মেয়েলি আড্ডার হালচাল : 14
এ নব ও নব ঘুরিয়ে যন্তরটার ফোকাস ঠিক করি। আসছে, আসছে, ফ্রেমের মধ্যে এসে যাচ্ছে, যাচ্ছে নয় যাচ্ছেন একজন ভদ্রলোক, ঘিয়ে রঙের টি-শার্ট পরা। স্পঞ্জের মতো কাপড়টা। পকেটের ওপর ছোট্ট একটা মোটিফ যেন, ওই একই রঙের, সামান্য গাঢ় হতে পারে। চুলগুলো রুপোর তাজের মতো মাথার ওপর শোভা পাচ্ছে। বেশ চৌকো চওড়া মুখটি। ঘন ভুরু, কিন্তু ঝোপের মতন নয়। কপালে গুনে গুনে দুটি আড়াআড়ি দাগ, তাতে একটা ব্যক্তিত্ব, একটা চরিত্র দিয়েছে ভদ্রলোককে। নাকটা খাড়া কিন্তু পাতলা নয়, খানিকটা মোটা, ফটো-ক্রোম্যাটিক লেনসের চশমা পরা, লেনসটা ভারী, মুখের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে। ঠোঁট দুটোও বেশ পুরু। পাতলা ঠোঁটের পুরুষদের কেমন নিষ্ঠুর দেখায়। যেমন বঙ্কিমচন্দ্র। কুন্দকে বিষ খাইয়ে, রোহিণীকে বন্দুক দেগে হত্যা করেন। শৈবলিনীকে নরক দেখান। প্রফুল্লকে দিয়ে বাসন মাজান, যা নরক দর্শনের চেয়ে কোনও অংশে কম খারাপ নয়। পুরু বেশ ঢেউওলা ঠোঁটের অধিবারীরা খুব বর্ণময় ব্যক্তিত্ব হয়ে থাকেন। যেমন সমরেশ বসু। যিনি জ্যোতির্ময় শ্রীচৈতন্য লেখেন, তিনিই গোগোল লেখেন। এক হাতে কালকূট, “কোথায় পাব তারে”র অন্বেষু বাউল আর এক হাতে শেকল ছেঁড়া হাত খুঁজে চলেছেন। ভদ্রলোক আনকোয়ালিফায়েড ডার্ক।
এই যে কালো তার দেখছি একটা আলাদা মহিমা। যতই দিন যাচ্ছে ততই আমি কেন যেন কালোর ভক্ত হয়ে পড়ছি। কৃষ্ণ কালো, কদম কালো … আমাদের যে ঐতিহাসিক পৌরাণিক প্রেমিক পুরুষ তিনি স্বয়ংই তো কালো। বর্ষার পুঞ্জ মেঘ, দেখো সেও নীল নবঘন, ‘কালো তা সে যতই কালো হোক, দেখেছি তার সাদা চুলের ক্লোক’— বলেছিল কাজল। বসে আছেন। তবুও বোঝা যায় ভদ্রলোক খুব লম্বা। লম্বা ছাড়া নায়ক হয় না। চয়েস যখন রয়েছে তখন বেঁটে নায়ক বাছব কেন? বেশি ঢ্যাঙা হয়ে গেলে চোঙা কি বেল বটম প্যান্ট পরলে অড দেখায় যেমন অমিতাভ বচ্চন, ব্যাপারটা ওঁর কোনও বেশকারের মাথায় আসেনি কেন কে জানে। হয়তো ওই অড এফেক্টাই পাবলিক খেয়েছে। তা সে যাই হোক— বিকাশকান্তি বসে আছেন। ফাইলের পাতায় চোখ, পেছনে পাশে কাচের জানালার ভারী পর্দা একটু একটু সরানো, যা দিয়ে লবণহ্রদের চমৎকার সবুজের দীর্ঘশ্বাস দেখা যায়। সামনের টেবিলে দুটো টেলিফোন— একটা সাদা, একটা কালো, কলমদানিতে সার সার বল পেন, অনেক ফাইল গাদা করা, নিবিষ্ট মনে পড়ছেন, টিক মারছেন, সইসাবুদ করছেন ভদ্রলোক, টেলিফোন বাজল, ইন্টারকম। সাদাটা তুলে নিলেন ভদ্রলোক। ‘সান্যাল’ গম্ভীর গলায় বললেন— এই স্বরটাও খুব জরুরি। স্বর যদি মেঘমন্দ্র না হয় তো তাকে ঠিক প্রাপ্তবয়স্ক পর্যায়ে ভাবা চলে না— যেমন শচীন তেণ্ডুলকর চিরবালক।
‘ও, আচ্ছা, আমি একটু ব্যস্ত, ঠিক আছে, এসেছেন যখন চলে আসুন, আসতে দাও রমেন।’
মিনিট দুই পরে যে ঢুকল তাকে আমি হাড়ে হাড়ে চিনি। আপনারাও চেনেন, অর্থাৎ নামে জানেন, কিন্তু দেখেননি কখনও। এটি সুমিতা। এবং বিকাশকান্তির বিপরীতার্থবোধ। সুমিতা ধবধবে ফরসা, বেঁটে না বলে ছোটখাটো বলা ভাল, নায়িকাও আমি দীঘল দীঘল পছন্দ করি, কিন্তু এ যে সত্যি সুমিতা একেবারে মেপে পাঁচ ফুট। বাড়াব কী করে? ঝুমুর ঝুমুর চুলে পেছন থেকে একটা লম্বা চকচকে গুবরে পোকার মতো ক্লিপ দিয়ে আটকানো, প্রসাধনের সমস্ত আধুনিক নিয়ম পালন-করা লিচু-লিচু মুখ, কাজলপরা ম্যাসকারা মাখা চোখে ইচ্ছে করলেই বালিকার বিস্ময় ফোটাতে পারে, আবার খুব চালাক-চালাক পাজির-পা-ঝাড়া খুনসুটে মেজাজ ফোটাতেও ওর জুড়ি নেই। বেশ টেবো টেবো গাল, দেখলেই টিপে দিতে ইচ্ছে করবে আপনার। ঠোঁটও বেশ ফুলো ফুলো, যেন এক্ষুনি ঠোঁট ফুলোবে, এই সব ভাব— অর্থাৎ আদুরি, পাজি, চালাক অভিমানী, মজাদার—এ সব সুমিতা নিজের মুখে তুলি দিয়ে আঁকতে পারে। অ্যাক্টিং লাইনে গেলে অনেকের ভাত মারতে পারত।
সুমিতা আজকে একটা হালকা চাঁপা রঙের টাঙাইল শাড়ি পরেছে। তাতে সাদার গোল গোল বুটি। ব্লাউজটাও একেবারে এক রঙের। গলায় চিকচিকে সরু সোনার হার, কানে সোনার বুটি, হাতেও ঝিকমিকে সোনার চুড়ি, গুনে তিনগাছা। যেন জরির সুতোর মতো জড়িয়ে আছে। ঢুকেই সুমিতা একটা হাসি দিল। আত্মবিশ্বাসে উজ্জ্বল, কিন্তু খুব সংযত সংহত হাসি, হাসিটা বোধহয় ওজন দাঁড়িতে মেপে এনেছে।
বিকাশকান্তি বললেন— ‘বসুন। তারপর?’
শিল্পী হলে বলত— ‘তার আর পর নেই।’ ওই একটা জবাবই ওর ঠোঁটের গোড়ায় রেডি। কিন্তু সুমিতা অত কাঁচা খেলোয়াড় নয়। সে একটা সুদৃশ্য ফাইল বার করে ফেলে। বলে— ‘প্রজেক্টের সিনপসিসটা আজ দেখবেন? বিকাশকান্তি বলেন— ‘সিনপসিস দেখার কি আমার সময় আছে ম্যাডাম? আপনি মোটামুটি মেইন পয়েন্টগুলো বলে দিন।’
‘হাই ইনকাম-গ্রুপের চাকুরেদের, মাইন্ড ইউ সার ব্যবসায়ী নয়, স্যালারিড পার্সনস— এঁদের স্টাডি করছি মোটামুটি। একটা কোয়েশ্চনেয়ার তৈরি করেছি— আপনাকে দিয়ে যাব, আপনি কাইন্ডলি জবাবগুলো দিয়ে দেবেন। বেশির ভাগই ইয়েস, নো কিম্বা চয়েস। ভয় পাওয়ার কিছু নেই।’
অল্প একটু হাসি দেখা গেল বিকাশকান্তির মুখে— “আপনি পেপার তৈরি করছেন খুব ভাল, কিন্তু একটা ইয়ংগার এজ-গ্রুপ নিয়ে করলে পারতেন না?’
‘দেখুন সার, এখন এঞ্জিনিয়ার ছাড়া অন্য সবার চাকরি পেতে পেতেই আটাশ উনত্রিশ হয়ে যাচ্ছে। বছর চল্লিশের আগে কেউ নিজেকে প্রতিষ্ঠিত ভাবতেই পারছে না। আমি চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ রেখেছি এজ-গ্রুপ।’
‘তা হলে হয়েই গেল, আ অ্যাম অন দা রং সাইড অফ ফিফটি।’ বিস্ময়ের চোখটা এবার করল সুমিতা।
‘এতো অবাক হচ্ছেন কেন? আমার মাথার দিকে চাইলেই তো বোঝা যায়!’
‘ইউ মীন ইট ইজ ন্যাচর্যাল?’
‘তার মানে?’
‘প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড, আমি ভেবেছিলাম আপনি আজকালকার ফ্যাশন অনুযায়ী চুল রুপোলি ডাই করেছেন।’
‘চুল আবার রুপোলি ডাই করা যায় না কি? ইটস নিউজ টু মী।’
‘এই তো আমার একটা প্রশ্নের জবাব আপনি এক রকম দিয়েই দিলেন। সাত নম্বর প্রশ্নটা দেখবেন।’
‘দেখে আর কী করব, আমি তো আপনার আওতার বাইরে চলে গেলাম।’
‘কেউ বিশ্বাস করবে না মি. সান্যাল, কিন্তু আপনি যখন বলছেন— বিশ্বাস করছি। আমি আমার আওতাটাকে বাড়িয়ে নেব এখন। অসুবিধে নেই। ইনকাম গ্রুপটা জরুরি, এজটা নয়। — আচ্ছা আজ চলি।’
হাতজোড় করে সুমিতা উঠে দাঁড়ায়।
‘শুনুন শুনুন।’ ব্যস্ত হয়ে সান্যাল বলে ওঠেন— ‘আসল কথা আমার এত পেন্ডিং কাজ পড়ে আছে। বাড়িতেও ফাইল নিয়ে যেতে হচ্ছে রোজ। কখন আপনার প্রশ্নপত্র পড়ব?’
‘এই কথা?’ সুমিতা এবার খুব সিরিয়াস মুখ করে, ‘আচ্ছা ধরুন, এ সমস্যাটির সমাধান যদি আমি করে দিই।’
‘আমার সময় সমস্যার সমাধান আপনি করবেন?’
‘সাইকলজির লোক তো আমি।’— এ বার সুমিতা তার সবচেয়ে মুগ্ধকর হাসিটা হাসে।’
‘সাইকলজির লোকেরা টাইমও বার করতে পারে?’
‘সাইকলজির লোকেরা অনেক কিছুই বার করতে পারে টেনে টেনে।’ সুমিতা জবাব দেয়, ‘আচ্ছা, অফিসের পর আপনি কী করেন?’
‘অফিসের পর?’— হো হো করে হেসে ওঠেন বিকাশকান্তি।’ ওই সময়টাকেই আপনি ধরবেন সমস্যার সমাধান করতে? এই আপনার সাইকলজি?’
আমার সাইকলজি ঠিকই আছে। আপনি বলুন না কী করেন?’
‘একটু রিল্যাক্স করি, আর কী করব? যতক্ষণ না জ্যামটা কাটে— একটু স্ট্র্যান্ড ধরে হাওয়া খাই। ধরুন, ফোর্ট উইলিয়মের এন্ডটায় বসলাম, কি সেকেন্ড হুগলি ব্রিজ দিয়ে এক পাক ড্রাইভ করলাম। তারপর বাড়ি ফিরে যাই।’
গাম্ভীর্যের খোলস খুলে বিকাশকান্তি ব্যক্তিগত জীবনের আশেপাশে ঘোরাফেরা করতে থাকেন।
সুমিতা খুব কিন্তু কিন্তু করে বলে— ‘ওই রিল্যাক্সেশনের সময়টা আমি যদি দু-চারদিন একটু থাকি আপনার সঙ্গে, আপনার কি খুব আপত্তি হবে? আপনার বিশ্রামের আমি ব্যাঘাত করব না, বরং রিল্যাকসেশনের কতগুলো উপায় আপনাকে শিখিয়ে দেব। আসলে সাইকলজির লোক তো!’– সুমিতা হাসে।
‘ঠিক আছে, এক দিন এক্সপেরিমেন্ট করে দেখা যেতে পারে।’ ফাদার জেনকিন্সের ভাষায় বিকাশকান্তি ভাঙ্গেন তবু মুচকেন না।
‘মেনি থ্যাংকস,’ বিব্রত মুখে সুমিতা বলে, ‘আপনাকে খুব বিরক্ত করছি আমি জানি, কিন্তু এটা ফোর্ড ফাউন্ডেশনের একটা গ্রান্ট থেকে হচ্ছে। ফাঁকি দিয়ে সারা যায়? বলুন!’
আর বিরক্ত করে না তাঁকে সুমিতা। মুহূর্তে ফর্ম্যালিটির মোড়কে মুড়ে যায়। প্রফেশন্যাল গলায় বলে—‘নমস্কার, থ্যাংকস।’
‘তা হলে কাল পাঁচটার সময়ে আসুন’— বিকাশকান্তিই পিছু ডেকে তাকে মনে করিয়ে দ্যান।
‘এইখানে? এত দূরে? তার চাইতে আপনি বাই-পাসে পড়ে পার্ক সার্কাস কানেক্টরের ওখানে আসুন। আমি দাঁড়িয়ে থাকব। সাড়ে পাঁচ। ঠিক আছে।’ বলে তাকে বিদায় দিয়েই বিকাশবাবুর কেমন মন খুঁতখুঁত করতে লাগল, তিনি একটা পাবলিক সেক্টর সংস্থার ম্যানেজিং ডাইরেক্টর, বয়সও পঞ্চান্ন হল। এই মেয়েটি তাঁকে যে পরিস্থিতিতে ফেলে গেল তাতে করে তাঁকে অফিসের পর অনেকটা রাস্তা গিয়ে একটি প্রতীক্ষমাণা মহিলা, না না তাঁর স্ত্রী মহিলা। কিন্তু এ মেয়েটি নেহাতই মেয়ে, যাই হোক, প্রতীক্ষমাণা মেয়েকে মিট করতে হবে।
‘ইডিয়টিক!’ বলে তিনি ড্রয়ারটা শব্দ করে বন্ধ করলেন। কিন্তু বলা কথা আর ছোঁড়া তীর ফিরিয়ে নেওয়া কি যায়?
বাড়ি ফিরে মালবিকার সঙ্গে একটু পরামর্শ করলে হত। কত রকম বিপদ হয়েছে আজকাল। মেয়েটি কোনও দলের হয়ে কাজ করছে না তো? তাঁকে কোনও রকম বেকায়দায় ফেলবে না কি? কিন্তু মালবিকাকে কি আর সন্ধেবেলায় বাড়ি পাওয়া যায়! মহিলা সমিতির নাম করে মহিলা অষ্টপ্রহর সংকীর্তন করে বেড়াচ্ছে। বাড়িতে তাকে পাওয়াই যায় না। একটা ছেলেমেয়েও যদি থাকত এতটা বাড় বাড়ত না। এখন তাকে হ্যা হ্যা করে চব্বিশ ঘণ্টা হাসতে আর পান চিবোতে বাধা দিচ্ছে কে? চ্যাটাং চ্যাটাং করে চটি পায়ে গলিয়ে বেরিয়ে গেলেই হল। বাড়ি ফিরে চান-টান করে টিভিটা চালিয়ে দিয়ে একটু আলগা হলেন সান্যাল। প্রত্যেক চ্যানেলে একই নাচ দেখাচ্ছে— শখানেক মাথায় ফেট্টি বাঁধা খালি গা ধুতি মালকোচা পরা ছোকরা আর ডজন দুয়েক লিকপিকে মেয়ে নিজেদের দশ ডবল সাইজের ঘাঘরা পরে নাচছে। কিছুক্ষণ দেখতে দেখতে মেয়েগুলোর জন্যে বড্ড দুঃখু হল বিকাশকান্তির। আহা খেতে পায় না। টাকার অভাবের জন্যে নয়। এই নাচ নাচবার জন্যে, স্রেফ মিনার্যাল ওয়াটার আর আপেল খেয়ে থাকে বোধ হয়। ছোকরাগুলোর কিন্তু মজা খুব, যত তাগড়া হবে ততই ভাল, সুতরাং খেয়ে যাও আর মুগুর ভেঁজে যাও, খেয়ে যাও আর মুগুর ভেঁজে যাও। তাঁর বাবার মতো। মেয়েদের এক্সপ্লয়েট করবার কত পদ্ধতিই না বার করেছে পৃথিবী। তিনি এক্সপ্লয়টেড হতে যাচ্ছেন না তো কোনওভাবে। আচ্ছা, মেয়েটি তাঁকে একটা কার্ড দিয়েছিল না? খুঁজে পেতে ব্রীফ কেস থেকে কার্ডটা বার করেন বিকাশকান্তি।
সুমিতা সরকার—এম এসসি, এম.ফিল, পিএইচ ডি
রীডার ইন সাইকলজি
অমুক কলেজ,
সাইকো-অ্যানালিস্ট
ফোন— চেম্বার .. এত
রেসিডেন্ট— এত।
আচ্ছা, এটা তো অনায়াসেই ভেরিফাই করে নেওয়া যায়। আচ্ছা, এই কলেজের প্রিন্সিপ্যালই তো অশোক লাহিড়ী। তাঁর বন্ধু দীপক ভাদুড়ির ভায়রা। অবিলম্বে দীপককে ফোন করেন বিকাশকান্তি।
‘আরে দীপক, আছিস কেমন? করছিস কী?’
‘কী আর করব, খাতার পাহাড় সবে হালকা হতে শুরু করেছে, একটু টিভি দেখছি।’
‘পারছিস দেখতে?’
‘আরে বুঝলে না, মাথা ভোঁতা হয়ে গেছে এখন, একটা ঠ্যালাওয়ালাও যা এক জন দীপক ভাদুড়িও এখন তাই।’
‘আচ্ছা দীপক তোমার ভায়রা যেন কোন কলেজের প্রিন্সিপ্যাল?’ নাম বলেন দীপক।
‘ভদ্রলোককে আমার একটু দরকার ছিল।’
‘হঠাৎ?’
‘একটা ইনফর্মেশন নিতাম।’
‘কলেজ-সংক্রান্ত কিছু?’
‘ধরো তাই।’
‘ধরতে হবে কেন? অ্যাডমিশন? পোস্ট খালি? রেজাল্ট?’
নাঃ দীপকটা ছাড়বে না।
‘পোস্টের কথাই জিজ্ঞেস করছিলাম। ওদের কলেজে সাইকলজি আছে?’
‘হ্যাঁ অ্যাঁ।’
‘পোস্ট খালি আছে কোনও?’
‘আমি তো যদ্দুর জানি, না। নরনারায়ণ পাণ্ডে, সীতা মহলানবিশ, সুমিত্রা সরকার, স্পর্শমণি ধিংড়া।’
বাস আর শোনার দরকার নেই বিকাশকান্তির। কাজ হয়ে গেছে। বলেন—‘নেই তা হলে? আমার এক আত্মীয়র মেয়ে চাকরি চায়।’
‘চাকরি চায় তো কলেজ সার্ভিস কমিশনের বিজ্ঞাপনের জবাব দিতে বলো। এমনি এমনি কি আর এ সব চাকরি হয় আজকাল? নেট, স্লেট-এ বসতে বলো—এমপ্যানেলড হোক, আর যদি ওদের ফিফ্থ পোস্ট হয়ে থাকে তো বলে দেখতে পারি। কী নাম মেয়েটির?’
ফোনটা কেটে দিলেন বিকাশকান্তি। আর-একটু হলেই সুমিতা সরকার বলে ফেলেছিলেন।
তা তো হল। কিন্তু এই সুমিতাই এই সুমিতা কি না, কী করে জানা যাবে? এ প্রশ্নটা বিকাশকান্তির মনে এল আরও একটু পরে। চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে আপ্তবাক্যটি যে কতটা সত্যি তাই ভেবে বিকাশ হাত পা কামড়ান। আচ্ছা, কার্ডে দেওয়া ফোন নম্বরগুলো ট্রাই করলে কেমন হয়!
প্রথমে চেম্বারেরটা করলেন তিনি। বেজেই যায়, বেজেই যায়। তারপর এক জন খুব ক্যাঁটকেঁটে গলার মহিলা বললেন—‘কাকে চাই? সুমিতা সরকার? সে তো শুধু মঙ্গলবার বসে।’ সে কী? কালই তো মঙ্গলবার! যদি চেম্বারেই বসবে তো সুমিতা আসে কী করে? এইবার ধরেছি—এই মেজাজ নিয়ে তিনি বললেন—‘আচ্ছা ম্যাডাম, ইনি কোন সুমিতা সরকার বলুন তো? কালো করে মোটা করে…’
‘ম্যাডান ট্যাডান নয় বাছা, আমি কালীপদর মা। ও মেয়ে খুব ধিঙ্গি, তবে কালো মোটা বললে মিথ্যে বলা হবে। মেমের পারা গোরা। বে হয়ে গেছে কিন্তু।’
মহিলা ফোন রেখে দ্যান।
আশ্চর্য! তাঁর গলা কি পাত্রর বাবার মতো শোনাচ্ছে না কি? বিকাশবাবু যারপরনাই বিরক্ত হন। তবে তিনি নিশ্চিন্ত হয়ে যান মোটামুটি। ব্যাপারটা তাঁর মনকে কতখানি অধিকার করে রেখেছে সেটা বোঝা যায় যখন খাবার টেবিলে বসে দু’ হাতে রুটি ছিঁড়তে ছিঁড়তে তিনি বলেন—‘মেয়েটা জেনুইনই।’
‘কে জেনুইন?’ মালবিকা অবাক হয়ে বলেন।
‘ও সে একটা কেস!’ অন্যমনস্ক হয়ে বিকাশকান্তি জবাব দ্যান।
‘কবে থেকে আবার তুমি ডাক্তার উকিল হলে?’
‘আজ থেকে?’ বলে বিকাশকান্তি বলে উঠলেন, ‘উকিল কেন? ডাক্তার হলেও হতে পারে!’
‘তুমিই তো একটি কেস দেখছি’ মালবিকা রুটি-মাংস নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
এখন, এঁরা দু’জনেই বিখ্যাত খাইয়ে ফ্যামিলির সন্তান। খাওয়াটা এঁদের কাছে একটা পবিত্র রিচুয়্যালের মতো। খাবার সময়ে এঁরা দু’জনেই তদ্গত হয়ে যান। কাজেই আধঘণ্টার মতো সময় বিকাশকান্তি তাঁর দুশ্চিন্তার ব্যাপারটা একেবারে ভুলে যান। এর পরে অফিস থেকে আনা ফাইলে মনোনিবেশ। এ সময়ে কোনও দুশ্চিন্তার প্রবেশ নিষেধ।
লাইট অফ্ফ। যাঃ। কী অদ্ভুত সভ্য-ভব্য লাজুক লাইট রে বাবা! মালবিকা-বিকাশের বেডরুম-সিনের বেলায়, সময় বুঝে অফ্ফ হয়ে গেল?