মৈত্রেয় জাতক (Maitreya Jatak) – গান্ধার ভবনে চণক
১৫
অশান্ত বালকের মতো দুর্ধর্ষ বেগে ঘোড়া ছুটিয়ে গান্ধার ভবনে প্রবেশ করলেন চণক। অশ্বরক্ষক এসে দাঁড়াতেই রূঢ় ক্ষিপ্রতার সঙ্গে তার হাতে সমর্পণ করলেন চিত্তককে। চিত্তক ভূমিতে পা ঠুকে হ্রেষা করছে, প্রভুর এই ব্যবহার তার মনোমত নয়। চণক ভ্রূক্ষেপ করলেন না। দাসদাসীরা ছুটে এলো, কোনক্রমে হাতমুখ ধুয়ে নিজের কক্ষে প্রবেশ করলেন।
এ কোন সোমাকে তিনি দেখে এলেন? অবাধ্য দুর্বিনীত। নাগরিক বাকচাতুর্যের আড়ালে হারিয়ে গেছে দেবরাতপুত্ৰী জিতসোমা, তাঁর প্রিয় শিষ্যা, প্রিয়তমা ভগ্নী। শুধু বাকচাতুর্য নয়, ব্যবহারচাতুর্যও বটে! অবাধ্যই কী? না দুর্বোধ্য? ঠিক দুর্বিনীত বলা যায় না, প্রকৃতপক্ষে কেমন অনমনীয়, তার ওপর আর কোনও প্রভাবই নেই যেন চণকের। তিনি কণ্ঠের মধ্যে একটা রুদ্ধ আক্ষেপের শব্দ করতে লাগলেন, যা খানিকটা তর্জন খানিকটা কান্নার মতো শোনালো। যে কাত্যায়ন চণক সমগ্র মগধরাজ্য, অঙ্গরাজ্য ঘুরে ঘুরে জম্বুদ্বীপের রাজনীতিতে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করে এলেন, যিনি প্রত্যন্ত মগধ, সীমান্ত অঙ্গের সামান্য জনের না-বলা আশাহতাশার কাহিনী অত সহজে বুঝে ফেললেন, যিনি বিম্বিসার থেকে আরম্ভ করে মেণ্ডক-ধনঞ্জয় পর্যন্ত বিভিন্ন প্রকার প্রভাবী পুরুষকে তাঁর নীতির সম্পর্কে প্রত্যয়ী করতে পারলেন, সামান্য একটি নারীর মুক্তি তিনি কিছুতেই ঘটাতে পারলেন না। হায়, কেন তিনি সোমাকে ফেলে চলে গিয়েছিলেন? যে কর্মভার নিয়েছেন, যা যা সম্পন্ন করছেন সবার পেছনে আছে অনিবার্যভাবে সোমার প্রেরণা। সে কাছে থাকলে, আরও কত পারতেন! সবচেয়ে বড় কথা সোমার সামনে জীবনের রুদ্ধ দ্বার খুলে যেত, উন্মুক্ত বিরাট কর্মময় জীবন যার মধ্যে নিজের জ্ঞানবুদ্ধির অধিকারে সে প্রবেশ করতে চেয়েছিল। সেই সাধ তার উত্তরাধিকার, পেয়েছে পিতার কাছ থেকে, পেয়েছে মাতার কাছ থেকে, চণক স্বয়ং সে সাধকে দিনে দিনে পুষ্ট করেছেন। চণকের কাছে যতটা গুরুত্বপূর্ণ ‘রাজশাস্ত্র’ ঠিক ততটাই গুরুত্বপূর্ণ সোমার জীবন। সোমার হৃদয়। সোমার ভবিষ্যৎ।
অথচ সে শান্ত মুখে প্রদীপের সলতে উসকে দিতে দিতে বলল— ভবিতব্য জেট্ঠ। গণিকার ভবিতব্য নিয়ে জন্মেছি। মাঝে বিদুষী-বিদুষী, পুরুষী-পুরুষী খেলা খেলেছিলাম। আপনি দুঃখ করবেন না, আপনার হাত দিয়েই বিধাতা সোমাকে তার গণিকা ভবিতব্যে ফিরিয়ে দিলেন। আপনি তো উপলক্ষ্য! …আর তা ছাড়া… সোমা সহসা মুখ তুলে তাকাল। তার চোখের মণিতে প্রদীপের প্রতিবিম্ব,— নৃত্য-গীত আমার রক্তে জেট্ঠ। আমি প্রতিনিয়ত নূতন সৃষ্টি করছি। কেউ তার প্রকৃত অর্থ বুঝুক না বুঝুক, এই নৃত্যগীতের ভক্তজন রাজগৃহে বহু। যদি মনোমত শিষ্য-শিষ্যা পাই নূতন ধারার প্রবর্তন করে যাব। একটু থামল সোমা, তারপর ধীরে ধীরে বলল— আমার ভালো লাগছে।
—কী ভালো লাগছে, এই নগরশোভিনী-বৃত্তি?
—নগরশোভিনী তো একটা বৃত্তি নয় জেট্ঠ! মুগ্ধতার বেদীমূলে একটি সমাদরময় বিশেষণের অঞ্জলি!
—কার সমাদর সোমা? সে সমাদরের পেছনে যে রিরংসার কদর্য ইঙ্গিত রয়েছে এ কথা নিশ্চয় দেবী দেবদত্তার কন্যাকে আজ নতুন করে মানে করাতে হবে না!
দেবী দেবদত্তার গরিমাময় ভঙ্গিতেই উঠে দাঁড়াল তাঁর কন্যা। বলল— নৃত্যগীত আমার জননীর উত্তরাধিকার। কে তার কী কদৰ্থ করে তা নিয়ে আর চিন্তা করি না দৈবরাত। আমার বিশ্রামের সময় হল। আপনিও ক্লান্ত। আজ এই পর্যন্ত।
সোনার কাজ করা কাসিক দুকুলের উত্তরীয়টি গা থেকে টেনে খুলে ফেললেন চণক যেন বৃশ্চিক তাঁকে দংশন করছে। খুলে ফেলেও দংশন জ্বালা গেল না। এই বসন এই উত্তরীয় জিতসোমার উপহার। নিশ্চয় তার নিজের উপার্জন! চণক কি গণিকাদের ঘৃণা করেন? কই, না তো! শিশুকাল থেকে তাঁদের সমাজশরীরের একটি আবশ্যিক অঙ্গ বলে দেখে এসেছেন। প্রশ্ন ওঠেনি তখন। মনে কোনও প্রশ্ন ওঠেনি। সমাজোৎসবে দূর থেকে এই অপরূপাদের দেখে বিস্মিত, মুগ্ধ বালক এক ধারে দাঁড়িয়ে থাকত। বালক তখন জানত না এর পেছনে কত বলাৎকার, প্রবঞ্চনা, অভিসন্ধির ক্লেদ আছে! বড় হয়ে নগরশোভিনীদের ইতিবৃত্ত শুনলেন ধীরে ধীরে, এঁরা যে অলৌকিক স্বর্গের অনন্তযৌবনা চিরসুখী জন নন, জানলেন, ভালো করে কাছ থেকে দেখলেন দেবী দেবদত্তাকে, তারপর থেকে এঁদের জন্য একটা গভীর বেদনাবোধ, সম্ভ্রমমিশ্রিত ব্যথা তাঁর হৃদয়ে স্থান পেয়েছে। অন্যান্য নানা বিষয়ে অনুসন্ধান চালাতে চালাতে তিনি একটি অবধান দিয়ে এঁদের সমস্যার সমাধানের কথাও চিন্তা করেন। কখনও ঘৃণা করেননি, না হলে শ্রীমতীর কাছে জীবনের অর্থ খুঁজতে যেতেন না। কিন্তু আজ জিতসোমার বৃত্তি, জিতসোমার উপার্জন তাঁর গায়ে জ্বালা ধরাচ্ছে কেন? ভগ্নী বলে? না…! চণক দু হাত দিয়ে মাথাটি ধরে নতমুখে বসে রইলেন বহুক্ষণ।
তাঁর চোখ দুটি ঘরের চারধারে ভ্রমণ করতে লাগল ধীরে ধীরে, চোখের পেছনে দৃষ্টি নেই, মন নেই তাই দেখতে পাচ্ছেন না। অনেকক্ষণ পরে দীপশিখাটি কেঁপে উঠল। চণক দীপের আলো অনুসরণ করে দেখলেন একটি অপরূপ গজদন্তের পীঠিকা। তিনি উঠে দাঁড়ালেন। শিল্পদ্রব্যটি তাঁর মনোযোগ আকর্ষণ করল। কাছে গিয়ে দেখলেন, পীঠিকার ওপর একটি মণিময় থালী, তার ওপর অলংকার—দুষ্প্রাপ্য কালো মুক্তার কণ্ঠী, হীরকখচিত রত্নবলয়, নীলকান্তমণির কর্ণভূষা। সন্দেহ নেই এ সমস্তই জিতসোমার। এবং উপহার। কারো উপহার। সোমা এসব ফেলে গেছে। তিনি আরও দেখলেন সুবর্ণ মুকুর, স্ফটিকের পানপাত্র, রজতের দীপদণ্ড। কারও বা অনেকের উপহার সোমা ফেলে গেছে। কক্ষময় মৃদু, অতিমৃদু নারীগন্ধ পেলেন, নারীসঙ্গবিবর্জিত পুরুষরা যেমন পায়। সেই সৌরভ কক্ষের অপ্রশস্ত শয্যার আচ্ছাদনে, উপাধানে, নাগদন্তে লম্বমান তাঁর বসনগুলিতে। সোমা কি ‘পুষ্পলাবী’ থেকে ‘গান্ধার ভবন’ নিয়মিত আসা-যাওয়া করে? তিনি শ্রান্ত হয়ে শুয়ে পড়লেন এবং ধীরে ধীরে নির্ভুল বুঝতে পারলেন, তাঁর অনুপস্থিতিতে সোমা তাঁর কক্ষটি ব্যবহার করত, সম্ভবত এখানেই থাকত। বাতাসে কান পাতলে তিনি যেন শুনতে পাচ্ছেন তার মৃদু কণ্ঠ, সে আপনমনে শ্লোক আবৃত্তি করছে, গুনগুন করে গান গাইছে, দীর্ঘশ্বাস। দীর্ঘ দীর্ঘশ্বাস। এই কক্ষ যেন তার বাতাসে ধরে রেখেছে সোমার কথা, ভাবনা, চিন্তা। কিন্তু তিনি শুধু মৃদু ধ্বনি শুনতে পাচ্ছেন, কথাগুলির মমোৰ্দ্ধার করতে পারছেন না। ভাবনাচিন্তাগুলি বিহঙ্গপক্ষের বাত্যাঘাতের মতো তাঁকে একটু একটু স্পর্শ করে যাচ্ছে মাত্র। তিনি ধরতে চাইলেই সেই স্পর্শভীরু বিহঙ্গগুলি পাখা মেলে উড়ে উড়ে যায়।
নিদ্রা আসতে লাগল। চণক অস্পষ্টভাবে অনুভব করতে লাগলেন: লোলা, সুতনা সেই একসালা গ্রামের বালিকাগুলি, রাজপোতলি গ্রামের সেই মানুষগুলি, বনের মানুষ রগ্গা উদ্দক—এরা অনেক সুবোধ্য। এদের সঙ্গ যেন সদানীরায় স্নানের মতো। কিংবা বিশাল তৃণভূমির মধ্য দিয়ে চমৎকার মৃদুল বাতাসের স্পর্শ গায়ে নিয়ে হাঁটার মতো। শিক্ষা যেমন মানুষের চিত্তবৃত্তি পরিশীলিত করে তেমনি তাকে শেখায় সর্ববিষয়ে দ্বিচারণ, গোপনীয়তা। ক্রমশই যেন তিনি নাগরিক জটিলতার অনুপযুক্ত হয়ে যাচ্ছেন। স্বপ্নের মধ্যে লোলা তাঁকে কুল্মাষপিণ্ড নিয়ে সাধাসাধি করতে লাগল, উদ্দক হাসি মুখে দেখাতে লাগল সূচীমুখ কাঠের ফলা। তিষ্যকুমার রগ্গাকে নিয়ে একটি ঘোর কৃষ্ণবর্ণ অশ্বের পিঠে তীরবেগে বেরিয়ে যাচ্ছে। চণক তাকে রাগত কণ্ঠে ডাকলেন— সোমাকে নিয়ে যাবার কথা, সে কেন রগ্গাকে নিয়ে যায়? ‘বিম্বিসার’…সে বলে গেল ‘বিম্বিসার, বিম্বিসার’…। এবং তারপরই তিনি দেখলেন সোমা লুটিয়ে লুটিয়ে কাঁদছে। কই, কাঁদছে না তো? সর্পিণীর মতো মাথা তুলল, তারপর অদ্ভুত দীপ্র ভঙ্গিতে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল।
জ্বলজ্বলদ্ ধমদ্ধমদ্ বষট্ বষট্— আকাশে বিদ্যুতের রেখার মতো ছুটোছুটি করতে লাগল জিতসোমা। এবং অবশেষে যখন বিধ্যেৎ বলে সূচীসমান তর্জনী যেন তরবারির ফলার মতো সামনে ছুঁড়ে দিল মনে হল সে এই পৃথিবীকেই বিঁধে ফুঁড়ে বেরিয়ে যাবে বুঝি। চণক নিদ্রার মধ্যেই অস্ফুটভাবে হৃদয়ঙ্গম করলেন এই তণ্ডু-তাণ্ডব নৃত্য এক ধরনের বিদ্রোহ, বহুমুখী বিদ্রোহ। শিল্পীর বিদ্রোহ, গণিকার বিদ্রোহ, নারীর বিদ্রোহ। জমছে শক্তি, তেজ, আক্ষেপ, আক্রোশ, প্রাণন শক্তি, মনন শক্তি, পুঞ্জীভূত হচ্ছে, ব্যবহার হচ্ছে না, যেদিন ফেটে বেরোবে মত্ত, করাল জিঘাংসু নগ্নিকার বেশে, কর্মী পুরুষ, ভোগী পুরুষ, যোগী পুরুষ পাংশু মুখে শবের মতো ধরাশায়ী হবে।
নিদ্রা তবু এ যেন নিদ্রা নয়। চেতনার ওপর একটি লঘু আচ্ছন্নতার স্তর পড়েছিল। শরীর নিষ্ক্রিয়। কিন্তু মন তার কাজ করে যাচ্ছে। মন, তার সঙ্গে হৃদয় যুক্ত হয়েছে, যে হৃদয় যুক্তিজাল ছাড়াই বোঝে। বোঝে সোজাসুজি। এ এক ধরনের প্রত্যক্ষ জ্ঞান, চিত্রের রূপ ধরে আসে।
চণক উঠে বসলেন। তাঁর ক্লান্তি দূর হয়নি। এবং স্বপ্নে যা দেখেছেন আধো অন্ধকার কক্ষে তা কতকগুলি ছিন্ন সূত্র কালো মুক্তার মতোই ছড়িয়ে আছে। তাঁর একটা তীব্র ইচ্ছা হল, ইচ্ছা এবং সংকল্প। তিনি যথাসম্ভব দ্রুত বেশবাস করে নিলেন। পেছনের দ্বার দিয়ে গিয়ে অশ্বরক্ষককে জাগালেন। সে চিত্তককে প্রস্তুত করে দিল। তিনি অশ্বরক্ষকের জিজ্ঞাসু দৃষ্টির সামনে দিয়ে কুলুপ খুলুপ শব্দ তুলে ঘোড়া ছুটিয়ে দিলেন। সমস্ত নগরীর গায়ে, পাহাড়ের গায়ে, আকাশের গায়ে রাত্রির অন্ধকার মাখামাখি হয়ে রয়েছে। তারাগুলি দপদপ করে জ্বলছে। কতকগুলি তারা যেন হুড়মুড় করে খসে গেল। উল্কাপাত! যেন একটি ছিন্ন হীরার মালার মতো উল্কাগুলি জম্বুদ্বীপের দিকে ছুটে আসছে। কোন প্রান্তর, কোন রাজ্য, কাকে ধ্বংস করবে ওরা? তিনি কোনও কুসংস্কারে বিশ্বাস করেন না, তবু কিছুক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়ালেন। তারপর দ্বিগুণিত সংকল্প নিয়ে সপ্পসৌণ্ডিকপভারের দিকে ঘোড়া ছুটিয়ে দিলেন।
ভুল হয়েছিল। প্রমাদ। প্রকৃত কথা, রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে তাঁর যেমন কতকগুলি গবেষণা আছে। সমাজনীতি, সমাজে মানুষের বিন্যাস সম্পর্কেও তেমনি কতকগুলি ধারণা আছে। সেগুলি গড়ে উঠেছে বহু ভাবনাচিন্তার পর। গোষ্ঠীবদ্ধতা ব্যাপারটি তাঁর মনোমত নয়। পিতা এবং অন্যান্য ঋষিদের কাছ থেকে শুনেছেন গোষ্ঠীবদ্ধ সমাজের একটি বদভ্যাস হল অন্তর্বিবাহ। ক্রমাগত এই অন্তর্বিবাহের ফল কখনও ভালো হয় না। তক্ষশিলায় ঋষি আত্রেয় পুনর্বসু এ নিয়ে বহু ভাবনাচিন্তা করেছিলেন। একটি বিদথে এ নিয়ে বিশদ আলোচনা হয়, তাতে চণক যোগ দিয়েছিলেন। এক সময়ে সহোদর ভাইবোনেরও বিবাহ হয়েছে, কয়েকটি জন নিজেদের উৎপত্তির ইতিহাস এভাবেই নির্দেশ করে। লিচ্ছবিরা, শাক্যরা… এখনও এরা গোষ্ঠীবদ্ধ থাকতে ভালোবাসে। আর বনেচরদের তো কথাই নেই। সম্ভবত মাতা পিতা ছাড়া আর কোনও সম্পর্কই এদের মধ্যে নিষিদ্ধ নয়। জীবক বৈদ্যর সঙ্গেও তাঁর এ বিষয়ে কথা হয়েছে। জীবকেরও তাই ধারণা। তিনি এবং জীবক উভয়ে আলোচনাকালে বিস্ময় বিনিময় করতেন গৌতমের পরম্পরা নিয়ে। অন্তত তিন পুরুষে এঁরা মাতুলকন্যা বিবাহ করছেন। অথচ গৌতমের মতো প্রতিভা কী করে শাক্যকুলে সম্ভব হল? জীবক বলেন– এরপর থেকে দেখবেন গৌতমের বংশ ক্রমশই বিশেষত্বহীন, সাধারণ হতে আরম্ভ করবে।
চণক হেসে বলেন— গৌতম তো নিজের বংশরক্ষা করতে তেমন উৎসুক নন! ভাই, ভ্রাতুষ্পুত্র যে যেখানে আছে সবাইকারই তো মাথা মুড়িয়ে হাতে ভিক্ষাপাত্র ধরিয়ে দিয়েছেন।
জীবক কিন্তু হাসলেন না। তাঁর মাথায় অদ্ভুত অদ্ভুত কথার উদয় হয়। তিনি বললেন— কে জানে নিজ বংশের সার্বিক অবক্ষয় দেখেই তথাগত এ কাজ করলেন কি না! সত্য সত্যই শাক্যবংশ প্রায় নির্মূল করে দিয়ে এসেছেন তথাগত। তাঁর এ কাজের কোনও ব্যাখ্যা পাই না আমি। অন্যত্র ভক্তদের তিনি ইচ্ছামতো উপাসক বা প্রব্রাজক হতে বলেন, অর্থাৎ নির্বাচনের একটা সুযোগ রাখেন। কিন্তু শাক্যদের উনি ছলে বলে কৌশলে প্রব্রজিত করলেন।
জীবকের বিচারবুদ্ধিকে যথেষ্ট শ্রদ্ধা করেন চণক। বলেছিলেন— একটা কথা জীবকভদ্র। সঙ্ঘে বিদ্যা বুদ্ধি বিচক্ষণতা এসবের জন্য যাঁরা বিখ্যাত তাঁদের কেউই কিন্তু শাক্য নন। এটা লক্ষ্য করেছেন? শ্ৰমণ আনন্দ তো গৌতমের ছায়া মাত্র। অন্যরা ধ্যানমার্গে হয়ত উন্নতিলাভ করেছেন আমি জানি না, কিন্তু জ্ঞানমার্গ বা বুদ্ধিমার্গে তাঁদের কোনও কৃতির কথা আজও শুনিনি। যতই বলা হোক নির্বাণই বুদ্ধমার্গের লক্ষ্য, আমরা জ্ঞান বুদ্ধি এগুলিকে তো মূল্য দেবোই!
জীবক বললেন— শুধু আমরা কেন? স্বয়ং তথাগতই কি দেন না? তাঁর অগ্রশ্রাবক কারা? মহাপণ্ডিত সারিপুত্ত ও মোগ্গল্লান। অগ্রশ্রাবিকা কাঁরা? দেবী খেমা যিনি রাজগৃহের প্রাসাদেও বিদ্যার জন্য খ্যাত ছিলেন। সম্প্রতি শ্রাবস্তীর উৎপলবর্ণা বলে যে ভিক্ষুণী আরেক অগ্রশ্রাবিকা হয়েছেন, তিনি প্রথামতো উপনয়নের পর পাঁচ বছর বারাণসীতে উপাধ্যায় গঙ্গাধরের কাছে ব্রহ্মচারিণী ছিলেন, পরে শ্রাবস্তীর একজন খ্যাতনাম্নী উপাধ্যায় খুব সম্ভব জ্যোতির্লেখা নাম, এঁর কাছে ত্রিবেদ ও আনুষঙ্গিক সবই শিক্ষা করেছেন। অতি সুন্দরী বলে বিবাহ হতে এর বিলম্ব হচ্ছিল। সেই সুযোগে দেবী জ্যোতির্লেখা নাকি এঁকে পরমবিদুষী করে তোলেন। তা হলে দেখুন। পুত্র রাহুলের ভার তথাগত দিলেন সারিপুত্তকে। কই রাজকুমার নন্দও তো অর্হন হয়েছেন তাঁকে তো দিলেন না!
—আর রাহুল? চণক জিজ্ঞাসা করলেন— রাহুল কি কোনও বিশেষ মানুষ হয়ে উঠছে? না বিনয় পালনের ভারে অবলুপ্ত!
ভাবিত কণ্ঠে জীবক বলেছিলেন— আপনি বুদ্ধমার্গের সম্পর্কে ভালো ধারণা পোষণ করেন না তাই না দৈবরাত?
চণক সোজাসুজি এ কথার উত্তর দেননি। তিনি বলেন— সাধারণজনের পক্ষে এই মার্গ ভালো জীবকভদ্র। আশ্রয়, অশন-বসনের বাহুল্যও নেই, চিন্তাও নেই, সৎভাবে জীবন যাপনের কতকগুলি নীতি বেঁধে দেওয়া আছে, সেগুলি অনুসরণ করে চলতে পারলে মোটামুটি ন্যায়নিষ্ঠ হয়ে দিনগুলি কেটে যায়। কিন্তু জীবকভদ্র, আপনারও তো বুদ্ধমার্গের প্রতি তেমন নিষ্ঠা আছে বলে মনে হয় না, যদিও আপনি উপাসক।
—এ কথা বলছেন কেন?
—আপনি যে সাধারণ রোগীর চিকিৎসা করতে চাইছেন না! বা অতি উচ্চ মূল্য চাইছেন চিকিৎসার, সেটা তো ঠিক বুদ্ধের করুণামার্গের উপযোগী হল না!
জীবক হাসতে লাগলেন, বললেন— দৈবরাত আপনার দৃষ্টি দেখছি সব দিকে। ব্যাপারটা কি বলুন তো? জীবক তার পিতৃপরিচয় জানে না, মাতা কে তাও জানে না। রাজানুগ্রহ পেয়েছে রীতিমতো ক্ষমতা দেখিয়ে। প্রথম দিকে তো মহারাজ আমাকে যথেষ্ট সন্দেহের চোখে দেখতেন। যা-ই হোক অনেক কৌশল তিনিও করেছেন আমার মন জানতে, আমিও বহু কৌশল করেছি তাঁকে তা জানাতে। এখন এই রাজানুগ্রহ ব্যাপারটা পদ্মপত্রে জলবিন্দুসম। এই আছে এই নেই। যতদিন আছে ভাই করে নিই। আবার শুনতে পাই মহারাজ স্বয়ং আমার পিতা হতেও পারেন, সে ক্ষেত্রে মাথার ওপর একটি খাঁড়া সবসময়ে ঝুলছে বুঝতে পারেন তো? তেমন বুঝলে ধনসম্পদ নিয়ে চম্পট দেবো। অত করুণা করলে জীবকের চলবে না।
চণক হাসলেন কিন্তু বললেন— চম্পট দেবেন? চম্পট কেন? মিথ্যা কারণে অত্যাচার হলে আপনি প্রতিবাদ করবেন না?
জীবক বললেন— ভৈষজ বিদ্যাটি ভালো করে আয়ত্ত করেছি দৈবরাত। সামান্য বুদ্ধি সুদ্ধিও আছে ঘটে, কিন্তু শস্ত্রচর্চা এমন করিনি যে কুমার কুনিয়র সঙ্গে যুঝে পারবো— তা ছাড়া দৈবরাত বৈদ্য শত হলেও একজন মানুষ, তার শারীরিক সাধ্যের একটা সীমা আছে। রাজবৈদ্য বলে রাজ-পরিবারের অমাত্যদের পরিবারের যে যেখানে আছে সবাইকার চিকিৎসা আমাকে করতে হয়। তথাগত এবং সঙ্ঘের চিকিৎসা ভারও আমার। তা হলে? আর সময় কই? বলুন? এর অধিক করতে গেলে জীবকের নিজস্ব সময় বলে কিছু থাকবে না। তার কাজের উৎকর্ষও হয়ত এক প্রকার না থাকতে পারে….।
ভাবনায় ভাবনায় অনেকটা পথ পার হয়ে এসেছেন চণক। অদূরে রাত্রির কৃষ্ণতার মধ্যে আরও গাঢ় কৃষ্ণিমা সৃষ্টি করে দাঁড়িয়ে আছে সপ্পসৌণ্ডিকপভার। সাপের ফণার মতো পর্বত গাত্র। জিতসোমা অতি বুদ্ধিমতী, বিদুষী হলেও ছিল তাঁর একান্ত অনুগত। এক অহেতুক ভয়ে সংকোচে তিনি তাকে ত্যাগ করে এসেছিলেন। না, ত্যাগ তাকে বলা যায় না। সেই মুহূর্তে তিনি বিভ্রান্ত হয়েছিলেন। সেই মুহূর্তে মনে হয়েছিল তাঁর সঙ্গ জিতসোমার পক্ষে অশুভ হবে। ভালো করে ভেবে দেখলে মনে হয় তাঁর আত্মবিশ্বাসের অভাব ঘটেছিল। এবং যেহেতু রাষ্ট্রিক কাজে নিজেকে নিবেদন করতে চান সেহেতু ব্যক্তিগত জীবনে জটিলতা পরিহার করতে তিনি সর্বশক্তি প্রয়োগ করেছিলেন।
মহারাজ বলছেন জিতসোমা তিষ্যকুমারকে মনস্থির করবার সুযোগ দেয়নি। তিনি জিতসোমার আরক্ষার জন্য সশস্ত্র রক্ষী রেখে দিয়েছিলেন। কিন্তু কুমার কুনিয়কে জিতসোমা নিজেই অনুমতি দিয়েছে গান্ধার ভবনে প্রবেশ করবার। দুজনের মধ্যে কী সম্পর্ক তা নাকি মহারাজ জানেন না। এবং বর্তমানে ‘পুষ্পলাবী’র এই নটীজীবন সোমা নিজেই নির্বাচন করেছে। সন্ধ্যায় নৃত্য-গীতের পর কোনও কোনওদিন কাব্যপাঠ, নানা বিষয়ে আলোচনা ইত্যাদির পর জিতসোমার দ্বার নাকি বন্ধ হয়ে যায়। কারো প্রবেশের অনুমতি থাকে না। ভালো। আজ চণক ভগ্নীর গৃহে যাবেন। এ বার যখন প্রাচীতে যাবেন সোমাকে নিয়ে যাবেন। অতি দুর্গম প্রদেশে যেতে হলে তাকে ভদ্দিয়তে রেখে দেওয়া যায়, চম্পায় মেণ্ডক শ্ৰেষ্ঠীর গৃহে রেখে দেওয়া যায়। একসালা গ্রামে বালিকা লোলার গৃহই বা মন্দ কী? প্রাচুর্যে অভ্যস্ত জিতসোমা। কাকে বলে দরিদ্রতা, কাকে বলে সরল জীবন, নিরাড়ম্বর, নিরুপকরণ, সামান্য আশা আকাঙ্ক্ষার জীবন, দেখুক। রাজশাস্ত্রে এদের কী স্থান হবে? এদের কী গুরুত্ব সে দেবে তিনি জানতে উৎসুক। এক বন্য বালিকাকে স্পর্শ করতে জিতসোমা ঘৃণা বোধ করেছিল …আবার… আবার গৌতম যখন সেই বন্যরমণী…কী যেন নাম হারীতি না? তাকে যখন বশ করলেন সে মুগ্ধ বিস্ময় প্রকাশ করেছিল, গৌতমের নীতির সশ্রদ্ধ সমর্থন করেছিল।
পুষ্পলাবীর কাননে ধীরে ধীরে প্রবেশ করলেন চণক, শিশিরসিক্ত মৃত্তিকার ওপর শিক্ষিত চিত্তকের খুরের শব্দ হল না। প্রতি মুহূর্তেই তিনি আশা করছেন রক্ষীদের।
—ও কী? ও কে? চন্দ্রকেতু না? অমাত্য চন্দ্রকেতু?
পেছনের দ্বার দিয়ে সন্তর্পণে বেরিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে। অন্ধকারে চোখ অভ্যস্ত হয়ে গেছে চণকের, তাই তিনি চিনতে পারছেন। এক মুহূর্ত। পরক্ষণেই আর চন্দ্রকেতুকে দেখতে পেলেন না চণক। কিন্তু আরও একটি ছায়ামূর্তি বেরিয়ে আসছে। একইভাবে। সহসা চণকের কী হয়ে গেল তিনি কটি থেকে ছুরিকা টেনে নিলেন, ক্ষিপ্র হাতে অন্ধকারের বক্ষ ভেদ করে ছুঁড়ে দিলেন। অব্যর্থ লক্ষ্যে ছুরিকা বিঁধে গেল ছায়ামূর্তির কণ্ঠনালীতে। ঘড়ঘড় মতো একটা মৃদু শব্দ হল, লোকটি সম্ভবত ঝোপঝাড়ের ওপর পড়ল। সংবিত ফিরে এলো চণকের। ওই ছায়ামূর্তি যদি কুমার কুনিয় হয়? যদি হন স্বয়ং মহারাজ?
চণক, কাত্যায়ন, তুমি দিশা হারাচ্ছো। সম্ভবত তোমার চিত্ত তোমার বশে নেই। এইসব অতর্কিত প্রতিক্রিয়া, তড়িৎ-সিদ্ধান্ত, হত্যা, রক্তপাত,— এ সবই তোমার অনেক পেছনে ফেলে আসার কথা ছিল। চণক! চণক!
চকিতে চণক চিত্তকের পিঠ থেকে নেমে ছুটে গেলেন। একটি কামিনীঝোপের ওপর পড়ে আছে লোকটি। কৃষ্ণ বসন পরা, কণ্ঠ থেকে গলগল করে রক্তপাত হয়েছে। না পরিচিত কেউ নয়। একটি অপরিচিত সামান্য মানুষ। মরে গেছে।
পেছনের দ্বারে মৃদু করাঘাত করলেন চণক। সামান্য পরেই জিতসোমা স্বয়ং দরজা খুলে দিল। চোখে নিদ্রার চিহ্নমাত্র নেই। পরিপাটি সাধারণ বেশ। দীর্ঘ বেণী দুলছে। চণককে দেখে তার চোখ দুটি বিস্ফারিত হয়ে উঠল। চণক আঙুল দিয়ে ঝোপের দিকে দেখালেন।
—ও কী?— এস্ত পায়ে কাননে নেমে এলো সোমা—রুরুকে এ ভাবে মারলে কে?
—আমি।
—আপনি? জেট্ঠ? — জিতসোমা এমনভাবে তাঁর দিকে তাকিয়ে রইল যেন সে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। সহসা তার চোখ দিয়ে বিন্দু বিন্দু অশ্রু পড়তে লাগল, স্খলিত গলায় সে বলল—রুরু, হতভাগ্য রুরু, রুরু, তুমি বিশ্বস্ত ছিলে, এই কি তোমার অপরাধ?
সে ছুটে ভেতরে চলে গেল। নিমেষের মধ্যে একপাত্র জল নিয়ে ফিরে এলো। তূল ভিজিয়ে ফোঁটা ফোঁটা করে রুরু নামক ব্যক্তির গলায় ঢেলে দিল। লোকটির গলার ভেতরে জল গেল কি না বোঝা গেল না। কিন্তু তার মাথাটি একদিকে হেলে গেল অসহায়ের মতো। জিতসোমা লোকটিকে দু হাতে তুলে ধরল অমানুষিক বলে। কোলে করে নিয়ে দাঁড়াল। পরিশ্রমে তার মুখে বিন্দু বিন্দু স্বেদ ফুটে উঠেছে। চণক দেখলেন তাম্রবর্ণ, খর্বকায়, কৃশ একটি সামান্যদর্শন মানুষ। তিনি বললেন— আমি সাহায্য করছি সোমা তুমি পারবে না।
সোমা প্রাণপণে মাথা নাড়ল— আপনি একে স্পর্শ করবেন না। যা আমার কর্তব্য তা আমাকেই পালন করতে দিন— তার দু চোখ দিয়ে এখন ঝরঝর করে জল পড়ছে।
—এত দূর? এত দূর তোমার অধঃপতন সোমা! ধিক। একটি সামান্য লম্পট! তার জন্য এত! একেবারে ক্রোড়ে তুলে নিয়েছো?
সোমার বক্ষের উত্তরীয় রক্তে মাখামাখি হয়ে গেছে। সে দৃপ্ত ভঙ্গিতে বলল— আপনিও তো একদিন এক নষ্ট-ভ্রষ্ট বন্যবালিকাকে কোলে করে নিয়ে এসেছিলেন, আসেন নি? মুগ্ধ কাতর নেত্রে চেয়ে থাকতেন তার দিকে দিবসরজনী। তাতে দোষ হয়নি? নাকি সে আপনি দেবরাত পুত্র বলে!
চণকের ক্রোধ আসছে। তিনি রুষ্ট কণ্ঠে বললেন— সে বালিকা নষ্ট-ভ্রষ্ট ছিল না।
—এ ব্যক্তিও লম্পট নয়।
—সকলই তোমার ক্ষমার অযোগ্য মোহ।
—মোহ আপনার, ভ্রম আপনার। আর, কাউকে ক্ষমা করা অথবা না করার দায় সোমা নেয় না।
সোমা উচ্চতম সোপানে দাঁড়িয়েছে এবার। চলে যাবে।
ক্রোধে ক্ষোভে মুখ রক্তবর্ণ করে চণক বললেন— যাও, যাও, সোমা ভিক্ষুণীসংঘে যোগ দাও গিয়ে। স্বাধীনতা কন্দুক নয় যে তাকে হেলায় মলক্ষেত্রে ফেলে দেবে। যাও সোমা যাও যাও…
তিনি আর দাঁড়ালেন না। তীব্রবেগে মুখ ফেরালেন। কয়েকটি ক্ষিপ্র পদক্ষেপে পৌঁছে গেলেন চিত্তকের কাছে। তারপর রাজগৃহের প্রত্যূষ-পথে ধূলার ঘূর্ণাবর্ত ছাড়া কিছু দেখা গেল না।
১৬
কিশোর সোপাক চলেছিল ভিক্ষুণী উপাশ্রয়ের দিকে। হন হন করে। মায়ের সঙ্গে দেখা করবে। দুতিন বছরের মধ্যেই সোপাক অতিশয় প্রজ্ঞাবান হয়ে উঠেছে। সে স্থবির সারিপুত্তর সার্ধবিহারিক। প্রত্যূষে উঠে উপাধ্যায়কে দন্তকাষ্ঠ, মুখ ধোবার জল, ধোয়া চীবর— এসব গুছিয়ে দিয়েছে। উপাধ্যায় এবার ধীরে ধীরে পদচারণা করবেন, তারপর ভিক্ষায় বেরোবেন। সোপাকও বেরোবে ভিক্ষায়। কিন্তু বেরিয়ে প্রথমেই সে যায় ভিক্ষুণী উপাশ্রয়ে মায়ের কাছে। মাকে না দেখে সোপাক থাকতে পারে না। অবশ্য মা এখন এই সময়টা উপাশ্রয়ে থাকেন না।
সোপাক চণ্ডালপুত্র। তিন চার বছর আগে তাকে দেখলে মনে হত একটি শশকশাবক। সর্বদা ভয়ে ভয়ে আছে এই কোনও হিংস্র জন্তু এসে তাকে গ্রাস করে নিল বুঝি বা। সোপাকের অভিজ্ঞতা বলত সংসার এক অরণ্য। হিংস্র, ভয়াল, কিংবা উদাসীন। একমাত্র আশ্রয় মা। অথচ পিতৃব্যপুত্রের জন্মের আগে সে ছিল গৃহের পরম আদরের ধন। সেসব দিনের কথা ক্ষীণভাবে মনে পড়ে সোপাকের। তার হাতে ক্ষীরমণ্ড তুলে দিচ্ছেন পিতৃব্য। নানাপ্রকার খেলনা এনে দিচ্ছেন। সে তখন নিতান্তই শিশু। মা বলতে চান না। কিন্তু দুঃখে দ্বন্দ্বে বড় হয়ে সোপাক যতটা বোঝার তার চেয়ে অধিক বোঝে। তার পিতার মৃত্যুর পর পিতৃব্যের পত্নী হবারই কথা ছিল তার মায়ের। তাদের পরিবারে এ রূপই হয়ে থাকে। হলে কোনও গোল হত না। কিন্তু মা সম্মত হননি। পিতৃব্য বিবাহ করলেন, সেই থেকে পিতৃব্যপত্নী খুল্ল-মা, তাদের বিষচোখে দেখলেন। সারাদিন পরিশ্রমের পর পিতৃব্য গৃহে ফিরলে অভিযোগ আর অভিযোগ। অল্পবয়স থেকেই সোপাক প্রহার খেয়ে আসছে। তর্জন-গর্জন, চপেটাঘাত, মুষ্ট্যাঘাত, কেশের গুচ্ছ ধরে প্রহার। সেদিন মা গেছেন প্রতিবেশী গৃহে মহানসীর কাজে। তাঁকে গৃহের কাজ করা ছাড়াও উপার্জন করে এনে দিতে হয় পিতৃব্যকে। তৈলের ভাঁড় তুলতে গিয়ে হাত থেকে পড়ে যায়। খুল্ল-মা আর খুল্ল-পিতা তাকে এমন প্রহার করলেন যে সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলল। কতক্ষণ পর জ্ঞান এসেছে সে জানে না, কিন্তু জ্ঞান হতে দেখল ঘোর অন্ধকার চারিদিকে, টুপ টুপ করে হিম ঝরছে। অন্ধকারে গোল গোল জ্বলন্ত চক্ষু, ভয়ে আর্তনাদ করে উঠল। আর্তনাদে চক্ষুগুলি সামান্য দূরে সরে গেল, কিন্তু আবার একটু পরে কাছে ঘেঁষে আসতে লাগল। সোপাকের দুর্বল শরীর, প্রহারের ক্ষতগুলিতে যন্ত্রণা হচ্ছে। সে কিছু একটা পিণ্ডজাতীয় বস্তুর সঙ্গে বাঁধা। চেষ্টা করেও নিজেকে মুক্ত করতে পারল না সে। বস্তুটা কী? কোনও বৃক্ষ বা যষ্টি জাতীয় কিছু তো নয়! বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। আকাশ ঘোর কালো। প্রচুর মেঘ সঞ্চয় হয়েছে। সেই বিদ্যুতের আলোয় সোপাক দেখল সে একটি শবদেহের সঙ্গে বাঁধা। আতঙ্কে বালক চিৎকার করে উঠল— ‘মা, মা বাঁচাও। কে কোথায় আছো বাঁচাও…।’
অন্ধকারে কে কোথা থেকে বলে উঠল—‘কে তুমি? কোথায় আছো?’
—আমি সোপাক। একটি মৃতদেহের সঙ্গে বাঁধা আছি।
বিদ্যুতের আলোয় পথ হাতড়ে হাতড়ে এক শ্ৰমণ এসে দাঁড়ালেন। দ্রুত হাতে তার বাঁধন খুলে দিলেন।
—কী ভাবে তুমি এখানে এলে বালক?— স্নেহসিক্ত কণ্ঠ।
সোপাক ফুলে ফুলে কাঁদতে কাঁদতে সব বলল।
—হায় তথাগত, মানুষ এত নিষ্ঠুর!
আর একটি কণ্ঠ বলল— আনন্দ ওকে আমার কোলে দাও।
দুই শ্ৰমণ মিলে তাকে বেলুবনে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেই মধ্যরাত্রে তার সর্বাঙ্গ উষ্ণ জলে ধুইয়ে নানা স্থানে অনুলেপন লাগানো হল। পরিষ্কার বস্ত্র পরানো হল। গরম দুধ পান করানো হল। সারা রাত্রি দুজনে তার ব্যথাক্লিষ্ট শরীরে কোমল স্পর্শ বুলিয়ে বুলিয়ে তাকে ঘুম পাড়ালেন। যখন ঘুম ভাঙল চারদিক আলোয় আলো। সে বুঝতে পারল অপূর্ব চন্দনের গন্ধর মধ্যে অতিশয় সুখে সে শুয়ে আছে। এতো সুখ, এতো শান্তি, এতো স্নেহ যেন সে পায়নি কখনও। সেই কক্ষে তখন কেউ ছিল না যেন। অথচ তার কোনও ভয় তো হলই না, একটা নির্ভরতার ভাব, আশ্রয়ের আশ্বাস তাকে ঘিরে রইল। নিশ্চিন্তে পাশ ফিরে আবার নিদ্রা যেতে যাচ্ছিল সে, একটি গম্ভীর কিন্তু কোমল কণ্ঠ তাকে বলল—এই হল সংসার, সোপাক, এই-ই সংসার, এই-ই সংসার। এখানেই কি ফিরে যেতে চাও?
—না, না, কখনোই না।
—বিলাস, ব্যসনের সুযোগ পাবে না বালক। নিয়ম পালন করতে হবে। তবে বিদ্যা শিক্ষা পাবে।
—মা? আমার মা?
—মাকেও পাবে বচ্চ। সংঘে আসবে কী?
—আসব দেবতা।
—আমি দেবতা নই সোপাক।
—তবে?
—আমি মানুষ।
—আমার মতো?
—তোমারই মতো?
—আমি যে চণ্ডাল!
—তোমার সঙ্গে আমার কোনই পার্থক্য নেই, বালক। শুধু আমি পথ পেয়েছি। তুমি এখনও পাওনি।
সোপাক হন হন করে হাঁটছিল। তার পেছন থেকে এক অশ্বারোহী তীব্র বেগে চলে গেলেন। সোপাক চোখ দুটি ঢেকে ফেলল। ধুলো উড়ছে।
ধূলি। সর্বত্রই শুধু ধূলি, শুধু ভস্ম। সোপাকের অস্তিত্বটি যেন একটি শুক্তির মধ্যে মুক্তার মতো। শুক্তির আশ্রয়ে আছে সে, কিন্তু সেই শুক্তির জোড় সামান্য খোলা। সে টের পায় ঘূর্ণমান ধূসর কল্লোল তাকে ঘিরে। বহু প্রকার মাংসজীবী মৎস্য, জলজন্তু লাঙুল ঝাপটায়। এই রাজগৃহের বাইরে এখনও সে যায়নি। রাজগৃহই তার পৃথিবী। কিন্তু রাজগৃহের পথে বেরোলেই মনে হয়—কেমন অশান্ত, উত্তাল, কেমন হিংস্র এই নগর, যেন দাঁতে নখে তাকে খেতে আসছে। অশ্বগুলি, রথগুলি বুঝি তাকে পিষে ফেলে চলে যাবে। যদি দুইয়ের অধিক তিন ব্যক্তিও কাছাকাছি আসে সোপাক সভয়ে শশক শিশুর মতো পথ ছেড়ে দূরে সরে যায়। এরা যেন সোপাককে দেখতে পাচ্ছে না। যদি তাকে মাড়িয়ে চলে যায়? কিম্বা যদি সহসা হত্যা করে? ধূলি চারদিকে ধূলি উড়ছে। সংসারের ধূলি, মানুষের বিচিত্র কামনা-বাসনার ধূলি। লোভ, রোষ, দম্ভ, ঈর্ষার ধূলি সর্বব্যাপী এক ভয়াল ঘূর্ণিঝড়ের মতো রাজগৃহ নগরকে ঘিরে ঘিরে উৎক্ষিপ্ত করতে চাইছে। ওই যে অশ্বারোহী চলে গেল, কিসের অত বেগ, কোথায় ওকে পৌঁছতে হবে নিমেষের মধ্যে? কিম্বা পালাচ্ছে কী? কোথাও থেকে পালাচ্ছে কী? যেন উন্মত্ত ক্রোধের এক দীর্ঘ পুচ্ছ পথের মধ্যে রেখে গেল। ক্রোধ? কিম্বা…কিম্বা…শোক? উন্মত্ত শোক? দুহাতে মুখ ঢাকে কিশোর সোপাক। এই ধূলির ঝড়ের মধ্যে সে যে একা বেরিয়েছে। কেমন করে পথ পাবে?
মায়ের কাছে বহু কষ্টে পৌঁছল সোপাক। তিনি এই সময়টা ভিক্ষুণী উপাশ্রয় ছেড়ে থাকেন বৈভারগিরির ওপরে একটি কন্দরে। নির্জন সাধনা হয়ত তাঁর লক্ষ্য। কিন্তু এই নির্জন গিরিগুহায় তিনি প্রাণভরে পুত্রকে আদর করতে পারেন। কেউ দেখবার নেই। কাষায় চীবর পরিহিতা শ্রমণা পুত্রকে বুকে টেনে নেন।
—সোপাক, সোপাক, বচ্চ আমার, কাঁপছিস কেন বাপা?
—মা। নগরীতে বড় ভয়। বুঝি কিছু অমঙ্গল ঘটবে।
—এ তোর কী হল সোপাক। কেন এতো ভয়? এতো বুঝিস কেন? আহা যদি তথাগত তোকে আমার কাছে থাকতে দিতেন! না, না, মা তো তোকে রক্ষা করতে পারেনি। তিনিই তোকে রেখেছেন। তিনি যা বলবেন তাই করবি।
—তাই করি মা। তাই করি। যখন তাঁর সঙ্গে থাকি, বেলুবনেই হোক, সিতবনেই হোক, কোনও ভয় থাকে না তো মা! বাইরে পা দেবামাত্র নগর যেন লুব্ধ পশুর মতো আমাকে তাড়া করে আসে। —সোপাক কেঁদে ফেলে।
—ভগবান তথাগতকে বলিস নি এ কথা?
—না।
—বলবি। বিলম্ব করবি না।
—শোন সোপাক একটু কাঞ্জিক খা। গোধূমের পুরোডাশে ভিজিয়ে।
—কোথায় পেলে মা? সঞ্চয় করছো?
—না, বাপা। গিরিগুহায় থাকি। মোড়ানো মাথা। গায়ে শ্রমণার বস্তর। লোকে মনে ভাবে কত বড় সন্ন্যাসিনী বুঝি। দিয়ে যায়। আজ প্রভাতেই দিয়ে গেছে।
—মা, আমরা একাহারী। সারাদিন ভিক্ষার পর মধ্যদিনে খাই।
—মরে যাই বচ্চ, তুমি বালক, তুমি কখনও এতোক্ষণ না খেয়ে থাকতে পারো? প্রভাতে যাউ বা কাঁজি খেতে তো নিষেধ নাই।
—কিন্তু মা, পুরোডাশ?
—খাও সোপাক, মায়ের হাতে খেলে তোমার উপাধ্যায় রাগ করবেন না।
—তা হলে তুমিও খাও মা।
দুখিনীর চোখ বেয়ে জল পড়তে লাগল। বললেন—আবার আমি কেন বচ্চ! আমি তো আর তোমার মতো বালক নই?
—তা হলে আমিও খাবো না মা—সোপাক উঠে দাঁড়ায়।
—বোস, বোস, কোথায় যাস বচ্চ। ঠিক আছে, আমি খেলে যদি তোর অনাগামি ফল লাভ হয় তো খাচ্ছি।
গিরিগাত্র বেয়ে মাতা পুত্র নেমে আসে।
—কোন দিকে যাবি এখন সোপাক?
—পুব পল্লীতে যাই মা? সোপাক এখন অনেকটা শান্ত।
—তাই এসো বচ্চ। ওদিকে হাট রয়েছে। যা পাবে নিয়ে তাড়াতাড়ি সঙ্গে চলে যেও।
পুব পল্লী থেকে ফেরবার পথে একটি রোরুদ্যমানা রমণী সোপাকের পথ রোধ করল। সোপাকের চোখে ধন্দ। একটু পরে সে বুঝতে পারল এ তার খুল্লমাতা।
—সোপাক, সোপাক, রুরু কোথায় জানো?
—রুরু? রুরু কে?
—ছল করছো? রুরুকে জানো না? রুরু আমার ছোট ভাই।
তখন সোপাকের মনে পড়ল রুরু নামে এক ব্যক্তি অদ্ভুত অদ্ভুত অসময়ে তাদের গৃহে আসত বটে। তার খুল্লমার অতিশয় আদরের ভাই। এলেই গৃহের যাবতীয় সুখাদ্য তার সামনে ধরে দিতেন খুল্লমা।
—রুরু কদিন আমার কাছেই ছিল। সন্ধ্যায় কাজ আছে বলে বেরোলো। আজ দেখো সুয্যি মাঝ আকাশে চড়তে গেল তবু তার দেখা নেই। সে আমাকে নিশ্চয় করে বলেছিল আজ গৃহে আমার কাছে পলান্ন পায়স খাবে…কী সোপাক কথা বলছো না কেন?
সোপক একটা গভীর বিস্ময়ের ঘোরের মধ্যে ছিল। যে রমণী এক বালককে সামান্য কারণে বা অকারণে প্রহার করে মৃতপ্রায় করে ফেলে তাকে আমক শ্মশানে মৃতদেহের সঙ্গে বেঁধে রেখে আসতে পারে, সে-ই আবার আরেক ব্যক্তির ফিরতে বিলম্ব হওয়ায় এমন ব্যাকুল হয়ে কাঁদে! কী অদ্ভুত মানুষ! কী অদ্ভুত গতি স্নেহের!
—কথা বলছো না কেন?
—আমি কী করে জানবো? সোপাক শান্ত স্বরে বলে।
—তোমারই অভিশাপ। তোমারই অভিশাপ। সমন হয়েছ। ইদ্ধি হয়েছে। এখন আমাদের ওপর শোধ নিচ্ছো। —ক্রুদ্ধ স্বরে বলল রমণী। তারপর সহসা কেমন যেন ভেঙে সোপাকের পায়ের কাছে পড়ে গেল। গদ গদ কণ্ঠে বলতে লাগল—সমন সোপাক, সমন সোপাক দয়া করো, কোথায় কী বিপদে পড়েছে রুরু আমায় বলে দাও। আমি তোমায় দান দেবো। তার পায়ে মাথা খুঁড়তে লাগল খুল্লমাতা।
সোপাকের চলে যেতে ইচ্ছা হচ্ছে অথচ সে যেতে পারছে না। তার পা দুটি বন্দী। তার সারা শরীর ঘিরে কেমন ভয়ের ঘোর। প্রত্যূষে রাজপথে যেমনটা সে অনুভব করেছিল। যেন দলে দলে সশস্ত্র মানুষ আসছে। একে অপরের মাথা কেটে নিচ্ছে। রুধির বইছে। পথে পথে রুধিরের স্রোত। সে শুধু অস্ফূটে বলল—বিপদ, বড় বিপদ জননী। রাজসভায় যান, সাহায্য চান।
হাতদুটি খসে গেল সোপাকের পা থেকে। রমণী ছুটে চলে গেল। সোপাকের পিণ্ডপাত্র হাত থেকে পড়ে গেছে। তার বাসিটি কোথায় তাও সে জানে না। উদ্ভ্রান্তের মতো সে বেলুবনে ফিরে এলো।
সন্ধ্যাবেলায় আমক শ্মশানে শবের স্তূপের মধ্যে রুরুর মৃতদেহ পাওয়া গেলে, ধীরে ধীরে নগরে সঙেঘ সর্বত্র রটে গেল চণ্ডাল বালক সোপাকের অলৌকিক ইদ্ধিলাভ হয়েছে। তার উপাধ্যায় আদেশ দিলেন সোপাক এখন ভিক্ষার্থে নগরে বেরোবে না। অন্য ভিক্ষুরা তাঁদের ভিক্ষাভাগ দেবেন তাকে। সে শুধু ধ্যান এবং নিভৃত-শ্রবণে শিক্ষালাভে দিন কাটাবে।
বিম্বিসার বললেন—পথে পথে ঘোষণা করাই। কেউ যদি রুরুর মৃত্যু সম্বন্ধে কিছু জানে। …আমার রাজ্যে আগে কখনও এমন ঘটেনি সোমা।
সোমা শিউরে উঠে বলল—মহারাজ, চর মাত্রেই বিপজ্জনক জীবিকা নেয়। কখন…কোথায়…কীভাবে…। কী প্রয়োজন? ছেড়ে দিন।
—প্রয়োজন? তোমায় যে বললাম এ রাজ্যে আগে কখনও এমন ঘটেনি সোমা। তোমার কি মনে হয় কুনিয়র লোকেরাই ওকে হত্যা করল?
—কোনও সিদ্ধান্তে আসবেন না মহারাজ। আমার কাছে কর্ম করতে এসে লোকটি নিহত হল, এটাই আমার দুঃখ…লজ্জা…। সোমার মুখ অতি বিষণ্ণ।
প্রথমটা মহারাজ নীরবে ছিলেন। সম্ভবত ইতিকর্তব্য কী ভাবছিলেন। হঠাৎ মুখ তুলে বললেন—তোমার কাছে কর্ম করতে ‘এসে’ লোকটি নিহত হল? কোনও বিশেষ অর্থে বলছো না কি? ও কি নিহত হবার পূর্বে তোমার কাছে এসেছিল।
—ও তো ইদানীং প্রায় প্রতি রাত্রেই আসত…সোমা বিবর্ণ মুখে বলে।
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালেন একবার মহারাজ।
সোমা বলল—মহারাজ, যাই হোক, ও বড় মূল্যবান সংবাদ দিয়ে গেছে। এখন আপনার প্রধান কর্তব্যই হবে কুমারকে ছলে বলে চম্পায় পাঠানো। অমাত্য বর্ষকারকে পদচ্যুত করবেন কি না ভাবুন।
—বর্ষকারকে পদচ্যুত করলে আরেকটি মহাশত্রু সৃষ্টি করা ছাড়া কিছুই হবে না সোমা।
—সেইজন্যই ভাবতে বলছি। অন্ততপক্ষে তাকে দূরে রাখুন। অমত্য চন্দ্রকেতু যাতে আপনার কাছে কাছে থাকেন, সেই মতো ব্যবস্থা করতে হবে। অমাত্য সুনীথ সম্পূর্ণভাবে বর্ষকারের অনুবর্তী। স্বয়ং উদ্যোগী হয়ে কিছু না করলেও তাঁকে বিশ্বাস করা যায় না। আপনার রক্ষীদলকে আরও সুসংবদ্ধ করুন।
অন্যমনস্কের মতো বিম্বিসার বললেন— বন্ধুরা শত্রু হয়ে যাচ্ছে, রক্ষী নিয়ে কী করবো সোমা?
কিন্তু রুরুর মৃত্যু নিয়ে নগরে যে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছিল, তা হঠাৎই মরে গেল। ঘটনাটা ঘটেছিল এইভাবে:
সেদিন স্থবির সারিপুত্ত ভিক্ষায় বেরিয়েছিলেন। পূর্বপল্লীর মুখে লোক জমাছিল।
—একটি লোক নিহত হল, তার হন্তা কে বোঝা যাবে না? সকলে ভারী উত্তেজিত।
—শাস্তি হবে না অপরাধীর?
—বাঃ ভালো রাজ্য হয়েছে…
—আগে কখনও এমন হয়নি!
রাজা যদি সমনের পরামর্শে রাজ্য চালান। তো এমন হবে না তো কী?
—কে বলল আগে এমন হয় নি? …গম্ভীর কণ্ঠে সারিপুত্ত বললেন, ফিরে তাকাল সবাই।
অসুরেন্দ্র ভরদ্বাজ এদের দলপতি। সে-ই সবচেয়ে সোচ্চার।
—আপনি বলছেন আগে হয়েছে? —সারিপুত্তকে দেখে অসুরেন্দ্র সসম্ভ্রমে বলল।
—হয়েছে যে এমন অনুমান করতে পারি সমন সোপাকের ঘটনা থেকে।
—সমন সোপাকের ঘটনাটা কী?
সোপাকের পিতৃব্য আর তার পত্নী তাকে প্রহার করে অর্ধমৃত অবস্থায় আমক শ্মশানে শবদেহের সঙ্গে বেঁধে আসে। ঘোর অমাবস্যার রাত্রে। একাদশ বর্ষীয় বালক একটি…আপনারা কি মনে করেন একটি বালককে হত্যার চেষ্টা ঘৃণ্য অপরাধ নয়।
অসুরেন্দ্র শিউরে উঠে বলল— বলেন কী? তারপরে?
—তারপর সমন আনন্দ ও ভগবান তাকে উদ্ধার করেন, সে এবং তার দুঃখিনী মা দুজনেই এখন সঙ্ঘে যোগ দিয়েছেন। …এই রুরু তো শুনতে পাচ্ছি সেই পাষণ্ড পিতৃব্যেরই শ্যালক!
—আপনি কি বলছেন বালক সোপাকের হয়ে কোনও মহাশক্তিই এই প্রতিশোধ নিয়েছেন?
—আমি কিছুই বলছি না ভদ্র, আপনারা বলাবলি করছিলেন এ রাজ্যে আগে কখনও এমন হয় নি…আমি তারই সাধ্যমতো উত্তর দিলাম। …আর ভদ্র এ জন্য রাজাকে দোষ দেওয়া অনুচিত। কোথায় কোন বালকের খুল্লমাতা-পিতা তাকে প্রহার করে মেরে ফেলছে রাজা কী করে জানবেন? যদি না বালকের প্রতিবেশীরা তাঁকে জানায়? রাজ্য-শাসনযন্ত্রের কতকগুলি স্তর থাকে ভদ্র। প্রাথমিক স্তর পরিবারে। তার পরে সমাজ। সমাজ…যদি এই সকল অন্যায়-অবিচারের প্রতি চোখ বুজিয়ে থাকে, শাসন যন্ত্র কী করবে? সেক্ষেত্রে যতগুলি পল্লী ততগুলি চর, এবং উপযুক্ত সংখ্যক রাজভট রাখা প্রয়োজন। আপনার পল্লীতে আপনি গৃহের বালক-বালিকা-নারী-দাসেদের প্রতি কী ব্যবহার করছেন দেখবার জন্য চর ঘুরঘুর করলে আপনার ভালো লাগবে?
অসুরেন্দ্র বললেন— সত্যই ভালো লাগবে না। আপনি ঠিকই বলেছেন সমন।
—প্রতিবেশীর দায়িত্ব আছে, সমাজের দায়িত্ব আছে। শাসনযন্ত্র একা কী করবে? বলতে বলতে স্থবির সারিপুত্ত চলে গেলেন।
রুরুর হত্যা থেকে এখন সমালোচনাটি ঘুরে গেল। সোপাকের প্রতি তার আত্মীয়দের অমানুষিক ব্যবহারের প্রতি এবং অনিবার্যভাবে সোপাকের অলৌকিক ক্ষমতার প্রতি।
১৭
দেবরাতপুত্র চণক এসব কিছুই জানতেন না! জানবার অবস্থাও তাঁর ছিল না। জীবনে কখনও তিনি এরূপ উত্তেজিত হননি। সে রাত্রে গান্ধারভবনে তিনি আদৌ ফেরেননি। চলে গিয়েছিলেন উত্তরদুয়ার পেরিয়ে নগরীর বাইরে। প্রত্যূষে দুয়ার খোলবামাত্র। নগরপ্রাচীর, নগরপ্রত্যন্ত, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গ্রাম, শস্যক্ষেত্র তারপর ক্রমে ক্রমে পাটুলিগ্রাম। এবং গঙ্গা। পাটুলিতে গঙ্গার ধারে পাথরের সুন্দর বিশ্রামগৃহ। এইখানে বসে জলের দিকে তাকিয়ে চণক স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন। তিনি সম্পূর্ণ অন্যমনা। নানা ভাবনা ও ভাব তাঁর চিত্তের মধ্য দিয়ে যাওয়া-আসা করছে, কোনটিই স্থিত হচ্ছে না। প্রায় তিন দিন দুই রাত তাঁর এখানেই কেটে গেল। অতিশয় ক্ষুধা বোধ হলে হাটে গিয়ে কোনও সমাশালয় থেকে খেয়ে আসেন। চিত্তককে খাওয়ানো কোনও সমস্যাই নয়। পাটুলি অত্যন্ত সম্পন্ন গ্রাম। অশ্বরক্ষার জন্য মন্দুরাও এখানে আছে। এই বিশ্রামগৃহের অদূরেই আছে একটি ভালো মন্দুরা। চিত্তককে আপাতত সেখানেই সমর্পণ করেছেন তিনি। গঙ্গার বহমান জলধারার দিকে তাকিয়ে তাঁর প্রহরগুলি কাটছে।
তৃতীয় দিন সকালে সহসা তাঁর অত্যন্ত কাছে বসে কেউ বলল– দৈবরাত, আপনি এখানে!
চমকে মুখ তুলে চণক দেখলেন— অমাত্য বর্ষকার!
কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থেকে চণক বললেন— আমিও তো আপনাকে একই প্রশ্ন করতে পারি অমাত্যবর?
—প্রশ্ন করলে উত্তর দেবো ভদ্র। আমি এবং সুনীথ এই স্থানে অর্থাৎ গঙ্গাতীরে একটি দুর্গের উপযুক্ত স্থান দেখে বেড়াচ্ছি। অর্থাৎ সন্ধান করছি।
—দুর্গ? ও—চণক অনুৎসুক স্বরে বললেন।
—আপনি কি মনে করেন না পাটুলি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান? পূর্ব-দক্ষিণের বাণিজ্যদ্বার, শক্তিশালী বজ্জি রাজ্যের ঠিক বিপরীতে এর অবস্থান। গঙ্গা-হিরণ্যবাহর সঙ্গমস্থল। ধনার্থী-রণার্থী-পুণ্যার্থী সবাইকার প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম এই অনুপম স্থানটি…নয়?
চণক তখনও নীরব রয়েছেন দেখে বর্ষকার গলায় একপ্রকার আক্ষেপের শব্দ করে উদ্বিগ্ন স্বরে বললেন— হল কি দৈবরাত? আপনিও কি আবার সোতাপত্তি মগ্গে প্রবেশ করলেন নাকি? সর্বনাশ!
চণক হঠাৎ যেন ঘুম ভেঙে জেগে উঠলেন, বললেন— কী বলছিলেন অমাত্য?
—বলছিলাম, মহারাজকে কিছুতেই বোঝাতে পারছি না, এই পাটুলিতে দুর্গ রচা প্রয়োজন। উত্তর-পশ্চিম থেকে মগধ আক্রান্ত হলে শত্রুসৈন্য এই স্থানেই অবতরণ করবে। তাদের বাধা দেবার উপযুক্ত ব্যবস্থা এখানেই থাকা উচিত। নয় কী!
চণক চারদিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে বললেন— হতে পারে…নিমেষ পরে আর একটু উৎসাহ ও আস্থার সঙ্গে বললেন—ঠিকই। রাজগৃহ পর্যন্ত তাদের যেতে দেওয়া ঠিক নয়…
বর্ষকার নিজের ঊরু চাপড়ে বললেন— ঠিক এই কথাটাই আমি মহারাজকে বোঝাতে পারছি না। উনি সর্বদাই রাজগৃহের প্রাচীর, প্রাকৃতিক সুরক্ষা ইত্যাদির কথা বলে থাকেন। রাজগৃহ যেন মহারাজের প্রথম সন্তান। আর কিছু তার সমকক্ষ হোক তা তিনি চান না। অথচ এরূপ কোনও পক্ষপাত রাজার উপযুক্ত নয়। দৈবরাত, আপনি যদি সময় করে মহারাজকে বোঝান…
চণক জিজ্ঞেস করলেন— মহারাজের সম্মতি ছাড়াই কি আপনারা দুর্গ-স্থল অনুসন্ধান করছেন?
—করছি দৈবরাত, ব্যক্তিগত উদ্যোগে। সমস্যাটা হল কি জানেন? আমরাও দণ্ডনীতি জানি, বার্তা জানি, তার ব্যবহারিক প্রয়োগ করতে করতে বহু সমস্যা ও তার সমাধান মাথায় আসে। শুধু মহারাজের আজ্ঞাবহ ভৃত্য হয়ে কাল কাটাতে পারি না।
অমাত্য সুনীথ এই সময়ে উত্তেজিত হয়ে কোথা থেকে ছুটে এলেন।
—অমাত্য বর্ষকার, অমাত্য বর্ষকার! দুর্গের উপযুক্ত স্থান আর একটু পশ্চিমে পেয়েছি।
চণককে দেখে তিনি থেমে গেলেন।
—মহামান্য দৈবরাত যে! আপনি এখানে?
চণক উত্তর দিলেন না। একটু হাসলেন শুধু। বর্ষকার ও সুনীথ পরস্পর চোখ চাওয়াচাওয়ি করলেন।
চণক বললেন— আমার প্রত্যাবর্তনের সময় হলো। নমস্কার অমাত্যগণ।
কিছুদূর গিয়ে তাঁর কী মনে হল, দাঁড়ালেন, সামান্য পথ ফিরে এসে বললেন— আমি কোনও চরকর্ম করতে এখানে আসিনি।
এবার তিনি দ্রুত মন্দুরার দিকে গেলেন, চিত্তককে সংগ্রহ করলেন। কিছুক্ষণ পরেই রাজগৃহ অভিমুখে তাঁর ঘোড়া ছুটল। তিনি বোধিকুমার ও জননী সুমেধার সঙ্গে সাক্ষাতের কথা ভুলে গিয়েছিলেন।
চলতে চলতে তাঁর মনে হল— শ্ৰীমতী? শ্রীমতী কি ফিরেছে? যদি তার সন্তান নির্বিঘ্নে জন্মে থাকে তা হলে এতদিনে তার বেশ কয়েক বৎসর বয়স হয়ে যাবার কথা। তাকে তিনি তক্ষশিলায় পাঠাবেন। রাজার কাছে ওই লম্পটটিকে হত্যা বিষয়ে স্বীকারোক্তি করা ভাল। চন্দ্রকেতু যদি বিদ্ধ হত? তা হলে এতক্ষণে রাজগৃহে কোলাহল পড়ে গেছে। তিনি অনেক চেষ্টায় মনটিকে অন্য চিন্তায় ফেরালেন। দ্রুত পথ অতিক্রম করতে লাগলেন। একটি রথ চলে গেল তাঁর পাশ দিয়ে, রথ স্বহস্তে চালাচ্ছেন একজন বীরপুরুষ, পাশে সূত। ভেতরে বসে একটি শ্রমণ। দৃশ্যটি অদ্ভুত লাগল তাঁর। কে ওই বীরপুরুষ? রূঢ়দর্শন। কিন্তু সম্ভবত বয়সে একেবারেই যুবক। দাম্ভিক, রীতিমতো শক্তিধর… প্রায় রাজগৃহের প্রাকার পর্যন্ত চলে আসার পর চণকের মনে হল— এ নিশ্চয় কুমার কুনিয়।
ভেতরে শ্রমণটি কে? তথাগত? তিনিও তীব্র বেগে ঘোড়া ছুটিয়েছিলেন। রথটিও চলেছিল আট পা তুলে ঊর্ধ্বশ্বাসে। কাষায় বস্ত্র ও মুণ্ডিত মস্তকের একটা স্মৃতি রয়েছে মাথায়। কিন্তু তথাগত নয়। অন্য কেউ। কে?
গান্ধারভবনে গিয়ে স্নান সাজসজ্জা আহার করে পরিতৃপ্ত হলেন চণক। তীব্র ইচ্ছা হচ্ছে পুষ্পলাবীতে যেতে। জানেন না, আজ অনুষ্ঠান আছে কি না, কিন্তু শুনতে ইচ্ছা হচ্ছে প্রস্ফুটিত কুসুমের গান, দেখতে ইচ্ছা হচ্ছে সেই মহাকালের নৃত্য। কিন্তু গোপনে। কেন কে জানে জিতসোমার মুখোমুখি হতে তাঁর ইচ্ছা হচ্ছে না।
সন্ধ্যার পূর্বেই তিনি রাজপ্রাসাদে মহারাজ বিম্বিসারের দর্শনার্থী হয়ে গেলেন। কূটকক্ষে আহূত হলেন চণক।
—মহারাজ, আপনাকে আমার ভ্রমণ-বৃত্তান্ত তো এখনও কিছুই বলা হয়নি— কেমন অস্থির যেন আজ চণক রাজাও যেন কেমন অন্যমনা। বিমর্ষ।
—আমি শোনবার জন্য উৎসুক হয়ে আছি আচার্যপুত্র। বললেন, কিন্তু কেমন নিরুৎসুক।
—শুনুন, দু-তিনটি নতুন জনপদ বসিয়ে এসেছি, বন কেটে। অর্থ দিয়েছেন ভদ্দিয়র শ্রেষ্ঠী মেণ্ডক। আর প্রচার করে এসেছি।
—কী প্রচার করেছ চণক?
—প্রচার করেছি মহারাজ বিম্বিসার প্রজাপালক, উদারহৃদয়। মহারাজ পিতার মতো বৎসল, দেবতার মতো শক্তিধর, কিন্তু তিনি প্রজাদের কাছ থেকে বিপদের সময়ে সৈন্যবলের প্রত্যাশী। তিনি চান প্রতিটি গ্রাম আত্মরক্ষায় সমর্থ হোক।
বিম্বিসার উঠে বসলেন, বললেন— তুমি তোমার উপযুক্ত কাজ করেছ আচার্যপুত্র। তুমি চক্রবর্তী রাজার চক্রস্বরূপ। কিন্তু হায় এ চক্র ধারণ করবার মতো রাজা বুঝি আর নেই!
—এ কথা বলছেন কেন মহারাজ?
—নানান জটিলতায় ক্রমশই জড়িয়ে যাচ্ছে রাজ্যের ভাগ্য, রাজার ভাগ্য…
মহারাজের হতাশাব্যঞ্জক মনোভাবকে প্রশ্রয় দিলেন না চণক। বললেন— ভাল কথা, আমি একটি গর্হিত কাজ করে ফেলেছি। দণ্ডনীতির দিক থেকে গর্হিত, কিন্তু আমার ব্যক্তিগত নীতির দিক থেকে কাজটি শ্লাঘ্য।
—অর্থাৎ! বিম্বিসার ভ্রূ কুঁচকে তাকালেন।
—‘পুষ্পলাবী’র নগরশোভিনীর গৃহে রাত্রিচর একটি লম্পটকে আমি হত্যা করেছি।
—তুমি! বিম্বিসার চমকে উঠলেন— সোমা জানে?
—অবশ্যই! মুমূর্ষু প্রণয়ীকে অন্তিম জলগণ্ডুষ তো সে-ই দিল। আপনি বিচার করে আমার যা শাস্তি প্রাপ্য মনে করেন, দিন।
বিম্বিসার গম্ভীর হয়ে বললেন— এ অপরাধের প্রকাশ্য বিচার তো হওয়া সম্ভব নয় দৈবরাত!
—কেন?
—তাতে শুধু তুমি নও, জিতসোমা, মগধের শুভাকাঙ্ক্ষী অমাত্যরা এবং শেষ পর্যন্ত মহারাজ বিম্বিসারও জড়িয়ে পড়বেন।
চণক অনুভব করলেন, তিনি ধীরে ধীরে আবার উত্তেজিত হয়ে উঠছেন।
মহারাজ বললেন— চণক, জিতসোমা আমার অমাত্য, পূর্বেও তোমাকে বলবার চেষ্টা করেছি, বিশ্বাস করনি। আবারও বলছি, নগরশোভিনীর এই আয়োজন, এ তার ছদ্মবেশ। রাত্রে তার কাছে প্রণয়ীরা যায় না। যায় চরেরা। এবং বিম্বিসার-ভক্ত অমাত্যরা। কুনিয়-পন্থী অমাত্যদেরও সে সমান আতিথ্য দেয়, কিন্তু তা শুধুই তার রাজকার্য করতে। যে ব্যক্তিকে তুমি হত্যা করেছ, সেই রুরু একটি সামান্য চর।
চণক বিস্ময়ে নির্বাক হয়ে রইলেন।
বিম্বিসার বললেন— জিতসোমা প্রশংসনীয় অমাত্য-কর্ম করেছে চণক। অতি অল্পকালের মধ্যে সে শ্রেষ্ঠী ও অমাত্যদের মধ্যে কারা বিম্বিসারের শত্রু, আবিষ্কার করেছে। আবিষ্কার করেছে, বিম্বিসারের ঘনিষ্ঠতম অমাত্যরাই কুমার কুনিয়র সঙ্গে ষড়যন্ত্রে যোগ দিয়েছেন। এবং এঁদের প্ররোচিত করছেন একজন শাক্যপুত্রীয় শ্রমণ—দেবী রাহুলমাতার সহোদর— ভগবান তথাগতর নিজের শ্যালক—স্থবির দেবদত্ত। … তাই বলছিলাম, চক্র হল কিন্তু চক্র ধারণ করার মতো রাজা হয়ত আর থাকবে না।
চণক ঘটনার বিবরণে বিহ্বল হয়ে গিয়েছিলেন। এবার তিনি পাটুলি গ্রামে দুর্গ, বর্ষকার-সুনীথ, এবং রথারোহী কুমার ও শ্রমণের দৃশ্যগুলি পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কিত করতে পারলেন। সেই সঙ্গে সোমার জল-ভরা চোখ ও দৃপ্ত ভঙ্গি মনে পড়ে তিনি নির্বাক হয়ে রইলেন। ব্যক্তিগত জীবনের জটিলতায় এমনই বিভ্রান্ত ছিলেন যে মহারাজের শেষ কথাগুলি তাঁর কান এড়িয়ে গেল। তিনি অভিমানহত গলায় বললেন— সোমার সমস্ত ব্যাপারটি আমায় পরিষ্কার করে বলা কি আপনাদের উচিত ছিল না?
—সমস্তটাই গুপ্ত। কেউ জানতে পারলে সর্বনাশ!
—আমার থেকেও গুপ্ত?
—তোমাকে সব খুলে বলতে নিষেধ ছিল দৈবরাত।
কার নিষেধ মহারাজ?
—সোমার।
—এইসব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে একজন নারীর নিষেধের কী মূল্য মহারাজ!
—কিন্তু এই নারী বিদুষী, দণ্ডনীতিতে অভিজ্ঞ। নূতন পথ প্রদর্শন করছে সে, তার মতামতের মূল্য নেই? তুমি তার আচার্য, তুমিও এরূপ বলছো!
—মহারাজ, সোমা বিদুষী, তত্ত্বজ্ঞারূপে আপনার রাজ্যের গোপন ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে পথ নির্দেশ করছে। কিন্তু আমাকে জানাতে নিষেধটা সে করেছে অভিমানে। এবং নারী অতিমাত্রায় আবেগতাড়িত ও স্পর্শকাতর বলেই অতিবিদূষী হওয়া সত্ত্বেও তাকে গুরত্বপূর্ণ কাজে নিয়োগ করার আগে দুবার ভাবতে হয়। ব্যক্তিসত্তার থেকে নৈর্ব্যক্তিক কর্মীসত্তা স্বতন্ত্র করতে পারে না সে।
—সকল পুরুষই কি তা পারে?
—পারে না মহারাজ। ঠিকই। কিন্তু পারতে হয় এবং বহুকাল ধরে পারতে পারতে এটা পুরুষের অভ্যাস হয়ে গেছে।
—তা হলে তুমি বলছ, সোমাকে অমাত্য নিয়োগ করে আমি ভুল করেছি?
চণক নীরবে দু দিকে মাথা নাড়তে লাগলেন। যেন, তিনি কী বলবেন ঠিক করতে পারছেন না।
—বলো, কিছু বলো বন্ধু! বিচারটা ঠিক করলে কি না ভাবো।
—ভাবছি, ভাবছি মহারাজ… সোমার অহেতুক গোপনীয়তার কারণে একটি নির্দোষ ব্যক্তিকে হত্যাকারী হতে হল। নিহত হল আরেক ব্যক্তি। নিহতর চেয়ে হত্যাকারীর ভাগ্যই কি ভাল?
হত্যাকারীর ভাগ্য নির্ধারণ, আমি রাজা আমি যা হয় করব। তুমি এ নিয়ে অনর্থক চিন্তা না-ই করলে!
—মহারাজ, সে চিন্তার কথা বলছি না। একটি ব্যক্তিকে শুধু শুধু হত্যা করেছি এ কথা ভাবলে নিজেকে কলঙ্কিত লাগে ভয়ানক। চণক ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললেন। —
ক্ষত্রিয়দের ওরূপ কত হত্যা করতে হয়! তা ছাড়া বন্ধু তুমি তো জেনেশুনে করোনি! যাই হোক, আমি তোমাকে শাস্তি দেবো, ভেবো না। শুধু প্রকাশ্যে দেওয়া সম্ভব নয়। এইটুকু। আমার আর একটা অনুরোধ, এই দুঃসময়ে তুমি আমার পাশে, রাজগৃহে থাকো।
ক্ষণকাল ভেবে চণক বললেন— স্বীকৃত হলাম।
কিন্তু এর কয়েক দিন পর বোধিকুমারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গিয়ে চণকের স্বাভাবিক স্থৈর্য আবার টুকরো টুকরো হয়ে গেল।
সকালবেলা রাজগৃহ নগরী রৌদ্রে স্নান করছে। ক্রমশই তপ্ত হয়ে উঠছে পথ। চণক দেখলেন বোধিকুমারের গৃহদ্বার খোলা। সকালে বন্ধ থাকবার কোনও কারণও অবশ্য নেই। কিন্তু মাতা-পুত্র উভয়ে গালে হাত দিয়ে গৃহদ্বারের প্রান্তে বসে আছেন। মুখ যারপরনাই বিষণ্ণ।
চণককে দেখে বিস্ময়ে প্রায় লাফ দিয়ে উঠল বোধিকুমার। আলিঙ্গন করার জন্য এগিয়ে আসছিল। সহসাই সে পিছিয়ে গেল।
—কী ব্যাপার? —চণক হাসিমুখে জিজ্ঞাসা করলেন—সব কুশল তো?
দেবী সুমেধা বললেন—আজ দশম দিন হল।
‘কিসের দশম দিন?’
প্রথমে.কেউ উত্তর দিল না।
একটু পরে বোধিকুমার বলল— শ্ৰীমতীর মৃত্যুর।
‘শ্রীমতী… মারা গেছে?’ চণক ধীরে ধীরে প্রশ্ন করলেন।
সুমেধা বললেন—বচ্চ চণক, মারা গেছে অত্যন্ত দুঃখের কথা, শোকের কথা। কিন্তু তার জন্য শোক করছি না। আজ দশ দিন হয়ে গেল হতভাগিনীর সৎকার হল না।
‘—সে কী? কেন জননী!’
—রাজাদেশে, সমন গৌতমের আদেশে…
—অর্থাৎ?
উত্তরে চণক এই কাহিনী শুনলেন : শ্ৰীমতী সন্তান জন্মের পর দ্বিগুণ রূপ যৌবন নিয়ে রাজগৃহে ফিরে আসে। এবং তার গৃহে নিয়মিত নৃত্য-গীত-সভাও বসাতে থাকে। বোধিকুমার তার নিষ্ক্রয়ের ব্যবস্থা করেছিল, দেবী সুমেধা তাকে সাদরে পুত্রবধূ বলে গ্রহণ করবার প্রস্তাবও দিয়েছিলেন। কিন্তু শ্ৰীমতী সবিনয়ে এ সকল প্রত্যাখ্যান করে পূর্ববৎ জীবনযাপন করতে থাকে। বোধিকুমার নিয়মিত তার সভায় যেত। দিন দশ আগে গিয়ে শোনে শ্রীমতীর প্রবল জ্বর এসেছে। বৈদ্য ঔষধ দিয়ে গেছেন। বিশ্রাম নিতে পরামর্শ দিয়েছেন। প্রতিদিনই সে শ্ৰীমতীর সংবাদ নিতে যেত, কিন্তু দাসী চন্দা দেখা করতে দিত না। তিনদিন জ্বরভোগের পর মধ্যরাতে শ্রীমতীর যন্ত্রণার অবসান হয়। তার দেহ দাসেরা বয়ে নিয়ে যায় শ্মশানে। চিতা জ্বালাবে, এমন সময় সমন গৌতম তাঁর একটি তরুণ শিষ্যকে নিয়ে সেখানে উপস্থিত হন।
—কেমন? এ-ই তো সেই নারী? —সমন শিষ্যকে জিজ্ঞাসা করলেন।
—হ্যাঁ ভন্তে, এই সেই লাবণ্যকোমল, মধুরা, গীতকুশলা, অপরূপা রমণী যাকে দেখে আমার মনে হয়েছে প্রব্রজ্যা প্রকৃতপক্ষে প্রবঞ্চনা ছাড়া কিছু নয়।
সমন হেসে বললেন—ভালো, সেই মোহন দেহকাণ্ডের আর রইল কী? যা কোমল দেখেছিলে তা এখন কেমন কঠিন দেখো, যা উষ্ণ ভেবেছিলে তা শীতল, গীত স্তব্ধ হয়ে গেছে।
—হোক কঠিন, হোক শীতল, হোক স্তব্ধ, তবু কী সুন্দর, কী মোহময় ভন্তে।
শিষ্যর এই কথায় সমন গৌতম শ্ৰীমতীর সৎকার স্থগিত রাখতে মহারাজকে আদেশ করেন। মহারাজও সে আদেশ ঘোষণা করে দেন।
চণক উঠে পড়লেন। দেবী সুমেধা চোখ তুলে তাকালেন, বোধিকুমারকে চোখের ইঙ্গিত করলেন শুধু।
চণক বেরিয়ে গেলেন চক্ষের নিমেষে। বোধিকুমারের এখন একটি অশ্ব হয়েছে। সে অশ্বকে প্রস্তুত করে যেতে যেতে চণক অদৃশ্য হয়েছেন। সে অনুমানে নির্ভর করে দক্ষিণ শ্মশানে পৌঁছল। এখানেই শ্ৰীমতীর শব রয়েছে।
প্রচুর লোক জমেছে শ্মশানের মুখে। বোধিকুমার দেখল উচ্চমঞ্চে শ্ৰীমতীর শবদেহটি শোয়ানো, কণ্ঠ অবধি একটি শুভ্রবর্ণ, সোনারূপার কাজ করা কার্পাসিক বসন দিয়ে ঢাকা। মঞ্চের সামনে সে গৌতমকে দেখতে পেল, সঙ্গে বেশ কয়েকজন ভিক্ষু। জনপরিধি ঠেলে বোধিকুমার শ্মশানভূমিতে পৌঁছল।
—কেমন বন্ন? এখনও কি তোমার এই রমণীকে বাঞ্ছিত, সুন্দর বলে মনে হচ্ছে? গৌতম বললেন।
শ্ৰীমতীর মুখের ত্বক শুষ্ক। অস্বাস্থ্যকর ভৌতিক এক কৃষ্ণবর্ণ তাতে। ওষ্ঠাধরদ্বয় কেমন যেন ঝুলে পড়েছে, দাঁত দেখা যাচ্ছে। বোধিকুমার আরও এগিয়ে দেখল যেন বিকট এক মুখব্যাদান। সভয়ে চোখ সরিয়ে নিল সে। গৌতম ততক্ষণে তাঁর হাতের দণ্ডটি দিয়ে আচ্ছাদন বস্ত্রটি ধীরে ধীরে সরিয়ে দিচ্ছেন। এবং চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ছে এক উৎকট গন্ধ।
উপস্থিত সকলে উত্তরীয় দিয়ে নাসা চেপে ধরল।
—আয়ুষ্মান বন্ন, দেখো এই নারীদেহ কী বীভৎস পূতিগন্ধময়, কৃমি-কীটের বাস। দুর্গন্ধময় এই নারীর জন্য তুমি…
সহসা ভিড় ঠেলে প্রবেশ করলেন চণক। দেখলেই বোঝায় যায় তিনি ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে এসেছেন। তাঁর দেহ ঘর্মসিক্ত। চোখদুটি জ্বলছে।
তিনি চিৎকার করে বললেন—কে, কে এই রমণীর অন্ত্যেষ্টিতে বাধা দেয় দেখি! —তিনি জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে আছেন শ্রমণ গৌতমের দিকে।
—কেউ বাধা দেবে না আয়ুষ্মান, তুমি এর সৎকার করো—গৌতম বললেন।
—এতকাল কে বন্ধ রেখেছিল সৎকার? কার আদেশে এই নারীর এরূপ অসম্মান ঘটল?
—বিশেষ প্রয়োজনে, এই ভিক্ষুকে প্রব্রজ্যায় ফেরাতে অন্ত্যেষ্টি স্থগিত রাখা প্রয়োজন হয়েছিল। অসম্মান তো নয় কাত্যায়ন?
—অসম্মান নয়? একটা সামান্য লম্পটের তথাকথিত ধম্মের নামে একটি স্বকর্মে নিষ্ঠ নারীকে এভাবে দাহ না করে ফেলে রাখা অসম্মান নয়?
—কাকে লম্পট বলছো কাত্যায়ন?
যে ভিক্ষু নারীর দেহকেই নারী বলে মনে করে, যৌবনশোভায় মত্ত হয়, আর মৃতদেহে কৃমি দেখে ঘৃণায় শিহরিত হয় সেই মুর্খ দেহসর্বস্ব ভিক্ষুকে লম্পট ছাড়া কী বলব? আর যিনি এইভাবে স্বসংঘে জনসংখ্যা বাড়ান, তাঁকে কী বলব? কী বলব? বলে দিন শ্রমণ!
—তাঁকে যা ইচ্ছা বলতে পারো আয়ুষ্মান—বুদ্ধর মুখে মৃদু হাসি।
—তাহলে তাঁকে দিগ্ভ্রান্ত, কাণ্ডজ্ঞানশূন্য, দাম্ভিক, বাতুল, উন্মাদ বলি। উন্মাদ শ্রমণ।
আরও কিছু চীবরধারী আশেপাশে ছিলেন, তাঁরা ক্রুদ্ধস্বরে বলে উঠলেন, কাকে কী বলছেন? কাকে কী বলছেন? ধিক, ধিক আপনাকে।
গৌতম বললেন— বলতে দাও। যখন কোনও ব্যক্তি কাউকে কিছু দেয় এবং প্রথম ব্যক্তি তা গ্রহণ করে না, তখন দত্ত বস্তুগুলি কী হয়?
ভিক্ষুরা বলে উঠলেন—দাতার কাছে ফিরে যায় ভন্তে।
—ভালো, ওই তিরস্কারগুলি আমি গ্রহণ করিনি। ওগুলি কাত্যায়নের কাছেই ফিরে গেল।
তিনি দৃঢ়পায়ে স্থানত্যাগ করতে উদ্যত হলেন।
চণক বললেন—চলে যাবার আগে শুনে যান শ্রমণ, আপনি বাসনার কণ্ঠরোধ করার নামে প্রণয়কে হত্যা করছেন। দুর্বলতা, ভীরুতা, অসংযম এগুলিকে শক্তি, সাহস ও সংযমে পরিণত করতে সাহায্য করছেন না। শেষ অবধি কতকগুলি নপুংসক সৃষ্টি করে যাচ্ছেন সমাজে। যে সমাজ সুস্থ বাসনার বেগ ধারণ করতে পারে না, স্বাভাবিক বীর্যপাতকে যে বজ্রপাত মনে করতে শেখে, নারীকে কামের উপকরণ বলে ভাবে, এবং ভিক্ষাজীবীকে সম্মান করতে বাধ্য হয় সে সমাজ কীটদষ্ট বটবৃক্ষের মতো আমূল উৎপাটিত হয়ে ধ্বংস হয়ে যাবে। আপনি জানেন না, আপনিই সেই শক্তিশালী কীট। বটবৃক্ষরূপী জম্বুদ্বীপের বর্তমান, তার ভবিষ্যৎ শাণিত দন্তে কেটে ছিন্ন ভিন্ন করছেন।
—ক্ষান্ত হও চণক, ক্ষান্ত হও।
বোধিকুমার দেখল একটি দীর্ঘদেহী গৌরবর্ণ যুবক এসে চণককে দুহাতে সংবৃত করছে।
চণক একেবারে অবাক হয়ে দুহাতে ব্যক্তিকে আলিঙ্গন করে ধরলেন—অনঘ। সখা অনঘ, এতকাল পরে? কোথা থেকে?
যুবকটির বীরপুরুষের মতো আকৃতি। কটিবন্ধ থেকে কোষবদ্ধ অসি ঝুলছে। তিনি বললেন, সেসব কথা পরে হবে, এখন এসো এই মৃতদেহের সৎকার করি। আপনারা এখানে যাঁরা আছেন, এই অন্ত্যেষ্টিতে যোগ দিতে পারেন।
অনেকেই স্থানত্যাগ করল। রয়ে গেল বোধিকুমার স্বয়ং এবং সে বিস্মিত হয়ে দেখল আরও দু’চার জনের মধ্যে রয়েছেন স্বয়ং রাজসচিব বর্ষকার ও সুনীথ এবং কুমার বিমল।
চিতায় অগ্নিসংযোগ করবার পর, আগুন তখন ধুধু করে লেলিহান শিখায় ওপর দিকে উঠছে, বোধিকুমার দেখল কুমার বিমল কৌণ্ডিল্য শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন অগ্নিশিখার দিকে।
বর্ষকার বললেন—দৈবরাত ঠিকই বলেছেন। কী বলেন কুমার?
বিমল কোনও উত্তর দিলেন না।
বর্ষকার আবারও বললেন—কিন্তু সমন গৌতম যা-ই করে থাকুন, মহারাজের অনুমতি ছাড়া তো করেননি! প্রকৃতপক্ষে… অর্থাৎ বুঝলেন কুমার, বুঝলেন কবি মহারাজের ওপর এই শ্রমণের প্রভাব… উঁহুঃ বর্ষকার মাথা নাড়তে থাকলেন।
সুনীথ বললেন—অমাত্যবর, রাজনটীদের রক্ষার দায় রাজার, তারাও রাজাকে উপার্জনের অংশ করস্বরূপ দিয়ে থাকে। এখন সে মারা গেলে তার শেষকৃত্য তো রাজাদেশেই সুসম্পন্ন হওয়ার কথা! এটি একটি রাজকৰ্তব্য! এই অনাথার প্রকৃত নাথ তো রাজাই!
বিমল ধীরে ধীরে অতি মৃদুস্বরে বললেন—এই-ই নটীর ভাগ্য। কোন দুর্ভাগিনী মায়ের কোলে জন্ম নিয়েছিল! যখন উৎসবমুখর থাকে সভাগুলি, বহুজনের শংসা, সাধু সাধু রব, মৃদঙ্গের ধ্বনি, বংশীর গীত, নূপুরের নিক্কণ… সকল সৌন্দর্যের যেন আপনভূমি, তখন কি সে ভেবেছিল? ভেবেছিল এরূপ হবে!
কথাগুলি যেন কুমার আত্মগত বলছেন। বোধিকুমার ভিন্ন আর কেউ সম্ভবত শুনতে পায়নি। কুমার মৃদুস্বরে কথাগুলি বলতে বলতে থেমে গেলেন। ওদিকে দুই অমাত্য এবং আরও কয়েকজনের মধ্যে মৃদুস্বরে হলেও প্রবল তর্ক চলছে। চণক বসে আছেন একটি শিলাখণ্ডে, পাশে তাঁর সখা অনঘ।
বিমলকে মাঝে মাঝে শ্ৰীমতীর সঙ্গীতসভায় দেখেছে বোধিকুমার। কিন্তু তিনি কি শ্ৰীমতীর প্রণয়ী ছিলেন? উনি বৈশালীর নগরশ্রী অম্বপালীর পুত্র বলে একটি রটনা আছে রাজগৃহে। মহারাজ বিম্বিসারের ঔরসে। কত দূর সত্য কে জানে!
শবদাহক বলল—আপনারা কি গঙ্গানীর দিয়ে চিতা নেভাবেন? তাহলে এক্ষুনি যাওয়া প্রয়োজন। গঙ্গা থেকে রাজগৃহের দিকে যে নালিকা কাটা হয়েছে তার জল হলেই চলবে।
চণক উঠে দাঁড়ালেন, বললেন—চিত্তক অতি দ্রুত যায়। আমি যাচ্ছি।
কুমার বিমল বললেন—আমার রথটি যাবে আরও দ্রুত। যদি কেউ সঙ্গে আসেন। তিনি বোধিকুমারের দিকে তাকালেন।
বর্ষকার বললেন—সেই ভালো।
চিতা তখন নিভে এসেছে। একটা গরম বাষ্প উঠছে তা থেকে। সেই বাষ্পে দৈবরাত চণকের মুখটি শুষ্ক, শোকার্ত দেখায়। সূর্য ঢলে পড়েছে। বোধিকুমার মৃৎকলসটি চণকের হাতে তুলে দিল।
চিতায় জল ছিটোতে ছিটোতে মন্ত্রোচ্চারণ করতে লাগলেন চণক। তারপর শ্মশানের পার্শ্ববর্তী সরোবরে স্নানে নামলেন সবাই।
অমাত্য বর্ষকার একটা ডুব দিয়ে উঠে বললেন—কবি, কুমার কোথায়?
বোধিকুমার তার সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতায় স্তব্ধ হয়ে ছিল। এখন যেন স্বরকে তার আবিষ্কার করতে হল। কয়েকবার চেষ্টা করবার পর সে সফল হল। বলল—কুমার গন্তব্যে পৌঁছে আমাকে জল নিয়ে ফিরে যাবার কথা বললেন। বললেন—তিনি আর ফিরবেন না। বৈশালী যাবেন, গঙ্গার অভিমুখে চলে গেলেন কুমার।
—বলেন কী? অমাত্য সুনীথ বললেন।
—হ্যাঁ আশ্চর্য। পথে যেতে যেতে কুমার বলছিলেন—সব তর্ক, সব বাদ প্রতিবাদের ঊর্ধ্বে জেগে আছে অবমাননাময় ক্লিন্ন এই মৃত্যুর সত্য। এই ভবিতব্য যেন তাঁর না হয়। কখনও তাঁর না হয়!
—কার কথা বলছিলেন কুমার? নিজের কথা?
—না। বোধহয় দেবী অম্বপালীর কথা।
সকলে নীরব হয়ে গেলেন।
সিক্ত বসন নিংড়োতে নিংড়োতে চণক চিত্তকের কাছে এসে পৌঁছলেন, অশ্বগুলি সবই একস্থানে রক্ষিত। যে যার অশ্বে উঠবেন এবার।
—চণক বললেন—কবি, আমার পুত্র কোথায়?
—পুত্র তো নয় দৈবরাত, কন্যা।
—কন্যা? চণক থমকে দাঁড়ালেন। একটু পরে বললেন—সে কোথায়?
—কী করবেন জেনে? সে তো আপনার কোনও কাজে লাগবে না!
—এতকাল পরে আমায় এই বুঝলেন কবি! চণক কি শুধু প্রয়োজনের কথাই ভাবে? আর কিছু নেই! তাঁর কণ্ঠস্বর যেন আর্তের।
বোধিকুমার বলল—তা নয় দৈবরাত, প্রয়োজনই শুধু নয়, আপনার যে আছে মহান কর্তব্য, কন্যাটিকে গ্রহণ করবার কথাও তো আপনি বলেননি! পুত্রের কথাই বলেছিলেন, তাই…
—কন্যাটিকে কি আপনি লালন করতে চান? চণকের কণ্ঠ এখন অনেক শান্ত।
—সে সুযোগ শ্রীমতী আমায় দেয়নি দৈবরাত। কন্যাটিকে সে রাজপ্রাসাদে পাঠিয়ে দিয়েছে। মহিষী কোশলকুমারীর প্রাসাদে বড় হচ্ছে সে। চণকভদ্র শ্রীমতী তার পিতৃপরিচয় দেয়নি। আমি আপনার সব কথা তাকে বলেছিলাম, তবুও না। সে আপনাকে কন্যার পিতা বলে স্বীকারও করেনি। ওই কন্যাকে আমি দেখিনি ভদ্র, শুনেছি সে মাতৃমুখী। কোশলদেবী তারও নাম রেখেছেন শ্ৰীমতী।
তখনও অপরাহ্ণ হয়নি। দু’জনেই দেখলেন শ্মশানবৃক্ষগুলির শাখায় শাখায় একে একে শকুন এসে নামছে।
১৮
ক্রমে রাজগৃহে সন্ধ্যা নামে। রাত্রি নামে। রজনীর যামগুলি একে একে পার হতে থাকে। চণকের চোখে কোনদিনই ঘুম আসে না। পাশের শয্যায় সখা অনঘ ঘুমে অচেতন। দীর্ঘ দিন শাক্যপুত্রীয় সংঘে বিনয় পালন করে অনঘ শিখেছে কীভাবে চিত্তকে সংযত, একাগ্র, উদাসীন রাখতে হয়। শাক্য মুনির গুণগ্রামে সে অভিভূত। শুধু স্বীকার করে একটি বিশেষ কর্মভার নিয়ে একদিন সে বেরিয়েছিল। তার স্বদেশের ভাগ্য ছিল তাতে জড়িত। সেই কর্ম ফেলে রেখে শ্রমণসংঘে যোগ দেওয়া তার অনুচিত হয়েছিল। চণকের কাছে বারবার সে অনুতাপ প্রকাশ করেছে। কিন্তু যা শিখেছে, যা জেনেছে তা নিয়ে তার আনন্দের অবধি নেই। তাই শয্যায় শোয়ামাত্র নিদ্রায় সে অভিভূত হয়ে যায়। বাঁদিকে পাশ ফিরে হাতের ওপর মাথা রেখে উপাধান বিনা সে শুয়ে থাকে। প্রশান্ত মুখ, সহসা দেখলে মনে হয় সে চোখ দুটি বন্ধ করে শুয়ে আছে মাত্র। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সে সুষুপ্ত। চণক পদচারণা করতে করতে ভাবেন আপন চিত্তের সঙ্গে, জীবনের সঙ্গে সমস্ত দ্বন্দ্বের যার অবসান হয়েছে সে-ই একমাত্র এমন নিদ্রায় নিদ্রিত থাকতে পারে। চণক পারছেন না। শুধু আজ বলে নয়, যৌবনোন্মেষের সময় থেকেই অদ্ভুত সব শক্তিশালী চিন্তা, স্বপ্ন, কল্পনা তাঁকে জাগিয়ে রেখেছে। মধ্যরাত্রে সহসা ঘুম ভেঙে যেত কতদিন। কোনও ভাব, কোনও সমস্যা তার সমাধান, একেবারে চিত্রের মতো ভেসে উঠত, মনে হত যেন কেউ তাঁর ভেতরে বসে সমস্যাগুলির সমাধান করছে, চিত্রগুলি লিখছে, ভাবগুলি উদিত করে অঙ্গুলিনির্দেশ করছে। প্রথম যৌবনে মনে হত কেউ, কোনও দেবতা তাঁকে ভর করেছেন। তাঁর ভেতরে বসবাস করছেন। এখন, বহু অভিজ্ঞতার পর তিনি বুঝেছেন না, কোনও দেবতা নয়। তাঁর চিত্তের মধ্যে আরও একটি চিত্ত আছে। সদাসতর্ক। বহিশ্চিত্তের দৃষ্টিতে যা এড়িয়ে যায় এই অন্তশ্চিত্ত তাকেও দেখে, তার ক্ষমতা অসীম, বাড়ালেই বাড়ে। চণকের গভীর, দৃঢ় আত্মপ্রত্যয়ের মূলে তাঁর এই অন্তশ্চিত্তের প্রতি আস্থা। কিন্তু সম্প্রতি, অতি সম্প্রতি সেই আস্থা টলেছে। তিনি উপলব্ধি করছেন বাইরের ঘটনাবলীকে তাঁর চিত্ত নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না সবসময়ে যতই চেষ্টা করুন, আর দ্বিতীয়ত যেটি আরও ভয়াবহ, তাঁর অন্তশ্চিত্তও ভুল করে। তিনি অস্থিরও হন। আজ যে দ্বন্দ্ব যে সমস্যা তাঁর সামনে তিনি কিছুতেই ভেবে পাচ্ছেন না কী ভাবে তার সম্মুখীন হবেন।
প্রাসাদ থেকে ভেরীঘোষ ভেসে এলো। শেষ যাম রজনীর। অস্থির চণক দ্রুত পদে গান্ধার ভবনের পেছনের দ্বার খুললেন গিয়ে। অন্ধকারে কয়েকটি ছায়ামূর্তি।
ভেতরে নিঃশব্দে ঢুকে এলো।
গম্ভীর কণ্ঠে একটি মূর্তি বলল-একেবারে অভ্যন্তরে, সোমার কক্ষে নিয়ে চলুন আর্য।
চণকের পেছন পেছন অন্তঃপুরের শেষ কক্ষটিতে পৌঁছলেন সবাই। পরিত্যক্ত কক্ষ। নাগদত্ত থেকে একটি ছেঁড়া-তার বীণা ঝুলছে। শয্যার ওপর চিত্রময় একটি আস্তরণ। রাত্রে শুতে যাবার আগে একটি আচ্ছাদন হর্ম্যতলে বিছিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। অতিথিরা তার ওপরে বসলেন, শুধু কর্কশ কণ্ঠ-বিশিষ্ট ব্যক্তি বসলেন গিয়ে একেবারে জিতসোমার শয্যার ওপরে।
চণক একবার কী বলতে গিয়ে থেমে গেলেন। অনঘ উঠে এসেছে।
—আসুন আসুন মহামান্য গান্ধার—বলে উঠলেন শয্যায় উপবিষ্ট ব্যক্তি।
চণক দ্রুত গিয়ে দ্বার বন্ধ করে দিলেন।
বর্ষকার বললেন এবার আমাদের আলোচনা আরম্ভ হতে পারে কুমার।
শয্যায় উপবিষ্ট ব্যক্তিই কুমার কুনিয়। তিনি উঠে দাঁড়ালেন। ঈষৎ হেসে বললেন আলোচনার তেমন কিছু তো নেই। মগধ কোনদিন আর সাম্রাজ্য হবে না। মগধের রাজাও সম্রাট, রাজচক্রবর্তী হবেন না। তিনি প্রকৃতপক্ষে ভীরু। উত্তরে শক্তিশালী রাজ্য সব, বিশেষত বৈশালীর কাছে তিনি একপ্রকার পরাজিতই হয়েছেন। লিচ্ছবিরা নানা প্রকার বাণিজ্যিক সুযোগ-সুবিধা নেন, আমাদের রাজা দেখেও দেখেন না, শ্বশুর কুল তো! কী, আমি কি সত্য বলেছি শ্রেষ্ঠী অহিপারক!
অহিপারক শুধু মাথা নাড়লেন।
বিশদই বলুন না, ভয় কী? বর্ষকার বললেন
বিশদ আর কী বলব দৈবরাত, গান্ধার অনঘ, বৈশালী আর মগধের সীমানায় একটি রত্নখনি আছে। পূর্বে তার উৎপাদন মগধও কিছু পেত। যত দিন যাচ্ছে, সুকৌশলে লিচ্ছবিরা রত্নখনির চারপাশে পাহারা বসাচ্ছে। মাগধ বণিকরা আর সেখানে গতায়াত করতে পারেন না। আমাদের গোষ্ঠী থেকেই এ অভিযোগ এসেছে। শ্রেষ্ঠীবর যোতীয় জানেন।
চণক ধীরে ধীরে বললেন—মহারাজকে জানিয়ে ছিলেন?
—কতবার।
—ফল হয়নি?
—না।
—ভালো, আমাকে কী করতে বলেন? —চণক জিজ্ঞেস করলেন।
কুমার কুনিয় পদচারণা করছিলেন, থেমে গিয়ে বললেন— আপনি কী করবেন তা পরে স্থির হবে দৈবরাত। এখন বলুন তো! সমগ্র জম্বুদ্বীপ জুড়ে এক সাম্রাজ্য, এক রাজচক্রবর্তীর মহৎ কল্পনা নিয়েই কি আপনি আসেননি?
—এসেছিলাম কুমার।
জানবেন, মহারাজের এখন যা মতিগতি তাতে তার আর আশা নেই। এখন বলুন নটী শ্রীমতীর মৃতদেহ দশ দিন যাবৎ সৎকার না করে ফেলে রাখা— এ আপনি সমর্থন করতে পেরেছেন?
—পারিনি— কঠিন মুখ চণকের।
গৌতম বুদ্ধ নামে শাক্য রাজকুমার স্বরাজ্য ছেড়ে এখন সমস্ত রাজ্যের ওপর নিজের প্রভাব বিস্তার করবার কাজে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছেন। সিংহাসনে বসতে তিনি চান না। কিন্তু হতে চান রাজদণ্ডের নিয়ামক। সত্য কি না?
এই সময়ে অনঘ বলে উঠলেন—আমি তথাগতর ঘনিষ্ঠ ছিলাম। এরূপ কোনও অভিপ্রায় তাঁর আছে বলে আমার মনে হয়নি। তিনি মহাত্মা।
—তিনি যে মহাত্মা তাতে আমাদের সন্দেহ নেই, বর্ষকার তাড়াতাড়ি বললেন, আপনি আমাদের ভুল বুঝবেন না গান্ধার, কিন্তু মহাত্মারাও সর্বদর্শী হন না, অথচ নিজেদের সর্বদর্শী ভেবে থাকেন। রাজকার্যে অনর্থক বাধার সৃষ্টি করে মগধরাজ্যকে গৌতম বুদ্ধ একটি মহা সঙ্কটে ফেলে দিয়েছেন। রাজগৃহ তো আর তাঁর সঙ্ঘ নয় যে সমগ্র রাজগৃহকে তার রাজা-প্রজা সহ তিনি বিনয় পালন করাবেন!
—তিনি কি তাই করছেন?
—তা ছাড়া কী, গান্ধার? বৈশালীর স্পর্ধা চূর্ণ করবার জন্য মহারাজের যদিও বা একেকবার ইচ্ছা জাগে, ইনি তাঁর কানে মন্ত্র দেন— বৈশালী অপরাজেয়। বৈশালী সংঘবদ্ধ, তাই অপরাজেয়। রাজ্যে যক্ষ-রক্ষের উপদ্রব হলে আগে এদের মুণ্ড কেটে বনপথে বর্শায় গেঁথে রাখা হত, আর এখন? ইনি তাদের রক্ষা করেন। সবচেয়ে ভয়ের কথা মহারাজ শাস্তি দিতে উদ্যত সেই সময়ে সেই উত্তোলিত হাত ইনি ধরে ফেলেন। এতে রাজার মর্যাদা নষ্ট হয়, সাধারণের আস্থা নষ্ট হয়।
চণক ধীর কণ্ঠে বললেন— বন্যদের সঙ্গে গৌতমের নির্দেশে মহারাজ যে নীতি মেনে চলছেন। তাতে উপকার হয়নি কোনও?
—উপকার? ব্যাঘ্রের গুহায় আপনি প্রবেশ করে বসবাস করতে আরম্ভ করলে ব্যাঘ্র আপনাকে ছেড়ে দেবে ভদ্র? সাম্রাজ্য বিস্তার করতে হল শক্তিপ্রকাশ, রক্তপাত, আস্ফালন এগুলি করতেই হবে দৈবরাত। পৃথিবী মহর্ষিদের তপোবন নয় যে এখানে ‘মা-মা হিংসী’ বললেই সব হিংসা থেমে যাবে। আর তপোবনও যে সংগ্রামের হাত থেকে পুরো মুক্ত নয়, সে কথা আপনি ভালোই জানেন। প্রকৃত কথা সাম্রাজ্য স্থাপন। কেন? কোনও ব্যক্তি বা বংশের শ্রীবৃদ্ধির জন্য কী? না, তা নয়। সাধারণ অস্ত্রহীন মানুষ, উৎপাদক, বণিক, দাস, ভূস্বামী সবাই, সবাই নিরাপদে থাকবে বলে, দেশ সুরক্ষিত হবে বলে— উদ্দেশ্য মহৎ। কিন্তু তার জন্য প্রথমে কঠোর হতেই হয়। দৈবরাত আপনারও কি এরূপ মত ছিল না?
চণক একটু ইতস্তত করে প্রশ্নটি সামান্য এড়িয়ে বললেন— মৈত্রীর মধ্য দিয়ে, দান, সহমর্মিতা ও কল্যাণকর্মের মধ্য দিয়েও যে রাজ্যবিস্তার এবং সংহতি হয় না এ কথা আমি বিশ্বাস করি না। কিন্তু মহামান্য সচিব যে বলছেন কোনও ব্যক্তি বা বংশের শ্রীবৃদ্ধির জন্য সাম্রাজ্য নয়, তিনি কি বলতে পারেন ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হলে ক্রমশই তা ব্যক্তির ও বংশের হয়ে যাবে না?
—তার জন্য মন্ত্রিপরিষদ চাই। —সুনীথ এতক্ষণে বললেন!
—মন্ত্রি-পরিষদের যথেষ্ট ক্ষমতা চাই—বর্ষকার বললেন।
—কী হবে এই সকল কথা আলোচনা করে? রক্ত বসনাবৃত মুখ প্রকাশ করলেন এক বয়স্ক শ্ৰমণ। কক্ষের অন্ধকারতম কোনটিতে এতক্ষণ বসেছিলেন ইনি।
চণক অবাক হয়ে গেলেন। তিনি ভেবেছিলেন তাঁর অতিথিরা সকলেই রাজপুরুষ। এই দলে একটি শ্ৰমণ আছেন এ কথা তিনি স্বপ্নেও ভাবেননি। তাঁর বিদ্যুচ্চমকের মতো মনে পড়ল কুমার কুনিয়র রথের ভেতরে সেই শ্রমণের কথা। তিনিই কি ইনি?
শ্ৰমণ কৃশকায়, দীর্ঘদেহ, চক্ষুদুটি কোটরাগত। সুগৌর বর্ণ। কুমার কুনিয় সম্ভবত চণকের বিস্ময় লক্ষ্য করেছিলেন। বলে উঠলেন– দৈবরাত, ইনি ভগবান দেবদত্ত, ইনিই প্রকৃত বুদ্ধ।
মহাসচিব বর্ষকার ভিন্ন দিকে তাকিয়ে রইলেন, সুনীথ মাথা নিচু করেছেন। প্রকৃত বুদ্ধ? রজনীর শেষ যামে কয়েকজন রাজপুরুষের সঙ্গে একজন বিদেশীর গৃহে এসেছেন মন্ত্রণা করতে? মন্ত্রণা, না যড়যন্ত্র?
তাঁর চিন্তাজাল ছিন্ন হয়ে গেল শ্রমণ দেবদত্তের কণ্ঠস্বরে।
—গৌতমকে আমি শিশুকাল থেকে ঘনিষ্ঠভাবে চিনি। সে অতিশয় ক্ষমতালিপ্সু। রাজা তো অনেকেই হয়। সেও হতে পারত গণরাজ। হয়ত শাক্যরা সবাই তাকে মেনে নিত। কিন্তু তার আকাঙ্ক্ষা আরও অনেক উচ্চে। সে রাজাদের নিয়ন্তা হতে চায়। তার অঙ্গুলিহেলনে চলবে কোশল, বৎস, মধুরা, কুরুদেশ, মগধ—সব, সব। সঙ্ঘের মধ্যে যেভাবে সকলকে দমিত করে রেখেছে, সেইভাবেই সারা জম্বুদ্বীপের রাজপুরুষদের ওপর সে নিজের ইচ্ছা-অনিচ্ছা চাপাতে চায়।
দেবদত্ত একটু থামলেন, কেউ কোনও কথা বলছে না। তথাগত বুদ্ধের কার্যাবলীর এই জাতীয় একটি ব্যাখ্যাও হতে পারে কেউ সম্ভবত ভাবেনি।
দেবদত্ত চারদিকে একবার তাঁর তীক্ষ্ণদৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে বললেন— আমি তোমাদের আরও কয়েকটি কথা বলব, ধৈর্য ধরে শোনো। তোমাদের মনে হয়ত আমাদের সম্পর্কেও অনেক প্রশ্ন জাগছে। মনে হতে পারে আমি গৌতমের প্রতি ঈর্ষায় এসব করছি। ঈর্ষা কিন্তু নয়। গৌতমের অহন্তা যে কতদূর সর্বনাশা হতে পারে আমি তার প্রত্যক্ষদর্শী, জীবন দিয়েও আমি তার কুফল রোধ করব এই আমার প্রতিজ্ঞা। সমগ্র শাক্যকুলকে সে ছিন্ন ভিন্ন করে দিয়েছে। কত শত শাক্যরমণী যে মর্মবেদনায় মৃত্যুবরণ করেছে, আরও কত যে উপায়ান্তর না দেখে সংঘে প্রবেশ করেছে এবং আরও কত যে জীবন্মৃত হয়ে রয়েছে তা তোমাদের বোঝাতে পারবো না। এখন যে শাক্যপ্রধান সেই মহানামা তো গৌতমের নাম শুনলে জ্বলে যায়। তাকে শতাধিক অনাথা রমণী প্রতিপালন করতে হচ্ছে।
দেবদত্ত আবার থামলেন, বললেন—ভেবো না, শাক্য-কোলীয়দের হয়ে প্রতিহিংসা সাধন করতে আমি গৌতমের শত্রুতা করছি। শাক্যদের উদাহরণ দিলাম শুধুমাত্র বোঝাতে গৌতমের শক্তি কী রূপ। সে ইচ্ছা করলে এই সমগ্র জম্বুদ্বীপ শুধু তার নিবৃত্তির তত্ত্ব দিয়েই শ্মশান করতে নিতে পারে।
অনঘ বলে উঠলেন— কিন্তু ভন্তে এ কথা কি সত্য নয় যে অন্যান্য শাক্যকুমার যেমন ভগু, কিম্বিল, ভদ্দিয় এঁদের সঙ্গে আপনি স্বেচ্ছায় এসে সংঘের শরণ নিয়েছিলেন।
—নিয়েছিলাম আয়ুষ্মান। গৌতমের প্রভাব কি সামান্য মনে করো? সে সময়ে শাক্য রাজ্যে প্রতি গৃহ থেকে একজন অন্তত প্রব্রজ্যা না নিলে লোকে তাকে নিয়ে উপহাস করত। আমি প্রব্রজ্যা নিই, কঠোর সাধনা করে অর্হত্ত্ব লাভ করি, তারপর জ্ঞানচক্ষুর উন্মীলন হল— সব কিছু পরিষ্কার দেখলাম, বুঝলাম।
কী বুঝলেন, আমাদের যদি একটু বলেন ভালো করে… কুনিয় বলল।
—কুমার বুঝলাম সংসার-ত্যাগী সন্ন্যাসী আর গৃহীর পথ সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। সম্পূর্ণ। সম্পূর্ণ। সন্ন্যাসী কখনও অর্ধগৃহী হবেন না। এই যে সব বিশাল বিশাল বিহার নির্মিত হচ্ছে, সর্বশ্রেণীর মানুষ সে চণ্ডাল হোক, পুক্কুশ হোক, সংঘভুক্ত হচ্ছে, রোগ-ব্যাধির নাম করে তিন তলিকা পাদুকা পরা হচ্ছে, মধু, ঘৃত, পায়স, গৃহস্থের গৃহে অন্নভোগ মৎস্য মাংস সহযোগে, এ সকল কি অর্ধগৃহীত্ব নয়? সন্ন্যাসী হতে চাও পূর্ণ সন্ন্যাসী হও, আর নইলে পূর্ণ গৃহী। গৃহীর সামাজিক দায়িত্ব কি অল্প? প্রকৃতপক্ষে তা সন্ন্যাসীর চেয়ে অনেক অধিক। গৃহীই সমাজকে, পৃথিবীকে রাখে। সেই গৃহীরা যে সন্ন্যাসীর লবণ ও অম্লতৃষ্ণা মেটায়, তাকে প্রয়োজনে রক্ষা করে এই-ই তো অনেক। এর ওপরে এ কানন দাও, ও কানন দাও, বিহার গড়ো, নিমন্ত্রণে আপ্যায়িত করো, এ সকল কি ভালো? আমি একজন অর্হন, জীবন্মুক্ত পুরুষ—আমি বলছি ভালো নয়, এ কখনও কল্যাণকর হতে পারে না।
ঘরটি অর্হন দেবদত্তর কণ্ঠস্বরে গমগম করতে লাগল। কেউ কোনও কথাই বলতে পারলেন না।
অনেকক্ষণ পরে অনঘ বললেন: কিন্তু ভগবন, আপনি এক নতুন দৃষ্টিতে বুদ্ধবাণীর ব্যাখ্যা করলেও ওঁর নিজের দিক থেকে উনি একে বলছেন মঝ্ঝিম পন্থা।
তিক্তস্বরে অর্হন দেবদত্ত বললেন হ্যাঁ। গৃহীর দায়িত্বও পালন করতে হবে না। সন্ন্যাসীর করণীয়ও করতে হবে না। গৃহীর সুখও রইল, সন্ন্যাসীর সুখও রইল। আমি অর্হন দেবদত্ত বিহারে থাকি। তা শীতে উষ্ণ, গ্রীষ্মে শীতল, কেন না শ্রেষ্ঠ স্থপতিরা রাজাদেশে তা প্রস্তুত করেছেন। নামমাত্র ভিক্ষায় বেরোই একেক দিন, গৃহস্থ আমাকে দেখলেই তটস্থ হয়ে তার সেদিনের শ্রেষ্ঠ ব্যঞ্জনাদি তা আমার পাত্রে ঢেলে দেয়, আমি নির্জন বৃক্ষতলে বসে আহার সমাধা করি, অন্য কোনও গৃহস্থ আমাকে নিমন্ত্রণ করে শুধু ষোড়শ ব্যঞ্জন দিয়ে ভোজনই করায় না, উপরন্তু উপহার দেয়। রেশমের কাষায়বস্ত্র অতি সুখস্পর্শ, কোমল কার্পাসিক পাদুকা, উজ্জ্বল কৃষ্ণবর্ণ ভিক্ষাপাত্র, সম্প্রতি স্বর্ণ-রৌপ্যও দিচ্ছে, সংঘ গ্রহণ করছে। সংঘের কোষাগার প্রস্তুত হচ্ছে। অর্থাৎ কোনও কর্ম না করেই, না সন্তান পালন, না জনক-জননী আদি পূর্বজ, ভার্যা প্রভৃতি প্রতিপালনীয়াগণের, বন্ধু-বান্ধব প্রভৃতি সুহৃৎ গণের প্রতি কোনও কর্তব্য, রাজাকে কর না দিয়ে, বণিককে পণ্যের অর্থমূল্য, দাসকে আরক্ষা না দিয়েই সর্বপ্রকার গৃহসুখ পাচ্ছি। মঝ্ঝিম পন্থাই বটে।
অর্হন দেবদত্তর তিক্তভাষণে সবাই অনেকক্ষণ চিন্তিত, স্তব্ধ হয়ে রইল।
—শ্ৰমণ গৌতম কোনও কোনও বিচারে ভুল করেন— চণক অবশেষে বললেন— কিন্তু তাঁকে, অর্থাৎ তাঁর কার্যকলাপকে আমি ঠিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বা অভিসন্ধিমূলক বলে ভাবতে পারছি না।
—তাহলে উনি বজ্জিদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করতে মহারাজকে বাধা দিচ্ছেন কেন? কুনিয় বলল।
—কেন? আপনার কী মনে হয় কুমার? চণক জি্জ্ঞেস করলেন।
—বজ্জি, মল্ল শাক্য এরা সবাই গণরাজ্য। নিজে শাক্য বলে, গণরাজ্যের সন্তান বলে, শ্রমণ গৌতমের সহানুভূতিও পরিপূর্ণ এদের পক্ষে। বজ্জিরা স্বাধীন, মল্লরা হৃতগৌরব, তবু একপ্রকার স্বাধীনই, শাক্যরা নামেমাত্র কোসলের প্রজা, কার্যত স্বাধীন। উনি চান এই গণরাজ্যগুলি ক্রমে শক্তিশালী হয়ে উঠুক, মগধ সাম্রাজ্যর অন্তর্ভুক্ত না হোক। বজ্জিরা যে কোনও দিন মগধ আক্রমণ করতে পারে দৈবরাত, তখন শ্ৰমণ গৌতম মহারাজের কানে মন্ত্র দেবেন, বজ্জিরা সংঘবদ্ধ, তারা অপরাজেয়। মহারাজের মনোবল ভেঙে যাবে। রাজনীতির এইসব কূটকৌশল, শত হলেও আপনি ব্রাহ্মণ, আপনি বোঝেন না।
বর্ষকার হাঁ হাঁ করে উঠলেন— এ কথা বলবেন না কুমার, ব্রাহ্মণরাই চিরকাল রাজসচিবের কাজ করে এসেছে, রাজনীতি ও বার্তা নিয়ে তত্ত্ব রচনা করেছেন যাঁরা, তাঁরাও ব্রাহ্মণ।
কুমার কুনিয় বলল– দৈবরাত যদি আমার কথায় আঘাত পেয়ে থাকেন, আমি মার্জনা চাইছি। তিনি তো আমার পিতৃবন্ধুও। আবার বয়সে তিনি পিতার চেয়ে অনেক ছোট। আমার পিতৃব্য হলেন। তাই না? আমি মগধ সাম্রাজ্যের ভবিষ্যৎ ভেবে আকুল হয়েছি। ভগবান দেবদত্ত ক্ষত্রিয়, তাই রাজ্যরহস্য জানেন আবার প্রব্রজিত, তাই সন্ন্যাসরহস্যও জানেন। বাইরে থেকে আমরা সন্ন্যাসী দেখেই ভক্তিতে নত হয়ে পড়ি। কিন্তু সন্ন্যাসী হলেই তিনি সকল ভ্রমের উর্ধ্বে, প্রলোভনের উর্ধ্বে হন না, স্বভাবতই সমালোচনাও তাঁকে শুনতে হবে।
চণক বললেন— না। শ্ৰমণ গৌতমের কার্যকলাপের পেছনে কোনও স্বার্থপর অভিসন্ধি আছে, এমন মনে করা ভুল কুমার। নূতন কোনও তত্ত্বকে আমরা সহসা গ্রহণ করতে পারি না। আমাদের সংস্কার তাতে বাধা দেয়। ইনি রাজনীতির ব্যাপারে একটি নূতন তত্ত্ব এনেছেন। মৈত্রী তত্ত্ব শুনতে সহজ, রূপ দিতে সহজ নয়। আবার যতটা কঠিন মনে করছি, ততটা কঠিনও না। শুধু বজ্জি, মল্ল, শাক্য নয় উনি সমগ্র জম্বুদ্বীপকে মৈত্রীবদ্ধ হতে বলছেন। রাজা প্রজা, ভিন্ন ভিন্ন রাজ্যের রাজশক্তি—সবাইকে। হয়ত উনি ঠিক এভাবে বলেননি, কিন্তু ওঁর সার্বিক তত্ত্ব থেকে রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক এইটুকুই। পারস্পরিক বিপদ ভুলে নিজ নিজ স্বাতন্ত্র্যে স্থিত থেকে সংঘবদ্ধ হওয়া।
দেবদত্ত বললেন— আয়ুষ্মান, তোমার সঙ্গে না গতকল্যই তার তুমুল বিবাদ হয়েছিল। নটীর অন্তিম সৎকার বন্ধ করা নিয়ে? তুমি এরূপ গৌতমের পক্ষ নিয়ে কথা বলছো?
চণক ধীরে ধীরে বললেন— আমি তাত্ত্বিক। তত্ত্বের প্রয়োগও কিছু কিছু করে থাকি। তাত্ত্বিকের দৃষ্টিতে একদেশদর্শিতা থাকে না। বিবাদ ঘটেছিল, বিবাদের কারণ ছিল বলে, তার অর্থ এই নয় যে….
কুমার বলে উঠল,— আপনি ভগবান দেবদত্তকে অপমান করছেন দৈবরাত! আপনি প্রয়োগকুশল পণ্ডিত হতে পারেন, কিন্তু তিনি অর্হন।
চণক একটা দুর্বোধ্য হাসি হাসলেন। তারপরে দেবদত্তের দিকে ফিরে বললেন— আমার উক্তি কি আপনাকে কোনও কোমল স্থানে স্পর্শ করল নাকি ভন্তে!
রাতের অন্ধকার থাকতে থাকতেই চলে গেলেন পাঁচ আগন্তুক।
সহসা অনঘর দিকে ফিরে চণক বললেন— সখা অনঘ, তুমি কি জানো, দেবী দেবদত্তার কন্যা জিতসোমা এই নগরীতেই আছে।
অনঘ আশ্চর্য হয়ে বলল— জিতসোমা! এখানে? কী বলছো সখা!
—তুমি গান্ধারী নটী সোমার নাম শোন নি? শোননি এই গান্ধার ভবনে সোমা থাকত এক সময়ে! আজ আমরা যে কক্ষে বসে মন্ত্রণা করলাম, সে কক্ষ জিতসোমার, ওই বীণা, এই শয্যা জিতসোমার।
অনঘ একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেলেন। অনেকক্ষণ পরে বললেন— নটী সোমার নাম শুনেছি, শুনেছি গান্ধারভবনে তোমাকে দেখাশোনা করত সেই নটী পূর্বে। কিন্তু এই সোমা সেই জিতসোমা….এ আমি স্বপ্নেও ভাবিনি।
—অনঘ ক্ষণেক নীরব থেকে আবার মাথা নাড়লেন— না, না। স্বপ্নেও না।
চণক বললেন— এখন তো শুনলে। কী ভাবছো এখন?
—কী বিষয়ে? অনঘ কথা কটি বললেন সম্পূর্ণ অন্যমনে।
চণক বললেন—এ কথা কি সত্য নয় অনঘ যে, এত বৎসর পরে জিতসোমার স্মৃতিই তোমাকে সংঘ ত্যাগ করতে বাধ্য করল?
—হয়ত তাই চণক। হয়ত নয়। তুমি যে অর্থে বলছো, সে অর্থে নয় অন্তত।
—যে অর্থেই হোক অনঘ, তোমার কাছে আমার অনুরোধ, তুমি জিতসোমাকে মাগধ রাজনীতির এই জটিল আবর্ত থেকে সরিয়ে নিয়ে যাও।
—রাজনীতির জটিল আবর্ত? কী বলছো চণক, ভালো করে বুঝিয়ে বলো।
—সোমা শুধু রাজনটী নয়, আমি যতদূর জানি, সে কিছু রাজকার্যও করে। ঘটনাচক্র যেদিকে চলেছে তাতে তার সে ভূমিকা আর গোপন থাকবার নয়। আজকে যাঁরা এসেছিলেন, বুঝলাম, তাঁরা কুমার কুনিয়কে সমর্থন করছেন। জিতসোমা, অমাত্য চন্দ্রকেতু এঁরা সমর্থন করছেন মহারাজকে। কুনিয় জিতসোমার প্রতি আসক্ত। তার বিশ্বাস মহারাজই তার প্রণয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী। সোমা বুঝতে পারছে না, রাজ্যলোভ, সেই সঙ্গে প্রণয়—উভয় মিলে কুনিয় অতি ভীষণ হয়ে উঠেছে। সোমা অতিশয় বিপন্ন। অনঘ সখা, দয়া করো। পূর্বকথা ভুলে যাও।
অনঘ মৃদুস্বরে বললেন— চণক, তুমি ছাড়া আর কারও সাধ্য নেই জিতসোমার কোনও মঙ্গল বা অমঙ্গল করে। তুমি, তুমিই তাকে বাঁচাতে পারো।
চণক অব্যক্ত বেদনার ধ্বনি করে বললেন— তুমি তো জানো অনঘ, সে কীরূপ উগ্ৰ অভিমানী, মর্যাদা জ্ঞানসম্পন্ন। সে আর আমার কথা শুনবে না। তুমি চেষ্টা করো অনঘ। এই ভয়ঙ্কর আবর্তের মধ্যে পড়ে সোমা না শূলবিদ্ধ হয়ে প্রাণ দেয়।
তড়িৎস্পৃষ্টের মতো চমকে উঠলেন অনঘ। একটু পরে শান্ত হয়ে বললেন—চণক, চণক, সোমাকে রক্ষা করতে কে তোমাকে বাধা দিচ্ছে! কেনই বা তুমি আমাকে তার রক্ষার ভার দিতে চাইছো সব জেনে শুনে!
—সময়, অনঘ সময়। যখন জিতসোমা তোমাকে প্রত্যাখ্যান করেছিল, তারপর অনেক শুক্লপক্ষ অনেক কৃষ্ণপক্ষ এসেছে, গেছে অনঘ। হিমবন্তের শিখরে শিখরে মেঘরাজি কতবার তুষার হয়ে গলল, সিন্ধু গঙ্গা যমুনা, সদানীরার জল কতবার আমূল পরিবর্তত হয়ে গেছে, সোমা জানে না, সে কত বিপন্ন! অনঘ তুমি একবার অন্তত চেষ্টা করো।
অনঘ নিঃশব্দে অন্যমনার মতো ভোরের কাননের দিকে চলে গেলেন। তাঁর মুখে বেদনার ছবি। চণক কিছুক্ষণ পদচারণা করতে লাগলেন। আজ যে পাঁচ আগন্তুক তাঁদের দুই গান্ধার যুবককে নিজেদের গুপ্ত মন্ত্রণায় স্থান দিল, তার কারণ কী? তিনি প্রকাশ্যভাবে শ্রমণ গৌতমের বিধানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন, তাঁকে কটু কথা শুনিয়েছেন তাই? এবং অনঘ সংঘত্যাগ করে চলে এসেছে, তাই? এ মূর্খদের একবারও মনে হল না, অনঘর সংঘত্যাগের পশ্চাতে গৌতম বিরাগ ছাড়া অন্য কিছু থাকতে পারে? একবারও মনে হল না, তিনি একটি ব্যাপারে গৌতমের সমালোচনা করেছেন বলেই অন্য ব্যাপারে না-ও করতে পারেন! এই মূর্খতার কারণ কী? ত্বরা। অতিশয় শীঘ্র কুমার একটা বিম্বিসার-বুদ্ধবিরোধী দল গড়তে চাইছে। কুনিয়ই কী? না দেবদত্ত নামে ওই শ্ৰমণ! বর্ষকার, সুনীথ ও শ্রেষ্ঠী অহিপারকের অবস্থান আরও জটিল। তাঁরা যতটা রাজার বিরুদ্ধে তার চেয়েও অধিক তাঁর বর্তমান নীতির বিরুদ্ধে। এবং গৌতমকে তাঁরা শ্রদ্ধা হয়ত করেন, রাজনীতিতে তাঁর হস্তক্ষেপ একেবারেই কল্যাণকর মনে করেন না। ইতিমধ্যে শ্রমণ গৌতম নামে ওই ব্যক্তি রাজনীতি, সমাজনীতি, সংঘনীতি কিছুই গ্রাহ্য করেন না। যা ভালো মনে করেন, তা যতই অদ্ভুত হোক, অপ্রচল হোক করেই ছাড়েন। সেদিন তিনি গৌতমকে কিছু কঠিন কথা শুনিয়েছিলেন, কী প্রতিক্রিয়া হল তাতে ওঁর! ওগুলি নাকি তিনি গ্রহণ করেননি। অগৃহীত উপহার ওই গালিগুলি নাকি চণকের কাছেই ফিরে এসেছে। বা! বা! বা! অতি অদ্ভুত কৌশল তো! কী তীক্ষ্ণ ধীশক্তি এই শ্রমণের, কী সংযম! কী শক্তি দৈহিক এবং চারিত্রিক।
হঠাৎ চণক যেন চমকে উঠলেন। এই কি সেই
ব্যক্তি নয়, যাঁকে তাঁর পিতা কাত্যায়ন দেবরাত এবং তিনি চণক সারাজীবন ধরে খুঁজে চলেছেন? এই তো সে, যে সমগ্র জম্বুদ্বীপের আরক্ষা ও প্রতিপালনের ভার নিতে পারবে! এই সেই রাজচক্রবর্তী যার ছত্রতলে সব রাজা নিজেদের রাজদণ্ড স্বেচ্ছায় নামিয়ে রাখবে। বিনা সংগ্রামে, বিনা রক্তপাতে। ইনিই তিনি, যাঁর কান্তি দিব্য, ধৈর্য অসীম, বুদ্ধি অসামান্য, ভেদবুদ্ধি নেই, সংস্কার নেই, যে কোনও ঋষিবাক্যকে স্পর্ধা জানাতে পারেন। অসাধারণ ব্যক্তিমায়া। লোভ নেই, জিঘাংসা নেই, জুগুপ্সা নেই, অথচ বীরপুরুষ।
স এষ, সে-ই এই। চণক ছটফট করে উঠলেন। অথচ এক্ষুনি, এই মুহূর্তে তিনি মহারাজ বিম্বিসারের কাছেও যেতে পারেন না। যেতে পারেন না শাক্যমুনির কাছেও। কুমারের চর কি তাঁর ওপর লক্ষ রাখছে না? মন্ত্রভেদ তিনি করবেন না, এমন কথা তাঁর কাছ থেকে এরা নেয়নি, সম্ভবত ভেবেছিল, নটী শ্রীমতীর কারণে তিনি চিরকালের মতো বিম্বিসারবিরোধী হয়ে গেছেন। কিন্তু এখন? সব বিষয়ে তিনি বা তাঁরা যে এদের সঙ্গে একমত হতে পারলেন না, এতেই এরা সতর্ক হয়ে যাবে। অথচ, অথচ… অনঘ কই? তিনি কাননের কোণে কোণে আনঘকে খুঁজলেন তারপর ফিরে এলেন গৃহে। না, গৃহেও সে নেই। কোথায় গেল অনঘ? এখুনি, এই মুহূর্তে সোমার কাছে যাওয়া বিপজ্জনক। ভীষণ বিপজ্জনক। চণক দীর্ঘ কয়েকটি পদক্ষেপে মন্দুরায় পৌঁছে গেলেন। না, কোনও ঘোড়া নেয়নি অনঘ। তিনি এক লাফে চিত্তকের পিঠে চড়লেন। ভোরবেলা তিনি চিত্তকের পিঠে পাহাড়ের দিকে বেড়াতে যান। চর থাকলে সে দেখুক। সন্দেহের কোনও কারণ ঘটবে না। পথে অবশ্যই অনঘকে পাবেন। পেতেই হবে। কিন্তু চণক অনঘকে কোথাও পেলেন না।
সেইদিনই গভীর রাতে অমাত্য চন্দ্রকেতু সংবাদ নিয়ে এলেন। অনঘ কারারুদ্ধ হয়েছেন। অপরাধ—চক্রান্ত। মগধরাজ্যের বিরুদ্ধে। আর নিয়ে এলেন মহারাজ বিম্বিসারের কাছ থেকে চণকের জন্য দণ্ডাজ্ঞা। নিবার্সন। রুরুবধের জন্যই কী? হে চন্দ্রকেতু, সত্য বলো। সত্য বলো। গোপন করো না কিছু।
গভীর উদ্বেগে চন্দ্রকেতুর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন চণক। তার পর মুখ ফিরিয়ে নিলেন।
১৯
তিন্দুক, আমার একটি কাজ করে দিতে পারবে?
নিশ্চয়, মহামান্ন পাঞ্চাল, আপনি আমাদের যা বলবেন, তা-ই পালন করব।
শাক্য কৰ্ষক ভক্তি ও স্নেহভরে পাঞ্চালের দিকে চায়। এই যুবককে তারা ক দিনেই বড় ভালোবেসে ফেলেছে। বীরপুরুষ কিন্তু দম্ভ নেই। অন্যের জন্য নিজ প্রাণ বিপন্ন করেন। বিনিময়ে কিছু চান না। তুলনায় সাবত্থির রাজকুমারকে তাদের ভালো লাগেনি। সামান্যজনের থেকে দূরত্ব রেখে চলে কুমারটি, কারো দিকেই চায়ই না, যেন শক্কদেব স্বয়ংই বা এলেন। নিয়ে তো নিলি পাঞ্চালের জয় করা হাতিটা। ঈর্ষায় কেমন অস্থির-অস্থির করছিল শেষটা? এ প্রসঙ্গ রাত্রে আগুন ঘিরে বসে তারা শাক্য-কৰ্ষকরা অনেকবার আলোচনা করেছে। পাঞ্চাল মহাপ্রাণ মানুষ। তবু, আঘাত লেগেছিল তাঁর। সেই আঘাতের প্রশম করতে তারা কদিন প্রাণপণ করেছে। সমাদরে ভরিয়ে দিয়েছে তাঁকে। তাদের যতদূর সাধ্য! তবুও পাঞ্চাল গভীর রাত্রে টিলার ওপর একা বসে থাকতেন। আকাশের অগণিত তারাগুলির দিকে চেয়ে চেয়ে যেন কাকে খুঁজতেন, কোন প্রশ্নের উত্তরও হয়ত খুঁজতেন। তারা দূর থেকে দেখত। কাছে যেতে সাহস হত না।
—একটি পত্র রাজগহে নিয়ে যেতে হবে তিন্দুক, মহারাজ বিম্বিসারকে পৌঁছে দিতে হবে।
—ওরে বাবা, মগধরাজ! রাজা-রাজড়া কখনো যে দেখিনি পাঞ্চাল!
—দেখনি? সত্য বলো। —পাঞ্চাল মৃদু হাসেন।
—হ্যাঁ হ্যাঁ দেখেছি পাঞ্চাল, যাবো। কিন্তু… মহারাজের কাছে পৌঁছবো কী ভাবে?
—অভিজ্ঞান দেবো। অতিশয় সাবধানে রাখবে সেটি।
“সাহেত-গামের আপণটি রইল। বাণিজ্য-বিস্তারে বহু সময় গেল। এবার যাবো ভিন দেশে। ধরুন কপিলা, কোসম। বেসর-গামে এখনই না। বেসর হয়ে ফিরব। পণ্য এতদিনে ভালো বিকোয়। সংবাদের জন্য মন বড় উচাটন।”
শেষ পংক্তিটি ভেতরের একটা তাড়ায় লিখে গেছে, কেটে দেবে কিনা অনেকবার ভেবেছে তিষ্য। কোন সংবাদ, কার সংবাদের জন্য তার চিত্ত ব্যাকুল হয়েছে তা যেন তার নিজের কাছেও স্পষ্ট জানা নেই। মহারাজ কি তার এ ব্যাকুলতাকে বাতুলতা মনে করবেন? …না, না। তিনি নিজেও কোমল চিত্তের মানুষ। বারবার তার প্রমাণ সে পেয়েছে।
তিন্দুক ধূলিধূসর বসনপ্রান্ত দিয়ে তার গাধাটির পিঠ মুছে নিচ্ছে। বেঁধে নিয়েছে চিঁড়ে-গুড়। পাথেয়র জন্য কয়েকটি তাম্ৰ কার্ষাপণ পায় সে, পুরস্কারস্বরূপ পাঁচটি স্বর্ণ কার্ষাপণ।
আনন্দ, কৃতজ্ঞতা, ভালোবাসা মুখশ্রীতে। তিন্দুক যায়। গাধার ক্ষুরে খুটটুট শব্দ হতে থাকে।
বিলীয়মান সেই বিন্দুটির দিকে তাকিয়ে থাকে তিষ্য। কতদিন, আর কতদিন এই নির্বাসনে, এ কেমন কাজ যা সমাধা করতে যুগ লেগে যাচ্ছে!
বিপরীত দিকে চায় সে। কপিলবস্তুর পথ। কৌতূহল ছিল। তথাগত বুদ্ধর জন্মভূমি… কেমন তা? কেমন তাঁর গোষ্ঠীর মানুষ? শ্ৰমণ আনন্দর মতো সুঠাম, নিরভিমান? না বিনয়ধর থের উপালির মতো বাক্যব্যয়ী? বকবকবক। হাত পা নেড়ে মাথা ঝেঁকে অস্থির হয়ে যাচ্ছেন সদাই! থের ভদ্দিয়র মতো সদাপ্রসন্ন সৌম্যদর্শন? না থের রূপনন্দর মতো উদাসীন, মূক, বৈরাগী! বিরূঢ়ক কি তার সূক্ষ্ম ঈর্ষার অসদ্গুণটি মাতৃবংশ থেকে পেল? নাকি জনক প্রসেনজিতই তাকে দিলেন এই দোষ? অথচ বিরূঢ়ককে সর্বাংশে মন্দ বলা যাবে না। রাজার কুমার হলেই কি এতো অসহিষ্ণু হতে হয়? কুমার বিরূঢ়ককে এখনও সে স্নেহই করে, কিন্তু কোশলের রাজা হতে হলে কুমারটিকে আরও উদার হতে হবে। গর্ব ভালো, কিন্তু এই প্রকার অহন্তা সর্বনাশ ডেকে আনতে পারে। আশা-নিরাশা, আশা-নিরাশা… মানুষের সঙ্গে সম্পর্কে তিষ্যর এই পরম্পর-বিরোধী অভিজ্ঞতা হয়েই যাচ্ছে, হয়েই যাচ্ছে।
শাক্যভূমিতে যাওয়া হল না যখন মল্লভূম বা বজ্জিভূমিতেও এ যাত্রা যাওয়া স্থগিত থাকুক। রাজগৃহের যত কাছে যাবে তত তার কর্তব্যের লৌহ শৃঙ্খল ভেঙে বেরিয়ে যেতে ইচ্ছে করবে। সে জানে। সংবাদের জন্য মন বড় উচাটন। কার সংবাদ? শুধু কি মহারাজ বিম্বিসারের? শুধু কি ক্যাত্যায়ন চণকের? অন্য নামটি নিজের মনের কাছেও উচ্চারণ করতে পারে না তিষ্য।
সুতরাং পাঞ্চাল ঘোড়া ছুটিয়ে দ্যান। —উত্তরপথের দীর্ঘ পুচ্ছ সচল হয়।
—কে যায়? কে যায়?
—সার্থ যায়।
—সার্থবাহ কে?
—অমৃত।
—কোথাকার?
—চম্পার। কোথায় যান ভদ্র?
—আপাতত কুরুদেশে।
—আমাদের গোযানগুলির ভেতরে উৎকৃষ্ট শয্যা আছে, বিশ্রাম নিতে পারেন পথিক। সঙ্গে উৎকৃষ্ট চাল, আসব রয়েছে। রাত্রে গো-মাংস পাক করব, কুক্কুট পাক করব। আমাদের আতিথ্য গ্রহণ করলে সুখী হবো।
সার্থর পর সার্থ পেছনে ফেলে পাঞ্চাল যান। দেহের ওপর দিয়ে দিন রাত বহে যায়, বহে যায়। রৌদ্র কিরণ, উত্তরের হিমবায়ু। দেহবর্ণ তাম্রাভ হয়ে ছিল, ঘোর তাম্রবর্ণ হয়ে যায়, ত্বক রুক্ষ, কেশগুলি অযত্নে বেড়ে গেছে। অবয়বে রুক্ষতা, রূঢ়তাও কী?
মৃত্তিকার প্রকৃতি পরিবর্তিত হয়ে যায়, জলের বর্ণ নীলাভ, আকাশ দ্যুতিমান, বহতা বাতাস কই? ওই তো! কনকনে বাতাস। পাঞ্চাল তিষ্য কোনও রাজ-আশ্রয়ে অধিক দিন থাকেন না। শুধু মগধরাজের বার্তাটুকু বোঝাতে যা বিলম্ব।
—অহো, রাজ্যে রাজ্যে শান্তির প্রস্তাব নয়?
—হ্যাঁ মহারাজ তাই, কিন্তু অধিকন্তুও কিছু!
—বলি যুদ্ধ-টুদ্ধ তো কিছু নেই!
—নিশ্চিন্ত থাকুন, আপাতত কোনও যুদ্ধ নেই।
—তা মগধরাজ তো ক্রমেই পরাক্রান্ত হয়ে উঠছেন। তিনি তো ইচ্ছে করলেই… সাম্রাজ্য-বিস্তারে আমাদের সাহায্য চান না কি?
—না। শুধুমাত্র জম্বুদ্বীপের শত্রু ঠেকাতে, আন্তঃরাজ্য সমস্যাগুলির সমাধান করতে।
—এ যেন নতুন প্রকার মনে হয়!
—নতুনই, একেবারেই নতুন। আপনারা মর্যাদা দিলেই মর্যাদা পায় এই নূতন তত্ত্ব।
কুরু-রাজ্য পাঞ্চাল রাজ্যের সে সব গৌরবের দিন আর নেই। কিন্তু অহঙ্কার আছে। মধ্যদেশীয় যুবকটির নির্লিপ্ত কিন্তু সবিনয় আচরণে সেই অহঙ্কার চরিতার্থ হয়। বিদ্বেষ মাথা তুলতে পায় না।
অবিনয়ী এবং অহঙ্কারী এখানকার মানুষ জন। বহুদিনের ঐতিহ্য বহন করার অহঙ্কার, বিদ্যার অবিনয়। অতিথিভবনের দাসেরা পর্যন্ত কুতূহলী দৃষ্টিতে তাকায়।
—মধ্যদেশীয়… মগধ… আচার-বিচার মানে না
—সত্য না কি?
—কিন্তু ভীষণ পরাক্রমী। এখন তো ওদেরই দিন পড়েছে।
নিজেদের মধ্যে জনান্তিকে বলাবলি করে ওরা।
গ্রাহ্য করেন না পাঞ্চাল। উভয়পক্ষীয় রাজাদের সম্মানরক্ষার্থে যতদিন প্রয়োজন তার চেয়ে একদিনও অধিক থাকেন না।
উত্তরপথের একটি শাখা চলে গেছে বৎস-অবন্তীর দিকে। চলেন, চলেন। বামে ঘুরে যান পাঞ্চাল।
—কে যায়?
—সমন যান। সাক্কপুত্তীয় সমন।
—কোথা থেকে আসেন? কোথায় যান?
—আসি কোসাম্বি হতে। যাই সাবত্থির পথে।
—আমরা যাই বেসালি।
—দিকে দিকে যান না কি? কোনও সমবেত লক্ষ্য নাই?
—দিগ-বিদিকে ধম্ম বহে নিয়ে যাওয়াই আমাদের কাজ হে পথিক। তা ছাড়া সন্ধান করি, ভগবান কোথায় যে গেলেন!
—হারিয়ে গেলেন না কি? —তাম্রকের রাশ টেনে ধরে মৃদু কৌতুকে জিজ্ঞাসা করেন পাঞ্চাল।
—আমাদের ত্যাগ করেছেন তথাগত।
অশ্রুমুখী ভিক্ষুরা।
—আমরা কলহ করেছিলাম। বিরক্ত হয়ে চলে গেছেন।
—ও আপনারা তাহলে কলহও করেন! সংসার-ত্যাগ করে সংঘ আশ্রয় করার প্রয়োজন কি ছিল তবে?
—সত্য, সত্য কথা। আপনি তাঁকে দেখেছেন না কি?
—দেখি নি, দেখে থাকলেও বলব না।
পথের ধুলোয় বিব্রত হয়ে অরণ্যসঙ্কুল স্থানগুলির মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন পাঞ্চাল। অবাক কাণ্ড! সত্যই তথাগতকে আবিষ্কার করলেন। একটি শাল বৃক্ষের তলায় তিনি বসে আছেন আর একটি হাতি শুঁড়ে করে জল এনে তাঁর মাথায় ওপর ফেলছে।
অদূরে দাঁড়িয়ে পাঞ্চাল দৃশ্যটি দেখলেন কিছুক্ষণ।
দাঁড়িয়ে উঠে নিজের উত্তরাসঙ্গটি ভালো করে নিংড়ে নিচ্ছেন তথাগত। ঝাড়ছেন শব্দ করে। বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠের ওপর ভর দিয়ে উঁচু শাখে শুকোতে দিলেন বসনটি। অন্য একটি শাখা থেকে সংঘাটি তুলে নিয়ে পরলেন। এবার অন্তরবাসক নিংড়োচ্ছেন। শুকোতে দিলেন।
এক লাফে তাম্রকের পিঠ থেকে নামলেন পাঞ্চাল। শুষ্ক পত্রের মর্মর শব্দ তুলে দৌড়ে গেলেন। বৃক্ষের তলা জলে ভিজে, ধুলোর সঙ্গে মিশে কাদা হয়েছে, নিজের পেটিকা থেকে বসন বার করে পরিষ্কার করে দিলেন স্থানটি।
এই মানুষটির জন্য কিছু করতে ভালো লাগে।
—চিনতে পারছেন ভন্তে?
—পারছি। সাবত্থির। কুমার তিষ্য, নয়? মৃদু হাসছেন তথাগত।
—পলায়ন করেছেন শুনলাম?
—অবশ্যই। দেখো আয়ুষ্মান, ওই মোঘপুরুষগুলিকে যেন আবার আমার সংবাদ দিও না।
—নাঃ, তাই দিই? সংঘ সৃষ্টি করে বড় বিপদেই পড়েছেন তাই না ভন্তে?
প্রসন্ন হাসি হাসলেন তিনি।
—উত্তর দিলেন না তো আমার কথার?
—তুমি পৃথগ্জন, ধম্মে বিশ্বাস করো না, তোমায় উত্তর দেবো কেন?
—কী করে জানলেন ধম্মে বিশ্বাস করি না! কোনদিন তো তিষ্য বলে আহ্বান জানাননি! রাজগৃহে প্রথম সাক্ষাৎ, তারপর কতবার সিতবনে, বেলুবনে, অম্ববনে গেছি। গেছি জেতবনে। কখনও তো ডাক দেননি।
—যারা বলে সমন গোতম শিষ্যসংখ্যা বাড়াবার জন্য মায়ার আশ্রয় পর্যন্ত নেয়, তাদের এ কথা বলল আয়ুষ্মান।
—আজ আমার কাছ হতে ভিক্ষা নিন।
—তাই হোক।
তিষ্য তার সংগ্রহ থেকে শুষ্ক খাদ্য বার করে, তারপর কী মনে করে বলে
—আমি আসছি, লোকালয় কোনদিকে বলতে পারেন?
—ওই তো… আঙুল দেখান তথাগত— ওই দিকে পারিলেয্যক গাম।
গ্রাম থেকে চিঁড়ে, দধি, মিষ্টান্ন সংগ্রহ করে এসে তিষ্য দেখে একটি বৃদ্ধ বানর হাতে কী নিয়ে অবিকল মানুষের ভঙ্গিতে তাঁর সামনে বসে আছে।
—কী ব্যাপার? হাতি-বানর সব পুষছেন নাকি ভন্তে, মানুষ শ্ৰমণদের ওপর রাগ করে! এদেরও ধম্ম বিতরণ করছেন?
—ওরা ধম্মের কতকগুলি মূল কথা জানে। ও আমাকে মধু খাওয়াতে এসেছে। কিন্তু তুমি ভিক্ষা দেবে বলেছ তাই ওকে বসিয়ে রেখেছি।
তথাগত পাত্র এগিয়ে ধরলেন, তিষ্য তার সংগৃহীত খাদ্যগুলি পাত্রের ওপর রাখলে, তথাগত পাত্রটি বানরটির দিকে বাড়ালেন, তড়িৎগতিতে বানর মৌচাক দুহাতে টিপে তাঁর পাত্রের ওপর মধুবর্ষণ করল, তারপর দুতিন লাফে দূরে বনের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল।
পারিলেয্যক হয়ে আরও একদিনের পথ অপরাহ্ণ অবধি চলে পাঞ্চাল কৌশাম্বী পৌঁছান। রাজ অতিথিশালে দিন কাটে। যত্ন, বিলাস, প্রমোদ কিছুর অভাব নেই। শুধু রাজার সঙ্গে দেখা হয় না। অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করে শোনেন রাজা নাকি শোকার্ত।
—কিসের শোক? কী ঘটেছে রাজ্যে?
—রাজ্ঞী সামাবতী আর তাঁর সহচরীরা আকস্মিক অগ্নিকাণ্ডে নিহত হয়েছেন।
—সর্বনাশ! কী করে আগুন লাগল? নেভানো গেল না? এতো সরোবর…
—আহা দাহ্য পদার্থ অপর্যাপ্ত থাকলে সে আগুন নেভে?
—দাহ্য পদার্থ?
—হ্যাঁ মান্যবর দগ্ধ তৈলের গন্ধে ধ্বংসস্তূপ পরিপূরিত ছিল।
—তাহলে এ তো সাধারণ দুর্ঘটনা নয়।
—নয়ই তো! কাউকে বলবেন না আমি বলেছি, রানীকে সপরিষদ কেউ হত্যা করেছে। হয়ত বা রাজ-আদেশই… জিভ কাটে অতিথিশালার অধ্যক্ষ।
—ভালো— পাঞ্চাল গম্ভীরভাবে বলেন— তাহলে আবার শোক কিসের?
—বলেন কি মহামান্য মাগধ! শোক করবেন না! দেবী সামাবতী যে গুণের আকর ছিলেন, দীপশিখা হেন স্নিগ্ধোজ্জ্বল মানুষটি। অমন সেবা আর কেউ করলে তো! ঘোষিত শ্ৰেষ্ঠীর পালিত কন্যা ছিলেন তো। বহু ভাগ্য বিপর্যয় দেখেছিলেন জীবনে। বড় ক্ষমাশীলা, করুণার্দ্রা মহিয়সী ছিলেন আহা।
—এতোই যদি গুণ তো!
—আমাদের উদেনরাজ বড় অধৈর্য, লোকের কথায় বড্ডই নৃত্য করে ওঠেন কিনা। অমন রাণী অবিশ্বাসিনী হয়? আপনিই বলুন না পাঞ্চাল…
—আমার কিছু বলবার নেই। কবে মহারাজ সভায় আসছেন? সভায় না আসেন, আমাকে নিভৃত আলাপের সুযোগ দিন।
উদেনরাজার পারিষদ সব যেন বিদূষকের মতো।
—এখন কোনও লাভ হবে না। দুর্ঘটনার পেছনে কারণের অনুসন্ধান চলছে, এখন সাক্ষাতে কোনও লাভ নাই। কোনও লাভ নাই… তাদের এক কথা।
কিন্তু একদিন রাজপ্রাসাদ থেকে ডাক আসে। রাজার নয়, রাণীর। না কি জানতে পেরেছেন মগধদূত দীর্ঘদিন প্রতীক্ষা করছেন।
যাবো কি যাবো না! —তিষ্যকুমার ভাবতে থাকেন। রাজগৃহে দীর্ঘদিন মহারাজের সঙ্গে আহার-বিহার। কিন্তু মহিষীদের সঙ্গে কোনও পরিচয় হয়নি কোনদিন। কোশলমল্লিকা অবশ্য আপন ভগিনীর মতো মধুর ব্যবহার করতেন। শাক্যকন্যা বাসবীও ততটা না হলেও মাঝে মাঝে উৎসব কি ধর্মানুষ্ঠান উপলক্ষ্যে সাক্ষাৎ হলে জ্যেষ্ঠার মতোই আচরণ করতেন। না, রাজ্ঞীরাও তো মানবী-ই। ডেকেছেন, না যাওয়া তো রাজাজ্ঞার অবাধ্য হওয়ারই মতো। না, যাবো, যাই।
অহো! কী গরিমাময় গ্রীবাভঙ্গি! হাত তো নয় যেন রাজদণ্ড। মাথার মুকুট সু-উচ্চ। অঙ্গবস্ত্র, অলংকার সবই কেমন অতিমানবিক। ইনি নিজেই তো সাম্রাজ্য পরিচালনা করতে পারেন মনে হয়। করবেনও হয়ত অদূর ভবিষ্যতে। রাজা উদেনের যেরূপ অবস্থা!
—আমি পট্টমহিষী মাগন্দিয়া। কুরুদেশের কন্যা, ব্রাহ্মণ…
নত হয়ে নমস্কার জানান পাঞ্চাল। কুরুকন্যা? তো কী? ব্রাহ্মণ… তাতেই বা হল কী?
—কোশল হতে আসছেন শুনলাম।
—ঠিকই শুনেছেন দেবি…
ভণ্ডটা নাকি ধরা পড়েছে!
—কোন ভণ্ডের কথা বলছেন?
—নির্লজ্জ দাম্ভিকটা এখানেও তো কিছুকাল আগে বসবাস করছিল। তা নাগরিকরা ও প্রকার লোক সহ্য করবে কেন? গালি দিয়েছে অকথ্য। পালিয়েছে। —ওই যে শ্রমণ গৌতম!
—শ্ৰমণ গৌতম? তিনি আর যাই হোন ভণ্ড তো নন? দাম্ভিক তো ননই। কখনো নন।
পাঞ্চালের চোখের সামনে দৃশ্যটি ভেসে ওঠে। পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠের ওপর ভর দিয়ে তিনি— শালশাখায় উত্তরাসঙ্গ শুকোতে দিচ্ছেন।
—এই যে শুনলাম শ্রাবস্তীতে, রাজগৃহে তার নামে প্রবল অভিযোগ উঠছে, কোন রমণীকে না কি সে…
—ও সব মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। ওই রমণীগুলিই দুষ্ট লোকের কাছ থেকে উৎকোচ খেয়ে…
—থামুন… ক্রুদ্ধ কণ্ঠস্বর
চক্ষু তুলে পাঞ্চাল দেখেন এ তো রূপের রূপিনী নয়! যেন বিষের সর্পিণী! কিসের ক্রোধ এতো?
—আমার মতো সুন্দরী দেখেছেন আর?
পাঞ্চাল বোঝেন যাকে গরিমা মনে হয়েছিল তা শুধু দম্ভ।
—সুন্দরীরা কখনও একে অন্যের মতো হন না তো দেবি, প্রত্যেকে স্বতন্ত্র।
—বিদুষী দেখেছেন? ব্যাকরণ, ছন্দ সব কণ্ঠস্থ?
—দেখেছি, শুনেওছি— পরম সন্তোষের সঙ্গে বলে পাঞ্চাল। গান্ধার ভবনের দিনগুলি স্মরণে আসে। চিত্ত কোমলতায় গৌরবে উদ্ভাসিত হয়ে যায়।
—থামুন— ছিন্ন জ্যার মতো অতর্কিতে উঠে দাঁড়ান রাজ্ঞী
—আপনি আমাকে অপমান করছেন?
—তা যদি বলেন দেবি, আপনিই আমাকে অপমান করছেন। আপনি রাজ্ঞী হতে পারেন, কিন্তু আমি মগধরাজের প্রতিনিধি, তাঁর সম্মান আপাতত আমারই প্রাপ্য। তবে তা যদি না-ও দিতে চান, আপনার বা বৎসরাজ্যের ভৃতক তো আমি কখনোই নই।
পাঞ্চাল উঠে দাঁড়ান।
—তুমি… তুমি তোমাকে বন্দী করবার ব্যবস্থা করছি।
ক্রোধে কাঁদতে থাকেন মাগন্দিয়া।
করুন— বিরস মুখে কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসেন পাঞ্চাল। ভেতরে বহু শব্দ। বহুস্বর। রানীর সখীরা তাঁকে শান্ত করবার চেষ্টা করছে।
উদ্বিগ্ন কণ্ঠে প্রতিহারী বলে— রাজ্ঞী অতিশয় বিদুষী, রূপ তো দেখলেনই, কেন যে এমন উন্মাদের মতো… শ্ৰমণ গৌতম নাকি ওঁকে প্রত্যাখ্যান করে ছিলেন তাইতেই…
রূপ, বিদ্যা, অর্থ, উচ্চপদ কিছুই তাহলে কিছু না? ভেতরে বাসনার কূটদন্ত যদি কামড় দেয় তো রক্ষা নেই!
বিশৃঙ্খল বৎসরাজ্য ছেড়ে উজ্জয়িনীর দিকে চলে যান পাঞ্চাল। প্রদ্যোৎ মহাসেন মহা সমাদর করেন মগধদূতের।
মহারাজ বিম্বিসার যতদিন, যখন যেভাবে আমাকে সাহায্য করতে বলবেন আমি তা করব। তিনি আমাকে দুরারোগ্য রোগ থেকে বাঁচিয়েছেন। আমার জন্য তিনি ভেবেছেন, আমিও তাঁর জন্য ভাববো। তেমন প্রয়োজন হলে আমার সেনা তাঁকে অনুসরণ করবে।
বৃদ্ধ, কিন্তু মহাবল, ক্রোধী বলে পরিচিত এই নৃপতি এই কথা বললেন। তখন উত্তর-পশ্চিম দিক প্রান্তের দিকে তাকিয়ে তিষ্য কুমারের মনে হল সে তার কাজ সমাধা করতে পেরেছে, প্রায়। অবশিষ্ট রইল সুদূর উত্তর-পশ্চিমের রাজ্যগুলি— মদ্র, সৌবীর, গান্ধার। উচিত সেদিকেই যাওয়া। কিন্তু চিত্ত বড় ক্লান্ত। অবন্তীরাজের কাছে বিদায় নিয়ে সে দ্রুতবেগে ঘোড়া ছুটিয়ে দেয়। উত্তর পথ পিছু হাঁটতে থাকে।
শ্রাবস্তী পার হয়ে যায় যায়। অদ্ভুত সংবাদ কানে আসে।
রানী বাসবী আর কুমার বিরূঢ়ব নাকি প্রাসাদ থেকে বিতাড়িত হয়েছেন। প্রত্যন্ত গ্রামের লোকেরা বলাবলি করছে।
গ্রামের নাম সালবতিকা। পুষ্কর্ণী থেকে স্নান সেরে ফিরছেন দুই গৃহস্থ। বলছেন:
—কোসলরাজের কোনও হ্রস্ব-দীর্ঘ জ্ঞান নেই। পট্টমহিষী বলে কথা, উপযুক্ত পুত্র… বার করে দিলেন?
—না না এ ভালো কথা নয়।
—মহিষী না কি শাক্যরাজার দাসীকন্যা। কোসলবংশে নিজেদের কন্যা দেবে না বলে বঞ্চনা করেছে। কপিলবস্তু হতে জেনে এসেছে। কুমারের বসার আসন না কি সাত ঘড়া দুধ দিয়ে ধুচ্ছিল। দাসীপুত্রের ছোঁয়ায় অপবিত্র হয়ে গেছে।
—চমকে ওঠে তিষ্য। এক মুহূর্ত ভাবে। তার পর বৈশালীর পথে অশ্বচালনা করে। বিরূঢ়ব যদি সত্য সত্যই রাজকুমার হয়, ভাগ্যবিপর্যয়ে হতাশ্বাস হবে না সে। কিন্তু কোসলরাজের কাণ্ডখানা দেখো!
পসেনদি, উদেন, এঁরা দুজনেই ভারসাম্যহীন মানুষ তাহলে! রাজসত্তা আর ব্যক্তিসত্তার মধ্যে সামঞ্জস্যবিধানে অক্ষম! বর্তমান জম্বুদ্বীপের দৃজন প্রতাপশালী নরপতি এইভাবে চলছেন! উদেনের পুত্র বোধিকুমার নাকি সুংসুমারগিরিতে একটি বিলাসপ্রাসাদ প্রস্তুত করাচ্ছে। যার তুলনা জম্বুদ্বীপের কোথাও নোই। রাজার কোষটি কী দিয়ে ভরেছে? কিছু সীতা ভূমির ওপর তাঁর অধিকার থাকে ঠিকই, কিন্তু আর সব? সবই তো প্রজাদের রাজস্ব, অপুত্রক প্রজার সম্পত্তি, বণিকের শুষ্ক এইসব। রাজাকে তাঁর প্রাসাদ, যান, অলঙ্কার এ সকল কে দেয়? প্ৰজাই তো! অথচ সেই ধন যথেচ্ছ ব্যয় করে যান প্রত্যেক রাজা, তাঁরা যে প্রকৃত পক্ষে রাজ্যের বৃত্তিভোগী ভৃতক এ চেতনা থাকে না। মগধরাজ এরই মধ্যে একটু ব্যতিক্রমী বই কি!
গণরাজ্যে ধনের বণ্টন কী রূপ দেখা যাক। রাজনীতির খেলাই বা তাঁরা কী ভাবে খেলেন।
কপিলবস্তুর ক্ষুদ্র শাখাপথটি পার হয়ে গেছে। শাক্যরাজ্যে যাবার প্রবৃত্তি হয়নি। সে শুনেছিল রানী বাসবী স্বয়ং তথাগতর ভ্রাতৃকন্যা। কোসল রাজ শাক্যকুলের কন্যা বিবাহ করতে চেয়েছিলেন। শাক্যদের এতো দূর স্পর্ধা যে বিবাহের জন্য দাসীকন্যা পাঠাল! বলে দিতে পারত। আর এই যে ধনী ব্যক্তিমাত্রেই অজস্র দাসী, নটী রাখবে, তাদের গর্ভে ইচ্ছামতো সন্তান উৎপন্ন করবে এই অপব্যয়ী প্রথাই বা কেন? যশ নামে এক অর্হন আছেন তিনি ছিলেন বারাণসীর এক শ্ৰেষ্ঠীপুত্র। একবার শ্রাবস্তীতে তিষ্যর গৃহে ভিক্ষার্থে আসেন। তিষ্যর বড় কৌতূহল, কখন কী পরিস্থিতিতে এঁরা প্রব্রজ্যা নেন! অর্হন যশকে জিজ্ঞাসা করেছিল। উনি বলেন— ঘৃণায়।
—ঘৃণা?
—একদিন ব্রাহ্মমুহূর্তে যখন পৃথিবী সবে নিদ্রান্তে জাগছে, অপার্থিব বালার্ককিরণে চতুর্দিক রহস্যভূমি, তখন জেগে উঠে দেখলাম আমি শুয়ে আছি, বিলাস শয্যাটি তছনছ, দু পাশে দুই নারী, মুখ হাঁ করে ঘুমোচ্ছে। প্রভুপুত্রের সেবা করে এতো ক্লান্ত যে তাদের অস্থি পর্যন্ত যেন শিথিল হয়ে গেছে। হর্ম্যতলে কৃমি কীটের মতো কিলবিল করছে আরও অনুরূপ নারী। বিতৃষ্ণা হল।
—কার ওপর, ওই নারীগুলির ওপর না কি?
—ওরাই ঘৃণা জাগায়, মূত্র পুরীষের আধার, অপবিত্র, কুৎসিত… কিন্তু পরক্ষণেই বুঝলাম আমি, আমিই ঘৃণ্য, ঘৃণ্য আমার এ জীবনযাপন, তখনই ছুটে চলে গেলাম। ভাগ্যক্রমে ভগবান তথাগতর সন্ধান পাই।
মৈত্রেয় জাতক (Maitreya Jatak) – একশ এক জন গণরাজা
২০
একশ এক জন গণরাজা সংস্থাগারে মগধদূতের সঙ্গে আলোচনায় বসেন। অভূতপূর্ব সাফল্য।
সেনাপতি অভয় বললেন: কিন্তু একটা কথা আপনারা স্মরণে রাখবেন পাঞ্চাল নিজেকে মগধের প্রতিনিধি বলছেন না, বলছেন বিম্বিসার-প্রতিনিধি।
—দুটির মধ্যে কোনও পার্থক্য আছে নাকি?
—সে-কথা পাঞ্চালই বলুন।
সাবধানতার সঙ্গে শব্দ নির্বাচন করতে হয় পাঞ্চালকে।
—তত্ত্বটি মহারাজের নিজস্ব ভাবনা-প্রকৃত। সমপর্যায়ের ব্যক্তিদের কাছেই তিনি প্রথম প্রচার করতে চান। আপনারা সম্মত হলে তবেই রাজ্যেরও নীতি বলে স্বীকৃত হবে।
—আর সম্মত না হলে! মগধরাজ কি যুদ্ধ করবেন?
সেনাপতি অভয় লোকটি অতি চতুর।
পাঞ্চাল বলেন—আমার কাজ মৈত্রী নীতির কথা, রাজসংঘের কল্পনার কথা আপনাদের জানানো। এর অধিক বলবার অধিকার আমার নেই। তবে একটা কথা জানিয়ে রাখা ভালো— মগধরাজ দুর্বল বা রণভীরু এমন ভাববেন না। অন্যরা হোক তা-ও তিনি চাইছেন না। একের বিপদে বহুর বিপদ। সুতরাং সংঘবদ্ধ হওয়া ভালো—এই-ই তাঁর ধারণা।
—সংঘনায়ক কে হবেন? রাজা ছেটক জিজ্ঞাসা করলেন। সবাই উৎসুক হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। এই প্রশ্নটিকেই ভয় করছিলেন পাঞ্চাল। মাথার মধ্যে বিদ্যুৎ খেলে গেল, হেসে বললেন : আপনারা? আপনারা বৈশালীর গণরাজারা এই প্রশ্ন করছেন?
ছেটক স্মিতমুখে বললেন : ঠিকই। ভগবান বুদ্ধও আমাদের কর্মপদ্ধতির ভূয়সী শংসা করে থাকেন। আমরা সবাই সমমর্যাদার অধিকারী, মহল্লকদের পরামর্শ গ্রহণ করি। শলাকার দ্বারা নির্বাচনের পদ্ধতি বার করেছি… প্রশাসনের ব্যাপারে শেষ কথা আমরাই বলতে পারি।
সেনাপতি অভয় তবু ছাড়েন না।
—মগধরাজ তাহলে আর সাম্রাজ্য চাইছেন না? সৈন্যদল ভেঙে দিচ্ছেন?
—রাজসংঘ গড়ে উঠলে কারোই আর সাম্রাজ্যের প্রশ্ন থাকছে না— মহামান্য সেনাপতি। কিন্তু সৈন্যদল ভেঙে দেবেন কেন?
—বসিয়ে বসিয়ে ভৃতি দেবেন নাকি?
—নিশ্চয়! তাদের প্রশিক্ষা, অস্ত্রনির্মাণ এ সমস্তই অব্যাহত থাকবে। জম্বুদ্বীপের বহিঃশত্রুর প্রসঙ্গটি আপনারা বিস্মৃত হয়ে যাচ্ছেন।
সংস্থাগার থেকে প্রত্যাবর্তন করতে করতে পাঞ্চাল বুঝলেন এঁরা, এই গণরাজারা অত্যন্ত চাতুর্যের সঙ্গে এই মৈত্রী-প্রস্তাবের ভেতর থেকে নিজেদের জন্য কোনও বিশেষ সুযোগ বার করে নিতে চাইছেন। এঁরা চাইছেন, মগধরাজ অস্ত্র ত্যাগ করুন, সৈন্যদল ভেঙে দিন। নেতৃত্ব বৈশালীর হাতে অর্পণ করুন।
সেনাপতি সীহর কাছে পত্র দিয়ে বন্ধুল পাঠিয়েছেন তাকে। রাষ্ট্রীয় অতিথিশালায় না রেখে সীহ তাকে রেখেছেন নিজের গৃহে। রথে উঠতে উঠতে সীহ জিজ্ঞাসা করলেন, কী ভাবছেন পাঞ্চাল?
—ভাবছি গান্ধার সীমান্তের কথা।
হেসে উঠলেন সহ—কোথায় বেসালি আর কোথায় গান্ধার।
—যতটা দূর ভাবছেন, ততটা নয় সেনাপতি। কুভা নদী পার হতে পারলেই…
—কুভা? যমুনা, সদানীরা, সিন্ধু এগুলির কথা বলুন…বিস্মিত সীহ বললেন।
—পারস্য থেকে এ-দেশে আসতে তো সর্বাগ্রে কুভা-ই পড়বে সেনাপতি! তারপরে অবশ্য সিন্ধু, সদানীরা, যমুনা, গঙ্গা সবই সহজে পার হওয়া যাবে। যে সময়টা আমরা কে সংঘনায়ক হবেন বা কোনও রাজ্যের সৈন্যদল থাকবে কি থাকবে না এই নিয়ে বিতর্ক করব, সেই সময়ের মধ্যেই এ-নদীগুলি পার হওয়া যাবে।
শুনতে শুনতে সীহর চোখ দুটি বিস্ফারিত হয়ে উঠছিল। বেশ কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর তিনি বললেন—সত্যি, আমরা ক্ষুদ্র স্বার্থ নিয়ে বড়ই ব্যস্ত থাকি, নয়!
—ইতিবৃত্ত মনে করুন সেনাপতি। যারা যেখানে পরাজিত হয়েছে, এই কারণেই হয়েছে। এই ক্ষুদ্র স্বার্থ।
—মগধরাজ মহানুভব—আপন মনেই বললেন সীহ, বললেন, রত্নখনি নিয়ে আমরা এত ক্ষুদ্রতা করছি তার পরেও তিনি মৈত্রীর কথা ভাবেন। সত্য পাঞ্চাল, অন্যদের কথা বলতে পারি না, কিন্তু আমি লজ্জিত বোধ করছি।
তিষ্য কোনও রত্নখনির বিষয়ে জানে না। সে সতর্ক কানে শুধু শুনল। মন্তব্য করল না।
—এমন মহানুভব শুধু তথাগত বুদ্ধকেই দেখেছি।
মহারাজ বিম্বিসারের সঙ্গে তথাগত বুদ্ধর তুলনায় তিষ্য চমৎকৃত হয়। কিন্তু সীহ এখন উচ্ছ্বাসের ঘোরে আছেন।
—আমি পূর্বে জিন নাতপুত্তের অনুগামী ছিলাম। ভগবান বুদ্ধের উপাসক হওয়ার পর তিনি আমাকে প্রথম কী কথা বললেন জানেন?
—কী?
—বললেন নাতপুত্তকে আগের মতো অর্চনা করতে আমি যেন বিস্মৃত না হই। তাঁর যেন কোনও ক্ষোভ বা কষ্টের কারণ না জন্মায়।
সেই রাত্রে সীহর গৃহের বিলাস-শয্যায় সহসা আবার তিষ্যকুমারের শয্যাকণ্টকী হল। নিদ্রার মধ্যে অতর্কিতে গুপ্ত শত্রুর মতো এক অনির্দেশ্য উৎকণ্ঠা তার শরীর-মন অধিকার করে নিচ্ছে। এত তীব্র যে, তার প্রথম নিদ্রা ভেঙে মনে হয়েছিল কোনও ব্যাধির আক্রমণ হয়েছে বুঝি বা।
—আমি কি হলাহল পান করেছি? বিস্মিত তিষ্য নিজেকেই নিজে জিজ্ঞাসা করতে থাকে। কী সুতীব্র আক্ষেপ! কোনও খরস্রোতা নদীর তীরে তাকে দাঁড় করিয়ে রেখে কেউ বুঝি চলে গেছে। কেউ নেই, কিছু নেই, কাষ্ঠপুত্তলিকার মতো চালিত হচ্ছে সে এক অবস্থান থেকে অন্য অবস্থানে। বিপুল অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হল। কিন্তু অভিজ্ঞতাগুলিও সব সারিবদ্ধ কাষ্ঠমূর্তির মতো সত্তার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। কোনটিই তার ভেতরে এসে তার রক্ত, মাংস, মজ্জার সঙ্গে মিশল না। হঠাৎ তার মনে হল, সে তার মৃত্যুদৃশ্য দেখছে।
‘পাঞ্চাল তিষ্যর দেহাবসান হয়েছে-এ-এ’ কোথাও কেউ ঘোষণা করছে। ‘এই মাত্র মারা গেলেন।’
‘পাঞ্চাল তিষ্য? কে তিনি?’
‘তিষ্যকুমার নামে এক উচ্চাকাঙ্ক্ষী যুবাকে চিনতাম। কিন্তু পাঞ্চাল?’
‘ও অবশ্যই। সেই তিষ্যই! ভাল, তিনি সৎকৃত হয়েছেন তো?’
শয্যা থেকে উঠে পড়ে তিষ্য। সুপরিসর কক্ষটিতে ঘুরে বেড়াতে থাকে। কখনও বাতায়নের কাছে থামে। তমসাবৃত কাননের দিকে চেয়ে থাকে। আবার আকাশের দিকে মুখ তোলে। জ্যোৎস্নায় তার মুখটি পাণ্ডুর দেখায়। মুষ্টিবদ্ধ হাত দুটি কখনও পেছনে রাখে। কখনও খুলে বাতায়নের বাইরে মেলে দেয়।
—পাঞ্চাল!
—কে? তিষ্য বেগে ঘুরে দাঁড়ায়।
—আমি সীহ।
—আপনি! এত রাতে!
তিষ্য জানে না লিচ্ছবিরা অতিথিবৎসল হলেও অতি সতর্ক। মগধের কোনও রাজপ্রতিনিধিকে কখনও তারা চোখের আড়ালে রাখবে না।
—আপনার নিদ্রা আসেনি!
—এসেছিল, হঠাৎ ভেঙে গেছে।
—অপরাধ মার্জনা করবেন পাঞ্চাল, আমি এখুনি সুন্দরী নটী পাঠিয়ে দিচ্ছি।
—না— পাঞ্চালের চক্ষু দুটি বাঘের মতো জ্বলে।
মৃদু প্রদীপের আলোয় সীহ সেদিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন।
এখন মধ্যরাত। সমস্ত পৃথিবীর সুখী ও নির্বোধেরা গাঢ় নিদ্রায় নিদ্রিত। তিষ্য আর সীহর মাঝখানে নিশীথিনীর আড়াল।
পাঞ্চালের কণ্ঠ ভেসে আসে—এ-কথা কি সত্য সেনাপতি?
—কী সত্য পাঞ্চাল?
—পুরুষের তাবৎ যন্ত্রণার নিরাময় নারীশরীরে?
—এ-কথা কখন বললাম?
—আমাকে বিনিদ্র দেখে রমণী পাঠিয়ে দেবার কথা বলেননি?
—বলেছি পাঞ্চাল! যা সহজ, সুপ্রচল—তাই ভেবেছি। মার্জনা করুন। আপনি স্বতন্ত্র।
—মার্জনার প্রশ্ন নেই সেনাপতি। কিন্তু আপনি অভিজ্ঞ ব্যক্তি। বয়োজ্যেষ্ঠ। বলতে পারেন, কী সে যাতনা যা আমাকে থেকে থেকে বৃশ্চিকের মতো দংশায়।
সত্যিই, অতিথিকক্ষের আলো-অন্ধকারে পাঞ্চালকে এক নীল বর্ণের পুরুষ বলে ভ্রম হয়। দংশনের বিষে নীল।
সীহ বললেন—পাঞ্চাল, যতদূর শুনেছি আপনি তো আমার চেয়েও অধিক আমার চেয়েও ঘনিষ্ঠভাবে তাঁকে দেখেছেন। মনে হয়নি, আপনার এ-যাতনা তিনি দূর করতে পারেন!
—কার কথা বলছেন?
—সেই আদিত্যবর্ণ পরমপ্রাজ্ঞ অমিতাভ তথাগত।
—তিনি যে মৃত্যু এবং নিবৃত্তির কথা বলেন,
—কিন্তু তিনি অমৃতের কথাও তো বলেন! নির্বাণ অমৃত ছাড়া কী? আর নিবৃত্তির কথায় তো আপনার ভয় পাওয়ার কিছু নাই, আপনি সংযমী পুরুষ।
—না, না, এ নির্বাণ, এ-নিবৃত্তি আমার নয়।
তখন নিশ্বাস ফেলে সীহ বললেন, আসুন পাঞ্চাল, বেশবাস করে নিন, দেখি আপনার বৃশ্চিকের দংষ্ট্রা নির্বিষ করতে পারি কি না।
—কোথাও যেতে হবে, সেনাপতি?
—ব্যক্তিগত সংকটের কথা যে মুহূর্তে আমাকে জানিয়েছেন, সে মুহূর্ত থেকে আমি আপনার সুহৃৎ। আমাকে সেনাপতি বলে আর সম্বোধন করবেন না পাঞ্চাল। হ্যাঁ যেতে হবে। চিত্ত এবং চিত্তবৈকল্যের ব্যাপারে যাঁকে সবচেয়ে প্রাজ্ঞ বলে মানি তাঁর কাছে নিয়ে যাই। আমাকে বিশ্বাস করুন।
স্ফটিকের পাত্রের মধ্যে একটি আলোকশিখা জ্বলছে। দূর থেকে দেখা যায়। সম্ভবত একটু উচ্চ ভূমির ওপর গৃহটি। শ্বেতমর্মরের সেই অপরূপ স্থাপত্য জ্যোৎস্নাপিণ্ডের মতো অন্ধকারেও দৃশ্যমান। দীর্ঘ কয়েকটি অঙ্গন পেরিয়ে একটি সুবিশাল কক্ষ। পাথরের স্তম্ভগুলিতে ওপরে পদ্ম, নিচে সিংহ, হস্তী। কোথায় আলো জ্বলছে দেখা যায় না। ভোরের মতো আলোয় কক্ষটি ভরে রয়েছে। মৃদু একটা সৌরভ। সীহ তাকে বসিয়ে রেখে আসছি বলে চলে গেছেন। এতো রাতে নিশ্চয় গৃহকর্তাকে নিদ্রা থেকে তুলতে সময় লাগবে।
কক্ষটিতে প্রতিকৃতি রয়েছে অনেকগুলি। মহাবল, শক্তিসুন্দর পুরুষ সব। দেখতে দেখতে একটির সম্মুখে থেমে যায় তিষ্য—মহারাজ সেনিয় না? একেবারে উদ্ভিন্নযৌবন। কী অসামান্য প্রতিভাদীপ্ত মুখশ্রী! তিষ্যর বক্ষের ভেতর থেকে কী যেন একটা উঠে আসতে চায়। চক্ষু বাষ্পাচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে। এ-দুর্বলতা তাকে সাজে না, সাজে না! সে ঘুরে দাঁড়ায়। সুন্দর-সুন্দর মূর্তিও রয়েছে কক্ষটিতে। সত্যি কথা বলতে কি কত যে শিল্পসম্ভার, আর কী অদ্ভুত সুন্দর তাদের বিন্যাস সে কথা মুখে বলা যায় না। নারীমূর্তিগুলি নৃত্যভঙ্গিমায়। শ্বেত পাথরের, কৃষ্ণ মৃত্তিকার, কত প্রকার আভা যুক্ত বস্তু, সে কি কাংস্য না অন্য কিছু বোঝা যায় না সব সময়ে। তিষ্য মূর্তিগুলি অলস চোখে দেখতে থাকে। এক একটি মূর্তি যেন জীবন্ত। দেখতে দেখতে সুন্দরতম মূর্তিটির সামনে সে দাঁড়িয়ে যায়। এর চোখদুটি অলৌকিক করে এঁকেছেন শিল্পী। ঈষৎ দেখা যাচ্ছে কদলী পুষ্পের মতো একটি দুটি দাঁত। হাত দুটি অঞ্জলিবদ্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে মূর্তি। মুগ্ধ তিষ্য বিস্মিত হয়ে বলে, কোন শিল্পী তোমাকে গড়েছেন জানি না। কিন্তু তিনি মহাশিল্পী।
অঞ্জলিবদ্ধ হাতদুটি কপালের কাছে ওঠাল মূর্তি। মৃদু নিক্কণ শোনা গেল। তিষ্যকে বিস্ময়ে অভিভূত করে মুর্তি বলল—যিনি আপনাকে গড়েছেন, তিনিই।
—আপনি…আপনি…
—আমি অম্বপালি।
পাঞ্চাল তিষ্যর পরিণত যৌবনের শরীর থেকে যেন মন্ত্রবলে বেরিয়ে এল একটি অনভিজ্ঞ, প্রণয়োন্মুখ, বহু আশার আশী এক কিশোর। সে কোন চিরকালের নদীপ্রান্তে দাঁড়িয়ে এক সদ্যকিশোরীকে বলল—আমায় ফিরিও না। ফিরিয়েছ বলে আমি পূর্ণ হতে পারছি না, প্রত্যয়ী হতে পারছি না।
—ফেরাইনি তো! আমি যে তোমাকে বারবার ডেকেছি। দুই সজল চোখে বিদ্যুৎ বর্ষণ করে কম্পিত ওষ্ঠাধরে বলে উঠলেন অলভা—আমাকে এই অফলা যৌবনের কারাগার থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যাও।
যাতনায় নীল হয়ে মুখ ফেরাল তিষ্য।
অমনি কক্ষ পার হয়ে চলে যেতে যেতে স্ফুরিতাধরে কেউ বলে উঠল—চাই না। কিছু চাই না। নিজ কর্তব্যে যাও, ডেকো না আমাকে, বলল—কোমলে ও কঠিনে, প্রণয়ে এবং দুর্বিনয়ে।
—অম্বপালি! আপনি অম্বপালি! বিস্ময়, শ্রদ্ধা, আনন্দ, সমর্পণ সব সব কিছু যেন তার কণ্ঠে।
—হয়ত অম্বপালি। হয়ত নয়। হয়ত বা অন্য কেউ যাকে চিত্তের মধ্যে মূক করে রেখেছেন হে পাঞ্চাল। —করুণ হাসিতে যেন গলতে থাকে মুখশ্রীর মণ্ডন।
তিষ্য দেখল তার দু’ নয়ন থেকে তৈলধারার মতো অশ্রুবর্ষণ হচ্ছে। এক বারিধিই বুঝি জমে ছিল তার বুকের ভেতর।
বারিবিধৌত সেই মুখটিকে তাঁর দু’হাতের অঞ্জলিতে নিয়ে চুম্বন করলেন অম্বপালি। কোথাও দ্বার খোলবার শব্দ হল। আকাশ স্বয়ং নত হয়ে পড়েছে তার ভোরবেলাকার কুসুমবর্ণ মেঘরাজি, তার দ্বিপ্রহরের কাংসোজ্জ্বল রোদ, তার ত্রিযামা যামিনীর অগণ্য নক্ষত্রশোভিত আলো-অন্ধকার নিয়ে। পদ্মগন্ধের লহরী বহে যায়। বহে যায়।
অম্বপালি গান ধরলেন মৃদুস্বরে। কোন অন্তরাল থেকে বীণা বেজে উঠল।
সীহ যখন তিষ্যকে নিতে এলেন তখন সদ্যই অংশুমালী দিগন্ত পার হয়েছেন। স্ফটিকের মতো ঝকঝক করছে শিশিরমণ্ডনা বৈশালী। সখী রম্ভা এসে জানাল—তিস্স ভদ্দ গভীর নিদ্রায় অভিভূত আছেন। অম্বা তাঁকে জাগাতে নিষেধ করেছেন।
সীহ ফিরে গেলেন। মধ্যাহ্নভোজনের পূর্বে আবার তাঁর উৎকণ্ঠিত রথ এসে দাঁড়ায়। রম্ভা জানায় ভদ্দ তিস্স এখনও নিদ্রিত।
—কোনও বিশেষ সুরা…ইতস্তত করে জিজ্ঞাসা করেন সীহ।
—কই না তো! কোনও সুরাই তো নয়!
গোধূলিবেলায় তিষ্য জেগে ওঠে। প্রথমে সে বুঝতেই পারেনি সময় অপরাহ্ণ। সে ভেবেছিল প্রত্যূষ হচ্ছে। ঘরটির চারদিকে বাতায়ন। মুক্ত বাতায়নপথে চোখ ভরে দেখা যায় বৈশালীর অপরাহ্ণশ্রী। দুটি যুবতী ঘরে ঢুকে তাকে স্নানের আহ্বান জানাল।
—স্নানগৃহটি শুধু দেখিয়ে দিন। কারো সাহায্য লাগবে না। বলল তিষ্য। সসম্ভ্রমে কলসে সুরভিত কবোষ্ণ জল রেখে, মার্জনী বস্ত্র, তৈল, অঙ্গরাগ, সুগন্ধি সব সাজিয়ে রেখে চলে গেল তারা।
এক প্রস্থ নববস্ত্র, তার অলঙ্কারগুলি ফলকের ওপর রাখা। স্নানের পর বাইরে এসে দেখে যুবতী দুটি দাঁড়িয়ে আছে। বলল, আসুন ভদ্দ।
—কোথায় যেতে হবে? আমি এবার…
—সায়মাশ খেতে হবে না? অম্বার গৃহ থেকে এমনি যাবেন? আর কয়েক প্রহর হলেই তো পুরো একটি দিবস নিদ্রা হয়ে যেত। ক্ষুধাবোধ হচ্ছে না?
—একটি দিন কেটে গেছে?
—প্রায়।
—তবে কি এখন প্রত্যূষ নয়?
—এখন বৈকাল ভদ্দ।
পরস্পরের দিকে তাকিয়ে হাসে দু’জনে।
সত্যই সে অত্যন্ত ক্ষুধার্ত। এত ক্ষুধা যেন তক্ষশিলার সেই ব্রহ্মচর্যের দিনগুলিতেও কখনও অনুভব করেনি সে। একটি স্বপ্ন দেখেছিল সে গতরাত্রে। স্বপ্নটি তার চিত্তের সমস্ত অন্ধকার সংগ্রহ করে নিয়ে মিলিয়ে গেছে।
অপর দিকের বস্ত্রাবরণী সরিয়ে এক রমণী প্রবেশ করেন। শুভ্র সামান্য বসন। অলঙ্কারের কোনও বাহুল্য নেই। মুক্তকেশী। কে ইনি? এঁর উপস্থিতির ছটায় কক্ষটি যেন বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে।
—এখন ভাল বোধ করছেন তো? মৃদু স্বরে জিজ্ঞাসা করে তিনি বসলেন একটি পীঠে।
—আমার কি কিছু হয়েছিল?
—না, তেমন কিছু নয়। গীত শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়লেন। গভীর নিদ্রা। সুষুপ্তি বলতে পারেন। যে নিদ্রায় কোনও দুঃস্বপ্ন থাকে না।
—দেবী অম্বপালি বোধহয় আমাকে ঘুম পাড়াতেই ওই গীত গেয়েছিলেন…তিষ্য বলে, একটি ফলকে আহার্য এল।
তিষ্য বলল আমি ক্ষুধার্ত। অনুমতি করুন।
—নিশ্চয়, আপনি উদর পুরে খান।
তিষ্য শুনল—খেতেই তো বললাম যুবক…বলছেন এক শুভ্রবসনা কুণ্ডলকেশী শ্রমণা।
একজন যুবতী এসে বলল—অম্বা, সেনাপতি এসেছেন।
—তাঁকে প্রতীক্ষাগৃহে আপ্যায়ন কর সুলসা। আমার নমস্কার জানাও, জানাও মহামান্য পাঞ্চাল প্রায় প্রস্তুত, এখনি যাচ্ছেন।
—যাবার আগে দেবী অম্বপালীর কাছে একবার বিদায় নেব। কোথায় তিনি?
—এই তো আমি। আমিই সে।
—তা হলে কাল রাতে যাঁকে…স্তম্ভিত তিষ্য কথা শেষ করতে পারে না।
—আমাকেই তো দেখেছিলেন পাঞ্চাল।
লজ্জা সংকোচ ভুলে সে এই প্রগাঢ়যৌবনা, তপ্তকাঞ্চনবর্ণা, তন্বী, লাবণ্যকোমল, প্রজ্ঞাভাস্বর মানবীরত্নর দিকে তাকিয়ে রইল।
—বিশ্বাস হচ্ছে না? কেমন এক প্রকার হাসলেন রমণী,—আমি সর্ব কল্যাণী নারী। ছলনা করি না। কিন্তু মানুষ আমার মধ্যে তার মনোলোকের কল্পমূর্তি দেখে। সত্য মানুষটিকে দিবালোক ছাড়া দেখতে পায় না। দিবালোকেও পায় কি? তা পাঞ্চাল আপনি কি স্বপ্নের ঘোরেই থাকতে চান, না দিবালোকের স্পষ্টতায় ফিরতে চান।
—আমি কি স্বপ্নের ঘোরেই ছিলাম এতদিন?
—এমন স্বপ্ন দেখা চোখ আমি বহুদিন দেখিনি।
—বুঝলাম না দেবি।
কী বুঝলেন না?
—কিছুই না।
—একটু প্রতীক্ষা করুন, ধৈর্য ধরুন, দেখবেন, অনেক কিছুই বুঝতে পারছেন। প্রকৃত কথা নিজের চিত্তকে বোঝা।
—তাহলে আমি আপনার কাছে আবার আসব। অনুমতি দিন…
—কাল রাত্রেই আমি আমার শেষ অতিথি গ্রহণ করেছি ভদ্র।
গভীর সজল সেই চোখ দুটির দিকে চেয়ে তিষ্য মাথা নিচু করে বলল—অতিথির মতো আসতে চাই না। আচার্যের কাছে শিক্ষার্থী যেমন আসে, তেমনি আসব দেবি।
জম্বুদ্বীপের এই শ্রেষ্ঠ নারী ভগবান বুদ্ধের চোখেও ধন্দ লাগিয়ে দিয়েছিলেন। বৈশালীতে তাঁর আমন্ত্রণসভায় তথাগত বারবার তাঁকে দেখছিলেন—কী আশ্চর্য এই অম্বপালি। কত সামান্য বেশ, কোনও প্রসাধন নেই, অলঙ্কার ন্যুনতম, তবু কী মহিমা! তুষিত স্বর্গের দেবীরাও বুঝি এই মানবীর কাছে পরাজিত হবে।
প্রকৃতপক্ষে সর্বার্থসুন্দরী এই নারীকে দেখলে পুরুষ এত বিভ্রান্ত হত যে কেউই তাঁকে সঠিক চিনতে পারত না। স্পষ্ট দেখতেই পেত না। তিনি নিতুই নব নব রূপে পুরুষের প্রাণের দুয়ারে গিয়ে আঘাত দিতেন।
২১
ঊষাকাল। মুক্তাভার মতো একটি আস্বচ্ছ দ্যুতিতে দ্যুতিমতী ধরণী। শেষবারের মতো গৃধ্রকূটের পাশ দিয়ে নগর-প্রাকারের দিকে চলে যাচ্ছেন চণক। চলেছেন একটা ঘোরের মধ্যে। পরিচিত পথগুলি অপরিচিত লাগছে। সব যেন অসত্য, ভ্রান্ত, মায়া। নিদ্রিত রাজগৃহ। রাজগৃহ, তুমি জানলে না এক যুগেরও অধিক কাল তোমার জন্য, শুধু তোমার জন্য। হে গৃধ্রকুট, আমার চিন্তার চারণভূমি, বিদায় দাও। হে বৈপুল্ল, বৈভার গিরিমালা, কালশিলা, শীতবন, আম্রবন, বেণুবন, লট্ঠিবন কাত্যায়ন চণক যে পথে এসেছিল সেই পথেই ফিরে যায়।
প্রাকার-তোরণের কাছে বিদায় নিচ্ছেন চন্দ্রকেতু। স্থবিকা দিচ্ছেন কাত্যায়নের হাতে।
—কী এ?
—পাথেয় হে কাত্যায়ন।
—প্রয়োজন হবে না।
—মান্যবর, এ স্থবিকা না নিয়ে যাবেন না, মহারাজের আদেশ।
তোরণ পার হচ্ছেন চণক। —এই পর্যন্ত মগধরাজের আদেশ মানি। তারপর আর না।
মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। চিত্তক তার আরোহীকে নিয়ে ছুটছে। উষা ক্রমে স্ফুট হচ্ছে। স্থবিকা হাতে বিমূঢ় থেমে আছেন চন্দ্রকেতু। কী বলবেন বিম্বিসার নামে সেই দীর্ণ বিভক্ত মানুষটিকে যিনি তরবারির ওপর ভর দিয়ে কূটকক্ষের অভ্যন্তরে একা দাঁড়িয়ে আছেন?
ক্রমে মহাবন, সেই মহা-অরণ্য মানুষের বহু পূর্ব থেকে যা অধিকার করে আছে জম্বুদ্বীপের উত্তর-দক্ষিণ, পূর্ব-পশ্চিম। মাঝে মাঝে তাকে কেটে পরিষ্কার করে কোনও জন নিজেদের বাসভূমি প্রস্তুত করেছে, মাথা তুলেছে জনপদ। সভ্যতা, বাণিজ্য, কৃষি, নগরায়ণ, সংস্কৃতি, মনন, রাজনীতি। কিন্তু সে কতটুকু!
চিত্তককে বনের প্রবেশপথে একটি আমলকী গাছের সঙ্গে শিথিল বাঁধনে বাঁধলেন তিনি। একটু শক্তি প্রয়োগ করলেই সে বাঁধন ছিঁড়ে মুক্ত হতে পারবে। সঙ্গে সঙ্গে উদগত তৃণদলের মধ্যে মুখ নামাল চিত্তক। কত সুখী এই মনুষ্যেতর প্রাণীরা! কত অল্প প্রয়োজন! অল্পতর সান্ত্বনা! চণক মহাবনে প্রবেশ করলেন। যতই যান, বনভূমির আঁচল তাঁকে ঢেকে দিতে থাকে। অনেক চেষ্টায় তিনি সেই কুটিরটিতে আসেন, একদা যা আটবিকরা তাঁর জন্য বেঁধে দিয়েছিল। কুটির নয়, কুটিরের অকিঞ্চিৎকর অবশেষ এখন। চালের একটি খণ্ড বটবৃক্ষের মাথায় দুলছে। খুঁটিগুলি অদৃশ্য। বনভূমির থেকে এক হাত প্রমাণ উঁচু ছিল। সেই উচ্চতার কিছু এখনও টিকে আছে। সেই সরোবর অদূরে, যা দেখে তিনি একদিন বাসস্থান নির্বাচন করেছিলেন। আরও এগিয়ে যান যেখানে একটি জনগোষ্ঠী বাস করে বলে তিনি জানতেন। কোনও চিহ্ন নেই কারও। তৃণে তৃণে গুল্মে গুল্মে ঢেকে গেছে মানুষের চরণচিহ্ন। খসখস শব্দ তুলে চকিত শশক পালিয়ে গেল। ওরাও অমনি করেই পালিয়ে গেছে। ভয়ে। হয়ত শুধু ভয়ে নয়। অজানা আতঙ্ক, কল্পনার অতীত কৃতঘ্নতা হয়ত তাদের ঘৃণাও জাগিয়েছে। হয়ত কেন, নিশ্চয়ই। অথচ তিনি তাদের সেই ক্রোধ, আতঙ্ক, ঘৃণার নিরসন করবার চেষ্টা না করে, তাদেরই বাসভূমি অধিকার করে করে মগধরাজ্যের সীমানা বাড়াতে গিয়েছিলেন। কী মূঢ়তা, কী সীমাহীন মূঢ়তা! আরও বন পার হতে থাকেন তিনি। তৃষ্ণা পেলে পান করেন কোনও পল্বলের জল, ক্ষুধাবোধ তাঁকে ছেড়ে গেছে, তবু যখন জঠরের কথা স্মরণ হয় তখন ফল পাওয়া গেলে খান। না পাওয়া গেলে জল আরও জল। চলতে চলতে তিনি বুঝতে পারেন এই অরণ্যই তাঁর নিয়তি ছিল। নইলে উচ্চভূমি, তুষারাবৃত পর্বতের সানু, উজ্জ্বল বারিহীন দিনরাত্রি এবং স্বর্ণ বর্ণের মানুষ দেখে যার অভ্যাস সে কেন এই অরণ্য, এই বৃষ্টি, এই কৃষ্ণদেশকে এত ভালোবাসবে! চলতে চলতে অস্পষ্টভাবে তাঁর আরও মনে হয় তিনি প্রকৃতপক্ষে একটি প্রবাহ যা অরণ্য ভেদ করে কৃষ্ণ ভারতের অভিমুখে ছুটে চলেছে, রক্তের ভেতরের কোন অজানা তৃষ্ণায়, তৃষ্ণা মেটাবারও তৃষ্ণায়। সম্ভবত তাঁকে চালিত করছে এক অমোঘ শক্তি যা জম্বুদ্বীপের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের একটি সূচক বলে তাঁকে চিহ্নিত করেছে। তাঁর এবং এই দেশের ভবিতব্য হয়ত বা এক ও অভিন্ন। পরম্পরাক্রমে রাজশাস্ত্রের যে চর্চা তাঁরা করে আসছেন তারই বলে হয়ত স্বদেশের ভাগ্যে ভাগ্য মেলাবার এই দুরূহ পুরস্কার তাঁর। কোনও সত্য-সাম্রাজ্য স্থাপনের গুপ্ত মন্ত্র উদ্ভাসিত হচ্ছে তাঁর কাছে আজ, শান্তরস তপোভূমির আশ্রয়ে নয়, অনার্য-অধ্যুষিত এই আদিমানবী অরণ্যানীর গুণ্ঠনের তলায়।
ক্রমশই চণক ঢুকে যেতে লাগলেন আরও গভীরে, গহনে, গম্ভীরে। চতুর্দিকে বনস্পতিসকল আকাশ বিদ্ধ করে নিঃশব্দ কোলাহল করতে থাকল। দেখো হে মানব, মৃত্তিকায় প্রোথিত চরণ, তবু উর্ধ্বে উঠি। যত দূর চক্ষু যায় তত দূর, আরও দূর। সূর্যশিখার সন্ধানে ক্রমাগত নভস্তল বিঁধে চলি। শাখাপ্রশাখাগুলিকে প্রচারিত করে দিই শূন্যমণ্ডলে। বিমুক্ত, অনপেক্ষ, আদিম তবু নবীন, সকল শীতবসন্ত বুকে নিয়ে চিরস্থির তবু চিরপ্রচল।
স্পর্ধিত এই বনবাণী শুনতে শুনতে হর্ষে, রোমাঞ্চে, আক্ষেপে, আক্রোশে, পিপাসায়, অন্বেষায়, ত্রাসে, বিস্ময়ে, দুঃখে, মোহে এক সময়ে তাঁর বাস্তবের জ্ঞান হারিয়ে গেল। সময়ের হৃৎস্পন্দন শোনা যায় না। সময় চলেছে তাঁরই সঙ্গে একীভূত হয়ে, তাঁরই অনুভূমিক বক্ররৈখিক ভঙ্গিতে। এক অনাদ্যন্ত ব্রাহ্মমুহূর্ত ক্রমাগত চলে চলেও তিনি পার হতে পারছেন না এই বোধ তাঁকে আক্রান্ত করল। মস্তিষ্ক হারিয়ে ফেলল তার অনবদ্য ভাবনা-প্রতিভা, স্মৃতি, তার প্রখর আত্মজ্ঞান ও সাধন-সংকল্প, স্বাতন্ত্র্য।
ঘন গুল্ম, লতাপাতা, কোমল বৃক্ষকাণ্ড, শাখাপ্রশাখা দু হাতে সরাতে সরাতে কঠিন শাল-শাল্মলী-অশ্বথ-ন্যগ্রোধ-অর্জুন-সপ্তপর্ণী কাণ্ডে দু হাতে আঘাত করতে করতে চিৎকার করে চণক ডাকতে লাগলেন—রগ্গা, রগ্গা, রগ্গা, রগ্গা, রগ্গা… গম্ভীর নাদের সেই ডাক ক্রমশ ভাঙতে লাগল— কর্কশ, করুণ, শক্তিহীন, ক্রমশ তা ঝিল্লির ডাকের মতো নিরন্তর এক অরণ্যধ্বনি হয়ে গেল। তিনি নিয়ন্ত্রণহীন, সংজ্ঞাহীন পড়ে গেলেন সেই মহাবনের গহন গভীর বক্ষের কোমলতম কজ্জলিত মৃত্তিকায়। অবিকল যেন একটি দীর্ঘ শালবৃক্ষ, সমূল উৎপাটিত। দীর্ঘ হাত দুটি সামনে ছড়িয়ে রইল, বজ্রমুষ্টি খুলে গেল ক্রমশ? তিনি কি প্রথমে কিছু ধরতে চেয়েছিলেন? দুর্মূল্য কোনও কিছু? তার পর সেই বস্তুর ওপর আস্থা হারিয়ে, মায়া হারিয়ে তাকে মুঠি খুলে ফেলে দিয়েছেন! পা দুটি মহাশালের নিষ্পত্র শাখা, কেটে রাখা হয়েছে, দক্ষ বর্ধকিরা অদূরভবিষ্যতে কাজে লাগবে বুঝি বা। তাঁর সুগঠিত নাসা ডুবে গেছে ঝরাপাতার স্তূপে। ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছে সমস্ত মুখমণ্ডলটিই। সম্ভবত তাঁর অন্তরাত্মা লুকোতে চাইছে। কিংবা আশ্রয় চাইছে ধরিত্রীর গভীরে। আশাহীন কোনও মহাসংকটে পরাজিত মহাবীরেরা বীরাঙ্গনারা এইভাবেই আশ্রয় চান ধরিত্রীর কাছে।
উপকথালোক ছেড়ে উড়ে আসে ত্রিকালদর্শী বৃদ্ধ ভূশণ্ডী কাক, ক্রমাগত ডানা ভাসিয়ে ভাসিয়ে আসতে থাকে ব্যঙ্গমা-ব্যঙ্গমী। আসে শুক-সারী, অমিতায়ু উলুক।
—কে ধায়? কে যায়?
—এক প্রেমী পুরুষ। আর ধায় না, যায় না, এখন শয়ান। এখন শব।
কাকে স্নেহ করেছিল?
—স্বজাতিকে, স্বদেশকে, যাকে পৃথিবী বলে জেনেছিল।
—আর কাকেও?
—আর সেই পৃথিবীকে ধারণ ভরণ করতে পারেন এমন একজনকে।
—আর কাকেও?
—বড় জটিল এই স্নেহ স্নেহান্তরের কথা…আর কারও অসুখও তাই এত জটিল নয়।
—আরোগ্য হবে না?
—সময়ান্ত হলে হবে, নইলে নয়।
—এমন কেন হয়? এ অসুখে কেউ কষ্ট পায়, কেউ পায় না…
—সময়কে হারাতে চায় যারা তাদেরই বোধহয় এ অসুখ করে…
—অসুখও তবে এক প্রকার সুখ?…সুখ…সুখ…সুখ এবং ঠিক সেই সময়ে, পরিপূর্ণ সভাগৃহে, বামে বর্ষকার, দক্ষিণে সুনীথ সার্থক সচিবদ্বয়, অবিদূরে চন্দ্রকেতু বিনিশ্চয়কার, অহিপারক নগর শ্রেষ্ঠী, দুই পাশে কুমার অভয় বীরপুরুষ যিনি অবন্তীর আক্রমণ প্রতিহত করেছিলেন এবং হল্ল ও বেহল্ল ছেল্লনাদেবীর পুত্রদ্বয়, আরও বহু অমাত্য, দ্বারপাশে ধনুর্গ্রহ দ্বারী, পিছনে চামরধারিণীরা, ঝলসে উঠল বর্শা কুনিয়র হাতে।
এত অবাক যেন অমাত্যরা আর কখনও হননি। ঠিক এমনটি তাঁরা কেউই ভাবেননি। কুমারের স্বপক্ষীয়রা না, বিপক্ষীয়রাও না। মন্ত্র এখনও গুপ্ত। প্রকৃত বিপদ শ্রমণ গৌতমের, তিনিই মহারাজকে ক্রমশ নিষ্ক্রিয় করে দিচ্ছেন। কিন্তু প্রকাশ্য সভায় মহারাজকে ঘিরে এমন ঘটনা ঘটতে পারে কারওই কল্পনায় ছিল না। বর্ষকার সুনীথ কুমারের আনুগত্য স্বীকার করেছেন। অহিপারক তাঁকে অর্থসাহায্য করবেন কথা দিয়েছেন। কিন্তু তা ইতিকর্তব্য স্থির হবার পর। চন্দ্রকেতু এবং তাঁর অনুগত অমাত্যরা তরোয়ালের কোষে হাত রাখলেন। অভয় স্থিরবুদ্ধি মানুষ। পাছে কেউ মনে করে তিনি সিংহাসনের উত্তরাধিকার চাইছেন তাই নিজেকে সতর্কভাবে সঙ্কুচিত রাখেন। আজ তিনি কিংকর্তব্যবিমূঢ়। হল্ল বেহল্লর চোখে মহাভয়। ভয় বিস্ময় অনুপস্থিত শুধু রাজার চোখে। সামান্য কৌতুক সেখানে এবং ক্লান্তি।
মহিষী কোশলকুমারী কদিন উপর্যুপরি দুঃস্বপ্ন দেখে ঘর্মাক্ত হয়ে জেগে উঠছেন। প্রতিদিন প্রত্যূষে তিনি তাঁর প্রার্থনা নিবেদন করেন।
—কদিন বিশ্রাম করুন মহারাজ, অন্তঃপুর থেকে বেরোবেন না।
—কেন?
—স্বপ্ন দেখলাম গিজ্ঝকুটের গিজ্ঝমুণ্ডটা পড়ে যাচ্ছে, আপনার শির চূর্ণ করে দিল।
—স্বপ্ন দেখলাম জল, ভীষণ তরঙ্গ এক ছুটে আসছে। আপনাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল।
—মহারাজ যাবেন না, স্বপ্ন দেখলাম দক্ষিণবনে দাবানল লেগেছে। আপনি একটি বৃক্ষ, পুড়ে যাচ্ছে…
—দেবি, তথাগত বলেছেন, দুঃস্বপ্ন শরীর মনের বিকারমাত্র।
—যাবেন না মহারাজ, বন্ধ থাক সভা—ছুটে এসেছেন ছেল্লনা।
—কেন?
—কেমন ভালো লাগছে না। কুমার কদিন কেমন অস্থির, চঞ্চল…
—যখন দীর্ঘদিন ধরে তাকে তপ্ত করেছিলে মনে হয়নি এমন দিন আসবে?
অশ্রুমুখী ছেল্লনা, ভয়ার্ত কোশলকুমারীকে পেছনে ফেলে অন্তঃপুরের দ্বার পেরিয়েছিলেন তিনি।
—একমাত্র কাপুরুষেরাই অবরোধের বিবরে মুখ লুকোয় দেবি, বিম্বিসার তো কাপুরুষ বলে সাম্রাজ্য-বিস্তার বন্ধ রাখেনি!
তিষ্যকুমারের শেষ পত্রটির কথা স্মরণ করলেন তিনি। সে তার যথাসাধ্য যত্ন করেছে। প্রত্যেক রাজা, কোশলের তো নিশ্চয়ই, কুরুর, পঞ্চালের, কৌশাম্বীর, উজ্জয়িনীর, বৈশালীর গণরাজারা সবাই তাঁর সঙ্গে মৈত্রী স্বীকার করেছেন। কিন্তু রাজসংঘের ব্যাপারটি কেউই ভালো করে বোঝেননি।
—বোঝেননি? না বুঝতে চাননি? ব্যক্তি বিম্বিসারের তাঁরা সবাই সুহৃৎ। সুহৃৎ? রাজা সেনিয় বিম্বিসার হাসেন। রাজনীতির নিরুক্ত-কারিকায় সুহৃৎ কথাটি বড় আপেক্ষিক। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বার্থে, ব্যক্তিগত, কুলগত, গোষ্ঠীগত স্বার্থে একজন আর একজনের সুহৃৎ হয়। বৃহৎ রাজনৈতিক স্বার্থও আছে। কিন্তু বৃহৎ হলেও তা তো স্বার্থই! নিঃস্বার্থ বন্ধুতা কোনও রাজা কারও কাছ থেকে চাইতে পারেন না। চাওয়া ভ্রম। সে ভ্রমের মূল্য তাঁকে হৃৎ-পিণ্ড ছিঁড়ে দিতে হয়েছে। ব্যক্তি বিম্বিসার? ব্যক্তি বিম্বিসার কে? তাকে কেউ দেখতে পায়? দর্পণ? দর্পণও দেখে কি? সেই ব্যক্তি বিম্বিসারকে জম্বুদ্বীপের রাজকুল আশ্বাস দিয়েছেন নাকি? তিষ্য বলছে! তিষ্য আরও বলছে…রাজসংঘের তত্ত্ব বোধগম্য হতে আর একটু সময় লাগবে। সময়? তিনি হাসেন? সময় আছে নাকি? তিনি তো দেখছেন, সময় দ্রুত চলে যাচ্ছে। সময় আর থাকছে না। তিনি তাঁর রক্তের মধ্যে সময়ের সেই অবলোপ অনুভব করছেন যে!
হে তথাগত, এই জীবন ততটুকুই পারবে যতটুকু ব্যক্তির কর্ম নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। হে তথাগত, এই জীবন বহু আকাঙ্ক্ষার যোগফল, তুমি বলেছ। জীবনের শেষে মৃত্যু। দুর্বার। কেমনভাবে সে আসবে সে-ই স্থির করে। হে তথাগত…
ডান হাতটি তুললেন মহারাজ। আত্মরক্ষার ভঙ্গিতে নয়। যেন বরাভয় দিচ্ছেন। অদ্ভুত! হত্যা করতে যাচ্ছে ঘাতক, তাকে অভয় দিচ্ছেন নাকি? মহাপাপ, মহাপাপ থেকে মহাভয়। অনন্ত নরক। জীবনে এবং জীবনান্তে। তাই অভয়!
—পিতাকে হত্যা করতে চাও? কেন?—একেবারে নিরুদ্বেগ প্রশ্ন, যেন অস্ত্র তোলেনি, কন্দুক তুলেছে কোনও বালক।
—আর কতকাল এই সিংহাসনে বসে আমার পথরোধ করে থাকবেন? আর কতকাল? কত আয়ু আপনার?
সভা শ্বাসরুদ্ধ করে শুনছে। সুনীথ, অহিপারক মুখ নত করেছেন, লজ্জায়, দুঃখে। কোনও নীতি নয়। লোভ, বর্বর লোভের কথাই শেষ পর্যন্ত বলল কুমার? বর্ষকার চেয়ে আছেন দূরের প্রাচীরের দিকে। কী ভাবছেন, বোঝা যায় না। সম্ভবত কী করে এই লোভকে বীর্যে পরিণত করা যায়, সেই কথা ভাবছেন উপায়কুশল মহাসচিব। চন্দ্রকেতুর মুঠির তরোয়াল কোষমুক্ত।
বিম্বিসার উঠে দাঁড়ালেন। কৌতুকের চিহ্ন মুছে গেছে মুখ থেকে।
—বসো। এ আসন ছেড়ে দিলাম। পিতৃরক্ত পাত করা কুশল কর্ম নয়।
সভা ত্যাগ করে চলে গেলেন তিনি। উত্তরীয়টি লুটোতে লুটোতে অবশেষে খসে পড়ে গেল। রাজসভা এবং অন্তঃপুরের মধ্যবর্তী পথে ছিন্ন পতাকার মতো পড়ে রইল।
যত দূর দেখা যায় দেখলেন সভাসদরা। সিংহকটি এখনও, প্রশস্ত পিঠ, পেশল কাঁধ। বীরপুরুষের আকৃতি। বীর কিন্তু অনিচ্ছু। নিজেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছেন।
পরিপূর্ণ সভার অনুচ্চারিত ধিক্কারের মধ্যে ভ্রূকুটি ভীষণ মুখে অজাতশত্রু সিংহাসনে বসলেন।
পুষ্পলাবীর গবাক্ষপথে জিতসোমা দেখল পথ যেন জনহীন। দু চারজন যা চলাফেরা করছে অত্যন্ত সন্তর্পণে, যেন প্রয়োজন সমাধা হয়ে গেলেই আপন বিবরে মুখ লুকোবে। সংবাদ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। কুমার কুনিয় নাকি রাজসভায় সর্বসমক্ষে মহারাজকে হত্যা করতে গিয়েছিল এবং মহারাজ রাজদণ্ড সেই পাপীর হাতে তুলে দিয়ে, রাজমুকুট সেই পাপীর মাথায় পরিয়ে সভাত্যাগ করেছেন।
—এ কী করলেন মহারাজ? তাঁর অনুগত রক্ষী, অমাত্য এরাও তো কিছু অল্প ছিল না! এতেই কি তিনি বাঁচতে পারবেন? শুধু জীবনের প্রতিই এত মায়া!
সহচরী বৃন্দা বলল—পুত্রের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধ করবেন? পিতা-পুত্র পরস্পরের রক্তপাত করছে সেটাই কি ভালো? শুনেছি অমাত্যরা সব মাথা নত করে বসেছিলেন, কেউ একটি কথাও বলেননি, কী বুঝবেন এতে রাজা?
ব্যর্থ ক্রোধে কক্ষের চারপাশে ঘোরে জিতসোমা। নিজেকে এত অযোগ্য মনে হয়! ওই সভায় উপস্থিত থাকার অধিকার সে কোনও মতেই অর্জন করতে পারেনি। মহারাজ তাকে ভৃতকভোগী অমাত্যের পদ দিলেন শেষ পর্যন্ত, কিন্তু তা গুপ্ত রইল। এই গোপনতায় তার সম্মত হওয়া উচিত ছিল কি। কুনিয়-দেবদত্তর দলকে দমন করার যে পরিকল্পনা সে করেছিল তা-ও মহারাজের সঙ্গে আলোচনা করার সময় পাওয়া গেল না। এই থের দেবদত্ত নিজেকে প্রকৃত বুদ্ধ বলে প্রচার করছেন। তাইতে মহারাজ বিরক্ত, ক্রুদ্ধ। সোমা তাঁকে বার বার বলছে রাজগৃহ তো কোনও শ্রমণ কোনও সন্ন্যাসীকেই ফেরায় না! কূটনীতির অঙ্গরূপে মহারাজ থের দেবদত্তকেও উপহার পাঠান না! গয়াশিরে তাঁকে একটি সুন্দর বিহার করে দিন! নিরাপদ দূরত্বও থাকবে, আবার বুদ্ধদ্বেষী এই স্থবির প্রশমিতও হবেন। দেবদত্ত রাজগৃহ থেকে দূরে এবং তুষ্ট থাকলে কুমারের সাহস দম্ভ আস্ফালন সবই অল্প হয়ে যাবে, কারণ অলৌকিক শক্তির ওপর কুমারের বিশ্বাস বালকের মতো। কিন্তু মহারাজ এত কূটনীতিজ্ঞ হয়েও এইটুকু করতে চাইলেন না। বুদ্ধদ্বেষী কাউকে তিনি কোনও ছলেই সইবেন না। …হয়ত মহারাজ মনে করেন, অকপট, অচঞ্চল থাকলে তথাগতই তাঁর অলৌকিক শক্তিবলে তাঁকে সাহায্য করতে পারবেন। কিন্তু এ বিশ্বাস কি ঠিক? তা হলে যে মুহূর্তে কুনিয়র হাত পিতৃবধে উদ্যত হয়েছিল, সে মুহূর্তে সে হাত কেন খসে পড়ল না? নাকি মহারাজ ওই সন্ন্যাসীকে আপন প্রাণের চেয়েও ভালোবাসেন?
জিতসোমা রক্ষীপ্রধানকে ডেকে পাঠায়। সে কিছু বলবার আগেই রক্ষীপ্রধান বলে—সেনাপতির কাছ হতে আদেশ এসেছে দেবি, আমরা কিছুক্ষণের জন্য যাচ্ছি।
—কেন ডেকেছেন?
—তা তো জানি না।
—অনুমানও করতে পারো না?
—অতিশয় গোপন কথা দেবি, সম্ভবত সেনাপতি আমাদের যতজনকে পারেন একত্র করতে চাইছেন।
—যাও।
রক্ষীদের বিদায় দিয়ে জিতসোমা প্রসাধনকক্ষে যায়। দীর্ঘ কেশ কাঁধ পর্যন্ত কেটে ফেলে। বক্ষে চর্মের বর্ম বাঁধে। পায়ে উপানৎ। পিঠে তূণ, কটিতে ছুরিকা। মাথায় করোটিকা শিরস্ত্রাণ। হাতে, জানুতে লাগিয়ে নেয় স্থূল চর্মের পট্টিকা, তাণ্ডব-নৃত্যের নটী সে, পুরুষসুলভ চলনের ছন্দ আয়ত্ত করতে তার বিলম্ব হয় না। সে অপেক্ষা করে। তার অনুগত রক্ষীদের অপেক্ষা।
এক দিন যায়, দু দিন যায়, তৃতীয় দিনও যায় যায়। রক্ষীরা আসে না। আসে কুমার। সংবাদ পেয়ে জিতসোমা বর্ম, শিরস্ত্রাণ, অস্ত্র, উপানৎ সব নামিয়ে রাখে। শুধু বসনের মধ্যে থাকে তীক্ষ্ণধার ছুরিকা।
আসনশালায় ভ্রূকুঞ্চিত মুখে কুমার কুনিয়, সঙ্গে রক্ষীরা। এবং এক শ্রমণ।
—ঘোষণা শুনতে পেয়েছ?
—পেয়েছি। এক দুর্বৃত্ত পিতার হাত থেকে রাজদণ্ড ছিনিয়ে নিয়েছে।
—সাবধান…সাবধান সোমা…কুনিয় চিৎকার করে উঠে দাঁড়ায়।
—মিথ্যা বলেছি?
—কুমার বীরোচিত কর্ম করেছে—পাশে এসে দাঁড়ালেন দীর্ঘদেহী শ্ৰমণ।
—বীর? —সোমা যত না ক্রুদ্ধ তার চেয়েও বুঝি বিস্মিত।
—কাপুরুষের হাতে রাজদণ্ড থাকা না থাকা সমান নারী। যে সন্ন্যাসীর নির্দেশে রাজ্য চালায় তার ওপর কে আস্থা রাখবে?
এই তা হলে সেই স্থবির দেবদত্ত!
বৌদ্ধ ধর্মসংঘের ভেতরে ইনি রাষ্ট্রীয় রাজনীতির কীট ঢুকিয়ে দিলেন তা হলে! এ কি কোনও সনাতন ঐতিহ্য? না কোনও ইতিহাসের আরম্ভ হল এভাবে? নির্বাসনা প্রব্রাজকরা তা হলে রাজনীতিতে এত বড় শক্তি? কারণ? কারণ কী? অশন-বসন নয়, বিলাস নয়, নারীও নয়, প্রভুত্ব। আর সব বাসনা যখন যায়, তখন সব বাসনার শক্তি একত্রিত হয় প্রভুত্বের বাসনায়। জিতসোমার মাথার ভেতরে রাজশাস্ত্রের কয়েকটি শূন্য পাতা উল্টে যাচ্ছে। সে লিখছে: সাবধান! রাজপুরোহিত শুধু ধর্মকার্যে রাজাকে সহায়তা করেন না। তিনি এবং যে কোনও পন্থের প্রব্রাজকদের সঙ্গে রাষ্ট্রনীতির সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে থাকে। সাধারণ সূত্র—ক্ষমতার লোভ। প্রয়োগের ক্ষেত্র—প্রজাসাধারণ। উভয়েরই অস্ত্র—ভয়। রাজা ধনমানপ্রাণের ভয় সব সময়ে জাগিয়ে রাখেন রাজদণ্ড সামনে রেখে। আর সন্ন্যাসীর পলাশদণ্ড? অভিশাপের ভয়, নরকের ভয়, তির্যগ্ বা হীনযোনিতে জন্মের ভয়। হে রাজন, ভবিষ্যৎ যুগের রাজাসকল, আপনারা যদি সত্য সত্যই প্রজাপালক, লোকসেবক হন, হতে চান, তা হলে যে প্রব্রাজক, পুরোহিত, বৈরাগী আপনার ঘনিষ্ঠ হতে চাইবে তাকে গূঢ়, কূট, স্বার্থসন্ধানী জেনে দূরে রাখবেন। রাজা ও সন্ন্যাসী একত্র হলে তা কোনও অর্থেই রাজ্যের পক্ষে শুভ নয়। রাজার পক্ষেও তা শেষ পর্যন্ত অশুভ হয়ে দাঁড়ায়। যেমন মহারাজ বিম্বিসারের ক্ষেত্রে হল।
—কথা বলছ না কেন জিতসোমা? এ কি! কেশ কেটে ফেলেছ কেন?
—এ তো কেশমাত্র, কারও মাথা তো আর নয়!
—কী বললে? রাজা কুনিয়র মাথা নিতে চাও?
রুষ্ট চোখ অন্য দিকে ফিরিয়ে নেয় জিতসোমা।
হঠাৎ অপ্রত্যাশিতভাবে হাসে কুনিয়, বলে—যাই হোক মহামান্য কাত্যায়নও তো এই কথাই বলেন, সে একটি পুঁথি বার করে, —পড়তে থাকে: যে রাজ্য নিজেকে বিতত করে না, প্রতিবেশী রাজ্যের অন্যায় সয়ে যায় সে রাজ্যের আয়ু শেষ হয়ে আসে।…মহামান্য চণক আমাদের সঙ্গে সহমত।
চমকে ওঠে জিতসোমা, কিছু বলে না।
দেবদত্ত বলেন—তক্ষশিলার স্নাতক। রাজশাস্ত্রের রচয়িতা তিনি। বহুদূর পর্যন্ত দেখতে পাবেন, বুঝতে পারবেন—এ আর অধিক কী?
কুনিয় তির্যক চোখে চেয়ে বলল—তিনি যে শ্রমণ গৌতমকে সবার সামনে স্পর্ধা জানালেন, তিরস্কার করলেন, তাঁর প্রভাব যে রাজার পক্ষে, রাজ্যের পক্ষে ক্ষতিকর এ কথা স্পষ্ট জানালেন—তাইতেই তো আমরা আরও ত্বরা করলাম। যে কোনও উত্থানের পেছনে তাত্ত্বিকের সমর্থন থাকা প্রয়োজন। তক্ষশিলক না হতে পারি। পণ্ডিতদের মেনে চলি।
—এ পুঁথি কোথায় পেলেন? ছিন্ন কেন?
—গান্ধার ভবনে! আর কোথায় পাবো? পাতাগুলি কক্ষের মধ্যে ইতস্তত বিচরণ করছিল।
—সে কী? তিনি কোথায়?
—আমরা সন্ধান করছি। মনে শঙ্কা রেখো না সোমা। দৈবরাত চণককে আমরা মাথায় করে রাখব। আর তোমাকে?…
কুমার কুনিয় এখন রাজা অজাতশত্রু, তার কথা শেষ করল না। প্রকৃতপক্ষে সে সোমাকে কোনও নির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি দিতে পারছে না। অন্তঃপুরে তার মহিষী পদুমাবতী অত্যন্ত চতুর, ক্ষমতাবতী, অভিমানিনী হয়ে উঠেছে। সদ্যবিবাহিতা সুন্দরী তরুণী, কুনিয়র তার প্রতি আকর্ষণও কিছু অল্প নয়। অথচ সোমা এক অমূল্য সম্পদ, পিতার সঙ্গে সংগ্রাম করে পাওয়া। সোমাকে হারাতে হলে…হারাতে হলে…কুমার ক্ষিপ্তের মতো ঘাড় ফেরায়। না। না।
রাত্রি দ্বিপ্রহর। শ্মশানের স্তব্ধতা চারদিকে। কিন্তু রাজগৃহের ঘরে ঘরে শিশু, রোগী ও অতিবৃদ্ধ ছাড়া নিদ্রা যায়নি কেউ। যুবরাজ অজাতশত্রু রাজা হয়েছেন এ ঘোষণা চলেছে সারাদিন, রাতের প্রথম প্রহর পর্যন্ত। এখন সে ঘোষণাও বুঝি ক্লান্ত। যারা এতদিন রাজাকে দোষারোপ করছিল, তারা বিষণ্ণ হয়ে ঘরের মধ্যে বসে। হট্টে, আপণে ক্রয়-বিক্রয় তেমন হয়নি। বিম্বিসার সমালোচিত হলেও লোকপ্রিয় ছিলেন, প্রজাদের ক্ষতি কখনও করেননি। পিতাকে সিংহাসনচ্যুত করে যে সিংহাসনে বসে, তার হাতে নিরাপত্তা থাকবে কিনা এই প্রশ্নে ভারাক্রান্ত সবার মন। কিন্তু রাজপরিবারের ব্যাপার, অমাত্যরাই কিছু বলছেন না, সাধারণে কী বলবে!
মহাশ্রেষ্ঠী যোতীয় জটিল শ্ৰেষ্ঠীকে বললেন—বুঝলে কিছু?
জটিল সতর্ক কণ্ঠে বললেন—আমাদের ধনমানপ্রাণ?
—নিরাপদ ছিল, এখন বিপন্ন।
—বলছেন?
—বলছি—স্থূল ভ্রূযুগের মধ্যে অসংখ্য কুঞ্চন, যোতীয় চোখ দুটিও কুঞ্চিত করে যেন অদূরকালের অভিসন্ধি বোঝবার জন্য সামনে চেয়ে রইলেন।
—রাজ্যের হয়ত ভালোই হবে। মহারাজ তো ইদানীং…
—বাক্য শেষ করো জটিল। মহারাজ তো ইদানীং কী? সুবিচার করছিলেন না? না, তোমার সঞ্চিত ধনের কলসগুলি চেয়ে পাঠিয়েছিলেন! কোনটি?
—কোনওটিই নয় মহাসেট্ঠি, রাজোচিত উদ্যম-উদ্যোগের কিছু অভাব দেখা দিয়েছিল। এই মাত্র।
—তোমারও পুত্র আছে জটিল। ভেবে দেখো…
রাজসভাতেও অমাত্যরা গম্ভীর মুখে বসে থাকেন, গ্রামণীরা ব্যাপার শুনে শুষ্কমুখে ফিরে চলে যান। রাজগৃহ-শ্রেষ্ঠী অহিপারক দিনের পর দিন অনুপস্থিত থাকেন, তাঁর নাকি কঠিন অসুখ। অন্তঃপুর থেকে সংবাদ আসে রানিরা অজাতশত্রুর সাক্ষাৎ-প্রার্থী। থের দেবদত্ত বলেন—সাবধান মহারাজ, আপনার পিতা ছিলেন লোকপ্রিয়। তাঁকে চক্ষের সামনে রেখে রাজত্ব করা দুষ্কর হবে। আরও সাবধান, আপনার মাতারা আপনাকে দ্রব করতে চেষ্টা করবেন।
সেনানীগ্রামে উপঢৌকন যায়—সেনারা নতুন রাজার অভিষেক উপলক্ষে উৎসব করো। নৃত্য-গীত, ভোজ, যত প্রকার আমোদ-প্রমোদ জানা আছে, সব। ব্যয় বহন করবেন রাজা। রাজ্যময় উৎসবের ঘোষণা হতে থাকে। অন্ত্যজ-পল্লীতে নতুন বস্ত্র, গন্ধানুলেপন, উৎকৃষ্ট তণ্ডুল বিতরিত হয়। দান যায় শাক্যপুত্রীয় ছাড়া অন্য শ্রমণসংঘগুলিতে। রাজা অজাতশত্রু অন্তঃপুরে আসেন ভয়ানক অপরিচিত মুখ নিয়ে, সঙ্গে নতুন রক্ষী সব। অঙ্গদেশ থেকে এসেছে। আদেশ হয়—
—কারারুদ্ধ থাকবেন রাজপিতা, এখন থেকে।
আর্তনাদ করে ওঠেন রানিরা।
বিম্বিসার বলেন—আর কী চাও?
—রাজদ্রোহ প্রচার করছেন অন্তঃপুরে বসে!
—প্রমাণ?
—আপনাকে দেখাতে শোনাতে বাধ্য নই।
অস্ত্র ঝনঝন করতে করতে চলে গেল অজাতশত্ৰু।
ছেল্লনা সকাতরে বললেন—মহারাজ! কিছু করুন!
—আর কিছু হয় না—বিম্বিসার বললেন— এ-ই আমার কর্মফল। তোমারও কর্মফল রাজ্ঞী। হল্ল-বেহল্লকে অবিলম্বে সেচনকের পিঠে মাতুলালয়ে পাঠাও।
—হল্ল-বেহল্ল নিয়ে গেছে আমার মঙ্গলহস্তী, আঠার লহর রত্নহার। এ সব রাজার সম্পদ। —অজাতশত্রু ক্রোধে আগুন হয়ে কারাগারে প্রবেশ করে—কেন দিয়েছেন?
—এক পুত্রকে সমগ্র রাজ্য দিলাম। আর দুই পুত্রকে মাত্র একটি হস্তী ও একটি রত্নহার। অন্যায় হল?
—ওই হস্তী রাজার বাহন। ওই হার কণ্ঠে নিয়ে রাজা সিংহাসনে বসেন।
ভদ্রাবতী আছে, নালাগিরি আছে, বাহনের অভাব কী? রত্নহারেরও অভাব নেই কোষাগারে। ক্রোধে গর্জন করে অজাতশত্রু।
ক্ষীণভাবে মনে পড়ে রাজার, এই পুত্র তাঁর প্রথম বৈধ পুত্র। একে দিনে দিনে বেড়ে উঠতে দেখেছেন মাতৃগর্ভে। ভূমিষ্ঠ হবার পর সে কী উৎসব সমস্ত রাজ্যে। কুনিয়কে অদেয় সেদিন তাঁর কিছুই ছিল না। সারা বাল্য এই পুত্রের কেটেছে তাঁর প্রশ্রয়ে, সচিবরা বলেছিল তক্ষশিলায় পাঠাতে। অত দূরে বলে তিনি বারাণসী থেকে আচার্য আনান। স্বতন্ত্র প্রাসাদে আচার্য এবং শস্ত্রাচার্যদের কাছে শিক্ষা কুনিয়র। কোশলদেবীর এতে আপত্তি ছিল। তিনি ঐতিহ্যশালী কোশল রাজবংশের কন্যা, তক্ষশিলার শিক্ষা না হলে সত্যিকার রাজবংশের উপযুক্ত হবে না পুত্র, এইজাতীয় মনোভাব তাঁর ছিল। কিন্তু কুনিয় নিজেও যেতে চাইল না। তিনিও মেনে নিলেন। ফলে, প্রকৃত ব্রহ্মচর্য পালনই করতে হয়নি কুমারকে। আরও অতিরিক্ত স্নেহ ছিল তার দেহগত ত্রুটির জন্য।
—হল্ল-বেহল্লকে ফিরে আসতে আদেশ করুন। হস্তী এবং হার নিয়ে।
—তারা পালিয়েছে প্রাণের ভয়ে কুনিয়। অভয় দিলে নিশ্চয়ই আসবে।
আর উপহার দিয়ে ফিরিয়ে নেবার আগে বিম্বিসারের মৃত্যুও ভালো।
—তবে তাই হোক। দন্তে দন্ত ঘর্ষণ করে উচ্চারণ করে সে।
অজাতশত্রু আদেশ দিয়ে গেল বন্দীর আহার বন্ধ। কেউ যেতে পারবে না তাঁকে দেখতে, একমাত্র কোশলদেবী ছাড়া।
কদিনের মধ্যেই বৃদ্ধ হয়ে যান বিম্বিসার! অন্ধ কারাকক্ষে একটিমাত্র ছিদ্র। সেই ছিদ্রপথে গৃধ্রুকুট দেখা যায়, আলোকিত সেই বিন্দুটির দিকে চেয়ে চেয়ে রাজ্যচ্যুত মগধরাজ ভাবেন—কে আমি? সত্যই বা কী? ষোড়শ বর্ষের যে কিশোরকে তার পিতা রাজমুকুট পরিয়ে দিয়েছিলেন, যে যুবক শত্রুরাজ্যের শত বিপদ অগ্রাহ্য করে এক অনন্যার প্রণয়াহ্বানে সাড়া দিয়েছিল, যে পরিণতযৌবন বীরপুরুষ এক অলোকসামান্য শ্রমণকে আত্মনিবেদন করেছিল, সে কি সত্য? না এই ক্ষুৎপিপাসা-কাতর ভগ্নহৃদয় বৃদ্ধ সত্য? দুটি আমিই কি এক ব্যক্তি হতে পারে? কোন্ কর্মফল দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন আকৃতির, ভিন্ন ভাগ্যের মানুষকে যুক্ত করছে? মঙ্গলহস্তীর পিঠে সেইসব দুঃসাহসী অভিযান…শতসহস্র প্রজার জয়ধ্বনি, সপারিষদ সেই সব তীর্থগমন!
ক্রমশ হতবল হতে থাকে শরীর। অবসন্ন মন। চৈতন্য আবিল। বৃদ্ধ আর ভালো করে দেখতে পান না। চিন্তাগুলি বিবর্ণ চিত্র গড়ে। গড়ে আর ভেঙে যায়। শত চেষ্টা করেও সেগুলি সমঞ্জস ও সুস্থির রাখতে পারেন না। কে আমি? এই চেতনা যাকে আমি বলে জানে সে কে? কয়েক দিন আগেও তো সে ছিল না? হায় তথাগত! বলেছিলে বটে প্রতিটি ক্ষণ স্বতন্ত্র; নিরবচ্ছিন্ন ধারে ক্ষণ পরম্পরা আসে তাই মনে হয় এক। প্রকৃতপক্ষে এক নয়। বালক বিম্বিসার, যে জলের মুকুরে মুখ দেখত, বান্ধবী সুমনাকে যখন তখন প্রহার করত ও প্রহার খেত, যে বিম্বিসার পিতার পরাজয়ের শোধ নিতে অঙ্গরাজ ব্ৰহ্মদত্তকে হারিয়ে নির্মূল করে দেয়, যে বিম্বিসার মহাসমারোহে শ্রাবস্তীর রাজকুমারীর পাণিগ্রহণ করল সমবেত জয়কারের মধ্য দিয়ে, এক শ্ৰমণ যুবকের অলোকসামান্য প্রতিভাচ্ছটায় মুগ্ধ হয়ে যে তাঁকে রাজন্যপদ, সেনাপতিপদ সব দিতে চাইল, দেশনা শুনছে, মহারানি ক্ষেমার সঙ্গে রহস্যালাপে মত্ত, চণক…দৈবরাত চণকের সঙ্গে সেই আশ্চর্য মিলনে মিলিত বিম্বিসার, ভোজনগৃহের কেন্দ্রে আমরণ বন্ধুত্বের অঙ্গীকার…হায় চণক…হায়, এগুলি ভিন্ন ভিন্ন বিম্বিসার, নানা বিম্বিসারের এক মালা এ। একটির কর্ম অন্যটিকে সৃষ্টি করে যাচ্ছে ক্রমাগত…তৈলধারের মতো। এগুলিকে স্বতন্ত্র বলে পরিষ্কার চিনতে পারছেন তিনি আজ। কার্যকারণ সম্পর্কে বিম্বিসারগুলি গ্রথিত।
ভগবন, ভগবন পিপাসায় বুক ফেটে যায়। করুণা করো করুণা করো। তোমার সেই অলৌকিক করুণাধারে স্নাত করাও এই বিম্বিসারের জীবন, যা ধ্বস্ত, ব্যর্থ হতে চলেছে। এ কি ঘোর অন্যায়? ঘোরতর পাপ! আত্মজ হয়ে স্নেহশীল পিতাকে কারারুদ্ধ করে? অনাহারে হত্যা করে? জননীর দেহ অনুসন্ধান করায়! কোন্ কর্মফলে এই ব্যর্থ পিতা, ব্যর্থ রাজা সৃষ্টি হল? হে ভগবন!
গবাক্ষের দিকে মুখ তুলে চান বন্দী। আশ্চর্য! তথাগত আবির্ভূত হয়েছেন! পসেনদিকে সহস্র বুদ্ধ দেখিয়েছিলেন, আজ বিম্বিসারের ডাকে তমসের মধ্যে জ্যোতিঃস্বরূপ হয়ে আবির্ভূত হয়েছেন। চোখ ভরে, প্রাণ ভরে সেই অতীন্দ্রিয় দৃশ্য দেখতে থাকেন বিম্বিসার। মহাশূন্যের পটে ভগবান তথাগত বুদ্ধ। দেখতে দেখতে দেখতে দেখতে অবশেষে বিম্বিসার নামের একদা প্রতাপশালী প্রজারঞ্জক অধুনা আত্মপরিচয়হারা, দীনাতিদীন বন্দী সহসা বুঝতে পারেন, এ কোনও অলৌকিক আবির্ভাব নয়। এখন কারার বাইরে পৃথিবীতে প্রত্যূষ এসেছে। তথাগত দেশান্তরে ছিলেন, এসে নিদারুণ সংবাদ শুনেছেন, রাজগৃহের বিস্ফোরক বাতাবরণে নিষ্ঠুর রাজনীতির কাছে উপরোধ করে বিম্বিসারকে মুক্ত করবার সাধ্য তাঁর নেই। তিনি শুনেছেন গৃধ্রকূটশীর্ষ থেকে এই কারাকক্ষ দেখা যেতে পারে। তাই সূর্যোদয়ের লগ্ন থেকে দাঁড়িয়ে আছেন সেখানে। তিনি যত সহজে ভগবানকে দেখতে পাচ্ছেন, ভগবান তত সহজে তাঁকে দেখতে পাচ্ছেন না। আদৌ পাবেন কি না সন্দেহ। কিন্তু তিনি চেষ্টা করছেন। বৃদ্ধ তথাগত, বৃদ্ধ বন্দী বিম্বিসারকে দেখবার চেষ্টা করছেন। সকরুণ, কাতর নয়ন। অশ্রুবিন্দুগুলি বুঝি চোখের প্রান্তে থমকে আছে। হাত দুটি কি অঞ্জলিবদ্ধ! সম্ভবত পরমপুরুষ উপনিষদোক্ত ঈশের কথা যিনি কখনও বলেন না, আজ পরমতর কোনও শক্তির কাছে তাঁর শ্রেষ্ঠ সুহৃৎ বিম্বিসারের জন্য প্রার্থনা করছেন। এবং সেই মুহূর্তে বিম্বিসার এ-ও বুঝতে পারেন, কী সেই কর্ম যার এই ফল। তথাগত, তথাগতরূপ সম্মোহই সেই কর্ম, এই রুদ্ধ কারা তারই ফল। শুধু তথাগত কেন, বিশ্বনিয়ামক কোনও মহাশক্তি পর্যন্ত তার ব্যত্যয় ঘটাতে পারে না।
তথাগতরটিত কর্মতত্ত্বের এবম্বিধ মর্মান্তিক উদ্ভাসই মহারাজ বিম্বিসারের জীবনের শেষ প্রাপ্তি।
২২
বাইরে অনেকগুলি পেঁচা একসঙ্গে যেন আর্তর করে উঠল। কাঁ কাঁ ক্রাঁরর্র্ ক্রাঁরর্র্। তারপরেই কাকেদের তুমুল কোলাহল। কারা ধ্বংস হচ্ছে বোঝা যায় না। কিছুক্ষণ আগে প্রাসাদের দিক থেকে উপর্যুপরি ভেরীর আরাব শোনা গেছে। সামান্য একটু তন্দ্রা এসেছিল, ভেরীর অস্বাভাবিকতাতেই সম্ভবত সে লঘু তন্দ্রা ছুটে গেল। রাতের পর রাত নিদ্রা আসে না জিতসোমার। পুষ্পলাবীর গর্ভে সে বহুদিন হল বন্দিনী। কত দিন সে আর গুনে গুনে পারে না। রাজপ্রাসাদ, রাজগৃহ নগরীর অভিজাতকুল, মগধের রাজনীতি সব, সব কিছুই যেন গান্ধার নটীকে ভুলে গেছে। জিতসোমার দেহ ক্ষীণ, চোখের চারপাশে অনিদ্রার কালি। রাজগৃহ কেমন যেন ছিল? তার পাহাড়, পাহাড়িয়া পথ, কাননগুলি? সব যেন দূর জন্মের স্মৃতি। জিতসোমা বাইরে যেতে পারে না। তার কাননে, প্রাসাদের প্রবেশপথগুলিতে পাহারা দিচ্ছে অজ্ঞাতকুল সব রক্ষী। কক্ষ থেকে কক্ষে ভ্রমণ করা ছাড়া তার আর কোনও উপায় রাখেনি এরা। প্রথম যেদিন বাইরে যাবার চেষ্টা করেছিল, তিনজন ভীষণদর্শন অস্ত্রধারী সঙ্গে সঙ্গে চলতে লাগল। সোমা দেখল তার রথ নেই। মন্দুরা শূন্য। কয়েক পা যাবার পর সে ফিরে এসেছিল।
তার দাসী ধ্রুবা প্রথম প্রথম হট্টে যেত। শাক, পর্ণ, মাংস, মৎস্য, ঘৃত.. তণ্ডুল… প্রয়োজন কি একটা? ধ্রুবা এসব ছাড়াও আনত সংবাদ।
এদিক ওদিক চেয়ে মৃদুকণ্ঠে বলত—শুনেছেন দেবি, মহারাজ নাকি এখন কারাগারে।
—সে কি? সিংহাসন ত্যাগ করার পরেও?
—তাই তো শুনছি? কুমারের সঙ্গে কী রত্নহার নিয়ে কলহ…
—আজ বড় মর্মান্তিক কথা শুনে এলাম।
—কী!
–কুমার নাকি মহারাজকে অনাহারে রেখেছে। কাউকে তাঁর কাছে যেতে পর্যন্ত দেয় না। এক মহারানি ছাড়া। তা মহারানি নাকি কবরীর মধ্যে, পাদুকার মধ্যে লুকিয়ে ভোজ্য নিয়ে যেতেন। ধরা পড়ে গেছেন। অকথ্য লাঞ্ছনা হয়েছে তাঁর। ভাবতে পারেন! রাজমহিষী, রাজার মা!… শুনছি কুমার নাকি মায়ের বিরুদ্ধে অস্ত্রও তুলেছিল। জীবক কোমারভচ্চ আর ওই অমাচ্চ বস্সকার মিলে থামান।
—প্রজারা, বড় বড় গৃহপতিরা কেউ কিছু বলছেন না?
—প্রজারা ভয়ে স্তব্ধ হয়ে রয়েছে। এতটুকু বিরুদ্ধাচরণ করলেই ভীষণ দণ্ড হয়ে যাচ্ছে। অমাচ্চ মহানাগকে হত্যা করেছে। সেট্ঠি পুন্নক পালিয়ে যাচ্ছিলেন, গঙ্গাবক্ষ থেকে তাঁকে ধরে এনেছে। ওই দেবদত্ত থের নাকি মহা ইদ্ধিমান। হাতে বালুমুঠি ধরে মন্তর পড়লে তা মুষলমুঠি হয়ে যায়।
কিন্তু এই সব সংবাদের প্রবেশ এখন থেমে গেছে। রক্ষীরা একদিন স্থবিকায় করে প্রয়োজনীয় দ্রব্যগুলি নামিয়ে রাখল একে একে। শাক, পর্ণ, মৎস্য, মাংস, ঘৃত, তণ্ডুল…। অপাঙ্গে একবার চাইল, সে কী দৃষ্টি! ভালো। কী চায় এই কুমার! বুদ্ধপূজা করার অপরাধে একটি বালিকা নটীকে পর্যন্ত না কি হত্যা করেছে রাজপুরীতে। শ্রীমতী। চন্দ্রকেতু কারাগারে, মহানাগ নিহত। আরও বহু বিম্বিসার ভক্ত, বুদ্ধপন্থী রাজপুরুষ হয় কারাদণ্ড ভোগ করছেন, নয় মৃত্যুদণ্ড। ওই অমাত্যদের সঙ্গে তার যোগাযোগের কথা কি এতদিনেও প্রকাশ পায়নি? তাকেও হত্যা করুক না। হত্যা করো। সোমাকে হত্যা করো কুমার। শৃঙ্খলিত করতেও অন্তত এসো! সোমা কোনদিন তোমার প্রতি সুমুখ হবে না। সে ভক্তি করেছিল তোমার পিতাকে।
কুট্ট কুট্ট কুট্ট কুট্ট… কোথায় যেন কাষ্ঠকুট্ট পাখি শব্দ করছে। একটু পরেই অদূর অরণ্য থেকে ভেসে আসে কৃষ্ণসার পুরুষের হ্বাক হ্বাক হ্বাক। আবার কাষ্ঠকুট্টর কুট্ট কুট্ট কুট্ট…
এত রাতে কাষ্ঠকুট্ট? সহসা সতর্ক হয়ে উঠল জিতসোমা। উত্তরীয়টি ভালো করে মাথায় জড়িয়ে, ডান হাতে ছোট ছুরিকা নিয়ে সে প্রস্তুত হয়। এ অন্য কোনও নিশাচর। শব্দটি লক্ষ্য করে সে বাতায়নের দিকে এগিয়ে যায়। নিঃশব্দে খুলে ফেলে কপাটদুটি।
এক অঞ্জলি ম্লান চন্দ্রালোক।
—ভদ্রে! —মৃদু বৃষ্টিপাতের মতো কণ্ঠস্বর। বহু বর্ষার ওপার থেকে কণ্ঠটি ভেসে আসে। বহু মেদুর বর্ষা, বহু বিফল বসন্ত, বহু নীলবর্ণ শীত, পীতবর্ণ গ্রীষ্ম। এই কণ্ঠ আর শুনতে পাওয়া যাবে আশা ছিল না। শুনলে হৃদয় এমন করবে জানা ছিল না।
ছায়াশরীর ভেতরে প্রবেশ করে।
—আজ রাত্রির প্রথম যামে মহারাজ… প্রয়াত হলেন।
উদ্গত ক্রন্দনধ্বনি অন্ধকার গ্রাস করে নেয়। দুজনে অতি নিকটে। মাঝে একটি আলিঙ্গন থমকে আছে।
—আপনি কি জানেন দৈবরাত নির্বাসিত?
—সে কী? কেন?
জিতসোমার পায়ের তলায় পৃথিবী প্রকম্পিত হচ্ছে।
সম্ভবত গৌতম বুদ্ধর বিরুদ্ধাচরণ করার জন্য। সম্ভবত কেন তাই-ই।
—কত দিন?
—অনেক দিন। তার পরেই কুমারের এই দ্রোহ…মহারাজের পাশে দুঃসময়ে তিনি রইলেন না। অঙ্গীকার ছিল উভয়ের মধ্যে, মহারাজ মানলেন না…নিয়তি…। ভদ্রে কেউ জানে না তিনি কোথায় গেছেন। কারাগারে অমাত্য চন্দ্রকেতুর কাছে শুনলাম… মহারাজের দেওয়া স্বর্ণ, বাহন, বসন, অস্ত্র সমস্তই প্রত্যাখ্যান করে চলে গেছেন।
নিমেষগুলি নিঃশব্দে পার হতে থাকে। বিশুষ্ক, অশ্রুহীন।
—ভদ্রে, আজ নগরী অরাজক, আপনার রক্ষীরা প্রাসাদের দিকে চলে গেছে। কুমার সম্ভবত গণ-উত্থান আশঙ্কা করছেন। আসুন, আমরা রাজগৃহ ছেড়ে চলে যাই।
পাঞ্চালের বাহু গান্ধার নটী বিম্বিসার-অমাত্য জিতসোমাকে ঘিরে ধরে।
নীলকৃষ্ণ বনরেখার ওপর গৈরিক পথটি বাঁক নিতে নিতে চলেছে। বিসর্পিল রেখায় চলেছে সার্থ। বারাণসী বণিকদের তীর্থ। এমন পণ্য নেই যা বারাণসীতে পাওয়া যায় না। এমন সার্থ নেই যারা বারাণসীতে বাণিজ্যার্থে আসে না। প্রাচী থেকে বহু বছর স্থলবাণিজ্য করে সার্থ মধ্যদেশে স্বগৃহে ফিরছে। বারাণসী হয়ে শ্রাবস্তী যাবে। রৌরূক থেকে কৌশাম্বী হয়ে আবার আসছে আরও একটি দল। এরা যাবে চম্পা, দক্ষিণগিরি, আলবী। বারাণসী হয়ে এসেছে। উভয় দলের দেখা হয়েছে উরুবেলা গ্রামের কাছে। দুটি দলেই রয়েছে শ্বেতবসনধারী নিয়ামক, লোহিত বেশ পরা রক্ষীরা। তাদের হাতে লগুড়, ধনুর্বাণ, তীক্ষ্ণ ধার ছুরিকা। বণিকদের অধিকাংশই কুসুমবর্ণের উত্তরীয় ও পাটল অধোবাস পরেছে। দীর্ঘ পথ পার হবার সময়ে ধূলির ভয়ে তারা এই বর্ণগুলিই নির্বাচন করে। সিন্ধু-সৌবীর থেকে আগত দলটির সঙ্গে অশ্বতর ও গর্দভ ছাড়াও রয়েছে কতকগুলি উট। মরুদেশ থেকে সংগ্রহ করে আনা হয়েছে। এই মরুবাহন উষ্ট্রদেবদের বিশেষ মর্যাদাসহকারে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। যানরূপে এদের অসীম গুণগুলির প্রচার হবে অঙ্গদেশে। এঁদের প্রধান পণ্য রত্ন। বারাণসীর হাটে সবই প্রায় বিকিয়ে গেছে। সম্ভ্রান্ত রুচিমান ধনপতিরা, মণিকাররা কিনেছেন।
অঙ্গদেশের সার্থ নিয়ে চলেছে তামা, লোহা, বসন, কিলিঞ্জক, সুরা। সার্থবাহ নন্দিয় রয়েছেন এই দলের পুচ্ছের দিকে। তাঁর বাহন একটি অশ্বতর। অশ্বতরই ভালো, তা যদি বলেন। অশ্ব থেকে একবার তিনি পড়ে গিয়েছিলেন। গুরুতর কিছু হয়নি। কিন্তু শিক্ষা হয়ে গেছে। জীবনটি দুর্মূল্য বস্তু। বহু ভাগ্যবিপর্যয়, আবার সৌভাগ্য, দৈব করুণা, মানুষী সহায়তা ইত্যাদি মিলিয়ে এখন একটি পরিতোষজনক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। অত সহজে দুম বলতে অশ্বের পিঠ থেকে পড়ে গেলে হয়! অপর দলটির কাছ থেকে তিনি দুটি উট কিনেছেন, সেগুলিকে এর পরে পশ্চিমে বাণিজ্যযাত্রা করার সময়ে ব্যবহার করবেন ভেবেছেন। কিন্তু নিজে ওগুলির ওপর কখনই চড়বেন না। বালুকাময় মরুকান্তারে নাকি চড়তেই হয়।
নন্দিয় অপর দলটির সার্থবাহর কাছ থেকে অনেক রত্ন এবং উপরত্ন কিনেছেন। বৈদুর্য, সিতমণি, বিদ্রুম, অকীক, স্ফটিক, নামহীন বহু বর্ণের উপরত্নই অধিক। নন্দিয়র ইচ্ছা বারাণসীতে মণিকারপল্লী থেকে এই রত্নগুলি দিয়ে পত্নী ময়ূরীর জন্য একটি ঘনমট্ঠক নির্মাণ করাবেন। এই অলঙ্কার পরেন বিসাখাভদ্দা, ময়ূরীর সখী। অত মূল্যবান অলঙ্কার নন্দিয় এ-জন্মে আর নির্মাণ করাতে পারলেন না। রত্নগুলির স্থানে উপরত্ন দিলে হয়ে যেতে পারে। বড় সুন্দর অলঙ্কারটি। নিজের জন্যও একটি রত্নহার গড়াবেন নন্দিয়। সকলের অলক্ষ্যে পেটিকা থেকে একটি মুকুর বার করে, কেশগুলি আঁচড়িয়ে নেন সার্থবাহ। মুখটি তো এখনও ভালোই আছে। তেমন বয়সের রেখা তো কই…!
পেছন থেকে একটি তরুণ অপর একটি তরুণকে বলল— খুল্লতাতর মাথাটি গেছে। কোসল যত এগিয়ে আসছে দর্পণে মুখ দেখা ততই বেড়ে যাচ্ছে।
কথাটি কানে যায় নন্দিয়র। খুল্লতাত? কোন পিতার সম্পর্কে তোমাদের খুল্লতাত হই বাপা! যাক জেট্ঠতাত যে বলোনি এই যথেষ্ট। সার্থবহ নন্দিয় মুকুর তুলে রেখে ঈষৎ কর্কশ কণ্ঠে চেঁচান— বাপা হে, একটু পা চালিয়ে বনের দিক থেকে অনেক সময়ে তরক্ষু কি দ্বীপী ঘাড় কামড়ে ধরে নিয়ে যায়।
শিবির পড়ে দুই পক্ষেরই। একটি ছোটখাটো গ্রামই হয়ে যায় যেন। ব্যস্ত সবাই। পশুগুলিকে বাঁধা, জল, ঘাস, খড় দেওয়া। শিবিরের ভেতর বাহির পরিষ্কার করা। শকটগুলিকে মাঝখানে রাখা, রাতে সমস্ত অঞ্চলটি ঘিরে অগ্নিকুণ্ড হবে তার জন্য কাঠকুটো সংগ্রহ করা, মাটি কাটা। দুই দলের বণিকরা, নিয়ামকদ্বয়, বসে বসে বিশ্রাম নেন।
ক্রমে অগ্নি জ্বলে। পাক হয়। মুক্ত আকাশের তলায় অন্ন সিদ্ধ হবার সুগন্ধ ওঠে। ভিন্ন ভিন্ন বণিকদল স্বতন্ত্র পাকশাল খুলেছে।
—তোমাদের কী ভাই?
—মাংসভক্ত। তোমাদের?
—কুল্মষ হচ্ছে ভালো মুদগ ও শ্যামাক ধানের তণ্ডুল দিয়ে। বর্তক পাখি আছে কতগুলি, পুড়িয়ে নেবো।
—বতিঙ্গণ নাই? বর্তক-পোড়ার সঙ্গে লাগবে ভালো।
—আছে। সার্থবাহর আদেশ নাই। কাল হবে।
অদূরে একটি সরোবর। তার তীর দিয়ে দিয়ে চলে যান দুই শ্রমণ। সম্ভবত জলপান করে উঠেছেন। ছায়ার মতো দেখা যায় দুজনকে।
—ভো সমন!
কথা কানে যায় না শ্ৰমণদের।
—ভো ভো সমন!
দুজনে থেমে গেছেন।
—সাক্কপুত্তীয় যেন মনে হয়! কোথা হতে আসা?
হাত ঘুরিয়ে দিক-নির্দেশ করে শ্রমণরা আবার চলবার উপক্রম করেন।
—অরে! যান কই? রাজগহ হতে আসেন নাকি?
মাথা নাড়েন শ্রমণরা।
—রাজগহে তো ভারি গোল?
মাথা নাড়েন শ্রমণরা।
—নতুন রাজা সাক্কপুত্তীয়দের ওপর অত্যাচার করছেন নাকি?
আবার মাথা নাড়ছেন শ্রমণদ্বয়।
—কী ডাইনে-বামে মুণ্ড নাড়েন সমন তখন হতে? স্বর নাই? ভাষা নাই? আমি এক সময়ে তীত্থিক ছিলাম, সমন-টমনের নাড়ি-নক্ষত্তর জানি। অত মান আমার কাছে পাবেন না, তা বলে দিচ্ছি। যাবেন কোথায়?
একটু ইতস্তত করে একজন বললেন—সাবত্থি।
—পাটুলির দিকের দ্বারগুলি বন্ধ করে দিয়েছে, না? বড় গোল। তা সাবত্থি তো আমরাও যাবো, বারাণসী, সাকেত হয়ে। বসুন না! আমাদের গো-শকটে আপনাদের নিমন্ত্রণ রইল। যতদিন না সাবত্থি পৌঁছাই। এতে দোষ নাই সমন।
সার্থবাহ নন্দিয় দুই শ্রমণকে পাশে বসান। আবার সার্থবাহকে জিজ্ঞাসা করেন— তা উদয়ভদ্দ, রোরুক ছাড়া আর কোথাও গিয়েছিলেন নাকি?
—ভরুকচ্ছে গিয়েছিলাম ভদ্দ। সমুদ্দুর দেখা হল। সে কী অকূল জলরাশি! নীল-হরিৎ বর্ণ। মহা বিস্ময়ের ব্যাপার সে। আবার শুনতে পাই ওই বারিধির ওপারেও নাকি ভূমি আছে।
—থাকুক—নন্দিয় বললেন—তা কখনই পৃথ্বী নয়। প্রেতলোক-টোক হতে পারে। কী বলেন সমন!
শ্ৰমণ দুজন বসে আছেন বাক্যহীন।
—মগধের নতুন রাজা কিন্তু সেট্ঠিদের ওপর শক্তি দেখাতে যাচ্ছেন, কাজটা ভালো করছেন না। কী বলেন!
মাথা নেড়ে সম্মতি জানান শ্ৰমণরা।
—সেট্ঠি-জেট্ঠক যোতীয় মহোদয়ের ঘটনাটি শুনেছেন নাকি ভদ্দ উদয়!
উদয় শোনেন নি। মহা উৎসাহে ঘটনাটি সবিস্তারে বলতে লাগলেন নন্দিয়।
—সেনাদল নিয়ে রাজা অজাতশত্রু তো গেছেন যোতীয়র প্রাসাদে। উদ্দেশ্য সম্পদ সব অধিকার করা। যোতীয়র সম্পদ অতুল, জানেন তো? সারা জম্বুদ্বীপ ওঁর নাম জানে, মান দেয়।
উদয় বললেন— আমরা অঙ্গদেশে মেণ্ডক মহোদয়কে মানতাম। এখন উনি প্রয়াত। ওঁর পুত্র ধনঞ্জয়ও মহাসেট্ঠি। তিনি অবশ্য…
—ওঁর কথা আপনি কী বলবেন? নন্দিয় বিজ্ঞ ভঙ্গিতে হাসতে লাগলেন। উনি তো আমাদের সাবত্থির মিগারমাতা বিসাখার পিতা। মিগারমাতার সখী আবার আমার পত্নী। এই সমনরা সাবত্থিতে গিয়ে যদি মিগারমাতু প্রাসাদে ওঠেন, কিছুর অভাব হবে না। নিশ্চিন্তে ধম্মকথা কইতে পারবেন।
—যোতীয় সেট্ঠির ঘটনাটি বলবেন না? —সার্থবাহ উদয়ই শুধু নয় আরও অনেকে নন্দিয়র কাছে ঘনিষ্ঠ হয়ে আসে কাহিনীর লোভে। নন্দিয় বলতে থাকেন।
—রাজা সসৈন্য যোতীয়র প্রাসাদের প্রধান দ্বার দিয়ে ঢুকে দেখেন অপরদিকে একটি বস্ত্রাবরণ। তার পেছনে সশস্ত্র রক্ষীদল অপেক্ষা করছে। রাজা তো দ্বিধায় পড়ে গেছেন। অরক্ষিত গেহ লুঠ করা এক, আর রক্ষীদের সঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হওয়া আরেক। রাজাকে কি তা শোভা পায়? ফিরে যাচ্ছেন। পথে সেট্ঠি মহোদয়ের সঙ্গে দেখা। রাজাকে দেখে রথ থামিয়েছেন যোতীয়। দেখেছেন তো মহাসেট্ঠিকে সমন? এঁরা না দেখে থাকতে পারেন। শুভ্র কেশ, ভ্রূগুলি সুদ্ধ পেকে গেছে। বৃদ্ধ মানুষ। কিন্তু বলিষ্ঠ। রাজা বললেন বাহা। ভালো সেট্ঠি তো আপনি। সাক্ষাৎ করতে গেলাম আপনার সঙ্গে আর যোদ্ধা দিয়ে দ্বার আটক রাখলেন?
বৃদ্ধ বললেন— সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিলেন? না গেহ লুঠ করতে গিয়েছিলেন কুমার?
—যদি তাই যাই। কী করবেন?
—ভালো। এই দেখুন আমার দশ আঙুলে দশটি অঙ্গুরী। এই বজ্ৰমণি, এই মুক্তা, এই মরকত, পদ্মরাগ, নীলকান্তমণি এ সকল প্রত্যেকটি দুর্মূল্য। অপ্রাপ্য বললেই হয়। লক্ষ লক্ষ সুবর্ণমুদ্রা পাবেন বিক্রয় করলে। নিন তো দেখি কেমন নিতে পারেন!—
তা শত টানাটানিতেও অঙ্গুরী খুলল না। শেষে ঘর্মাক্ত হয়ে থামলেন রাজা। তখন সেট্ঠি বললেন—পাতুন হাত, উত্তান করুন দেখি হাত দুটি।
সেই হাতের ওপর অঙ্গুরীগুলি ঝেড়ে ফেলে দিলেন। বললেন— শুনে রাখুন কুমার। বলপ্রয়োগ করে শুধু যোতীয় কেন কোনও সেট্ঠির কাছ হতেই কিছু পাবেন না। আর, আমার কুটিরে যোদ্ধও নাই, রক্ষীও নাই। স্ফটিকের প্রাচীর আছে, তাইতে নিজেদের প্রতিবিম্ব দেখে ভয় পেয়েছেন। যান, গেহে যান। স্নেহদুর্বল পিতার ওপর অত্যাচার করে পার পেতে পারেন, সেট্ঠিদের কাছে পাবেন না…
বলতে বলতে নন্দিয় বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দুটি ডাইনে-বামে নাড়তে লাগলেন।
—বুঝলেন তো সবাই? সেট্ঠিরা অর্থ না দিলে রাজ্য আর রাজ্য থাকবে না খজ্জ হয়ে যাবে। আমাদের ঘরে যা আছে, রাজার ঘরে তা নাই।
অগ্নিকুণ্ড হতে সামান্য দূরে বসে আছেন শ্ৰমণ দুজন। নন্দিয়র কাহিনী শুনে সবাই ভারি আহ্লাদিত। তারা আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে আসে। সন্ধ্যার গাঢ় বাতাসে মাংসর উপাদেয় সুবাস। সার্থবাহরা কাহিনী, সংবাদ বলাবলি করছেন।
—সিন্ধু নদীর জল ছাঁকলে নাকি সোনা পাওয়া যায়?— নন্দিয়র দলের এক তরুণ বণিক প্রশ্ন করল।
উদয় বললেন— তা যায়। তরে সিন্ধুনীরে এখন ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র পোত নিয়ে পার্সরা ঘুরে বেড়ায়। স্বর্ণ যা পাবার তারাই পায়।
—পার্স? তারা কারা?
উদয় সাড়ম্বরে বর্ণনা করেন—কুভা নদীর অপর পার হতে এসেছে সব। দলে দলে। কপিশা নাকি তাদের করায়ত্ত। পাকা সোনার মতো গাত্রবর্ণ। নাসাগুলি বিষম তীক্ষ্ণ। তক্ষশিলায় শুনতে পেলাম কুভা আর সিন্ধুর মধ্যবর্তী দেশগুলি এই পার্সদের রাজা দরায়ভুস জিতে নিয়েছেন। সিন্ধুর এপারে গান্ধারের সৈন্যদল সর্বদা পাহারা দিচ্ছে।
একজন শ্ৰমণ অর্ধস্ফুট একটি শব্দ করেন। নন্দিয় ফিরে তাকালেন। শ্ৰমণ অতিশয় গৌরবর্ণ। দীর্ঘ চক্ষুদুটি। গাঢ় অক্ষিপল্লব। কেশগুলি অল্প বড় হয়েছে। অতিশয় শোভাময়। অপর শ্রমণ তাড়াতাড়ি জিজ্ঞাসা করলেন—যুদ্ধ হবে নাকি?
—পার্সগুলি স্বর্ণলোভী বুঝলেন শ্রমণ, উদয় বললেন, তক্ষশিলা অবধি আসেনি। সিন্ধুর ওপারেই ঘোরে। রাজা দরায়ভুস স্বর্ণ নেবার জন্য দূত পাঠান। স্বর্ণ পেলেই হল। সিন্ধুটি তো সেঁচে ফেলছে একেবারে। নদীতটে বালুর সঙ্গে স্বর্ণ মিশ্রিত আছে। নদীর জলেও সোনা বইছে।
দরায়ভুস নামটি অনেকেরই হাসির উদ্রেক করে।
—দরায়ভুস, দরায়ভুস। ভুস, ভাউস নানাপ্রকার হাস্যমিশ্রিত গুঞ্জন ওঠে।
আশ্চর্যের কথা কী জানেন? উদয় বললেন—এই পার্সরা অসুরভক্ত। পার্সগুলি ‘স’ উচ্চারণ করতে পারে না বোধ হয়। অসুরকে বলে আহুর। সিন্ধুকে বলে হিদুস্। সোমকে বলে হোম। আমাদের বৈদিকদের মতো আগুন জ্বেলে যজন-হবনও করে থাকে।
সকলেই অতিশয় আশ্চর্য হয়ে গেল।
গৌরবর্ণ শ্রমণ মৃদু কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন: যুদ্ধ ছাড়াই কি পার্সরা গান্ধার জয় করে নিল?
—ওই যে বললাম, রাজা দরায়ভুস স্বর্ণ চায়। যুদ্ধ ছাড়াই যদি প্রতি বৎসর স্বর্ণ পেয়ে যায়, যুদ্ধের কী প্রয়োজন শ্রমণ। তবে যুদ্ধ যদি করত ওগুলিকে বাধা দেবার কেউ থাকত না। গান্ধাররাজ পুক্কুসাতি তো শুনলাম, ভগবান বুদ্ধকে দেখবার আশায় এদিকেই এসেছিলেন, দুর্ঘটনায় মারা যান। তাঁর পুত্র রাজা স্বর্জিতের তেমন কোনও ক্ষমতা নাই। প্রকৃত ক্ষমতা অমাত্যদের। গর্বসেন না দ্রবসেন! মহা ধুরন্ধর ব্যক্তি। তবে তিনিও তো বৃদ্ধ! সত্য বলতে কি জম্বুদ্বীপের সর্বত্রই কেমন একটা শূন্যতা দেখা দিয়েছে। তেমন কোনও রাজা দেখি না যিনি চক্রবর্তী হতে পারেন। মহারাজ বিম্বিসারকে দিয়ে আমাদের বড় আশা ছিল।
নন্দিয় শ্রমণ দুজনের দিকে তাকিয়ে বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়তে লাগলেন। আগুনের প্রভায় শ্ৰমণদের মুখগুলি বড়ই বিষণ্ণ দেখায়।
নন্দিয়র সহবণিক একজন বললেন—কেন? আমাদের কোসলরাজ?
নন্দিয় বললেন—সত্য কথা বলব?
—বলুন না ভদ্দ। ভয় কী?
—ভয়? ভয় নন্দিয় কাউকে করে না। আপনারাই বলুন না কোসলরাজের প্রকৃত বল কী? কে? বন্ধুল মল্ল। নয় কী? তার পুত্রগুলিই বা কী? সব পিতার মতো বীরপুরুষ। তা এগারজনকেই কি নিহত হতে হয়?
একজন শ্রমণ ভয়ানক চমকে উঠলেন।
—কী বললেন সার্থবাহ?
—দেখুন সমন, আমি পাঁচ বৎসর পরে দেশে ফিরছি। কিন্তু দেশের সঙ্গে যোগাযোগ আমি সর্বদাই রেখে যাই। কজঙ্গলের দিকে রয়েছি সে সময়টা। সাবত্থি হতে একদল নাতপুত্তীয় এলেন, ওঁরা লাঢ়দেশে যাচ্ছেন, ওঁরাই আলোচনা করছিলেন বন্ধুল ও তার পুত্ররা সব প্রত্যন্ত দস্যুদের হাতে নিহত হয়েছেন। সেই দারুণ শোকসংবাদ বুকে নিয়েই বন্ধুলপত্নী মল্লিকা নাকি বুদ্ধ ও সংঘের সেবা করেছেন। ভোজ শেষ হবামাত্র জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়েন।
শ্ৰমণটি হঠাৎ দু হাতে মুখ ঢাকলেন, তার বক্ষ ফুলে ফুলে উঠছে। গাঢ় সন্ধ্যার তিমিরেও তার শোক ঢাকতে পারছে না।
—চিনতেন নাকি মল্লকে?
সার্থবাহ নন্দিয় তার এ প্রশ্নের উত্তর পেলেন না।
কিছুক্ষণ পর নন্দিয় বললেন—সমন, মনে কিছু করবেন না, আমিও এক সময়ে ভগবান বুদ্ধের দেশনায় মুগ্ধ হয়ে পব্বজিত হতে চেয়েছিলাম। আজও তাঁকে শ্রদ্ধা করি। কিন্তু চতুর্দিকে এই যে তার বড় বড় উপাসকদের শোচনীয় গতি হচ্ছে এর অর্থ কী? ভগবান কি বৃদ্ধ হয়েছেন বলে তাঁর ক্ষমতাগুলি ধীরে ধীরে লোপ পাচ্ছে? যিনি অঙ্গুলিমালের মতো নিষ্ঠুর নরহন্তাকে বশ করলেন, তিনি কি মগধের এই পিতৃঘাতী রাজকুমারটিকে কোনক্রমেই শান্ত করতে পারতেন না?
শোকার্ত শ্রমণ এই সময়ে উঠে চলে গেলেন। অগ্নির প্রভা থেকে দূরে। বনরেখা যেখানে আকাশের প্রান্তে লুটিয়ে রয়েছে সেইখানে তাঁকে পেছন ফিরে ছায়ার মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল।
সার্থবাহ নন্দিয় অপর শ্রমণকে লক্ষ্য করে বললেন—সত্য বলুন তো! উনি পঞ্চাল তিস্স না!
শ্ৰমণটি সম্মতিসূচক মাথা নাড়লেন।
—প্রথম হতেই আমার ওঁকে পরিচিত মনে হচ্ছিল। কেশগুলি এখন খুদ্দ খুদ্দ… সমন হয়েছেন… তাই কেমন…। উনি তো বন্ধুলের দক্ষিণ হাত স্বরূপ ছিলেন। পুত্রদের থেকেও অধিক বোধ হয়। যখনই কোনও ক্রীড়া কি প্রতিযোগিতার আয়োজন হবে, উনি থাকবেন বন্ধুলের পাশে। আহা! কী আঘাতই না ওঁর লাগল! মুহ্যমান হয়ে গেছেন একেবারে! হলেনই বা পব্বজিত। পিয়জনের শোক লাগবে না তাই বলে! একটু পরে নন্দিয় আক্ষেপের সুরে বললেন—সব বীরপুরুষই যদি সমন হয়ে যান…
সার্থবাহ উদয় বললেন— আপনি কিন্তু মধ্যদেশের নয় সমন।
এই শ্রমণটি বড় অল্পভাষী, মাথাটি নাড়লেন শুধু। একটু পরে তিনিও উঠে গেলেন বনভূমির দিকে। … গান্ধার পার্সকবলিত হয়ে গেল তা হলে! সমুদ্র তরঙ্গের মতো সৈন্যদল আসে নি! তবু পরাজিত হয়েছে! এত হতবল! কী-ই বা করবে? দ্বীপের মতো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্য, যে যার অস্তিত্বসংকট নিয়ে ব্যস্ত। কিন্তু গান্ধার শত্রুর গর্ভে গেল, আর যিনি এই পরিণাম দ্রষ্টার চোখ দিয়ে দেখেছিলেন, তিনি কোথায় রইলেন! জানতেও পারলেন না! অনঘ, সুভদ্র, চণক, এঁদের তক্ষশিলার লোকে বলত ‘ত্রয়ী’ ‘ত্রিবেদ’, দেশের সংকট, বিদ্যার সংকট, সমাজের সংকট নিয়ে এঁরাই চিন্তা করতেন, সেসব চিন্তার কথা আলোচনা করতেন। কোথায় রইলেন তাঁরা গান্ধারের এই দুঃসময়ে?
কিন্তু, দুঃসময় কি একা গান্ধারেরই? সমগ্র জম্বুদ্বীপই কি বিপন্ন নয়? যিনি এই বিপদের মর্ম যথার্থ বুঝতেন সেই মহাবীর রাজা আরেক দিক দিয়ে এত দুর্বল যে তাঁকে কারারুদ্ধ করা গেল, অনাহারে মেরে ফেলাও গেল। শার্দুলের পরিণাম যদি মার্জারের মতো হয়, তা হলে তো তথাগতকে লোকে দোষ দেবেই। সঙ্গত কারণেই দেবে।
সার্থবাহ উদয় এবং অঙ্গদেশগামী বণিকদের সঙ্গে বিদায় অভিবাদন বিনিময় করে শ্রাবস্তীর দল আবার পথ চলে। সকাল এবং সন্ধ্যা যায়। সন্ধ্যা এবং সকাল। বারাণসী যতই এগিয়ে আসে ঘোর কলরোল শোনা যায়। এরা পরস্পরের মুখের দিকে চায়। বারাণসীতে এরা এই প্রথম তো আসছে না! স্থানটি হট্টগোলের সত্য। কিন্তু তাই বলে এত কোলাহল?
নিয়ামক রক্ষীদের অস্ত্র বার করতে বলল। বোঝা যাচ্ছে না ঠিক। কিন্তু ভয়ানক কোনও দস্যুদল হতে পারে।
নন্দিয় বললেন—না। নগরীর এত কাছে দস্যু যদি আসেও, আসবে নিঃশব্দে। এভাবে নয়।
পথ আরেকটি বাঁক নিতেই ব্যাপার পরিষ্কার হয়ে গেল। সমুদ্রের মতো সৈন্যদল আসছে। হা হা শব্দ করতে করতে, তূর্যধ্বনি করে, শল্য ধনুর্বাণ মুষল আস্ফালন করতে করতে। পদাতিক, অশ্বারোহী, গজবাহী, রথারোহী সেনাদল।
নিয়ামক চিৎকার করে বলল— পথ ছেড়ে দাও হে। ত্বরা করো, ত্বরা করো, প্রান্তরে, বনে যে যেখানে পারো নেমে যাও…
উভয় দিকে নেমে যেতে থাকে বণিকদল। শুধু দুই শ্রমণ ছুটে গিয়ে মাঝে দাঁড়ান হাত তুলে। নিয়ামকের হাত থেকে ভেরীটি তুলে নিয়েছেন শ্রমণ।
সেনাদলের ঘোষকের সঙ্গে উত্তর-প্রত্যুত্তর হচ্ছে।
—কোথকার সেনা-আ-আ-?
—কাশী কোসলের-র-র।
—কোথায় যায়?
—মগধ আক্রমণ করতে-এ-এ-
—কেন-ও-ও-ও-?
—মহারাজ পসেনদি ভগ্নী কোসলদেবী ও ভগ্নীপতি মহারাজ বিম্বিসারের হত্যার প্রতিশোধ নিতে চলেছেন। কাশীগ্রামটি কোসলদেবীর বিবাহের যৌতুক ছিল-অ-অ। আমাদের রাজকুমারী, মগধের মহারানি বিষপান করে আত্মঘাতী হয়েছেন-ন। মগধের পিতৃমাতৃ ঘাতক কুমার কি এখনও কাশীগ্রামের রাজস্ব ভোগ করবে না কি-ই-ই? কোসলরাজ তা করতে দেবেন না-আ-আ।
—সৈনাপত্য করছেন কে-এ-এ?
—কোসলকুমার ও দীঘ মল্ল-অ-অ।
রক্ত কাষার দেহ থেকে খুলে দূরে নিক্ষেপ করলেন শ্রমণদ্বয়। সংঘাটির তলা থেকে প্রকাশিত হল বর্ম-অস্ত্রধারী যোদ্ধৃশরীর। পাঞ্চাল ভেরী মুখে তুলে চিৎকার করে বললেন— ভো সেনাধ্যক্ষ দীঘকারায়ণ, ভো ভো কুমার বিরূঢ়ব আমি পাঞ্চাল তিষ্য বলছি-ই-ই। আমাদের অশ্বরথাদি রণসামগ্রী দিতে আজ্ঞা হোক। আমরা যুদ্ধে যাবো-ও-ও।
২৩
বনের মধ্যে রাতগুলি দিন শুষে নিয়ে পুষ্ট হতে থাকে। প্রসূত হতে থাকে অচেনা শব্দ, অজানা গন্ধ, বহু অদৃষ্টপূর্ব আলো যাদের প্রভায় দেখা যায় অদ্ভুত অদ্ভুত দৃশ্যও। তাদের ভৌতিক, অলৌকিক মনে হতে থাকে। একমাত্র নানা জাতীয় মৃগরা, শশকরা, সরীসৃপরা জানে এগুলি অলৌকিক নয়। কেউ নাক ডুবিয়ে ঘ্রাণ নেয়, কেউ সতর্ক করে কান দুটি, দ্রুত তরঙ্গে পালায়। এইখানে মাটিতে মাটি, তৃণেতে তৃণ, গুল্মেতে গুল্ম হয়ে শুয়ে থাকে নিঃসংজ্ঞ দেহটি। গাত্রবর্ণ হারিয়ে ফেলে তার কাঞ্চন আভা। কেশগুলি হয়ে যায় পিঙ্গল, জটাবদ্ধ। শীর্ণ অতি শীর্ণ দেহ। পিঠের ওপর কয়েক স্তর মাটি জমে যায়। তার ওপর খেলা করে গোধিকা, শল্লকী, বৃক্ষমার্জার। শিশুরঙ্কু কেশগুলি তৃণ ভেবে চিবার, তারপর বিস্বাদ মনে হওয়ায় ফেলে দিয়ে লম্ফ দিয়ে দিয়ে দূরে চলে যায়। নকুলযুবা রক্তচক্ষু মেলে দ্রুত ছুটে আসে, অস্থির হয়ে ঘোরে, সামনের পা দিয়ে মাটি খোঁড়ে, মুদিত চোখ দুটি খুবলে নেবে কি না ভাবে, আবার অস্থিরভাবে ছুটে চলে যায়। বানরেরাও শাখা থেকে ঝুপঝাপ নেমে পড়ে, মহা কৌতূহলে। আবার ওপরের শাখায় উঠে যায়, দোল খায়। বহু দূর থেকে ধ্বনি প্রতিধ্বনিময় নাদ শোনা যায় ধিমি ধিমি দ্রিমি দ্রিম দ্রিমি দ্রিম দ্রিম্ দ্রিম্—। লঘু পায়ে দেহটি মাড়িয়ে ছুটে চলে যায় কজন! চমকে থামে। পায়ের আঙুল দিয়ে মাটি খোঁচায়।
—তলে ই তো বাহাসিন্দড়ি লয়?— এ ওর মুখের দিকে তাকায়।
—কী? কী? কী তবে?
কটিদেশের পাতার মালা দুলিয়ে মানুষগুলি উপুড় হয়ে পড়ে। দেখতে দেখতে চোখগুলি গোল হয়ে যায়। অভীষ্ট বস্তু বুঝি পেয়ে গেছে তারা। একজন কী ইঙ্গিত করে। আরেক জন ছুটে চলে যায়।
—বেগাবেগি যা, বেগাবেগি যা… পেছন থেকে নির্দেশ আসে।
ক্রমে একটি পুরো দল চলে আসে। টাঙ্গি দিয়ে বৃক্ষশাখা কেটে কেটে একটি চারকোনা খাটুলি প্রস্তুত হয়। তারপর সংজ্ঞাহীন মৃত্তিকাময় দেহটি বাহিত হয়ে চলে যায় দূরে… বহু দূরে।
এ দিকে বহধ্বম্ জহধ্বম্ শব্দ করে গিজ্ঝকূট থেকে গড়িয়ে পড়ে পাথরের খণ্ড। বৃদ্ধ হলে হবে কী! গৌতম বিড়ালের সতর্কতায় সরে যান। তাঁর শ্রবণেন্দ্রিয় অতি সজাগ। ধীর চারিকায় ছিলেন তিনি। অদূরে ছিলেন উপস্থায়ক আনন্দ। চারিকার সময়ে তিনি মগ্ন থাকেন নানা চিন্তায়। কেউ বলতে পারে না তা কী! তা কি ব্রহ্মবিহার! নাকি দেশ কাল-পাত্র-সমাজ বিহার! যদি ধ্যানেই মগ্ন থাকবেন তো এতো সতর্ক হন কী করে?
কিন্তু সতর্কতায়ও পুরো ফল হয়নি। একটি পাথরের খণ্ড গুল্ফ ঘেষে চলে গেছে। রক্তধারা বয়ে যাচ্ছে, অস্থি ভেঙেছে কিনা বোঝা যায় না। কিন্তু গুল্ফের পাশটি থেঁৎলে গেছে। উঠতে পারছেন না ভগবান।
—কী হল? কী হল জেট্ঠ?
ভগবান স্মিতমুখে আনন্দর দিকে চান। বিপন্নতম মুহূর্তগুলিতে আনন্দ ভুলে যান তিনি শ্রমণ। তথাগত বুদ্ধর উপস্থায়ক। শুধু মনে থাকে ইনি জেট্ঠ। মাতা গোতমীর কোলে সিদ্ধার্থ ও নন্দ, কিন্তু কিশোর সিদ্ধার্থের সকল কাজের কাজি বালক আনন্দ, শাক্য অমৃতোদনের ছেলে।
আনন্দ বসে পড়েছেন। দ্রুত হাতে ছিঁড়ে নিচ্ছেন ঘাস। চেপে ধরেছেন ক্ষতস্থানের ওপরে।
পথ দিয়ে আসছিলেন দুজন নাগরক। ঊর্ধ্বে মুখ তুলে দেখলেন কিছু মানুষের আকৃতি। গিজ্ঝকূটের পাথর ও গুল্মের মধ্য দিয়ে পালাচ্ছে। আনন্দ ব্যাকুল স্বরে বললেন—আয়ুষ্মন, মহাবেজ্জকে একবার সংবাদ দেবেন! ভগবান দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন।
—তা দিচ্ছি সমন, তবে আপনারা সাবধান হন, এটি দৈব বা আকস্মিক দুর্ঘটনা নয়।
ইঙ্গিতপূর্ণ চোখে গিরিশিরের দিকে তাকায় নাগরকদ্বয়।
উদ্বিগ্ন আনন্দর মুখের দিকে তাকিয়ে তথাগত বললেন—সম্মা সতি, হে আনন্দ, সম্মা সতি।
—সেদিন ধনুর প্রহারের হাত থেকে বেঁচে গেলেন বহু ভাগ্যে, আজ নামল গিরিশৃঙ্গ, এর পরে কী? চলুন ভগবন আমরা রাজগৃহ ছেড়ে চলে যাই। আনন্দ আকুল হয়ে বললেন।
—হে আনন্দ, পৃথিবীর একটি ক্ষুদ্রতম অংশেরও নাম করো যা মৃত্যুস্পৃষ্ট নয়।
আনন্দ সজল চোখে নির্বাক হয়ে রয়েছেন। তথাগতর যুক্তিজালের সঙ্গে তিনি পরিচিত। সমগ্র জীবন, সমস্ত পৃথিবী এবং মহাকালের প্রেক্ষিতে তার সব বিচার।
—বলতে পারছো না! তবে কোথায় পালাবে? ভয়ানক, ভয়ানক থেকে ভয়ানকতর, ভয়ানকতম মৃত্যুও অপেক্ষা করে থাকতে পারে তোমার আমার জন্য। যে বাসনামুক্ত হয়েছে, যে চতুর্ আর্যসত্য জানে—সে ভয় ভৈরবের হাত থেকেও মুক্ত।
নাগরকরা এগিয়ে আসে।
—ধনুর প্রহার থেকে বেঁচে যাবার কথা কী যেন বলছিলেন সমন!
আনন্দ বললেন— এই তো পাঁচ ছ’দিন পূর্বে প্রত্যূষে আজকের মতোই ধীর চারিকায় আছেন ভগবান। গিজঝকুটের পাশ দিয়ে পথ। পাঁচটি ধনুর্গ্রহ এসে তাঁকে প্রণাম করল। এরা কজঙ্গলের অধিবাসী, ভাগ্যান্বেষণে রাজগহে এসেছে। এদের নাকি বলা হয়েছে, এই পথের পাশে গুপ্তভাবে থাকতে। প্রথম এ পথ দিয়ে যে আসবে তাকেই হত্যা করতে হবে। ভগবানকে আসতে দেখে ঘাতকরা আশ্চর্য হয়ে যায়। স্বভাবতই শ্রদ্ধাবনত হয়ে তার শরণ নেয়। গৃহে ফিরছে এরা, আরও পাঁচটি ধনুর্গ্রহ বেরিয়ে আসে। দ্বিতীয় দলের একজন প্রথম দলের একজনকে চেনে। তারপর প্রকাশ পায় দ্বিতীয় দলকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে প্রথম দলকে হত্যা করবার। বুঝলেন তো? ভগবানকে হত্যা করার কোনও সাক্ষী থাকবে না। ব্যবস্থাটি উত্তমই হয়েছিল। কিন্তু পণ্ড হল।
নাগরকরা উচ্চকণ্ঠে এই ষড়যন্ত্রকে ধিক্কার দিতে দিতে চলে গেল। তাদের বুঝতে বিলম্ব হয়নি এর পেছনে কারা আছে।
মহারাজ বিম্বিসারের হত্যা আপামর রাজগহবাসীকে রাজনীতি সচেতন করে দিয়ে গেছে। পূর্বে শুধু অভিজাতরাই দণ্ড ও বার্তা নিয়ে মাথা ঘামাতেন। এখন যে কোনও গৃহস্থ জানে, একজন স্বৈরাচারীর আয়ত্তের মধ্যে বাস করার কী ভয়ানক বিপদ। তথাগত বুদ্ধর ওপর তারা অনেকেই বিরক্ত ছিল, এখন তার দ্বিগুণ বিরক্ত দেবদত্তর ওপরে। হত্যা, গুপ্তঘাতের যেন বান ডেকেছে নগরে। মহারাজ বিম্বিসার নিষ্ক্রিয় হয়ে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তিনি কি এভাবে প্রজাসাধারণের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়েছেন কখনও? ক্রমশ তাদের ভয় চলে যাচ্ছে। আর কিছুকাল দেবদত্তকে সহ্য করতে হলে তারা বিদ্রোহ করবে, টেনে নামাবে ওই পিতৃঘাতী রাজাকে। অমাত্যগুলি তাকে ঘিরে আছেন, এটাই কথা। কেন? ওঁদের পক্ষপাত কোথায় এবং কেন বুঝতে না পারলে তারা এখনও কিছু করতে সাহস করছে না। কিন্তু রাজগহে অসন্তোষ এখন ধূমায়মান।
নাগরক দুজন চোখের আড়ালে গেলে তথাগত বললেন—আনন্দ তুমি ভালোই বাক্যবাগীশ।
আনন্দ বললেন—আপনিই তো বলে থাকেন মৌনতা অবলম্বন করলেই মুনি হয় না। মৌনতার অর্থ অনেক সময়ে প্রতীতির অভাব, বা কিছু জানাতে কৃপণতা। আমি ওই ঘটনাটি নিশ্চিতরূপে জানি, জানাতেও আমার কার্পণ্য নেই। আপনার অক্রোধের উপদেশের কথা স্মরণে রেখেই এ কথা বলছি।
তথাগত বললেন— তথাগতর উপস্থায়ক না হয়ে তুমি কোনও বোহারিকের উপস্থায়ক হলে ভালো করতে।
আনন্দর মুখটি শুকিয়ে গেল কিন্তু তিনি মুখ নত করে জ্যেষ্ঠের কথা মেনেও নিলেন না। বললেন— কোসাম্বিতে ভিক্ষুরা কলহ করেছিল বলে আপনি সে স্থান ত্যাগ করে চলে গিয়েছিলেন। তা এখানেও কি একজন কলহ করে সংঘভেদ করছেন না? আর মগধের রাজকুমার? তিনি যা করলেন তা কি ক্ষমার যোগ্য?
—আনন্দ, ভিক্ষুরা আমার আপনজন। তাদের ছেড়ে আমি চলে যাই তাদের চেতনা জাগাতে, আমার এবং তাদের মধ্যে যে সূত্র রয়েছে, সেই সূত্র ধরে টান দিতে। কিন্তু পৃথগ্জন অধ্যুষিত এই ভূমি এমনই মরু যা তথাগতকে পার হতেই হবে। সংঘকেও। এমন কি আনন্দকেও। আর তাতেই মরু হয়ে যাবে ফুল্লকানন।
জীবক রথে করে এসে পৌঁছলেন, তাঁর রথে— চর্মপেটিকায় শুশ্রূষার সব আয়োজন। দুহাতে আহত তথাগতকে তুলে নিলেন তিনি।
তথাগত স্মিতমুখে বললেন— হে জীবক, তুমি তো শুধু মহাবেজ্জই নও! মহাবলীও দেখছি।
জীবক হেসে প্রত্যুত্তর দিলেন— তা যদি বলেন ভন্তে, আপনাকে দশবল লোকে শুধু শুধু বলে না। আপনার দশ বলের একটি বল অন্তত দৈহিক বল। সম্যক আহার, সম্যক বিহারে শরীরটি রেখেছেন চমৎকার!
—আর সম্যক সমাধি? তার কথা তো কই বললে না জীবক! ধ্যানটি ঠিক মতো অভ্যাস করছো তো?
—যতদূর পারি ভন্তে! তবে বোঝেনই তো জীবকের ধ্যানের একমাত্র বিষয় হল ব্যাধি। বিচিত্র, দুরন্ত সব ব্যাধি— জীবক হাসিমুখে তথাগতর ক্ষত পরিষ্কার করে ভেষজ লাগিয়ে পট্টিকা বেঁধে দিলেন। না, অস্থি ভাঙেনি।
নালাগিরির ঘটনার পর রাজগৃহের মনোজগতে আমূল পরিবর্তন হয়ে গেল। ঘটনাটি ঘটে এইরূপ: নালাগিরি এমনিতেই দুর্দান্তস্বভাব হাতি। মহারাজ বিম্বিসার ছাড়া আর কাউকে সে পিঠে নিতে চাইত না। তাকে সুরাপান করিয়ে উন্মত্ত অবস্থায় পথে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে ঠিক যে সময়ে বুদ্ধ ভিক্ষার্থে বার হয়েছেন। সঙ্গে অল্প কজন ভিক্ষু। হাতির সামনে পড়ে গেছে শিশু কোলে এক রমণী। আনন্দ ছুটে আসছেন— রক্ষা করতে হবে ওই শিশুটিকে, তার মাতাকে, তথাগতকে। উপস্থায়ক আজ প্রাণ দিয়েই ছাড়বেন। সহসা তথাগত স্বয়ং একটি যুবক মল্লর মতো দ্রুত, অতিদ্রুত চারণে সবাইকে পার হয়ে প্রায় মুখোমুখি দাঁড়ালেন হাতিটির। কী যেন বলছেন হাতিটিকে। শুঁড় তুলে হাতি বাতাসে গন্ধ নিতে থাকে—এ সেই তাঁর গন্ধবাহী বাতাস না, যার অদর্শনে সে ক্ষিপ্ত হয়েছিল! রক্ত গৈরিকের ছটা, প্রসন্ন সুন্দর মূর্তি— এঁর চারিদিকের ব্যক্তিত্ব-বলয়ে তার প্রভু বিম্বিসারের গায়ের ঘ্রাণ! হাতির শোকানলে শান্তি বারি ঝরছে। সে জানু মুড়ে বসে পড়ল।
কাতারে কাতারে লোক জমে গিয়েছিল সেদিন জীবকাম্রবন থেকে বৈভারের পথে। চতুর্দিকে জয়ধ্বনি উঠতে থাকে গৌতম বুদ্ধর নামে। এতদিন পরে মহারাজ বিম্বিসারের একটি স্বপ্ন পূর্ণ হল বুঝি বা। রাজগৃহের মানুষ তাদের পূর্ব অভিযোগ ভুলে গৌতমের চরণে লুটিয়ে পড়ল। প্রাসাদে বসে প্রমাদ গুণলেন অজাতশত্রু। গয়াশিরে পালালেন দেবদত্ত, কোকালিক, মোরগতিষ্য, খণ্ডদেবপুত্র ও সাগরদত্ত। সংঘভেদী বিশ্বাসঘাতক পাঁচ শ্রমণ।
কার্তিকোৎসবের উৎসব মুখরিত দীপোজ্জ্বল সন্ধ্যা। পূর্ণিমার চাঁদ থেকে যেন কুন্দকুসুমের প্রপাত নেমেছে। রাজা অজাতশত্রু উৎসবে অংশ নিতে পারছেন না। সভাসদদের ডেকেছেন। এসেছেন বর্ষকার সুনীথ, চন্দ্রকেতু-জীবক, কুমার অভয়, এসেছেন নগরশ্রেষ্ঠী অহিপারক। বেশ-বাস করেছেন রাজা, জ্যোৎস্নায় ঝকঝক করছে মুকুটের হীরক, কিন্তু প্রাসাদ অঙ্গনেই বসে আছেন, কখনও বসে, কখনও বা দাঁড়িয়ে উঠছেন। অতি অস্থির। মাধ্বী পরিবেশিত হয়েছে। সোনার পাত্রে স্বাদু, দুর্মূল্য আসব। পাত্র হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করছেন জীবক, চন্দ্রকেতু।
গণ-উত্থানের ভয়ে তুমি আজ রূপ পরিবর্তন করছে, তাই না কুমার? বহিঃশত্রু তো আছেই। কোশলরাজ একবার পরাজিত হয়েছেন, আবারও হবেন কী? সেনাপতি মহানাগ নেই। হত হয়েছেন মহাবীর কুরুবিন্দ। শোনা যাচ্ছে অবন্তীর সৈন্যও বেরিয়ে পড়েছে। প্রদ্যোত মহাসেন নাকি বিম্বিসার হত্যায় জ্বলন্ত অয়সের মতো তপ্ত হয়ে রয়েছেন। তিনি এবার বৈশালীর সঙ্গে মিলবেন। সঙ্গে আসছে তার দুর্দান্ত নিষাদ সেনা। … তাই আজ সভাসদ্দের ডেকে পানভোজন করতে চাইছো! এই অভয়কুমারকে নিজ প্রাসাদে বন্দী রেখেছিলে, চন্দ্রকেতুকে পাঠিয়েছিলে কারাগারে, অহিপারক, বর্ষকার, সুনীথ কারো কথার মান দাওনি! এই সচিবরা তাই অন্য অমাত্যদের কাছে অপরাধী হয়ে আছেন। চোখে চোখ রাখতে পারেন না কারো। নিঃশব্দ ধিক্কার চতুর্দিকে— ধিক বস্সকার, ধিক ধিক সুনীথ তোমাদের না মহারাজ বিম্বিসার সবচেয়ে উচ্চপদে বসিয়েছিলেন! বিশাল মগধসাম্রাজ্যের সর্বার্থক হওয়ার আশা পরিপূরিত হয়নি বলে কুমারের লোভে ইন্ধন জুগিয়ে রাজার প্রাণ নিলে? রানির প্রাণ নিলে? ধিক ধিক, শত ধিক্…
সহসা কুমার দু হাত ঊর্ধ্বে তুলে অব্যক্ত আর্তনাদ করে উঠল—পিতা! পিতা!
অদূরে ধাত্রী এসে দাঁড়িয়েছে কুনিয়র শিশুপুত্র উদায়ীকে কোলে নিয়ে, শিশু পিতার দিকে বাড়িয়ে দিয়েছে দু হাত।
—কুমার দু হাতে নিজের বক্ষে আঘাত করতে থাকে।
ধাত্রী সভয়ে শিশুটিকে নিয়ে পালায়। অন্তঃপুরের পথ থেকে শিশুটির কান্না ভেসে আসে। ক্রমশই ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর।
মুখ নত করে বসে থাকেন সবাই। একটি সান্ত্বনার বাক্যও উচ্চারণ করতে পারেন না।
—জীবকভদ্র। জীবকভদ্র!— কুমার এমন করে ডাকছেন যেন কেউ তাকে ছুরিকাবিদ্ধ করেছে।
—বলুন কুমার— রাজা হতে পারেন অজাতশত্রু। এঁরা কেউ তাঁকে কুমার ছাড়া বলেন না।
—বলুন, কার কাছে, কোথায় গেলে শান্তি পাবো! দিনে রাতে সর্বত্র পিতার মুখ দেখি… মাতার মুখ… সইতে পারি না।
অক্কোধেন জিনে কোধং অসাধুং সাধুনা জিনে…
জীবকের হৃদয়ের মধ্যে ধ্বনিত হতে লাগল। কিন্তু সেই মহাবাণী ছাপিয়ে তাঁকে অধিকার করতে লাগল পবিত্র ক্রোধ।
খেলা, না? এই সব রাজা-হওয়া, রাজা-হত্যা করা! অমাত্য নির্বাচন, যুদ্ধ! হে রাজনীতিকগণ— ক্ষত্রিয় ও ব্রাহ্মণ, খেলা পেয়েছ, না? লক্ষ কোটি মানুষের জীবন নিয়ে চিরকাল ধরে খেলা করে চলেছ? জানলে না জীবনের রহস্য। জানতে চাও না। পারবে? মহাপ্রাণ ছেড়ে এক বিন্দু প্রাণও সৃষ্টি করতে পারবে? বিকলাঙ্গ, বিকৃতমস্তিষ্ক প্রাণ? তাও পারবে না। আয়ুর্বেদ বলছে—পারবে না। জীবক জানে— পারবে না। ব্যাধির দুঃখ, অঙ্গহানির দুঃখ, মহাদুঃখ জীবজগতে, জীবক প্রাণপণে তার সারা জীবনের সাধনায় সে দুঃখ এই মগধেই বা কতটুকু দূর করতে পেরেছে? পারেনি, কিছুই পারেনি। আরও অনেকগুলি জীবন পেলে, আরও ফলবান মস্তিষ্ক, যুগাতিশায়ী প্রতিভা পেলে আরও পারতো। কিন্তু জীবক জানে, সুস্থ সবল সুন্দর জীবনের কী অপরিসীম মূল্য। সেই জীবনগুলি শিশু যেমন করে পতঙ্গের পাখ ছেঁড়ে তেমনি করে ছিঁড়েছ, ভেঙেছ, সর্বনাশ ছড়িয়ে দিয়েছ দু হাতে; তোমার শান্তির অধিকার কী?
ক্রোধে অগ্নিপিণ্ডের মতো লোহিতবর্ণ হয়ে স্থির বসে রইলেন কোমারভচ্চ।
সেট্ঠিবর, বলুন, আপনি অন্তত কিছু বলুন!
গলাটি অনাবশ্যক ঝেড়ে কেশে অহিপারক বললেন— রাজগহের পাহাড়ে, কন্দরে তো কত বড় বড় তীর্থঙ্কর বাস করছেন, গিয়েই দেখুন না!
—না, না, এমন কেউ কি নেই যাঁর করুণা অলৌকিক, আকৃতি বচন এমনই সৌম্য মধুর যে দেখলেই হৃদয় শান্ত হয়!
উপস্থিত সকলেই বুঝতে পারেন কুমার কার কথা বলছেন, কিন্তু কিছু দিন আগেও যাঁর নাম পর্যন্ত মুখে আনা নিষিদ্ধ ছিল, যাঁকে আরাধনা করার অপরাধে যত্র তত্র হত্যা হয়েছে, হত্যা হয়েছে এমন কি সুকুমারী নারী পর্যন্ত, কিশোরী নটী শ্রীমতীর হত্যার স্মৃতি কি অত সহজে মুছবে? কে তাঁর নাম মুখে আনবে?
জীবকের দিকে ভিক্ষুকের মতো চেয়ে রয়েছে কুমার।
জীবক ভাবলেশহীন গম্ভীর কণ্ঠে বললেন— আপনি কি তথাগত বুদ্ধর কথা বলছেন? তিনি এখন আমারই অম্ববনে অবস্থান করছেন। যান, যাবেন তো যান। এমন কোনও ক্ষমা নেই যা তাঁর অদেয়।
জীবক উঠে দাঁড়ালেন।
—কোথায় যান মহাবেজ্জ? আপনি সঙ্গে যাবেন না?
ভয়, ভয়ভৈরব অধিকার করেছে পিতৃঘাতককে।
অম্ববন। ঝিল্লির ডাকটি পর্যন্ত শোনা যায় না। কার্তিকী পৌর্ণমাসীর জ্যোৎস্নায় গাছের পাতাগুলি পর্যন্ত স্বতন্ত্রভাবে চেনা যায়। সঙ্গে সভাসদরা! কুমার সভয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল— জীবক ভদ্র, এ কী? ছল করে এখানে এনে হত্যা করাবেন নাকি?
-—এর অর্থ?— জীবক ক্রুদ্ধ মুখে দাঁড়িয়ে পড়লেন— আপনিই তো আসতে চাইলেন? আপনি পাবেন শান্তি? সান্ত্বনা? মহারৌরব নরকের আগুন আপনার নিজের ভেতরেই জ্বলছে।
—মহাবেজ্জ। মৃদুকণ্ঠে ডাকলেন অহিপারক। সতর্ক করা প্রয়োজন জীবককে।
কিন্তু কুমার যেন কিছুই শোনেননি। বললেন— এই সব বৃক্ষের পেছনে অস্ত্রধারী ঘাতক আছে। আমি জালে পড়ে গেছি। গুপ্তহত্যা… স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি শল্যগুলি শাখা-প্রশাখা ফুঁড়ে বেরিয়ে আসছে… দূর হতে বিঁধবে…
অমাত্য চন্দ্রকেতু আর সহ্য করতে পারলেন না, এগিয়ে গেলেন। পেছন পেছন চলে গেলেন জীবক ও অহিপারক। প্রাণান্তক ভয়ে অজাতশত্রু অসি কোষমুক্ত করে সামনের বৃক্ষতল পেরোলেন। অমনি অন্ধকার সরে গেল। আলো, আলো। আলোর সমুদ্রে ভাসছে রাজগৃহ। ধনী, দরিদ্র, ক্ষত্রিয়, ব্রাহ্মণ, গৃহপতি, দাস, নর, নারী, বালক বালিকা, নটী, গৃহিণী সবাই। সমগ্র রাজগৃহে প্রচার হয়ে গেছে তথাগতবুদ্ধ এক দেবমানব। রাজগৃহের অনেক ভাগ্যে তিনি এখানে অবস্থান করছেন। তার ঋদ্ধি বিফল করে দিয়েছে সমস্ত বিরুদ্ধ ষড়যন্ত্র। এই আনন্দসন্ধ্যায় তাই রাজগৃহ তার ভ্রম শুধরে নিতে জীবকাম্রবনে এসে বসেছে। শুভ্র বসন সব, উত্তরীয়গুলি বাতাসে অল্প অল্প উড়ছে, মানবসমুদ্রে যেন হিল্লোল উঠছে। ঋজু, শুভ্র মূর্তি। বসে আছেন মণ্ডলমালে। দুই ভ্রূর মাঝখানে একগুচ্ছ শুভ্র রোম।
তিনি বলছেন—এক অদ্ভুত জগৎ অদ্ভুত সমাজের কথা। সেখানে হিংসা, ঈর্ষা, দ্বেষ, কলহ নেই। সৎ কর্ম, সৎ সঙ্কল্প, সৎ চিন্তার মধ্য দিয়ে জীবনকাল কাটিয়ে পৌঁছও এক অনির্বাণ প্রশান্তিতে— যার নাম নির্বাণ।
নির্বাণ কী? কেমন? তা ভাষার অতীত, বর্ণনার অতীত। কেমন সে কথা ভেবে অনর্থক কালক্ষেপ করে কাজ নেই। কেউ কি কখনও গঙ্গার বালুরাশি কিংবা সমুদ্রের জল গুণে, পরিমাপ করে শেষ করতে পেরেছে? প্রয়োজনই বা কী?
—ভগবন, জগৎ শাশ্বত কি অশাশ্বত?
—দেহ ও আত্মা এক না পৃথক?
—ভগবন, নির্বাণ প্রাপ্ত অর্হন কি বিদ্যমান থাকেন?
—হে রাজগহবাসী, আমি কি একবারও তোমাদের বলেছি এসো এসো। তোমরা তথাগতর শরণ নাও, তাহলেই আমি তোমাদের এ সকল প্রশ্নের উত্তর দেবো। এমন বচন দিয়েছি কী?
—না ভগবন, তা আপনি দেননি।
—তা হলে এ সকল প্রহেলিকা থাক। হে নাগরকগণ, যদি কোনও ব্যক্তির শরীরে বিষাক্ত বাণ প্রবেশ করে, এবং সেই ব্যক্তির আত্মীয়রা মহাবেজ্জ জীবককে ডেকে আনে তাহলে কি জীবক যন্ত্রণাকাতর রোগীকে প্রশ্ন করবেন এই বাণ কে মেরেছে? সে গৌরবর্ণ না কৃষ্ণ বর্ণ? সে ব্রাহ্মণ না ক্ষত্রিয়, না শূদ্র? ধনুকের জ্যাটি কিসের? জিজ্ঞাসা করবেন, না শল্য চিকিৎসা করে রোগীকে আরোগ্য করবেন!
—আরোগ্য করবেন ভগবন—
—জগৎ শাশ্বত বা অশাশ্বত, আত্মা আছে কিনা, মৃত্যুর পর কী ঘটবে এ সকল উত্তর-প্রত্যুত্তরে শুধু কালক্ষেপই হবে, জরা, মরণ, পরিদেব, শোক এগুলির থেকে মুক্তি হবে না। তথাগত যেসব বিষয়ে চর্চা করেননি সেগুলি চর্চার অযোগ্য জানবে। অস্ত্র ব্যতীত, হিংসা ব্যতীত এক সুন্দর জীবন গঠনের চেষ্টায় নিয়োজিত হও।
অজাতশত্রু সেই মহতী সভায়, জ্যোৎস্নালোকে তথাগতর বেদিকার সামনে সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাতের ভঙ্গিতে পড়ে গেলেন।
বড় সংশয়ী মানুষ বর্ষকার। বললেন— কুমারের চাতুর্য বুঝলে, সুনীথ?
—বলুন মহামাচ্চ, আপনার ব্যাখ্যাশুনি।
—গণ- অভ্যুত্থানের ভয় পাচ্ছেন তো, তাই গণের সামনেই তথাগতর শরণ নিলেন।
তথাগত এখন রাজগহের মাথার মুকুট। কুমার পাপী কিন্তু অনুতপ্ত, ওঁর শরণাগত।
উনি ক্ষমা করলে, রাজগহ ক্ষমা না করে করে কী?
—এতোটুকুও সত্য কি নেই কুমারের আচরণে?
—আছে সুনীথ, ভয়ের সত্য, ইদ্ধিতে বদ্ধমূল বিশ্বাসের সত্য, আর সহজাত কুটবুদ্ধির সত্য। ভয় নাই। কুমার অস্ত্রত্যাগ করবে না, মগধসাম্রাজ্য আমরা পাবোই। আজ, নয় কাল।
—তোমরা কে?— কণ্ঠ ক্ষীণ, দৃষ্টিতে আলো নেই, স্মৃতি আহত, যেন বহুদূর থেকে বললেন তিনি।
কোমরে পাতার মালা, গলায় কুঁচ ফলের হার, খালি গা, মানুষগুলি বলল– হড় গো, মোরা হড়। ই যে বির দেখিস কেঁদ, বয়ড়া, গাব, শ্যাওড়া, সাল, পিয়াল গাছে গাছ বির, ই বির মোদের।
এরা এই বনের মানুষ? নিজেদের এরা হর বলে কী?
—আমি কোথায়?
—মোদের মজাঙে আছিস। ভাবিস নাই। তু মোদের মেইয়্যার নাম লিছিস। তুরে ঠারে লিব। বুঢ়ামবুঢ়া বুঢ়ামবুঢ়ি বলিছে।
ধিমি ধিমি ধিমি ধিমি বাদ্য বাজে। তাঁর ঘোর লাগে। এরা কি তাঁকে কোনও সুরা পান করিয়েছে? জিভে কেমন একটা মাদক মধু মধু স্বাদ! বলকারক কোনও তৈল দিয়ে তার সারা শরীর মাজছে এরা। শরীরের অসাড়ভাব কেটে যাচ্ছে ক্রমশ। কার নাম নিয়েছেন তিনি? কার নাম? তিনি বুঝতে পারেন না কেন এরা তাঁকে সেবা করছে।
তিনি ঘোরে থাকেন। মজাঙে রক্ষিত আগুন থেকে তাঁর হাতে পায়ে সেঁক দিতে দিতে বাঁশের চোঙা থেকে মধুক-মদ পান করে তারা। গল্প করে অনেক চাঁদ আগে তাদের বন্ধু ভিন্ন এক কিল্লির পাঢ়ায় এক যতি এসেছিলেন। পূজা ঠিকমতো না হওয়ায় একদিন তিনি রাগ করে অদৃশ্য হয়ে যান। আর তারপরে তাঁর মন্তরের টানে তাদের বীরতমা মেয়েটি আর বীরতম ছেলেটি কোথায় চলে যায়। যতি দেখলেই তাই সব কিল্লির হড়রা তাকে তুষ্ট করবার প্রাণপণ প্রয়াস পায়। কে বলতে পারে কার মধ্যে কী শক্তি আছে!
ঘুমঘোরের মধ্যে গল্প কথা ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায় তাঁর চেতনা। তিনি অস্পষ্ট স্বপ্নে নিজেকে হাতড়ে ফেরেন। তিনি কে? কোথায় ছিলেন? তিনি কি কোনও যতি? এরা কি পত্ৰশবর? কারা হারিয়ে গেছে? তিনি কি তাদের চিনতেন।
২৪
মগধ-কোশলের যুদ্ধে ভিক্ষুসংঘ বড়ই জড়িয়ে পড়ে। কোশলের পক্ষে থাকে এবং থাকে সক্রিয়ভাবে। বুদ্ধ তখন জেতবনেই। ভিক্ষুদের সক্রিয় সহযোগের কথা তিনি প্রথম থেকেই জানতেন কিনা নিশ্চয় করে বলা যায় না। ধনুর্গ্রহ তিষ্য নামে এক স্থবির আরেক স্থবির উপ্তর সঙ্গে একই পরিবেণে থাকতেন! ধনুর্গ্রহ তিষ্য প্রব্রজ্যা নেবার আগে তক্ষশিলার শস্ত্রশিক্ষক ছিলেন। তাঁর সেই সময়ে রাতে নিদ্রা হত না পসেনদির মূর্খামিতে। অবশেষে উপ্তর পরামর্শে তিনি তাঁর শিষ্য পাঞ্চালকে ডেকে পাঠান।
—আমাকে নিমন্ত্রণ করছ না কেন তিষ্য?
—সে কী? এখনি করছি। কালই আসুন আচার্যদেব।
—যাবো যাবো অবশ্যই যাবো, কিন্তু আমি শ্ৰমণ, আমাকে সেইভাবে ডাকো আয়ুষ্মন।
—ভন্তে, আমার অপরাধ হয়ে গেছে।
পরদিন নিমন্ত্রণে এসে তিষ্যপত্নী সোমার হাতের পায়স চেটেপুটে খেতে খেতে স্থবির বললেন—উপাসককে ভোজনান্তে উপদেশ দেওয়ার নিয়ম, জানো নিশ্চয় তিষ্য! সুতরাং আরম্ভ করি। বলি বৎসে সোমা, তুমি এমন বিদুষী হয়ে পতিকে যুদ্ধে যেতে দিচ্ছ না এ বড়ই পরিতাপের বিষয়।
সোমা বলল—সে কি ভন্তে, এমন মিথ্যা আরোপ আমার ওপর?
—তবে তিষ্য সৈনাপত্য করছে না কেন? কে বাধা দিচ্ছে?
তিষ্য বলল—দীঘ মল্ল রয়েছেন। কুমার রয়েছেন। মগধ থেকে পালিয়ে আসবার সময়ে যুদ্ধ করেছি। মহারাজ তো স্বয়ং নেতৃত্ব দিচ্ছেন এখন।
কুমারের গূঢ় বিরাগ ও দ্বেষ যে তাঁকে এই যুদ্ধ থেকে শেষ পর্যন্ত সরিয়ে রাখল, এ কথা পাঞ্চাল পত্নী ছাড়া কারো কাছে প্রকাশ করেনি।
—ওটি তো একটি আস্ত গর্দভ!
—স্বর মৃদু করুন ভন্তে! আমি জানি উনি তাই। কিন্তু ওঁর গর্দভত্বের কোন্ দিকটির প্রতি আপনি এখন নির্দেশ করছেন?
—দীঘ মল্ল ও রাজকুমার বিরূঢ়ক যদি ওঁর সঙ্গে রণক্ষেত্রেই থাকে, তাহলে যুদ্ধে জয় হওয়া সম্ভব? অচিরেই মহারাজ বন্দীও হবেন। মল্লই ধরিয়ে দেবে।
—সে কী!
—বন্ধুলের কারণে দীঘ কারায়ণের হৃদয়ে প্রতিহিংসার অনল জ্বলছে না? আর বিরূঢ়ক ভগবানের মধ্যস্থতায় পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে সত্য। কিন্তু দাসীপুত্র বলে বিতাড়িত হবার অপমান সে কোনদিন ভুলবে?
—তা সত্য। কিন্তু প্রতিহিংসা? বন্ধুলের কারণে? ঠিক বুঝলাম না ভন্তে!
—তুমি তিষ্য আরও একটি গর্দভ।
—মাঝে মাঝে মনে হয় বটে। কিন্তু আপাতত এ বিশেষণটি কেন উপহার দিলেন ভন্তে?
—বন্ধুল আর তার দশ পুত্র মহাবীর। এগারটি মহাবীর প্রত্যন্ত দস্যুর হাতে নিহত হল এই শিশু-ভোলানো উপকথা তুমি ছাড়া আর কেউই বিশ্বাস করে না তিষ্য।
—তা হলে? —নিশ্বাস রুদ্ধ করে তিষ্য বলে।
—পসেনদি নিজে ওদের হত্যা করিয়েছেন।
তিষ্য কাঁপতে থাকে। শরীরে স্বেদ। দেহ কঠিন হয়ে যায়।
সোমা বৃথাই বলে, আত্মসংবরণ করো, ধৈর্য ধরো হে পাঞ্চাল।
স্থবির বললেন—বন্ধুল বড় পরিহাসপ্রিয় মানুষ ছিলেন। কখনও সখনও হয়ত পরিহাস করেই বলে থাকবেন তাঁদের এগারজনের মিলিত শক্তিতে অনায়াসেই পসেনদিকে রাজ্যচ্যুত করা যায়…পসেনদি যে তাঁর ছাত্রজীবনের সখা এ কথা তো বন্ধুল কখনওই ভুলতেন না—তা এই প্রকার কথাবার্তা হতে হয়ত অনড্বান রাজাটির মনে সংশয় জমে থাকবে! মল্লর বিরুদ্ধে মন্ত্রণা দেবার লোকও তো অমাত্যদের মধ্যে কিছু অল্প নয়। তুমি তো জানো সবই…কী হল তিষ্য, কথা বলো? এমন বাক্যহারা হলে প্রতিহিংসা নেবে কী করে?
—আপনি বুদ্ধপন্থী হয়ে প্রতিহিংসার কথা বলছেন?—তিষ্য অনেক কষ্টে সংবৃত হয়ে বলে।
—আয়ুষ্মন, বন্ধুল যেমন পসেনদির সতীর্থ ছিলেন তেমনি আমারও ছিলেন যে! আর সদ্ধর্ম যেমন প্রাণিহিংসা, হিংসার পরিবর্তে হিংসা নিষেধ করে, তেমনি অসৎকে পরিত্যাগ করার কথাও তো বলে। আমি এবং স্থবির সারিপুত্ত এমন কত উপদেশের ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা করে আনন্দ পাই। তবে প্রতিহিংসার অর্থ যে হত্যাই, তা আমি একবারও বলিনি তিষ্য। দেবদত্তর কেমন শাস্তিটা হল? নিজের শিষ্যদের পদাঘাতে মুখে রক্ত উঠল, তারপর ভগবানের কাছে আসবার পথে ভূকম্পে মারা গেল …তবে অসতের শাস্তিবিধান করতে হলে কাকে ছেড়ে কাকেই বা রুখবে? এই যে একেকটি রাজবংশ হয়ে যাচ্ছে, মনে করছে পরম্পরায় পৃথিবী ভোগ করবে, এতেই হয়ে যাচ্ছে সর্বনাশ!
—আমাকে কী করতে বলেন ভন্তে!
—যুদ্ধে যাও, কাশী হতে গয়ায় প্রবেশ করতে দু’ পাশে গিরি আছে, ওইখানে শকট ব্যূহ রচনা করে অজাতশত্রুকে টিপে মারো।
ধনুর্গ্রহ তিষ্য চলে গেলেন। যাবার সময়ে পেছন ফিরে একবার মৃদুস্বরে বললেন—আমার নামটি আবার যেন তথাগতের কানে না যায়। তুমি যা—
—গর্দভ! তিষ্য বলল।
কার্যকালে কিন্তু দেখা গেল তথাগত ব্যাপারটি শুধু জানেনই না, প্রসন্ন মুখে তিনি ধনুর্গ্রহ তিষ্যর গুণগান করছেন।
যাই হোক, পাঞ্চালের পরামর্শে শকট ব্যূহ রচনা করে পসেনদি জয় লাভ করলেন। কিন্তু অজাতশত্রুর শাস্তি? হল কই! দু’-তিনদিন ধরে বন্দী ‘মগধরাজকে অনর্গল তিরস্কার করে কন্যা বজিরার সঙ্গে তার বিবাহ দিলেন পসেনদি। এবং যে-কাশীগ্রাম নিয়ে বিরোধ সেটাই তাকে প্রত্যর্পণ করলেন।
কিশোরী বজিরার কান্না, আহত সৈনিক ও দাসদের আর্তনাদ, মৃত সৈনিকদের স্ত্রী-পুত্রদের হাহাকার ও বিবাহ উৎসবের বিবিধ হট্টরোল শুনতে শুনতে ক্রমশ বিষণ্ণ, উদাস হয়ে যেতে থাকেন পাঞ্চাল। ওই তো রাজা পসেনদি বার্ধক্য-কুঞ্চিত মুখে হা-হা করে তাঁর বিখ্যাত হাসি হাসছেন। মদিরার স্ফটিক পাত্র তুলে দিচ্ছেন তারই হাতে যে নাকি তাঁর ভগ্নী ও ভগ্নীপতির নিষ্ঠুর ঘাতক! কই? শোক, ক্রোধ এসবের কোনও চিহ্ন তো নেই! তা হলে যুদ্ধ কেন হল? সহস্র সৈন্য নিহত হয়েছে। শত শত আহত। উভয় পক্ষেই। রাজায় রাজায় এ এক গোপন খেলা তবে পরস্পরের সিংহাসন সুরক্ষিত করার জন্য?
বিবাহ-সভা ত্যাগ করে চলে যান পাঞ্চাল।
—কোথায় যান পাঞ্চাল!
কুমার বিরূঢ়ক আসছে পেছন পেছন।
—আপনি কোথায় যান?
ক্রুদ্ধ মুখে গর্জন করে কুমার বলে—ভগ্নীর কান্না আর শুনতে পারছি না পাঞ্চাল। একটা নৃশংস ঘাতক, বিকলাঙ্গ—এই কি বজিরার উপযুক্ত পতি? আমাদের ভাই-ভগ্নীর কোনও মূল্য নেই পিতার কাছে?
বড় বড় নিশ্বাস পড়ে কুমারের।
তিষ্য বলেন—এ এক প্রকার কান্না। কুমার, আরো কান্না আছে। শুনবেন তো আসুন।
শুশ্রূষাশালায় আহত সৈনিকদের মধ্যে প্রবেশ করলেন তিনি কুমারকে নিয়ে। বৈদ্যরা পট্টিকা লাগাচ্ছেন, ঔষধ দিচ্ছেন, হাত, পা, আঙুল বিবিধ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কেটে বাদ দিতে হচ্ছে। অমানুষিক চিৎকার, আর্তনাদে শুশ্রূষাশিবির যেন সপ্তম নরক।
অশ্বারোহী দলের এক সৈন্যের দুটি পা-ই গেছে, ক্ষতস্থান পচে ভীষণ আকার ধারণ করেছে। সে জান্তব আর্তনাদ করছে আর বলছে—নিপাত যাক, নিপাত যাক মগধ, কোশল নিপাত যাক…ধ্বংস হয়ে যাক যে যেখানে আছে।
—কী হবে আমাদের পুত্র-কন্যা-পত্নীর? কেউ কেউ বলছে।
—আমার বৃদ্ধ পিতা-মাতার? কে দেখবে? —রব উঠছে চারদিকে।
পাঞ্চাল বলেন—শান্ত হও, শান্ত হও সৈনিক, আমি দেখব, কথা দিচ্ছি, এই কোশলকুমার দেখবেন।
আরও বৈদ্য আসেন। শল্যবিদ আসেন। সেবক আসে। মৃত্যুর হাহাকার…তারই মধ্যে যাদের আঘাত অত গুরুতর নয়, যাদের চিকিৎসায় উপকার হচ্ছে তারা জয়ধ্বনি করে তিষ্যকুমারের, রাজকুমারের। ক্রমশ বৈদ্যদের কাছে গিয়ে প্রতিটি রোগীর সংবাদ নিতে থাকে বিরূঢ়ক।
—এই-ই করণীয় কুমার—ধীরে ধীরে বলেন পাঞ্চাল—স্বাভাবিক করুণার বশে যদি না-ও করেন, অন্তত প্রজাদের হৃদয়ে প্রবেশ করবার জন্যও করুন।
শ্রাবস্তীতে ফিরে মগধ যুদ্ধে হতাহত সৈনিকদের পরিবারগুলির জন্য ব্যবস্থা নেন পাঞ্চাল। সেনাপতি দীঘমল্লর পরেই এখন তাঁর স্থান। কিন্তু রাজার দেওয়া বৃত্তির অধিকাংশই ব্যয় করেন দানে। পত্নী জিতসোমার সঙ্গে থাকেন সাধারণ গৃহস্থের মতো।
চণকের সন্ধানে দিকে দিকে লোক যায়। কেউ কোনও সংবাদ আনতে পারে না। দর্ভসেনের মৃত্যুর পর গান্ধারের সবার্থক হয়েছেন তাঁর পরমমিত্র অনঘ আঙ্গিরস—এমন সংবাদ আসে। প্রায় নিশ্চিত হওয়া যায় তখন যে চণক সেখানে নেই।
শ্রাবস্তীর রাজনীতির আকাশে সবার অলক্ষ্যে মেঘ ঘনায়। কাল, জুহ্ন, উগ্র, শ্রীভদ্র—ব্রাহ্মণ অমাত্যরা কেউ বৃদ্ধ রাজার ওপর আস্থা রাখেন না। সারাটা জীবন তিনি একবার বুদ্ধ একবার বেদ এইভাবে দুই তরীতে পা দিয়ে চললেন; তাঁদের অসন্তোষ আজকাল পরিষ্কার বোঝা যায়। দীঘকারায়ণের সঙ্গে প্রায়ই তাঁরা নানা পরামর্শ করেন, যদিও সে মল্ল বলে তাকেও তেমন বিশ্বাস করেন না। প্রায়ই এই অমাত্যদের গৃহ থেকে নিমন্ত্রণ আসে তিষ্যর কাছে।
এমনই এক নিমন্ত্রণে যেতে অমাত্য শ্রীভদ্র একদিন বললেন—মহামান্য পাঞ্চাল, আপনি তো কোশলেরই সন্তান…
পাঞ্চাল বুঝতে পারেন না শ্রীভদ্র কী বলতে চান।
শ্রীভদ্র বলেন, কোশলের গর্ব আপনি। প্রজাসাধারণকে যেরূপ অল্প সময়ের মধ্যে জয় করে ফেলেছেন তাতে করে মনে হয় কোশলের এখনও কিছু আশা আছে। আপনি কি সেই ঘটনাটি জানেন?
—কোন ঘটনা?
—ওই, রাজা রাজকুমার এরা মনোমত না হওয়ায় অমাত্যরা তাদের সিংহাসন থেকে টেনে নামায়, জনগণ সমর্থন করে, একজন সত্যিকার গুণী মানুষকে তখন রাজা করা হয়!
—এমন ঘটনা আগে প্রায়ই ঘটত—তিষ্য সতর্কভাবে বলেন।
—আবার ঘটবে, ভবিষ্যতে প্রচুর ঘটবে, বর্তমানেও ঘটা উচিত। এইভাবে চললে কোশলের আয়ু আর অধিক দিন নয়। মগধের গর্ভে চলে যাব আমরা।
তিষ্য মনে মনে হাসতে হাসতে ফেরেন। শ্রীভদ্র জানেন না, একদা এই তিষ্য মগধেরই আধিপত্য বিস্তার করার জন্য প্রাণপণে করেছেন। সে কথা জিতসোমাকে জানাতে সে বলে—সাম্রাজ্য হবেই পাঞ্চাল, দৈবরাত যে-চক্রবর্তীক্ষেত্রের কথা বলে গিয়েছিলেন এই মধ্যদেশ, প্রাচী-ঘেঁষা মধ্যদেশই সেই ক্ষেত্র। অজাতশত্রু এবং তাঁর দুই দুর্ধর্ষ সচিব বর্ষকার ও সুনীথ থাকতে মগধের সাম্রাজ্য হওয়ায় কেউ বাধা দিতে পারবে না। আমি অমাত্য ছিলাম, আমি জানি পাটুলিতে গঙ্গা ও হিরণ্যবাহর সঙ্গমস্থলে দুর্গ গড়া আরম্ভ হয়ে গেছে। অতি দক্ষ দ্রাবিড় কম্মাররা এসেছে, মহাশিলাকণ্টগ বলে এক ধরনের নতুন অস্ত্র নির্মাণ করাচ্ছে অজাতশত্রু। বড় বড় শিলাখণ্ড বহু দূর পর্যন্ত ছুড়তে পারবে এই অস্ত্র। গবেষণা চলছে রথমুষল নিয়ে। রথের চারপাশে মুষল থাকবে। এই দ্রুতগামী রথ শত্রুসৈন্যের মধ্য দিয়ে চললে বহু লোক নিমেষেই হতাহত হবে।
তিষ্য আশ্চর্য হয়ে বললেন—সত্যিই তো! নতুন অস্ত্র হলে তবেই তো পুরনো অস্ত্রধারীদের ওপর জয়লাভ করার আশা থাকে! এ কার কল্পনা সোমা?
—কুমারেরই।
—কুমার তো তা হলে সামান্য নয়?
—আমি কি একবারও বলেছি সামান্য? প্রকৃত কথা উদ্ভাবনী-প্রতিভার সঙ্গে শুভবুদ্ধি আছে কিনা। হে পাঞ্চাল, শুভবুদ্ধি বিবর্জিত কুমারের প্রতিভা তাই ভয়ের কারণ। তবে এখন শুনছি তথাগতর সঙ্গে সন্ধি হয়ে গেছে…আশা করতে পারি তার কিছু ভালো ফল হবেই! —সোমা হাসল।
অন্যমনস্কভাবে তিষ্য বললেন—তা হলে দৈবরাত ঠিক মানুষটিকে চিহ্নিত করতে পারেননি! পিতা নয়? পুত্র?
জিতসোমা বিষণ্ণ দু চোখ তুলে বলল—দৈবরাত ভুল করেননি পাঞ্চাল। কাল, স্বয়ং কাল এই ভুল করেছে।
শ্রাবস্তী থেকে কপিলবস্তু। কপিলবস্তু থেকে শ্রাবস্তী ঘন ঘন যাতায়াত করছেন বুদ্ধ। মগধের সঙ্গে সন্ধির পর নিশ্চিন্ত পসেনদিও তাই করছেন। রানি মল্লিকার মৃত্যুর পর এক স্থানে স্থির থাকতে পারেন না তিনি। বুদ্ধর প্রতি আকর্ষণ আরও বেড়েছে। সমান অনুপাতে বেড়েছে অমাত্যদের বিরাগ।
অবশেষে একদিন প্রবাসী পসেনদির রাজছত্র, মুকুট ইত্যাদি রাজচিহ্ন চুরি করে নিয়ে দীঘকারায়ণ ঘোড়া ছুটিয়ে আসেন। তাঁর পেছনে কোশলসৈন্যের একটি দল। বিরূঢ়কের রাজ্যাভিষেক হয়। অমাত্যরা কেউ আপত্তি করেন না। কিন্তু আড়ালে পাঞ্চালের কাছে এঁরা নানা প্রকার অভিযোগ জানাতে থাকেন। বয়োবৃদ্ধ অমাত্যদের নানাভাবে অপদস্থ করছেন বিরূঢ়ক।
—অমাচ্চ হয়েছেন কিসের জন্য? ভৃতি, প্রাসাদ, লোকজন, বহু স্ত্রী, সম্পদ ভোগ করবার জন্য? রাজাকে সুপরামর্শ দেওয়া আপনাদের কাজ নয়? যখন পট্টমহিষী এবং তাঁর কুমার প্রাসাদ থেকে বহিষ্কৃত হলেন সামান্য দাসদাসীর মতো, তখন কোথায় ছিলেন? সুন্দরী শূদ্রা দাসীর অঙ্কে শয়ন করেছিলেন বোধহয়!
কিংবা
—মগধের রাজাকে হাতে পেয়ে ছেড়ে দিলেন আপনাদের মহারাজ? এর মধ্যে দণ্ডনীতির কোনও ভুল নেই? হিংস্র শার্দুলকে হাতে পেয়ে ছেড়ে কেউ দেয় মহামূর্খ ছাড়া? তারপর আবার সেই শত্রুর ঘরে কন্যা পাঠানো! জেনে রাখবেন অমাচ্চ মহোদয়রা, পাশকের গুটি এখন ওই বিকলাঙ্গ রাজার হাতে। আমরা কোনওদিন ওর সাম্রাজ্য বিস্তারের বিরোধিতা করতে পারব না, কন্যা দিয়েছি বলে। নিষেধ করতে পারেননি?
—শোনেন তিষ্যও। ঠিকই বলেছে বিরূঢ়ক। বয়স অধিক নয়, কিন্তু বুঝেছে সঠিক। শুধু যদি প্রতিহিংসা প্রবৃত্তি আর অকারণ রূঢ়তাকে জয় করতে পারত।
পসেনদি মারা গেলেন রাজগৃহের উত্তর দ্বারের বাইরে এক রথকারের কুটিরে। রাত্রে এসে পোঁছেছিলেন। রাজগৃহের দ্বার রাত্রে খোলে না। অজাতশত্রুর কাছে শেষ আশ্রয় নিতে এসেছিলেন, না সাহায্য প্রার্থনা করতে এসেছিলেন বোঝা গেল না। তার আগেই হৃৎস্পন্দ বন্ধ হয়ে গেল।
অমাত্যদের গোপন প্রার্থনা তিষ্য রাজা হোক। ক্ষণে ক্ষণে নানা ছলে নানা বেশে চর আসছে তার কাছে। যে কোনও সুযোগে তাঁরাই বসাবেন তিষ্যকে সিংহাসনে। বহু শ্ৰেষ্ঠী, সাধারণজন পাঞ্চাল তিষ্যকে চায়। পাঞ্চাল ভাবেন—হায় ঈশ, একদিন রাজাই হতে চেয়েছিলাম, কী অফুরন্ত শক্তি। উৎসাহ, কল্পনা ছিল, গড়তে চেয়েছিলাম আমার সব দিয়ে একটি আদর্শ রাজ্য। বোধহয় একটি রানীর অভাবে তা হল না। —ভাবতে ভাবতে তিষ্য আপনমনেই হাসেন—আর এখন? রানী প্রস্তুত, রাজ্য প্রস্তুত, সিংহাসন ডাকছে, কিন্তু তিষ্যই প্রস্তুত নয়। মহাবীর পাঞ্চাল কি শেষে চৌর্যবৃত্তি ধরবেন? না, কখনও না। মন্দ উপায়ে কখনও শুভফলে পৌঁছনো যায় না।
পরদিন কোশলের রাজসভা পাঞ্চালের তীব্র প্রতিবাদ শুনল। রাজা বিরূঢ়ক ঘোষণা করেছিলেন, কপিলবস্তুর বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করবেন।
—কেন? পাঞ্চাল তিষ্য উঠে দাঁড়িয়েছেন—কেন জিজ্ঞাসা করতে পারি মহারাজ! শাক্যরা কোশলের অধীন, নিয়মিত রাজস্ব দেয়। আমাদেরই মনোমত ব্যক্তিকে গণজ্যেষ্ঠক করে, কী ছলে তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করবেন?
—তারা কোশলের রাজবংশকে, রাজকুমারকে অপমান করেছে। এর চেয়ে বড় কারণ আর কী হতে পারে? বিরূঢ়ক ক্রুদ্ধ।
—কিন্তু কোশলের রাজবংশ তো আর কোশল নয় মহারাজ।
—অর্থ?
—কোশলের রাজবংশ একটি ধনশালী কুল। একদা কুলের প্রমুখের হাতে এ রাজ্যের শাসনভার ন্যস্ত হয়েছিল। কথা ছিল সচিবরা, মহামাত্ররা মিলে সিদ্ধান্ত নেবেন, রাজা একা কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না। আমি একজন মহামাত্র, সেই পদাধিকারে আপনাকে নিষেধ করছি—মিথ্যা লোকক্ষয় করবেন না। মাতুলদের কুলের সঙ্গে আপনার যে মান-অভিমান তা ব্যক্তিগত। সে কারণে আপনি সমগ্র কোশলকে বিপন্ন করতে পারেন না। এই সেদিন মগধের সঙ্গে যুদ্ধ উপলক্ষ্যে কোশল রক্তস্নান করে উঠেছে, আবারও যুদ্ধ হলে তা কোশলের কাল হবে।
জুহ্ন, কাল, শ্রীভদ্র—তিন অমাত্য উঠে দাঁড়িয়ে বললেন—মহামাত্র পাঞ্চাল ঠিকই বলেছেন মহারাজ।
সিংহাসন ছেড়ে রাগে গরগর করতে করতে সভা ত্যাগ করে চলে গেল বিরূঢ়ক।
কদিন পরই কোশলসৈন্য কপিলবস্তুর দিকে যাত্রা করল। কুমার স্বয়ং পরিচালনা করছেন। দীঘকারায়ণ রাজধানী রক্ষা করতে লাগলেন। আর কাউকেই নতুন রাজা বিশ্বাস করেন না।
পাঞ্চাল নিজের গৃহে ফিরে জিতসোমার কক্ষে প্রবেশ করলেন। পুঁথিতে সম্ভবত ছায়া পড়েছিল, জিতসোমা মুখ তুলে তাকালেন। মগধ হতে আসবার পর থেকে জিতসোমার শীর্ণতা কাটেনি। চোখদুটি অস্বাভাবিক বড় এবং কালো দেখায়। রজতসূত্র দেখা দিচ্ছে মাথায়। এখনও চণকের সন্ধান চলছে। দেশে দেশে সার্থ যায়। ক্রমেই তাদের সংখ্যা, সম্পদ বেড়ে যাচ্ছে। তাদের দেওয়া হয় সন্ধানের ভার। সংবাদ মেলে না।
তিষ্য জানু মুড়ে বসে পড়েন, তারপর প্রিয়ার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়েন।
—কী হল, মহামাত্র কি ক্লান্ত?
—সম্ভবত তিষ্য আর মহামাত্র নেই প্রিয়ে।
—কেন? —সোমা লেখনী রেখে দেন।
ক দিন আগেকার সভার বিবরণ, আজ যুদ্ধযাত্রার বিবরণ দেন তিষ্য। তারপর বলেন—বৃথাই রাজশাস্ত্র লিখছ সোমা, তোমার স্বর্গরাজ্য স্থাপনের কল্পনা কোনওদিন সফল হবে না।
—স্বর্গরাজ্য তো নয় পাঞ্চাল! সুখ-দুঃখ পাপ-পুণ্যের অভিঘাতময় এই মর্ত্যের উত্তরাধিকারকেই বিবেক ও নিয়মের শাসনে সংযত করে যেতে চাই।
—কিন্তু স্বভাবের মধ্যে হিংসাকে উচ্ছিন্ন না করলে, বাসনাকে বন্দী করতে না পারলে কি মানুষ কোনদিন সুখ পাবে?
—হায় পাঞ্চাল, তুমি যে তথাগতর মতো কথা বলছ? হিংসাকে কোনদিন উচ্ছিন্ন করা যাবে কি? কামনাকেও বিনষ্ট করা যাবে না। সব মানুষ একই সময়ে সর্বতোভাবে সুখীও হবে না।
—তা হলে? তিষ্য স্মিত মুখে জিজ্ঞাসা করেন।
—তোমার কি মনে হয় না এগুলি জীবনেরই স্বভাব? ওই কামনা! বাসনাজাত ক্রোধ লোভ, দম্ভ, ঈর্ষা—এইসব! যতই এদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে ততই দ্বিগুণ বলের সঙ্গে এরা তোমাকে আক্রমণ করবে। এমন কি তুমি দেখোনি? শোনোনি?
—তা হলে উপায়?
—ক্রোধকে ক্ষাত্ৰতেজ, লোভকে বাণিজ্য বিস্তার, দম্ভকে মর্যাদাবোধ, ঈর্ষাকে উৎকৃষ্ট থেকে উৎকৃষ্টতর হওয়ার প্রয়াসে পরিণত করা যায় না কী?
—আর বাসনা?
—বিত্তবাসনার কথা তো বললামই পাঞ্চাল, শক্তিবাসনার থেকে উদ্ভূত হোক বিরাট বিরাট কর্মকাণ্ড, মহান সব মানুষ—আর দেহবাসনার রূপান্তর তো সবচেয়ে সুন্দর হবে! এই যে পাঞ্চাল সারা জীবন ধরে বিশাখার জন্য অস্থির বাসনাকে সোমার জন্য স্থির প্রেমে পরিণত করলেন, এ কী তবে? দুঃখময় পৃথিবীতে এই অমৃতের জন্যই কি লক্ষবার ফিরে আসতে ইচ্ছা হবে না?
মৈত্রেয় জাতক (Maitreya Jatak) – তিষ্যভদ্র
২৫
তিষ্যভদ্র! তিষ্যভদ্র!—তিষ্যকে তিষ্য ডাকবার লোক এখানে কেউই নেই। সকলেই বলে পাঞ্চাল। হরিৎ উত্তরীয়টি কাঁধে গুছিয়ে নিয়ে তিষ্য দাঁড়িয়ে পড়েন। বিশাখা। অদূরে পূর্বারাম মহাবিহার। বিশাখার শিবিকা থেমে আছে। বিশাখা নেমে এসেছে।
—বলুন দেবি!
—দেবি নয় সাকেতকুমার, সখি বিশাখাকে বিশাখা বললেই তো যথেষ্ট হবে!
শ্রাবস্তীর শালতরুর তলায় সরযূ বহে যায়, মল্লিকার গন্ধ ভেসে আসে।
—আপনি নাকি যুদ্ধে হতাহত সৈনিকদের জন্য সর্বস্ব দিয়ে দিচ্ছেন!
—সর্বস্ব? এ কথা কে বলে বিশাখা?
—সারা সাবত্থি বলছে।
—সর্বস্ব নয়। সামান্যই।
—কখনও সামান্য নয় ভদ্র, আপনার কাজই ঠিক। ঠিক স্থানে পৌঁছচ্ছে। আজ মনে হয় আমি বড় বাহুল্য করেছি, যৌবনের অফুরন্ত শক্তির, কল্পনার অপব্যয়…
—এ কথা কেন বিশাখা?
—জেতবন মহাবিহার তো ছিলই। তা সত্ত্বেও পূর্বারাম নির্মাণ করাতে শক্তি দিলাম। সমস্ত শক্তি।
—দান করে খেদ করতে নেই বিশাখা।
গ্রীবা ঋজু করে পঞ্চকল্যাণী নারী বলে—দেবী সুমনার কন্যা সত্য স্বীকার করতে কুণ্ঠিত হয় না। ভদ্র, পিতার কাছে শিখেছিলাম ধন উপার্জন করার সুযোগ ও প্রতিভা সবার থাকে না, তাই যার থাকে তাকে সে ধন ভাগ করে নিতে হয়। স্বকুল, স্বগোত্র, স্বগ্রাম। যদি আরও থাকে তো দানের সীমা আরও বাড়াতে হয়। তাতেই আসে ধনসাম্য। নইলে বসুন্ধরা কুপিত হন, সৃষ্টি নষ্ট হয়ে যায়। পিতার শিক্ষার মূল কথাটি বুঝিনি। ভগবান তথাগতও বলেছিলেন—যারা সংসার ত্যাগ করে আসছে তাদের জন্য কি দ্বিতীয় সংসার গড়ছো, বিশাখা? তখনও বুঝিনি। মোহগ্রস্ত ছিলাম ভদ্র। আজ দেখছি পূর্বারামের মধ্যে চীবরের পেটিকা নিয়ে কলহ করছে ভিক্ষুরা। কয় তলিকা পর্যন্ত পাদুকা পরার অনুমতি পাবে, ভেষজ বলে ঘৃত, মধু, মাংসভক্ত কীভাবে সংগ্রহ করা যায় এই নিয়ে চিন্তা করছে। বিহার প্রাঙ্গণে একদিন শ্ৰেষ্ঠীদের পাঠানো অন্ন ইত্যাদি দিয়ে পাকসাক হচ্ছিল মহাভোজের জন্য জানেন? থের সারিপুত্তর তিরস্কারে থামে। নিমন্ত্রণে কে দধির অগ্র পায়নি, কার ভাগের মাংসে অস্থি অধিক ছিল এই নিয়ে নিমন্ত্রককে কটু কথা শুনতে হয়। তিষ্য ভদ্র, প্রতিদিন পাঁচ শত ভিক্ষুকে আহার দিতে প্রতিশ্রুত আমি, আমি জানি মুষ্টিমেয় অর্হন, আদি-ভিক্ষু ও সৎ-কয়েকজনকে বাদ দিলে সংঘ একটি অলস, পরভোজী, অপদার্থ মানব সম্প্রদায় সৃষ্টি করে চলেছে। শুধু মুণ্ডিত মাথা আর রক্তকাষায়ের জন্য আজ মানুষের শ্রদ্ধা ও দান অবলীলায় নিয়ে যাচ্ছে এবং তাইতে এদের আত্মাভিমান, অধিকার বোধ আরও বেড়ে যাচ্ছে। আমি তাদেরই পুষ্ট করছি।
বিশাখা ম্লান মুখে চেয়ে থাকে।
—এত বিরাট একটি সম্প্রদায় সকলেই কি সমান হয় বিশাখা?—তিষ্য সান্ত্বনা দিতে বললেন।
—বলেন কী? এরা যে অনাগারী। নির্বাণ পথের পথিক, কামনাকে জয় করবে বলে এসেছে! জানেন, থের সারিপুত্ত ও মোগ্গল্লানের প্রয়াণের পরে এরা কী বলাবলি করছিল?
—কী?
—ভালই হল—এঁরা গেলেন। এবার তথাগত গেলেই আমরা ইচ্ছামতো চলতে পারব। এত তিরস্কার, উপদেশ, বাঁধাবাঁধি, নিয়ম আর ভালো লাগে না।
—বলো কী বিশাখা?
—হ্যাঁ। এইরূপই অবস্থা। ভগবান নাকি ভিক্ষুণীসংঘ প্রতিষ্ঠার সময়ে বলেছিলেন, নারীদের স্থান দেওয়ায় ধম্মের আয়ু পাঁচশ বৎসর অল্প হয়ে গেল। আমি জানি ধম্মের আয়ু আরও অল্প। কিন্তু তা নারীদের স্থান দেওয়ার জন্য নয়। …এমনকি ভগবানের সব আচরণও আমি বুঝতে পারি না। মেনে নিতে পারি না ভদ্র! পরম খেদে বিশাখা নতমুখী হয়ে বলল।
তিষ্য দাঁড়িয়ে থাকেন।
—আমার কন্যাসমা ভগ্নী সুজাতা মাতৃহারা, পিতার বড় আদরের, সাকেতের গৃহে সে ছিল মুক্ত, সম্রাজ্ঞী। মহাসেট্ঠি সুদত্তর ঘরে তার বিবাহ হয়েছে। বিশাল পরিবার, বহু প্রকারের মানুষ সেখানে, হতভাগিনী সেখানে বালিকাস্বভাবে আগের মতোই আহার-বিহার করে। দিনকাল পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে তিষ্যভদ্র, আমি আমার অধিকার, মর্যাদা রক্ষার জন্য মিগারগৃহে সংগ্রাম করেছি। ভগ্নী আমার তা পারে না। তার নামে ভগবানের কাছে অভিযোগ এলো সে দুর্বিনীত, কাউকে মান দেয় না। অমনি ভগবান সেখানে গিয়ে তাকে প্রতিজ্ঞা করিয়ে এলেন সে দাসীর মতো থাকবে। ধনঞ্জয়ের কন্যা দাসী? আমি…আমি ভগবানের সঙ্গে এ নিয়ে কলহ করেছি তিষ্যভদ্র, বলেছি তিনি প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ইচ্ছানুযায়ী চলছেন, বলেছি প্রব্রজিতদের গুহায় কন্দরে থাকাই ভালো—স্থবির দেবদত্ত এ কথাটি অন্তত ঠিকই বলেছিলেন। আরও বলেছি, সমাজের শক্তি তাঁর চেয়ে অনেক অধিক। তিনি কি পেরেছেন মহারাজ বিম্বিসারের হত্যা রোধ করতে? তিনি কি পেরেছেন নারীদের অধিকার সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে? পেরেছেন কি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ থামাতে? অন্ত্যজদের দুঃখ দূর করতে? তা হলে কেন তিনি বহুজনহিতের কথা, বহুজনসুখের কথা, শ্রামণ্যফলের কথা বলবেন—বিশাখার দু’ চোখে অভিমানের অশ্রু।
—শান্ত হও সখি, তিষ্য তাড়াতাড়ি বলেন—শান্ত হও। তোমার সে অপূর্ব স্থৈর্য কোথায় গেল? উপাসিকার মহাসম্পদ প্রশান্তি! তুমি না সাত বছর বয়সে স্রোতাপত্তি মার্গে প্রবেশ করেছিলে?
—তিষ্য, আমার চারপাশের পৃথিবী যখন ভেঙে যেতে থাকে, আমার সন্তানরা বিপথে চলে যেতে থাকে, তখন আমি মাতা কেমন করে স্থির থাকি? পারি। নিজেকে প্রত্যাহার করে নিতে পারি। কিন্তু জীবনের প্রথম থেকেই কিছু সংকল্প ছিল। নারীদের জন্য, দাসেদের জন্য কিছু করতে চেয়েছিলাম। পারিনি…আমি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছি।
সেই বিশাখা। সাকেত সুন্দরী গরবিনী কিশোরী যে হতে পারতো রানী। কোনও পদই যার পক্ষে অধিক মর্যাদার হত না। জীবন তাকে এক ধরনের সার্থকতা দিয়েছে। ভাবতেন তিষ্য। আজ সেই সখী বিশাখা অশ্রুমুখী, নিজের শূন্যতার কথা নিজেই বলে গেল। তিষ্যর চেয়ে আপন আর কেউ নেই তার এ কথা বলবার। ম্লানমুখী বিশাখাকে শিবিকায় তুলে দিয়ে গৃহে ফিরতে লাগলেন তিষ্য।
সন্ধ্যা বহুক্ষণ অতিক্রান্ত। বর্ষা আসব আসব করছে। মেঘেরা জলসঞ্চয় করছে। কাননের মধ্যে হরিৎ অন্ধকার। শেষ গ্রীষ্মের কুসুমের সুগন্ধে মন কেমন করে। কী প্রবল আত্মপ্রত্যয় নিয়ে একেকটি অমূল্য জীবন আরম্ভ হয়—ভাবলেন তিষ্য। তারপর একদিন যখন ফেরবার পথ থাকে না তখন উপলব্ধি হয় লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছি। কিছুই পারিনি। এ কি শুধু মিগারমাতা বিশাখারই অনুভব? অধিকাংশ কর্মী মানুষেরই তো এই এক অনুভব! বিম্বিসার কি পারলেন রাজসংঘ প্রতিষ্ঠা করতে? চণক কি পারলেন বৈদেশিক আক্রমণের বিরুদ্ধে জম্বুদ্বীপকে সংহত করতে? ঐক্যবোধ আনতে? ভগবান বুদ্ধ কি পারলেন পারস্পরিক হিংসা, যা দেখে তিনি উন্মন হয়েছিলেন, তা বন্ধ করতে? উপরন্তু বলা যায় বহু হিংসার অনুষ্ঠানের পরোক্ষ কারণ তিনিই। হত না বিম্বিসার-হত্যা তিনি না এলে, অহিংসার বাণী প্রচার না করলে, কারণ রাজগৃহের আপামর মানুষ প্রাণপণে সাম্রাজ্যের গৌরব চেয়েছিল, আজ যে বিরূঢ়ক শাক্যদের ধ্বংস করতে ছুটছে তা-ও হত না, শাক্যমুনিকে দেখে মুগ্ধ পসেনদির মনে শাক্য-কন্যার লোভ না জাগলে। মগধ-কোশল বন্ধুভাবে এক বিরাট সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে পারত হয়ত। হয়ত রূপ পেত রাজসংঘ। হয়ত বা।
তিষ্যর মনে হল পশু-পাখি-বৃক্ষ-লতা এবং সমস্ত মানুষের নির্যাস দিয়ে গড়া একটি রূপ যেন ভেদ করতে চাইছে ক্রান্তিকালের কঠিন প্রাচীর। ব্যর্থতার পর ব্যর্থতা পার হয়ে এসেছে সে। তার পরেও নতুন ব্যর্থতার পাষাণ প্রাচীরে এসে মাথা ঠুকে যায়। ব্যর্থতাই কি তবে মানুষের নিয়তি? কোথায় দৈবরাত? এতো ভালোবেসে ছিলেন মহারাজ বিম্বিসারকে যে নির্বাসন দণ্ডের অভিমানে একেবারে হারিয়ে গেলেন? আজ তিনি থাকলে ইতিবৃত্ত অন্যপ্রকার হত। কিছু না হোক নক্ষত্রালোকে ছাদে বসে তাঁরা তিনজনে অলোচনা করতেন রাজনীতি, মানবনীতি।
কানন পার হয়ে নক্ষত্রালোকিত প্রান্তরে পড়লেন তিষ্য। একটি তীক্ষ্ণ ছুরিকা পেছন থেকে এসে আমূল বিঁধে গেল তাঁর পিঠের বাঁদিকে। পুষ্পিত বকুলের তলায় তিষ্য পড়ে গেলেন। একটি আর্তনাদের শব্দও মুখ থেকে বেরল না। এমনই নিপুণতা ঘাতকের। শুধু তরুতলে ঝরা বকুলগুলি গাঢ় রক্তে রাঙিয়ে যেতে থাকল।
অচিরবতীর শুষ্ক খাত। শিবিরের পর শিবির পড়েছে। রথ, হাতি, ঘোড়া, গো-শকট। শাক্যদের শিশু-বৃদ্ধ-নারীদের গরম রক্তে হাত ধুয়ে প্রতিহিংসার শপথ পূর্ণ করেছে বিরূঢ়ক। শিবিরে শান্তিঃ। সাবাত্থিতেও একমাত্র পথের কাঁটা যে নির্মূল, সে-সংবাদ পৌঁছে গেছে। হৃদয়ে শান্তির ঢল। গভীর রাতে গাঢ় কল্লোল জাগে। সুখশয্যায় পাশ ফিরতে ফিরতে কুমার ভাবে এ আমার রক্তেরই কল্লোল। বড় আহ্লাদিত রক্তকণাগুলি। বইছে, নিষ্কণ্টক বইছে। অহো কী শান্তিঃ! আর্তনাদ কিসের? অশ্বের হ্রেষা, হাতিদের বৃংহণ? যেন রাত্রি ফাটিয়ে ফেলতে চায়? অচিরবতীর শুষ্ক খাতে ঢল নেমেছে। উজানে বৃষ্টি। মুষলধার। পশুগুলি মুক্ত হবার প্রাণপণ চেষ্টা করছে, শত শত সৈন্য পায়ের তলায় পিষ্ট করে ছুটোছুটি করে। তুমুল বন্যায় বিরূঢ়কের সেনা, রথ, পশু, অস্ত্র, শিবির ভেসে যায়। ফেনিল গর্জন করতে করতে বর্ণময় বস্ত্রগুলি ঊর্ধ্বে তুলে অচিরবতী ছোটে। পাণং ন হানে…পাণং ন হানে…পাণং ন হানে…
এবং মাৎস্যন্যায়ে পূর্ণ অরাজক শ্রাবস্তী নগরী ছেড়ে অবশেষে গান্ধারের দিকেই যাত্রা করেন একাকিনী সোমা। কোলে শিশুপুত্র। সার্থবাহ নন্দিয় যাচ্ছেন উত্তর পথ ধরে। সিন্ধু সৌবীর ঘুরে গান্ধার যাবেন। পার্সরা বহু নতুন পণ্য আনছে, অনেক মূল্য দিয়ে কিনছেও পূর্বাঞ্চলের পণ্য। তাই সার্থ যায়। নন্দিয়র সঙ্গ নিয়েছেন পাঞ্চালপত্নী সোমা। কখনও শকটে, কখনও অশ্বে, কখনও পদব্রজে পথ চলেন। শিশুটিকে সাবধানে নিয়ে চলে রক্ষীরা। চলতে চলতে গান্ধারী ভাবেন—সারাজীবন কি তিনি প্রবাসেই কাটালেন? মধ্যদেশ…এই মধ্যদেশ তাঁকে মুক্তি দিয়েছে, কর্ম দিয়েছে, প্রতিষ্ঠা দিয়েছে, প্রেম দিয়েছে, শোক দিল মর্মান্তিক বিচ্ছেদের, মর্মান্তিক মৃত্যুর। ব্যাকুল আশঙ্কায় এখন মাতৃভূমির কোলে ফিরছেন তিনি। পার্সপুরীর রাজা ধারদ্বসুর সামন্তরাজ্য এখন গান্ধার। পরপদানত। তা হোক। মা দেবদত্তার নিঃশ্বাস মিশে আছে তক্ষশিলার বাতাসে। পিতা দেবরাতের ভাবনা। যেমন করেই হোক তক্ষশিলার মহাবিদ্যালয়ে পৌঁছতে হবে। আছেন মিত্র অনঘ আঙ্গিরস। নিশ্চয় সাহায্য করবেন। পিতা দেবরাতের স্বভূমিতে বেড়ে উঠুক তাঁর কন্যার বংশ। তিষ্যপুত্র চণক…তার পুত্র চণক…তার পুত্র, তার পুত্র…সোমা চণকের রক্ত এবং স্বপ্ন নিয়ে নতুন গোত্র জন্ম নেবে নাকি? সেই চাণক্য গোত্রসম্ভব কোনও প্রতিভাধর দূর ভবিষ্যতে যদি চণকের স্বাধীনতার স্বপ্ন বুঝতে পারে, যদি বন্ধন মোচন করতে পারে।
২৬
…গৌতম জানেন এই তাঁর শেষ যাত্রা। এই শেষবার বেণুবন, কলণ্ডক নিবাপ, মোর নিবাপ, গিজঝ্কুট, জীবকাম্ববন…এই শেষ। কেউ জানে না। তিনি একা জানেন। রাজগহ পেরিয়ে চলেছেন মেঘের সঙ্গে সমান তালে। অম্বলট্টিকা। পাবারিক অম্ববন। দলে দলে মানুষ আসছে। সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা হয়ে যাচ্ছে একটি নতুন সংঘারামের। পণ্ডিত শ্রেষ্ঠ সারিপুত্তর জন্মস্থান নালকগ্রামের অদূরে এই পাবারিক সংঘারাম।
বহুজনের হিতের জন্য, বহুজনের সুখের জন্য আমি দীর্ঘ আশি বছর জীবিত রয়েছি? সাধনা করেছি। প্রথমেই মানুষের করণীয় সম্পর্কে সব বুঝে যাইনি। আজ সদ্ধম্ম বলে তোমরা যা জানো তার সবটাই নিমেষের উদ্ভাস নয়। দিনে দিনে তিলে তিলে একে গড়েছি। গড়েছেন এই নালক গ্রামের সারিপুত্ত, যিনি অতি সাধারণ মানুষের মতো রক্তবমন করে মারা গেলেন, গড়েছেন মোগ্গল্লান যিনি ধ্যানরত অবস্থায় নিতান্ত অসহায়ের মতো দস্যুদের হাতে, সম্ভবত অনঙ্গ চণ্ডাল ও তার দলবলের হাতে নিহত হলেন, গড়ছে প্রতিভাবান কিশোর কুমার কাশ্যপ যে মাতৃগর্ভে সঙেঘ এসেছিল, রাজপুরীর সুখে লালিত হয়েও যে এখন অনাগারী, কূট দার্শনিক প্রশ্নের মীমাংসা করছে ছোট থেকে। গড়ে চলেছেন অগ্গসাবিকা খেমা ও উপ্পলবন্না তাঁদের বিশ্বাস দিয়ে, গড়ছে বিসাখা মিগারমাতা তার সংশয় দিয়ে। নালক থেকে পাটুলি যাই তবে? নালক যদি বৌদ্ধবিদ্যার মহাবিদ্যালয় হয় তবে পাটুলি হবে আর্যাবর্তের এক শ্রেষ্ঠ নগরী। শোন হে মগধবাসী, কোনও ঋদ্ধি থেকে বলছি না, বর্ষকার ও সুনীথ যে-দুর্গের পত্তন করেছেন, দেখে এসো, তার সঙ্গে মেলাও তার অবস্থান। আমাকে বুঝতে পারবে। অগ্নি, জল আর অন্তঃকলহ এই তিন ভয় থাকবে এ নগরীর। সাবধান নগরবাসী, সকল ঐশ্বর্যশালী নগরীরই এই তিন ভয় থাকে। বর্ষকার, পূর্বের বিরুদ্ধাচরণের ক্ষতিপূরণ করতেই কি এই দ্বারের নাম দিলে ‘গৌতমদ্বার’? এই ঘাটের নাম দিলে ‘গৌতমঘাট’? তা দাও, কিন্তু সেই সঙ্গে বৈশালীকে পরাজিত করার মন্ত্রটিও তো জেনে নিলে! জেনে নিলে না অনুমতি নিলে? ভেদনীতির কথা কি আর তোমরা জানো না? জানে, লিচ্ছবিরাও জানে, তবু ভুল হয়ে যায়।
—কোটিগ্রাম ছেড়ে চলি নাতিকাগ্রামে। ভিক্ষু সাল্হ, ভিক্ষু সুদত্ত, ভিক্ষুণী নন্দা এই নাতিকাগ্রামের মানুষ। এখন নির্বাণ লাভ করেছেন। না গ্রামবাসীজন, তোমাদের প্রিয়জনদের পারলৌকিক গতি সম্পর্কে কোনও প্রশ্নের উত্তর আমি দেব না। কেন এ প্রশ্ন করো? অবান্তর। দূরে দেখা যায় আমার বড় প্রিয় বৈশালী নগরী। না ছেটক, কূটাগারশালায় যাব না এখন, আপনাদের নিমন্ত্রণ গ্রহণ করব না, যাব অম্বপালীর অম্ববন। এসো মা অম্বিকা, তোমার নিমন্ত্রণ গ্রহণ করেছি তো! অম্ববনটি তথাগতকে দেবে? দাও—সম্মতি দিলাম। বিহারে বিহারে ভরে যাক মগধ। চলো ভিক্ষুগণ—স্মৃতি জাগ্রত রাখো। সমাদর, দান, বহু জনসমাগম এসব উদ্ভ্রান্ত করে দেয় চিত্ত। স্মৃতি জাগ্রত রাখো। স্মৃতি…। সম্মা সতি।
বর্ষা আসছে। বেলুব গ্রামে বর্ষাযাপন করলেন গৌতম। জীবনের শেষ বর্ষা! তাই বোধহয় নিয়ে এলো কঠিন আন্ত্রিক পীড়া। নিদারুণ যাতনা।
—ভগবন, এই ব্যাধিই কি আপনার শেষ ব্যাধি? যদি তা-ই হয় ভিক্ষুসংঘকে জানিয়ে যাবেন না?
—কেন আনন্দ? সংঘ আমার কাছ থেকে আর কী প্রত্যাশা করে? যা করণীয় বলে, ধর্ম বলে মনে করেছি সব নিঃশেষে জানিয়ে দিয়েছি, মুষ্টিবদ্ধ তো রাখিনি কিছুই। অতি সরল সহজ, কিন্তু দারুণ কঠিন সেই উৎকৃষ্ট জীবনের দ্বার খোলার সংকেতসূত্র। কঠিন। কিন্তু গোপন, রহস্যময় তো নয়? হে আনন্দ, মনে করো না আমিই তোমাদের পরিচালক, ভেবো না ভিক্ষুসংঘ আমার আশ্রিত। তোমরা নিজেরাই নিজেদের আশ্রয়। আত্মদীপ হও। এ দেহ জরাজীর্ণ। ভাঙা শকটের মতো, এখন একে পরিত্যাগ কারবার সময় এসেছে।
তবে ঋদ্ধিপাদ ব্যক্তি ইচ্ছা করলে আয়ুর সীমা বাড়িয়ে নিতে পারেন। এ কী? এ কথা কেন বললাম? আনন্দ উন্মন? শোনেনি কি? কেন বললাম? বহুজনের বহু প্রশ্নের উত্তর দেওয়া বাকি রয়ে গেল—তাই? মহাকাল তাদের প্রশ্নের উত্তর দিক। সত্যই কি সমাজের প্রভাববলয়ের বাইরে যেতে পারিনি? যদি সমাজের সম্পূর্ণ বিরুদ্ধ স্রোতে যেতাম, যেটুকু সম্পাদিত হয়েছে সেটুকুও হত না, মঝ্ঝিম পন্থা আমার, সর্ব অর্থেই মধ্যম। নারীরা ক্রমে পুরুষের ইচ্ছার দাস হয়ে যাচ্ছে, বর্ণভেদ বাড়ছে। আমার ব্যক্তিগত বিদ্রোহ আমি রেখে গেলাম রাজাকে উপেক্ষা করে নটীর নিমন্ত্রণ নিয়ে জীবনের এই অন্ত্য পর্বে, চণ্ডাল সোপাক, নীচকুলজাত সুনীতকে সংঘে গ্রহণ করে, নহাপিত উপালিকে শ্রেষ্ঠ বিনয়ধরের সম্মান দিয়ে। হে বিরুদ্ধবাদীরা, আমি অন্তর্যামী, আবার অন্তর্যামী নইও। কিছু অনুমান করতে পারি, কিছু পারি না। বিপুল চরিত্ৰজ্ঞান, অন্তর্ভেদী দৃষ্টি আর করুণা দিয়ে পৌঁছতে পারি অনেক সময়েই দ্বন্দ্বের মূলে। সমস্যার মূলে। আমি যেখানে পৌঁছেছি ধ্যানস্তিমিত সেই প্রশান্তির পারাবারে বিক্ষোভ ওঠে না। তবু চেষ্টা করেছি লোকচিত্তের কাছাকাছি থাকতে। লোকভাষায় কথা বলতে।
ডেকো না আনন্দ, আমাকে ডেকো না, আমি এখন সমাধিমগ্ন থাকলেই ভালো থাকি।
বর্ষাকাল শেষ। মহাবনে বহু ভিক্ষু সমবেত হয়েছেন। তাদের তিনি উপদেশ দিলেন: ‘ব্যয়ধম্মা ভিক্খবে সঙ্খারা অপ্পমাদেন সম্পাদেথ’—তোমরা অপ্রমত্ত হয়ে কর্তব্য সম্পাদন করো। ভাণ্ডগ্রাম-ভোগনগর…আনন্দ চৈত্য। এখানে বললেন : যদি কেউ এসে বলে তথাগত এই বলেছিলেন, তথাগত তাই বলেছিলেন তা হলে বিনয়সুত্তের সঙ্গে তা মিলিয়ে দেখবে। জানবে বিনয়ই হল তোমাদের মূলশাস্ত্র! এবার মল্লভূমি পাবা। ভিক্ষুসংঘ-সহ গৌতম নিমন্ত্রিত চুন্দর আম্রকাননে। কম্মার চুন্দ বহু আয়োজন করেছেন। তার মধ্যে রয়েছে সূকরমদ্দব নামে একপ্রকার ছত্রাকের ব্যঞ্জন। বুদ্ধ খেয়ে বললেন—চুন্দ, এগুলি আর কাউকে দিও না। মাটিতে পুঁতে ফেলো।
বিষম রোগযন্ত্রণায় কাতর হয়ে পড়লেন তিনি। উপস্থিত সবাইকে বললেন—তথাগত সমস্ত জীবন যা যা খেয়েছেন তার মধ্যে শ্রেষ্ঠ হল সুজাতার দেওয়া পরমান্ন যা বোধিলাভের পূর্বাহ্ণে খাই আর চুন্দর দেওয়া এই পাক্কান্ন যা…। ভিক্ষুগণ তোমরা যেন চুন্দকে দোষ দিও না।
অসুস্থ দেহেই তিনি পথ চলতে আরম্ভ করলেন। ক্রমে ককুত্থা নদী পার হয়ে গেল। জলপান করে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করলেন। মল্লপূত্র পুক্কুস তাঁর শরণ নিল। নদীতে স্নান করে আম্রকুঞ্জে আশ্রয় নিলেন। আবার চলতে থাকেন। হিরণ্যবতীর তীরে কুশিনারা দেখা যায়। পায়ে হেঁটে নদী পার হয়ে মল্লদের শালবন। আর পারেন না। যুগ্মশালের অন্তরালে তাঁর শেষ শয্যা পাতা হল। বৈশাখী পূর্ণিমার জ্যোৎস্নায় বনভূমি প্লাবিত। শালের কুসুম ঝরছে। সিংহ শয়নে শুয়ে গৌতম বললেন—আমার যা সাধ্য তা করেছি হে আনন্দ। পাঁচ সহস্র বছর পরে সদ্ধম্মের প্রভাব যখন লুপ্ত হয়ে যাবে তখন আসবেন আরেক বুদ্ধ—মেত্তেয্য (মৈত্রেয়)।
২৭
শোন ও মহানদীর মধ্যবর্তী বিস্তীর্ণ পাহাড় জঙ্গলময় মালভূমির নানান অঞ্চলে বন কামানো ও জারানো শেষ হয়ে যায়। ছোট গাছপালা ঝোপঝাড় সবই কেটে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। পুরু ছাইয়ের পরত পড়ে গাভিন হয় জমি। পরিষ্কৃত এলাকায় লোহার লকুট দিয়ে গর্ত করে বীজ বুনতে বুনতে আকাশের দিকে তাকান চণক। বৃষ্টি আসছে। বৃষ্টি। নৈর্ঋৃত থেকে অগ্নিকোণে মোড় নিয়ে ছুটে আসছে পরিমিত বৃষ্টিদায়ী ছাই-রঙা মেঘের দল। দেখতে দেখতে ব্যাখ্যাতীত আহ্লাদে ভরে যেতে থাকে মন। ক্রমে শস্য ফলে। চারদিকে আগুনের কুণ্ড জ্বেলে, রেখা টেনে, খুঁট গেড়ে গ্রাম পত্তন হয়। ব্রীহি থেকে ঢেঁকিতে কুটে চাল হয়। সারনায় সারনায় পবিত্র পাকুড় কিংবা শ্যাওড়া গাছের তলায় কালো মোরগ কেটে সূর্যদেবতা সিঙবোঙার পুজো হয়। পুজো হয় গ্রাম-দেবতা বুঢ়ামবুঢ়া বুঢ়ামবুঢ়ির। তাঁর কেশবতী শবরী পত্নী রগ্গা মিশ্রবর্ণের স্বাস্থ্যল সন্তান প্রসব করে। শিশুর শুভজন্ম উপলক্ষে আখারায় আখারায় ধিমি ধিমি চাঙ্গু বাজে। ক্রমে তাঁরা খুঁজে পান স্বর্ণপ্রসূ এক গাঙের অবারিত বেলা। নতুন জনপদ গড়তে গড়তে এগিয়ে যান অপরিমেয় লোহা ও তামার আকরের শিরা চেঁছে নিয়ে, রত্নখনি মাড়িয়ে, তৃণগুলুময় বুরুগুলির ওপর দিয়ে পুবে আরও পুবে! পথে পড়ে প্রাচীন সব সাসান-দিরি। খাড়া খাড়া পাথরগুলি পিতৃপুরুষের চিহ্ন নিয়ে স্তব্ধ হয়ে থাকে। ক্ষণেক দাঁড়ান তিনি। কারা তাঁর পিতর্? তিনি কে? কী যেন তাঁর করার ছিল? মনে পড়ে, পড়ে, পড়ে না। আগুনে টান টান করে সেঁকা চাঙ্গুর ধিমি ধিমি বোল ভেসে আসে। স্তব্ধ কোনও দুপুরে ভূমি চষতে চষতে শোনেন ভিন্ন কিল্লির ভিন্ন পাঢ়ায় ছাগপালক রাখালিয়ার বাঁশের বাঁশি তিরি-লিরি করে বাজছে। উন্মন থেমে দাঁড়ান। মনে পড়ে, পড়ে, পড়ে না। তিনি মিশে যান পারাপারহীন জীবনস্রোতে। বইতে থাকেন পাঁচ হাজার বছর পরেকার কোনও সময়বিন্দুর দিকে। বইতে থাকেন। মৈত্রেয় হবেন বলে।
টীকা
অগ্নিস্টোম—অতি ব্যয়সাধ্য এবং কঠিন এক সোমযাগ।
অচিরবতী—বর্তমান রাপ্তী।
অট্ঠগুরুধম্ম—আটটি নিয়ম যা মেনে নেওয়ার পর মহাপ্রজাবতীর নেতৃত্বে ভিক্ষুণীসংঘ স্থাপিত হয়। ১. ভিক্ষুদের প্রতি সম্ভ্রম দেখাতে হবে। ২. যেখানে ভিক্ষু নেই সেখানে ভিক্ষুণীরা বাস করতে পারবেন না। ৩. সব বিষয়ে ভিক্ষুসংঘের অনুমতি নিয়ে চলতে হবে…ইত্যাদি ইত্যাদি।
অট্টালক—Watch-tower
অঙ্কধাত্রী—ধাত্রী তখন নানারকম হত, মেয়েদের এটি একটি বহুপ্রচলিত জীবিকা। অঙ্কধাত্রী শিশুকে কোলে নিয়ে যত্ন করবে, স্তন্যধাত্রী—দুধ-মা, মালধাত্রী বা মণ্ডনধাত্রী পোশাক পরিচ্ছদের ভার নেবে, ক্রীড়াপনিক ধাত্রী—শিশুর সঙ্গে খেলবে। ইত্যাদি ইত্যাদি।
অনাগামি—বৌদ্ধ ধর্মে শ্রাবকদের চার শ্রেণীতে ভাগ করা হত। সোতাপন্ন—তিনটি বন্ধন নাশ করলে, সকদাগামি—আর দুটি বন্ধন কাম-ক্রোধ নাশ হলে, অনাগামি—এই পাঁচটি বন্ধন সম্পূর্ণ ক্ষয় হলে, তারপর আরও পাঁচটি বন্ধন নাশ হলে হয় অর্হন।
অবীচি—বৌদ্ধশাস্ত্রের অষ্ট নরকের অষ্টমতম।
অরুর্মুখ—লালমুখো। কৌষিতকী উপনিষদে আছে ইন্দ্র বলছেন: অরুর্মুখান্ যতীন সালাবৃকেভ্যঃ প্রাযচ্ছম—অর্থাৎ আমি লালমুখো মুনিদের সালাবৃক (হায়েনা বা নেকড়ে)দের মুখে দিয়েছি, অর্থাৎ ভক্ষণ করিয়েছি।
আজানেয় অশ্ব—Throughbred horse
অসুর—আসিরীয়
আবুস—সমপর্যায়ের ব্যক্তিকে সম্বোধন।
আর্য—অর্থ—noble man. পরে জাতিবাচক অর্থেও ব্যবহৃত হয়েছে। এঁরা ভারতের উত্তর-পশ্চিম প্রান্ত দিয়ে প্রবেশ করে দ্রাবিড় সভ্যতা ধ্বংস করে সিন্ধুর তীরে বসবাস শুরু করেন। এমন ঐতিহাসিক মত। তবে প্রশ্নটি এখনও গবেষণাধীন।
ইন্দ্রকীল—নগরতোরণের সামনে সুদৃঢ় স্তম্ভ, যাতে হাতি এসে সোজাসুজি ধাক্কা মারতে না পারে।
উদকশুদ্ধিক—বিশেষ নদী বা দিঘির জলে স্নান করলে পাপ থেকে রেহাই পাওয়া যাবে এমন বিশ্বাস যার। অনুরূপ শ্মশানশুদ্ধিক, নামসিদ্ধিক।
উপসয়—উপাশ্রয়। ভিক্ষুসংঘের কাছাকাছি ভিক্ষুণীদের থাকবার জায়গা।
উপায়কুশল—resourceful
কম্মারগাম—কর্মকারগ্রাম—কর্মকারদের পল্লীও হতে পারে, আবার একটি পুরো গ্রাম শুধু কর্মকারদের বসতি এমনও হতে পারে। তুলনীয়—লোণকারগাম, বর্ধকিগাম…
কর্মান্ত—estate বা factory
কর্মস্থান—ধ্যানের বিষয়, বুদ্ধ ভিক্ষুদের ধ্যানের বিষয় বলে দিতেন তাদের প্রকৃতি অনুযায়ী।
কামানো ও জারানো—বন কেটে জ্বালিয়ে চাষের জমি প্রস্তুতের আদিবাসী পদ্ধতি। জুম চাষ।
ককায়বন্ধন—কোমরবন্ধ। বেল্ট, ভিক্ষুদের পোশাকের অঙ্গ।
কাষ্ঠকুট্ট—কাঠঠোকরা পাখি
কার্ষাপন—পালি কহাপন > কাহন। স্বর্ণ, রৌপ্য ও তাম্র তিন ধাতুরই হত এই মুদ্রা।
কিলিঞ্জক—মাদুর।
কিল্লি—গোত্র।
কুম্ভথুনিক—হাঁড়ি-বাজিয়ে।
কূটাগার—চিলেকোঠা
কুরুস—পারস্যরাজ Cyrus (558-530) B.C); ইনি পুব দিকে গাণ্ডারাইটিস জয় করেছিলেন এমন অনুমান আছে। সম্ভবত ইরান (পারস্য) ও ভারতের সীমান্ত প্রদেশ তিনি জয় করেছিলেন। এবং সেখান থেকে কর আদায় করতেন। এই গাণ্ডারাইটিসই গান্ধার হতে পারে। নিশ্চিতভাবে কিছু বলা যায় না।
কুলপুত্র—ভদ্রলোকের ছেলে।
কুলপতি—দশ হাজার ছাত্র যাঁর তেমন আচার্যকে কুলপতি বলা হত। Universityর Vice-Chanceller?
কেতুকাম্যতা—ambition
কোমারভচ্চ—কৌমারবৎস, শিশু-চিকিৎসক। জীবকের উপাধি ছিল, কিন্তু তিনি সবার চিকিৎসাই করতেন।
খজ্জ—শুকনো খাবার > খাজা।
গহপতি—সংস্কৃত গৃহপতি। সাধারণভাবে সম্পন্ন গৃহস্থকেই বোঝাতো। কিন্তু বিশেষার্থে বুদ্ধযুগে বণিকদের বোঝাত। শুধু বৈশ্য নয়, ব্রাক্ষণ বা ক্ষত্রিয় গহপতিরও উল্লেখ পাওয়া যায়।
গান্ধারদেশ—বর্তমান পেশোয়ার (পুরুষপুর) ও রাওয়ালপিণ্ডি। রাজধানী তক্ষশিলায় প্রাচীন ভারতের সবচেয়ে বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। গান্ধাররাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল কাশ্মীরও।
চত্তার আর্যসচ্চ—চতুরার্যসত্য—দুঃখ আছে, দুঃখের কারণ বাসনা, বাসনা নিবৃত্তি করেই মানুষ দুঃখ থেকে মুক্তি পাবে, বাসনা নাশের উপায় হচ্ছে অষ্টাঙ্গিক মার্গ।
সোমযাগ—সোমরস আহুতি দেওয়া হয় এমন ব্যয়সাধ্য কঠিন যজ্ঞ। ব্রাহ্মণদের জীবনে একবার করতেই হত।
চাঙ্গু—ধামসা জাতীয় পশুচর্মের বাজনা।
চতুর্মাসা—আষাঢ়ি পূর্ণিমা থেকে কার্তিকী পূর্ণিমা পর্যন্ত চারমাস বৌদ্ধরা বাস করতেন।
চেল—বস্ত্রখণ্ড বা প্রান্ত, রুমালের মতো ওড়ানো হত।
ছন্দ—বেদের ভাষা ও ছন্দ
ছয় তীর্থংকর—১. অজিত-কেশকম্বলী—নাস্তিক, চার্বাকের মতো। ২. মস্করী গোশাল—বা মকখালি গোসাল—নিয়তিবাদ মানতেন। অর্থাৎ ভালো-মন্দ কিছুতেই কিছু হয় না। সংসারের সবগুলি চক্রের ভেতর দিয়ে যাবার পরই দুঃখের অন্ত হবে। ৩। পুরণ কাশ্যপ, বা পূরণ কাস্সপ পাপ-পুণ্য বলে কিছু নেই, কর্মফল নেই—অক্রিয়বাদী। ৪. নির্গ্রন্থ জ্ঞাতপুত্র বা নিগ্গণ্ঠ নাতপুত্ত—মহাবীর নামে পরিচিত। চাতুর্যাম ও তপস্যার দ্বারা বিগতজন্মসমূহের পাপ ক্ষয় করা সম্ভব—এই ছিল এঁর মত। ৫. প্রক্রুধ কাত্যায়ন পকুধ। কচ্চায়ন—অন্যোন্যবাদী। পৃথিবী, জলবায়ু, তেজ, সুখ দুঃখ ও জীবন অচল ও কূটস্থ পদার্থ। এদের কেউ নষ্ট করতে পারে না। ৬। সঞ্জয় বৈরট্টিপুত্র— বা বেলট্ঠিপুত্ত—ইনি বিক্ষেপবাদী। অজ্ঞেয়বাদী বলা যায়।
ছোটিকা—তুড়ি।
ঠারে—কাছে, আপন করে।
দর্শযাগ—প্রতি অমাবস্যায় করণীয় যাগ।
দহর ভিক্ষু—অল্পবয়স্ক ভিক্ষু।
দ্বিজ—ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য তিন বর্ণই উপনয়নান্তে উপবীত ধারণ করত, ও দ্বিজ আখ্যা পেত।
ধর্মনাটক—নিঃসন্তান রাজা প্রথমে দাসীদের, পরে অপ্রধান রাণীদের। তারপরে অগ্রমহিষীদেরও অবরোধের বাইরে ছেড়ে দিতেন। ইচ্ছে মতো বিচরণ করে সন্তানসম্ভবা হয়ে আসবার জন্য।
ধারদ্বসু—দরায়ুস, দরায়বৌস, পারস্যরাজ (522-486 B.C.) আনুমানিক 518 B.C.-র মধ্যে উত্তর পাঞ্জাব অর্থাৎ গান্ধারের কিছু অংশ অধিকার করেন। তাঁর পার্সিপোলিস লেখতে (520-518 B.C.) গান্ধার এবং সিন্ধু উভয়েরই উল্লেখ আছে। ৩৬০ ট্যালেন্ট সোনা তিনি রাজস্ব হিসেবে আদায় করতেন। অজাতশত্রুর রাজত্বকালেই কোনও সময়ে এই ঘটনা ঘটে। দরায়ুস কীভাবে বিজিত প্রদেশ শাসন করতেন জানা যায় না।
নবকম্মকুটির—ভিক্ষুণীদের নির্জনবাস ও ধ্যানের জন্য ছোট কুটির।
নলপট্টিকা—পাটি, একরকম মাদুর।
নিগমগ্রাম—বাজার হাট আছে এমন গ্রাম। গঞ্জ।
নিয়োগপ্রথা—সন্তান না হলে স্বামীর অনুমতিক্রমে ভিন্ন পুরুষের ঔরসে গর্ভধারণ। পঞ্চপাণ্ডব যেভাবে জন্মেছিলেন।
পঞ্চকল্যাণী—চুল সুন্দর (কেশকল্যাণী), দাঁত সুন্দর (অস্থিকল্যাণী)। গড়ন সুন্দর (মাংসকল্যাণী) ত্বক সুন্দর (ছবি কল্যাণী) ও চিরযুবতী (বয়ঃ কল্যাণী) কন্যা।
পঞ্চরাজচিহ্ন—খড়্গ, ছত্র, উষ্ণীষ, পাদুকা ও চামর।
পর্ণ—শাক।
পরিবৃত্তী—রাজাদের চারজন বৈধপত্নী থাকতা—মহিষী, বাবাতা, পরিবৃত্তী ও পলাগালী। মহিষী সম্মানে শ্রেষ্ঠ, বাবাতা প্রিয়া, পরিবৃত্তী পুত্রহীনা, ইনি ও পালাগলী—একেবারেই দুয়োরানী।
পরিস্রাবণ—ছাঁকনি, ভিক্ষুদের ব্যবহার্য।
পাণং হানে—প্রাণী বধ করো না। বুদ্ধোক্ত পঞ্চ শীলের প্রথমটি।
পার্স—পারসিক।
পুণ্যশিষ্য —Charity Scholar
পূর্ণমাস যাগ—প্রতি পূর্ণিমায় করণীয় যাগ।
পোষধ—পালি উপোসথ > উপোস। প্রতি পূর্ণিমা ও অমাবস্যায় পালনীয় ছিল। শুধু বৌদ্ধদের নয়, ধর্মপ্রাণ অন্য মানুষদেরও। কিন্তু পোষধ হচ্ছে সংযম পালন। অনাহারে থাকা নয়।
বাসি—ছোট ক্ষুর।
বাহাসিঁদড়ি—মাটি, ভূমি, বসুন্ধরা।
ব্যক্তিমায়া—Charisina
বির—অরণ্য।
বুঢ়ামবুঢ়া বুঢ়ামবুঢ়ি—জুয়াঙ্গদের গ্রামদেবতা।
বেগাবেগি—তাড়াতাড়ি
ব্রীহি—ধান—দ্রাবিড় শব্দ।
মজাঙ্—মাচাং—গ্রামের প্রথমে একটি বড় ঘর যেখানে যুবকেরা রাত কাটায়। নাচ গান এরই চাতালে হয়। অতিথি এলে এখানেই থাকে।
মহানসী—রান্নার যোগাড়ে
মাণ্ডলিক রাজা—সার্বভৌম রাজার অধীনে কোনও অঞ্চলের রাজা।
রজ্জুক—Surveyor.
লকুট—ধাতুর খন্তা।
শম্বোষ্ঠী —মোটা-ঠোঁট অলা
শাক—তরি-তরকারি
সম্মা সতি—সম্যক স্মৃতি, ধারণা ঠিক রাখা, অষ্টাঙ্গিক মার্গের অন্যতম।
সারনা—পবিত্র বৃক্ষ সম্বলিত স্থান।
সুমের—বর্তমান ইরাক।
সৌভঞ্জন—সজনে
হড়—মানুষ।
যেসব গ্রন্থের সাহায্য নিয়েছি:
- Political History of Ancient India : H.C. Ray Chaudhuri.
- The Age of Imperial Unity : History and Culture of the Indian People, Vol. II by Bharatiya Vidya Bhavan.
- The Vedic Age :,, Vol I
- Buddhist India : T.W. Rhys Davids
- Social Organisation in North-East India in Buddha’s Time : Richard Fick
- Society at the Time of Buddha : Narendra K. Wagle
- Genesis of Buddhism—Its social Content : Dr. Bratindranath Mukherjee
- Studies in the Buddhist Jatakas : B.C.Sen.
- Buddhist Legends : 6 Vol. E.W.Burlingame
- Tribal Life of India : Nirmal Kumar Bose
- Introduction to Ancient Indian History and Culture : D.D.Kosambi
- জাতক—ছয় খণ্ড-অনুবাদ : ঈশানচন্দ্র ঘোষ
- কৌটলীয় অর্থশাস্ত্র—দুই খণ্ড—,, : ডাঃ রাধাগোবিন্দ বসাক
- ধম্মপদ,, : নারদ মহাথের
- উপনিষৎ প্রসঙ্গ ৫ম—অনুবাদ—,, কৌষিতকী : শ্রীমৎ অনির্বাণ
- থেরী গাথা—অনুবাদ : ভিক্ষু শীলভদ্র
- মিলিন্দ-প্রশ্ন,, : শ্রীমৎ ধমাধার মহাস্থবির
- বুদ্ধ কথা : ডঃ অমূল্যচন্দ্র সেন
- ভগবান বুদ্ধ : ধৰ্মানন্দ কোসাম্বি
20 তথাগত বুদ্ধ : শান্তিপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায়
- বৌদ্ধ ধর্ম : সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর
- দর্শন দিগ্দর্শন : রাহুল সাংকৃত্যায়ন
- যজ্ঞ কথা : রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী
- বেদের কবিতা : গৌরী ধর্মপাল
- প্রাচীন ভারত : সমাজ ও সাহিত্য : ড. সুকুমারী ভট্টাচার্য
- পালি সাহিত্যে নারী : ডঃ বাণী চট্টোপাধ্যায়
- প্রাচীন ভারতের অর্থনৈতিক ইতিহাসের সন্ধানে : ডঃ রণবীর চক্রবর্তী
- বাংলার ইতিহাস : ডঃ নীহাররঞ্জন রায়
- বিজ্ঞানের ইতিহাস—১ম খণ্ড : সমরেন্দ্রনাথ সেন
- বৌদ্ধযুগের ভূগোল : ডঃ বিমলাচরণ লাহা
- প্রাচীন ভারতের পথপরিচয় : গৌরাঙ্গগোপাল সেনগুপ্ত
- হিন্দুসমাজের গড়ন : নির্মলকুমার বসু
- সায়ণ মাধবীয় সর্বদর্শন সংগ্রহ : সত্যজ্যোতি চক্রবর্তী।