষ্য বলল—ওঁকে যে মহারাজ বিম্বিসার সেনাপতির পদ দিতে চেয়েছিলেন, শুধু শুধু নয়।
—এ কথা কেন বলছেন? সোমা জিজ্ঞাসা করল।
তিষ্য বলল—ভদ্রে, আমি মল্লবিদ্যা শিক্ষা করেছি ভালা করে, যদিও শিক্ষা সম্পূর্ণ হয়েছে বলে মনে করি না এখনও। কিন্তু আমার আচার্য বন্ধুলকে দেখেছি তো! ইনি, এই বুদ্ধ, তাঁর চেয়েও কুশলী। মল্লক্ষেত্র আর শাক্যক্ষেত্র প্রায় পাশাপাশি। ইনি মল্লবিদ্যার এই দ্রুত স্থান-পরিবর্তনের প্রক্রিয়া এমন শিখেছেন যে, সহসা দেখলে ইন্দ্রজাল মনে হয়।
চণক উচ্চৈঃস্বরে হেসে উঠল, বলল—তিষ্য, তুমি সংশয়ী বটে! অজিত কেশকম্বলী কিংবা প্রক্রুধ কাত্যায়নের থেকেও।
তিষ্য হাসল, বলল—কিন্তু চণকভদ্র, ইনি আমাকে চমৎকৃত করেছেন অন্য কারণে।
—বলো শুনছি—চণক পানীয়ে চুমুক দিয়ে বলল।
—চণকভদ্র, জীবনে এই প্রথম আমি কাঁদলাম। সে কী বিপুল দুঃখের বেগ ভদ্রা, আপনিও বোধ হয় তার থেকে মুক্ত ছিলেন না। চণক আমি দেখলাম, চোখের সামনে দেখতে পেলাম যেন নিস্পাপ শিশুগুলিকে এরা দুজনে মিলে হত্যা করছে। সেই অগ্নিকুণ্ডটি চোখের সামনে ভাসিত হল। আধপোড়া শিশুদের শব.। ওহ্, চণক, আমার কিন্তু ক্রোধ হল না। সঙ্গে সঙ্গে বধ করতে পারতাম ওই যক্ষীকে। কিন্তু ক্রোধের আগুন যেন নিবিয়ে দিল দুঃখের জল। যতক্ষণ বেদীর ওপর দাঁড়িয়ে গৌতম ওইভাবে কথা বলছিলেন বা শুধু দাঁড়িয়েছিলেন সমগ্র আম্রবনে করুণা, ক্রন্দনের একটা তরঙ্গ উঠছিল। এত তীব্র যে কাননের গাছগুলিও বোধ হয় তা থেকে মুক্ত ছিলে না।
একটু থামল তিষ্য। তারপর বলল—চণকভদ্র, আপনি বুঝতে পারছেন আমি কী বলছি?
—বুঝেছি,তুমি ওঁর প্রভাবশক্তির কথা বলছ।
—এ প্রকার প্রভাব ঋদ্ধিমান পুরুষ না হলে থাকে না—সোমা বলল। পানীয়টি এখনও তার হাতে ধরা—তা ছাড়া আর্য চণক, আমরা কি একটা বাইরের প্রভাবে অত কষ্ট পেলাম! তা নয়, আমাদের হৃদয়ের মধ্যে যে বৎসহারা জননীর ব্যথা আছে, তাকেই উনি যেন চেতিয়ে তুললেন। সেই ব্যথার সূত্র ধরে এলো আমার ব্যক্তিগত সমস্ত ব্যথার দুঃখ, তারপর…তারপর আরও যে যেখানে আছে, সবার সর্বপ্রকার দুঃখের মধ্যে মিলে গিয়ে তা এক মহাদুঃখ হয়ে হৃদয় দীর্ণ করতে লাগল। অন্তত আমার।
তিষ্য মুখ নত করে বলল—আমারও ঠিক এই অনুভূতি। ঠিক এই। ভদ্রা অবিকল বর্ণনা দিয়েছেন। হৃদয়টি যেন ইন্দ্রকীল, দুঃখগুলি সব হস্তিযূথ। প্রাণপণে হৃদয় ভেঙে দিচ্ছে।
সোমা পানপাত্র নামিয়ে ত্বরিতপদে ভেতরে চলে গেল। অনেকক্ষণ পরে তিষ্য মৃদুস্বরে বলল—চণকভদ্র উনি কে? এই ভদ্রা?
—ওঁর পূর্ণ পরিচয় তোমায় পরে দেব তিষ্য। এখন শুধু জেনে রাখো এই নারী বিদূষী, সঙ্গীত নৃত্য ইত্যাদি বহু চারুকলায় এঁর সমকক্ষ পাওয়া কঠিন কাজ। ইনি আমাদের পিতা-পুত্রের জীবনের প্রধান কৃতি রাজশাস্ত্রের প্রতিলিপি প্রস্তুত করছেন।
—ইনি আপনার পত্নী বা পত্নীস্থানীয়া নন? সসঙ্কোচে জিজ্ঞেস করল তিষ্য।
—না, না। তিষ্য, একেবারেই না।
দাসীরা এসে জানাল—রাত্রের আহার্য প্রস্তুত।
বহু প্রকার খাদ্য-দ্রব্য ভারে ভারে সামনে এনে রাখল দাসীরা। অদূরে ছায়ামূর্তির মতো বসেছে সোমা। কারওই আহারে তেমন রুচি নেই। সোমাও কাউকে দ্বিতীয়বার অনুরোধ করছে না। সে জানে আজ এদের খাদ্যে রুচি থাকবে না। তিষ্য অবশেষে দুধের পাত্র তুলে নিল। পান করতে করতে ভাবল—এই ভদ্রা কে? ইনি ব্যক্তিগত দুঃখের কথা কী বলছিলেন! এঁর মুখশ্রী গম্ভীর। বৃথা ভদ্রতা করেন না। এঁর ব্যক্তিগত দুঃখগুলি কী? এখন যেমন স্থির বসে রয়েছেন, আম্রবনেও তেমনি ছিলেন। শুধু চোখ দিয়ে জল পড়ছিল। গাল ভেসে যাচ্ছিল। ইনি বিবাহিতা বলে মনে হচ্ছে না। অথচ বৎসহারা জননীর কথা কী যেন বলছিলেন?
২৭
নগরীতে ভয়ানক গোলমাল। চণক তিষ্যকে নিয়ে যাচ্ছিল এক গোষ্ঠীতে। বোধিকুমার, চারুবাক এঁরা তো থাকেনই, আরও চার-পাঁচজন বিশিষ্ট কবি, বিদ্বান, কুলপুত্র আসেন এখানে। চণকের উদ্দেশ্য ছিল তিষ্যকে এদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া। একটু আগেই বেরিয়েছে ওরা। চণক বলল— চলো অনুচিত্তর পানাগারে গিয়ে কিছুক্ষণ বসি। এত শীঘ্র গেলে হয়তো অনর্থক অপেক্ষা করতে হতে পারে।
অনুচিত্তর পানাগারটি হাটের একেবারে মধ্যিখানে। নানা ধরনের লোকেরা তার ক্রেতা। দুধারে গন্ধ, মাল্য, ফুল ইত্যাদির আপণ। এইখানেই কয়েস মাস আগে একটি মাগধ চর, কিংবা হয়ত চর নয়, চতুর এক নাগরিক চণকের ছদ্মবেশ ভেদ করে তাকে মহা অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছিল। স্থানটি প্রধান রাজপথের একটি শাখা, বৈপুল্লগিরি থেকে যাওয়া-আসার পথে পড়ে। প্রধান রাজপথগুলির দু পাশে কানন, প্রাসাদ। প্রাসাদগুলিও অধিকাংশই কানন বেষ্টিত। কিন্তু হাট বা কোনও আপণ নেই। মৎস্য, মাংস, শাক এবং অন্যান্য খাদ্যবস্তুর হাট উত্তরের এবং দক্ষিণের দুটি উপপথে রয়েছে। সেখানেও পানাগার আছে, তবে তা একেবারে নিম্নশ্রেণীর জন্য। বৈপুল্লগিরির সানুদেশের এই পথটিকে বিলাসদ্রব্যের হাট বলা যায়। সূক্ষ্ম বসন, শিশুদের খেলনা, কিংবা অন্য শিল্পদ্রব্য যেমন ইন্দ্রর মূর্তি যক্ষিণী মূর্তি—এ সবই এখানে পাওয়া যায়।
মালা কিনবার জন্য দুজনে একটি বড় আপণের সামনে থাকল। আপণের সামনে কয়েকজন বেশ উত্তেজিত হয়ে কথা বলছিল।
একজন আরেক জনকে বলল—তুমিই বলো না অসুরেন্দ্র, এর পর ওই মুণ্ডক শ্ৰমণ রাজ্য চালাবে,
আমাদের মহারাজ! অন্যান্য শ্রমণরা নিজেদের আধ্যাত্মিক ব্যাপার নিয়ে থাকেন। ধ্যান-ধারণা করেন, লোকে চাইলে উপদেশ বা ভাষণ দেন, দুটি ভিন্ন পন্থের মধ্যে বিতর্ক হলেও আমরা উপকৃত হই। উত্তেজক হয় ব্যাপারটা। এই মুণ্ডকের মতো কেউ সব বিষয়ে নাক গালচ্ছে কী? কাকে শাস্তি দিতে হবে না-হবে, সে রাজা বুঝবেন!
অসুরেন্দ্র নামে লোকটি বলল—রাজা নিজেই সমাদর করে করে এঁর মাথাটি চর্বণ করেছেন। এখন বুঝুন!
তিষ্য এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল—কী হয়েছে ভদ্র?
অসুরেন্দ্র বলল—আর বলবেন না আয়ুষ্মন্ আমরা এই রাজগহের নাগরিকরা জ্বলেপুড়ে গেলাম, জ্বলেপুড়ে গেলাম। আপনি নিশ্চয়ই এখানে আগন্তুক?
—হ্যাঁ, দু এক মাস হল এসেছি।
—তাই জানেন না। এক ন্যাড়ামুণ্ড শ্রমণ কয়েক বছর ধরেই এ নগরে যাতায়াত করছে। নিজেকে বলে বুদ্ধ। আমাদের মহারাজকে এমনভাবে সম্মোহিত করে ফেলেছে যে তিনি এর সমস্ত বাক্য বেদবাক্যের মতো মানতে আরম্ভ করে দিয়েছেন।
এই সময়ে অন্য একটি লোক মৃদুস্বরে কী বলল। অসুরেন্দ্র তাতে একটু না দমে বললেন—চর? চর আমার কী করবে? আমি অন্যায় কিছু বলেছি? যক-যক্ষিণী নাগরিকদের শিশু চুরি করে নিয়ে গিয়ে খেয়ে ফেলল। কেউ তাদের ধরতে পারছিল না। কী করে ধরবে! ভিক্ষুক সেজে ছল করে লোকের বাড়িতে ঢুকত আর শিশুগুলিকে চুরি করত। ওই মুণ্ডকের বুদ্ধিতে না হয় তাদের ধরা গেল। রাজার রক্ষীরা তাদের বেঁধেছিল, এমন সময়ে মুণ্ডক কি না বলে ওদের ছেড়ে দাও! মহারাজও দিব্য ছেড়ে দিলেন! শুনছি নাকি আবার সাক্কপুত্তীয় সমনরা নিজেরে ভিক্ষাভাগ ওদের নিত্য দেবে। ওদের দুঃখে হৃদয়গুলো সব গলে জল হয়ে গেছে। রাক্ষসীর উদরে যে আমাদের শিশুগুলি জীর্ণ হচ্ছে সেটা কিছু না। রাজা নাকি যক্ষিণীর পল্লীতে রক্ষী নিয়োগ করেছেন, যাতে ওদের কেউ ক্ষতি করতে না পারে।
মালা কিনে চণক ততক্ষণে পানাগারের দিকে পা বাড়িয়েছে। তিষ্যর পেছন পেছন রাজগৃহর এই নাগরিকগুলিরও একই গন্তব্য। যে-যার আসনে বসে, সুরার কথা বলে আবার একই প্রসঙ্গ আরম্ভ করল ওরা।
কয়েকটি পীঠের ওপর পরিষ্কার ভুল আচ্ছাদন পেতে দিয়েছে এরা। উপাধান ইতস্তত ছড়ানো। চতুর্দিকে ফুলের মালা ঝুলছে। কয়েকটি বড় বড় মাটির কলসে সুরা রয়েছে নানাপ্রকার। তীক্ষ্ণ এবং মৃদু উভয়ই রয়েছে। অনুচিত্তর দুজন সুবেশ দাস ও সুকেশী দাসী সুন্দর কৃষ্ণবর্ণ মৃৎপাত্রে সুরা পরিবেশন করছিল।
চণক পানীয়ে চুমুক দিয়ে জিজ্ঞেস করল—আপনাদের কারও গৃহে কি শিশু চুরি গেছে?
অসুরেন্দ্র বললেন—কী যে বলেন ভদ্র! আমার…আমাদের সবার গৃহই যথেষ্ট সুরক্ষিত। ধনী সেট্ঠিদের মধ্যে দ্বারপাল না থাকতে পারে কিন্তু শিশুগুলিকে দেখাশোনা করবার জন্য দাসদাসীর অভাব নেই। ধাত্রীরা রয়েছে, মায়েরাও সতর্ক। এসব শিশু চুরি ঘটেছে প্রান্তিক পল্লীতে।
চণক বলল—আমিও তাই ভেবেছিলাম।
অসুরেন্দ্র বললেন—দেখুন ভদ্র, আমাদের উচ্চশ্রেণীর গায়ে না লাগলে আমরা যদি এসব ব্যাপারে গুরুত্ব না দিই, ভবিষ্যতে তাতে কি আমাদের ভালো হবে? আমরা নগরবাসীরা প্রতিদিনের কার্যাকার্যে এই নিম্ন শ্রেণীর ওপর নির্ভরশীল। আজ ছ’দিন হল আমাদের বর্জ্য কুটিরের মল পরিষ্কার করার জন্য নিযুক্ত অন্ত্যজরা আসেনি। মাতঙ্গ নামে এক চণ্ডাল ওদের নেতা। মাতঙ্গর একমাত্র সন্তান নাকি যক্ষীর উদরে গেছে। এখন ভদ্র, চণ্ডাল হলেও তো সে পিতা; শিশুঘাতিনীর শাস্তি না হলে সে ক্রুদ্ধ হতেই পারে। কী হে ভৃগু তোমার কী মত?
ভৃগু নামে ব্যক্তি বললেন—ঘটি কলস তৈজসাদি চুরি করলে যেখানে হাত পা ছেদন করে শাস্তি দেওয়া হয়, সেখানে একজন শিশুঘাতিনী যক্ষীকে হাতে পেয়ে ছেড়ে দেওয়া হল, আবার তার নিত্যভোজনের ব্যবস্থা হল, এর মধ্যে কোনও যুক্তি আছে? এই বুদ্ধ সমন আমাদের সর্বনাশ করবেন।
আরেক ব্যক্তি বলে উঠল—মহারাজ বিম্বিসার এতদিন প্রজাপ্রিয় লোকপাল ছিলেন। আমরা গর্বিত ছিলাম আমাদের রাজ্য ন্যায়ের রাজ্য, শান্তির রাজ্য বলে। আর এখন?
পানীয় শেষ করে চণক তিষ্যর দিকে তাকাল, নিম্নকণ্ঠে বলল—এখন আর গোষ্ঠীতে গিয়ে কাজ নেই, চলো একবার আম্রবনে গিয়ে দেখি শ্রমণের দেখা পাই কি না।
যতই আম্রবন এগিয়ে আসে ততই অস্বস্তি বাড়তে থাকে উভয়ের। পথে যেন ভিড় বাড়ছে। আম্রবনের প্রবেশপথে তারা একদল নিম্নশ্রেণীর লোক দেখতে পেল। পরনে কটিবস্ত্র। উধ্বাঙ্গে অধিকাংশেরই কিছু নেই। কেউ কেউ বাকল জাতীয় বস্ত্রও পরে রয়েছে। এরা অপরিচ্ছন্ন, শ্মশ্রূ-গুম্ফ বিশেষ কাটে না। গায়ের বর্ণ সবারই যে কৃষ্ণ তা নয়, কয়েকজন তাম্রবর্ণ, এমন কি গৌরবর্ণও আছে, কিন্তু বড় মলিন। ভিড়ের মধ্যে একটি বিশালদেহী যুবককে আঙুল দিয়ে দেখাল তিষ্য—দেখুন, চণকভদ্র দেখুন!
লোকটির কটিতে রক্তবসন, মাথায় কেশগুলি কুণ্ডলীকৃত হয়ে রয়েছে। হাতে একটি যষ্টি। চোখগুলি একে রক্তবর্ণ, এখন যেন তাতে আগুন জ্বলছে। সে উন্মত্তের মতো বলছে—রাক্ষসীর শিশু ফিরিয়ে দেওয়া হল, আমার শিশু, আমাদের শিশুগুলিকে কে ফিরিয়ে দেবে? সমন তার জাদু দেখাক। দিক ফিরিয়ে আমার চন্দকে। দিক, আমি কিছু বলব না। দেওয়ার সাধ্য তার আছে?
বলতে বলতে মাতঙ্গ ঝড়ের মতো আম্রবনে ঢুকতে লাগল। কিছু দূর থেকে চণক ও তিষ্য তাদের অনুসরণ করল।
—কী করবে ওরা? তিষ্য উত্তেজিত হয়ে উঠেছে, শ্রমণ গৌতমকে বধ করতে যাচ্ছে না কি?
চণক বলল—তা মনে হয় না, তবে এদের কথার উত্তর শ্রমণকে দিতে হবে। তিনি কী উত্তর দেবেন তিনিই জানেন।
আম্র তরুমূলে বেদীটি শূন্য। একজন ভিক্ষু বেরিয়ে এলেন, বললেন—কে তোমরা? কী চাও?
—বুদ্ধ কোথায়? বুদ্ধ?—মাতঙ্গ কণ্ঠস্বরে প্রচণ্ড ক্রোধ ও ব্যঙ্গভরে বলল।
—তথাগত আজ ভোরেই পরিব্রজন করতে বেরিয়ে গেছেন। এখন তো আর ফিরবেন না। তাঁর সন্ধান করছ কেন আবুস?
মাতঙ্গ বলল—যক্ষিণী আমার শিশুকে খেয়েছে, তার শাস্তি তিনি বন্ধ করেছেন কেন? উত্তর দিন! আপনি কে? সমন বুদ্ধকে না পেলে আমরা আপনার কাছ থেকেই উত্তর চাইব।
—আমি তথাগত বুদ্ধর অগ্গসাবক মোগ্গল্লান। তোমরা কার শাস্তি চাও? এসো, দেখো।
মোগ্গল্লান মাতঙ্গের দলকে একটি কুটিরের দিকে নিয়ে গেলেন। সবাই দেখল স্বল্প-পরিসর কুটিরের মধ্যে দুটি বন্য নরনারী শুয়ে আছে। অচৈতন্য। তাদের সর্বাঙ্গ ক্ষতে পূর্ণ। কোনও কোনও ক্ষত দিয়ে এখনও রক্ত ঝরছে। যক্ষীটির গলার চারপাশে আঙুলের চিহ্নে।
মাতঙ্গর দলের একজন অবাক হয়ে বলল— সমন ওদের এভাবে শাস্তি দিয়েছেন?
মোগ্গল্লান ধীরে ধীরে বললেন— সেই শাস্তিই সবার বড় শাস্তি যা মানুষ নিজে নিজেকে দেয়। দুদিন, দুই রাত ধরে এই বন্য দম্পতি উন্মাদের মতো নিজেদের হত্যা করবার চেষ্টা করেছে। এতদিনে এদের হৃদয় জেগেছে বুঝতে পেরেছে কী পশুর মতো আচরণ করেছে এরা। অনুশোচনায় দগ্ধ হচ্ছে। অন্তর। তিনি দলটির দিকে চেয়ে বললেন ‘কে তোমাদের দলপতি? নাম কী?’
কয়েকজন বলে উঠল— মাতঙ্গ। মাতঙ্গ।
মোগ্গল্লান বললেন— মাতঙ্গ! তোমাদের তো চিরকালই ওই প্রান্তিক পল্লীতে বনের ধারেই থাকতে হবে?
—তা তো হচ্ছেই। মাতঙ্গ রুক্ষ কেশভরা মাথা ঝাঁকিয়ে বলল।
—‘তোমরা চিরকালের মতোই নিরাপদ হতে চাও তো?’
একজন বলল— তা তো চাই-ই সমন, নিত্যি-নিত্যি ঝামেলা কে পোয়াবে?
—আজ একজন যক্ষীকে হত্যা করলে কাল আরেকজন শিশুঘাতী যক্ষ আবির্ভূত হবে না এ কথা কেউ বলতে পারে?
—হতেই পারে। এই বনে যক্ষই থাকে তো!
—ওদের নরমাংস খাওয়া ছাড়াতে পারলে, সভ্য মানুষের মতো কাজকর্ম করে বাঁচবার সুযোগ দিলে ওদের মধ্যে থেকে এই ঘৃণ্য অভ্যাস তো চলে যেতে পারে?
—ওরা রাক্ষস, ওরা আমাদের মতো মানুষ নয়, সমন!
বেশ ওদের দেখে এসো ভালো করে, রাক্ষসের কী লক্ষণ ওদের আছে দেখো। আমাদেরই মতো হাত পা, মুখ, কেশ, আমাদেরই মতো চোখ মুখ। শুধু ভাষা একটু ভিন্ন। তা-ও আমরা বুঝতে পারি এমন কথা ওরা বলতে আরম্ভ করেছে। অজ্ঞান, অনাহার, অভাব এবং প্রতিহিংসা প্রবৃত্তি থেকে ওরা এই কাজ করেছে। এখন যদি ওদের হত্যা করা হয়, বন্যরা আরও ভয় পেয়ে যাবে মাতঙ্গ, আমাদের শত্রু হয়ে উঠবে। কিন্তু একজনকে যদি ক্ষমা করা যায় ওরা আমাদের বিশ্বাস করবে, শ্রদ্ধা করবে, ভালোবাসতে আরম্ভ করবে। তোমাদের পল্লী যক্ষভয় থেকে চিরকালের জন্য রক্ষা পাবে। মাতঙ্গ, ওরাই বনের মধ্যে তোমাদের রক্ষী হয়ে থাকবে। এ সুযোগ তোমরা হাতছাড়া করো না।
জনতার মধ্যে একটা গুঞ্জন ধ্বনি উঠল। তিষ্য দেখল বিশাল বক্ষপট চেতিয়ে মাতঙ্গ ভিড় ঠেলে বাইরে বেরিয়ে আসছে। সে পায়ের দুমদাম শব্দ করে চলে গেল। তার মুখ মেঘাচ্ছন্ন। অন্য লোকগুলি ভিক্ষু মোগ্গল্লানকে নমস্কার করল। অনেকে বলে উঠল—সমন, সত্যি সত্যি আমরা এবার নিরাপদ তো?
—আমি জানি এই পাঞ্চিক আর হারীতি, তোমাদের এবং তোমাদের শিশুদের রক্ষা করবে। ওদের সভ্য, শিষ্ট মানুষ হয়ে উঠতে আর বিলম্ব নেই। তোমরা সাহায্য করো।
—কিন্তু শিশুগুলিকে তো আর আমরা ফিরে পাবো না। আমাদের অনেকেরই শিশু গেছে।
—তোমাদের ঘরে আরও শিশু আসুক আবুস। যেগুলি গেছে তারা মুক্তাত্মা। মহাত্মা। সংসারের দুঃখচক্র থেকে মুক্তি নিয়ে চলে গেছে। তাদের জন্য শোক করো না।
লোকগুলি মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছে। মাতঙ্গ যেতে যেতে ফিরে দাঁড়িয়ে প্রবল বেগে একবার মাটিতে পা ঠুকলো। তারপর শব্দ করে থুৎকার করল—থুঃ, থুঃ থুঃ।
সে একা একা প্রায়ান্ধকার পথ বেয়ে চলে গেল। অন্য লোকগুলি চলতে চলতে বলতে লাগল—আমাদের বচ্চগুলি চণ্ডাল পুকুশের জীবন থেকে মুক্তি পেয়েছে। সমন বলেছেন ওরা মহাত্মা।
—সমন বলেছেন ওরা মহাত্মা। আমাদের নন্দু লোহিচ্চ, সচ্চ—সব মহাত্মা।
—ভবচক্র থেকে মুক্তি পেয়েছে।
—মুক্তি পেয়েছে … ওরা মহাত্মা। এই ঘৃণিত জীবন থেকে ওরা রক্ষা পেয়েছে।
—ব্রাহ্মণ, ক্ষত্তিয়, বৈশ্যরাই শুধু মুক্তি পায় না গো, নিচু বন্নের মানুষও মুক্তি পেতে পারে। মহাত্মা হতে পারে। সমন বলেছেন।
জীবকাম্রবন ছাড়িয়ে অনেকটা চলে আসার পর দুজনেরই লক্ষ্য পড়ল গোষ্ঠীতে যাবার পথ তা ছাড়িয়ে এসেছে। দীপদণ্ডগুলি জ্বলতে আরম্ভ করেছে পথের পাশে। অজানা বুনোফুলোর মাদক গন্ধ পাহাড়ের দিক থেকে বয়ে আনছে বাতাস। তপোদারাম যাবার উপপথটির মুখে আসতে বেশ কয়েকজন তীর্থিক পন্থের শ্রমণকে দেখতে পাওয়া গেল। তাঁরা পাহাড়ের দিকে চলে যাচ্ছেন। রথ এবং ঘোড়ায় চড়ে কিছু নাগরিক চলাচল করছেন। দু একটি শিবিকাও চলে গেল। শান্ত রসের সন্ধ্যা।
তারা দুজন ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে ঘোড়াদুটিকে হাঁটিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। নইলে কথা বলবার সুবিধে হয় ন।
তিষ্য বলল— এই মোগ্গল্লানকে পূর্বে দেখেছেন না কি, চণকভদ্র?
—নাঃ।
—এঁরা সকলেই সম্মোহন বিদ্যা জানেন দেখছি।
—তিষ্য, তুমিও যে দেখছি রাজগৃহের নাগরিকদের মতো হলে?
—আপনি কি বলছেন শ্রমণের ওই সব কথা সত্য? শিশুগুলি মহাত্মা, মুক্ত হয়ে চলে গেছে? চণক হেসে বললেন— মৃত্যুর পর মানুষ জড় উপাদানসমূহের বন্ধন থেকে মুক্তই তো হয়! আত্মায় বিশ্বাস করি না করি, এটুকু তো অন্তত বুঝতে অসুবিধা নেই!
—কিন্তু মহাত্মা? শ্ৰমণ কি যক্ষীর জঠরে যাওয়া সব শিশুগুলিকে দেখেছেন? দেখে না থাকলে তারা মহাত্মা এরূপ ধারণা ভিত্তিহীন অনুমান ছাড়া কী? এক যদি এই শ্ৰমণরা সর্বজ্ঞ হন।
—শ্রমণ গোতম নাকি বলেন কেউ সর্বজ্ঞ নয়। হতে পারে না।
—তাহলে?
—তিষ্য তুমি সন্মোহন দেখছ, আমি দেখছি কুটনীতি। শ্ৰমণ গোতম কুটনীতি প্রয়োগ করে বন্যদের বশ করলেন। তাঁর শিষ্য মোগ্গল্লান কূটনীতি প্রয়োগ করে বিদ্রোহী চণ্ডাল-পুক্কুশদের বশ করলেন। এমন আমি আর দেখিনি।
—একে আপনি কূটনীতি বলছেন চণক ভদ্র? কূটনীতির মধ্যে একটা চতুরতার প্রবঞ্চনার ব্যাপার আছে। জেনেশুনে তাকে প্রয়োগ করেন কূটনীতিক। এই শ্ৰমণদের ঠিক ধূর্ত, চতুর মনে করতে আমার দ্বিধা হচ্ছে।
চণক বলল—সাধারণ রাজপুরুষ যিনি গতানুগতিক পথে চলেন তাঁর হাতে কূটনীতি চতুরতাপ্রসূত হতে পারে তিষ্য। কিন্তু আমি যে কূটনীতির কথা বলছি তা রাজশাস্ত্রের সূক্ষ্মতম এমন কি বলতে পারো মহত্তম নীতি। এর জন্ম হৃদয় থেকে, রাজায় রাজায়, রাজায় প্রজায় পরিপূর্ণ মৈত্রী স্থাপনের হার্দ্য ইচ্ছা থেকে।
কিছুক্ষণ থেকেই পেছনে অশ্বক্ষুরধ্বনি শোনা যাচ্ছিল। এই সময়ে অশ্বারোহী দুই পথিকের পাশে এসে দাঁড়িয়ে গেলেন। এক লাফে নেমে অশ্বারোহী বললেন-‘মান্যবর, আপনাদের আলোচনায় যোগ দিতে পারি?
তিষ্য অবাক এবং বিরক্ত হয়ে দেখল একটি সৈনিক। শ্মশ্রূ, গুম্ফ বেশ যত্নে লালিত। বক্ষে লৌহজালিকা। মাথায় করোটিকা শিরস্ত্রাণ। চণকের থেকে সামান্য খর্ব। কিন্তু বিশাল বক্ষপট। কটিদেশ বৃকর মতো। বরপুরুষ বটে। কিন্তু তিষ্য অত সহজে মুগ্ধ হবার পাত্র নয়। সে ভ্রূকুটি করে বলল— ‘না পারেন না। আপনি উচ্চপদস্থ যোদ্ধা হতে পারেন, কিন্তু সহসা পথের পেছন থেকে এসে কোনও আলোচনায় যোগ দিতে হলে আপনাকে আমাদের পরিচিত হতে হবে।’
অশ্বারোহীর শ্মশ্রূ-গুফের ফাঁকে হাসি খেলে গেল। বললেন— অবশ্যই। যদিও নাম রূপ ক্ষণকালীন, নিতান্ত নশ্বর বস্তু, যে কোনও মুহূর্তে কপূরের মতো উবে যেতে পারে, তবু আপনার প্রীতির জন্য জানাই আমি জনৈক সৈনিক। দেখতেই পাচ্ছেন, মগধের সৈন্যদলে কাজ করি। নাম লোকপাল। পদের তুলনায় নামটি কিঞ্চিৎ ভারী। উপায় নেই। পিতা স্বর্গত। তাঁর সঙ্গে তো এখন আর বিবাদ করা যায় না।
চণক বলল— ভদ্র লোকপাল, পথে পথে আলোচনা না করে আমার গৃহে যদি আসেন। এই অল্প দূরেই, এসে পড়েছি।
লোকপাল সহাস্যে বললেন কিন্তু আপনার সঙ্গী যুবাটি সম্মত হবেন কী? আমার নাম বললাম, বৃত্তি বললাম, কিন্তু আয়ুস্মন আপনি তো পরিচয় জানালেন না?
তিষ্যর বিরক্তি এখনও যায়নি। সে অসন্তুষ্ট কণ্ঠে বলল—উনি চণক। তক্ষশিলার নমস্য আচার্য দেবরাতের পুত্র, আপনাদের মহারাজ বিম্বিসারের বিশেষ প্রীতিভাজন। আমি তিষ্য, সাকেতের রাজকুমার।
—আপনি কি মহারাজ বিম্বিসারের অপ্রীতিভাজন না কি?
তিষ্য বলল— আপনাকে বয়সে বড় মনে হচ্ছে। আপনার অসম্মান করতে চাই না, কিন্তু অকারণ প্রগল্ভতায় কাজ কী?
লোকপাল নামে সৈনিক হঠাৎ অট্টহাস্য করে উঠলেন।
চণকের জম্বু কানন এসে গেছে। সে বলল—আসুন ভদ্র লোকপাল, তিষ্য এসো।
তিষ্য অপ্রসন্ন মুখ বলল—আমি বরং আজ যাই।
সহসা তার ডান হাত শক্ত করে ধরে লোকপাল বললেন—আপনার মতো বিদ্বান বুদ্ধিমান, গম্ভীর যুবা উপস্থিত না থাকলে আলোচনার রস নষ্ট হয়ে যাবে। দয়া করে আসুন।
চণক বলল—‘তিষ্য, আপত্তি করো না। আজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিন। বিশেষ তোমার পক্ষে।’
তিষ্য অনিচ্ছা সত্ত্বেও ঢুকল। অশ্বশালার দাসেরা তিনটি ঘোড়াই নিয়ে গেল। আসনশালায় প্রবেশ করতেই কোথা থেকে সোমা ছুটে এসে সৈনিককে আভূমি প্রণাম করল। তারপর সৈনিকের বর্ম, শিরস্ত্রাণ ইত্যাদি খুলতে সাহায্য করতে লাগল। তারই ইঙ্গিতে সম্ভবত দাসীরা ছুটে এলো। তাদের হাতে বড় বড় সুগন্ধি জলের পাত্র, মার্জনী বস্ত্র।
সোমা বলল— কী পানীয় আনব দেব?
—কিছু না, জল খালি। বিশুদ্ধ পানীয় জল।
—উষ্ণ কিছু আনব না? হিমে এতখানি পথ এলেন!
—তিষ্যকুমার, আপনার কী অভিরুচি?
তিষ্য কিছু বলবার আগেই চণক বলল—তিষ্য, ইনি মহারাজ বিম্বিসার।
তিষ্য এতো চমকে গেছে যে সে সঙ্গে সঙ্গে তার আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। তার মুখের বর্ণ দেখবার মতো।
সেদিকে চেয়ে মহারাজ বিম্বিসার হাত বাড়িয়ে বললেন—প্রগলভতার জন্য ক্ষমা করো আয়ুষ্মান। গম্ভীর রাজ-পরিবেশে দিন কাটাতে কাটাতে একটু চপলতার জন্য, লঘু কৌতুকের জন্য বড় তৃষ্ণা বোধ করি। চণক, ছদ্মকণ্ঠ ধারণ করতে পেরেছি তো?
তিষ্য ততক্ষণে নতজানু হয়ে নমস্কার করছে। হাত ধরে তাকে তুলে বিম্বিসার বললেন সাকেতের রাজকুমার বললে—রাজন্য উগ্রসেনের পুত্র না কি?
—হ্যাঁ, দেব—তিষ্য কোনমতে বলল।
—পিতার কোন কাজে রাজগৃহে এসেছ?
—পিতার কাজ নয়। নিজেরই আগ্রহে। ভ্রমণ করছি।
—ও, সেই সূত্রেই চণকের সঙ্গে বন্ধুত্ব? ভ্রমণ পিপাসা?
চণক বলল—মহারাজ, তিষ্যকুমার তক্ষশিলার স্নাতক। শ্রাবস্তীতে বন্ধুল মল্লর কাছেও অস্ত্রশিক্ষা করেছে। ও উচ্চ পদের যোগ্য। অনুসন্ধিৎসু স্বভাবের যুবক।
—সে-কথা আমি আগেই বুঝেছি— বিম্বিসার স্মিত মুখে বললেন—এখন সোমাকে উত্তর দাও তিষ্যকুমার শীতল পানীয় খাবে না উষ্ণ কিছু?
তিষ্য বলল—যা ঘটল আজ, তাতে তীক্ষ্ণ সুরা না হলে স্বস্তি ফিরে পাবো বলে মনে হচ্ছে না।
বিম্বিসার হেসে বললেন—যাক, তিষ্য কুমারের মন ভালো হয়েছে। সোমা, তীক্ষ্ণ সুরা আননা, আমাদের আজ গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা আছে।
সোমা নম্র কণ্ঠে বলল—আমি উপস্থিত থাকতে পারি?
—অবশ্যই।
দাসীরা পানীয় নিয়ে এলো। বিবিধ খাদ্যও। চণক বলল—‘মহারাজ কি আম্রবনে উপস্থিত ছিলেন না কি?’
—‘সংবাদ এলো, অন্ত্যজ পল্লীতে অসন্তোষ। ওরা আম্রবনে ভিক্ষুদের আক্রমণ করবে। সৈনিক পাঠিয়েছিলাম কিছু। কিন্তু নিজেরও অত্যন্ত কৌতূহল ছিল।’ রাজা বললেন—‘স্বয়ং উপস্থিত থেকে দেখতে চেয়েছিলাম কী হয়।’
চণক বলল— মহারাজ, শ্রমণ মোগ্গল্লান একরূপ উত্তর দিয়ে বিদ্রোহী অন্ত্যজদের ক্ষান্ত করলেন। আমার জানতে ইচ্ছা হয় আপনার মত কী! আপনি হলে কী উত্তর দিতেন।
রাজা কিছুক্ষণ নীরবে থেকে ধীরে ধীরে বললেন—অন্ত্যজদের অভিযোগ তো সত্য চণক। সম্পূর্ণ সত্য। যাদের পুত্র-কন্যার ওই নৃশংস পরিণতি হয়েছে তারা কী করে বন্যদের ক্ষমা করবে? অথচ তথাগতর কথাও সত্য। কোথাও আমাদের পারস্পরিক হিংসার এই কর্মকাণ্ড থামাতে হবে। রাজা অন্যায়কারীর শাস্তিবিধান করতে পারেন কিন্তু তথাগত তার যে মানসিক পরিবর্তন ঘটালেন তা কি অলৌকিক নয়? তিষ্যকুমার তুমিও তো স্বচক্ষে দেখেছ, বলো!
তিষ্য দ্বিধাগ্রস্ত স্বরে বলল—‘দু পক্ষই যেখানে ঠিক, সেখানে সুবিচার করা কী ভাবে সম্ভব হবে, মহারাজ!’
—সেই কথাই ক দিন ধরে ভাবছি তিষ্যকুমার। এর পরে যখন চৌর্য, দস্যু-বৃত্তি, প্রতারণা, হত্যা ইত্যাদির জন্য শাস্তিবিধান করতে যাবো, তখন আমার অন্তরের মধ্যে তর্জনী আস্ফালন করে ওই মাতঙ্গ কি বলবে না—তোমার বিচারের পেছনে কোনও নীতি নেই রাজা, বিচার হবে সবার জন্য এক। বিচারের মানদণ্ড দুই প্রকার হয় না। …
হাতের পাত্রটি নিয়ে রাজা শুধু নাড়াচাড়া করছেন, পান করছেন না। বিষগ্ন, নীরব।
কিছুক্ষণ পর চণক বলল—‘মহারাজ, আমার মনে হচ্ছে কোথাও আপনার একটা সূক্ষ্ম ভুল হচ্ছে। সভ্য মানুষ, সামাজিক মানুষ যখন চৌর্যবৃত্তি, দস্যুবৃত্তি করে তখন জেনে শুনে করে। আপন সমাজের মানুষের প্রতি অন্যায় করে। কিন্তু বন্যরা প্রথমত সভ্য নয়, দ্বিতীয়ত তারা আমাদের ভিন্ন শ্রেণীর জীব বলে মনে করে। শুনলেন না ওই যক্ষী কী বলছিল? আমরা ওদের বন নিয়ে নিয়েছি। বনের পশু মেরে শেষ করে দিয়েছি। ভিক্ষা চাইতে এলে দ্বার বন্ধ করে দিই। … ওদের জয় করতে হলে, ওদের সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন করতে হলে আপনার দিক থেকে ওদের ভয় ভাঙতে হবে, বিদ্বেষ দূর করার চেষ্টা করতে হবে।’…
তিষ্য বলল—চণক ভদ্র, আপনি তো শ্ৰমণ মোগ্গল্লানের মতো বলছেন অবিকল।
চণক বলল—এ-ও হতে পারে তিষ্য ওই শ্ৰমণ চণকের মতো করে ভাবেন। অবিকল। চণক পুনরাবৃত্তি করছে না। চিন্তার এই সূত্র চণকের মনের মধ্যে কিছুকাল থেকেই ঘোরাফেরা করছে। তবে চণক ওঁর মতো মানুষকে অভিভূত করবার ক্ষমতা রাখে না।
—দৈবরাত চণক প্রথম থেকেই বন্যদের পক্ষে রাজা লঘু গলায় বললেন। তারপর তিষ্যর দিকে ফিরে বললেন—তিষ্যকুমার, এই যে আজ বন্যদের জয় করতে গিয়ে অন্ত্যজদের অসন্তুষ্ট করতে হল, তথাগত বুদ্ধর কথাকে মান দিতে গিয়ে প্রজাদের ন্যায্য অভিযোগের মীমাংসা করতে পারলাম না, এর ফল কী হতে পারে, মনে করো? তুমিও তো দণ্ডনীতি বোঝো।
তিষ্য বলল—শ্রমণ মোগ্গল্লান তো ওদের বুঝিয়ে দিয়েছেন মহারাজ। ওদের শিশুগুলি সব মহাত্মা ছিল, ভবচক্র থেকে মুক্তি পেয়েছে। চণকভদ্র আমায় বলছিলেন এই-ই হল কূটনীতির পরাকাষ্ঠা। হার্দ্য কূটনীতি।
চণকের দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালেন বিম্বিসার। চণক বলল—হ্যাঁ মহারাজ, আমি তিষ্যকে উন্নত ধরনের কূটনীতির তত্ত্ব ব্যাখ্যা করছিলাম যা হৃদয়ের যথার্থ মৈত্রী ভাবনা থেকে উৎপন্ন হয়। আমি যে চক্রবর্তী রাজার কল্পনা করি তাঁর কূটনীতি হবে গভীরতম মানবধর্ম থেকে উৎসারিত। সংকীর্ণ স্বার্থ রক্ষার অস্ত্র নয়।
মহারাজ একটু বিষগ্ন হাসলেন, বললেন—আচার্যপুত্র, আজ দেখি তথাগতর দেশনা আর তোমার রাজনীতির তত্ত্ব কোথাও মিলে যাচ্ছে। আমি হয়ত উভয়কেই অনুসরণ করে দেখব। আমার বিবেক তাই বলে। কিন্তু লোকচরিত্রে আমার যে অভিজ্ঞতা হয়েছে তার অধিকারে বলছি অদূর ভবিষ্যতে সাধারণ প্রজার প্রশ্নহীন ভক্তি, আনুগত্য ভালোবাসা আমি ধীরে ধীরে হারাতে থাকবো। তথাগত এবং তাঁর সংঘের ভিক্ষুদের মতো মানুষকে অভিভূত করার সাধ্য আমারও নেই।
সোমা এই সময়ে মৃদুস্বরে বলল—মহারাজের জয় হবে।
চণক বলল—অন্ততপক্ষে তার জন্য চেষ্টা তো করতে হবে।
তিষ্য সহসা অসংলগ্নভাবে বলল—মহারাজ, আমি প্রস্তুত।
বিম্বিসার অন্যমনস্ক ছিলেন, চমকে মুখ তুলে বললেন—তোমরা সবাই আমার শুভার্থী? বাঃ। তিষ্যকুমার, তুমি কিসের জন্য প্রস্তুত?
—আপনার যাতে জয় হয়, তা করতে মহারাজ!
বিম্বিসার উঠে দাঁড়িয়ে বললেন—তাহলে তিষ্য তোমায় যদি শ্রাবস্তীতে কিছুকালের জন্য পাঠাই, মগধের রাজপ্রতিনিধি বলে! আপত্তি আছে?
তিষ্যর মুখের ওপর দিয়ে যেন একটা ছায়া সরে গেল। একটু পরে সে বলল—দূত?
দূত নয়। রাজপ্রতিনিধি। তোমার কী করণীয় হবে রাজপুরীতে কূটকক্ষে বিশদ আলোচনা করব আগামী কাল। পরে এভাবেই তোমায় যেতে হবে অবন্তী, কৌশাম্বী, ইন্দ্রপ্রস্থ।
মহারাজ বিদায় নিয়ে চলে গেলে চণক উদ্বিগ্ন হয়ে বলল— তিষ্য, তোমার যে দক্ষিণ দেশে যাবার আকাঙ্ক্ষা, সে-কথা মহারাজকে বললে না কেন? সহসা আবেগের বশে এ কী করলে?
সোমা উৎকণ্ঠ চোখে তাকিয়ে ছিল। কিছু বলছিল না। তিষ্য ধীরে ধীরে মাথা নিচু করে বলল—চণকভদ্র, দক্ষিণ দেশে রাজ্যস্থাপন করার প্রসঙ্গ তুলে আমায় আর লজ্জা দেবেন না। কিছুই জানি না, কোনও অভিজ্ঞতা নেই। লোকবল নেই। স্বপ্ন দেখি শুধু। আপনার মতো চিন্তক, ভদ্রা জিতসোমার মতো বিদুষী, মহারাজ বিম্বিসারের মতো কুশলী মহাপ্রাণ রাজা, আর ওই শ্ৰমণদের মতো অলৌকিক প্রভাবসম্পন্ন মানুষদের সংস্পর্শে এসে বুঝতে পেরেছি আমাকে প্রস্তুত হতে হবে। নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে। তারপর যদি সময় থাকে … যদি অর্জন করতে পারি কিছু … তাহলে … তখন দেখা যাবে।
সে দুজনকে নমস্কার করে বিদায় নিয়ে চলে গেল। যেন স্বপ্নচালিতবৎ।
২৮
হিম ঋতুর শান্ত ভোরবেলা। কুজ্ঝটিকায় আবৃত চারিদিক। শ্রাবস্তী নগরী যেন জলের তলার নগরী। পাতালপুরী। রাজগৃহ বা সাকেতের মতো পরিকল্পিত নগরী নয় শ্রাবস্তী। ঠিক শ্ৰেষ্ঠী-পল্লী বলতে যা বোঝায় তেমন কিছু এখানে নেই। মিগারের ত্রিতল প্রাসাদ ও বিশাখার বিবাহ-যৌতুকের দ্বিতল বিলাসগৃহটি যে সুন্দর কাননের মধ্যে অবস্থিত, তার আশেপাশে আর কোনও ধনীগৃহ নেই। আছে কিছু একতল ইষ্টক নির্মিত বা দারুময় গৃহ। উচ্চতায় বা গঠন সৌকর্যে আভিজাত্যের গর্ব করতে পারে না। কিন্তু প্রাঙ্গণ, কক্ষ, অন্তঃপুর, বাহিবাটি মিলিয়ে প্রায় প্রত্যেকটিই অনেকটা স্থান নিয়ে আছে। বিশৃঙ্খলভাবে। যখন যেমন প্রয়োজন হয়েছে, ঘর তোলা হয়েছে। বিশাখা এরূপ দৃশ্যে অভ্যস্ত নয়। সৌন্দর্য, সুষমা, শালীনতা এগুলিতে তার চোখ, কান, মন এমন অভ্যস্ত হয়ে গেছে যে, কুশ্রী কিছু দেখলে, শুনলে, সঙ্গে সঙ্গে তার মনে একটা বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়। তার গৃহটি কাননের এক প্রান্তে হওয়ায়, বাতায়ন ও অলিন্দ থেকে সে বাইরের দৃশ্য, অন্যান্য গৃহের অন্তরঙ্গ দৃশ্যও দেখতে পায়।
ও পাশের গৃহটির অঙ্গনে দাসীর সঙ্গে গৃহিণীর তুমুল কোন্দল লেগে যায়, যখন তখন। চাল ঝাড়া, মণ্ড প্রস্তুত করা, শস্য শুকোনো সবই ওই অঙ্গনে অনুষ্ঠিত হয়। গভীর রাতে ঘুম না এলে এই অলিন্দ থেকে সে ওই অঙ্গনে নরনারীর সঙ্গম দৃশ্যও দেখেছে। খুব সম্ভব দাসী ও প্রভুপুত্র। দাসী ও বর্ষীয়ান প্রভুটিও হতে পারেন। এ ছাড়াও এ পল্লী খানিকটা নির্জন বলে কাছাকাছি কোনও কাননে বোধহয় প্রণয়ীরা মিলিত হয়। পথ দিয়ে নীলকৃষ্ণ বসন-পরা মাথায় অবগুণ্ঠন দেওয়া অভিসারিকা রমণীদের দ্রুত চলে যেতে দেখা যায়। তাদের প্রণয়ীরাও যায় পায়ে হেঁটে। এরা সব সময়ে তরুণ-তরুণী হয় না। তার বাতায়নের তলায় কাননপ্রান্তে একদিন সে চুম্বনরত এক প্রণয়ী-যুগলকে দেখতে পায়। পুরুষটি প্রৌঢ়। নারীটি কোন শ্রেণীর তা সে বুঝতে পারেনি। কিন্তু সে বিবাহিত। চুম্বনের ফাঁকে ফাঁকে সে নিজ পতির মুণ্ডপাত করছিল। মিগারের গৃহেও এর কোনও ব্যতিক্রম নেই। মিত্তবিন্দ নামে যে সূতটি কাকে প্রণয় নিবেদন করেছিল এখন দেখা যাচ্ছে সে। আরও অনেককেই অনুরূপ কথা বলেছে। কহ্না আঘাত পেয়েছে। ধনঞ্জয়-গৃহে আজন্ম লালিত সে। বিশাখার সঙ্গে দীর্ঘদিন থাকতে থাকতে তাদের সবার রুচিই খানিকটা বিশাখার মতো হয়ে গেছে। কহ্না মিত্তবিন্দকে রূঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে। তা সত্ত্বেও লোকটি যখন-তখন কাকে বিরক্ত করে। এ সব কথা গৃহকতার কানে তুললে মিত্তবিন্দর কপালে দুঃখ আছে। তাই কহ্না বা বিশাখা নিজে কিছুই বলে না। মিগার ও তাঁর গৃহিণী দাস-দাসীদের ওপর নির্মম। যদি শাস্তি দেবেন মনে করেন, তবে কঠোর শাস্তিই দেবেন।
শ্রাবস্তীতে পচন ধরেছে। পচে গেছে নগরীটি। বিশাখা কুজ্ঝটিকাগ্রস্ত পথ-ঘাট গৃহ-প্রাঙ্গণ কানন ইত্যাদির দিকে চেয়ে মনে মনে বলে— কোশল, কোশল দেশটাই পচে গেছে। তার বালিকাকালের সেই উচ্চাকাঙ্ক্ষার কথা মনে হয়। সে দেশে দেশে ভ্রমণ করতে চেয়েছিল। বাল্যকাল সম্ভবত দর্পণের মতো। তখনই সঠিক চিন্তা সঠিক আকাঙ্ক্ষাগুলির প্রতিবিম্ব পড়ে মনোভূমিতে। বাল্যকালে তো কেউ পুরুষ অথবা নারী থাকে না, সেই সময়টাই শ্রেষ্ঠ সময়। তবে কি সে পুরুষ হতে পারেনি বলে দুঃখ বোধ করে? তাও তো নয়! পুরুষ মাত্রেই কেমন রুক্ষ, কর্কশ, ব্যাভিচারী, অমার্জিত। সে পুরুষ হয়নি বলে তার দুঃখ নেই। দুঃখ একটাই। তার ভেতরে সে বিপুল শক্তির নড়াচড়া টের পায়। কর্মৈষণা। কর্মের ক্ষমতা। রাজদণ্ড হাতে রাজ্যশাসন করতে পারলে হয়তো সে তৃপ্ত হত। কুমার কুনিয়র রানী নয়, দেবী মল্লিকার মতোও নয়। সে মহারাজ বিম্বিসারের মতো সভা ডেকে, প্রজানিচয়ের মঙ্গলবিধান করবে, সীমান্ত-দস্যুদের দমন করবে, ভিন্ন দেশের রাজদূতদের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ দণ্ডনীতির বিষয়ে আলোচনা করবে, কূটগৃহে মন্ত্রীদের সঙ্গে পরামর্শ করবে। এর সুযোগ, অত্যন্ত ক্ষীণ হলেও সুযোগ একটা এসেছিল, একটা নয় দুটো। তিষ্যর মাধ্যমে, এবং কুমার কুনিয়র সঙ্গে বিবাহের সম্ভাবনায়। কিন্তু বিশাখা তখন মনে মনে প্রণয়ভিক্ষু ছিল। সে জানতো না, প্রণয় বলে কিছু নেই। কিছু থাকবে না। আবেগের মোহন আবরণে ঢাকা দেহ-কামনাকেই লোকে প্রণয় বলে।
সে যদি পিতার মতো শ্রেষ্ঠী হতো? বিবাহ না করলেই সে তা হতে পারতো। পিতা তো তাকে শেখাচ্ছিলেনই! মায়ের যে দুঃসাহসিক বাণিজ্য যাত্রার কথা সে শুনেছে, সেইভাবে সেও যেতে। দেশে দেশে, অশ্বপৃষ্ঠে, জলযানে, যাতায়াত করত। গৃহে ফিরে ছোট বণিকদের গোষ্ঠী পরিচালনা করতো। না হয় অমাজুরা, জরৎকুমারী বলতো লোকে, নিন্দা করতে আড়ালে। সে পেত এমন জীবন, যা কর্মে পরিপূর্ণ, অর্থপূর্ণ কর্মে। সর্বোপরি নিজের জীবনটি তার নিজের হাতেই থাকত। কিন্তু একবারও তার এসব কথা তখন মনে হয়নি। বিবাহ যেন রক্তের মধ্যে সংস্কার হয়ে ঢুকে ছিল। উপরন্তু, তার হৃদয় ছিল প্রণয়ের জন্য উন্মুখ! এখন সে কী করবে?
তা হলে কি সে নারী বলেই এই নিয়তি তাকে মেনে নিতে হবে? নারী হলেও সে যে মিগার-পত্নী, এমনকি তার সখী সুপ্পিয়ার মতোও নারী নয়। তার রক্তে যে দেবী সুমনার উত্তরাধিকার। সে এই সময়ের থেকে অনেক এগিয়ে আছে, কিংবা পিছিয়ে আছে কী? মা সুমনা, পিতামহী পদ্মাবতী তাকে, তাদের কাহিনী শোনাতেন সব নারী যোদ্ধার—মুদগলিনী, বিশ্পলা বধ্রিমতী শশীয়সী…। আরও কাহিনী শুনেছে সে ঋষি বাক্, ঋষি সূর্যার, মহাবিদুষী গার্গী কীভাবে বাজসনেয় যাজ্ঞবল্ক্যর সঙ্গে বিদেহ রাজসভায় ব্রহ্মবাদ নিয়ে তর্ক করেছিলেন। ঠিক যে নারী যোদ্ধা অথবা ব্রহ্মবাদিনী হওয়ার দিকেই তার ঝোঁক তা-ও বলা যায় না। বিশাখা তার নীলকৃষ্ণ কেশগুচ্ছ হাতে নিয়ে তদগত হয়ে যায়। এই কেশ সে বড় ভালোবাসে। ভালোবাসে এই অনুপম হাতগুলি, হাতের অগ্রভাগে আধ-ফোটা পদ্মকলির মতো হাতের পাতা আর আঙুলগুলি। বস্তুত তার অতুলনীয় সৌন্দর্য বিশাখার জীবনের গভীর আনন্দ, আত্মপ্রত্যয় ও প্রসন্নতার একটি উৎস। সে কখনও এই সৌন্দর্যকে তুচ্ছ বলে মনে করেনি। এ যে দেবতাদের দান, এক অমূল্য আশীর্বাদ এবং বিশেষ সুবিধা তার জীবনে তা প্রতিদিন অনুভব করে সে। সে কি গর্বিত? নিজেকেই নিজে জিজ্ঞাসা করে বিশাখা। না, ঠিক গর্ব নয়। বিশিষ্ট হবার অহঙ্কার কী? না, বোধ হয় তাও না। তা হলে? তা হলে? প্রকৃত কথা, দৈহিক সৌন্দর্য তার মানসিক গঠন, গুণাবলী, চরিত্র এ সবের সঙ্গে এমন খাপ খেয়ে গেছে যে, সর্বদা এই সৌন্দর্য সম্পর্কে মোটেই সচেতন থাকে না সে। আজ এখন কুয়াশায় ভরা ভোর বেলাতে যখন পৃথিবী শান্ত, পাখিদের ঘুম-ভাঙা স্বর সবে শোনা যেতে আরম্ভ করেছে তখন সহসা নিজের আঙুলগুলির দিকে চোখ পড়ে, মনে পড়ে যায় তার কেশও ঠিক অমনি সুন্দর। চোখগুলিও। হাত, পা, সমস্ত অবয়বই কী সুন্দর! বিশাখার মনে হয় সে বোধহয় স্বয়ংসম্পূর্ণ। পুণ্যবর্ধন যে তার মনোমতো, তার যোগ্য পতি হল না, এ দুঃখকে সে আর প্রশ্রয় দেয় না। প্রথমটা একটা তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। তা যতটা দুঃখে তার চেয়েও বেশি অপমানে। সে পিতা-মাতার জন্য, সাকেতের জন্য, বিবাহ-পূর্ব জীবনের স্বস্তি ও শান্তি, আদর ও স্নেহের জন্য আকুল হয়ে কেঁদেছিল। কিন্তু সেই ভয়ংকর রাতেই বোধ হয় বিশাখার কৈশোরের ওপর পূর্ণচ্ছেদ পড়ে গেছে। পুরনো বিশাখার ভস্ম-স্তূপের মধ্য থেকে নতুন বিশাখা দাঁড়িয়ে উঠেছে। তার চারপাশ থেকে আরক্ষার স্নেহচক্রগুলি যত খসে পড়ছে, ততই একা হয়ে যাচ্ছে সে। ততই যেন তার নিজস্ব শক্তি আবিষ্কার করছে সে। বিশাখা স্বভাবে নেত্রী। যোদ্ধ্রী। কিন্তু যুদ্ধ তো শুধু রণক্ষেত্রে হয় না!
তার প্রথম জয় হল পুণ্যবর্ধনের পলায়ন। পুণ্যবর্ধনের কথা ভাবলে এখন বিশাখার আর রাগ হয়, হাসি পায়। ভীরু। মায়ের আদরের পুত্ত হতে পারে, কিন্তু মাকে ভয় পায়, পিতাকে তো পায়ই। এখন, পত্নীকেও ভয় পাচ্ছে। হতভাগ্য মানুষটির কোনও চরিত্রই গড়ে ওঠেনি। বারাণসীতে গুরুগৃহে গিয়ে কী শিখে এসেছে, শঙ্কুদেবই জানেন! কুসঙ্গে পড়ে আর অর্থহীন প্রশ্রয়ে দাসেরও অধম হয়ে গেছে। বিশাখাকে অল্পবয়সী ও সুকুমারী দেখে পৌরুষ দেখাতে গিয়েছিল। যখন ছিটকে শয্যায় পড়ে গেল! কী হতবুদ্ধিই না হয়ে গিয়েছিল! বিশাখার ক্রোধেরও যোগ্য নয়। দু দিন আর গৃহে ফেরেইনি। তৃতীয় দিনে এলো। সন্ধ্যাবেলায় ময়ূরীকে ডেকে বলল, তোমার স্বামিনীকে বলল, আমি উপার্জন করতে বিদেশ যাচ্ছি।’
মিগার প্রায়ই বলছেন এতদিনে পুত্তটার সুবুদ্ধি হয়েছে। তার শ্বশ্রূও আহ্লাদিত। বিশাখা ঘটনাটি পুরোপুরি বুঝতে পারেনি। যদি পুণ্যবর্ধন শুধু চলেই যেত, তা হলে মনে হতো, সে রাগ করেছে। বিশাখার সঙ্গে আর বসবাস করতে চায় না। কিন্তু বলে চলে যাওয়ায় মনে হচ্ছে, হতভাগ্য তার কাছে বশ্যতা স্বীকার করছে। উপার্জন করতে যাচ্ছে বলে গেল, অর্থাৎ সে তার পুরনো অলস, বিলাসী জীবন ত্যাগ করে নতুন কিছু করতে চায়, বিশাখার শ্রদ্ধা আকর্ষণ করার এটাই এখন একমাত্র পন্থা মনে করেছে। মুখোমুখি হল না। হয়তো একটু অভিমানও আছে। যাই হোক, আপাতত এই লোকটি এ গৃহ থেকে চলে যাওয়ায় সে স্বস্তি পেয়েছে। কিন্তু যতই উপার্জন করুক, আর অলস জীবন ত্যাগ করুক পুণ্যবর্ধন কি কোনওদিন শ্রদ্ধার যোগ্য হয়ে উঠতে পারবে? পচে গেছে। এই শ্রাবস্তীর মতো, এই কোশলরাজ্যের মতে, এই সমাজের মতো পুণ্যবর্ধন একেবারে পচে গেছে। ইদানীং এখানে এই প্রকার নরনারীই দেখা যাচ্ছে। এই পচা-গলা কুৎসিত মানসিক ব্যাধিগ্রস্ত মানুষটিকে কি সে কোনওদিন স্বীকার করতে পারবে? যাক, আপাতত সে অনুপস্থিত। তাই সমস্যাটাও নেই।
কিন্তু বিশাখা আরও যুদ্ধ জয় করেছে। সে বহুজনের সামনে নিজেকে নিরপরাধ এবং মিগার শ্ৰেষ্ঠীকে ভুল, প্রমাণ করতে পেরেছে। সে মিগার-পত্নীকেও জয় করতে পেরেছে। সেই বিচার-সভার দিন থেকে কোনও রহস্যময় কারণে তার শ্বশ্রূ তাকে অত্যন্ত সমাদর করছেন। মাঝে মাঝেই বলেন— সদ্য সদ্য বধূ ঘরে নিয়ে এসে তার অপরাধের বিচার করবার জন্য সভা না বসালেই চলছিল না? নিজেকেই অপদস্থ হতে হলো তো! ভালো হলো। গহপতি এবার বুঝুন। তাঁর কথাই শেষ কথা নয়।
আবার কখনও কখনও বিশাখাকে ডেকে বলেন— নিগ্গণ্ঠদের তিরস্কার করে ভালো করেছে। বিশাখা। গহপতির ঘরে ভোজ্য-খজ্জ খেয়ে, উদর পুরে, কতকগুলি নীরস, অর্থহীন কথা বলে যাবে— সবাইকে হাত জোড় করে তদ্গত হয়ে শুনতে হবে। কেন? সবার যদি ভালো না লাগে? কী ভাবে কর্তৃত্ব করে আবার নগ্ন সমনগুলি। ঘরে এসেই দর্প প্রকাশ করবে। আমরা এই তপস্যা করি, সেই তপস্যা করি। বলি, মুখে বস্ত্রখণ্ড বেঁধে রাখলে কী হবে, ছেঁকে জল খেলেই বা কী হবে, বাতাসে যদি কীট কীটাণু থাকে তা হলে যখন ভোজন করছেন, তখনও তো সেগুলি মুখের মধ্যে ঢুকছে, না কী? সব শঠ, প্রবঞ্চক! বিশাখা ওগুলিকে তাড়াও, তাড়িয়ে ছাড়ো। বোঝা যাচ্ছে মিগারপত্নী দীর্ঘদিন ধরে নির্গ্রন্থদের নিয়ে মিগারের বাড়াবাড়ি ভক্তি ভালো মনে করেননি। সববিষয়েই কর্তার ইচ্ছা মেনে চলাও তাঁর মনোমত ছিল না।
আজ সশিষ্য বুদ্ধ তথাগত আসবেন। মিগার তাঁর কথা রেখেছেন। নির্মীয়মাণ জেতবন বিহারে গিয়ে বুদ্ধ এবং তাঁর সংঘকে নিমন্ত্রণ করে এসেছেন। তবে এখন বর্ষাবাসের সময় তো নয়। সংঘের ভিক্ষুরা এখন মধ্যদেশের নানান স্থানে ছড়িয়ে আছেন। বুদ্ধ ভগবান নিজেও অল্প দু-এক দিন হল শ্রাবস্তীতে এসেছেন। আবার শীঘ্রই বেরিয়ে যাবার সম্ভাবনা। জনা দশেক ভিক্ষু নিয়ে তিনি আসবেন। বিশাখার নিজ গৃহের ভোজনশালায় তাঁদের আপ্যায়নের ব্যবস্থা হয়েছে। বিশাখা বলেনি কিছু! মিগার নিজেই বললেন— ‘তোমার আগ্রহেই নিমন্ত্রণ। বিসাখা, তোমার গৃহেই আয়োজন করো।’ ভালো। বিশাখা তাই করবে। তাই করেছে।
ভোজনশালাটাকে ঘষে মেজে তকতকে করেছে তার দাস-দাসীরা মিলে। সমস্ত গৃহটিই মার্জনা করা হয়েছে। কিন্তু ভোজনশালাটি বিশেষ করে। দু-তিন দিন ধরে অনবরত চন্দনচুর্ণ পুড়িয়ে ঘরটি সুগন্ধ করা হয়েছে। রন্ধনগৃহে যাবার দ্বারে গৈরিক বস্ত্রাবরণী। বড় বড় অশ্বত্থ পাতায় শিউলি ফুল দিয়ে সুন্দর সুন্দর অলঙ্করণ রচনা করেছে তার সইয়েরা। সেগুলি কক্ষপ্রাচীরে বসানো হয়েছে। উজ্জ্বল কৃষ্ণবর্ণ মৃৎ-কলসে আম্রপল্লবের, কুমুদ কহ্লারের সজ্জা। বসবার আসনগুলি স্থূল কোমল কম্বলের। তার ওপর গৈরিক রেশমের আচ্ছাদন। ভোজন ফলকগুলি সব চন্দনকাঠের। পায়া-অলা। সব নতুন নির্মিত হয়েছে বিশাখার নির্দেশ অনুযায়ী। গজদন্ত বর্ণের কাসিক বস্ত্রের ওপর বিশাখা সেই অশ্বথবৃক্ষের চিত্র লিখেছে, যে বৃক্ষের তলায় গৌতম বোধিলাভ করেছিলেন। চিত্রট কক্ষের মাঝখানের প্রাচীরে প্রলম্বিত আছে।
দুই গৃহের মধ্যবর্তী অঙ্গনটিও আজ দু-তিন দিন ধরে বহু পরিশ্রম করে মাজা-ঘষা হয়েছে। সেখানে একটি আম গাছের মূলে নাতি-উচ্চ বেদী নির্মিত হয়েছে।
প্রাঙ্গণটি সুন্দর সব অঙ্গদেশীয় নলপট্টিকায় ঢাকা। বড় বড় মৃৎপাত্রে তুষের আগুন রাখার ব্যবস্থা হচ্ছে। ভিক্ষু সংঘ আসবার কিছুক্ষণ আগে থেকেই তাতে চন্দনচূর্ণ ছড়ানো হবে।
বিশাখা এখন নিশ্চিন্ত, পরিতৃপ্ত। পরিমার্জন, চিত্ৰণ বিশেষত চন্দনচূর্ণের কল্যাণে তার গৃহের বাতাবরণ থেকে আজ সমস্ত অপ্রসন্নতা, অপবিত্রতা, হতাশার গ্লানি দূর হয়ে গেছে। কোনও উদ্বেগ নেই, আছে একটি শান্ত প্রতীক্ষা। ভদ্দিয়তে সেই সাত আট বছর বয়সের পর সে আর বুদ্ধ ভগবানকে দেখেনি। তাঁর সম্পর্কে তার ভক্তির চেয়েও কৌতূহল বেশি। অল্প বয়সে তখন বুঝতে না। অভিভূত হবারই বয়স সেটা। কিন্তু পরে সে দেখেছে তার পিতা ধনঞ্জয়, মাতা সুমনা এঁরা কেউই ঠিক যাকে বলে ভক্তি গদ্গদ্— তা হননি। তাঁরা নোকাচার পালন করেন, পারিবারিক বিধি পালন করেন, বুদ্ধের উপদেশগুলিকে বিচার করে যা নেবার নেন, অবশিষ্ট সম্পর্কে নীরবে থাকেন। অর্থাৎ সবার ওপরে কাজ করে তাঁদের নিজেদের বিচার বুদ্ধি, মন। বিশাখাও সেই রীতিতেই চলতে অভাস্ত। তারও বিচার বুদ্ধি অত্যন্ত প্রখর। সে যে কী পাবার আশায় বুদ্ধ-সংঘকে নিমন্ত্রণ করে আনিয়েছে, তা তার কাছে স্পষ্ট নয়। ভক্তি নয়, স্মৃতি, বাল্যস্মৃতির ঘোর। সমর্পণ নয়, শ্রদ্ধা। আবেগ নয়, সন্ধিৎসাই খুব সম্ভব আজ তার এই নিমন্ত্রণের পেছনে কাজ করছে।
ধনপালী তাকে স্নানের জন্য তাড়া দিতে এসেছে। তার এই তিন সই আজ দারুণ উত্তেজিত। তাদের উত্তেজনার কারণ অবশ্য ভিন্ন ভিন্ন। প্রথমত তারা সকলেই শুনেছে এই বুদ্ধ ভগবান অসাধারণ সুদর্শন। এখন তাঁর চল্লিশের যথেষ্ট ওপর বয়স হয়েছে, কিন্তু দেখায় নাকি তরুণের মতো। এই সুন্দর পুরুষটি কেমন সুন্দর— এই তাদের প্রধান কৌতূহলের বিষয়।
ময়ূরী ঘোষণা করেছে— দেখিস, যতটা লোকে বলে ততটা নয়। সব কিছু বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলা লোকের স্বভাব।
ধনপালীর মত— বজ্জিদের মতো সুন্দর তো কেউ নয়। কিন্তু ওই নাতপুত্ত? উনি তো বজ্জি। উনি কি সুন্দর? একটুও নয়। তবে? বুদ্ধ তথাগতও এক প্রৌঢ় সন্ন্যাসী ব্যতীত আর কিছু না। কহ্নার কৌতূহল— শোনা যায় এঁর দেহে বত্রিশটি মহাপুরুষ-লক্ষণ আছে। সে ওই লক্ষণগুলি গুনে গেঁথে দেখতে চায়।
ময়ূরী তাতে বলে— তুই কি তবে বুদ্ধ ভগবানকে মুখ হাঁ করতে বলবি? চল্লিশটা দাঁত আছে কি দেখবার জন্য?
সবাই তাতে হাসতে আরম্ভ করলে ময়ূরী বলে— অন্যগুলি দেখব। কত দীর্ঘ হাত। মাথায় সহজাত উষ্ণীষ আছে কিনা। দেহ-ত্বকে সত্যি সত্যি ধুলো লাগলে ঝরে যায় কিনা!
তখন আবার ময়ূরী বলে— তুই কি ওঁর গায়ে ধুলো ছুঁড়ে দেখবি? কহ্না কিছু বলে না! মৃদু মৃদু হাসে।
বিশাখা তাইতে সাবধান করে দিয়েছে ওদের— কোনও অভদ্র আচরণ ওরা যেন আবার করে না। ফেলে।
স্বামিনীর দেহটি নবনী ও হরিদ্রার অবলেপ্য দিয়ে বেশ করে মাজবার পর এবার ওরা তাকে পীঠিকায় বসিয়ে কলসে করে দুগ্ধমিশ্রিত জল ঢালছে। বিশাখার চুলগুলি এখন চুড়ো করে বাঁধা। দধি এবং ভেষজ দিয়ে আগেই তাদের পরিষ্কার করা হয়েছে। কোমল ক্ষার মৃত্তিকা দিয়ে এবার সর্বাঙ্গ লেপে দিল ধনপালী। চন্দন জল ঢালল তারপর। সবশেষে পরিষ্কার কাকচক্ষুর মতো নির্মল জল দিয়ে মাথা থেকে পা পর্যন্ত সব ধোয়া হল। এবার অতি কোমল মার্জনী বস্ত্র দিয়ে মুছিয়ে দেবার পর চন্দনের পাপড়ির মতো কোমল, পদ্মবর্ণ দেহত্বক দেখা দিল, আরও উজ্জ্বল, আরও কান্তিমান।
চুলগুলি মেলে দিয়েছে বিশাখা। জ্বালা হয়েছে সুগন্ধি ধূপ। ব্যজনী দিয়ে বাতাস করছে ময়ূরী। ধনপালী সেগুলিকে খুলে মেলে মেলে দিচ্ছে। কহ্না বস্ত্র বার করেছে পেটিকা থেকে। লঘুভার সূক্ষ্ম চম্পক বর্ণের দুকূল। বার করে কহ্না বলল— ভদ্দা, এই বর্ণ কিন্তু কাষায়বর্ণের কাছাকাছি। সমনরা আবার এই দেখে তোমাকে পব্বজ্জা দেবার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠ্বেন না তো?
বিশাখা বলল— কেন? যদি নিই-ই পব্বজ্জা!
অমনি তিন সই ছুটে এসে বিশাখার দুই পা, দুই হাত নিজেদের হাত দিয়ে শক্ত করে বেঁধে ফেলল।
—কী করিস? কী করিস? —বিশাখা হাসতে থাকে।
কহ্না দৌড়ে গিয়ে চম্পকবর্ণের দুকূলটি তুলে ফেলল। —না, এই বসন তুমি আজকে পরবে না ভদ্দা। আমরা তোমার বেশকারিণী, আমরা যা বলব তাই শুনতে হবে। সই বলো না আমাদের?
—সে একটি আকাশের মতো নীল, অথচ সকালের রোদের মতো স্নিগ্ধোজ্জ্বল বসন বার করে।
বিশাখা সেদিকে এবার তাকিয়ে বলে— যদি তথাগত মনে করেন আমি রূপগর্বিত! দেবী ক্ষেমার মতো আমার অবস্থা করেন যদি! এই নীল দুকূলে বড় বেশি সজ্জিত লাগে আমাকে।
ধনপালী বলল— সজ্জিত বলো না, সুন্দর বলো। তা কোন বর্ণে তোমাকে অসুন্দর দেখাবে বলো তো! বলে দাও! সেটাই বার করি।
বিসাখা বলল— শ্বেতবর্ণ দে।
ময়ূরী বলল— শ্বেতবর্ণে তোমাকে পূজনীয়া দেবীর মতো লাগে। বেশ তাই ইচ্ছা হয় তাই পরো, কিন্তু ভিক্ষুরা ভক্তি গদগদ হয়ে প্রণাম করলে আমরা জানি না।
বিশাখা র্ভৎসনা করে বলল— ছি ময়ূরি, এত অহংকার ভালো না। যাঁরা নির্বাণ পথের পথিক তাঁদের কাছে সুন্দরী ও বানরীতে কোনও পার্থক্য থাকে না।
—তুমি কী করে জানলে?
—আমি ঠিক জানি। শ্বেত দুকূলটি কটিতে বাঁধতে বাঁধতে বিশাখা বলল। শ্বেত নীবিবন্ধে বাঁধা পড়ল বসনটি। ঊর্ধ্বাঙ্গে শ্বেত ঊর্ণার উত্তরীয় ভালোভবে জড়িয়ে নিল বিশাখা! সর্বশ্বেত। শুধু তার স্তনপট্টের শ্যামল বর্ণ উত্তরীয়ের মধ্য দিয়ে আভাসিত হতে লাগল।
এই ভাবেই রন্ধনগৃহে গেল সে। ভিক্ষুদের জন্য পায়স ও অপূপ নিজ হাতে প্রস্তুত করল। উডুম্বর, অলাবু, কুষ্মাণ্ড, বতিঙ্গণ সৌভঞ্জন বিভিন্ন শাক ও মেথিকা পলঙ্ক্য ইত্যাদি পর্ণ দিয়ে সুস্বাদু ব্যঞ্জন প্রস্তুত হয়েছে। উত্তম ঘৃতৌদন, তিলৌদন, দধি, মিষ্টান্ন। ঘৃত, নবনীত, গুড়, সুবৃহৎ সুমিষ্ট কদলী।
মিগার-পত্নী এসে আয়োজন দেখে প্রশংসা করলেন। বললেন— এই দশবলকে দেখতে আমি বড় উৎসুক রয়েছি বিসাখা! ইনি মহারাজ প্রসেনজিৎকে পর্যন্ত বশ করেছেন।
মধ্যাহ্ন সমাগত। পুরনারীরা সবাই সমবেত। বিশাখা মিগার সেট্ঠিকে কোথাও দেখতে পাচ্ছে না। অবশেষে তার একজন দাস এসে জানাল, মিগারকে তাঁর গৃহের পেছন দিককার কাননে নিগ্গণ্ঠ শ্ৰমণদের সঙ্গে আলাপ করতে দেখা গেছে। নিগ্গণ্ঠরা নাকি দলে দলে এসে মিগারকে তাঁর কর্মকক্ষ থেকে এক প্রকার তুলে নিয়ে গেছেন। দাসটি এসে বলল— প্রভু বললেন, বধূই নিমন্ত্রণ করে এনেছে। বধূর গৃহেই ভোজনের আয়োজন হয়েছে, বধূই ভিক্ষুদের আপ্যায়ন করুক। তিনি কাজে ব্যস্ত আছেন।
এমন সময়ে ময়ূরী এসে সংবাদ দিল দেখো, দেখো, সমনেরা আসছেন! ধনপালী ও কহ্না তাড়াতাড়ি শাঁখে ফুঁ দিল। বিশাখা তার গৃহের উন্মুক্ত সুসজ্জিত দ্বারদেশের সামনে বদ্ধাঞ্জলি হয়ে দাঁড়াল।
খর রোদে কাষায় চীবরগুলির ওপর যেন আগুন লেগেছে। চোখ ঝলসে যাচ্ছে। শীতসকালের আকাশপটে ছড়িয়ে থাকা ময়ুখসমূহই কি সংহত হয়ে শ্রাবস্তীর পথে নামল নাকি? পার হয়ে আসছে মিগার-গৃহের দ্বার, কানন, বিশাখার পরিমার্জিত, সজ্জিত প্রাঙ্গণে ঢুকবে বলে? নাকি এগুলি সেই হব্যবাহন অগ্নির শিখা সমুদয়, যে অগ্নির সেবা করতে বিশাখা অস্বীকৃত হয়েছিল? বিশাখা অদ্ভুত এক সম্মোহে, দৃষ্টিবিভ্রমে দেখে আগুনের শিখাগুলি কাঁপছে—লেলিহান নয়, তাই ভয় জাগায় না, কিন্তু জ্বলছে। দীপ্তি ছড়িয়ে যাচ্ছে চারদিকে, ওই এবার কাননে প্রবেশ করলো। জ্বলছে, অথচ দাহ নেই তো! চোখ ঝলসে দিল দীপ্তিতে, দাহে নয়। কানন পার হয়ে যখন তার প্রাঙ্গণে প্রবেশ করলো তখন সে সবিস্ময়ে উপলব্ধি করল, এ আগুন, শীতল আগুন। তার চিত্তের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম কোণগুলিতে প্রবিষ্ট হচ্ছে এ আগুনের শীতল ভাস্বর শান্তি। গুনগুন করে কোনও সূক্ত বলতে বলতে সারিবদ্ধভাবে আসছেন ওঁরা। প্রত্যেকের দেহদণ্ড কাষায় চীবরে সম্পূর্ণভাবে আচ্ছাদিত, পরিষ্কার মুণ্ডিত মস্তকগুলি দেহদণ্ডের ওপর দীপের মতো শোভা পাচ্ছে, চলার কী অনুপম ছন্দ! যেন কোনও অদৃশ্য মৃদঙ্গের তালে তাল মিলিয়ে ওঁরা আসছেন। আরও নিকটবর্তী হলে সে সেই মৃদঙ্গের ধ্বনিগুলি, বাণীগুলি শুনতে পেল :
অনেক জাতি সংসারং সন্ধ্যাবিসসং অনিব্বিসং
গহকারকং গবেসন্তো দুক্খা জাতি পুনপ্পনং।
গহকারক দিট্ঠোসি পুনগেহং ন কাহসি
সব্বা তে ফাসুকা ভগ্গা গহকূটং বিসংখিতং
বিসংখারগতং চিত্তং তনহানং খয়মজঝগা।
গৃহকারককে তোমার দেখেছ হে সমনগণ! এ কথা সত্য? অনেক জন্ম ঘুরে ঘুরে সন্ধান করেছ! ব্যর্থ হয়েছ, তবু ছাড়োনি? এই দেহগৃহের রচক! কে সে? সংস্কার, তৃষ্ণা সব খসে পড়ে গেছে? গৃহকূট ভেঙে তবেই বিপুল শান্তি? আশ্চর্য! কী আশ্চর্য কথা বলছো? আমি যে এই গৃহকূটকেই ভালোবেসেছি, কষ্ট পাচ্ছি, একেই যে পরম বলে মনে করেছিলাম।
ধনপালী সোনার ভৃঙ্গার এগিয়ে দেয় —ভদ্দা! ভদ্দা! কী করছো! আত্মবিস্মৃত হলে যে! সমনদের অভ্যর্থনা করো!
এক আঘাতে দেহগৃহে ফিরে আসে বিশাখা, ধূলিলিপ্ত চরণগুলিতে জল ঢালে, জল ঢালে, জল ঢালে।
সত্থি, সত্থি— কে উচ্চারণ করছেন? কে?
প্রত্যেকেই। প্রত্যেকেই তো! অথচ যেন মনে হচ্ছে একজন!
স্বস্তি উচ্চারণ করে ভিজে পায়ের চিহ্ন ফেলে ঢুকছেন, মিগার-পত্নী মার্জনী বস্ত্র নিয়ে এগিয়ে আসছেন। প্রত্যেকের জন্য ভিন্ন ভিন্ন। কিন্তু এই সেবা নিচ্ছেন না সমনরা। স্মিত মুখে মার্জনী বস্ত্র হাতে নিয়ে চরণ মুছে নিচ্ছেন…সত্থি, সত্থি।
—সব্বে সত্তা সুখিত্তা হোন্তু…
রৌদ্র-ভরা, মোহদিগ্ধ চোখ দুটি এতক্ষণে তোলে বিশাখা। তার সামনে দাঁড়িয়ে পঙ্ক্তির সর্বশেষ শ্ৰমণ। রূপলোকের দেবতারা যেখানে থাকেন সেখানে কি একটি পলাশবৃক্ষ আছে? মহা মহীরুহ,? সেই পলাশই তবে আজ ফুটেছে এখানে! দেবকাননের দিব্য পলাশ! কী মহান! কী স্নিগ্ধ! কী অপার করুণাময় চোখ দুটি! সমস্ত হৃদয় জলের মতো তরল হয়ে টলটল করে তারপর স্রোত হয়ে ধুয়ে দিতে চায় ওই চরণ দুটি।
প্রবেশ করছেন উনি শ্লোকের শেষে পূর্ণচ্ছেদের মতো। বুঝি অনন্তযৌবন। দৃঢ়কায়, কিন্তু অসামান্য কোমল। সাত বছর বয়সে ওঁকে দেখেছিল। সেই স্মৃতি ছিল একটি অস্পষ্ট চিত্রের মতো। তাকে আজ পরিমার্জনা করে, উজ্জ্বল করে তার ভাগ্য তার সামনে দাঁড় করিয়ে দিল। কে বলে পুরুষ রুক্ষ, কর্কশ, অমার্জিত! এই তো পুরুষ। এই পুরুষের জন্যই কতকালের প্রতীক্ষা তোমার নারী! বলিষ্ঠ অথচ রুক্ষ নয়, দৃষ্টিতে মহাপ্রেম মহাক্ষেম। কই রিরংসা তো নেই! কী লাবণ্য অথচ কী দার্ঢ্য! সঙ্গীরা বলেছিল না সিদ্ধার্থই সেই পুরুষ যিনি…
বিশাখা নিজেকে সবলে ভেতর থেকে আঘাত করে। এ কী চিত্তবিকার! তার হাত পা কাঁপছে কেন? অঙ্গে রোমহর্ষ। বিন্দু বিন্দু স্বেদজল কপালে। সে যেন স্বপ্নের ঘোরে। এবং কোথা থেকে কেউ ডাকছে ‘ভদ্দা, ভদ্দা, শীঘ্র এসো, আপ্যায়ন করো, ভগবান তথাগত ও সমনদের ভোজনে আপ্যায়ন করো।’ বনকপোতের ডাকের মতো দুরাগত উন্মনা আহ্বান।
কুমারী বিশাখা এগিয়ে যাচ্ছে। এখনও সে কুমারীই। দত্তা কিন্তু গৃহীতা নয়। সে পথ দেখতে পাচ্ছে না। আবিষ্টের মতো এগিয়ে যাচ্ছে। কহ্ন আর ময়ূরী দু পাশ থেকে তার সঙ্গে সঙ্গে চলেছে। তারা খুব সম্ভব বুঝতে পেরেছে তার বিহ্বল অবস্থা।
শ্ৰমণ দলের পুরোভাগে বুদ্ধ তথাগত। ওঁর হাতে জল ঢেলে দিতে হবে। তখন উনি এই ভোজন-আপ্যায়ন গ্রহণ করতে সম্মতি দেবেন। দান গ্রহণের এই-ই নিয়ম। হতবুদ্ধির মতো বিশাখা তথাগতর দিকে চায়, হাতে জল দেয়। উনি স্মিত মুখে গ্রহণ করেন। এ কি রহস্য হে শক্কদেব! সারির প্রথমেও তথাগত! শেষেও তথাগত? ইনি বলিষ্ঠ এক প্রাজ্ঞ পুরুষ, সিংহকটি। জ্বল জ্বল করছে দেহত্বক। মুণ্ডিত শিরের মধ্যভাগ অল্প উঁচু। ওরা বলেছিল, ওঁর মাথায় সহজাত উষ্ণীষ আছে। প্রশান্ত গম্ভীর মুখমণ্ডল, যেন জ্যোতি বেরোচ্ছে এমনি চম্পক গৌরাঙ্গ। দুই ভ্রূর মাঝখানে দুর্বাঘাসের মতো এক গুচ্ছ রোম। যেন তৃতীয় নয়নের অধিষ্ঠান বোঝাচ্ছে। যে নয়ন দিয়ে তিনি লোকাতীতকে প্রত্যক্ষ করেন, প্রত্যক্ষ করেন লক্ষ বছরের ইতিহাস, এবং আগামী সময়। প্রণত হল বিশাখা। পুরোভাগে যদি তথাগত তবে পঙ্ক্তির শেষে উনি কে? কাকে সে সিদ্ধার্থ ভেবেছিল? ইনি যদি দিব্য আগুন, উনি তবে দিব্য পলাশ। ইনি যদি পশুরাজ উনি তবে মৃগযূথপতি! বিশাখা মুখ নত করে রইল।
শ্রমণেরা ধীরে ধীরে বসছেন। বিশাখার গৃহ আলোময় হয়ে উঠছে। তথাগত শ্রমণদের পরিচয় দিচ্ছেন। মুখে প্রসন্ন মৃদু হাসি। বিসাখা— ইনি সারিপুত্ত। এঁকে ধম্মসেনাপতি বলা হয়। মহাপণ্ডিত। আর ইনি হলেন মোগ্গল্লান-মহাইদ্ধিমান। এঁরা তথাগতর অগ্গসাবক। এঁরা দুজনেই ধম্মের সবচেয়ে কুশলী প্রবক্তা। যদি তোমার বা পুর-ইত্থিদের কারও কিছু জিজ্ঞাস্য থাকে, তথাগতকে প্রশ্ন করবে না বচ্চে, এঁদের দুজনকে প্রশ্ন করবে।
বয়স্থ দুই অগ্রশ্রাবক এবং অন্যরাও স্মিতমুখ। কৌতুকে উজ্জ্বল মুখ পুরনারীদের। তথাগত তাহলে অন্য সমনদের মতো গুরুগম্ভীর নন! লঘু আনন্দের হিল্লোল মৃদু স্বস্তিকর দখিনা বাতাসের মতো ছুঁয়ে যায় বিশাখার ভোজনশালা।
—ইনি তিস্স—বিশাখা চমকে ওঠে— লোকে এঁকে স্থূলতিসস্ বলে, অন্য সমনরা তাতে বাধা দিতে পারেন না। যা সচ্চ তাকে তো মানতেই হবে। বলো? ইনি ভোজনপটু। তোমার আয়োজনের সদ্ব্যবহার করবেন। স্থূলতিষ্য হাসছেন। কিন্তু তাঁকে ঠিক লোভী বলে মনে হচ্ছে না।
এবার নারীদের মধ্যে হিল্লোল আর একটু স্পষ্ট হয়। যদিও সবাই কায়সংযমের কথা স্মরণে রাখে।
—ইনি কৌণ্ডিন্য। মৃগদায়ে তথাগতকে প্রথম আসন দিয়েছিলেন। না দিলে তথাগত আজও মৃগদায়ে দাঁড়িয়ে আছেন।
ইনি অর্হৎ যশ— অতি অল্প সময়ের মধ্যে অৰ্হত্ত্ব প্রাপ্ত হয়েছেন। সত্যই যশস্বী।
ইনি উপালি—সঙেঘর শ্রেষ্ঠ বিনয়ধর হয়ে উঠছেন ক্রমশই।
ইনি ভিক্ষু অনঘ আর ইনি ভিক্ষু সুভদ্দ —এঁরা সংঘের প্রথম গান্ধার দেশীয় ভিক্ষু। এঁরা তথাগতর উদীচ্য-জয়ের স্মারক বলতে পারো বিসাখা।
আর ইনি। এঁকে দেখো বচ্চে। ইনি আনন্দ। নিজেকে সবার পেছনে রাখতে ভালোবাসেন। যদিও আদৌ পশ্চাৎপদ নন। বরং অসামান্য সুকৃতির অধিকারী। ভিক্ষুণীসংঘ এঁর ইচ্ছাতেই স্থাপিত হয়েছে। নারীদের দুঃখ ইনি সবচেয়ে ভালো বোঝেন।
জ্যোতির্ময় শাক্যসিংহ আম্রবৃক্ষের তলায় সুরচিত মৃৎবেদীর ওপর থেকে মধুর গম্ভীরস্বরে কী উপদেশ দিলেন, বিশাখা তা জানল না। শুধু ধ্বনি শুনল। অপূর্ব কোনও মৃদঙ্গের মতো। সে জানল না, শাক্যসিংহ লক্ষ করেছেন গহপতি উপস্থিত নেই। তাঁর দেশনাকে তাই তিনি সচেতনভাবে করেছেন আরও মর্মস্পর্শী। পার্থিব জীবনের সমস্ত দুঃখগুলিকে তিনি দু হাতে ধরে ভালো করে ঝাঁকিয়ে এক একটি অয়োমুখ শায়কের মতো নিক্ষেপ করছেন এবং তা নির্ভুল লক্ষ্যে আবরণীর পেছনে বসা মিগার সেট্ঠির হৃদয়ে বিঁধে যাচ্ছে। তথাগত যেন ব্যক্তিগতভাবে জানেন মিগারের সব অপমানের দুঃখ, প্রতিযোগিতায় হারের দুঃখ, প্রিয়সঙ্গগুলি না পাওয়ার দুঃখ, অপ্রিয় সঙ্গের দুঃখ, ধনক্ষয় হওয়ার দুঃখ, বয়স বৃদ্ধির দুঃখ, জীবনের বাঁকে বাঁকে প্রতি মুহূর্তের নিরন্তর সংগ্রামের দুঃখ, মনোমত সন্তান না হওয়ার দুঃখ, জীবনের সব ক্ষেত্রে দ্বিতীয়, তৃতীয় কিংবা চতুর্থ হওয়ার দুঃখ। জন্মের সঙ্গে সঙ্গে দেহত্বকের মতো জীবের গায়ে লেগে যায় এই সমস্ত দুঃখ। সম্মা দিট্ঠি, সম্মা সংকপ্পো, সম্মা বাচা, সম্মা কম্মন্তো, সম্মা আজীবো, সম্মা ব্যায়ামো, সম্মা সতি, সম্মা সমাধি— এই আটটি সম্যক্ পালন করলেই জীবচক্র থেকে মুক্তি পাবে। যেতে হবে না কৃচ্ছের কঠিন সাধনে, শুধু অপরিমিত বিলাস ও ভোগের স্রোতে গা ভাসিও না, সচেতন থাকো, দান করো হে কৃপণ, ধন কুক্ষিগত করে রেখো না। দানই সেই সহায়ক যা তোমাকে নির্বাণলোকে নিয়ে যাবে।
বিশাখা দেখল, তার রুক্ষমূর্তি, কটুভাষী শ্বশুর অসহিষ্ণু মিগার সেট্ঠি বুদ্ধকে ভূলুণ্ঠিত হয়ে প্রণাম করছেন। ও কি, তিনি যে এবার তাকিয়ে আছেন তারই দিকে! চোখে শ্রদ্ধা বিস্ময়— বিসাখা বিসাখা সুহ্না আমার, বালিকা বলে তোমাকে উপেক্ষা করেছিলাম। কিন্তু তুমিই এতদিনে মিগারের সত্যিকার দাহশান্তির কারণ হলে। মাতৃস্তনধারার মতো শান্তিধারায় তুমি আমায় স্নান করালে মা। আজ থেকে তুমি মিগারের মাতা। ভন্তে, আপনি কদিন নিত্য মিগারের ঘরে নিমন্ত্রণ গ্রহণ করুন।
তথাগত স্মিতমুখে মৌন হয়ে রয়েছেন। হতাশ নির্গ্রন্থের দল ক্রুদ্ধ মুখে কানন থেকে চলে যাচ্ছে। তারা সারাক্ষণ অন্তরাল থেকে দেখেছে এই দ্বৈতযুদ্ধে কীভাবে নাতপুত্তকে পরাজিত করে সমন গোতম অনায়াসে জয়ী হলেন। মায়াবী। সত্য সত্যই ইন্দ্রজাল আয়ত্ত করেছে লোকটি।
উনি আসবেন? ওঁরা আসবেন। মিগারের গৃহে! বিশাখার গৃহে? বিশাখার আপন গৃহে? উনি? উনি আসবেন তো? ওই পরমানন্দ? কত কি বলার ছিল বিশাখার। হে শক্কদেব, ভাষা দাও, হে ইড়া, সরস্বতী, বাক্ হয়ে জিহ্বায় ভর করো। কিংবা এমন ভাষা দেবে কী? যা না বলেও বলতে পারে?
২৯
যোতীয়, কাকবলীয়, জটিল, পুণ্যক— এঁরা সবাই রাজগৃহে থাকেন। পঞ্চ মহাশ্রেষ্ঠীর মধ্যে একমাত্র মেণ্ডকই বেছে নিয়েছেন ভদ্দিয়। তিনি ছাড়া আর চারজন আজ সমবেত হচ্ছেন রাজগৃহ-শ্রেষ্ঠী অহিপারকের গৃহে। অহিপারক অন্যদের চেয়ে ধনে ন্যূন হলে হবে কি, তিনি মগধের রাজসভার স্বীকৃত শ্ৰেষ্ঠী। রাজা ও রাষ্ট্রীয় ব্যাপারের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ প্রত্যক্ষ এবং ঘনিষ্ঠ। তাঁর মর্যাদাই স্বতন্ত্র।
অহিপারকের বহির্বাটিতেই, কিন্তু তাঁর নিজস্ব নিভৃত কক্ষে আজ মৃদু কিন্তু উৎকৃষ্ট সুরার ব্যবস্থা হয়েছে। শূকর-বৎসের তুলতুলে মাংসখণ্ড সব ভাজা হয়েছে। ভাজা হয়েছে রক্তালুক বা রাঙালুর খণ্ডও। তিল ও উত্তম গুড় দিয়ে মোদকও প্রস্তুত হয়েছে। শ্রেষ্ঠীরা এলে তাঁদের যথাবিধি অভ্যর্থনা করে খাদ্য ও সুরা দাসীরা দিয়ে যাবে। তার পর আর কেউ যেন ব্যাঘাত না করে, সেই মতোই ব্যবস্থা করেছেন অহিপারক। শ্রেষ্ঠী-জ্যেষ্ঠক হলেন যোতীয়। ইনি রাজগৃহের শ্রেষ্ঠীদের মুখপাত্র তো বটেই, সারা মগধে বিভিন্ন স্থানে যত ছোট বড় বণিক আছে, তারা নিজেদের নগরী অথবা গ্রামে ক্ষুদ্রতর বণিক সঙঘ করেছে। সেই বণিক সঙঘগুলি আবার রাজগৃহের শ্রেষ্ঠী-জ্যেষ্ঠকের কাছে তাদের যা-কিছু অসুবিধা-আবেদন নিবেদন জানায়। মগধের চার শ্রেষ্ঠী এবং শ্রেষ্ঠী অহিপারক আজ এই জাতীয় কোনও বিষয় নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় বসবেন। আবেদনগুলি স্বভাবতই এসেছে যোতীয়র কাছে, তিনি জানিয়েছেন অন্যদের। তাঁর গৃহেই সভা বসত। কিন্তু অহিপারক কোনও বিশেষ কারণে নিজ গৃহেই আমন্ত্রণ জানিয়েছেন এঁদের।
সময়টা সন্ধ্যা। দীপদণ্ডগুলি জ্বললেও, বাতাসের অভাবে সান্ধ্য কুয়াশা সূক্ষ্ম লতাতন্তুর মতো নগরীর ওপরে বিস্তৃত রয়েছে। সন্ধ্যা আর একটু গাঢ় হলেই সরে যাবে। এখন নগরীর সব রন্ধনশালায় কাঠের আগুন জ্বালানো হয়েছে উনানগুলিতে। সেই ধোঁয়াও কুয়াশায় অংশ নিয়েছে। শীতের জন্য লোক চলাচল ধীরে ধীরে অল্প হয়ে যাচ্ছে। বেরিয়েছে তিন শ্রেণীর মানুষ। দাস-দাসীরা, তাদের কোনও-না-কোনও কাজের কারণে; বণিক ও পর্ণিকরা, তাদের নানাবিধ আপণ ছড়ানো রাজগৃহের হাটে, না বেরোলে তাদের চলে না। আর বেরিয়েছে সেইসব প্রমোদ-বিলাসীরা যাদের প্রমোদ-তৃষ্ণার আকর্ষণ দুর্বার। বেরিয়েছে সুরালুব্ধ নাগরিক, সারা দিনের পর শৌণ্ডিকগৃহে না গেলে এদের অন্ন জীর্ণ হয় না। গণিকাসক্ত নাগরেরাও বেরিয়েছে, কেউ একা, কেউ সদলে। নৃত্য গীত বাদন, গণিকার সঙ্গে রসালাপ— এ তাদের নিত্যকৃত্য। গৃহে প্রচুর সঞ্চিত ধন, গ্রামাঞ্চলের শস্যক্ষেত্র থেকে এসে যাচ্ছে। পরিশ্রম নেই, কায়ক্লেশ নেই। সারা দিন গৃহের বাইরের কক্ষে সেই সম্পদের গোনাগাঁথা করে। কিছু মল্লক্রীড়া বা নিতান্ত বালসুলভ শস্ত্র-শস্ত্র খেলা খেলে, সন্ধ্যা হতেই এরা বেরিয়ে পড়ে। এদের মিলিত হবার জন্য নির্দিষ্ট ব্যবস্থা হল গোষ্ঠী। গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে রাজগৃহের ধনী, সচ্ছল, নানা বিষয়ে আগ্রহী পুরুষেরা মিলিত হয়ে বহুপ্রকার আলোচনায় কাল কাটায়। পাশা খেলা হয়, তবে পণ রেখে পাশা খেলার আরও ভালো ব্যবস্থা সুরাগৃহগুলিতে। সেখানে সুরা পরিবেশন করবার জন্য অধিকাংশ সুরাবণিকই নিয়োগ করে সুন্দরী দাসীদের। কখনও কখনও সুরাবণিকের নিজের কন্যা বা কন্যাস্থানীয়রাও আপ্যায়ন করে ক্রেতাদের। আর গণিকাদের গৃহে গেলে সর্ববিধ প্রমোদের সুপ্রচুর আয়োজন পাওয়া যায়। সুরা, চারুকলা, নারী, নানান উচ্চশ্রেণীর বিদ্যা ও জ্ঞানের আদানপ্রদান।
রাজগৃহ যখন প্রথম গড়ে উঠেছিল তখন এ নগরের গণিকাসম্পদ বলবার মতো কিছু ছিল না। অতি তরুণ রাজা তখন রাজ্য বিস্তার, অর্থাৎ সংগ্রাম এবং নিজের রাজ্যে সর্বপ্রকার প্রজার সুখবিধান করতেই ব্যস্ত ছিলেন। ধনসম্পদে ঋদ্ধ শ্ৰেষ্ঠীশক্তি সেই সময়ে রাজার পাশে দাঁড়িয়ে তাঁকে সর্বপ্রকার সাহায্য দেয়। সার্থবাহ অর্থাৎ বণিক দলের নেতারা বিভিন্ন জনপদে ঘুরে ঘুরে অমূল্য অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে আসতেন। কোন রাজ্যের কী বিশেষত্ব, কোথায় কোন্ কারণে বণিক সমাগম অধিক হয়, এসবের চতুর বিশ্লেষণ একমাত্র তাঁরাই করতে পারতেন। যোতীয়, জটিল এঁরা তাই-ই করেছিলেন—রাজগৃহে নদী না থাকায় তাঁরা পাটলি গ্রামটিকে বাণিজ্যদ্বার বলে ব্যবহার করতেন, এখনও করে থাকেন। এখানে গঙ্গা ও হিরণ্যবাহর সঙ্গম। পাটলি গ্রাম বারাণসীর মতো পট্টন না হলেও, অতিশয় সমৃদ্ধ একটি নিগম গ্রাম। এঁরাই রাজাকে পরামর্শ দেন বৈশালীর মতো রাজনটীর প্রথা প্রবর্তন করতে। এই নটীকে রাষ্ট্রের ব্যয়ে শিক্ষিত করা হবে। এর আকর্ষণে পাটলিতে পণ্য নামিয়ে চলে যাবে না বণিকরা। একটু পথ এগিয়ে রাজগৃহে আসবে। আর কে না জানে, বণিকদের চলাচলই যে-কোনও নগরীর, যে-কোনও রাজ্যের সমৃদ্ধির উৎস। শালবতী নামে এক সুন্দরীকে অতঃপর নিয়োগ করা হল। তাঁর মায়ের তত্ত্বাবধানে শালবতী হলেন নৃত্যগীত ও অন্যান্য গুণে অলঙ্কৃতা এক অপরূপা গণিকা। তাঁর জন্য তাঁর মা দাবি করলেন এক রাত্রির জন্য সহস্ৰ কার্ষাপণ। বৈশালীর গণিকা-শ্ৰেষ্ঠা আম্রপালীর দক্ষিণা ছিল তার অর্ধেক। এই নিয়ে রাজগৃহ ও বৈশালীর মধ্যে তীব্র মনোমালিন্যের সৃষ্টি হয়। যাই হোক, এখন এই শালবতী বা সালাবতী ছাড়াও রাজগৃহে আরও তরুণী সুন্দরী গণিকাদের বসবাস হয়েছে। সকলে শালবতীর মতো উচ্চমূল্যের এবং রাজা ও রাজপুরুষ-ভোগ্যা নন। নানা শ্রেণীর পুরুষের মনোরঞ্জনের ব্যবস্থা রাজগৃহে প্রবর্তন করেছেন শ্ৰেষ্ঠীরা। বা বলা যায় তাঁদের প্রথম উদ্যোগের পর আপনা-আপনি এই ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। কেননা, নগরী, বিশেষত রাজধানীতেই তো যত ধনী, অবসরপ্রাপ্ত যুবাপুরুষদের ভিড়। প্রৌঢ় ও বৃদ্ধরাও অবশ্য বাদ যান না। মগধের বিভিন্ন স্থান থেকে, সংলগ্ন রাজ্যগুলি থেকেও এই গণিকাদের আকর্ষণে আসে বহু লোক। বাণিজ্য রমরম করতে থাকে। সর্বপ্রকার বাণিজ্য। আবসথাগার, আরাম, সুরাগৃহ, বহুবিধ বিলাসদ্রব্য, বসন, অলঙ্কার, ভৈষজ, খাদ্যদ্রব্য। শ্রেষ্ঠীরা যথার্থই বলতে পারেন— এই নগরীর প্রতিষ্ঠার, স্থান নির্বাচনের, আরক্ষার গৌরব যদি মহারাজ বিম্বিসারের, নগর-পরিকল্পনার গৌরব যদি স্থপতি মহাগোবিন্দর, তবে এর সমৃদ্ধি এবং সমারোহের গৌরব নিঃসন্দেহে শ্ৰেষ্ঠীদের। তবে তাঁরা এসব কথা প্রকাশ্যে বলেন না। ভাবুক না রাজারা, ক্ষত্রিয়রা নিজেদের শ্রেষ্ঠ ভাবাতে তো কোনও দোষ নেই! ব্রাহ্মণ-পণ্ডিত-পুরোহিত এঁরাও নিজেদের শ্রেষ্ঠ ভাবতে থাকুন। ক্ষত্রিয়রা বা সাধারণভাবে সব শস্ত্রধারী যোদ্ধাই, সে ক্ষত্রিয়ই হোক, ব্রাহ্মণই হোক, সংগ্রামে প্রাণ দিয়েও ভূমি-ধনসম্পদ রক্ষা করবে। তাদের আত্মশ্লাঘার প্রসন্নতায় স্থিত রাখা ভালো। পণ্ডিত-পুরোহিত-আচার্যরাও বহু ক্লেশ করে ধরে রেখেছেন জাতির সঞ্চিত বিদ্যা। এঁরাও দেশের গৌরব। কিন্তু প্রকৃত শক্তির স্বাদ পাচ্ছেন এখন শ্ৰেষ্ঠীরা।
প্রধানত আজ এঁদের আলোচনার বিষয়বস্তু এই-ই। এই নবলব্ধ শক্তি কীভাবে আরও বাড়ানো যায়, কীভাবে এ শক্তির যথার্থ প্রয়োগ করা যায়—এ নিয়েই এঁরা চিন্তিত।
যোতীয় এঁদের মধ্যে সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ। তাঁর কেশ তো শুভ্র বটেই, ভ্রূগুলিও পেকে গেছে। তার ওপর তিনি সিংহভ্রূ। যোতীয়র গাত্রবর্ণ তামাটে। তিনি শ্বেত বস্ত্র ছাড়া অন্য কিছু পরেন না। কপালে তিন-চারটি স্পষ্ট বলিরেখা, হাসলে চোখ এবং ওষ্ঠাধরের পাশে কুঞ্চন দেখা যায়। কিন্তু নাতিদীর্ঘ দেহটি বলিষ্ঠ, দেহত্বক এখনও লোল হয়নি। ঊর্নার আচ্ছাদনে তিনি ভালো করে ঊর্ধ্বাঙ্গ ঢেকেছেন, পায়ে কোমল মৃগচর্মের উপানৎ। হঠাৎ তাঁকে দেখলে সম্ভ্রম হয়। কিন্তু শ্বেত স্থূল ভ্রূর তলায় তাঁর চোখ দুটি অতিশয় ধূর্ত এবং দর্পী। তিনি অতি স্থূল বা অতি কৃশ নন।
যোতীয় রথ থেকে নামতেই, অহিপারকের ভূতকরা তাঁকে সাহায্য করবার জন্য সসম্ভ্রমে এগিয়ে এলো। যোতীয় হাতের যষ্টিটি আস্ফালন করে বললেন, ‘সাহায্যের প্রয়োজন নেই, দূরে যাও’— তাঁর বলবার ভঙ্গি ঈষৎ রুক্ষ।
অহিপারকের মুখ্য লেখক বসু অদূরে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি চোখের ইঙ্গিতে ভৃতকদের নিরস্ত করে শ্রেষ্ঠীকে পথ দেখিয়ে মন্ত্রণাগৃহে নিয়ে গেলেন।
প্রশস্ত মণিকুট্টিমের ওপর বসবার জন্য শয্যা বিছানো। তার ওপর ইতস্তত উপাধান। কতকগুলি ত্রিপদীও ইতস্তত ছড়ানো আছে। যোতীয় আসতেই অন্যরা সবাই উঠে দাঁড়িয়ে অভ্যর্থনা করলেন।
শ্রেষ্ঠী কাকবলীয় একটি খর্বকায় বলিষ্ঠ প্রৌঢ়। তাঁর পরনে ধূসর বর্ণের বসন। শ্মশ্রু গুম্ফ দুটিতেই তামাটে ভাব। কিছু কিছু পক্ক কেশও আছে। ইনি বিরলকেশ।
ইনি যদি বিরলকেশ হন তো জটিল একেবারেই কেশহীন। মাথায় একটি সুগোল ইন্দ্রলুপ্ত। সেটির অস্তিত্ব ইনি কিছুতেই ভুলতে পারেন না। সর্বদাই হাত বোলান। অল্প শ্মশ্রু ও গুম্ফ পরিষ্কার ছাঁটা। ইনি কিছুটা স্থূল এবং শিথিলকায়। গৌরবর্ণ শরীরটি যে ভোগীর, তা দেখলেই বোঝা যায়। এঁর পরনের বস্ত্রে গোরোচনার চিত্র করা। উত্তরীয়টি হরিদ্রা বর্ণে রঞ্জিত।
পুণ্যক মানুষটি অতিশয় দীর্ঘকায় এবং শীর্ণ। সুগৌর, প্রায় যুবক এই শ্রেষ্ঠী পিতার উত্তরাধিকারকে অতি অল্প বয়সেই শতগুণ বাড়িয়েছেন শোনা যায়। ইনিই শ্রেষ্ঠীদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ। লোকে বলে, সম্পদগুলি ইনি স্বর্ণপিণ্ডে পরিবর্তিত করে ভিন্ন ভিন্ন গুপ্ত স্থানে পেটিকায় তাম্রকলসে রেখে দেন। অতি ব্যয়ের ভয়ে ভালো করে খান না। পরিজনদের তো দেনই না। ব্যয়ের ভয়েই এঁর গৃহে একটি মাত্র পত্নী। এঁর পুত্ররা নাকি খেলার ছলে শ্রেষ্ঠীর উদ্যানে গুপ্তধনের কলসগুলি সন্ধান করে বেড়ায়। সখাদের কাছে বলে, একটি কলস বা পেটিকার সন্ধান পেলেই চম্পট দেবে। পিতৃগৃহের খাদ্য বা বলা যায় অখাদ্য তাদের নাকি আর সহ্য হচ্ছে না। একটি মাত্রই কন্যা, তার বিবাহ দিয়েছেন অহিপারকের এক পুত্রের সঙ্গে। এই কন্যা মাধবিকা। আজ সাত বছর শ্বশুর গৃহে এসেছে, পিতার গৃহে একেবারেই যেতে চায় না। বলে, ‘পিতা কৃপণ, কন্যা জামাতা গেলে ব্যয়ের ভয়ে তাঁর বুক ফেটে যাবে। ভাইগুলি দুঃশীল, গেলেই বলবে কয়েক কহাপন দিয়ে যাও জেট্ঠা বড় প্রয়োজন আছে।’ একমাত্র মাতাকে দেখতে এবং তাঁর জন্য উপহার নিয়ে যেতেই মাধবিকা পিতৃগৃহে মধ্যে মধ্যে যায়। তার নিয়ে যাওয়া কাসিক দুকূল দেখে শ্ৰেষ্ঠী পুণ্যক শিহরিত হন— কী করেছ কন্যা, এত ব্যয় করেছ? অহিপারক আমার চেয়ে অনেক ধনী তা জানি, তাই বলে তার ধন এভাবে ক্ষয় করতে তোমার বাধে না!
মাধবিকা মনে মনে হেসে বলে, ‘এ ধন সেট্ঠির নয়, পিতা, তাঁর পুত্রের।’
—জামাতাকে এ ভাবে ধনহীন করে দিচ্ছো? তুমি তো দেখছি পুণ্যকের অপবাদের কারণ হবে। মাধবিকা এবার বিরক্ত হয়ে বলে, ‘অপবাদ হয় আমার হবে। আপনার কী? আপনার জামাতা বারাণসী থেকে এই বস্ত্র মায়ের জন্য বিশেষ করে এনেছেন।’
এইবার পুণ্যকের মুখ দিয়ে সত্য কথা বেরোয়, ‘এ প্রকার বস্ত্র দিতে থাকলে, তোমার মা তো আমার কাছ থেকেও এরূপ দাবি করবেন, পুত্তগুলিও প্রভাবিত হবে। এর পর পুত্তগুলির বিবাহ দিতে হবে, তখন তাদের বধূরা…, তিনি আর বলতে পারেন না। তাঁর হৃৎকম্প হচ্ছে।
পুণ্যকের পত্নী অত্যন্ত অপমানিত বোধ করে সাশ্রু নয়নে কন্যাকে বলেন, সারা জীবনই তো রুক্ষ বসন পরে কাটলো, মাধবী তুই এ বসন নিয়ে যা, আমার চাই না।’
মাধবিকা তখন বড় রাগ করে। সে পিতাকে বলে, ‘আমি মাতাকে নিয়ে বারাণসী চলে যাবো, তখন আপনার গৃহে দাসীবৃত্তি কে করে, আমি দেখব।’
পুণ্যক গতিক ভালো নয় দেখে স্থানত্যাগ করেন।
শ্রেষ্ঠী অহিপারক এঁদের মধ্যে সবচেয়ে সুদর্শন। অধিক কথা বলেন না। যখন বলেন, একটি মর্যাদাবোধ তাঁকে ঘিরে থাকে। রাজসভায় তাঁর নিত্য যাতায়াত। মহারাজ, অন্যান্য রাজপুরুষ ও রাজকুমারদের সঙ্গে নিত্য ওঠাবসা। তাঁর মার্জিত আচরণ ও স্বভাবের জন্যই তিনি রাজশ্রেষ্ঠীর পদ পেয়েছেন, না রাজশ্রেষ্ঠী বলেই এমন পরিমার্জিত হয়ে উঠেছেন, বলা কঠিন।
অহিপারককে হঠাৎ দেখলে অক্ষত্রিয় মনে হয় না। যদিও ক্ষত্রিয়, ব্রাহ্মণ ও বৈশ্যের মধ্যে তেমন কোনও মৌলিক পার্থক্য নেই। তবে ক্ষত্রিয় পুরুষরা ব্যায়াম ও অস্ত্রশিক্ষায় অনেক সময় ব্যয় করেন বলে তাঁদের আকৃতিতে একটি সুগঠিত সুঠাম পৌরুষের ব্যঞ্জনা থাকে। শ্রেষ্ঠী অহিপারক, মহারাজ বিম্বিসারের সমবয়সী হবেন। তিনি নিয়মিত শস্ত্রচর্চা করেন, ব্যায়াম করেন। তাঁর গৃহে একটি মল্লভূমি আছে। পুত্ৰ পরিজনদেরও তিনি বলশালী, শাস্ত্রনিপুণ ও সুদেহী হতে উৎসাহ দিয়ে থাকেন। যদিও তাঁর দ্বিতীয় পুত্র মাধবিকার স্বামী উদয় কিছুটা কৃশকায়।
অহিপারক সসম্ভ্রমে অভ্যর্থনা করলেন জ্যেষ্ঠ যোতীয়কে।
—আসুন আসুন সেট্ঠি। আপনার জন্যই আমরা সাগ্রহে প্রতীক্ষা করছি। সংবাদ সব ভালো তো?
সতর্ক চোখে চারিদিকে তাকিয়ে যোতীয় বললেন, ‘ভালো মনে করলেই ভালো। কী বলো কাকবলীয়?’
অহিপারকের ইঙ্গিতে বসু চলে গেল। অহিপারক দ্বারটি বন্ধ করতে করতে মুখ বাড়িয়ে বসুকে যথাসময়ে সুরা ও খাদ্য পরিবেশন করার কথা মনে করিয়ে দিলেন।
যোতীয় বললেন, ‘আজ এত সাবধানতা? অহিপারক, আজ কি আমরা পুন্নকের সুবন্নকলসগুলির সংখ্যা জানতে পারছি, না কি?’
অহিপারকের মুখে মৃদু হাসি খেলে গেল। কাকবলীয় বললেন, ‘পুন্নকের স্বর্ণকলস? কী যে বলেন, সেট্ঠি জেট্ঠক। পুন্নকের ঘরে কয়েকটি মাটির কলস ভিন্ন আর কিছুই নেই। তার ভিতরে আবার ভস্ম ভরা।’
সকলের পরিমিত হাসির মধ্যে পুন্নকের ক্ষীণ প্রতিবাদ শোনা গেল, ‘ধনীরা সর্বদাই অল্পধন সেট্ঠিকে নিয়ে যথেচ্ছ কৌতুক করে থাকেন, কী আর বলবো! এ অপমান আমার সহ্যই হয়ে গেছে।’
যোতীয় নিজেকে সংবরণ করে নিলেন। ভালোভাবে বসে, মেরুদণ্ড সোজা করে, তিনি তাঁর দিকে এগিয়ে দেওয়া উপাধানটি জটিলের দিকে সরিয়ে দিলেন। বললেন, ‘যোতীয় তোমাদের চেয়ে বয়সে বড় হতে পারে বিলাসের অভ্যাসে বড় নয়। দৈহিক ক্ষমতায়ও ছোট নয়।’
অহিপারক বললেন, ‘মহা সেট্ঠি। গোট্ঠিগুলির সংবাদ কী?’
‘সেটাই তো কথা’, যোতীয় গলার স্বর মৃদু করে বললেন, ‘গোট্ঠীগুলি বলছে, মগধের মধ্যে বাণিজ্যের কোনও অসুবিধে নেই। কিন্তু কোসলে বড় পথদস্যু জলদস্যু। কোসল ও লিচ্ছবি রাজ্যে যথেচ্ছ শুল্ক দাবি করে রাজপুরুষেরা। কোসল ছাড়িয়ে বংস রাজ্যে অবন্তী, কুরু-পাঞ্চালে গেলে তো কথাই নেই! শুল্ক দিতে দিতে সার্থবাহরা উত্ত্যক্ত হয়ে যাচ্ছে, এবং মুদ্রার কোনও মান না থাকায় তারা বিনিময়ে বাধ্য হচ্ছে। অনেক সময়েই তাদের মনে হচ্ছে, তারা প্রবঞ্চিত হচ্ছে, ক্রেতারাও বহু ক্ষেত্রে তাদের প্রবঞ্চক বলছে। একটি জটিল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তারা এর সমাধান চায়। স্বভাবত এবং ন্যায়ত আমাদেরই কাছ থেকে।’
কাকবলীয় বললেন, ‘এরা তো তবু মগধের মধ্যে নিরাপদ। আমাদের তরুণ বয়সের কথা মনে করুন ভদ্দ! কীভাবে, কত বিপদ, বন্য জন্তু, বন্য মানুষ, নরখাদক, দস্যু, চোর, ভিন্ন ভিন্ন দেশের চোর, রাজপুরুষ এদের সঙ্গে অবিরাম যুদ্ধ করে করে, তবে আজ ধনশালী হয়েছি। সংগ্রাম সবাই করে। ক্ষত্রিয় যোদ্ধা একভাবে, আমরা বণিকরা আরেকভাবে।’
জটিল বললেন, ‘নিশ্চয়। আমরা যখন সার্থবাহ ছিলাম, সঙ্গে বীরপুরুষ স্থলনিয়ামক নিয়েছি, আরও যোদ্ধা নিয়েছি। কিন্তু শুল্ক ও রাজপুরুষদের অন্যায় লোভ তো আর নিবারণ করতে পারিনি। এরা আমাদের কাছ থেকে কী আশা করে?’
পুণ্যক করুণ মুখে বললেন, ‘এইসব কারণেই তো আমি আর বৈদেশিক বাণিজ্যে ধন নিয়োগ করি না। কুসীদিন বলে অপমান করে লোকে, কিন্তু শুল্ক দিয়ে দিয়ে আর চোর দস্যুর হাতে নিজের ধন তুলে দিয়ে নিঃস্ব হবার কোনও সাধ নেই আমার।’
অহিপারক ধৈর্য ধরে সবার কথা শুনছিলেন। এবার ধীরে ধীরে বললেন, ‘মহাসেট্ঠি যোতীয়, জেট্ঠ জটিল, ভদ্দ কাকবলীয়, ভাই পুন্নক— আমরা কি ভাবিনি মগধ রাজ্য আরও বিস্তৃত হবে? মহারাজ বিম্বিসার যখন অঙ্গদেশ জয় করলেন তখন আমাদের ধনক্ষয় অল্প হয়নি। পরাজয়ের বিভীষিকাও যে সামনে ছিল না তা নয়, কিন্তু আমরা মহারাজের রাজ্য বিস্তারে উৎসাহিত হয়েছিলাম। হইনি কি?’
যোতীয় কুটিল চোখে চেয়ে বললেন, ‘অবশ্যই। আমরা ভেবেছিলাম, আজ অঙ্গ-মগধ এক রাজ্য হল। এর পর অঙ্গ-মগধ-কোসল-বেসালী এক রাজ্য হবে। এই বিশাল রাজ্যের অধীশ্বর হওয়া মহারাজ বিম্বিসারের পক্ষে এমন কিছু কঠিন নয়। কিন্তু হল না। কোসল, বেসালী উভয়ের সঙ্গেই মৈত্রী স্থাপন করলেন তিনি। এ কি তোমাদের অভিপ্রেত ছিল?’
জটিল বললেন, ‘মৈত্রীই তো ভালো মহাসেট্ঠি। যুদ্ধ হলেই সব কিছু অস্থির হয়ে যায়। জীবনটা তো ভোগের জন্যই। তা দীর্ঘদিন যুদ্ধবিগ্রহ চললে কি আর নিশ্চিন্তে আনন্দ করা যায়?’
পুন্নক বললেন, ‘ঠিক। একেবারে ঠিক। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাবে। বৃহৎ সংসার সব। আয়-ব্যয়ে সমতা রাখা অসম্ভব হয়ে পড়বে।’
যোতীয় বললেন, ‘মহারাজ বিম্বিসার যখন অঙ্গদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন তখন তোমার কত বয়স পুন্নক? তখন তোমার পিতা মহাসেট্ঠি অনঙ্গ তোমাকে বাণিজ্যযাত্রায় উত্তরে পাঠিয়েছিলেন। সে সময়ে তুমি অনেক উপার্জন করেছ। বলি তোমার কোনও বাধা-বিপত্তি হয়েছে? তোমার পিতার বৃহৎ সংসার চালিয়েও এত সঞ্চয় হয়েছিল যে তুমি মাত্র কয়েক বছর বাণিজ্যযাত্রা করেই বসে গেলে। তখন মগধ এত সংহত ছিল না। খুদ্দ খুদ্দ রাজ্যপাট। এখন মগধের শৃঙ্খলা শাসন ব্যবস্থা ত্রুটিহীন। রাজগহের ভেতরে তোমার কিসের অসুবিধা? এসব অর্থহীন শঙ্কাকে প্রশ্রয় দিও না। অহিপারক, মহারাজ বীরপুরুষ, কূটবুদ্ধিও ধরেন। লিচ্ছবি দেশে তাঁর সম্পর্ক ছেটক রাজার সঙ্গে, অন্য গণরাজাগুলি তো আর তাঁর শ্বশুর নয়! গঙ্গার উত্তরে রাজ্য বাড়াতে তাঁকে কে বাধা দিচ্ছে? ওদিকে রয়েছে সাক্করা, মল্লরা, এগুলি তো পুরোপুরিই প্রায় কৃষিকার্য নিয়ে থাকে। এগুলিকে নিজ রাজ্যভুক্ত করতে বাধা কি?’
অহিপারক তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, ‘সাক্কদের আক্রমণ করার তো প্রশ্নই উঠছে না। ভগবান বুদ্ধ সাক্কজাতীয় না? ওঁদের বিরুদ্ধে মহারাজ কখনই অস্ত্র তুলবেন না।’
‘এই এক মহাসমস্যা হয়েছে’, যোতীয় বলে উঠলেন, ‘রাজা যুদ্ধ করবে, আচার্য শিক্ষা দেবে, সেট্ঠি ধন উপার্জন করবে, কস্সক শস্য ফলাবে, নারী পুত্রোৎপাদন করবে, দাস সেবা করবে— সমাজ এভাবেই গঠিত হয়েছে, এভাবেই স্থিতি পেয়েছে, এই নিয়মশৃঙ্খলা অনুসরণ করেই উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি হচ্ছে সমাজের। এই নিয়মকে হঠাৎ লণ্ডভণ্ড করে দেবার কি প্রয়োজন পড়ল? করুক না রাজা তপস্যা। সন্ধান করুক অতীন্দ্রিয় আনন্দ, তার একটা সময় আছে। মহারাজ যদি রক্তপাতে বিতৃষ্ণা বোধ করেন, বিবাদে অসুখী হন তো…’
‘তো কী?’ অহিপারক জিজ্ঞেস করলেন।
তাঁর দিকে চোখ কুঁচকে তাকিয়ে শ্রেষ্ঠী যোতীয় বললেন, ‘অহিপারক, তুমি তো শুধু শুধু নগরসেট্ঠি হওনি বাপা। বয়োজ্যেষ্ঠ অভিজ্ঞ মানুষ বলে অনেক কথা, অনেক মত অনেক সংশয়ের কথা বলে ফেলি। বলবার অধিকার আছে বলেও মনে করি। পদাধিকার। মগধের যতেক বণিকসেট্ঠি তাদের সুখ-দুঃখের অভাব-অভিযোগের কথাগুলি আমাকেই শোনায়, আমার থেকেই তাদের প্রতিকার আশা করে কি না!’
অহিপারক হেসে বললেন, ‘সত্য কথা। অবশ্যই বলবেন।’
—কিন্তু তুমি তো আর শুধু শুধু নগরসেট্ঠি হও নাই।
—ও। আপনি বলছেন আমি এ সব কথা রাজার কর্ণগোচর করব?
—আমি কিছুই বলছি না। বলছ তুমি।
—শুনুন মহাসেট্ঠি রাজবাড়ির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বলে আমি যেমন এ সমস্যার একদিক জানি, আপনিও আপনার পদাধিকারবলে সেই সমস্যার অন্য দিক জানেন। আলোচনা প্রয়োজন বলেই আপনাদের সাদরে ডেকে পাঠিয়েছি। আমাদের সেট্ঠিদের স্বার্থ এক। সেই সেট্ঠি সংঘ ভেদ করবার উদ্দেশ্য থাকলে…’
কাকবলীয় তাঁর গুফের কেশগুলি টানতে টানতে বললেন, ‘আহা হা হা, এ তো স্বাভাবিক সতর্কতা ভদ্র অহিপারক। মহাসেট্ঠি আপনিই বা এত সন্দেহাকুল হচ্ছেন কেন?’
এই সময়ে দ্বারে মৃদু করাঘাত হল।
অহিপারক শ্ৰেষ্ঠীদের সবার দিকে একবার করে তাকিয়ে অবশেষে যোতীয়র ওপর তাঁর দৃষ্টি স্থির করলেন, বললেন, ‘আমার আজকের আর এক অতিথিকে এই সভায় উপস্থিত করবার অনুমতি প্রার্থনা করছি মহাসেট্ঠি।
যোতীয় একটু ক্ষুব্ধ হয়েই যেন বলে উঠলেন, ‘গৃহ তোমার, আয়ুষ্মান অহিপারক, তুমি যে-কোনও অতিথিকে যে-কোনও সভায় উপস্থিত করতে পারো। অনুমতির প্রয়োজন হবে কেন? তবে আমাদের সভার কাজ আর হবে না।’
অহিপারক বললেন, ‘ক্ষুব্ধ হবেন না মহাসেট্ঠি। এই অতিথির কথা শুনলেই স্থির করতে পারবেন সভার কাজ এগোবে না স্থগিত থাকবে।’
তিনি দ্বার খুললেন। যিনি ঢুকলেন তাঁকে দেখে উপস্থিত সবাই চমকে উঠলেন। পুরুষটি অহিপারকের কাছাকাছি বয়সের হবেন। তাম্রাভ গৌরবর্ণ। মুখশ্রীর মধ্যে কোনও বৈশিষ্ট্য নেই যাতে তাঁর সম্পর্কে কারও কোনও ধারণা হতে পারে। নাসা, চক্ষু, ওষ্ঠাধর সবই অতিশয় সাধারণ। রাজগৃহের পথে ঘুরলে এই ধরনের আকৃতি অনেক দেখা যেতে পারে। মাথায় এঁর যথেষ্ট কৃষ্ণ কেশ, কাঁধ পর্যন্ত নেমে এসেছে। একটি অত্যন্ত সাধারণ বস্ত্র ও উত্তরীয় পরনে। তিনি এসেই কটি থেকে সমস্ত শরীর সামনে নত করে সবাইকে নমস্কার করলেন। তারপর গৃহস্বামীর অনুমতি নিয়ে বসলেন।
অহিপারক বললেন, ‘রাজসচিব বস্সকারের সঙ্গে সবার পরিচয় করিয়ে দিই।’
পুণ্যক হঠাৎ বলে উঠলেন, ‘সেট্ঠি আমি কি একটু ভেতরে যেতে পারি?’ প্রয়োজন পড়েছে।‘ পুণ্যক অবশ্য অহিপারকের অনুমতির অপেক্ষা করলেন না, বস্সকারের পেছন দিয়ে দ্বারপথে দ্রুত অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
জটিল তাঁর সুগোল ইন্দ্রলুপ্তের ওপর থেকে হাতটা নামিয়ে নিয়ে তাড়াতাড়ি বললেন, ‘আমাদের আর নূতন করে পরিচয় করাবার প্রয়োজন কী? ওঁকে আমরা সবাই চিনি।’
দ্বারে আবার শব্দ হল। অহিপারক উঠে দ্বার খুললেন। সবাই ভেবেছিলেন পুণ্যক। কিন্তু পুণ্যক নয়। দাসীরা সুদৃশ্য ভৃঙ্গার বয়ে আনছে দেখা গেল। তক্ষিত দারুফলকের ওপর খাদ্যসম্ভার নিয়ে প্রবেশ করছে দাসেরা। সব কিছু রাখা হলে, অহিপারকের ইঙ্গিতে দাস-দাসীরা চলে গেল। অহিপারক বসুকে নিম্নকণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, ‘পুণ্যকভদ্র কোথায় গেলেন?’
বসু ঈষৎ হেসে বলল, ‘তিনি একেবারে অন্তঃপুরের দিকে চলে গেলেন, আমায় বলে গেলেন বৈবাহিক যেন আমাকে আর সভায় না ডাকেন, আমার অসুখ বোধ হচ্ছে।’
অহিপারক ঘরে ঢুকে বললেন, ‘আপানারা আলাপ করুন। আমি একটু আসছি। বসু তুমি খজ্জগুলি পরিবেশন করে যাও।’
প্রথমে তাঁর এ পরিকল্পনা ছিল না। বসু যদিও তাঁর নিজের অত্যন্ত বিশ্বাসভাজন। কিন্তু মহাসেট্ঠি যোতীয়র সদা-সন্দিগ্ধ চরিত্রের সঙ্গে তাঁর যথেষ্ট পরিচয় আছে। অন্যেরাও গোপনতা চাইবেন। তাই তিনি বসুকে যথাসাধ্য দূরে রাখতেই চেয়েছিলেন। কিন্তু এখন তাঁর সাময়িক অনুপস্থিতিতে আপ্যায়নের ভার গৃহস্বামীর পক্ষ থেকে কাউকে তো নিতেই হয়!
পুণ্যকের সন্ধানে অন্তঃপুরের ভেতরে অবশ্য তাঁকে যেতে হল না। দুই পুরের মধ্যবর্তী কাননে আম্রবৃক্ষের তলায় পাষাণবেদীতেই পুণ্যকের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়ে গেল।
পুণ্যক শ্ৰেষ্ঠী বেদীর ওপর বসে একটি চরণ দোলাতে দোলাতে ঊর্ধ্বমুখ হয়ে গাছের মধ্যে কী নিরীক্ষণ করছিলেন তিনিই জানেন। অহিপারক ব্যস্ত হয়ে সেখানে এসে বললেন, ‘কী হল পুণ্যকভদ্র সবাই আপনার জন্য অপেক্ষা করে আছেন যে!’
পুণ্যক গম্ভীরভাবে বললেন, ‘বিরক্ত করবেন না সেট্ঠি, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছি এখন।’
—কী কাজ? কী এমন গুরুত্ব তার যে সভা উপেক্ষা করছেন।
অহিপারক শুধু বিস্মিতই নন, বিরক্তও বটে। তাঁর এই কুটুম্বটি তাঁকে মাঝে মাঝে এমন বিপদে ফেলেন! তাঁর মর্যাদা রক্ষা হয় না।
—আপনার এই অম্ববৃক্ষটির পাতা গুনছি। এই কাজ—পুণ্যক একইভাবে বললেন।
—তার অর্থ? সেট্ঠি পুন্নক, আপনি একজন ধনবান নাগরিক, সেট্ঠিকুলের স্তম্ভ, তার ওপরে আমার বৈবাহিক…
—হ্যাঁ, আর সেই জন্যই আপনি আমাকে ধ্বংস করবার ব্যবস্থা করেছেন। বাঃ। সাধু সাধু সেট্ঠি অহিপারক।
—অর্থ কী এসব কথার?
—আপনার আচরণের অর্থটাই আমাকে আগে বুঝিয়ে দিন! সামান্য কুসীদজীবী বণিক আমি। মহাসেট্ঠি স্নেহ করেন বলে আপনারা নিজেদের সমিতিতে স্থান দিয়েছেন। নিজের সামান্য অবস্থা নিয়েই তো আমি সন্তুষ্ট আছি। কই কারও গৃহে তো চৌর্যবৃত্তি করতে যাইনি। বড় বড় পদ, মর্যাদা, এসবের ওপরেও তো কোনও লোভ করিনি।
শ্রেষ্ঠী অহিপারক হতবুদ্ধি হয়ে তাকিয়ে রইলেন।
পুণ্যক বললেন, ‘ওই রাজসচিব বস্সকারকে ডেকে এনে আমার মতো সামান্য লোকের কথা, নাম, ধাম তাঁর কর্ণগোচর করবার জন্য আপনি ব্যস্ত কেন? রাজরোষে পড়ে, কিংবা রাজভৃত্যদের লোভের লক্ষ্য হয়ে সামান্য যেটুকু শান্তি বা ধন সঞ্চয় করেছি, সেটুকু হারাই এই চান? এই কি জ্ঞাতকের ব্যবহার!’
পুণ্যক মহা উত্তেজিত হয়ে ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলতে লাগলেন। এতক্ষণে অহিপারক ব্যাপারটা কিছুটা বুঝতে পারলেন। তিনি হাসি গোপন করে বললেন, ‘এই কথা? রাজসচিব বস্সকার আমাদের বন্ধুত্ব প্রার্থনা করতে এসেছেন। অনেক গভীর নীতি সম্পর্কে তিনি আজ আমাদের সঙ্গে একমত। সেই জন্যই তাঁর প্রার্থনাতেই আমাদের সভায় তাঁকে ডেকেছি। আপনার ভয় বা সংশয়ের কোনও কারণই নেই।’
পুণ্যক বললেন, ‘রাজপরিষদের লোকদের সঙ্গে সখ্য করবার আমার বিন্দুমাত্র সাধ নেই, সেট্ঠি, আর রাজনীতিরই বা আমি কী বুঝি? বুঝতে চাইও না। আপনি দয়া করে আমায় ছেড়ে দিন।
—কিন্তু ওঁদের কী বলব? যথেষ্ট উৎকৃষ্ট সুরা ও খজ্জের আয়োজন হয়েছে। সবাই একত্রে ভোজন করব…..
—আমার অংশটি না হয় অন্তঃপুরের ভোজনশালার পাঠিয়ে দিন। আপনার পত্নী সমাদর করে খাওয়াবেন এখন। আর ওঁদের বলুন, আমার সহসা অসুখ…ঠিক আছে বলে দিন উদরাময় হয়েছে….উদরে শূল বেদনাও অনুভব করছি…না না, এতটা বলবেন না। এঁদের আবার যেমন স্নেহের আধিক্য হয়ত দেখতে এসে পড়বেন…যা হয় বলুন, আপনার মাথায় কি আর বুদ্ধির অভাব আছে?
—আপনি কি সত্যিই যাবেন না?
—না না। পুন্নক এক কথা দ্বিতীয়বার বলে না।
অহিপারক বিরক্ত মুখে ফিরে আসতে লাগলেন। তাঁর কপালে ভ্রূকুটি। এই পুণ্যকের পিতা মহাসেট্ঠি অনঙ্গ ছিলেন যোতীয়র আগে গোষ্ঠীজ্যেষ্ঠক। তখনও অবশ্য মগধ রাজ্যরূপে এভাবে সংহত হয়নি। কয়েকটি ছোট ছোট অঞ্চল ছিল স্বাধীন, সার্বভৌম। গোষ্ঠীপতিদের মধ্যে বিম্বিসার পিতা ক্ষেত্রৌজা ছিলেন সবচেয়ে শক্তিশালী। তাঁর মধ্যে বৃহৎ রাজ্য গঠনের স্বপ্ন ছিল। অনঙ্গ সে সময়ে কত দুঃসাহসিক অভিযানই না করেছেন। বাণিজ্যপথের সর্বপ্রকার খুঁটিনাটি তিনি জানতেন। তাঁর অতুল ধনসম্পদ পেয়েছে পুণ্যক। কিন্তু এমন নিরুদ্যম, কৃপণ, এমন অকারণে ভীত মানুষ তিনি আর দেখেননি। মহাসেট্ঠি অনঙ্গর যে এ প্রকার পুত্র হতে পারে, না দেখলে বিশ্বাস হয় না। অথচ প্রথম যৌবনে এই পুণ্যকই ছিল একেবারেই ভিন্ন চরিত্রের।
নিজের মন্ত্রণাগৃহে আসতে আসতে অবশ্য তাঁর কপাল মসৃণ হয়ে এলো। প্রকৃত অবস্থা এবং তাঁর মনোভাব এঁদের কাছে প্রকাশ করা যাবে না। তাঁর সম্মানহানি হবে। বস্সকারেরও।
তিনি ঘরে প্রবেশ করে পেছনে কপাট দুটি বন্ধ করে দিলেন। জটিলের মুখে মাংসখণ্ড। তিনি শুধু চোখ তুলে চাইলেন। কাকবলীয় বললেন, ‘কী হল?’
—আরে আমার বৈবাহিক হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। উদরাময়। অন্তঃপুরে পাঠিয়ে দিয়েছি। একটু সুস্থ বোধ করলেই আসবেন।
যোতীয় মৃদু হেসে বললেন, ‘ভোজনের আগেই?’
বর্ষকার ভেতরের কথা, পুণ্যকের চরিত্র কিছুই জানেন না। তিনি মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, ‘অত্যন্ত দুঃখের কথা। আমারই দুর্ভাগ্য। যাক, কিছু ভৈষজের ব্যবস্থা করেছেন তো?’
—নিশ্চয়ই! অহিপারক বসতে বসতে বললেন।
একটু পরে হাত মুখ প্রক্ষালন করে, সবাই পানপত্র তুলে নিলে, অহিপারক বললেন, ‘মহামান্য বস্সকার, আপনার কী যেন বলবার ছিল…’
চারিদিকে একবার সতর্ক দৃষ্টিতে তাকিয়ে নিয়ে বর্ষকার বললেন, ‘আমার বলবার কথা নির্ভর করবে, আপনাদের বক্তব্যের ওপরে।’
জটিল পানীয়ে চুমুক দিয়ে অবাক হয়ে বললেন, ‘বক্তব্য? আমাদের? আপনার কাছে? কিছু তো নাই! কী মহাসেট্ঠি। মান্যবর রাজসচিবের কাছে আমাদের কী-ই বা বক্তব্য থাকতে পারে?’
যোতীয় বললেন, ‘আমাদের বণিক গোষ্ঠীর লাভালাভ, অভাব-অভিযোগের ব্যাপার আমরা নিজেরাই সমাধান করি। নেহাত না পেরে উঠলে মহারাজ আছেন। তা এখনও সেরূপ অবস্থা হয়নি।’
অহিপারক বললেন, ‘মহাসেট্ঠির অনুমতি নিয়ে দু-চারটি কথা নিবেদন করছি। আপনি জানতে চাইছেন বলে। দেশ থেকে দেশান্তরে যাতায়াতকালে শুল্ক এবং মুদ্রা নিয়ে বণিকদের বড়ই সমস্যা হচ্ছে। এ কথা আমরা রাজ সন্নিধানে পরবর্তী সভাতেই জানাবো।’
ভাবলেশহীন মুখে বর্ষকার বললেন, ‘আপনাদের কোনও সমস্যারই সমাধান হবে না। মুদ্রার জন্য যে বিপুল পরিমাণ ধাতু প্রয়োজন তা আমাদের নেই। মগধ রাজ একটি অচলাবস্থায় এসে পৌঁছেছে মহামান্য সেট্ঠিগণ। বজ্জিরা সাম্রাজ্যলোভী, অবন্তীও তাই। কোসল একটি বৃহৎ শূন্যগর্ভ কলসের মতো। মগধ সামান্য একটু তৎপর হলেই বিশাল বিশাল রাজপথ আপনাদের সামনে খুলে যাবে, মগধাধিপ ছাড়া আর কারুকে শুল্ক দিতে হবে না। রাজনীতি সেদিকেই চলেছিল, কিন্তু…’
‘কিন্তু কী?’ কাকবলীয় কখন নিজের অজান্তেই ব্যগ্র হয়ে উঠেছেন।
—কিন্তু নীতির পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে, আমরা রাজার মন্ত্রণাদাতা। রাজ্যের পক্ষে যা ভালো তাই পরামর্শ দিয়ে থাকি। সেট্ঠিদের অসুবিধাগুলি দূর করতে না পারলে, কী ভাবে রাজ্যের সমৃদ্ধি সম্ভব?
—নীতির পরিবর্তন ঘটছে কেন? যোতীয় সাবধানে প্রশ্ন করলেন।
বস্সকার আবার একবার চারদিকে তাকিয়ে নিলেন, বললেন, ‘অবশ্যই গৌতম বুদ্ধ নামক শ্রমণের জন্য। আমাদের রাজা, শুধু আমাদের কেন সাধারণভাবে সৎ রাজামাত্রেই শ্রমণদের ওপর, সন্ন্যাসীদের ওপর শ্রদ্ধাশীল। কিন্তু রাজার কর্তব্যাকর্তব্যে এঁরা কেউই হতক্ষেপ করেন না। এই শ্ৰমণ করছেন। অনেকেই এ ব্যাপারটি মেনে নিতে পারছেন না।’
—যেমন?
—যেমন রাজপরিবারের অনেকে, বহু অমাত্য, প্রজারা, এবং আপনারা— শেষের দিকে বর্ষকারের মুখ সহাস্য হয়ে উঠল!
—আমরা? জটিল হতবুদ্ধি হয়ে প্রশ্ন করলেন।
—হ্যাঁ সেট্ঠিবর, এই শ্রমণ রাজস্বার্থবিরোধী। বণিকস্বার্থবিরোধী। এমন কি প্রজাস্বার্থবিরোধীও বটে। অনঙ্গ নামে ওই বিদ্রোহী চণ্ডালের কথা কি শুনেছেন?
—কিছু কিছু কানে এসেছে বটে— যোতীয় তাঁর অবিচলিত গরিমায় বললেন।
“>—অনঙ্গের নেতৃত্বে প্রথম দিকে রাজগৃহের ঘরে ঘরে মলভাণ্ড বয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজ বন্ধ হয়ে যায়। তাদের দাবি ছিল শিশুচোর যক্ষ-যাক্ষিণীকে শাস্তি দিতে হবে। মহারাজ তা দিতে উদ্যতও হয়েছিলেন। তাঁর কাজে বাধা দিলেন শ্রমণ গৌতম। চণ্ডাল পুক্কুসদের কী বোঝালেন তিনিই জানেন, তারা শান্ত হয়ে কাজে যোগ দিল। শুধু অনঙ্গ এখনও দু চোখে আগুন ছড়িয়ে ঘুরে বেরাচ্ছে। সে বিদ্রোহী। রাজদ্রোহীও বলতে পারেন। নগরের পথে পথে সে শ্ৰমণদের, রাজামাত্যদের, রাজনীতিকে গালি দিতে দিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। লোকটি প্রায় উন্মাদ। কিন্তু পুরোপুরি নয়। এখন উচিত কাজ হল তাকে কারাদণ্ড দেওয়া, কিন্তু মহারাজ তো সে আদেশও দিচ্ছেন না। তাঁর বোধ হয় আশা শ্ৰমণরাই তাকে শান্ত করবেন!
কিছুক্ষণ পর যোতীয় বললেন, ‘দুর্ভাগ্যের ব্যাপার, কিন্তু এর মধ্যে আমাদের জ্ঞাতব্যই বা কী? কর্তব্যই বা কী?’ তাঁর চোখ দুটি এখন আবার ধূর্ত হয়ে উঠেছে। তিনি যে নিজেদের পক্ষের কথা সম্পূর্ণ গুপ্ত রেখে, ধীরে ধীরে বর্ষকারের মনের কথা জেনে নিচ্ছেন এই আত্মপ্রসাদে তাঁর প্রাচীন মুখে এখন যথেষ্ট দীপ্তি।
বর্ষকার বললেন, ‘আপনারা ওই শ্রমণকে সংযত করুন এই প্রার্থনা। সোজা হয়ে বসলেন চার শ্রেষ্ঠী, কী ভাবে?’
—আপনাদের আনুগত্য, পূজা, উপহার দিয়ে। এমন অবস্থা সৃষ্টি করে যাতে আপনাদের প্রার্থনা, আপনাদের ব্যবহারিক প্রজ্ঞা অমান্য করতে উনি না পারেন। শ্রাবস্তীতে তো শুনছি উনি সেট্ঠি সুদত্তর একেবারে বশীভূত হয়ে গেছেন। মান্যবর অহিপারক বলতে পারবেন।
অহিপারক বললেন, ‘সুদত্ত আমার জ্ঞাতক। সে জেতকুমারের কাছ থেকে শ্রাবস্তীর শ্রেষ্ঠ কাননটি ক্রয় করেছে। সেখানে প্রাসাদোপম আরাম নির্মাণ করছে ভিক্ষুদের জন্য। তার প্রধান দ্বারই এত বৃহৎ, এমন কারুকার্যমণ্ডিত যে বহু ধনী পণ্ডিত যাঁরা গৌতমের সঙ্গে তর্ক করতে ইচ্ছুক, তাঁরা ভয়ে সম্ভ্রমে ফিরে যাচ্ছেন। তা শ্ৰমণরা তো চিরকাল গুহায়, বৃক্ষতলে, বড় জোর পর্ণকুটিরে বাস করে এসেছেন। আশ্রয়ের নামে এই বিলাসগৃহ যখনই গৌতম গ্রহণ করেছেন তখনই তিনি সেট্ঠিকুলের আয়ত্তের মধ্যে এসে গেছেন, জানবেন। আমাদের এ বিষয়ে একটু তৎপর হতে হবে।’
বর্ষকার সকলকে নমস্কার করে উঠে দাঁড়ালেন, বললেন, ‘আপনারা বুদ্ধিমান, দলে দলে দাস-দাসী, রোগী, দণ্ডিত বা দণ্ডযোগ্য ব্যক্তি সাক্ক পুত্তীয় সমনসংঘে প্রবেশ করছে, যাচ্ছে সাধারণ গৃহস্থ, নারীকুল— মনেও করবেন না সবাই নিবাণ চায়। আর… এটি প্রথম পদক্ষেপ, মগধকে শক্তিশালী করবার আরও কাজ পড়ে রয়েছে। তবে দক্ষ স্থপতি আগে গৃহনির্মাণের জন্য নির্বাচিত স্থানটি সমান করে নেয়। কণ্টক গুল্মগুলি তুলে ফেলে… তাই না?’
বর্ষকার পেছন ফিরলেন, অহিপারক তাঁকে সঙ্গে করে বাইরে নিয়ে গেলেন। কাকবলীয় সাবধানে দ্বার বন্ধ করে বললেন, ‘কী বুঝলেন মহাসেট্ঠি? ভদ্র জটিল কী মত আপনার?’
যোতীয় বললেন, ‘সমন গোতম সম্পর্কে যা বলে গেল ভালো কথা, যুক্তিগ্রাহ্য। কিন্তু প্রথম পদক্ষেপ… অর্থাৎ দ্বিতীয় তৃতীয় পদক্ষেপও আছে এঁর উর্বর মস্তিষ্কে। সাবধান জটিল, কাকবলীয়, ভাবনা-চিন্তা করে আমাদের পা ফেলতে হবে। এই বস্সকার আমাদের মনের গোপন অভিপ্রায়গুলিই যেন ব্যক্ত করে গেল। কিন্তু…’
এই সময়ে অহিপারক ঢুকলে সবাই নীরব হয়ে গেলেন।
অহিপারক একবার সবার দিকে তাকালেন। মৃদু হাসি তাঁর মুখে। কোনও পরিস্থিতিতেই তিনি বিরক্তি প্রকাশ করেন না। তিনি বললেন, ‘এই রাজসচিব বস্সকার… বুঝতেই পারছেন রাজস্বার্থের সঙ্গে বণিকস্বার্থের মিলন ঘটাতে চান।’
‘ইনি আমাদের ব্যবহার করতে চান, আর কিছু না, এবং স্বার্থটা ওঁর নিজের… ব্যক্তিগত স্বার্থ, কাকবলীয় ঈষৎ উত্তপ্ত হয়ে বললেন, ‘প্রথম পদক্ষেপ… দ্বিতীয় পদক্ষেপ— এ সব বলতে উনি কী বোঝাচ্ছেন? প্রথমে কণ্টক তুলবেন, সমন গোতমকে উচ্ছেদ করবেন। তারপর? তারপর কী মহারাজকেই…’
‘আহা হা হা’, যোতীয় তাঁর প্রাচীন হাত তুলে বাধা দিলেন, ‘যা অবক্তব্য তা কখনও বলবে না। এই রাজসচিব যদি আমাদের ব্যবহার করতে চান আমরাও ওঁকে ব্যবহার করতে পারি। এটা কোনও সমস্যা নয়। তা ছাড়া উনি আপাতত একটি কূটনীতিক সমাধানের কথা বলেছেন— সমন গোতমকে বশ করে নিজেদের সুবিধামতো তাঁকে কিছুটা চালনা করার প্রস্তাব তো মন্দ কিছু নয়। অহিপারক, বস্সকারকে এনে তুমি ভালোই করেছ।’
জটিল চতুর হাসি হেসে বললেন, ‘ধন দিয়ে, বিলাসের উপকরণ দিয়ে শ্রমণদের বশীভূত করা কিছুই নয়। এই তো পুরন কাস্সপের শিষ্যরা। সেবার ওই মহাত্মা ক মাসের জন্য রাজগহে এলেন। তো কদিন এঁর দেশনা শুনলাম— ইনি পাপ-পুণ্য মানেন না, ঠকানো, হত্যা, মিথ্যাচার, পরস্ত্রী গমন কিছুই এঁর মতে পাপ নয়, আবার সত্য কথন, দান, দয়া, সংযম এসবের দ্বারাও পুণ্যলাভ হয় না। অর্থাৎ কি না কর্মের কোনও ফল নেই। আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম— হত্যা, চুরি, ব্যভিচার— এগুলি আপনার মতে পাপ না হতে পারে কিন্তু এগুলির প্রত্যক্ষ ফল তো রাজদণ্ড। উনি বললেন— অবশ্যই। কিন্তু পরলোকে গিয়ে এসব তথাকথিত পাপের জন্য কাউকে কণ্টকবনের মধ্য দিয়ে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়, কাউকে জ্বলন্ত কটাহে নিক্ষেপ করা হয়— এ ধারণা সর্বৈব ভুল। যে কদিন রাজগহে ছিলেন, আমি প্রায়ই এঁর দেশনা শুনতে যেতাম এবং প্রচুর পরিমাণে ভোজ্য নিয়ে যেতাম, মহাত্মা পুরন কাস্সপের শিষ্যদের কাছ থেকে যে পরিমাণ আশীর্বাদ পেয়েছি তাতেই মনে হয় আমার এ জীবনটা চলে যাবে। আমার ধারণা এই তীর্থঙ্কর ও তাঁর সম্প্রদায় এর পর এখানে এলে আমার কোনও প্রার্থনা অপূর্ণ রাখবেন না।’
কাকবলীয় বললেন, ‘ওই চার্বাকদের মতো আর কি! পরলোক মানে না, ইহলোকে সর্বপ্রকার সুখ সম্ভোগ করতে চায়। এঁদের বশ করা আর এমন শক্ত কাজ কি?’
মৈত্রেয় জাতক (Maitreya Jatak) – গৃধ্রকূট থেকে সূর্যোদয়
৩০
অতি প্রত্যূষে গৃধ্রকূট থেকে সূর্যোদয় দেখবার জন্য চণক, জিতসোমা এবং তিষ্য তিনটি ঘোড়ায় চড়ে বেরিয়ে পড়ে। তখন নগরীর পথঘাট ঘন কুয়াশায় ঢাকা। চলাচল করে অন্ত্যজ শ্রেণীর লোকেরা গৃহমল পরিষ্কার করবার জন্য। আর দেখা যায় শ্রমণদের। কেউ শ্বেত বস্ত্রধারী, কেউ গৈরিক, কেউ অর্ধনগ্ন, কেউ-বা একেবারেই নগ্ন। প্রত্যূষ ভ্রমণে অভ্যস্ত কিছু নাগরিকও বেরোয়। কয়েকজন বৈদিক ব্রাহ্মণ আছেন, একটি গো-শকটে করে নিত্য পাটুলি গ্রামে গিয়ে গঙ্গাস্নান করেন, ফিরতে ফিরতে অপরাহ্ণ হয়ে যায়। আবার রাত কাটিয়ে পর-প্রত্যূষে গো-শকট চলে পাটুলি অভিমুখে। অর্থাৎ এঁদের সারা দিনটাই ব্যয় হয়ে যায় যাতায়াতে। জিজ্ঞেস করলে এঁরা বলেন, বহতা জল নইলে এঁরা স্নান করে পবিত্রতা ফল অনুভব করেন না। তার ওপর গঙ্গাস্নান। যা কিছু পাপ সারা জীবন জ্ঞাতে অজ্ঞাতে হয়ে যাচ্ছে সবই প্রতিদিনের গঙ্গাস্নানে ধুয়ে যাচ্ছে। অনেকেই এঁদের চেনে, উদকশুদ্ধিক ব্রাহ্মণ বলে এঁদের খ্যাতি বা অখ্যাতি আছে।
পরস্পরকে ভালোভাবে দেখা যাচ্ছে না এমনই কুয়াশা। জিতসোমা অশ্বারোহিণী হবার সময়ে অধোবাস পুরুষদের মতো করে পরে নেয়। তার ঊর্ণার স্তনপট্ট দৃঢ়ভাবে বাঁধা। তার ওপর একটি স্থূল ঊর্ণার উত্তরীয় সে সুকৌশলে পিঠ এবং বুক ও পেট ঢেকে নীবিবন্ধে বেঁধে নিয়েছে। চণক ও জিতসোমা উভয়েরই শীত অভ্যাস আছে। শীতে দুজনেই উল্লসিত হয়। কিন্তু তিষ্যকুমার তক্ষশিলায় বহু বছর কাটালেও, শীতে খানিকটা পর্যুদস্ত হয়। বিশেষ করে অশ্বের ওপর। অশ্ব চলায় বেগ দিলেই দু’পাশ দিয়ে হু-হু করে হিমেল বাতাস বইতে থাকে। তিষ্য তার ঘোড়ার রাশ টেনে ধরে বলে, ‘তাম্রক, তাম্রক, ধীরে, ধীরে, আমরা রণক্ষেত্র থেকে পালাচ্ছি না। তাড়া নেই।’
চণক তার ঘোড়ার পেটে মৃদু আঘাত করে বলে, ‘চিত্তক, চিত্তক, জোরে, আরও জোরে, সূর্যোদয়ের পূর্ব মুহূর্তে উপস্থিত হওয়া চাই।’
জিতসোমা কুয়াশার অন্তরালে হাসতে থাকে, তার মুখের সামনে হিম বাতাসে বাষ্প নির্মিত হয়। সে এক হাতে ঘোড়ার রাশ টেনে ধরে আরেক হাত বাষ্প খণ্ডগুলিকে ধরতে যায়। ধরতে না পেরে আবারও হাসতে থাকে।
এইভাবে কখনও দ্রুত, কখনও ধীর লয়ে তিনজনে গৃধ্রকূটে পৌছে যায়। যেতে যেতে প্রথমেই নগরীর উত্তর দ্বার দিয়ে বেরোতে উদ্যত গো-শকটটির সঙ্গে তাদের দেখা হয়। বয়স্থ ব্রাহ্মণ তিনটি শীতে জড়সড় হয়ে কোলের ওপর পুঁটলি নিয়ে বু-বু করে কাঁপতে কাঁপতে কী সব মন্ত্র উচ্চারণ করতে থাকেন। তিষ্যকুমার হেঁকে বলে ‘কে যায়?’
—তিন ব্রাহ্মণ গঙ্গাস্নানে যায় বাপা— কুয়াশার মধ্যে ব্রাহ্মণত্রয় নিশ্চয় তাদের ভেবেছে তোরণরক্ষী কী সৈনিক। নইলে এত বিনীত উত্তর পাওয়া যেত না।
—তিষ্য দ্বিগুণ হেঁকে বলে, ‘দূরান্তের গঙ্গায় কেন? রাজগহে কি পুষ্কর্ণী নেই!’
—পাপগুলি ধুতে বাপা, পুষ্কর্ণীতে কি আর পাপ-স্খলন হয়?
—কী পাপ? তিষ্য গলা বিকৃত করে। ভীষণ শোনায় তার স্বর। ব্রাহ্মণগুলি আরও বু-বু করে কাঁপতে থাকে।
—পাপগুলি অবিলম্বে জানাও। বোহারিকের কাছে চলো। নরহত্যা না অলংকার চুরি?
একজন ব্রাহ্মণ তাড়াতাড়ি বলে, ‘ও সব কিছু নয় বাপা, তিন সত্য করছি। প্রাণিমাত্রেই অজ্ঞাতে পাপ করে ফেলে, সেইসব অনির্দিষ্ট পাপের কথা বলছি।’
তিষ্য তখন চাপা গলায় বলে, ‘যাও, গঙ্গার জলে ডুবে মরো গে যাও।’
জিতসোমা তার কাণ্ড দেখে মৃদুস্বরে হাসে। চণকের ওষ্ঠাধরও দুদিকে ছড়িয়ে যায়।
কোনও সাড়াশব্দ না পেয়ে উদকশুদ্ধিক ব্রাহ্মণ তিনটি বলে, ‘কী হল? যাবো তো বাপা? পথে আবার আটকাবে না তো? ও কি, নারীকণ্ঠের হাসি শুনলাম যেন!’
আরেক জন বলে, ‘দু পা গেলেই শ্মশান। নারীকণ্ঠের হাসি শোনা যাবে, এ আর বিচিত্র কী? তাড়াতাড়ি চলো! তাড়াতাড়ি চলো! ওহে শকটচালক, থামছ কেন?’
কিছুদূর চলে এসে চণক হাসিতে ফেটে পড়ে, ‘সোমা, সঙ্গীতচর্চা করছ কতদিন! হা সোমা! তোমার হাসি প্রেতিনীর হাসি বলে ভুল হয়?’
সোমা হাসতে হাসতে বলে, ‘ওই ব্রাহ্মণগুলির পরিবর্তে আমারই এখন গঙ্গায় ডুবে মরা উচিত, কী বলুন তিষ্যভদ্র?’
—আমাদেরও ওরা এতক্ষণে প্রেতই ভাবছে। দেখুন, আজ গৃহে ফিরে কোনও প্রেতনাশক ক্রিয়া-কর্মের আয়োজন করে কি না!’
সূর্য ওঠার লগ্ন থেকেই কুজ্বটিকা গলতে থাকে। ধীরে ধীরে তরল রক্তিমাভ আলোর স্রোত বইতে থাকে। তিষ্য ঈষৎ বিষন্ন গলায় বলে, ‘চণকভদ্র আমার শ্রাবস্তী যাবার দিন ঘনিয়ে এলো।’
—তুমি তো নিজেই বেছে নিলে এই ভাগ্য তিষ্য। তবে হয়ত এই-ই ভালো হল।
তিষ্য বলল, ‘মহারাজের সন্দেশ বয়ে নিয়ে যেতে আমি বিন্দুমাত্র দুঃখিত হচ্ছি না ভদ্র। বরং আমি অত্যন্ত আনন্দিত, গর্বিত যে এরূপ বিশিষ্ট কার্যের ভার আমার ওপর দেওয়া হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে চণকভদ্র, রাজগৃহে আসার আগে আমি নাবালক ছিলাম।’
—এখন সাবালক হয়েছেন? জিতসোমা মৃদু মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করল। বালার্কের রক্তাভা এখন তার গৌরবর্ণ মুখশ্রীর ওপর একটি অসামান্য সৌন্দর্যের মুহূর্ত রচনা করেছে। সে মাথাটিও উত্তরীয় প্রান্ত দিয়ে ভালোভাবে জড়িয়ে নিয়েছে। কপালের ওপরে সামান্য কিছু কেশ দেখা যায়। সে নারী না অতি কিশোর বয়স্ক পুরুষ বোঝা যাচ্ছে না।
তিষ্য সোজাসুজি জিতসোমার সঙ্গে কথা বলতে লজ্জা পায়। কেমন একটা জড়তা, সঙ্কোচ। সে জানে না কেন! সে মুখ নিচু করে দুঃখিত স্বরে বলল, ‘তা-ও বলতে পারি না ভদ্রা। মহারাজের অভিনব কার্য আমাকে সাবালকত্ব দেবে আশা করছি।’
চণক বলল, ‘তিষ্য, বিনয় ভালো। কিন্তু অতি বিনয়ে কাজ কি? বিশেষত সখাদের কাছে! তুমিই এই কাজের উপযুক্ততম পাত্র। তুমি শিক্ষিত, উদার, অভিজাত, সুন্দর বাক্য ব্যবহার করতে জানো। একটিই মাত্র প্রশ্ন আছে আমার।’
—কী প্রশ্ন?
—মহারাজা যে উপায়ে রাজসংঘ করে জম্বুদ্বীপকে একত্র করতে চাইছেন, তোমার নিজের তাতে সম্মতি এবং বিশ্বাস আছে তো?
তিষ্য বলল, ‘আমার সম্মতির প্রশ্ন উঠছে কেন আর্য চণক?’
—এই জন্য উঠছে যে তুমি রাজ্য বিস্তার করতে চেয়েছিলে। বিস্তার না বলে বলা ভালো রাজ্য সৃষ্টি করতে চেয়েছিলে। অর্থাৎ সার্বভৌমত্বই তোমার প্রিয় তত্ত্ব, প্রিয় কল্পনা। কিন্তু মহারাজের প্রতিনিধিত্ব করতে যে তত্ত্ব তুমি অবলম্বন করতে যাচ্ছ, তা তোমার পুর্বের কল্পনার বিরোধী, ওই কল্পনা যদি তোমার স্বভাবানুগ হয়, তা হলে বলতে হয় রাজপ্রদত্ত এই কর্ম তোমার প্রকৃতিরও বিরোধী।
—আর্য চণক, আমি দক্ষিণে যেতে চেয়েছিলাম। দক্ষিণ তত সহসা কেউ ভেদ করতে পারবে না! অন্তত উত্তরের প্রতিযোগিতা ও আগ্রাসী লোভ থেকে আমার রাজ্য সুরক্ষিত থাকবে এবং সেই শান্তির সুযোগে আমি আদর্শ রাজ্য, আদর্শ রাজা-প্রজা সম্পর্ক, বিভিন্ন বৃত্তির মধ্যে পারস্পরিক আদানপ্রদানের ফলে পণ্য বিতরণের মসৃণ গতি ইত্যাদি প্রতিষ্ঠিত করতে পারব, আমি এইভাবে ভেবেছিলাম। সার্বভৌমত্বের জন্যই সার্বভৌমত্বে আমার কোনও লোভ ছিল না আর্য। সার্বভৌমত্ব যে শান্তি ও শৃঙ্খলা, সুসভ্য, সুমিত জীবনধারণের সুযোগ দেয়, তারই জন্য সার্বভৌমত্ব আমার কাম্য ছিল। মহারাজ বিম্বিসার দেখিয়ে দিলেন অন্যভাবেও তা সম্ভব। রাজশক্তি যদি পরস্পরের আনুকূল্য করে, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভিন্ন রাজ্য হওয়ার জন্য প্রজাদের অসুবিধাগুলি মিলিতভাবে দূর করবার চেষ্টা করে, তা হলে আমার কল্পনার রাজ্য তো আমি পেলাম। পেলাম না!
চণক সাবধানে বলল, ‘আমি জানতাম না তিষ্য, তুমি ক্ষত্রিয়, অথচ ক্ষত্রিয়ের যা স্বধর্ম সেই যুদ্ধবাসনা, বা রাজ্যবাসনা তোমার নেই। তুমি চিরকাল কারও না কারও নেতৃত্ব মেনে নিতে প্রস্তুত আমি এ কথা বুঝতে পারিনি।’
অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে জিতসোমা বলল, ‘আর্য চণক, আমি বুঝতে পারছি না আপনি তিষ্যভদ্রকে তাঁর ক্ষত্রিয়োচিত উচ্চাকাঙ্ক্ষা সংবরণের জন্য তিরস্কার করছেন, না তাঁর মহানুভবতার জন্য প্রশংসা করছেন।’
তিষ্য সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে চেয়ে আছে চণকের দিকে। তার চোখ দুটি দীর্ঘ। ঘনপক্ষ্ম। তার তরঙ্গায়িত ওষ্ঠাধর এবং নাতিউচ্চ নাসাগ্রে এখন রোদ ঝলমল করছে। সে ডান হাতের পাতা দিয়ে মাঝে মাঝে রোদ আড়াল করছে। আর যাই থাক, এই মধ্যদেশীয় যুবকের মধ্যে বিন্দুমাত্রও ধূর্ততা নেই।
সে বলল, ‘তিষ্য, আমি তোমাকে তিরস্কারও করছি না, প্রশংসাও করছি না। শুধু তোমাকে ভালো করে ভেবে নিতে বলছি। তোমার বয়সে হঠাৎ কারও ব্যক্তিমায়ায় মুগ্ধ হয়ে তাঁর আদিষ্ট কর্ম করতে গিয়ে সহসা যদি আবিষ্কার করো তা তোমার প্রকৃতিবিরোধী, তখন না পারবে এগোতে, না পারবে পেছোতে। তুমি যেরূপ বিবেকী, শুধু অন্তর্দ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষতই হবে। তা ছাড়া যথার্থ প্রত্যয় না থাকলে কাউকে তুমি স্বমতে, অর্থাৎ বিম্বিসার মতে আনতেও পারবে না। ওই তত্ত্বে তোমার প্রত্যয় চাই!’
তিষ্য অনেকক্ষণ চিন্তামগ্ন রইল, তারপর বলল, ‘আপনার কথা আমি বুঝতে পেরেছি। মহারাজের তত্ত্বের ওপর আমার শ্রদ্ধা আছে… কিন্তু…।’
—কিন্তু কী?
—এটি একটি নূতন তত্ত্ব স্বীকার করেন তো? কুরু-পাঞ্চালের ভয়ানক যুদ্ধের কথা স্মরণ করুন। শুনেছি জম্বুদ্বীপে সামান্য কয়জন ছাড়া আর যুবা বা প্রৌঢ় অবশিষ্ট ছিল না। শুধু শিশু আর নারী, বিধবা নারী। সমগ্র জম্বুদ্বীপ এই যুদ্ধে কোনও-না-কোনও পক্ষে যোগ দিয়েছিল। সেই আদর্শ থেকে আমরা কি এখনও সরে এসেছি? ওই যুদ্ধ থেকে কোনও শিক্ষাই কি লাভ করেছি? এখনও ক্ষত্রিয় মানে যোদ্ধা, ধনুর্গ্রহ, গদাচক্রধারী। সুতরাং এটি, এই মৈত্রীর তত্ত্বটি এখনও তো পরীক্ষার স্তরেই আছে। তাই নয় কি আর্য চণক?
—সত্য বলেছ। কিন্তু কোনও তত্ত্ব যিনি উদ্ভাবনা বা প্রচার করেন তিনি বা তাঁরা অন্তত তত্ত্বটি, যথার্থতায়, প্রয়োগ-যোগ্যতায় বিশ্বাস রাখেন। যেমন ধরো, শ্ৰমণ গৌতম অনাত্মবাদ, ক্ষণিকবাদ প্রচার করছেন, আমি এখুনি তর্ক করে ওঁর যুক্তিজাল শতচ্ছিদ্র করে দিতে পারি। কিন্তু ওঁর প্রত্যয় তাতে টলবে না। উনি আমাকে বলবেন অবিশ্বাসী, অনধিকারী, পৃথগ্জন। ওঁর মুখের বিমল আভা দেখে, প্রত্যয়ী উক্তি শুনে বহু লোকে ওঁর অনুগামী হবে। হতেই থাকবে। সে রূপ প্রত্যয় কি তোমার আছে তিষ্য এই মৈত্রী তত্ত্বে?
‘না, চণকভদ্র, নেই,’ দুঃখিত গলায় তিষ্য বলল, ‘সত্যি কথা বলতে কি স্বয়ং মহারাজ বিম্বিসারেরও সেরূপ অবিচল প্রত্যয় নেই। তবে শ্রদ্ধা আছে, তাঁরও আমরাও। শুধু শ্রদ্ধা দিয়ে কাউকে স্বমতে আনতে পারবো না, বলছেন?’
জিতসোমা এই সময়ে বলল, ‘আর্য চণক, তিষ্যভদ্রকে নিরুৎসাহ করবেন না। যে কাজ মহৎ, যে চেষ্টা মৌলিক তার প্রতি শ্রদ্ধা থাকাই যথেষ্ট। আপনি যাকে প্রত্যয় বলছেন তা একমাত্র ঐশ্বরিক অনুপ্রেরণা থেকেই আসে। যেমন সংহিতার ঋষিদের এসেছিল!
অহমেব বাত ইব প্র বামি
আরভমানা ভুবনানি বিশ্বা।
পরো দিবা পর এনা পৃথিব্যা—
এতাবতী মহিনা সং বভূব॥
ঋষি বাক্-এর এই যে বুকের মধ্যে বিশ্বভুবন ধারণ করার অনুভব, আবার আকাশ ছাড়িয়ে পৃথিবী ছাড়িয়ে বিপুল মহিমায় দাঁড়িয়ে থাকার অনুভব, এ তো ঐশী প্রেরণার দান। যে শ্রমণ গৌতমের উদাহরণ আপনি দিলেন তিনি নাকি বলে থাকেন : অগ্গোহম অস্মি লোকস্স। —সমস্ত পৃথিবীতে আমিই শ্রেষ্ঠ, এইসব প্রত্যয় উপলব্ধিজাত। বুদ্ধি দিয়ে যা ভালো বলে বুঝি তাকে শ্রদ্ধা করে মানাও তো অনেক! গৌতমের বা ঋষি বাক্-এর প্রত্যয় মহারাজ বিম্বিসারই বা কোথায় পাবেন, তিষ্যভদ্রই বা কেমন করে পাবেন?’
সূর্য লাফিয়ে লাফিয়ে ওপরে উঠে যাচ্ছে। এখন তার মিশ্রিত রক্তাভার মধ্যে হরিদ্রার বর্ণই প্রধান হয়ে উঠছে। সূর্যের তাপ কোমল কম্বলের মতো জড়িয়ে ধরছে শীতার্ত বৃক্ষ ও গুল্মগুলিকে। এবং উপবিষ্ট তিনটি মানুষের শরীর। ঈষৎ তপ্ত হয়ে উঠেছে বাতাস, বইছে উত্তর থেকে, ভারি মধুর, উষ্ণ। তিষ্যর মনে হল বাতাস নয়, ভদ্রা জিতসোমাই এভাবে বইছেন। তাঁর গভীর সহমর্মিতার উষ্ণতায় আবৃত করে দিচ্ছেন চরাচর। তিনিই দাঁড়িয়ে আছেন পৃথিবী, আকাশ সব ছাড়িয়ে, উন্নতগ্রীব বিশাল মহিমায়। স্বে মহিম্নি।
চণক একটু পরে বলল, ‘না। আমি তিষ্যকে কখনওই নিরুৎসাহ নিরুদ্যম করছি না সোমা। শুধু ওকে চিন্তা করে নিতে বলছি। এইসব কর্মের ক্ষেত্রে কয়েকটি মানসিক বিপন্নতার সম্ভাবনা থাকে; ওকে সতর্ক করে দিচ্ছি তাই।’
তিষ্য বলল, ‘সে কথা আমি বুঝতে পেরেছি ভদ্র। আপনি যেন আমারই ভেতরের সত্তার একটি দিক। দুটি দিকের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক চলছে।’
কথাগুলো সে মৃদুস্বরে বলল। কেননা সে চায় না তার চারপাশে যে শান্তির, আনন্দের আবহ প্রস্তুত হয়েছে, তার হৃদয়ের মধ্যে এখন যে আবেশ তা ক্ষুণ্ণ হোক। ব্যক্তি-মায়া কী? কুণ্ডলকেশী সেই শ্রমণার অদ্ভুত কথাবার্তায় সে আবিষ্ট হয়েছিল, শ্রমণ গৌতম, বিশেষ করে মহা মৌদ্গল্যায়ন যেভাবে যক্ষ-যক্ষী দুটিকে এবং পরে উন্মত্ত জনতাকে শান্ত করলেন তখনও সে মুগ্ধ হয়েছিল। চণকের প্রতি সে আকৈশোর মুগ্ধ, মহারাজ বিম্বিসারকে তাঁর স্বরূপ দেখামাত্র তাঁর অদ্ভুত পৌরুষব্যঞ্জক হাবভাব ও স্নেহকৌতুক মিশ্রিত কথা, দেখা ও শোনামাত্র তাঁর চরিত্রের গভীরতা উপলব্ধি করা মাত্র সে মুগ্ধ হয়ে পড়েছে। এই-ই কি ব্যক্তিমায়া? আর এই যে ভদ্রা জিতসোমা অধিক কিছু বলেন না। কিন্তু যখন বলেন তখন দ্যুলোক ভূলোক ভরিয়ে বলেন, এতে যে মুগ্ধতার আবেশ সৃষ্টি হয়, মনে হয় আর কেউ কোনও কথা না বলুক, পৃথিবী ঠিক এই মুহূর্তে থমকে থাকুক, এ-ও কি ব্যক্তি-মায়া? তিষ্য কি তা হলে একটার পর একটা ব্যক্তি-মায়ায় বদ্ধ হয়ে চলেছে? তার নিজের কোনও ব্যক্তি-মায়া নেই? যাতে অন্য কেউ আবিষ্ট হতে পারে? আবদ্ধ হতে পারে?
শেষোক্ত চিন্তা মনে আসতেই তিষ্যর এতক্ষণের আবেশ, স্থিরতা, ধৈর্য, আনন্দ টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে গেল। তার মনে পড়ে গেল সরযূ নদীতীর। সুনীল বর্ণের বসনে সজ্জিত এক অপরূপা কিশোরী। তিট্ঠ, তিট্ঠ, তিস্স্। তার আবেশের, মুগ্ধতার কুন্দমালাটি যেন ছিড়ে-খুঁড়ে সে টুকরো টুকরো করে ফেলে দেয়। চার দিকে ছড়িয়ে যায় তার অধৈর্য, অশান্তি, যন্ত্রণা, জিতসোমা অবাক হয়ে মুখ তুলে তাকায়। দণ্ডায়মান তিষ্যর রক্তাভ, ভ্রূকুটি কুটিল মুখের দিকে অবাক হয়ে চেয়ে চণক বলে, ‘কী ব্যাপার তিষ্য, আজ কি এরই মধ্যে ফিরতে চাইছ?’
বহু কষ্টে আত্মসংবৃত হয়ে তিষ্য বলে, ‘কী লাভ? ভদ্র চণক? ক’দিন পরেই চলে যাবো শ্রাবস্তী। সেখানকার কাজ সমাপ্ত হলেই বৈশালী, তারপর যাত্রা করতে হবে উজ্জয়িনী-কৌশাম্বীর উদ্দেশে। কোথায় থাকবেন আপনারা? কোথায় বা হতভাগ্য তিষ্য।’
চণক উঠে দাঁড়িয়ে তার কাঁধ স্পর্শ করে বলল, ‘তিষ্য নিজেকে হতভাগ্য বলছ কেন সখা! তুমি যেমন দূরে যাবে, আমিও তেমন যাবো, আরও দুর্গম স্থানে যেখানে স্ব-সমাজের মানুষই হয়তো পাবো না। কিন্তু তুমি ক্ষত্রিয়, দুঃখে অবসন্ন হলে, ক্ষিপ্ত হলে কি তোমার চলবে?’
তিষ্য আরক্ত মুখে বলল, ‘আমি ক্ষত্রিয় নই আর্য চণক। আমি মানুষ। কোনও বিশেষ বর্ণের আচরণের চিহ্ন আমার গায়ে লেগে নেই। লেগে থাকবে না। কেন বারবার শুনতে হবে ক্ষত্রিয়, ক্ষত্রিয়, ক্ষত্রিয়, এমন কি আপনার থেকেও? কত যুগ ধরে আমাদের পূর্বপুরুষেরা এই ক্ষত্রিয়-সংস্কার, ব্রাহ্মণ-সংস্কার ঢুকিয়ে দিয়েছেন আমাদের রক্তে? ভদ্র চণক, ওই বিদ্রোহী চণ্ডাল অনঙ্গ যেমন দাসত্বের, শূদ্ৰত্বের পূর্ব-সংস্কার ভেদ করে উঠে দাঁড়িয়ে সক্রোধ প্রশ্নে জানিয়ে দেয় সে শুধু সেবক নয়, সে মানুষ, তিষ্যও তেমন ক্ষত্রিয়-সংস্কার ভেদ করতে চায়। প্রশ্ন করতে চায় কোনটা সুবিচার কোনটা অবিচার?’
হঠাৎই সে থেমে গেল। এ কী বলছে সে? কেন বলছে? কাকেই বা বলছে?
চণক নীরবে তার দিকে তাকিয়ে। চোখে উৎকণ্ঠা। জিতসোমা মুখ নত করে একটি ক্ষুদ্র উপলখণ্ড দেখতে মনোযোগী হয়ে উঠেছে। চণক ধীরে ধীরে বলল, ‘কী তোমার সে মহাদুঃখ তিষ্য, যার জন্য নিজেকে দুর্ভাগা বলো— জানি না। কী সে গূঢ় যন্ত্রণা যা এইভাবে হঠাৎ বিস্ফোরিত হল তা-ও জানি না। কিন্তু তিষ্য, তুমি কখনও বন্ধুহীন নও। কোনও দিন নিজেকে প্রকাশ করতে ইচ্ছা হলে স্বচ্ছন্দে করবে। আর বিদ্রোহের কথা যদি বলো— চণক তোমায় বিদ্রোহীর ভূমিকায় দেখতে আনন্দিতই হবে। চলো, এবার নামি। সোমা, এসো…।’
ক্ষমা প্রার্থনার একটি বাক্যও তিষ্য উচ্চারণ করতে পারল না। চণকভদ্র ওইভাবে তার ক্রোধের কারণ নির্ণয় করবার পর সে মুখ খুলতেও সাহস পাচ্ছে না। কে জানত তার বুকে এত হাহাকার জমে ছিল? শ্রাবস্তী যাবার প্রস্তাবে এইভাবে পুরনো ক্ষত থেকে রক্তপাত হয়ে তাকে উদ্ভ্রান্ত করে দেবে তা কি সে ভেবেছিল? আচ্ছা, কেন শ্রাবস্তীই? তাকে তো প্রথমেই কৌশাম্বী বা উজ্জয়িনী পাঠাতে পারতেন মহারাজ। সে বলেও ছিল। কিন্তু মহারাজের দৃঢ় ধারণা সহজ কাজ থেকে কঠিন কাজের দিকে অগ্রসর হতে হয়। তাই বৈশালী পেরিয়ে তাকে শ্রাবস্তীতেই যেতে হবে। চণক এবং জিতসোমার মতো সহমর্মী ছেড়ে, মহারাজ বিম্বিসারের মতো পক্ষপুটবিস্তারী মহামহিম রাজসঙ্গ ছেড়ে শ্রাবস্তী, যা এখন নিষ্ঠুর প্রত্যাখ্যানের বাসভূমি।
প্রকৃত ব্যাপার নারী! এই নারীই যত অনর্থের মূল! জননী হয়ে দুরূহ কর্তব্যের পথ থেকে টেনে ধরে রাখে পেছনে, জায়া হয়ে পথ ভোলায়, নিত্যনৈমিত্তিকের পথে বাঁধা গরুর মতো ঘোরায়, প্রিয়া রূপে উদ্ভ্রান্ত করে, পৌরুষের মধ্যে এনে দেয় নারীসুলভ কম্প্ৰতা, শেষ পর্যন্ত এই নারী কী দেয়? যন্ত্রণা ও আত্মধিক্কার ছাড়া? নারীদের যে অধম মনে করা হয়, পুরুষকে বিপথগামী করবার যন্ত্র মনে করা হয়, ঠিকই! ঠিকই! যে কোনও সম্পর্কের নারী, যে কোনও বয়সের পুরুষকে হাত ধরে নিরয়লোকে নিয়ে যেতে পারে। তার গুরুপত্নী অলভা! হতে পারে তিনি খুবই অল্প বয়স্কা। কিন্তু বিবাহিতা তো! আচার্য সংকৃতির পঞ্চম পত্নী তিনি। আচার্য সংকৃতি যিনি সারা জম্বুদ্বীপে তাঁর জ্ঞান, তাঁর মুক্ত দৃষ্টির জন্য সুবিদিত। তাঁর পত্নী। গুরুপত্নী সে যে বয়সেরই হোন না কেন জননীর মতো তো! অথচ অলভা তাকে প্রলোভিত করাবার জন্য কী করতেন। উড়ুম্বর বৃক্ষের ডালে বসে পা দোলাতেন, তাঁর শুভ্র কোমল চরণপত্র তো বটেই, তার ঊর্ধ্বের অংশও অনাবৃত হত। যখন কোনও আদেশ করতেন তখন গ্রীবা বাঁকিয়ে কটাক্ষে তাকাতেন তার দিকে, নীলাভ চোখের মণিতে একই সঙ্গে তিরস্কার ও প্রশ্রয় ফুটে থাকত। দাঁত দিয়ে অধর কামড়ে থাকার একটা মধুর ভঙ্গি ছিল অলভার। একদিন, একদিনই মাত্র বলেছিলেন, ভুজঙ্গিনীর মতো যেন ফণা তুলে—তিষ্যকুমার আমি তোমার থেকে তিন চার বছরের বেশি বড় হবো না। কক্ষনো আমাকে মাতৃসম্বোধন করবে না। কেন করো? কেন? কেন? আমি কারও মা নই, হইনি এখনও, হবোও না। আমি কারও পত্নীও নই। আমি অলভা, অলভা, অলভা… বলতে বলতে দূর বনচ্ছায়ে হারিয়ে গেলেন ছুটতে ছুটতে।
ধাবমানা, বনচ্ছায়ে হারিয়ে যেতে থাকা অলভার আকৃতিটি তিষ্যর বুকের মধ্যে ফুটে উঠল যেন একটি চলমান প্রতিকৃতি। সর্পিণী! সর্পিণী! এরা সকলেই সর্পিণী! তার পর সহসাই তার বুকের মধ্যে আরও প্রতিকৃতি ফুটে উঠল। আচার্য সংকৃতির। শ্বেত শ্মশ্রু, শ্বেত কেশ, শান্ত স্বরে ঋষি অগস্ত্য মৈত্রাবরুণির দ্যাবা-পৃথিবী সূক্ত ব্যাখ্যা করছেন :
সংগচ্ছমানে যুবতী সমন্তে
স্বসারা জামী পিত্রোর্ উপস্থে।
অভিজিঘ্ৰন্তী ভুবনস্য নাভিং
দ্যাবা রক্ষতং পৃথিবী নো অভ্বাত্..
“তরুণবয়সী দুটি মেশামেশি সীমানা পরস্পর
মিলেছ আপন দুটি ভাইবোন কোলটিতে মা-বাবার
ভুবনের নাভি আদরেতে ঘ্রাণ করো—
হে দ্যাবা পৃথিবী মহাভয় হতে মোদের রক্ষা করো…”
তিষ্যর যে কী হয়ে গেল হঠাৎ, সে জানে না। অলভার ছুটন্ত আকৃতি যেন একটি যন্ত্রণার তীরের মতো তার বুকে বিঁধে গেল। ঘৃণা নয়, যন্ত্রণা। এ যন্ত্রণার অর্থ সে জানে না। সংগচ্ছমানে যুবতী সমন্তে…। সংগচ্ছমানে… তিষ্যর চোখ সেই বিদ্ধ তীরের যাতনায় সজল হয়ে উঠছে। তরুণবয়সী দুটি মেশামেশি… অলভা একটি খড়ের কন্দুক প্রস্তুত করেছেন। একেবারে নিটোল, অতি নিপুণভাবে প্রস্তুত। প্রেঙ্খায় দুলছেন, দুলতে দুলতে মহাবেগে উঠে যাচ্ছেন ঊর্ধ্বে। শিংশপার উচ্চ শাখাগুলি বুঝি ছুঁয়ে ফেললেন, সেই ঊর্ধ্বে থেকে কন্দুকটি ছুঁড়ে দিচ্ছেন, পায়ের আঘাতে, ধরো তিষ্যকুমার ধরো, দেখি তো তুমি কেমন কুশলী!
অহমেব বাত ইব প্র বামি… বায়ুর মতো বয়ে যাচ্ছে বিশ্বভুবনে এক সুগভীর যন্ত্রণার তরঙ্গ। সব সময়ে বোঝা যায় না। হয়ত এইভাবে বয়ে যাচ্ছে আনন্দধারাও, একইভাবে বইছে আত্মোপলব্ধির তরঙ্গধারাও। কে কখন কোন ধারাটিকে ছুঁয়ে ফেলে, তার বিশ্বভুবন মুহূর্তে পাল্টে যায়, পাল্টে যায় জীবনের অর্থ, তিষ্যকুমার এখন আনন্দধারার ঊর্ধ্বে সেই বেদনাপ্রবাহকে ছুঁয়ে ফেলেছে, সেও এখন ধাবমান, চূড়ান্ত বেগে, হারিয়ে যাচ্ছে কোন অন্ধকার অরণ্যছায়ায়, পালাচ্ছে স্বস্তি, সংকল্প এবং কেতুকাম্যতার দিক থেকে ব্যথাজর্জর কোনও উপলব্ধির ব্যাখ্যাতীত গাঢ়তায়। যেতে যেতে বলে যাচ্ছে অনম ফণা তুলে—ক্ষত্রিয় নই। কারো কেউ নই। আমি তিষ্য… তিষ্য… তিষ্য…
৩১
বর্ষার পরে শীতের প্রারম্ভকালই যাত্রার জন্য প্রশস্ত। সে যুদ্ধযাত্রাই হোক আর তীর্থযাত্রাই হোক। কে কোথায় যুদ্ধযাত্রার জন্য প্রস্তুত হল বা হল না, জানা যাচ্ছে না। ছোটখাটো সংঘর্ষ তো লেগেই আগে। প্রদ্যোৎ মহাসেনের গান্ধারপিপাসা সম্ভবত এখনও মেটেনি। তবে তার তীব্রতা আর তেমন নেই। উত্তর বাণিজ্যপথে যাতায়াতরত সার্থগুলির থেকে এই জাতীয় আভাসই যেন পাওয়া যায়। সমস্ত কিছুর মধ্যে মহারাজ পুষ্করসারীর বিপন্ন মুখটির থেকে থেকেই মনে পড়ে। ভেতরে একটা অপারগতার কাঁটা ফোটে। তাই চণক সার্থদের কাছ থেকে পাওয়া সংবাদে হৃষ্ট হয়। মহারাজ বিম্বিসার ঠিকই বলেছিলেন। চণ্ড মহাসেনের চণ্ডতা আপনা থেকেই চলে যাবে। যাই হোক তেমন কোনও রণ বা মহারণযাত্রার কথা শোনা না গেলেও আরেক ধরনের যাত্রা চলেছে। তাকে তীর্থযাত্রাও ঠিক বলা যায় না। বিভিন্ন পন্থের পরিব্রাজকেরা বিশেষত সাক্ক পুত্তীয় সমনরা ছড়িয়ে পড়ছেন দূর থেকে দূরান্তরে। এঁদের কোনও নির্দিষ্ট গন্তব্য নেই। কাজেই তীর্থযাত্রা নয়। অথচ যাত্রা। নিঃসন্দেহে যাওয়া। দেশ থেকে দেশান্তরে পরিভ্রমণ করাই এঁদের কাজ। বিশেষত এই সময়ে। গৃহ নেই, ক্লান্তি নেই, চিন্তা নেই, অভিযোগ নেই। শুধু চলা। ক্ষণেক বিশ্রাম। আবার চলা। পথে পথে পথিকদের, গৃহীদের পরামর্শ দেন, সেবা দেন, উপদেশ দেন, সামান্য ভিক্ষাগ্নে ক্ষুণ্ণিবৃত্তি করেন। আবার চলেন। নভোমণ্ডলে মেঘে মেঘে কাশ ফুটে আছে। শুভ্রপক্ষ হংস হংসী উড়ে যাচ্ছে উত্তর থেকে দক্ষিণ-পূর্বে। দেখতে দেখতে পা দুটি চঞ্চল হয়ে ওঠে দৈবরাত চণকের। যাবার সময় হল। এখনও যদি না বেরাতে পারে তা হলে পুরো এক বছর বিলম্ব হয়ে যাবে। সোমার সঙ্গে পরিষ্কার কোনও আলোচনা না হলেও যেন একটা অনুক্ত চুক্তি হয়ে যাচ্ছে। সে রাজগৃহে দাস-দাসী নিয়ে বসবাস করবে। চণক কয়েক মাস পরিব্রজনের পর আবার আসবে। যাওয়া-আসা চলবে। কিন্তু চণকের ভেতরটা স্বস্তিতে নেই। কাজটা কি সে ঠিক করছে? সোমা মূক হয়ে রয়েছে। চণক যা করবে সে তা মেনে নেবে। কিন্তু চণকের দায়িত্ববোধ? অবশ্যই সোমার সুরক্ষার ভার নেবেন স্বয়ং মহারাজ। কিন্তু…। মহারাজের কূটকক্ষে যাবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে, চণক। সোমা প্রশান্ত মুখে তার কটিবন্ধ এগিয়ে দিল। প্রশান্ত, কিন্তু প্রসন্ন কী? প্রসন্ন হওয়ার কথা নয়। প্রসন্ন যে নয় তা প্রাণপণে লুকোবার জন্যই এই প্রশান্তি। ভ্রূ কাঁপে না, চোখ দুটি তাদের আয়ত নীলিমায় মগ্ন। ওষ্ঠাধর যেন পটে আঁকা। শুধু নাসারন্ধ্র একটু একটু স্ফুরিত হচ্ছে।
চণক হেসে বলল—‘সোমা, আমার কি হাতের সংখ্যা অল্প? কটিবন্ধটি কি নিজে নিতে পারি না? তুমি কেন এতো কষ্ট করো?
—এই সামান্য কটিবন্ধ তুলতে আমার কষ্ট হবে? আর্য, আপনার যদি ভালো না লাগে আমি এখুনি চলে যাচ্ছি।
চলে যেতে উদ্যত সোমাকে ক্ষিপ্র হাতে থামায় চণক।
—‘সোমা!’
—বলুন!
—আমার কথার কি এই অর্থই হয়?
—আর কোনও অর্থের কথা তো আমার মনে আসছে না।
বাইরে থেকে এই সময়ে তাম্রকের হ্রেষা ধ্বনি ভেসে আসে। তিষ্যকুমার এসে গেছে। উভয়ে রাজসকাশে যাবে।
সোমা বলে—যান আর্য, আপনার সখা এসে গেছেন।
কদিন আগে গৃধ্রকূটে সহসা নিজের আবেগের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাবার পর থেকে তিষ্য চণকের গৃহের ভেতরে আর আসছে না। আর একদিনও সে সোমার মুখোমুখি হয়নি। চণক বুঝতে পারে, এ তার লজ্জা, সংকোচ। সে তিষ্যকে সময় দিতে চায়। কিন্তু সোমা বোঝে না। চণকের কাছে যদি তার সংকোচ না থাকে, তা হলে সোমার কাছেই বা তার এতো সংকোচ কেন? ভেতরে ভেতরে সে গূঢ় অভিমানে স্তিমিত থাকে। চণকের সঙ্গে তর্ক করে। চণক বলে সোমা বোঝো না কেন, নারীর কাছে পুরুষের একটা সংকোচ স্বাভাবিক কারণেই আসে! সোমা বোঝে না।
সোমা তার জীবনে, তার প্রতিবেশে নারীর কাছে পুরুষের সঙ্কোচ দেখেনি যে। সে বরং দেখেছে বণিক, রাজপুরুষ, সাধারণ গৃহী, সর্বজাতীয় পুরুষ তার কাছে অকপট। মুক্ত। শারীরিক, জৈবিক, মানসিক সব অর্থে। দর্ভসেনের মতো বর্ষীয়ান পুরুষেরা নিজেদের শিথিল, বয়ঃকুঞ্চিত শরীর প্রকাশ করতে লজ্জা পেতেন না। রাজসভার যাবতীয় গুপ্ত কথা তারই সঙ্গে অসঙ্কোচে আলোচনা করতেন। গৃহীরা সংসারের যাবতীয় অসন্তোষ খোলাখুলি বলে যেত, বণিকরা বলত তাদের লাভালাভের কথা। কবিরা, পণ্ডিতরা তার সঙ্গে, তার জননীর সঙ্গে কাব্য এমন কি শাস্ত্রালোচনা করে যে সুখ পেতেন আর কারো সঙ্গে ততটা পেতেন না, এ কথা তাঁরা নিজেরাই বলেছেন। তা হলে কেন গূঢ় আলোচনার জন্য তিষ্যকুমার ও চণককে মহারাজের কূটকক্ষে যেতে হবে? কেন আর্য চণক সব কথা তাকে বললেও কিছু যেন আবার না বলা রেখে দ্যান? তিষ্যকুমার কেন তার মনের গোপন ব্যথাগুলি তার কাছে ব্যক্ত করে না! নারী কি পুরুষের বন্ধু হতে পারে না? আর্য চণকের কাছে সে তার সংকোচ জয় করল, অথচ জিতসোমা তার সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে থাকলেও তিষ্যকুমার কেন সে হাত ধরে না? কেন এড়িয়ে যায়?
এবং তিনজনের এই নতুন মন্ত্রণার ঘটনাটি ঘটবার পর থেকে সোমা থেকে যাচ্ছে বৃত্তের বাইরে। অন্তর্বৃত্তে শুধু ওরা তিনজন। মহারাজ এর আগে প্রায়ই আসতেন। চারজনে কত কথা হত! মনে হত মহারাজের মনে সোমার প্রতি আস্থা জন্মাচ্ছে। কিন্তু কূটকক্ষে যখন ডাকলেন শুধু দুটি পুরুষকেই ডাকলেন। যদিও সোমার অভিজ্ঞতা এবং সেই সুযোগে রাজনীতি সম্পর্কিত জ্ঞান এক অর্থে চণকের থেকেও অধিক। আর্য চণক তত্ত্ব জানেন, তত্ত্ব উদ্ভাবন করেন। কিন্তু সোমা তার জীবনে শিশুকাল থেকে অনেক তত্ত্বের প্রয়োগ দেখেছে, শুনেছে, কোথায় কোথায় কীভাবে তত্ত্ব নিষ্ক্রিয়, নিস্ফল হয়ে যায় তাও দেখেছে। এ গৃহে সেই চিত্তপ্রসন্নকর আলোচনাচক্রগুলি আর বসছে না। মহারাজ আসেন মাঝে মাঝে। লঘু তারল্যে যেন ভেতরকার কোনও উদ্বেগ গলিয়ে নিতে চান। কোনও গুরুত্বপূর্ণ কথা হয় না। তিষ্যকুমার তো কদিন ধরে আসছেই না। অথচ এই যুবার অনভিজ্ঞ গম্ভীরতা, আবার অতি তারুণ্যের মোহান্ধতা, তার মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি এ সব অত্যন্ত ভালো লাগে জিতসোমার। সে যেন মুক্ত বাতাসের মতো চণক আর সোমার মাঝখান দিয়ে বয়ে যায়।
সোমার দিকে একবার দ্বিধাগ্রস্ত চোখে তাকায় চণক। চোখে চোখ মেলে না কিন্তু। কেন না সোমা নতচক্ষু।
—যাই সোমা, নম্র গলায় বলে চণক বেরিয়ে পড়ে।
রাজপুরীর অন্তঃপ্রাচীর পার হবার পর ঘোড়া থেকে নেমে দুজনে পদব্রজে পুরীর দিকে যেতে থাকে, তাম্রক ও চিত্তকের পাশে পাশে। অন্তঃপ্রাচীরের তোরণ থেকে কূটকক্ষ পর্যন্ত পথটি দুজনে সম্পূর্ণ নীরবে চলে। একদিকে রাজসভা, রাজার ব্যায়ামাগার, রাজকোষ, মন্ত্রণাগৃহ ইত্যাদি মিলিয়ে একটি প্রাসাদ! রাজার বাসভূমি তার বিপরীত দিকে।
পথে মাঝে মাঝেই প্রহরীরা দাঁড়িয়ে আছে। প্রধান তোরণে একবার মাত্র পরিচয়মুদ্রা দেখাতে হয়, তারপর প্রাসাদের তোরণে পৌঁছতেই রাজসচিব বর্ষকার কিম্বা সুনীত তাঁদের রাজসকাশে নিয়ে যান। মন্ত্রণাগৃহটি কয়েকটি ভাগে বিভক্ত। কূটকক্ষ একেবারে ভেতরে। মহারাজ সেখানে তাদের সঙ্গে আলোচনা করেন না। বস্তুত তিনি মন্ত্রণাগৃহের একেক অংশে একেক দিন বসেন। আজ বর্ষকারকে দেখতে পাওয়া গেল।
এঁকে দেখলৈ তিষ্য বিরক্ত হয়। তার ধারণা ইনি কুর, কুটিল। চণক জানে রাজ-সন্নিধানে এ প্রকার বহু কুটিল, ক্রূর মানুষ থাকে। থাকাটাই স্বাভাবিক।
বর্ষকার বললেন—আসুন, আসুন মহামান্য চণক। আসুন কুমার তিষ্য। মহারাজ অনেকক্ষণ থেকেই আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছেন।
চণক বলল—হ্যাঁ, মহারাজ কখনও উত্তরদেশে যাননি তো, তাঁর জিজ্ঞাসা অনেক। কৌতূহলে আপাদমস্তক পূর্ণ থাকেন।
বর্ষকার কটাক্ষে একবার তার দিকে তাকিয়ে নিয়ে বললেন—মহারাজ কি সাকেতেও যাননি কখনও?
তিষ্য যে সাকেতক তা রাজসচিব বর্ষকারের জানার কথা নয়। সে যে মধ্যদেশীয় এ টুকু তিনি কেন অনেকেই অনুমান করে নিতে পারে। কিন্তু সাকেতক? মহারাজ কি বলেছেন? বলবার কথা নয়। রাজ-অমাত্যরা সবাই জানে চণক মহারাজের আচার্যপুত্র। সে এখনও কোনও অমাত্য-পদ পায়নি, বা নেয়নি এ তারা স্বচক্ষেই দেখছে। সে যে গৃহ-কানন দাস-দাসী, মাসিক বৃত্তি ইত্যাদি রাজ-অনুগ্রহও পাচ্ছে এ-ও তারা জানছে। পরিবর্তে চণক মহারাজকে কী দিচ্ছে। কী দিতে পারে এ নিয়ে প্রথম দিকে কিছুটা চঞ্চল কৌতূহল প্রকাশ পেয়েছিল। এখন তা শান্ত হয়ে এসেছে। তিষ্য চণকের সখা বলেই রাজসখা, তার অন্য কোনও গুরুত্ব বা ভূমিকা নেই—এমনটাই মহারাজ জানাতে চান। অথচ আজ বর্ষকার বললেন—সাকেতক তিষ্য! ভালো, এঁরা স্বভাবে চতুর, রহস্য ভালোবাসেন না। রহস্য ভেদ করতে থাকুন। চণক এঁদের সাহায্য করবে না। সে মৃদু হেসে এগিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু তিষ্য হঠাৎ থেমে গেল। তার মুখ-চোখের ভাব কঠিন। অথচ ওষ্ঠাধরে হাসি। সে বলল—‘শুনুন মহামান্য বর্ষকার, সাকেতকরা আবার কোশলের প্রজাও তো! তা কোশলরাজ্য তো মহারাজের শ্বশুর-গৃহ। কতদিন যান না। নিমন্ত্রণ করতে এসেছি। সম্মত করাতে পারছি না। দেখুন না একটু বলে কয়ে…’
সে এক পলক বর্ষকারের মুখের দিকে তাকাল। মেঘাচ্ছন্ন সে মুখ। ক্ষণপূর্বের হাসি প্রায় অন্তর্হিত হয়েছে। চণক খানিকটা এগিয়ে গেছেন। তিষ্য দ্রুতপদে গিয়ে তাকে ধরল। চণক তিষ্যর দিকে তাকাল না, অতি মৃদু স্বরে বলল—‘তিষ্য, কাউকে উত্তেজিত করে দিয়ে তার ভেতরের সংবাদ বার করে নেওয়াই কূটনীতিকের একটা কাজ। উত্তেজক উক্তির উত্তর দেবে নির্বোধের হাসি দিয়ে। আগুন নিয়ে খেলা না করাই ভালো।’
মন্ত্রণাগৃহের দ্বারে প্রহরী বিনত নমস্কার করে সরে দাঁড়াল। ভেতরে ঢুকে তিষ্য বলল—কেন জানি না, চণকভদ্র, আত্মসংবরণ করা আমার পক্ষে ক্রমশই কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। যদি আপনার মতো এমন নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারতাম নিজেকে!’ —তার কণ্ঠে হতাশার সুর।
চণক বলল—আত্মসংবরণ করতে পারছো না—এটা সত্য বলেছ তিষ্য কুমার। কিন্তু কেন জানো না, এটা সত্য বলল না। জানো, নিশ্চয় জানো। তিষ্য তুমিই তো বলেছিলে ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখের ঊর্ধ্বে কর্মকে, আদর্শকে স্থান দাও তুমি, বলোনি?
মৃদু কোমল কিন্তু দৃঢ় স্বরে কথাগুলি বলল চণক। কিন্তু উত্তরের জন্য অপেক্ষা করলনা। আর একটি দ্বার এসে গেছে, এটি পার হলেই মহারাজের সঙ্গে দেখা হবে।
এসো, এসো বয়স্য। এসো তিষ্যকুমার। মহারাজের সহাস্য আহ্বান ভেসে এলো। তিনি তাঁর উচ্ছ্বাস ও অভ্যর্থনা ইচ্ছে করেই একটু সশব্দ করেন। যাতে দ্বারে দণ্ডায়মান প্রহরীদের কানে যায়। তাদের কান থেকে হয়ত কৌতূহলী অমাত্যদেরও কানে পৌঁছতে পারে এমন কোনও অনুমানে। দ্বার বন্ধ হয়ে গেলে কক্ষে যখন তিনজনই মাত্র, তখন সহসা মহারাজের মুখ থেকে হাসি অন্তর্হিত হয়। আরম্ভ হয় আলোচনা। প্রধানত মহারাজ ও তিষ্যর মধ্যে। চণক শুধু শ্রোতা। মাঝে মাঝে রাজা বা তিষ্য তার মতামত জানতে চাইলে, বা তার কিছু মনে হলে সে মুখ খোলে। নয়ত সে মস্তিষ্কের একটি অংশ দিয়ে শোনে, আর একটি অংশ দিয়ে রাজশাস্ত্রের কোনও অধ্যায় মনে মনে লেখে, এবং আরও একটি অংশ দিয়ে ভাবে, সোমার সমস্যার কথা। কী সমাধান? জিতসোমার জীবনের জটিল গ্রন্থি সে কী ভাবে মোচন করবে?
প্রকৃতপক্ষে এই আলোচনা মহারাজ এবং তিষ্যরই। এখানে চণকের বিশেষ ভূমিকা থাকার কথা নয়, নেইও। তাকে আসতে হয় তিষ্যকে আড়াল করতে। তিষ্যকুমার যে মহারাজের কোনও গুরুত্বপূর্ণ, গোপন কাজের ভার নিয়ে কোথাও যাচ্ছে, এটা মহারাজ কাউকে জানাতে চান না। সে যাবে না রাজভাণ্ডার থেকে কোনও ধন বা অশ্বাদি কোনও যানবাহন, দাস-রক্ষী ইত্যাদি নিয়ে। মহারাজ তাঁর নিজস্ব সঞ্চয়ের যে ভিন্ন কোষ আছে তার থেকেই তিষ্যর ব্যয়-ভার বহন করবেন। মহারাজের প্রতিনিধিত্ব প্রমাণ করবার জন্য তার কাছে কী কী থাকবে সেই নিয়েই এখন আলোচনা হচ্ছে প্রধানত।
চণক সহসা বলল—‘আচ্ছা মহারাজ, এতো গোপনতার পক্ষপাতী কেন আপনি?’ জিজ্ঞাসা করছে বটে, কিন্তু চণক এখন একটু অন্যমনস্ক।
বিম্বিসার গম্ভীরভাবে বললেন—‘চণক, যুদ্ধের সপক্ষেই এখানে জনমত অধিক। আমার অমাত্যরা, যুবরাজ এমন কি অন্তঃপুরিকারাও বিশাল মগধরাজ্যের স্বপ্ন দেখে।’
চণক দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল—‘আমিও দেখেছিলাম।’
তিনজনেই বহুক্ষণ নীরব রইলেন। কারণ চণকের এই উক্তি তিনজনের চিত্তে তিনপ্রকার চিন্তা ও দিবাস্বপ্ন জাগিয়ে দিয়েছে। চণক দেখছে এক মহাসমুদ্রের মতো চতুরঙ্গ সৈন্যদল, তার ওপরে জেগে আছে মগধের মুদ্রা অঙ্কিত পতাকাগুলি। এই সৈন্যদলের মধ্যে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে শ্বেতকায়, তাম্রকায়, কৃষ্ণকায় বহু প্রকার সৈনিক এবং সেনাধ্যক্ষ। বাইরের বর্ণ ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে তাদের সবার চিত্ত এক। প্রত্যেকে ভাবছে আমি জম্বুদ্বীপবাসী। মহারাজ বিম্বিসার, সর্বগুণান্বিত, মহাবীর, লোকপাল বিম্বিসার আমাদের সর্বসম্মত রাজা এবং নেতা। এই মহাসমুদ্রের ও দিকে আছে আরও এক সমুদ্র। উপরিশ্যেন পর্বতের ওপার থেকে আসা বিদেশীরা। তাদের নেতা মহাবীর কুরুস। দুই সমুদ্র উত্তাল হয়ে উঠল। কিন্তু ক্রমশ কুরুস সমুদ্র পেছিয়ে যাচ্ছে পেছিয়ে যাচ্ছে। তার তরঙ্গগুলি ক্রমশই সংখ্যায় অল্প হয়ে যাচ্ছে। ভেঙে যাচ্ছে। জম্বু জলধি উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অবধি বিস্তৃত হয়ে গেছে। সেই ভীষণ, ভয়ঙ্কর, সগর্জন আকৃতি আর নেই, এমন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভরঙ্গভঙ্গে লীলা চপল সে জলধি। শান্তিঃ, শান্তিঃ শান্তিঃ। …
তিষ্য দেখছিল দুটি রুক্ষ শিলাসন। কৃষ্ণশিলা পাথরের অস্ত্র দিয়ে কেটে কেটে প্রস্তুত হয়েছে এই রাজাসন দুটি। ঘন অরণ্যের মধ্যে গুহাকৃতি একটি স্থান পরিষ্কৃত হয়েছে। পেশল বক্ষ, বিপুলকায় কালো মানুষেরা অরণ্যের বিভিন্ন অঞ্চল বৃক্ষ কেটে পরিষ্কার করে ফেলছে। সমান করে ফেলছে ভূমি। ‘মহারাজ ওইখানে কী হবে?’
—‘বস্ত্রবয়নশালা প্রজাগণ, তোমরা আর কতকাল নগ্ন, অর্ধনগ্ন থাকবে?’
—‘ওখানে কী হবে মহারাজ?’
—‘রথ নির্মাণের জন্য কর্মান্ত। দূর দূর অঞ্চলে যেতে হবে, রথ, রথচক্র এবং রথ্যা নির্মাণ না করতে পারলে এই মহা পৃথিবী যে তোমাদের আয়ত্তের বাইরেই থেকে যাবে!’
‘আর ওখানে? ওখানে কী নির্মাণ করব মহারাজ?
—অস্ত্র ও যন্ত্র নির্মাণ করবে, পাথরের এই ভল্ল এই ছুরিকায় কিছুই হবে না, এই বল্লমের মতো যন্ত্র দিয়েই বা তোমরা কতটুকু ভূমি কর্ষণ করতে পারবে?’
‘ওই বিশাল স্থানটি কী মহারাজ?’
—ওখানে গণ পাকশালা প্রস্তুত হবে। তোমরা অগ্নিপক্ক করে কী ভাবে মাংস মৎস্য খেতে হয় শিখবে। তোমাদের নারীদের ওখানে যেতে হবে, মহারানী এই বিভাগের ভার নিয়েছেন। তিনি তোমাদের রমণীদের শেখাবেন কী ভাবে কর্ষিত ভূমি থেকে উৎপন্ন শস্য সিদ্ধ করতে হয়, কী ভাবে তা চূর্ণ করতে হয়। আর কতকাল তোমরা বন্যফলের মুখাপেক্ষী, মৃগয়ার মুখাপেক্ষী হয়ে থাকবে প্রজাগণ? আর কতকালই বা অপক্ক মাংস খাবে পশুর মতো?… মহারানি…’
পাশে বসা নারীমূর্তিটি মুখ ফেরাল। তিষ্যর অন্তরাত্মা চিৎকার করে উঠল। নারীবেশধারী একটি শূন্যতা বসে রয়েছে তার পাশে। কোনও অবয়ব নেই, মুখমণ্ডলের স্থানে ঘোর অন্ধকার। শূন্য, শূন্য, শূন্য সব…।’
বিম্বিসার দেখছিলেন এক অষ্টাদশবর্ষীয় তরুণ যুবক উপবিষ্ট রয়েছে সামনে এক জ্যোতিঃপুঞ্জের মতো আকৃতির ব্রাহ্মণ। বর্ষীয়ান, কিন্তু উন্নতদেহ। উন্নতশির, বাইরেটা যেন প্রজ্জ্বলন্ত উল্কা। ভেতরটা স্নিগ্ধ যেন চন্দনতরু। পাঠ শেষে তরুণ প্রণাম করছে, ঋষিপ্রতিম আচার্য উঠে দাঁড়াচ্ছেন সামনে প্রসারিত করে দিয়েছেন হাত, করতল দিয়ে স্পর্শ করছেন তরুণের শির—তুমি রাজ চক্রবর্তী হবে বিম্বিসার।’
—‘সত্য? সত্য বলছেন আচার্য?’ তরুণের পিতা ব্যগ্রস্বরে জিজ্ঞাসা করছেন। —‘সত্য? না আশীবাদ?’
—দেবরাতের আশীর্বাদে আর সত্যে কোনও পার্থক্য থাকে না ভদ্র ক্ষেত্রৌজা।
বিম্বিসারের সামনে এ দৃশ্যের পাত্র পরিবর্তিত হয়ে গেল। সামনে এক স্নিগ্ধ চন্দনতরু, ভেতরে প্রজ্বলন্ত উল্কাই বুঝি। করুণার সমুদ্র নয়ন দুটি। কিন্তু স্বর জলদ্গম্ভীর।
—জন্ম থেকে শত শত বন্ধনে বন্দী মানুষ। শত নিষেধাজ্ঞা পদে পদে। একমাত্র প্রব্রজ্যায় নিষেধ নেই। প্রব্রজ্যার পথ বন্ধ করে দেওয়া অমানবিক নিষ্ঠুরতা।
বিম্বিসার নিজেকে বলতে শুনলেন কিন্তু তা হলে এই জগৎসংসার, এই রাজ্য, এই জনযাত্রা চলবে কী করে দেব? কী ভাবে চালাব? একদিনেই তো সমগ্র পৃথিবী ভবচক্র থেকে মুক্ত হয়ে যাবে না? প্রব্রজিত ভিক্ষুদের পিণ্ডদানের জন্যও তো সমাজ চাই? কে ধারণ করবে সেই সমাজ?—এতো কথা তিনি বলেননি। তথাগতর ভাষাও সামান্য ভিন্ন ছিল। কিন্তু তবু এ সবই তাঁরা উভয়েই বলেছিলেন, একে অপরের ভাষ্য পরিপূর্ণ বুঝতে পেরেছিলেন। নীরব সব। নিস্তব্ধ। অনেকক্ষণ। তারপর সেই ব্ৰহ্মঘোষ :
…তাই হবে। সৈনিকদের থেকে প্রব্রজ্যার অনুমতি প্রত্যাহার করে নেওয়া হল।
তথাগতর কণ্ঠে এখন জল। অতল ওই চোখদুটিতেও কি বাষ্প? বিম্বিসার তথাগতকে দুঃখ দিয়েছেন। রাজার কাজই হল দুঃখ দেওয়া। দুঃখ দেওয়া, দুঃখ পাওয়া, দুঃখ পাওয়া…
দুঃখ-শূন্যতা-বিজয়ের গরিমা ও শান্তি, শূন্যতা শান্তি-দুঃখ, শান্তি-দুঃখ-শূন্যতা তিনটি চক্রের মতো ঘুরে যাচ্ছে তীব্র বেগে। একে অপরকে স্পর্শ করছে আবার দূরে চলে যাচ্ছে।
হঠাৎ বিম্বিসারের মনে পড়ল কিছু। তিনি বললেন—সখা চণক, কোথাও কি কিছু হারিয়েছ?
—কই না তো মহারাজ!
—ভেবে বলো!
—ভেবে পাচ্ছি না তো!
বিম্বিসার তাঁর পাশে রাখা স্থবিকাটি খুলে, ধীরভাবে একটি বস্তু বার করে আনলেন, ডান হাত দিয়ে খানিকটা তুলে ধরে বললেন—চিনতে পারো?
একটি সুবর্ণমণ্ডিত কঙ্কতিকা, মধ্যে মধ্যে রক্তাভ মুক্তা। কালো দাঁতগুলি কঙ্কতিকার। সব মিলিয়ে ঝকঝক করে উঠল কক্ষ। কঙ্কতিকার মধ্যে লিখিত কাত্যায়ন চণক।
চণকের দুরযাত্রী চিত্ত যেন এক লক্ষে বিশ যোজন পেরিয়ে এলো। দুই চোখে ব্যগ্র বিস্ময়।
—এ কঙ্কতিকা কোথায় পেলেন মহারাজ? কোথায়?
মৃদু মৃদু হাসছেন বিম্বিসার—‘তবে যে বলছিলে হারাওনি কিছু! দৈবরাত চণক যে স্বর্ণ-মুক্তার কাঙাল নয়, তা সবাই জানে। এই কঙ্কতিকা কোন প্রিয় উপহার? কোন সুপ্রিয় অভিজ্ঞান? বলবে আমায় সখা চণক?
—বলছি। কোথায় পেয়েছেন, কী ভাবে পেলেন শীঘ্র বলুন মহারাজ।
—একটি চোরের কাছ থেকে। শুধু চোর নয়, একটি চোরও নয়। দুটি চোর। চৌর এবং চৌরী। চৌরীটি তার কেশে পরেছিল এই কঙ্কতিকা। রাজভটদের সন্দেহ হয়, বন্য যক্ষীর মাথায় সুবর্ণ কঙ্কতিকা? ধরে স্থানীয় বোহারিকের কাছে নিয়ে যায়।
চণক উঠে দাঁড়িয়েছে—তারপর? মহারাজ তারপর?
—তারপর আর কী? কঙ্কতিকায় কাত্যায়ন চণকের নাম দেখে বোহারিক একেবারে আমার কাছে সোজা পাঠিয়ে দিলেন দ্রব্যটি।
—‘আর সেই যক্ষ-যক্ষী?’
‘চোরের শাস্তি পেয়েছে। আবার কী? চোরটির হয়ত দক্ষিণ হস্ত ছিন্ন করবার আদেশ হয়েছে। চৌরীটির…
জ্যা-মুক্ত শরের মতো দৈবরাত চণক ছুটে বেরিয়ে গেল।
মহারাজ হতবুদ্ধি হয়ে বললেন—‘কোথায় যাও?’
তিষ্যকুমার হতবুদ্ধি হয়ে বলল—‘কী হল? কী হল?’
তোরণের পর তোরণ পার হচ্ছে, শিথিলভঙ্গি দ্বারীরা ছুটন্ত পুরুষমুর্তি দেখে বিস্মিত সতর্ক হয়ে উঠে দাঁড়াচ্ছে..এ ওকে বলছে—রাজমিত্ত মহামান্য চণক না?
—উনি তো মহারাজের আচারিয় পুত্ত, এই তো কিছুক্ষণ আগে…
নিজের অশ্বও ছেড়ে, কোনদিকে না তাকিয়ে উন্মত্তের মতো ছুটে যাচ্ছিল চণক। চিত্তক তীব্র স্বরে হ্রেষা করে উঠল। চণক দৌড়ে গিয়ে এক লাফে উঠল তার পিঠে। —‘চল চিত্তক, চল—উত্তর তোরণ। আমক শ্মশান’—যেন চিত্তক তার ভাষা বুঝবে। উল্কাবেগে ছুটে চলেছে চণক। রাজপথে পদযাত্রীরা ছুটে সরে যাচ্ছে। রথগুলি কোনওমতো পাশ দিচ্ছে। পথকুকুরগুলি চিৎকার করে দৌড়চ্ছে। একটি মার্জার বোধহয় চিত্তকের পায়ের এক আঘাতে দূর ছিটকে পড়ল। পিষ্ট হয়ে গেল একটি কুক্কুরশাবক।
—আরও জোরে চিত্তক আরো জোরে..চণক সামনে ঝুঁকে পড়েছে।
হতবুদ্ধি মহারাজ বললেন—গুরুতর কিছু হয়েছে, তিষ্যকুমার শীঘ্র চলো। দ্বারী! আমার অশ্ব প্রস্তুত করতে বলো। যতো তাড়াতাড়ি পারো।
দিবসের তৃতীয় যামেই যেন অমানিশার ঘোর তমিস্রা নেমেছে। চণক পথ দেখতে পাচ্ছে না। শুধু দিক। উত্তর। উত্তর প্রান্ত। দু পাশ দিয়ে ছুটে পেছনে সরে যাচ্ছে বৈপুল্ল, বৈভার। গিরিগুলিও বুঝি দৌড়চ্ছে। তাদের এতদিনের স্বভাব, স্থাবরতা ত্যাগ করে কোন মহা উদ্বেগে মহা আশঙ্কায় দৌড়চ্ছে। দৌড়চ্ছে বৃক্ষগুলি। জনবহুল রাজমার্গ? তা-ও দৌড়চ্ছে।
অবশেষে আমক-শ্মশান। ঘন বৃক্ষ দিয়ে ঘেরা রাজগৃহের বধ্যভূমি। এখানে অপরাধীদের হস্ত পদ ছেদন করা হয়। পাশবিক চিৎকার করতে করতে শূলদণ্ডে বিদ্ধ হয় মানুষ। যূপবদ্ধ মস্তকের ওপর নেমে আসে ভয়ানক খড়্গ। রক্ত ছিটকে যায়, মুণ্ড ছিটকে যায়। ছুটে আসে রক্ত পিপাসু তরক্ষু, শৃগাল। ওপর থেকে ঝুপ ঝুপ করে নামে গৃঘ্রদল। গলা অবধি প্রোথিত জীবিত মুণ্ডের দিকে ধেয়ে যায় দুঃস্বপ্নের বিভীষিকার মতো পশুপাখিগুলি। কেউ চোখ খুবলে নেয়, কেউ এ কান, কেউ ও কান। জীবিত মুণ্ড শুধু মরণান্তিক আতঙ্কে, যন্ত্রণায় চিৎকার করতে থাকে। তরঙ্গুর হাসির শব্দে ডুবে যায় তার ত্রাসস্তিমিত স্বর। তারপর পা দিয়ে মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে অর্ধজীবিত দেহটিকে বার করে পশুরা। একটি মনুষ্যশরীর চেতনার শেষবিন্দু পর্যন্ত ছিন্নভিন্ন হতে থাকে। চোর, দস্যু, ভ্রূণঘাতক, হত্যাকারী, ব্যভিচারিণী, বৈদেশিক চর, রাজদ্রোহী—সবারই অম্লাধিক এই জাতীয় দণ্ড। তবে অপরাধী সহজে মেলে না। সবাই জানে অপরাধের এই ভয়াবহ পরিণাম। নগরীতে এই আমক শ্মশান প্রত্যক্ষ। নগরবাসীর অস্তিত্বের মধ্যে বিদ্ধ এক আতঙ্কবিন্দু। কিন্তু, নগরী থেকে যতই দূরে যাওয়া যাবে ততই এ স্মৃতি ক্ষীণ, ক্ষীণতর। জানা আছে কিন্তু সে এক অপ্রত্যক্ষ নৈর্ব্যক্তিক তথ্য। আছে। রাজগৃহের উত্তর তোরণের বাইরে একটি আমক শ্মশান আছে। এই পর্যন্ত। তাই নগরীর বাইরে বিস্তীর্ণ গ্রামাঞ্চলে, বিভিন্ন রাজ্যের মধ্য দিয়ে চলাচলের সুদীর্ঘ পথগুলিতে, নদীগুলিতে চৌর্য আছে, দস্যুবৃত্তি আছে, ব্যভিচারও আছে। ঘাতকের দিনগুলি সবই বিফল যায় না।
চিত্তক তার আরোহীসমেত শরের মতো নিক্ষিপ্ত হল এই বধ্যভূমিতে। তখন একটি কৃষ্ণাঙ্গ তরুণের দ্বিতীয় হস্তটিও ছিটকে পড়ছে রক্তে ভেজা মাটির ওপর। পার্বত্য ঝর্ণার মতো গরম রক্ত উঠছে। রক্তকরবীর মালা পরা প্রকাণ্ড মূর্তিটি পিশাচের মতো হাসছে। —‘শাস্তি দিয়েছি, রাক্ষসকে শাস্তি দিয়েছি। রাক্ষসীকে শাস্তি দিয়েছি। এক জোড়াকে পারিনি। আরেক জোড়াকে পেরেছি। চণক লাফিয়ে নেমে খড়্গসমেত সেই ভীষণ হাত ধরল।
—থামো ঘাতক, থামো।
—থেমেছি তো। যে পর্যন্ত শাস্তি আদেশ ছিল, দিয়েছি। তারপর থেমেছি।
—উদ্দক। উদ্দক! চণক ডাকল
—দুই কাঁধ থেকে স্রোতের মতো রক্তপাত হচ্ছে। কৃষ্ণাঙ্গ তরুণটি লুটিয়ে পড়েছে। তার চোখ খোলা, কিন্তু তাতে কোনও দৃষ্টি নেই।
চণক নিজের উত্তরীয় ছিড়ে প্রাণপণে স্রোতের মুখ বাঁধতে বাঁধতে বলল—ঘাতক বৈদ্য ডাকো, বৈদ্য আনো। শীঘ্র, বিলম্ব করো না। একটি বালিকা ছিল, বালিকা…তাকে কোথায় রেখেছো?
ঘাতক রক্ত চক্ষে চেয়ে বলল—সে-ই তো প্রকৃত অপরাধিনী। তার নাক-কান কেটে ফেলে দিয়েছি।
—বলছো কী? চণক বাতাসের অভ্যন্তর চিরে আর্তনাদ করে উঠল। কোথায় সে? কোথায়? আঙুল দিয়ে দেখালো ঘাতক—ওই তো, ওই দিকে দেখতে পাচ্ছেন না?
দু-তিনটি শবদেহের ওপর থেকে কৃষ্ণবর্ণ একটি হাত এলিয়ে পড়ে আছে।
বিম্বিসার যখন তিষ্যকুমার এবং আরও রক্ষীদের নিয়ে বধ্যভূমিতে পৌঁছলেন তখন কৃষ্ণকায় সেই তরুণীর কর্ণ-নাসিকাহীন শির কোলে নিয়ে চণক উন্মাদের মতো হাহাকার করছে—রগ্গা, রগ্গা, রগ্গা…।
বিম্বিসার পেছন ফিরে রক্ষীদের আদেশ করলেন—জীবক বৈদ্য এবং বৈদ্য সন্নতিকে নিয়ে এসো। অবিলম্বে। বলবে রাজাদেশ। মুহূর্তকালও যেন বিলম্ব না হয়।
আরও কয়েকজন রক্ষীর দিকে ফিরে বললেন—শীতল জল আনো, পরিষ্কার বস্ত্রখণ্ড। শীঘ্র যাও।
চণকের পাশে নতজানু হয়ে বসে পড়েছেন বিম্বিসার। ভুলে গেছেন তিনি রাজা। চতুর্দিকে তাঁর ভূতিভোগী রক্ষী, প্রহরী, ঘাতক দল। তাদের সামনে তিনি এক মাত্র বুদ্ধ তথাগত ছাড়া আর কারো কাছে নত হন না। এমনকি যখন অজিত বা নির্গ্রন্থ নাতপুত্ৰ কিম্বা সঞ্জয়ের কাছেও যান সমবেত শিষ্যমণ্ডলী, শ্রোতামণ্ডলী উঠে দাঁড়ায়। উচ্চাসনে বসে থাকেন সঞ্জয় বা নাতপুত্র, কিম্বা অজিত তাঁরাও তাঁকে আশীবাদের ছলে উঠে দাঁড়ান। তিনি উপবিষ্ট হলে, তবে সবাই আবার বসেন। একমাত্র ব্যতিক্রম বুদ্ধ তথাগত। আর ব্যতিক্রম ঘটল আজ। আত্মবিস্মৃত রাজা নিজের দণ্ডমুকুটধারী ভাবমূর্তির কথা সম্পূর্ণ ভুলে গিয়ে মাটিতে জানু ঠেকিয়ে বসে বললেন—চণক, চণক, কী হয়েছে বন্ধু? কী হল?
নিজের হাত দিয়ে তরুণীর রক্তাক্ত নাসাস্থল আবৃত করে চণক বলল— অপরাধী নয়, নয়, এই বন্য তরুণ-তরুণী, রাজা এরা দিনের পর দিন আমায় আতিথ্য দিয়েছে সখ্য দিয়েছে, রক্ষা দিয়েছে, উজ্জীবন দিয়েছে, আর আমি এই সামান্য কঙ্কতিকা উপহারের ছলে আজ তাদের এই দিলাম। এই দিলাম মহারাজ এই দিলাম। ধিক সভ্যতা, ধিক আর্যতা, ধিক রাজশাস্ত্র। ধিক, ধিক, ধিক…
সমগ্র বধ্যভূমি, রাজভূমি, ভারতভূমি সাগরমেখলা আকাশমৌলি ধরাভূমি সেই ধিক্কারে থরথর করে কাঁপতে লাগল।
৩২
বোহারিক বললেন—অনঙ্গ চণ্ডাল ধরে এনেছিল। মাথার চুলে সুবন্ন কঙ্কতিকা দিয়ে সাজ-সজ্জা করে ওই বন্যতরুণী তরুণের হাত ধরে রাজগহ নগর দেখতে এসেছিল।
বিম্বিসার বললেন—আপনি তাকে জিজ্ঞাসা করেননি, সে কোথায় এ কঙ্কতিকা পেল?
—জিজ্ঞাসা করেছিলাম। বললে এক যতি দিয়েছে। এরা সর্বশ্রেণীর সন্ন্যাসীকে যতি, জটি এই সব বলে, জানেন তো?
—ভালো কথা, সে তো আত্মপক্ষে কিছু বলেছিল। মানলেন না কেন?
মহারাজের মুখ দেখে বোহারিকের তালু শুকিয়ে গেল। তিনি বললেন—কঙ্কতিকায় মহামান্য কাত্যায়ন চণকের নাম তক্ষিত রয়েছে দেখলাম। জিজ্ঞাসা করলাম চণককে চেনে কি না। বলল—না, চেনে না। এখন দেখুন মহারাজ, একে বন্য, তারপর সুবন্নের দ্রব্য, এ দিকে বলছে যতি দিয়েছে। কী অসম্ভব কথা! সন্ন্যাসী কখনও কাউকে কিছু দেয় উপদেশ ছাড়া? যদি বা দেয় সুবন্ন দেবে? তারপর মহামান্য চণকের নামাঙ্কিত দ্রব্য। চণককে তারা চেনে না। আমি…
—আপনার একবারও মনে হল না তরুণ-তরুণী দুটির চুরির দ্রব্য অমন সর্বজনের দেখার জন্য প্রকাশ্যে পরে ঘুরে বেড়ানো অস্বাভাবিক। চোর তো চোরাই দ্রব্য গোপনই করে!
—না। উপহার অথচ উপহর্তাকে চেনে না…।
—এ-ও তো আপনার মনে হতে পারত যে কঙ্কতিকাটি হয়তো হারিয়ে গিয়ে থাকবে, সত্যই কোনও সন্ন্যাসী বা সন্ন্যাসীবেশধারী কুড়িয়ে পেয়ে তরুণীটিকে উপহার দিয়েছেন সেটি!
—মহারাজ, অপরাধ মার্জনা করবেন, প্রণয়ীরা তরুণীদের কঙ্কতিকা উপহার দিতে পারে, সন্ন্যাসীরা নয়। বন্যদের কথাবার্তা আচরণ এতোই অসঙ্গতিপূর্ণ যে…
সে কথাই বলছি বোহারিক মহোদয়, এতোই অসঙ্গতি যখন ছিল ঘটনাটিতে এবং কাত্যায়ন চণকের নামাঙ্কিত ছিল যখন দ্রব্যটি, তখন আপনি চণকভদ্রকে ডাকলেই তো পারতেন। তিনি কী উত্তর দেন, জানা আপনার প্রয়োজন ছিল না?
—মহারাজ ক্ষমা করবেন, অনঙ্গ তার দলবল নিয়ে বন্য দুটিকে বেঁধে এনেছিল। ভীষণ স্বরে বলছিল, যক্ষরা শিশুহত্যা করেছে। যক্ষরা চুরি করেছে, তাদের দণ্ড দিন। দণ্ড দাবি করছি। বোহারিক। দণ্ড না দিলে এ বার গোটা রাজগহ আমক-শ্মশান করে দিয়ে চলে যাবো। কোনও শব আর দাহ হবে না।
—ও, তাহলে অনঙ্গ চণ্ডালই বোহারিক ছিল। আপনি ছিলেন না!
—না, অর্থাৎ, সময় দিতে চাইছিল না, ঘিরে রেখেছিল বিনিশ্চয়াগার…
—ও তাহলে আপনি চণ্ডালদের ভয়ে অন্যায় হচ্ছে জেনেশুনেও অমন দণ্ড দিলেন…
—না, মহারাজ, আমার প্রত্যয় হয়েছিল বন্যরা মিথ্যা বলছে…
—আপনি বোহারিক পদের সম্পূর্ণ অযোগ্য। আসন ত্যাগ করুন। আর কোনওদিন মগধের সীমানার মধ্যে বোহারিকের কাজ করবেন না। চলে যান। এই মুহূর্তে।
—কে অনঙ্গ চণ্ডাল? কে?
রক্তকরবীর মালা পরা রক্তবসনধারী বিশালকায় অনঙ্গকে কারা পেছন থেকে ঠেলে সামনে এগিয়ে দিল। —এ, মহারাজ, এই অনঙ্গ চণ্ডাল।
—তুমি দলবল নিয়ে বোহারিকের কাজে বাধা সৃষ্টি করেছিলে?
—দলবল ছিল। বাধা তো কিছু দিইনি! উদ্ধত উত্তর।
—বন্যরা চুরি করেছিল কি না তা তো স্পষ্ট প্রমাণ হয়নি অনঙ্গ? তার আগেই তুমি দণ্ড দাবি করোনি?
—স্পষ্ট প্রমাণ হলেও তো এ রাজ্যে অপরাধীর দণ্ড হয় না মহারাজা। আমাদের বচ্চগুলিকে খেয়ে যক্ষিণী তো দিব্যি রয়েছে। সুগন্ধি যাউ খাচ্ছে নাকি আজকাল।
—তাই তুমি অন্য এক যক্ষিণীর ওপর প্রতিশোধ নিলে?
অনঙ্গ আগুন-ঝরা চোখে চেয়ে চিৎকার করে বলল—হত্যকারীর দণ্ড যে বন্ধ করেছে সেই সমন বুদ্ধকে আগে দণ্ড দাও রাজা, এই বচ্চহারা দলিদ্দদের বঞ্চনা করে সগ্গলাভের কথা শুনিয়েছে যে, সেই সমন মোগগল্লানকে আগে দণ্ড দাও রাজা, দণ্ড দাও, দণ্ড দাও।
সে তার দু হাতের শৃঙ্খল বিনিশ্চয়াগারের পাথরের স্তম্ভে ঠুকতে লাগল।
পেছনে অন্য চণ্ডালগুলি। হাত জোড় করে বলল—অনঙ্গ উন্মাদ হয়ে গেছে, মহারাজ, বচ্চ হারিয়ে একেবারে উন্মাদ হয়ে গেছে। মাজ্জনা চাইছি। মাজ্জনা করুন।
—উন্মাদের স্থান লোকালয়ে নয়। প্রহরী এই উন্মাদকে কারারুদ্ধ করো।
বিনিশ্চয়াগার থেকে ক্লান্ত পদে, ক্লান্ত মনে বেরিয়ে এলেন বিম্বিসার। রথে উঠলেন। রথ ছুটল। অবসন্ন রাজা অঙ্গ শিথিল করে, চোখ বুজলেন। বড় ক্লান্তি, মহা ক্লান্তি, এত ক্লান্তি কেন?
—রক্তপাত নয়। এই বন্যরা রক্তপাতে কাবু হয় না। এদের শরীর অতি কঠিন ধাতু দিয়ে নির্মিত।
—তা হলে? তাহলে তরুণটিকে বাঁচানো গেল না কেন আয়ুষ্মান জীবক? তুমি কী মনে করো?
—মান্যবর সন্নতি, আমার ধারণা তরুণটির চিত্তে একটা দারুণ আঘাত লেগেছিল। তার থেকেই হৃৎপিণ্ড বিকল হয়ে গেল। অপ্রত্যাশিত একটা আঘাত।
—চিত্তে আঘাত? শরীরের আঘাতের চেয়েও বড়?
—তাই তো মনে হচ্ছে।
বৈদ্য সন্নতির বয়স হয়েছে। কেশে ভালোই পাক ধরেছে। চিকিৎসা করে করে তাঁর হাত মন-মস্তিষ্ক সবই যেন যন্ত্রের মতো সূক্ষ্ম হয়ে গেছে। এখন এসেছে এই তরুণ যুবা জীবক! তাঁর মুখে বক্র হাসি খেলে গেল। চিত্ত! হুঁঃ! চিত্ত! রক্তপাতটা কিছু না। কিছুই না।
দেখুন মহামান্য সন্নতি মনে কিছু করবেন না, চোরেদের হস্তচ্ছেদ তো হয়েই থাকে। কেউ মারা গিয়েছে বলে শুনেছেন কী? জীবকের মুখ গম্ভীর। চোখে সামান্য কৌতুকের ঝিলিক। সে বৈদ্য সন্নতির বাঁকা হাসি লক্ষ করেছে।
সন্নতি বললেন—কিন্তু আয়ুষ্মান জীবক, সাধারণত চোরেদের দক্ষিণ হস্ত ছেদন করা হয়, তা-ও কনুই থেকে। এ ব্যক্তির দুই হাতই কেটে ফেলা হয়েছে, একে বারে বাহুমূল থেকে। ক্ষত আরও ভয়াবহ। রক্তপাতও পরিমাণে অনেক।
—কিন্তু মহারাজের আচার্যপুত্ৰ চণক তত প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সে রক্তপাত বন্ধ করবার চেষ্টা করেছিলেন! রোগী তো ঔষধপ্রয়োগের সময় দিল না। একটি বন্য যুবার শরীরের শক্তি, সহন ক্ষমতা এ গুলি তো সভ্য মানুষের থেকেও অধিক হবার কথা মহামান্য সন্নতি! এ তো হস্তচ্ছেদ নয়, যেন শিরচ্ছেদ। ওর প্রাণ কি ওই হস্তদ্বয়েই ছিল?
—পরিহাস করছো জীবক? মহামান্য সন্নতির মুখ গম্ভীর।
জীবক বলল—কী বলছেন আপনি মান্যবর? পরিহাস করবো? আয়ুর্বেদের নূতন দিক উন্মোচিত হতে যাচ্ছে আর আপনি বলছেন পরিহাস?
—কী বলতে চাইছো, পরিষ্কার করে বলো। আমি কিছুদিন হল কানে ভালো শুনি না।
জীবক মনে মনে বলল—একটু চিৎকার করে বললেই আপনার কানে কথাগুলি ঠিকই পৌঁছে যাবে। কিন্তু মনে পৌঁছবে কী? মনকে যে দ্বাররুদ্ধ কক্ষের মতো করে রেখে দিয়েছেন!
মুখে বলল—প্রাণ কোথায় থাকে কেউ জানে না, মহাবেজ্জ। ত্রিদোষ বিকারের ফলে দেহস্থ প্রধান প্রধান যন্ত্রের একটি যখন বিকল হয়ে যায়, তখন প্রাণ বেরিয়ে যায়। প্রধান প্রধান অঙ্গ ছেদন করলেও যায়। কিন্তু অন্যথায় যাবার কথা নয়। আমার বক্তব্য হচ্ছে—আকস্মিক আঘাত—শুধু শরীরে নয়, মনে, হৃদয়ে, মৃত্যুর কারণ হতে পারে। এই যে বন্য যুবা তার প্রণয়িণীকে নিয়ে নগর দেখতে এসেছিল, তাদের হৃদয় ছিল আনন্দে পরিপূর্ণ। শঙ্কার লেশমাত্র তাতে ছিল না। কঙ্কতিকাটি তারা এমন কারও কাছ থেকে পেয়েছিল যাকে উভয়েই সম্পূর্ণ বিশ্বাস করে, ভালোবাসে। ওই কঙ্কতিকার জন্য যে তাদের শাস্তি পেতে হতে পারে, তা তারা কল্পনাও করেনি। এই আকস্মিক মানসিক আঘাত এদের মৃত্যুর প্রধান কারণ।
সন্নতি বললেন—এদের মৃত্যুর? উভয়ের কথা বলছো নাকি?
জীবক ভাবিত স্বরে বলল—বললাম, বলে ফেললাম।
সন্নতি উৎকণ্ঠিত হয়ে বললেন— চলো আয়ুষ্মান, বালিকাটিকে আরেকবার দেখে আসি।
জম্বুবনের মধ্যস্থিত গান্ধারভবন নামে কাঠের অনুপম প্রাসাদটিতে শোকময় স্তব্ধতা। প্রধান শয্যাগৃহ এখানে চারটি। জিতসোমা ও চণকের ছাড়াও দুটি স্বতন্ত্র শয্যাগৃহ আছে। জিতসোমার কক্ষটি অন্তঃপুর ঘেঁষে। বাকি তিনটি আসনশালার কাছেই। জিতসোমা সেদিন আপনকক্ষে ব্যস্ত ছিল লিখতে। তক্ষশিলার অনেক আচার্য ও ছাত্ররা মনন-প্রয়োগে অত্যন্ত কুশলী হয়। একই সঙ্গে তিন চার পাঁচ প্রকার ভাবনা চিন্তা করা তাদের কাছে কিছুই না। এইভাবে শতাবধান ব্যক্তি অর্থাৎ একই সঙ্গে একশ দিকে মন প্রয়োগ করতে পারেন এমন পণ্ডিতও সেখানে বিরল নয়। কিন্তু জিতসোমার একটিই মন, তার প্রয়োগও এক কালে দুই প্রকার হয় না। সে অনন্যমনে লিখছিল। সে শুধু অনুলিপিকার নয়। প্রকৃতপক্ষে জিতসোমা রাজশাস্ত্র পড়তে পড়তে এমনই মগ্ন হয়ে গেছে যে, তার নিজের চিন্তা, নিজের ধারণাও এই তথাকথিত অনুলিপির মধ্যে প্রবেশ করছে। সে এ কথা এখনও চণককে বলেনি। বলবে কিনা ভাবছে। চণক হয়ত তার ভাবনাগুলিকে যথাযথ মূল্যই দেবেন। কিন্তু স্বতন্ত্র করে লিখতে বলবেন, যা জিতসোমার মনোমত নয়। এই সময়ে অশ্বক্ষুরের শব্দ। যেন বহুজন একসঙ্গে তার গৃহের দিকে ধাবিত হচ্ছে। মানুষের মুখের শব্দ নেই। খালি রথের ঘর্ঘর, অশ্বের মৃদু হ্রেষা, কিন্তু এত অশ্ব রথ ও মানুষ যে, গৃহটি যেন কাঁপছে। জিতসোমা ছুটে বেরিয়ে এলো। দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়েছে সে, দীর্ঘ কেশ লুটোচ্ছে, উত্তরীয়টি যেমন তেমনভাবে গায়ে জড়ানো। সে দেখল রাজরথ আসছে। দুদিক থেকে দুটি ঘোড়ার পিঠ থেকে লাফিয়ে নামল তিষ্যকুমার ও জীবকভদ্র। জীবকভদ্রকে সে রাজান্তঃপুরে কয়েকবারই দেখেছে। চিনতে পারল। রথ থেকে সাবধানে নেমে এলেন আর্য চণক। তার প্রসারিত দু হাতের ওপর একটি নিস্পন্দ কৃষ্ণাঙ্গ নারীশরীর। একপ্রকার নগ্নই বলতে গেলে। কটিবস্ত্রটি ছিন্নভিন্ন। প্রথমেই সোমা দেখল দুটি সুবর্তুল কৃষ্ণোজ্জ্বল স্তন, কঠিন শিলানির্মিত মনে হয়। আকাশের দিকে তাদের বৃন্ত উঁচিয়ে রয়েছে। তারপর চোখ পড়ল মুখের ওপর। রক্তের দাগ, নানাভাবে পট্টিকা লাগানো। চণক তরুণীটিকে বয়ে আনছেন অতি সাবধানে, তার চোখ মুখের ভাব কেমন অদ্ভুত! যেন তিনি কাউকে চিনতে পারছেন না। যেন তিনি এ জগতে নেই।
তাঁকে পথ করে দেবার জন্য জিতসোমা চকিতে সরে গেল, চণক প্রবেশ করলেন তার আপন শয্যাগৃহে। পেছন-পেছন আসছেন মহারাজ বিম্বিসার, বৈদ্য সন্নতি। রাজরক্ষীরা বাইরে দাঁড়িয়ে রইল। চণক নিজের মৃগচর্ম আচ্ছাদিত শয্যায় শুইয়ে দিলেন তরুণীটিকে। একটু সরে দাঁড়ালেন, জীবকভদ্রর দিকে চাইলেন, জীবকভদ্র ও বৈদ্য সন্নতি দুদিক থেকে এগিয়ে এসে মেয়েটিকে পরীক্ষা করতে লাগলেন। চণক মাথার কাছে স্তব্ধ দাঁড়িয়ে। একেবারে স্তব্ধ।
জিতসোমা কিছুই বুঝতে পারছিল না। এ কে? একে তাদের গৃহেই বা আনা হল কেন? চণকের এরূপ অবস্থাই বা কেন? তরুণীটি কি তাঁর প্রণয়িনী! কে একে এভাবে আঘাত করলে? এমন গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে ব্যাপারটিকে যে স্বয়ং মহারাজ বিম্বিসার এসেছেন!
এই সময়ে জীবক বলে উঠলেন— জল, গরম জল।
সোমা তাড়াতাড়ি ঘরের দ্বারের কাছে দাড়ানো এক দাসীকে গিয়ে নির্দেশ দিল। সন্নতি এতক্ষণ তরুণীটির নাড়ি ধরেছিলেন। এবার তার ডান হাতটি ধীরে ধীরে নামিয়ে রাখলেন। জীবকের দিকে চেয়ে বললেন— নাড়ি ক্ষীণা, তবে ভয়ের কিছু নেই।
জীবক বললেন— পরিষ্কার বস্ত্রখণ্ড চাই। দুটি কম্বল। রোগিণীর দেহ বড়ই শীতল।
সোমা আবার দ্বারের কাছে গেল।
জীবক বললেন— ভদ্রে আপনি কি রোগিণীকে গরম জল দিয়ে পরিষ্কৃত করে দিতে পারবেন। আমি আর আর্য সন্নতি থাকবো। নির্দেশ দেবো।
সোমা বলল—না।
চণক মুখ তুলে তাকালেন। তিষ্যকুমার কিছু বলতে গিয়ে চুপ করে গেল। মহারাজ বিম্বিসার বললেন কল্যাণি, তোমার দাসীদের নির্দেশ দাও।
জিতসোমা এবার দ্বারের কাছে গিয়ে দুটি দাসীকে ডেকে দিল। তারপর ধীরে ধীরে ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল।
সে দেখেছে তরুণীটির নাসিকা ও কর্ণ ছিন্ন করা হয়েছে। সেখানে পট্টিকা লাগানো, কিন্তু সে দেখেছে। ব্যভিচারিণীর শাস্তি। এই কৃষ্ণাঙ্গিনী কে? দেখে মনে হয় অতি নিম্নবর্ণের। গান্ধার মদ্র এসব দেশে এই প্রকার কৃষ্ণাঙ্গ বড় একটা দেখা যায় না। বসনটি তক্ষশিলার মুনিদের মতো। বৃক্ষবল্কল। কার স্ত্রী হতে পারে এই রমণী! কার সঙ্গেই বা ব্যভিচার? আর্য চণক এরূপ বিষণ্ণ কেন? তরুণীটি কি তাঁর পত্নী? এই রমণীর অঙ্গ স্পর্শ করতে সোমার কেমন ঘৃণা হচ্ছে। আরও কী হচ্ছে সে প্রকাশ করতে পারছে না। সে নিজের কক্ষে গিয়ে দ্বার রুদ্ধ করে দিল। শয্যায় বসে পড়ল। কিছুক্ষণ পর জিতসোমা দেখল তার দুই চোখ জ্বালা করে অশ্রু ঝরছে। অশ্রু ঝরছে।
রোগিণীকে পরিষ্কৃত করে দাসীরা একটি নূতন বস্ত্র পরিয়ে দিয়েছে। উত্তরীয় দিয়ে ঢেকে দিয়েছে ঊর্ধ্বাঙ্গ। দুটি কম্বল দিয়ে তার কণ্ঠ পর্যন্ত ঢাকা। শুধু তার সুপ্রচুর কেশ এখনও পর্যন্ত কিছু করা যায়নি। ঝাঁকুনি লাগলে আবার রক্তক্ষরণ হতে পারে। ভৈষজ দিয়ে ভালভাবে বাঁধা হয়েছে ক্ষতস্থান। সারা মুখটিই পট্টিকা দিয়ে আবৃতপ্রায়।
সমস্ত কাজ সম্পূর্ণ হলে জীবক বললেন— মহামান্য সন্নতি। কত দিনে ক্ষতস্থান শুকোবে বলে আপনার মনে হয়!
সন্নতি বললেন— সম্পূর্ণ শুকোতে পক্ষকাল তো অন্তত সময় নেবেই!
আমারও তাই অনুমান। তারপর একে ভালো করে পরীক্ষা করে দেখব। তারপর মহারাজ এবং চণকভদ্রর যদি অনুমতি হয়, আমি এর কৃত্রিম কর্ণ ও নাসিকা প্রস্তুত করে দেবো।
জীবক উঠে দাঁড়ালেন।
সন্নতি বললেন, কৃত্রিম কর্ণ-নাসিকা? জীবক তুমি কি পাগল হলে? শুনেছি বটে তুমি সুবন্ন সেট্ঠির করোটি ভেদ করে কৃমিকীট বার করে এনেছো।
জীবক বললেন— জটিল সেট্ঠির এক পত্নীর উদরেও শল্যচিকিৎসা করেছি মহামান্য সন্নতি। ওঁর অন্ত্রগুলি পাকিয়ে গিয়েছিল। সেগুলি বাইরে এনে গ্রন্থিমোচন করে আবার কুক্ষিতে সংস্থাপন করেছি। মহারাজের ভগন্দর তো অস্ত্র করে বাদ দিয়েছিই। এবার…
—একি জাদু না কি? জাদুবিদ্যা? বিরক্ত এবং আশ্চর্য হয়ে সন্নতি বললেন।
জীবক হাতের একটা ভঙ্গি করে বললেন— আপনি নিজে একজন ভিষক হয়ে, যদি এ প্রকারের কথা বলেন, তবে আর কী করতে পারি? চিকিৎসাবিদ্যায় জাদুর স্থান নেই মহারাজ। আপনি যদি অনুমতি দেন এই তরুণীটিকে তার পূর্বের রূপ ফিরিয়ে দেবার চেষ্টা করতে পারি।
বিস্মিত বিম্বিসার বললেন— কী ভাবে জীবক? আমায় বলবে? অসুস্থ প্রত্যঙ্গ বাদ দেওয়া এক বস্তু। কিন্তু নূতন প্রত্যঙ্গ সংযোজন করা…
জীবক বললেন— মহারাজ, আপনাদের যতটা সহজভাবে বোঝানো যায়, সেভাবে বলছি। আমার পরিকল্পনা হল দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে প্রশস্ত অশ্বথ-পত্র দিয়ে কাটা নাকের মতো একটি কৃত্রিম নাক প্রস্তুত করব, তারপর তার সমান করে গণ্ড কিংবা গ্রীবা থেকে চর্ম কেটে নেবো। তাই দিয়ে নাক গড়ে মুখে নাকের কাটা অংশের উপরে বসিয়ে পশুরোম দিয়ে সেলাই করে দিলে ধীরে ধীরে জুড়ে যাবে। নূতন নাকের ভিতরে দুটি নল প্রবেশ করিয়ে দিলে নিশ্বাস-প্রশ্বাসেরও সুবিধা হবে। নাকটি দৃঢ়ও হবে। কান দুটি হয়ত দেখতে অত ভালো হবে না। না-ই হল। কিন্তু কৃত্রিম বলে কিছুতেই বোঝা যাবে না। অনুমতিটা দিয়ে ফেলুন মহারাজ।
বিম্বিসার বললেন— বৈদ্যর আবার অনুমতির প্রয়োজন কী? প্রাণ সংশয়ের প্রশ্ন আছে না কি? — তিনি চণকের দিকে তাকালেন।
জীবক বললেন—কিছুমাত্র না। তারপর তিনি চণকের দিকে তাকিয়ে বললেন— রোগিণীর শয্যাপার্শ্বে দিবারাত্র কারুর না কারুর থাকা প্রয়োজন।
চণক মৃদুস্বরে বলল— আমি থাকবো।
সন্নতি বললেন— একটি দাসীকে নিযুক্ত করবেন। রোগী রমণী যখন… তখন নানারূপ প্রয়োজন…
চণক বলল— সেবকের কোনও লিঙ্গ নেই।
পক্ষকাল কেটে গেছে। ক্ষতস্থানও শুকিয়ে এসেছে। যদিও দুই বৈদ্যর অনুমান মিথ্যা প্রমাণ করে এখনও সম্পূর্ণ শুকোয়নি। দুদিন অন্তর অন্তর পট্টিকা পাল্টানো এবং নূতন করে ভৈষজ লেপন করা জীবক নিজেই নিষ্ঠাভাবে করে চলেছেন। কিন্তু তরুণীটি যেন এখনও আচ্ছন্ন, ভালভাবে জ্ঞান ফিরে আসছে না। জ্বর নেই। অথচ প্রলাপের প্রবণতা আছে। নিজেদের ভাষায় সে কী সব যেন বলে। চোখ মেলে। কিন্তু বোঝা যায় তার চৈতন্য নেই।
সন্নতি এর কোনও কারণ নির্ণয় করতে পারছেন না।
জীবকের নিজস্ব একটি মত আছে এ বিষয়ে, কিন্তু সে তা প্রকাশ করছে না। সে এখন অধীর হয়ে আছে নবনাসিকা ও কর্ণ প্রস্তুতের পরিকল্পনা প্রয়োগের জন্য। এখন রোগিণী অচৈতন্য-প্রায় হয়ে আছে, গ্রীবা থেকে কলা কেটে নেওয়ার কাজটা এখনই নির্বিঘ্নে হয়ে যেতে পারতো। কিন্তু সে বুঝতে পারছে রোগিণী এখনও বিপন্মুক্ত নয়। বাইরের ক্ষত শুষ্কপ্রায়, কিন্তু সেই আকস্মিকতার আঘাত, তাকে এখনও বিকল করে রেখে দিয়েছে। তার বিদ্যা প্রয়োগ করলে যদি রোগিণীর মৃত্যু হয় তো চণকভদ্র তাকে ছেড়ে দেবেন না। মৃত্যু হলে হবে অন্য কারণে, কিন্তু সম্ভবত চণকভদ্র তা বুঝবেন না। জীবক তীক্ষ্ণধী মানুষ। সে অনুভব করছে দৈবরাত চণক ঠিক সরল মানুষ নয়। অধিক কথা বলেন না। এখন একেবারেই বলছেন না। এখন তিনি শান্ত। বিবিক্ত। সবার কাছ থেকে যেন নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন, চিত্তের কোন গহনে তিনি যেন গুহাহিত। কিন্তু সে চণককে শ্মশানে ঝঞ্ঝাবাততাড়িত বনস্পতির মতো আক্ষেপ করতে দেখেছে। এর ভেতরে কোনও গূঢ় ব্যাপার আছে। যত সহজে জটিল সেট্ঠির তৃতীয়া পত্নীর উদর দেশ চিরে অন্ত্রগুলি সে গিঁট খুলে আবার ভেতরে সংস্থাপিত করতে পেরেছিল, এই বন্য তরুণীর চিকিৎসা তত সহজ হবে না। রোগী এবং বৈদ্য উভয়ের মধ্যে শুধু রোগ থাকলে সমস্যা সহজ হয়। কিন্তু যদি থাকে অজানা আবেগ, যদি থাকে রোগীর পরিপার্শ্বে বহুমাত্রিক সব বেদনার আঘাত সংঘাত… কঠিন প্রস্তরের মতো মুখ চণকভদ্র, অপরাধীর মতো নিমীলচক্ষু রাজা, বিস্রস্তকেশা সুন্দরী গান্ধারীর চোখে কৃষ্ণবিদ্যুৎ, তাহলে? তাহলে তরুণ জীবকের কাজটা অপেক্ষাকৃত কঠিন হয়ে যায়।
উনিশ দিনের দিন জীবক এসেছে ক্ষতস্থান পরিষ্কার করতে। পরিষ্কারও হয়ে গেছে। শুধু সামান্য নরম আঘাতের স্থানগুলি। তরুণীটি চোখ মেলে চাইল। চোখ দুটি স্বাভাবিক। স্বচ্ছদৃষ্টিতে সে চারদিকে চেয়ে দেখল। চোখে বিস্ময়। জীবক চোখের ইঙ্গিতে চণককে ডাকল। হাঁটু গেড়ে বসে চণক সতর্ক স্নেহের সুরে ডাকল— রগ্গা, রগ্গা…
বিহ্বল দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইল তরুণী, তার ঠোঁট নড়ছে। মৃদুস্বরে সে বলছে— অজ্জ আমায় ছেড়ে দে। অজ্জ তোদের পায়ে পড়ি আমাদের ছেড়ে দে।
চণক বলল —রগ্গা, কোনও ভয় নেই। তুমি ঘুমোও। তোমাকে সুপক্ক শূকরমাংসের সুপ খাওয়াবো। কত মধু, পায়স, উত্তম অন্ন, মোক তোমার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে।
এবার তরুণীর চোখে ত্রাস ঘনিয়ে এলো, বলল— আমি অজ্জদের দাসী হবো না। তোদের পায়ে পড়ি, আমি খুড়ার কাছে যাবো। উদ্দক কোথায়? উদ্দক?
চণক শান্ত গলায় বলল— রগ্গা, আমরা তোমার বন্ধু। একটু ইতস্তত করে আবারও বলল— আমায় চিনতে পারছো না?
তরুণী অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। জীবক দেখল সহসা চণকভদ্র যেন কী মনে পড়েছে এমন মুখভাব করে দাঁড়িয়ে উঠলেন। ঘরের কোণে একটি পেটিকা থেকে কী সব বার করলেন। কিছুক্ষণ পর তিনি যখন এদিকে ফিরলেন তখন জীবক দেখল, চণক ভদ্রর মাথায় জটা, দীর্ঘ দাঁড়ি এবং গোঁফ, কপালে বলি আঁকা। অমন সুন্দর উজ্জ্বল গাত্রবর্ণ ভস্মাচ্ছাদিত। তরুণী চোখ বুজিয়ে ছিল। সে যে এখনও অত্যন্ত অবসন্ন, তা তাকে দেখলেই বোঝা যায়, পরীক্ষা করবার প্রয়োজন হয় না। এখনও তাকে কঠিন খাদ্য খাওয়াবার সময় আসেনি। প্রায় অচৈতন্য অবস্থায় একটু একটু করে দুধ মধু ও সহপানগুলি খাওয়ানো হয়েছে মাত্র। চণকভদ্র ওই প্রকার সাজসজ্জা করে তরুণীটির শয্যার পাশে এসে বসলেন, মৃদু কোমল স্বরে ডাকলেন— রগ্গা, রগ্গা… এখন দেখো তো আমায় চিনতে পারো কি না!
কয়েকবার ডাকবার পর তার চোখ দুটি খুলে গেল। তারপর যা ঘটল তার জন্য জীবক প্রস্তুত ছিলেন না। রোগিণীর চোখ-মুখ একবার বিবর্ণ তারপরই অগ্নিবর্ণ হয়ে গেল, সে বলে উঠল ‘শঠ যতি! শঠ! শঠ! শঠ!’… শয্যা থেকে সে অসম্ভব ক্ষিপ্রতায় লাফিয়ে পড়ল চণকের ঘাড় লক্ষ্য করে। দু’হাত দিয়ে চণকের গলা টিপে ধরল। চোখদুটি বন্য মার্জারের চোখের মতো জ্বলছে।
জীবক তার হাত দুটি ছাড়াবার চেষ্টা করতে লাগলেন—ধ্বস্তাধ্বস্তি এবং চিৎকারে বাড়ির ভেতর থেকে কয়েকটি দাস-দাসী ছুটে এলো। জিতসোমাকে দ্বারের কাছে দেখা গেল। সে ক্ষিপ্র পায়ে এগিয়ে এসে রোগিণীর মণিবন্ধের কাছে সামান্য আঘাত করল, হাত দুটি ছেড়ে গেল। মুক্ত হাত দিয়ে এবার রোগিণী প্রাণপণে চণকের বক্ষে আঘাত করতে লাগল—নিয়ে যা, নিয়ে যা কাঁকই। চাই না, চাই না তোদের কিচ্ছু। সব নিয়ে যা—সন্ন, দীপ, তেল, অন্ন সব নিয়ে যা… বলতে বলতে রোগিণী জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ল। জীবক এবং জিতসোমা তাকে তুলে শয্যায় শুইয়ে দিলেন, ক্ষতস্থানের পট্টিকাগুলি রক্তে সামান্য ভিজে উঠেছে। উত্তেজনায় ও পরিশ্রমে অর্ধশুষ্ক ক্ষতমুখ আবার খুলে গেছে।
জীবক র্ভৎসনার সুরে বলল— এটা কী করলেন আর্য চণক?
চণক শূন্যচোখে চেয়ে বলল— এভাবেই ও আমাকে চিনত। বিশ্বাস করতো। সেবা করতো।
—করুক। আপনি বুঝতে পারেননি ও আপনাকে দেখে উত্তেজিত হবে!
—না। আমি ভেবেছিলাম ওকে আশ্বাস দেবো। সান্ত্বনা দেবো। ভেবেছিলাম ওকে অভয় দেওয়া যাবে… এ ভাবেই।
ছদ্ম জটাজুটে, ভস্মলেপনে এখন কেমন হাস্যকর অথচ করুণ দেখাচ্ছে চণককে। তার গলায় বন্য তরুণীটির হাতের চিহ্ন। রক্তাভ একটি মালার মতো। তরুণীটি যখন গলা টিপে ধরেছিল তিনি বাধা দেবার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করেননি। এখন জিতসোমার ইঙ্গিতে দাসীরা গরম জল ও মার্জনী বস্ত্র নিয়ে এলো। সে জটাজুট, আধখোলা কৃত্রিম গোঁফ, দাড়ি গুলি সব খুলে নিল। চণক দুহাত দিয়ে যন্ত্রচালিতের মতো মুখ ধুলেন। শীতল জলে বস্ত্রখণ্ড ভিজিয়ে ভিজিয়ে সোমা তার কণ্ঠের চারপাশ ধুয়ে ধুয়ে দিচ্ছিল। বলল— জীবক ভদ্র, কোনও ভৈষজ অবলেপ্য দেবেন না?
—প্রয়োজন হবে না, ভদ্রে
—দেখছেন না কেমন ফুলে উঠেছে! ওই তরুণীর গায়ে কী অসম্ভব শক্তি।
জীবক রোগিণীকে একটি ভৈষজ খাওয়াবার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু দাঁতে দাঁত লেগে গেছে। খাওয়াতে পারছেন না। তিনি একখণ্ড তূল ভৈষজে ভিজিয়ে নিলেন, বললেন ভদ্রে, আপনি এক এর ওষ্ঠাধরদুটি ফাঁক করে ধরবেন?
সোমা প্রাণপণ চেষ্টায় শুধু ওষ্ঠাধর নয়, দাঁতের পাটিদুটিও সামান্য ফাঁক করতে পারলো। জীবক ভৈষজ পান করালো বিন্দু বিন্দু করে। কিন্তু তরুণীর জ্ঞান ফিরল না। সেদিন গভীর রাতে তার হৃৎ-স্পন্দন থেমে গেল।
সন্নতি বললেন— রক্তপাত। রক্তপাত!
জীবক আবারও বলল—আকস্মিক মানসিক আঘাত।
সন্নতি বললেন— মন অর্থাৎ চিত্ত? এ রোগিণী বন্য মনে রেখো।
জীবক বলল— মহামান্য সন্নতি, আঘাত পাবার মতো চিত্ত এই বন্যদেরও আছে, এটিই প্রমাণ হল। এরা বন্য হতে পারে, কিন্তু পশু নয়। আপনি বৈদ্য আপনার কাছে সভ্য মানুষে বন্য মানুষে প্রভেদ কী?
সহসা বৃদ্ধ সন্নতির বদ্ধ মনের দ্বার খুলে গেল। আলো প্রবেশ করছে। অনেক অনেক আলো। তিনি সকৃতজ্ঞ, সহর্ষ দৃষ্টিতে জীবকের দিকে তাকালেন। আয়ুষ্কালের শেষ পর্বে কে আর নূতন জ্ঞানের আশা করে! তিনিও করেননি। কিন্তু জ্ঞান এলো। আয়ুষ্মান জীবকের হাত দিয়ে, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার হাত দিয়ে। তিনি মুখ নিচু করে আপন মনেই বলতে লাগলেন—জীবতু, জীবতু।
জীবক কিঞ্চিৎ বিষগ্ন ছিল। তার নবনাসিকা-কর্ণ নির্মাণের একটি সুযোগ এমন বৃথা গেল! আর কি সে এমন রোগী পাবে? কর্ণ-নাসিকাচ্ছেদন ব্যভিচারিণীর শাস্তি। চোর সন্দেহে কাউকে এই শাস্তি দেওয়া যেতে পারে না। এই হতভাগিনী তরুণীর ওপর অপপ্রয়োগ হয়েছিল বোহারিকের ক্ষমতার। দ্বিতীয়ত এ তরুণী রাজসখা চণকের স্নেহভাগিনী, সুতরাং মহারাজেরও পূর্ণ সমর্থন পাওয়া গিয়েছিল এর ব্যাপারে। বৈদ্য সন্নতির আশীর্বাণী কানে যেতে সে মুখ তুলে ঈষৎ বিরক্তির সঙ্গে বলল— আর জীবতু, রোগিণীটি তো মারাই গেল।
সন্নতি বললেন— ‘মহাবেজজ জীবক তো এর মৃত্যুর ভবিষ্যদ্বাণী করেই ছিলেন। করেননি? কদিন আগে আর কদিন পরে।’
মহাবেজ্জ? জীবক অবাক হয়ে সন্নতির দিকে ভালো করে তাকাল। রাজগহের মহাবেজ্জ সন্নতি স্বয়ং। তিনি কি পরিহাস করছেন?
বৃদ্ধর চোখ দুটি বোজা। মুখে স্মিত হাসি। যেন ধ্যানে ইষ্ট দর্শন হয়েছে।
৩৩
‘শ্রীমতি! শ্রীমতি!’ দ্বারে ক্রমাগত করাঘাত করে যাচ্ছে চণক। সে লক্ষ করছে না, কাষ্ঠনির্মিত, তক্ষিত দ্বারের কপাট দুটিতে কেমন ধুলো লেগে আছে। গৃহটির আকৃতিতে অবহেলার, অমার্জনার চিহ্ন। সবে গোধূলি-লগ্ন উত্তীর্ণ হয়েছে। আকাশ এবং নগরীতে নক্ষত্রবিন্দু-দীপবিন্দু-সজ্জিত লঘু ধূম্রবর্ণের উত্তরীয়টি গায়ে জড়াতে জড়াতে সন্ধ্যা নেমে আসছে। এ সময়ে এ দ্বার তো বন্ধ থাকবার কথা নয়। কবি বোধিকুমার, নট চারুবাক, সঙ্গীতনৃত্যপ্রিয় বপ্পভদ্র এঁরা তো নিত্যদিনের আগন্তুক! শ্ৰীমতীর বিশেষ গুণগ্রাহী। এঁরা ছাড়া আরও অনেকে থাকেন। রাজগৃহের বহু যুবা-প্রৌঢ় শ্রীমতীর গান, নৃত্য, সুনক্ষত্রর মৃদঙ্গ-বাদন ভালোবাসেন।
বহুক্ষণ করাঘাতের পর দ্বার খুলল। একটি দাস মুখ বাড়াল।
—কে?
—কাত্যায়ন চণক।
—কী চান?
—কী চাই? —চণক যেন দাসটিকে ভেদ করে ভেতরে প্রবেশ করলেন। বাঁয়ে ফিরলেন। বিস্মিত দাসটি তাঁর পেছন পেছন আসছে।
প্রশস্ত অঙ্গন। শূন্য। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্তম্ভগুলিতে মাল্য জড়ানো নেই। দীপ জ্বলছে না। প্রশস্ত সুন্দর সভাচ্ছদ পাতা নেই। অন্তঃপুরের প্রবেশপথে পিতলের পিঞ্জরটি শূন্য। শীতের পাতা ঝরে পড়ছে চারদিকে।
শ্ৰীমতী কোথায়? রুক্ষ স্বরে পেছন ফিরে জিজ্ঞাসা করল চণক। দাসটি ভয়ে ভয়ে বলল—জানি না।
—জানো না? চন্দা। চন্দা কই? সুনক্ষত্র?
—জানি না। দেবীর সঙ্গে দেশান্তরে গেছেন সম্ভবত।
—কোথায়?
—আমি জানি না অজ্জ। আমি আর আমার পত্নী এ গৃহ রক্ষা করছি।
—একে কি রক্ষা করা বলে?—চণকের মুখ দেখে দাসটি ভয় পেল। বলল—যথাসাধ্য করি অজ্জ। কিন্তু এই মুক্ত আঙন, চার দিকে গাছ—ঝরা পাতায় ক্রমাগতই ভরে যেতে থাকে।
চণক ধীরে ধীরে বেরিয়ে এলো। সে কেন এখানে এসেছিলে, তার কাছে স্পষ্ট নয়। তার মনে হয়েছিল, সে শ্রান্ত। বিশ্রাম চাই। লোকজন, আলো, আলাপ-আলোচনা, সঙ্গীত-নৃত্য এ সবের কিছুই তার ভালো লাগছে না। কিন্তু এই সমস্তই অনেক সময়ে একটি অন্তরাল সৃষ্টি করে, একটি প্রকৃত অন্তঃপুর, যেখানে থাকে সন্তপ্ত হৃদয়ের জন্য একটি নিভৃত ক্রোড়। নিভৃত আশ্রয়। উদ্যত তর্জনীগুলির থেকে নিষ্কৃতিস্বরূপ দুঃস্বপ্নহীন নিদ্রার অবকাশ।
—চণক ভদ্র। এদিকে কোথায়?
চণক পদব্রজে চলেছিল। মুখ নিচু। ডাক শুনে পাশ ফিরে দেখল বপ্পকুমার।
—অনেক দিন আপনাকে দেখিনি। এদিকে… কোথায় এসেছিলেন?
চণক শুধু নির্বাক চেয়ে রইল। কী অর্থ হয় এই প্রশ্নের? পেছনে পথের বাঁক ফিরলেই তো দেখা যাবে শ্রীতীর গৃহদ্বার।
বপ্পকুমার বলল—আপনি অনেক দিন পর এলেন, না?
চণক উত্তর দিল না।
—শ্রীমতী কোথায় গেছে আমরা জানি না, বপ্পকুমার বলল, ভদ্র আমরা একদিন সন্ধ্যায় গিয়ে দেখি পিঞ্জর শূন্য। শ্রীমতী পক্ষী উড়ে গেছে। আমরা আজকাল নন্দার কাছে যাই। অত ভালো গায় না। কিন্তু চমৎকার সব গীত রচনা করে, সুর দেয়। অতিশয় চঞ্চল। একটি খঞ্জনের মতো যেন। চলুন না। নিয়ে যাই।
চণক বলল—না।
বপ্পকুমার তার পাশে পাশে চলতে লাগল। বলল—চণকভদ্র মনে যদি কিছু না করেন তো বলি, বারস্ত্রীর ওপর আসক্তি ভালো নয়। মোটে ভালো নয়। এরা কুট্টনীর কাছ থেকে নানা প্রকার সম্মোহক বিদ্যা আয়ত্ত করে, প্রধানত ধনী, সুদর্শন, কুমার পুরুষদের ওপর এদের বিদ্যা খাটায়। যাতে সারা জীবন একটু একটু করে শোষণ করতে পারে। তারপর যখন দেহে-মনে-ভাণ্ডারে নিঃস্ব হয়ে যাবে সে পুরুষ তাকে নিষ্ঠুরভাবে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। তা ছাড়া বারস্ত্রী তো একটি নয় ভদ্র, নন্দা আছে, সুপূর্ণা আছে, আছেন স্বয়ং সালবতী। তিনি অবশ্য অত্যুচ্চ বৃত্তের লোক, তবে আপনার অগম্যা নন কখনও। বয়সে হয়ত, হয়ত কেন নিশ্চয় আপনার আমার থেকে অনেক বড়। কিন্তু গেলে, দেখবেন, যেন বিংশতিবর্ষীয়া যুবতীটি। স্থিরযৌবনা। এঁরা অপ্সরা-বিদ্যা জানেন তো!
তখনও চণক কিছু বলছেন না দেখে বপ্প বলল—আমি জানি আপনি অতি লাজুক, আমিই না হয় আপনাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাই…
তার কথা শেষ হল না, চণক বলল—আমার বড় তাড়া আছে। চলি বাপ্পাকুমার…সে অতি দ্রুত পথ পার হতে লাগল। যেন বপ্প তাকে কোনমতেই ধরতে না পারে।
বপ্পকুমার অবাক হয়ে গেল। চণক নামে গান্ধার দেশের এই যুবা গোড়ার থেকেই অতি উন্নাসিক। উদীচীর লোকেরা এমনটাই হয়ে থাকে, সে শুনেছে। মাগধদের তারা অনেকেই মানুষের মধ্যে ধরে না। আবার তক্ষশিলার স্নাতক, আবার গান্ধারের রাজপুরুষ আবার এখন মগধের রাজমিত্ত। তাই-ই কি অহংকার আরও বেড়ে গেল চণকভদ্রর! বপ্পও অতি ধনবান সেট্ঠির পুত্ত। তার নামটা পর্যন্ত চণক ঠিকঠাক বলতে পারলেন না। অহংকার, না আত্মবিস্মরণ! শ্রীমতীর বিরহেই ওই প্রকার কৃশ, অন্যমনা নাকি! তা এতকাল কোথায় ছিলেন? শ্ৰীমতীর সভায় তারা তো নিয়মিতই যেত। চণকভদ্রকে দেখেনি তো! অথচ অনেক সময়েই দেখেছে গিজঝকুট থেকে ফিরতে। কিংবা কোনও পানগৃহে আর একটি সুদর্শন তরুণের সঙ্গে কথা বলতে। সহসা যেন চণকভদ্র তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেন। তারা দুঃখিত হয়েছিল। বিশেষত কবি বোধিকুমার। বোধিকুমারের সঙ্গে বোধহয় চণকভদ্রর সখ্যটি যথেষ্ট নিবিড় হয়েছিল। প্রথম প্রথম যখন চণক আসা বন্ধ করলেন, বোধিকুমার অত্যন্ত উতলা হয়েছিল। বলত, অমন কাব্যভাবক আর হয়ত পাবো না। কবিরা ততটা মান যশের প্রার্থী নয়, যতটা প্রকৃত সহমর্মী বোদ্ধার প্রত্যাশী।
বপ্পই বুঝিয়েছিল বোধিকুমারকে, রাজমিত্ত তো আর শুধু শুধু হয় না, নিশ্চয়ই কোনও রাজকার্যে জড়িয়ে পড়েছেন।
—সে ক্ষেত্রে একটি চমৎকার, উচ্চস্তরের সাহিত্যরসিককে আমরা হারালাম। কে জানে হয়ত কবিকেও!
—কবিকে হারাবার প্রশ্ন উঠছে কেন?—বোধিকুমারকে জিজ্ঞাসা করেছিল। বোধিকুমার তাতে বলে—আমার ধারণা চণকভদ্র নিজেও একজন কবি। নিজে কবি না হলে কবিতার অন্তরে ওইভাবে প্রবেশ করার সাধ্য থাকে না। তা ছাড়া বপ্পভদ্র, যথার্থ বোদ্ধা ব্যতীত কবির অস্তিত্ব কতদিন? একটি পিক আর কতদিন শূন্য প্রান্তরে, নির্জন বৃক্ষশাখায় বসে কুহু-কুহু করে, বলো?
—কেন, আমরা? আমরা মাগধরা কি এতই অরসিক? বপ্পকুমার আহত হয়ে জিজ্ঞাসা করে।
না, না, তা নয়—বোধিকুমার যেন একটু লজ্জিত—তারপর বলেছিল, আপনারাও কাব্য শোনেন, গ্রহণ করেন, কিন্তু কিছু মনে করবেন না বপ্পভদ্র, আপনাদের কাছে সাহিত্যরস বারস্ত্রী সঙ্গের তুল্য। প্রমোদের জন্য, বিলাসের জন্য আপনারা কাব্যের কাছে আসেন। চণকের মতো রসিক আসেন প্রণয়ীর মতো, মর্মে প্রবেশ করেন।
—কেন, ভদ্র চারুবাকও তো আপনার কাব্যের অলঙ্কারাদি ব্যাখ্যা করে থাকেন, দোষ-গুণ বিশ্লেষণ করেন। তাতেও আপনার মন ওঠে না?
ঠিকই। ভদ্র চারুবাক কাব্যের বহিরঙ্গ বোঝেন। সে সম্পর্কে তাঁর সঙ্গে আলোচনায় আমি বহুবার উপকৃত হয়েছি বপ্পভদ্র। সত্য। কিন্তু প্রকৃত কাব্যভাবক কাকে বলে তা আমি চণকভদ্রর সঙ্গে আলোচনার পূর্বে জানতামই না। সমগ্র কাব্য, তার ভাষা, শব্দযুথ, ধ্বনি ব্যবহার, ছন্দ, অর্থ, খণ্ড খণ্ডভাবে নয়, সামগ্রিক দৃষ্টিতে কাব্যের যে অধরা ব্যঞ্জনা, একই সঙ্গে বহু ব্যঙ্গার্থ বহন করবার ক্ষমতা—এ একমাত্র চণকভদ্রই রাজগৃহে বুঝেছিলেন।
ওই আরেক ব্যক্তি যে না কি শ্রীমতীর বিরহে ক্লিষ্ট। বপ্পকুমার নন্দার গৃহের দিকে পা চালাল। যদি ওখানে বোধিকুমারের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়, আজকের এই চণক-সংবাদ তাকে সত্বর জানাবে।
চণক কয়েক মুহূর্ত ইতস্তত করেছিল। বোধিকুমারের গৃহ কোথায় সে জানে। কিন্তু কখনও যায়নি। সাধারণত একটি আম্রকুঞ্জে বসে তাদের কথা হত। এখন আসন্ন সন্ধ্যার ছায়া পড়ে গেছে চতুর্দিকে। কুঞ্জ-কাননগুলিতে সেই ছায়া গাঢ়তর। নাঃ, আম্রকুঞ্জে বোধিকুমারের যাওয়ার সম্ভাবনা অল্প। সে অগত্যা বোধিকুমারের গৃহের দিকেই চলল।
পশ্চিম পল্লীতে ক্ষুদ্র গৃহটি কবির। সমগ্র রাজগৃহে কাননহীন গৃহ একটিও নেই। অন্ত্যজ ছাড়া আর কেউ দরিদ্রও নয়। গৃহগুলি যাতে সময়মতো সংস্কার হয়, কাননগুলি যাতে যথাযথ রক্ষা হয় তার জন্য অনমনীয় নির্দেশ আছে রাজার। বোধিকুমারের গৃহটি ক্ষুদ্র এবং মাটির। মাটির প্রাচীরের গায়ে খোদিত বহু প্রকার অলঙ্কার দেখতে পেল চণক। কাননটিও ক্ষুদ্র। কিন্তু অপরিসীম যত্নে কেউ তাকে রক্ষা করছে। এই শীতেও প্রত্যেকটি গাছ সবুজ। পাতাগুলি ঝকঝক করছে। একটি আম্র ও একটি হরীতকী ছাড়া বৃক্ষ বলতে তেমন কিছু নেই। সবই ছোট ছোট গুল্ম। দ্বারের কাছে দাঁড়িয়ে সে ইতস্তত করছে এমন সময়ে দ্বার খুলে গেল। গায়ে মাথায় উর্ণার উত্তরীয় জড়িয়ে বেরিয়ে এলেন এক রমণী। তাঁর মুখ দেখতে পাচ্ছিল না চণক। কাননের দিকে চলে যাচ্ছিলেন তিনি, সহসা চণকের উপস্থিতি অনুভব করে ফিরে দাঁড়ালেন—কে?
চণক সামনে এসে দাঁড়াল, বলল—বোধিকুমারকে প্রয়োজন ছিল। আমি কাত্যায়ন চণক।
গৃহের ভিতরে দীপ জ্বলছে, দ্বারপথে সেই দীপের আলো। রমণী ফিরে দাঁড়ালেন, ত্বরিতে ভেতরে ঢুকে গেলেন। তাঁর চলার ভঙ্গির দিকে ইচ্ছার বিরুদ্ধেও তাকিয়ে রইল চণক। ইনি কি নৃত্যকুশলা? একটু পরেই বেরিয়ে এলো বোধিকুমার।
—আসুন আসুন চণক ভদ্র—সে অভ্যর্থনা করল, চণকের মনে হল তার মধ্যে যেন পুর্বের আগ্রহের অভাব।
সে বলল—ভেতরে যাবো না কবি, আপনার এই কাননে…
চলুন, তাই চলুন—বোধিকুমার তার উত্তরীয়টি ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে, কাননে একটি বকুলমূলে মৃৎ-বেদীর ওপর বসল। মৃৎ-বেদীর ধারগুলিও অনুপম কারুকার্যে ভরা। পরপর অনেকগুলি হাতি শুঁড় তুলে রয়েছে, বেদীর প্রান্ত যেন সেই শুঁড়গুলির ওপর ন্যস্ত। একটি প্রিয় অলংকরণ মগধবাসীদের। মঙ্গলচিহ্নও বটে। হাতি।
সন্তর্পণে বেদীতে বসতে বসতে বিনা ভূমিকায় চণক জিজ্ঞেস করল—শ্রীমতী কোথায়? জানেন?
অনেকক্ষণ নীরবতার পর বোধিকুমার ঈষৎ কর্কশ স্বরে বলল, —শ্রীমতীকে কি আপনার আবার প্রয়োজন পড়েছে?
চণক তার দীর্ঘ চোখ দুটি তুলে বোধিকুমারের দিকে তাকাল, বলল—তিরস্কার?
—আপনাকে তিরস্কার করার স্পর্ধা আমার নেই হে উদীচ্য ব্রাহ্মণ। কিন্তু আপনি একদিন সহমর্মী চক্ষু দিয়ে ওই নগরবধূকে দেখেছিলেন বলে শুনতে পাই।
—সত্য, আমি বহুদিন ব্যস্ত ছিলাম.। শ্রীমতীর সংবাদ রাখিনি। একথা সত্য—চণক দূরের দিকে তাকিয়ে বলল।
—হ্যাঁ আপনি ব্যস্ত ছিলেন আপনার নূতন প্রণয়িনীকে নিয়ে।
—কে বললে? চণক আশ্চর্য হয়ে মুখ ফেরাল।
—সবাই জানে। শ্ৰীমতী জানে! বারবধূর তার ক্রেতাদের কাছ থেকে প্রত্যাশা কিছু থাকে না। থাকতে নেই। তবু…
চণক বলল—আমি কোনদিন শ্রীমতীকে ক্রয় করিনি, সে-ও নিজেকে আমার কাছে বিক্রয় করেনি।
—এই রূপই যেন শুনেছিলাম? অবিক্রীত দেহসম্ভোগের নাম প্রণয়। প্রণয় লাভ করলে বারস্ত্রীও বড় অভিমানিনী হয়ে ওঠে চণকভদ্র। আপনি জানেন না, শ্ৰীমতী কেন অদর্শন হয়েছে? জানেন না, কোন পরিস্থিতিতে বারাঙ্গনা অদর্শন হয়?
চণক অবাক হয়ে বলল—না। জানি না তো!
বোধিকুমার ক্রোধে রক্তিম হয়ে উঠে দাঁড়াল। শ্ৰীমতীর গর্ভস্থ সন্তানের পিতৃত্ব অস্বীকার করছেন তাহলে? তা তো করবেনই। এই প্রকারই তো হয়ে থাকে পাষণ্ড গণিকাভোগীরা। আপনাকে অন্যপ্রকার ভেবেছিলাম। ভেবেছিলাম….
—ক্ষান্ত হও পুত্ত—অদূরে সেই রমণী এসে দাঁড়িয়েছেন, তাঁর হাতে দারুফলকে পানীয়-অতিথির সেবা করো।
চণক আর কিছু শুনতে পেল না। কারণ, তখন সে তক্ষশিলার সন্নিহিত অরণ্যে আচার্য দেবরাতের কুটির-প্রাঙ্গণে একটি সুকুমার শিশুকে কন্দুক হাতে খেলা করে বেড়াতে দেখছিল। পিতার কোলে বসে সেই শিশু কিছুই না বুঝে ঋক্সংহিতা কণ্ঠস্থ করত। ক্লান্ত হলে পিতার বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ত। কোন এক সময়ে জ্যেষ্ঠা ভগ্নী কিংবা পিতার কোনও শিষ্য তাকে তুলতে এলে, পিতা বলতেন থাক্ থাক্, আহা থাক!
—কিন্তু, এতক্ষণ ওকে কোলে নিয়ে বসে আছেন, আপনার কষ্ট হবে যে! পা ধরে যাবে।
—যাক। দেখছ না কন্দুকটি হাতের মুঠোয় নিয়ে কেমন এলিয়ে রয়েছে। আহা, মাতৃহীন শিশু, থাক। তিনি সস্নেহে তার চুলগুলি যথাস্থানে বিন্যস্ত করে দিতেন। শিশু মাঝে মাঝেই আধো-ঘুমের মধ্যে পিতার স্নেহবাক্যগুলি শুনত।
চণকের প্রথম সন্তান? আচার্য দেবরাতের প্রথম পৌত্র?
সচেতন হবার পর সে শুনল—বোধিকুমার বলছে—মা তুমি জানো, তোমার কাছে শপথ করেছিলাম নিষ্ক্রয় দিয়ে শ্রীমতীকে মুক্ত করবো। এঁর জন্য তা হল না। না হোক, ভেবেছিলাম আমি না পারি, ইনিই তা পারবেন এবং করবেন।
বোধিকুমারের মা একটু এগিয়ে এসে বললেন—বচ্চ চণক, পানীয় গ্রহণ করো, আমার পুত্তের কথায় উত্তেজিত হয়ো না।
চণক ধীর স্বরে বলল—জননী, শ্রীমতী কোথায় আপনি জানেন?
—না বচ্চ, জানি না, তবে যদি কখনও সন্ধান পাওয়া যায়, আমার পুত্ত তাকে জানিয়ে দেবে। কাত্যায়ন চণক তাকে খুঁজেছিল।
বোধিকুমার কাঁদছে। অশ্রু গদগদ স্বরে কী বলছে। সহসা চণকের সমস্ত দৃশ্যটি, বিশেষত বোধিকুমারকে অসহ্য মনে হল। কাঁদছে? এই মাগধ পুরুষরা কাঁদেও না কি? চিরকালই তবে বালক থাকে বোধহয়! সে বিতৃষ্ণায় মুখ ফিরিয়ে নিল। আর একটিও কথা না বলে সে উঠে দাঁড়াল, দ্রুত কাননদ্বারের দিকে চলল।
পেছন থেকে দৃঢ় নারীকণ্ঠ শুনল—বচ্চ চণক, জননীকে অপমান করে যাচ্ছো? চণক যেন একটা আঘাত খেল। সে পেছন ফিরে মায়ের মুখোমুখি হল।
কোমলকণ্ঠে তিনি বললেন-বসো চণক।
চণক বসবার পর তিনি পানীয়র পাত্র এগিয়ে ধরলেন। বললেন—অতিশয় মৃদু এ পানীয়। যদিও মধু থেকেই প্রস্তুত, তবু উত্তেজক কিছু প্রায় নেই বললেই চলে। আমি নিজে করি। নাও। এই খজ্জও অন্তত একটি নাও। মিষ্ট নয় এগুলি। খেয়ে দেখো, ভালো লাগবে। তোমাদের মায়েরই করা। পুত্ত তুমিও নাও। বৃথা অশ্রুপাত করছো কেন? পরিস্থিতি বুঝে যা ভালো মনে হয়, বিচার করে, তাই করবে। এর মধ্যে অশ্রুর কোনও স্থান নেই। জীবন কি তোমার পরিকল্পনা মতো চলবে?
চণক একটি বর্তুলাকার খজ্জ মুখে তুলে নিয়ে কামড় দিল। ইনি ঠিকই বলেছেন। ভালো লাগছে। সুগন্ধ, মুড়মুড়ে। মুখের ভেতরটা যেন সুস্বাদে ভরে গেল।
—আরও একটি নাও বচ্চ, যদি ভালো লাগে। তার মনের কথা বুঝেই যেন বললেন বোধিকুমারের মা। দ্বিতীয় খজ্জটি তুলে মুখে দেবার পর চণকের সহসা এক প্রবল আত্মধিক্কারের বোধ এলো।
শ্রীমতী কোথায় কোন নির্বাসনে গেছে। হয়ত কষ্ট পাচ্ছে। মানসিক তো বটেই। সেই সঙ্গে দৈহিকও হয়ত। তার অর্থাগমের পথও রুদ্ধ। অথচ সে এখানে বোধিকুমারের জননীর কাছে বসে তাঁর রাঁধা খুজ্জ খেয়ে চলেছে মনের সুখে। যেখানে যাই ঘটুক পৃথিবী যেমন নির্বিকার, তার দিন-রাত্রি, বর্ষা-শীতের নিয়মে যেমন কোনও ব্যত্যয় হয় না, মানুষও তেমনি। তার ইন্দ্রিয়গুলি ক্ষুধার্ত। প্রিয়তম ব্যক্তির মৃত্যু বা অপঘাত বা অন্য কোনও দুর্দশা ঘটলেও কি ক্ষুধা-তৃষ্ণা বোধ, শৈত্য বা গরম বোধ, নিদ্রার প্রয়োজন ইত্যাদি ইত্যাদি মানুষ অস্বীকার করতে পারবে? পৃথিবীর পক্ষে এই প্রকার ব্যবহারের ন্যায় অন্যায়ের প্রশ্ন নেই, কেন না যতই ঋষিরা ভূমিসূক্তে, পৃথিবীসূক্তে তাকে জননী বলে স্তুতি করুন, প্রকৃতপক্ষে পৃথিবী জড়। কিন্তু মানুষের চিত্ত আছে। মস্তিষ্ক আছে। আবার সব মানুষই কি এক প্রকার? এই তো বোধিকুমার, চোখ দুটি এখনও অরুণাভ। মায়ের অনুরোধ সত্ত্বেও খজ্জের দিকে হাত বাড়ায়নি। এমন কি সে চণক, চণকও তো ক্ষুধা-তৃষ্ণা-নিদ্রা ভুলে ছিল যতদিন অরণ্যকুমারী রগ্গার সেবা করেছে। রগ্গা, চণকের বুকের মধ্যে তীক্ষ্ণ লৌহমুখ তীর বিঁধতে লাগল। মুখ থেকে খুজ্জ ফেলে দেওয়া অত্যন্ত অভদ্রতা হবে বুঝে সে প্রাণপণে সেগুলি গিলতে লাগল। বিষম খেলো। কাশির ধমকে তার সারা শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। বোধিকুমারের জননী কাছে এসে তার ঘাড়ে মৃদু মৃদু আঘাত করতে লাগলেন। অন্য হাতে পানপাত্র মুখের কাছে ধরে বলছেন, একটু পান করো, পান করো বচ্চ। না হলে ঠিক হবে কী করে?
সামান্য পান করবার পর কাশি প্রশমিত হলে তিনি বললেন—যখন যা করবে, চিত্ত তাতেই সমর্পণ করবে। জীবন তো বহু কর্মের, বহু চিন্তার, বহু দায়ের সমাহার হবেই। শতাবধান হবার সাধনা করে থাকো তো অন্য কথা, নইলে চিত্তকে সংযত একাগ্র করতে হবে, বচ্চ।
এই কথা বললেন বোধিকুমারের মা, একজন সামান্য মগধিনী, চণককে, কাত্যায়ন দৈবরাত চণককে, যে চণক শতাবধান না হোক, অন্তত দশাবধান তো বটেই, যে চণক তক্ষশিলার মুকুটমণি পিতার মুকুটমণি পুত্র, যার পাণ্ডিত্য ও বুদ্ধির যশ এমনই যে, গান্ধার রাজসভা ও তক্ষশিলার আচাৰ্যকুল উভয়ের মধ্যে তাকে নিয়ে রীতিমতো টানাটানি পড়ে গিয়েছিল। উপরন্তু, যে চণক এখন মগধরাজের মিত্র, রাজশাস্ত্রের রচক, যে চণক মগধরাজকে নতুন দিশা দেখাচ্ছে, যে চণক…। তখন চণক বুঝতে পারল ইনি সামান্য এক মগধিনী কখনও নন। সে মৃদুস্বরে জিজ্ঞাসা করল—এই বেদী, গৃহের মৃৎ প্রাচীরের এই সব অপূর্ব লতায়িত হংসমিথুন, শঙ্খহাতে নারী না অপ্সরী, বংশীবাদক, এই সমস্ত সৌকর্যায়িক, এসব কে করেছেন?
—তোমার এই জননীই করেছে বচ্চ।…একটু পরে নিজের হাত দুটি কোলের ওপর মেলে ধরে তিনি ধীরে ধীরে বললেন—প্রকৃত কথা, থাকতে পারি না, হাত দুটি যেন সর্বক্ষণ কেমন করতে থাকে।
চণক অদূরে সেই মৃৎ-গৃহের দিকে অপলক চেয়ে রইল। গাছের ডালে বাঁধা একটি উল্কা জ্বলছে। তার আলোয় গৃহের অলঙ্করণ কখনও স্পষ্ট কখনও অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সে সেই দিকে অভিভূতের মতো চেয়ে রইল।
জননী বললেন—চণক, বচ্চ, আমি স্থপতি মহাগোবিন্দের কন্যা সুমেধা।
—‘মা’ বোধিকুমার যেন র্ভৎসনা করে উঠল।
জননী বললেন—আমাকে বলতে দাও পুত্ত, বলতে দাও। তুমি না বলেছিলে এই ক্যাত্যায়ন চণক তোমার বর্ষা কাব্যের মমোৰ্দ্ধার করেছেন! বচ্চ চণক, আমি পাঞ্চালীও বটে। আমার মা এক পাঞ্চালী বারমুখ্যা। আমার জন্মের সম্ভাবনার কথা শুনে পিতা মহাগোবিন্দ দেশান্তরে যাবার সময়ে মাকে একটি মহামূল্য রত্ন-অঙ্গদ দিয়ে গিয়েছিলেন, বলেছিলেন পুত্র হলে ওই রত্ন অঙ্গদসহ তাঁর কাছে পাঠিয়ে দিতে, পিতৃবংশের সিপ্প শিক্ষা করবে সে পিতার তত্ত্বাবধানে, আর কন্যা হলে ওই অঙ্গদ বিক্রয় করে কন্যার ভরণপোষণ করতে। বচ্চ, আমার জননীর এবং আমার দুর্ভাগ্য যে, আমি কন্যাই হলাম। আমার এই পুত্ত আমাকে মুক্ত করেছে। যখন মাত্র দশ বছরের বালক, তখন আমরা পাঞ্চাল-রাজধানী কাম্পিল্ল ছেড়ে পালিয়ে আসি। কাম্পিল্লে থাকলে গণিকার বিট হওয়া ছাড়া আমার পুত্তের আর কোনও ভবিষ্যৎ থাকত না। আমরা বারাণসীতে গিয়ে বাস করি। পুত্তের শিক্ষা সমাপ্ত হবার পর রাজগহে ভাগ্যের সন্ধানে আসি। সামান্য অর্থ ও অলঙ্কার আনতে পেরেছিলাম, গ্রাসাচ্ছাদন চলে যায়। শিক্ষার ব্যয় তো লাগেনি! আচার্য গঙ্গাধর আমার পুত্তকে পুণ্যশিষ্য তো করে নেনই। উপরন্তু তার কবিপ্রতিভা দেখে তাকে কতভাবে সাহায্য করেছেন, বলে শেষ করা যায় না। এখন বচ্চ চণক, আশা আছে কোন না কোনদিন মগধের রাজসভা কবির প্রয়োজন বুঝবে। তখন..
বোধিকুমার মুখ তুলে বলল—ইতিমধ্যে আমার জননী পরিচয় গোপন করে ধনীদের গেহে সৈরিন্ধ্রীর কাজ করেন। রমণীদের সিপ্প শিক্ষা দেন, এমন কি উৎসব গৃহে মহানসীর কাজ পর্যন্ত নিয়ে থাকেন…।
মনে হল বোধিকুমার চণকের প্রতি তার ক্ষণপূর্বের ক্ষোভ ভুলে গেছে। সম্ভবত তার ব্যক্তিগত সঙ্কটের প্রসঙ্গে।
সে হঠাৎ বলল—আচ্ছা চণকভদ্র, এই যে সিপ্পসমূহকে বিদ্যার জগতে অন্ত্যজ করে রাখা হয়েছে, একি আপনি ন্যয়সঙ্গত বলে মনে করেন? কম্মার সিপ্প, কুম্ভকার সিপ্প এগুলির কথা বলছি না। কিন্তু ধরুন স্থাপত্য বিদ্যা, ভাস্কর্য অথবা চিত্রকলা? কাব্য উচ্চকোটির বলে স্বীকৃত। কিন্তু এই সমস্ত বিদ্যার মধ্যেও যে সৌন্দর্যের সঙ্গে দক্ষতা, প্রয়োজনের সঙ্গে সৌষম্যবোধের সমন্বয়সাধন হয়, তা কি উচ্চকোটির সিপ্প নয়?
চণক বলল— আমি এ নিয়ে এখনও চিন্তা করিনি কবি। আপনি কি এগুলিও জানেন না কি?
জননী বললেন—আমার পুত্ত অপূর্ব সব চিত্ত লিখতে পারে। পুতুল গড়তে পারে। স্থাপত্য বিষয়ে আমরা উভয়েই বহু চিন্তা ও পরিকল্পনার আলোচনা করে থাকি। আমাদের এই গৃহ হিমঋতুতে উষ্ণ থাকে, দীর্ঘ গ্রীষ্মের সময়ে থাকে সুশীতল। বর্ষার সময়ে ঢালু ছাদের যাবতীয় জল গিয়ে পড়ে একটি কূপে। গৃহের কোনও কক্ষে বা অলিন্দে জল ঢুকতে পায় না।
বোধিকুমার বলল—এখন আমরা চিন্তা করছি, সমুদয় আবর্জনা যা নালিকাপথে কাননে একত্রিত করি, তা কী করে আবার মাটির তলায় চালিত করা যায়। এইভাবে গৃহও হবে আবর্জনামুক্ত, মাটিও হবে উর্বরতর, অথচ ব্যয় এমন কিছু নয়। তবে এ ধরনের গৃহ সর্বদা সুসংস্কৃত রাখতে হয়। সংস্কারের কাজ গৃহের পুরুষরাই রমণীদের সাহায্য নিয়ে করতে পারেন। বিশেষজ্ঞর প্রয়োজন হয় না।
এবার সে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে ঘুরে ঘুরে চণককে তাদের কানন, গৃহাভ্যন্তর দেখাতে লাগল। কক্ষে কক্ষে অর্ধসমাপ্ত ভিত্তিচিত্র। এখনও কাঁচা রয়েছে কিছু কিছু।
—বর্ণ কী ব্যবহার করেন? চণক কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করল।
—শুভ্রবর্ণ নিই চুনম থেকে, গৈরিক মাটি থেকে, কৃষ্ণবর্ণ কজ্জল থেকে পেয়ে যাই। লাক্ষা থেকে রক্তবর্ণ, রক্তচন্দনও ব্যবহার করি। কিন্তু হরিৎ, নীল ও অন্যান্য বর্ণের জন্য রত্ন গুঁড়োলে ভালো হয়। ভেষজবর্ণে ঠিক হয় না। আমার তো সে সাধ্য নেই। তাই দেখছেন না কতকগুলি নির্দিষ্ট বর্ণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছি।
শ্রীমতীর চিত্র দেখল চণক একাধিকবার। সঙ্গীত-নৃত্য-সভা, কখনও শ্রীমতী গাইছে, কখনও নাচছে, সুনক্ষত্র বাজাচ্ছে। বহু চেনা-অচেনা মুখের মধ্যে দর্ভসেনের মুখটি সে পরিষ্কার চিনতে পারল।
—এই নৃত্যসভা তো শুধু প্রতিচ্ছবি নয়! —চণক দেখতে দেখতে বলল।
শিল্পী বলল—তা তো নয়ই। এই যে অতিগৌর, নাতিগৌর, হেমবর্ণ, চম্পকবর্ণ, তাম্রাভ, কৃষ্ণবর্ণ, সর্বপ্রকার বর্ণের মানুষ দিয়ে এই সভাটি লিখেছি তাতে বোঝানো হল না কি, সঙ্গীত আস্বাদনের ব্যাপারে বর্ণ-নির্বিশেষে সব মানুষের চিত্তই সমান উৎসুক! এখানে এই যে নৃত্যপর নারী বা বাদকদের দেখছেন, দেখুন এরা কিন্তু বস্তুপৃথিবীর নিয়ম মেনে লিখিত হয়নি। হাত, পা, চোখ সকলই কেমন লীলায়িত, যেন দেহে অস্থি বলে কিছু নেই। এ হল ভাব, নৃত্যের ভাবরসের একেবারে ভেতরকার কথা। বাদকের চারপাশে যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনিন্দ্যসুন্দর বালকগুলি নাচছে এগুলি প্রকৃতপক্ষে ধ্বনি, বিচিত্র ধ্বনি। তাই এদের শুধু গৈরিক দিয়ে লিখেছি। মুখ-চোখের মধ্যে দেখুন কেমন তদ্গত ভাব! এরা এ পৃথিবীর নয়। বিশুদ্ধ ধ্বনি সব। গন্ধর্বলোক থেকে এসেছে।
সাধু, বোধিকুমার, সাধু—মৃদুস্বরে বলল চণক,—আর আমাকে এগুলি না দেখিয়েই বিদায় করে দিচ্ছিলেন?
বোধিকুমার লজ্জা পেয়ে বলল—আপনাকে ভুল বুঝেছিলাম। মার্জনা করুন।
—করবো। যদি একটি সত্য কথা বলেন।
—বলুন।
—আপনি কি শ্রীমতীর প্রণয়প্রার্থী?
একটু ইতস্তত করে বোধিকুমার বলল—ছিলাম চণকভত্র। কিন্তু আপনি আসার পর সব যে অন্যরূপ হয়ে গেল! আপনি শ্ৰীমতীর সন্তানের পিতৃত্ব যখন স্বীকার করেছেন তখন বাকিটুকুও নিশ্চয়ই করবেন?
—অর্থাৎ?
—আমি রাজভাণ্ডারে নিষ্ক্রয় দিয়ে শ্রীমতীকে মুক্ত করবার জন্য ধনসঞ্চয় করছিলাম। সে কাজটা, সে যদি রাজগহে ফেরে, তো আপনাকেই করতে হবে।
একটু পরে চণক বলল—ধরুন তখন যদি আমি রাজগৃহে না থাকি! ধরুন কেন, সত্য সত্যই থাকবো না। আমার ভবিষ্যৎ আমায় কোন দেশে কোন অবস্থায় নিয়ে গিয়ে ফেলবে, আমি জানি না। …কবি…মৃদুস্বরে চণক ডাকল…আপনি কি আমার সেই অনাগত সন্তানের ভার নেবেন?
একটি রত্ন অঙ্গদ দিয়ে যান তাহলে; পুত্র হলে অঙ্গদসমেত… বোধিকুমারের কণ্ঠে বিদ্রুপের সঙ্গে ব্যথা মিশে আছে। তার কথা শেষ হল না। চণক বলল—না, অঙ্গদ নয়। কাত্যায়ন দৈবরাত এই গোত্র নাম আছে শুধু, তাই দেবো, কিন্তু…গৃহী হবার অবসর চণকের জীবনে হয়ত আসবে না। এই কথাটি শ্ৰীমতীকে বুঝিয়ে বলতে হবে।
বোধিকুমারের মুখের দীপ্তি ধীরে ধীরে নিবে গেল।
—আমি নিষ্ক্রয়ের ব্যবস্থা করে যাবো, চণক বলল।
—নিষ্ক্রয় দিয়ে মুক্তি কিনতে পারি ভদ্র চণক, প্রণয় কিনতে তো পারি না!
—প্রণয় কিনবে কেন কবি, চণক ধীরে ধীরে বলল, প্রণয় লাভ করতেও তো পারো!
চিন্তামগ্ন দৈবরাত সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হয়ে যাবার পর ধীরে ধীরে গান্ধার- ভবনে প্রবেশ করল। ঘরে ঘরে দীপ জ্বলছে। শান্ত সুন্দর। আসনশালায় তিষ্য বসে আছে। বসে আছে জিতসোমাও। তিষ্য কিছু বলছে, জিতসোমা শুনছে। এই দৃশ্যটি যেন বহু দূরের। চণকের সঙ্গে কোনও প্রত্যক্ষ সংযোগ নেই। সে প্রবেশ করতেই দুজনে নীরব হয়ে গেল। সোমার মুখে শোনার ঔৎসুক্য ছিল, অন্তর্হিত হল। সোমার এই ভাবান্তর চণক কি লক্ষ করল? দীর্ঘদিন ধরে সে অন্যমনস্ক। প্রায় সারারাত ধরে সে লেখে। ভোর হলে চিত্তকের পিঠে বেরিয়ে যায়। মধ্যাহ্নভোজনের সময়েও অনেক দিনই ফেরে না। আজ বোধিজননীর সংস্পর্শে, বোধিকুমারের শিল্পচর্চার প্রসঙ্গে চণক যেন সামান্য উজ্জীবিত। যদিও গান্ধার-ভবনে প্রবেশ করা মাত্র একটি কৃষ্ণাঙ্গী তরুণীর কর্ণ-নাসিকাহীন শব তার প্রাণশক্তি কেড়ে নেয়, তবু।
সে বলল—তিষ্য, আসছি, চলে যেও না। আজ নৈশভোজে একসঙ্গে বসবো। চণক ভেতরে যেতে তিষ্য উৎফুল্ল মুখে বলল—বলেছিলাম না ভদ্রে, একটু সময় দিন, চণকভদ্র আবার আগের মতো হয়ে উঠবেন।
সোমা কিছু বলল না। বিষণ্ণ মুখে যেমন বসে ছিল বসে রইল।
তিষ্য বলল—আপনার মুখে হাসি দেখছি না কেন ভদ্রে?
সোমা মৃদু অশ্রচ্ছন্ন কণ্ঠে বলল-বন্য কুমারীর সেবা করতে চাইনি সে কি আমার দোষ?
তিষ্য প্রথমটা আশ্চর্য হয়ে গেল, তারপর বুঝে বলল—আপনি হয়ত ঠিকই বুঝেছেন, চণকভদ্র বোধহয় ক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন।
সোমা বলল—আমি কখনও করিনি। নিষাদদের দেখিনি কখনও। ওরূপ বীভৎস দৃশ্যও কখনও দেখিনি।
সে যেন কোনও বোহারিক কি বিনিশ্চয়ামাত্যর কাছে আত্মপক্ষ সমর্থন করছে। তিষ্য কী বলবে? কিছুক্ষণ পর সে বলল—এতে কোনও অপরাধ হয়নি, আর হলেও…
জিতসোমা হঠাৎ উঠে অন্তঃপুরের দিকে চলে গেল। করুণ কোমল মূর্তি। তিষ্যর হৃদয় যেন ভদ্রা জিতসোমার জন্য দ্রব হয়ে যেতে থাকে। কী রহস্য এঁর হৃদয়ে! ইনি কী প্রকার বিদুষী, কত শিল্প জানেন—এ সবই প্রতিদিন তিষ্য দেখতে পাচ্ছে। বন্য কুমারী হতভাগিনী রগ্গা গান্ধার-ভবনে কী যে অনভিপ্রেত জটিলতার সৃষ্টি করে গেল! দাসী তাকে পানীয় এনে দেয়। তিষ্য বুঝতে পারে জিতসোমা সংবৃত হতে অন্তঃপুরে গেছেন কিন্তু ভোলেননি তিষ্যকুমার অতিথি, একা বসে আছে। সে ধীরে ধীরে পানীয়ে চুমুক দিতে থাকে। যেতে হবে। তাকে এবার শ্রাবস্তী যেতে হবে। শ্রাবস্তীর সঙ্গেই মগধের সম্পর্ক সবচেয়ে দৃঢ়। মহারাজ পসেনদি যদি সম্মত হন তো…তার চিন্তার সূত্র ছিঁড়ে যায় দ্বারের ওপর মৃদু করাঘাতের শব্দে। দাস-দাসীরা আসার আগেই সে দ্বার খুলে দেয়। রাত হচ্ছে, এখন কে আসবে? বাইরে ঘন অন্ধকার ও শীত। সমগ্র জম্বুবন জুড়ে সহস্র সহস্র জ্যোতিরিঙ্গণ জ্বলছে নিবছে। ঘোর কৃষ্ণ বসন-পরা মানুষটি প্রবেশ করলেন। লোকপাল। তিষ্য নত হয়ে প্রণাম করল। মহারাজ, এই সময়ে?
মৃদুকণ্ঠে লোকপালবেশী বিম্বিসার বললেন—আশু প্রয়োজন। চণক কোথায়? শীঘ্র ডাকো। সোমা? সোমাই বা কোথায়? তার সঙ্গেও প্রয়োজন আছে।
তাঁর মুখ দেখে সহসাই তিষ্য উপলব্ধি করল ব্যাপার যা-ই হোক, তা অতি গুরুত্বপূর্ণ। সে ভেতরের দ্বারের কাছে গিয়ে একটি দাসীকে বলল—‘ভদ্র লোকপাল এসেছেন, সংবাদ দাও…।’
সে যথেষ্ট উচ্চগ্রামে কথাগুলি বলেছিল। বলবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই জিতসোমাকে দেখা গেল। একটু পরেই চণক তার নিজের কক্ষ থেকে বেরিয়ে এলো।
বিম্বিসার বললেন, আসনশালার দ্বার বন্ধ করো।
চণকের উদাসীন মুখ এখন সতর্ক হয়ে উঠেছে, সে বলল—কী সংবাদ মহারাজ? আপনার কোনও বিপদ…?
আমার নয় চণক, তোমার। তোমার এবং সোমার, অসহিষ্ণু স্বরে বিম্বিসার বললেন।
আমার? সোমার? চণকের কণ্ঠে বিস্ময়। তিষ্য এবং জিতসোমা উৎকণ্ঠিত হয়ে তাকিয়ে আছে।
বিম্বিসার বললেন—আজ সকালে চম্পা থেকে দূত এসেছে। অগ্রদূত। কুমার কুনিয় আসছে। সে বলে পাঠিয়েছে তার প্রাসাদ যেন প্রস্তুত থাকে। আরও বলেছে, গতবারে যে গান্ধারদেশীয় রমণী তার প্রাসাদ সজ্জা করেছিল, সে যেন থাকে। বিশেষভাবে তার নৃত্য-গীত উপভোগ করতেই সে এবার রাজগৃহে আসছে।
জিতসোমার মুখ পাংশুবর্ণ হয়ে গেল। চণক ঈষৎ রুক্ষ স্বরে বলল—তা যে হয় না সে কথা কুমারকে বলে দিলেই তো হয়!
বিম্বিসার পদচারণা করতে করতে মুক্ত বাতায়নের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন, তাঁর পিঠ কক্ষে উপস্থিত উৎকণ্ঠিত মানুষগুলির দিকে। তিনি কি তাঁর মুখভাব গোপন করতে চাইছেন?
—কাজটা সহজ নয় চণক, তিনি বললেন, কুমার অত্যন্ত আত্মপর, ক্রোধী।… আমার সন্দেহ হয় এ অন্তঃপুরিকাদের ষড়যন্ত্র। কেউ তার কাছে জিতসোমার কথাটা তুলে দিয়েছে। হয়ত আমাকে বিব্রত করবার জন্যই।
তিনি ধীরে ধীরে চণকের মুখোমুখি হলেন, বললেন—আচার্যপুত্র, তুমি তাকে জানো না, তাই বলছো। কিন্তু তুমিই বা বিলম্ব করছো কেন?
—আর বিলম্ব হবে না মহারাজ। কালই বেরিয়ে পড়ব।
—না না, আমি তোমার যাত্রার কথা বলিনি আচার্যপুত্র, বলছি সোমাকে বিবাহ করতে বিলম্ব করছো কেন? আমি তো অনেক দিন আগেই তোমার হাতে সমর্পণ করেছি তাকে। সখা চণক, মন স্থির করতে তুমি বড় সময় নাও।
—আর সময় নেবো না মহারাজ।
—আমি তাহলে এখুনি বিবাহের আয়োজন করি!
—তা হয় না মহারাজ, সোমা যে আমার ভগ্নী!
তিষ্য চমকে উঠে দেখল তার কুসুমবর্ণ উত্তরীয়ে মুখ ঢেকে গেছে সোমার।
—সোমা তোমার..অর্থাৎ আচার্য দেবরাতের…
—মহারাজ, সোমা তক্ষশিলার প্রখ্যাত রাজনটী দেবদত্তার কন্যা, আচার্য দেবরাতের ঔরসে।
আসনশালা নিস্তব্ধ। একটিমাত্র পতঙ্গ উড়ছে। তার শব্দও যেন কানকে আঘাত করছে। চণক পতঙ্গটির দিকে তাকিয়ে বলল—আমার জননী আমার জন্মের পরেই মারা যান। পিতার হাতেই বড় হয়েছি। সমাবর্তনের পর পিতা আমাকে ডেকে বললেন—দেবী দেবদত্তার কন্যাকে বেদবিদ্যা শিক্ষা দিতে হবে। আমি আর সতীর্থ অনঘ দুজনে এই কাজের জন্য নির্বাচিত হয়েছিলাম। প্রথম দিন যাত্রার পূর্বে পিতা আমাকে বললেন—বৎস যেখানে যাচ্ছো, শিল্পচারুতা ও সৌন্দর্যের খনি সেই গৃহ। বড় বিভ্রান্তিকর। কন্যাটি কিশোরী। অত্যন্ত মেধাবী এবং অত্যন্ত সুন্দরী। কিন্তু সে তোমার বৈমাতৃক ভগ্নী, মনে রেখো।
সোমার মুখ অশ্রুপ্লাবিত। অস্ফুটে আত্মবিস্মৃতের মততা সে বলল- মহারাজ, হতভাগিনী সোমাকে সে কথা বলতে কেউ মনে রাখেনি। আচার্য দেবরাতের মর্যাদা রাখতে গিয়ে সোমার কথা কেউ ভাবল না। অবশেষে যখন আর্য অনঘর প্রণয় অস্বীকার করলাম, তখন জননী বললেন—কার আশায় এ কাজ করলে সোমা? চণক? সে যে তোমার জেট্ঠ! আচার্য দেবরাত তোমার পিতা, তিনিই তোমায় পিতৃধন বেদবিদ্যা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন।
চণক নীরক্ত মুখে সোমার দিকে তাকিয়ে বলল—তোমার না জানার কথা আমি কখনও জানতাম না সোমা, ক্ষমা করো।
কক্ষ নিস্তব্ধ। সেই পতঙ্গটিই শুধু উড়ছে। উড়ে উড়ে দীপবর্তিকার কাছে চলে যাচ্ছে। আবার ফিরে আসছে।
চণক বলল—মহারাজ আমার সব আয়োজনই প্রস্তুত, ভাবছিলাম দু- এক দিনের মধ্যেই যাত্রা করব। সোমার এই আশু বিপদের পরিপ্রেক্ষিতে এ ও ভাবছিলাম এইমাত্র, যা হয় হোক সোমাকে সঙ্গে নিয়ে যাবো। আমাদের দুজনের কারওই উপস্থিতবুদ্ধি অল্প নয়। যেতে যেতে যেমন বুঝবো, তেমনই ব্যবস্থা করবো। কিন্তু এখন আর তা হয় না। আমি চলে যাচ্ছি। আপনি রাজা, আপনি মিত্র, যেমন করে হোক আমার ভগ্নীকে রক্ষা করার ব্যবস্থা করুন। কুমার কুনিয়র লালসার আহুতি সে হবে না। হলে আমি প্রতিশোধ নেবো। মহারাজ, কুমারের আসার পর আমি উপস্থিত থাকলে অনর্থক বিবাদ, রক্তপাত, বন্ধুত্বনাশ হবে…আমি উঠলাম।
সে অন্তঃপুরের দিকে ফিরল।
জিতসোমা তীক্ষ্ণ আর্তস্বরে বলে উঠল—জেট্ঠ চণক, আমায় ফেলে রেখে যাবেন না। আমায় সঙ্গে নিয়ে যান। আমি শরণাগত। শরণাগত…বলতে বলতে চণকের প্রতিক্রিয়াহীন মুখের দিকে তাকিয়ে সে স্তব্ধ, বিবর্ণ, প্রস্তর-কঠিন হয়ে যেতে থাকল।
চণক বিষন্ন স্বরে বলল—ভেবে দেখো, আর তা হয় না সোমা। মহারাজ, দেবরাতপুত্রীর আরক্ষার ভার আপনার…আর…আর… তিষ্যকুমারের, যদি সে দায় স্বীকার করতে সে কুণ্ঠিত না হয়।
বলতে বলতে সে আসনশালার দ্বার খুলে ফেলল, বলল—মহারাজ, পশ্চিমপল্লীতে বোধিকুমার নামে এক গুণী ব্যক্তি আছেন রাজ-অনুগ্রহের অপেক্ষায়। সে থামল, কী যেন বলবে বলে তিষ্যর দিকে তাকাল। চোখে চোখ মিলল। তাকাল একবার পাষাণ-মূর্তি নতমুখী জিতসোমার দিকে। তার চোখের তারা যেন গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়ে যাচ্ছে। ধীরে অন্তঃপুরের দ্বার খুলে সে চলে গেল। সামান্য পরে উদ্যান পথে চিত্তকের মৃদু হ্রেষা শোনা গেল। তার প্রভু পেছনের দ্বার দিয়ে বেরিয়ে গেছেন। শিশির-সিক্ত কাননভূমির ওপর দিয়ে চিত্তকের ক্ষুরের ধ্বনি দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে।
অনেকক্ষণ পরে বিম্বিসার বললেন—তিষ্যকুমার আমাদের দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমার মনে হয়, তুমি আর সোমা গান্ধর্ব বিবাহ করো। এখনই! তারপর দ্রুতগামী অশ্বে শ্রাবস্তী চলে যাও। আমার মুদ্রা তো তোমার কাছে আছেই। এই দুটি স্থবিকায় আমি পর্যাপ্ত সুবর্ণ কার্ষাপণ নিয়ে এসেছি। তিষ্য তোমার অস্ত্র-শস্ত্র, সোমা তোমার বস্ত্রালঙ্কার, পুঁথিপত্র যত শীঘ্র সম্ভব সংগ্রহ করে নাও। কী তিষ্য? সোমা?
নীরব দুটি মূর্তির দিকে চেয়ে অসহিষ্ণু বিম্বিসার বলে উঠলেন।
তিষ্য আচ্ছন্ন স্বরে বলল—আমায় একটু ভাবতে সময় দিন মহারাজ।
—বলছো কী? —বিম্বিসার দ্রুত পদচারণা করতে লাগলেন—কুনিয় যাত্রা করে গেছে। হয়ত সে কাল প্রত্যূষেই এসে উপস্থিত হবে। তিষ্য, কুনিয় যখন তার মাতার গর্ভে ছিল, তার মাতা কোসলদেবীর বড় বিচিত্র দোহদ হয়। তিনি আমার কাধের ওপর দাঁত বসিয়ে দিতেন। লক্ষণপাঠক পণ্ডিতরা বললেন—এই জাতক পিতৃরক্তপিপাসু হবে। কোসলদেবী গর্ভ নষ্ট করবার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। আমি বাধা দিই। সোমা, এই আমার বংশের প্রথম পুত্র। পুত্ৰমুখ দেখে অপত্যস্নেহ কাকে বলে জানলাম। অবিমিশ্র আদর, স্নেহ দিয়েছি, দিয়েছি পিতার মতো। লক্ষণপাঠকদের কথা আমি বিশ্বাস করি না। ভগবান তথাগত এ সব বিশ্বাস করতে নিষেধ করেন। কিন্তু কুমার বড় দুর্বিনীত। তাকে উপরাজা করে দিয়েছি। কিন্তু আচার-আচরণ দেখলে মনে হবে, সে রাজাই। বড় অহঙ্কারী। যদি মনে করে কিছু চাই, না নিয়ে ক্ষান্ত হবে না কিছুতেই।
জিতসোমা এতক্ষণ নতমুখে বসেছিল। তার দেহে কোনও প্রাণের লক্ষণও যেন ছিল না। সে এবার ধীরে ধীরে উঠে দাড়াল। শান্ত স্বরে বলল—তিষ্যভদ্রকে তার গোপনীয় রাজকর্মে যেতে দিন মহারাজ। তাকে ভারাক্রান্ত করবেন না।
—আর তুমি? বিম্বিসার উৎকণ্ঠিত স্বরে বললেন
—সোমার ভাগ্যফল সোমাকেই বুঝে নিতে দিন।
—কী করবে তুমি? সোমা হঠকারিতা করো না।
তিষ্য বলল—ভদ্রে, আপনি আমার সঙ্গে শ্রাবস্তী চলুন। সেখানে গিয়ে…
সোমা বলল—আমি গান্ধারী। ভবিতব্যকে ভয় পাই না ভদ্র। আমার নিরাপত্তার জন্য এত জন উৎকণ্ঠিত হচ্ছেন দেখে আমার আত্মধিক্কার জন্মে যাচ্ছে।
সে নত হয়ে মহারাজকে অভিবাদন করে ভেতরে চলে গেল।