Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » মেয়েলি আড্ডার হালচাল || Bani Basu » Page 9

মেয়েলি আড্ডার হালচাল || Bani Basu

দুপুরবেলা চান-টান সেরে, ভাত-টাত খেয়ে একটু শুয়ে পড়েছি, বড্ডই গরম তার ওপরে টেনশন গেছে। ঘর অন্ধকার করে ফ্যান পুরো চালিয়ে দিয়েছি। ওদিকে ঘরের কোণে রেখেছি এক বালতি বরফঠাণ্ডা জল। আমি গরিব মানুষ। আমার বাড়িতে এয়ার-কন্ডিশনার নেই। গ্রীষ্মের দেশে জন্মেছি, গ্রীষ্মের দেশেই মরব। তা ছাড়া ত্বকের ওপর গরম রোদের ঝলসানি, গুমোট গরমে ভাপে সেদ্ধ হওয়ার এই সব যদি না অনুভব করি তা হলে লিখব কী করে? গ্রীষ্মকে বর্ষাকে যে রবীন্দ্রনাথের মতো ভালবাসতে পারলুম না— এ তো আমারই অক্ষমতা। এ অক্ষমতার জন্য আমি লজ্জিত। আর একটা সুবিধে আছে, আমাদের এ বাড়ি পুরনো দিনের। কুড়ি ইঞ্চি গাঁথনির দেওয়াল, সিলিংও যথেষ্ট উঁচু। ওপরে ছাত আছে। রোদে খাক হচ্ছে, তাই তার তাত নীচে খানিকটা নামেই। নইলে আমার বাড়ি আধুনিক সব মানুষের খোপ ফ্ল্যাটবাড়ির চেয়ে অনেক কম গরম।

ঘুমটা এসে যাব এসে যাব করছে, শেফালিবাবু ঢুকলেন। শেফালির একটা অসামান্য প্রতিভা আছে। ও ঠিক বুঝতে পারে ঠিক কখন আমি ঘুমের কোলে ঢলব ঢলব করছি, বা কখন আমার মনোযোগ চূড়ান্ত। আবার হাত চলছে, মন চলছে, কোথায় আছি, কেন আছি খেয়াল নেই। ঠিক সেই সময়েই ও খ্যানখ্যান করে একটা কাঁসি বাজিয়ে দেবে। খ্যান খ্যান খ্যান খ্যান।

‘কী হলরে? কী হল?’

‘মারো বউদি আমায় মারো’— বলতে বলতে কোমরে কাপড় জড়িয়ে শেফালি এসে উপস্থিত হল।

‘হলটা কী?’

‘সবচেয়ে ওপরের তাক থেকে অবরে-সবরে বার করার কাঁসার পরাতখানা পড়ে গেল।’

‘গেছে?’

‘কানা ভেঙে গেছে।’

‘বাঃ! নিজে থেকেই ঝাঁপিয়ে পড়ল পরাতটা? আত্মহত্যা করল না কি? তুই কি কোনও সাহায্যই করিসনি?’

‘পাশ থেকে খন্তি দিয়ে কুরুনিটা পাড়তে গিয়েছিলুম।’

‘বা বা বা, এখন যাও।’

কাঁসা পেতলের কিছু বাসন আমাদের এখনও আছে। কাঁসার জামবাটি, কাঁসার পরাত, চোদ্দো পনেরো জনের ময়দা মাখা যায় তাতে, নতুন কাঁসার সেট তো আছেই। জনা ছয়েককে পঞ্চব্যঞ্জন দিয়ে খেতে দেওয়ার মতো। স্টেনলেস স্টিলের ব্যক্তিত্বহীন সামান্যতার সাম্রাজ্যে পুরনো দিনের ঝকঝকে কাঁসা পেতল। আর কিছু না হোক সাজিয়ে রেখে দিলেও ভাল লাগে। সেই কাঁসার পরাত শেফালিবাবু ভাঙলেন। ভাঙলেন আবার মোক্ষম সময়ে, যখন আমার লেখা জমে উঠেছে। ভেঙে আবার নাটক করছেন— ‘মারো বউদি, আমায় মারো।’ মারতেই ইচ্ছে করছে। বেধড়ক মার। কিন্তু মারতে আমরা কবেই ভুলে গেছি। ‘এখন যাও’ আর ‘বা বা বা’ ছাড়া আর কী-ই বা বলতে পারি! মন মেজাজ তিতকুটে হয়ে যায়। লেখা ছেড়ে, টেবিল ছেড়ে, বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে থাকি কিছুক্ষণ। পৃথিবীতে সব বস্তুই নশ্বর, ভঙ্গুর, যা গেছে। তা গেছে, মন খারাপ করে বোকারাই— ইত্যাদি বাক্যে নিজেকে ভোলাবার চেষ্টা করি।

ঘুমের জন্য শুলে আমার চোখ ছোট বাচ্চাদের মতো এক বার খোলে, আবার বন্ধ হয়ে যায়। আবার খোলে, আবার বন্ধ হয়, ফট করে আবার খুলে যায়— দেখি ঘরের আধো অন্ধকারে পায়ের দিকে শেফালিবাবু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আঁচল আঙুলে জড়াচ্ছেন। অর্থাৎ কিছু বলবেন। বলুন তাতে ক্ষতি নেই। কিন্তু ঠিক এই সময়টাই বেছে নিতে হবে? আবার বিনীত ভঙ্গিটা দেখো, যেন কৃষ্ণের শয্যার পায়ের দিকে অর্জুন। ওই অর্জুনের মতোই ধুরন্ধর।

‘কিছু বলবে?’

‘অ্যাল’— করে জিভ কাটে শেফালি— ‘তোমার ঘুমটা ভাঙিয়ে দিলুম তো!’

ভাঙা আর ভাঙানো এই দুটিই তো ওর প্রধান কাজ। যাক গে সে কথা বলে আর কথা বাড়াতে চাই না।

‘বলে ফ্যালো তবে’— অনুমতি দিই।

‘রাগ করবে না তো?’ — শেফালির অনুনয়।

‘রাগ করার মতো হলে করব বই কি?’

‘রাগ করার মতোই বউদি। কিন্তু আমি শুধু খপর দিচ্ছি। আমার ওপর রাগ-ঝাল করো না।’

রহস্য গাঢ়তর। ব্যাপার কী?

‘শিল্পীদিদি বড্ড বাড়াবাড়ি শুরু করেছে।’

‘মানে?’

‘মানে আর কী বলব। তুমিও শান্তিনিকেতন গেলে আর শিল্পীদিদিও জমিয়ে এসে বসল।’

‘এখানেই ছিল না কি কদিন?’

‘ছিল নাকো। কিন্তু রোজ আসত প্রায় রোজ। আজ দই বড়া করে আনছে। কাল রোগন জুস, পরশু ফিশ তন্দুরি। দাদাবাবু এলে দেখো, চেহারা অনেক ফিরেছে। শান্ত তো লাফাতে লাফাতে বাড়ি ফেরে। শিল্পীমাসি আজ কী এনেছো?’

‘তা শিল্পীমাসিই খালি এক তরফা খাইয়ে গেল? তোমরা কিছু খাওয়ালে না তাকে?’

‘কী সব্বোনাশ, খাওয়াব কি গো, আমি তো ভয়ে আধখানা, পোড়-খাওয়া মেয়েমানুষ বাবা, আমার চোখ ফাঁকি দিতে পারবে না। দাদাবাবু খুব পটেছে। দু-দিন সিনেমা গেছে। এক দিন দর্পণায়— যুগান্ত, আর এক দিন নন্দনে কী জানি কী চেক ফিলম। ফিলিমও যে চেক-কাটা হয় এই প্রথম শুনলুম বউদি। আর খাওয়ানোর কথা বলছ, —আমার আর দরকার কি? সে কর্তব্য দাদাবাবুই করেছে। তিন দিন মোট তিন দিন, বাইরে থেকে খেয়ে এল। শান্তর জন্যেও এনেছিল। আমার জন্যেও। কিন্তু সে সব আমরা খাইনি। চুপিচুপি ফেলে দিয়েছি।’

‘সে কী?’ কেন?’

‘যদি তুকতাক থাকে বউদি?’

‘বা! বা! বা! এখন যাও।’

এ ছাড়া আর কী-ই বা বলতে পারি আমি, কোথায় কোথায় খেল কে জানে। শিল্পীর ভীষণ নাক-উঁচু, যেখানে-সেখানে ঢুকবেই না। ভাল-ভাল খাদ্যগুলো শান্ত বেচারি খেতে পেল না।

‘তুমি ছেড়ে দিতে পারো বউদি। তুমি দেবী। আমি কিন্তু ছাড়ব না। আমি ঘরপোড়া গোরু। তোমার ঘর আমি পুড়োতে দেব না। আংরা জ্বেলে ওই খ্যাংরাকাঠির মুখে যদি আমি নুড়ো না জ্বেলেছি তো …’

‘যাবি? একদম বাজে বকবি না।’

ফুঁসতে ফুঁসতে শেফালি চলে গেল।

এত বিরক্তি সত্ত্বেও আমি ঘুমিয়ে পড়লুম। তবে ছেঁড়া-ছেঁড়া ঘুম। তার মধ্যে স্বপ্ন— একদম সত্যির মতো। একটা বিরাট লাইব্রেরি। ফাদার জেনকিন্‌স এক দিকে বসে লেখাপড়া করছেন। আমাকে আঙুলের ইশারায় ডাকলেন। তারপর একটার পর একটা প্রশ্ন করতে লাগলেন। একটারও আমি উত্তর দিতে পারছি না। লজ্জায় মাথা নিচু করে আছি। কয়েকটা প্রশ্ন পর্যন্ত মনে আছে। ললি পপ-এর বাংলা কী? গঙ্গা আর হিমালয় ছাড়া ভারতে আর কী বড় নদী আছে? ই ইকোয়ালস্‌ এম সি স্কোয়্যার যদি হয় তা হলে নিরুপম ইকোয়ালস্‌ শিল্পী স্কোয়্যার হবে না কেন? আরও অনেক প্রশ্ন ছিল, কোনওটারই উত্তর দিতে পারিনি। হঠাৎ ঘুমের ঘোরটা একটু কেটে যেতেই চুষি ল্যাবেঞ্চুস, চুষি ল্যাবেঞ্চুস বলে চেঁচিয়ে উঠলাম।

একটা মুখ আমার ওপর ঝুঁকে পড়েছে।

‘কে?’ বলে এক প্রচণ্ড ঝটকা মেরে সরিয়ে দিয়েছি। ‘বা বা গো’ বলে কে যেন ঘুরে পড়ল।

ধড়মড় করে উঠে বসে দেখি কোণের দেওয়ালে ঠেস দিয়ে নিরুপম বসে আছে।

বললে— ‘বোলপুরের জলমাটিতে রণচণ্ডী হবার এলিমেন্ট আছে জানতুম না। উফ্‌ফ!’

‘ঘুমোচ্ছি, ও রকম করে মুখের ওপর ঝোঁকে। ঘুমের ঘোরে ঘাবড়ে যাব না?’

‘ল্যাবেঞ্চুস ল্যাবেঞ্চুস বলে বিড়বিড় করছিলে কেন? স্বপ্নে কি ছেলেবেলায় ফিরে গিয়েছিলে?’

‘আমি পড়া পারছিলুম না।’

‘তার ঝাল আমার ওপর ঝাড়লে? বেশ করেছ, এখন স্বপ্নের পাঠশালা থেকে উঠে এসে আমার মাথায় বরফ দাও।’

মাথার পেছন দিকে একটি ছোট্ট ট্যাঁপারি মতো হয়েছে। ছি, ছি! যদি বেচারার মাথা ফেটে যেত। তাড়াতাড়ি বরফ আনতে যাই। বরফ বার করে একটা প্লাস্টিকের মগে ভরছি। শেফালিবাবু চুলে এলোখোঁপা বাঁধতে বাঁধতে এলেন।

‘কী হল বউদি? হঠাৎ…’

বললুম—‘দাদার মাথায় লেগে গেছে।’

চলে যাচ্ছি, পেছন থেকে চাপা গলায় বলছে শুনি, ‘বেশ করেছ। উচিত শিক্ষে দিয়েছ। বিষ ঝেড়ে না দিলে…’

‘চুপ করবি?’—আমি জিভে বিষ ঢেলে বলি। কিন্তু মনের মধ্যেটা কেমন খচখচ করে। এমন করছে কেন শেফালি? এতটা?

একটু পরেই শান্ত ফিরল। চোদ্দো বছরের অশান্ত ছেলে। আমাকে দেখে ‘ইয়া, ইয়াও’ বলে কয়েকটা লাফ দিয়ে নিল। তার বাবা তখনও মাথায় হাত বুলোচ্ছে, চুল সব ভিজে।

ছেলে বলল— ‘ও কী বাবা? চুল দিয়ে জল ঝরছে কেন?’

‘তোমার মাতৃদেবী মেরেছেন বাবা, এমন মেরেছেন যে শীতের নতুন আলু বেরিয়ে গেছে, তাই বরফ দিতে হয়েছিল।’

—‘আহ? ইয়ার্কি মেরো না’— আমি খুব রাগ করি।

শান্ত বলে ‘তাই বলো, আমি ভাবলুম মা বুঝি সত্যি সত্যি মেরেছে—শিল্পীমাসির সঙ্গে সিনেমা গেছো বলে।’ —শেষের অংশটা ও চাপা গলায় বলল।

আমি প্রচণ্ড রেগে যাই— ‘শান্ত!’

শান্ত নিজের ঠোঁটের ওপর আঙুল রেখে স্পিকটি-নট হয়ে দাঁড়ায়।

’কখনও আমাকে মারামারি করতে দেখেছ?’

‘না।’

‘তা হলে? এ রকম অসভ্যের মতো কথা বলবে না!’

আমি আড়চোখে নিরুপমের দিকে তাকাতেই আড় চোখাচোখি হয়ে গেল। অর্থাৎ নিরুপমও সেই মুহূর্তে আমার দিকে আড়চোখে চেয়েছিল।

আমি বললাম, ‘দুপুরে আমাকে চন্দন পৌঁছে দিয়ে গেল।’

‘চন্দন কে?’

‘সে কী? শিল্পীর বরকে চেনো না? চন্দন বরাট। গাড়ি নিয়ে স্টেশনে উপস্থিত ছিল। নেভি ব্লু মারুতি এসটীম!’

‘শিল্পী ছিল?’

‘না, শিল্পী কোথায়?’ তীর্ণা যে ছিল, কাজলরাও যে ছিল আমি ভাঙি না।

‘হঠাৎ চন্দন বরাট তোমাকে স্টেশন থেকে আনতে যায় কেন, জানি না বাবা।’ নিরুপম নিজস্ব মেজাজ খারাপের স্টাইলে বলে।

‘তুমি যাও না বলে,’ শান্ত খুব সরল মুখে বলে।

আমি ওকে আদর করে বলি— ‘লাখ কথার এক কথা বলেছিস।’ ও লাফাতে লাফাতে চলে যায়, ‘ইয়া, ইয়াও।’

আমি বলি— ‘বাজার করব একা একা, প্রকাশকের বাড়ি যাব একা একা, বেড়াতে যাব একা একা, লোক-লৌকিকতা করব একা একা, কী? না নিরুপমদা ওয়ার্ডের হিরো, তাঁকে নইলে এক মুহূর্ত চলে না, নিরুপম গড়াই পলিটিক্স করছেন, কই অন্য কারও বেলায় তো সময়ের অভাব হয় না।’

‘নিজের বউকে বলা যায়, অপরের বউকে কি যাব না বলা যায়? যা নেই আঁকড়া তোমার বন্ধু। নিরুপমদা ‘যুগান্ত’ চলুন, নিরুপমদা অমুক চলুন তমুক চলুন…’ পাগল করে দিয়েছে একেবারে।’

আমি বললুম, ‘আর নিরুমপদা দই বড়া খান, নিরুপমদা শাম্মী কাবাব খান, এগুলো তো বলছ না!’

‘তুমি কী করে জানলে?’

‘জানলাম।’

‘শেফালিবাবুর লাগানো-ভাঙানো তা হলে হয়ে গেছে? ওকে কি স্পাই রেখে গিয়েছিলে? এত দূর সাহস ওর, যে আমার ওপর টিকটিকিগিরি করে তোমাকে লাগায়?’

আমি বললুম, ‘সে আবার কী— শিল্পীদিদি ভাল-ভাল খাবার-দাবার করে তোমাদের খাইয়ে গেছে, এটা বললে লাগানো হয়? বলবে না? এটা যদি না বলার মতো কোনও গর্হিত ব্যাপার হয় তা হলে তুমি ওকে সেটা বলে দিলেই পারতে।’

নিরুপম রণে ভঙ্গ দেয়।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress