Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

আজ হ্যালোইন

হ্যালোইন এদের একটি চমৎকার উৎসব। উৎসবের উৎপত্তি কোথায় জানি না।

কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করেছি কিছু বলতে পারেনি। আমেরিকানদের সাধারণ জ্ঞান সীমাবদ্ধ। খুবই সীমাবদ্ধ। হ্যালোইন ব্যাপারটি কি জিজ্ঞেস করা মাত্র অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে বলে–ও হ্যালোইন হচ্ছে ফান নাইট। খুব ফান হয়। বাচ্চারা নানা রকম ভূতের মুখোশ পরে বের হয়। বাড়ি বাড়ি গিয়ে বলে–Treat or tricks’ তখন ওদের চকলেট-লজেন্স এইসব দিতে হয়। বাড়ি সাজাতে হয়–কুমড়ো দিয়ে।

এর সবই জানি, আমার প্রশ্ন ছিল এই উৎসবটা শুরু হলো কিভাবে? হঠাৎ আমেরিকানদের কেন মনে হলো ভূতপ্রেতের জন্যে একটা রাত থাকবে? কেউ ডানে না।

বইপত্র ঘেঁটে দেখলাম অক্টোবরের ৩১ তারিখে সন্ধ্যায় এই দিবস উদযাপন করা হয়। এটি একটি ধর্মীয় উৎসব, All saint’s day (Allhallows}-র পূর্ব দিবস। সব সিরিয়াস বিষয় নিয়ে রসিকতা করা আমেরিকানদের মজ্জাগত। এই দিনটিকে ওরা রসিকতার দিন করে নিয়েছে। সেই রঙ্গ-রসিকতা কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে তার উদাহরণ দেয়া যাক–হ্যালোইনের ফান পরিপূর্ণ করার জন্যে নিউইয়র্কে প্রতি বছর কিছু দরিদ্র মানুষকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়। কিছু বাড়িঘরে আগুন দেয়া হয়। এই হলো ফানের নমুনা।

আমাদের বাড়িতে বাচ্চাকাচ্চারা ভূত সেজে আসবে তা মনে হয়নি তবু কিছু চকলেট কিনে রেখে দিলাম। যদি আসে?

না আসারই কথা। বাড়ির উঠোনে কোনো কুমড়ো সাজানো নেই। এর মানে এই বাড়িতে এমন কেউ থাকে যে হ্যালোইন সম্পর্কে জানে না।

তবু দেখি দুটি ছোট ছোট বাচ্চা এসে উপস্থিত। একজন সেজেছে কচ্ছপ অন্য একজন ডাইনী বুড়ি। প্রত্যেকের হাতে চকলেট সংগ্রহের জন্যে তিনটি ব্যাগ। ব্যাগের রং লাল, সাদী এবং সবুজ। ওর গম্ভীর মুখে বলল–Treat or tricks আমি চকলেট দিলাম। ওরা দু’জন মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে। ছোট জন বলল, কোন রঙের ব্যাগে নিব, সাদাটায়? বড় জন বলল, না লালটায়। জিজ্ঞেস করে জানলাম–সবুজ রঙের ব্যাগে ওরা নেয় পরিচিত মানুষদের দেয়া চকলেট। যাদের খুব ভালো করে চেনে। যাদের অল্প চেনে তাদের চকলেট সাদা রঙের ব্যাগে। যারা একেবারেই অপরিচিত তাদেরগুলি থাকবে লাল রঙের ব্যাগে। এই ব্যাগের চকলেট খাওয়া যাবে না। বাবা-মা’রা প্রথম পরীক্ষা করে দেখবেন। পরীক্ষার পর যদি বলেন–খাও। তাহলেই খাওয়া। অধিকাংশ সময়ই খেতে দেন না। ডাস্টবিনে উপুড় করে ফেলে দেন।

এই সাবধানতার কারণ আমেরিকা হলো বিচিত্র এবং ভয়ংকর মানসিকতার লোকজনদের বাস। সাধারণ মানুষদের মধ্যে লুকিয়ে আছে পিশাচ শ্রেণীর কিছু মানুষ। পাঠক-পাঠিকারা নিশ্চয়ই বিরক্ত হয়ে ভাবছেন পিশাচ শ্রেণীর লোকজন শুধু আমেরিকায় থাকবে কেন? সব দেশেই আছে। ভয়াবহ ক্রাইম তো বাংলাদেশেও হয়। ঐ তো বিরজাবালা’ পরিবারকে হত্যা করা হলো। যে মানুষটি করল সে কি পিশাচ নয়?

অবশ্যই পিশাচ।

তবে এখানে যেসব কাণ্ডকারখানা হয় তা সব রকম ব্যাখ্যার অতীত। পিশাচরাও এসে লজ্জা পেয়ে যায়।

সম্প্রতি নিউইয়র্কে ঘটে গেছে এমন একটি ঘটনা বলি। ৯১১ নাম্বারে একটি টেলিফোন এলো। এটি পুলিশের নাম্বার। এই নাম্বারে টেলিফোন পেলেই পুলিশ সচকিত হয়ে ওঠে। এক ভদ্রলোক কাঁদতে কাঁদতে টেলিফোন করেছেন। তার শিশু বাচ্চাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। দোলনায় ঘুমুচ্ছিল। হঠাৎ দেখা গেল সে নেই।

পুলিশ বলল, তোমার স্ত্রী কোথায়?

এইখানেই আছে।

তোমরা কি সারাক্ষণ ঘরেই ছিলে?

হ্যাঁ ঘরেই ছিলাম। আমি টিভিতে বেইসবল দেখছিলাম। আমার স্ত্রী রান্নাঘরে রান্না করছিল। এক সময় শোবার ঘরে গিয়ে দেখে বাচ্চা নেই।

ঘরে আর কেউ ছিল না?

না। তবে…

তবে কি?

আমাদের একটা বিশাল জার্মান শেফার্ড কুকুর আছে। আমার ধারণা…

থামলে কেন বলো…

আমার ধারণা কুকুরটা বাচ্চাটাকে খেয়ে ফেলেছে।

কি বলছ তুমি?

পুলিশ তৎক্ষণাৎ ছুটে এলো। এক্সরে করে দেখা গেল সত্যিই কুকুরটির পেটে বাচ্চাটির হাড়গোড় দেখা যাচ্ছে। কুকুরকে মেরে তার পেট কেটে হাড়গোড় বের করা হলো। সেই সব পাঠানো হলো পোস্ট মর্টেমের জন্যে।

পোস্ট মর্টেমের রিপোর্টে বলা হলো–হ্যাঁ কুকুর বাচ্চাটিকে খেয়ে ফেলেছে। তবে কামড়ে কামড়ে খায়নি। বাচ্চাটিকে ধারালো ছুরি দিয়ে কুচি কুচি করে কেটে কুকুরটিকে খাওয়ানো হয়েছে।

বাচ্চাটির বাবা তখন অপরাধ স্বীকার করল।

সে বলল–বাচ্চাটি কেঁদে কেঁদে খুব বিরক্ত করছিল। কাজেই সে রাগ করে আছাড় দিয়েছে। এতে বাচ্চাটি মরে গেছে। তখন পুলিশের হাত থেকে বাঁচার জন্যে সে তার স্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করে তাকে কুচি কুচি করে কেটে কুকুর দিয়ে খাইয়ে ফেলেছে।

বাংলাদেশের পাঠক, পাঠিকা, এমন মানুষ কি আছে আমাদের দেশে?

আরো একটি ঘটনা বলি, এটিও নিউইয়র্কের! একত্রিশ বছর বয়েসি একটি মেয়ে। বাবার সঙ্গে থাকে। কি কারণে বাবার সঙ্গে তার ঝগড়া হলো। বাবা তাকে খুন করে ফেলল। এখানেই ঘটনার শেষ না–ঘটনার শুরু। খুন করার পর সে তার মেয়েকে কেটেকুটে রান্না করে ফেলল। পুলিশ যখন তাকে এসে ধরল তখন সে রান্না করা মেয়েকে খেয়ে প্রায় শেষ করে এনেছে।

এইসব ভয়ংকর অপরাধীদের বিচার কী এদেশে হয় না? অবশ্যই হয়। তবে মৃত্যুদণ্ড প্রায় কখনোই হয় না। সভ্যদেশে মৃত্যুদণ্ড অমানবিক। আমেরিকার অল্প কিছু স্টেট ছাড়া সব স্টেটেই মৃত্যুদণ্ড নেই। সাধারণত জেল হয়। বেশিদিন জেল খাটতেও হয় না। পাঁচ বছর জেল খাটার পর প্যারোলে মুক্তি।

খুনিরা প্যারোলে মুক্তি পেয়ে জেলের বাইরে এসেই আবার খুন করে। ভয়ংকর সব খুনিরা এই দেশে প্রায় ন্যাশনাল হিরো’। একজন খুনি তের কি চৌদ্দটা মেয়েকে খুন করে নিজের বাড়ির বেইসমেন্টে পুঁতে রেখেছিল। তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া মাত্ৰ হৈচৈ শুরু হয়ে গেল। নাগরিকরা প্ল্যাকার্ড নিয়ে মিছিল বের করল। বর্বর মৃত্যুদণ্ড দেয়া চলবে না। মৃত্যুদণ্ডাদেশ বাতিল কর-ইত্যাদি। একটি সুন্দরী মেয়ে এই খুনির প্রেমে পড়ে গেল। তাদের বিয়েও হয়ে গেল। ন্যাশনাল টিভি খুনির নানান ধরনের ইন্টারভ্যু প্রচার করল। কি বলব এদের?

এরাই যখন আমাদের দেশ নিয়ে নাক সিটকে কথা বলে তখন রাগে গা জ্বলে যায়। জনি কার্সন বলে এক লোক আছে। গভীর রাতে সে টিভিতে টক শো’ দেয়। অর্থাৎ মজার মজার কথা বলে লোক হাসায়। খুবই জনপ্রিয় অনুষ্ঠান। এই ব্যাটা বদমাশ প্রায়ই বাংলাদেশ নিয়ে রসিকতা করে। এনবিসি টিভিতে একটা রসিকতা করল। আবর্জনা ফেলা নিয়ে রসিকতা। আবর্জনা বোঝাই একটা জাহাজ তখন দুমাস ধরে সমুদ্রে ঘুরছে। কোনো দেশ সেই জাহাজ বোঝাই আবর্জনা রাখতে রাজি নয়। জনি কার্সন বলল, এটা নিয়ে সবাই চিন্তিত কেন? আবর্জনা বাংলাদেশে ফেলে দিয়ে এলেই হয়। এরা খুব আগ্রহ করেই আবর্জনা রাখবে।

রসিকতা শুনে টক শোতে উপস্থিত আমেরিকানরা হাসতে হাসতে ভেঙে পড়ল। বড় মজার রসিকতা।

জনি কার্সন সাহেব, আপনি খুবই রসিক মানুষ কিন্তু দয়া করে জেনে রাখুন আমরা আমাদের বাচ্চাদের কেটে কুচি কুচি করে কুকুরকে খাইয়ে ফেলি না। আমাদের দেশে কোনো এইডস নেই। সমকামিতা ব্যাপারটি ভয়াবহ ব্যাধি হিসেবে আমাদের দেশে উপস্থিত হয়নি। আমরা অতি দরিদ্র এই কথা সত্যি। দু’বেলা খেতে পারি না এও সত্য। অভাবের কারণে জাল-জুয়াচুরি কেউ কেউ করে, এও সত্য–তবে সঙ্গে সঙ্গে এটাও সত্যি আমরা আমাদের আত্মাকে হারাই নি। আমরা দুঃখে-কষ্টে জীবনযাপন করি এবং এর মধ্যেই আত্মাকে অনুসন্ধান করি। খাঁচার ভেতর যে অচিন পাখি আসা-যাওয়া করে সেই পাখিটাকে বোঝার চেষ্টা করি। বিশ্বাস করুন কার্সন সাহেব আমরা করি।

আমাদের গাড়ির ড্রাইভার এলেকসি–১৯/২০ বছরের যুবক। আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। এই বয়সে আমেরিকান যুবকরা দৈত্যের মতো বিশাল হয়। এলেকসি সে রকম নয়–শিশু শিশু চেহারা, রোগা-পাতলা। লক্ষ্য করলাম তার বা কানে দুল। বাঁ কান ফুটা করে দুল পরার ব্যাপারটি এই বয়েসি আরো অনেক যুবকদের মধ্যে লক্ষ্য করেছি। নতুন কোনো ফ্যাশন কি? ফ্যাশানের ব্যাপারটি সাধারণত মেয়েদের মধ্যেই লক্ষ্য করা যায়–এবার দেখি ছেলেদেরও ধরেছে। সব ফ্যাশানের ‘শানে নজুল আছে। বাঁ কানে দুল পরার ফ্যাশানের শানে নজুল কি? কয়েকজন আমেরিকানকে জিজ্ঞেস করলাম, কিছু বলতে পারল না। বলতে

পারারই কথা। আমেরিকানদের জিজ্ঞেস করা আর গাছকে জিজ্ঞেস করা একই ব্যাপার! এরা কিছুই জানে না। জানার ব্যাপারে তেমন আগ্রহও নেই।

একজন বলল, কানে দুল পরা এসেছে মিডিল ইস্ট থেকে। মিডিল ইস্ট-এর যাযাবররা কানে দুল পরে।

অন্য একজন বলল, খুব সম্ভব এটা এসেছে রক স্টারদের কাছ থেকে। কোনো একজন রকস্টার হয়তো কানে দুল পরে শো করেছিল এই থেকে চালু হয়ে গেছে। তুমি তো জানোই রকস্টার হচ্ছে আমেরিকান যুবকদের সবচে বড় আইডল।

তৃতীয় একজন গলার স্বর নিচে নামিয়ে বলল, ওরা হামোসেকচুয়েল। বা কানে দুল হচ্ছে ওদের চিহ্ন। এই দেখে একজন অন্যজনকে চেনে।

এদের কারো কথাই বিশ্বাস হলো না। সরাসরি এলেকসিকে জিজ্ঞেস করলাম। সে হাসি মুখে বলল, তোমার কি কানে দুল পরা পছন্দ নয়? আমাকে কি ভালো দেখাচ্ছে না?

খুবই ভালো দেখাচ্ছে। দুটি কানে পরলে আরো ভালো লাগত। একটি কানে পরায় সিমেট্রি নষ্ট হয়েছে।

দুকানে পরা নিয়ম নয়।

নিয়মটা এসেছে কোত্থেকে?

জানি না।

কথা এর বেশি এগুল না। কে জানে সমকামিতার সঙ্গে বাঁ কানে দুল পরার কোনো সম্পর্ক আছে কি-না। থাকতেও পারে।

আমেরিকান সমাজের যে ক’টি ভয়াবহ সমস্যা আছে। সমকামিতা তার একটি। এইডস নামক ভয়াবহ ব্যাধি যার ফসল।

পনেরো বছর আগে লাস ভেগাসে লেবারেচি নামের একজন প্রবাদ পুরুষের একটি শো দেখেছিলাম। ভদ্রলোক হাতের দশ আঙুলে দশটি হীরার আংটি পরে স্টেজে এলেন। কোন আংটি কে তাকে উপহার দিয়েছেন তা বললেন। একটি ইরানের শাহ, একটি ইংল্যান্ডের রানী] তারপর নানান রসিতার ফাঁকে ফাঁকে পিয়ানো বাজিয়ে শুনালেন। দু’ঘটার অনুষ্ঠান–দু’ঘণ্টা দর্শকদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখলেন। অনুষ্ঠান শেষে তাঁকে স্ট্যান্ডিং ওভেশন দেয়া হলো। সমস্ত দর্শক দাঁড়িয়ে সম্মান জানালেন। আমিও তাদের একজন।

এবার এসে শুনি প্রবাদ পুরুষ লেবারেচি এইডসে মারা গেছেন। ভদ্রলোক ছিলেন সমকামী।

আমি থাকতে থাকতেই বিশ্ব এইডস দিবস উদযাপিত হলো। মিউজিয়ামের পেইন্টিং কাগজ দিয়ে ঢেকে দেয়া হলো। ভাস্কর্য মুড়ে দেয়া হলো কাপড়ে। কারণ এইডস নামক ভয়াবহ ব্যধির প্রধান শিকার শিল্পী, গায়ক, কবি-সাহিত্যিকরা। সমকামিতার ব্যাপারটি নাকি তাদের মধ্যেই বেশি। ক্রিয়েটিভিটির সঙ্গে যৌন বিকারের কোনো যোগ কি সত্যি আছে?

এই বিষয় নিয়ে লিখতে ভালো লাগছে না। লেখার মতো চমৎকার কোনো বিষয়ও পাচ্ছি না। এখানকার প্রোগ্রামের একটি দিক হচ্ছে–আইওয়াতে যেসব লেখা হয়েছে তার অংশ বিশেষ পাঠ। কিছুই লিখতে না পারার কারণে পাঠ করার মতো কোনো অংশই আমার কাছে নেই। আমি সম্ভবত একমাত্র লেখক যে এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে পারবে না।

বিকেলে জামা-কাপড় পরে বের হলাম। পরিকল্পনা করে নিলাম উদ্দেশ্যহীন হাঁটা হাঁটব। পুরোপুরি ক্লান্ত না হওয়া পর্যন্ত আমব না। সঙ্গে ম্যাপ থাকবে যাতে হারিয়ে না যাই। ক্যামেরা সঙ্গে নিতে গিয়েও নিলাম না। ক্যামেরা থাকে টুরিস্টদের হাতে। সুন্দর কোনো দৃশ্য দেখলেই চোখের সামনে ক্যামেরা তুলে ধরে। ছবি ভোলা মাত্রই তার কাছে দৃশ্যটির আবেদন শেষ হয়ে যায়। যার হাতে ক্যামেরা থাকে না সে জানে–এই অপূর্ব দৃশ্য সে ধরে রাখতে পারবে না। সে প্রাণভরে দেখার চেষ্টা করে। আমিও তাই করব। প্রাণ ভরে দেখব।

ঘন্টা খানিক ঘটার পর মনে হলো শহরের বাইরে চলে এসেছি। একটি বাড়ি থেকে অন্য একটি বাড়ির দূরত্ব খানিকটা বেড়েছে। গাছপালাও মনে হলো বেশি। আবহাওয়াও চমৎকার। শীত সহনীয়। আকাশ পরিষ্কার। সূর্য ডোবার আগের মায়াবী আলো পড়েছে মেপল গাছের পাতায়। আরো খানিকটা এগিয়েই অবাক বিস্ময়ে থমকে দাঁড়ালাম। সামনে সেইন্ট জোসেফ সিমেটিয়ারি। খ্রিস্টান কবরস্থান। বিস্তীর্ণ জায়গা জুড়ে নির্জন কবরখানা। ছোট ছোট নামফলক। বিস্ময়ে অভিভূত হবার কারণ হলো–প্রতিটি নামফলকের সঙ্গে একগুচ্ছ টাটকা ফুল।

ফুলে ফুলে পুরো জায়গাটা ঢেকে দেয়া হয়েছে। কত রকমারি ফুল, গোলাপ, টিউলিপ, কসমস, চন্দ্রমল্লিকা, মেরি গোল্ড। দিনের শেষের আলো ফুলগুলিকে শেষবারের মতো ছুয়ে যাচ্ছে। এমন সুন্দর দৃশ্য অনেক দিন দেখি নি। হৃদয় আনন্দে পূর্ণ হলো। আজ আর অন্য কিছু দেখার প্রয়োজন নেই। কিছু সময় কাটিয়ে ফিরে যাওয়া যেতে পারে। ফিরে যেতেও ইচ্ছা করছে না।

ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা মিলিয়ে গেল।

বাড়ির সামনে কালো কোট গায়ে কে যেন দাঁড়িয়ে। অন্ধকারে মুখ দেখা যাচ্ছে না, তবু কেন জানি চেনা চেনা লাগছে। আমি আরো কিছুটা এগিয়ে থমকে দাঁড়ালাম। ছায়ামূর্তি কোমল গলায় বলল, কেমন আছ?

এ কি কাণ্ড–গুলতেকিন দাঁড়িয়ে আছে।

এটা কি স্বপ্ন চোখের ভুল? কোনো বড় ধরনের ভ্রান্তি।

কি কথা বলছ না কেন? কেমন আছ?

তুমি এইখানে কি ভাবে?

আগে বলো তুমি কি আমাকে দেখে খুশি হয়েছ?

ব্যাপারটা সত্যি না স্বপ্ন এখনো বুঝতে পারছি না।

অনেকক্ষণ বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। শীতে জমে যাচ্ছি। দরজা খোলো। কোথায় গিয়েছিলে?

আমি জীবনে অনেকবার বড় ধরনের বিস্ময়কর ঘটনার মুখোমুখি হয়েছি কিন্তু এ ধরনের বিস্ময়ের মুকাবিলা করি নি। আমি তৃতীয়বারের মতো বললাম, এখানে কি করে এলে?

জানা গেল সে আমাকে অবাক করে দেবার জন্যে এই কাণ্ড করেছে এবং তার জন্যে তাকে খুব বেগ পেতে হয় নি। আমেরিকায় আসবার জন্যে ভিসা চাইতেই ভিসা পেয়েছে। তার নিজস্ব কিছু ফিক্সড ডিপোজিট ছিল, সব ভাংগিয়ে টিকিট কেটে চলে এসেছে। কে বলে মেয়েরা অবলা’?

বিস্ময়ের ঘোর কাটাতে অনেক সময় লাগল। গুলতেকিনকে অপরিচিত তরুণীর মতো লাগছে। তার হাত ধরতেও সংকোচ লাগছে। মনে হচ্ছে হাত ধরলেই সে কঠিন গলায় বলবে, একি আপনি আমার হাত ধরছেন কেন?

বাচ্চারা কেমন আছে গুলতেকিন?

ভালোই আছে। তুমি কেমন আছ?

ভালো।

তুমি চিঠিতে লিখেছিলে বিশাল দোতলা বাড়িতে থাকি। এই বুঝি তোমার বিশাল দোতলা বাড়ি?

তোমার কাছে বিশাল মনে হচ্ছে না?

হ্যাঁ বিশাল। তবে তোমার চিঠি পড়ে আমি অন্য রকম কল্পনা করে রেখেছিলাম। তুমি লিখেছিলে তোমার সঙ্গে ফিলিপাইনের এক ঔপন্যাসিক থাকেন। উনি কোথায়?

উনি দু’দিনের জন্যে আমানা কলোনিতে গেছেন। চলে আসবেন। তুমি হাত-মুখ ধুয়ে বিশ্রাম করো। আমি রান্না করছি।

তুমি রান্না করবে?

হ্যাঁ তুমি এখন আমার অতিথি।

ভাত, গোশত এবং ডাল রান্না করলাম। ভাত গলে গিয়ে জাউয়ের মতো হয়ে গেল। গোশত পুরোপুরি সিদ্ধ হলো না। ডালে লবণ বেশি হয়ে গেল। তাতে কি? সময় এবং পরিস্থিতিতে অখ্যাদ্য খাবারও অমৃতের মতো লাগে। আমি হাই ভি স্টোর থেকে এক প্যাকেট আইসক্রিম এবং দুটো মোমবাতি কিনে নিয়ে এলাম। হোক একটা ক্যান্ডল লাইট ডিনার।

খেতে কেমন হয়েছে গুলতেকিন?

চমৎকার।

আমি খানিকক্ষণ ইতস্তত করে বললাম, আচ্ছা গুলতেকিন আমাকে কি তোমার এই মুহূর্তে অপরিচিত কোনো যুবকের মতো লাগছে?

গুলতেকিন বলল, অপরিচিত যুবকের মতো লাগবে কেন? তুমি মাঝে মাঝে কি সব অদ্ভুত কথা যে বলো!

গুলতেকিনকে ঘুরে ঘুরে দেখাব এমন কিছু আইওয়াতে নেই। বড় বড় শপিং মল অবশ্যি আছে, সে সব তো আমেরিকার সব স্টেটেই আছে। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় কয়েকটি চমৎকার মিউজিয়াম আছে। সেখানে যেতে ইচ্ছা করছে না। দেশের বাইরে গেলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলি থেকে দূরে থাকতে চেষ্টা করি।

কিছু দেখার নেই বলে ঘরে চুপচাপ বসে থাকার অর্থ হয় না। পরদিন তাকে নিয়ে বের হলাম। সে বলল, আমরা কি দেখতে যাচ্ছি?

সেইন্ট জোসেফ সিমেটিয়ারি।

কবরখানা?

হ্যাঁ কবরখানা।

তের হাজার মাইল দূর থেকে কবরখানা দেখতে এসেছি?

চলো না। তোমার ভালো লাগবে।

তোমার রুচির কোনো আগামাথা আমি এখনো বুঝতে পারলাম না। আশ্চর্য।

চলো আগে যাই তারপর যা বলবে শুনব। আমার ধারণা তোমার ভালো লাগবেই।

তার ভালো লাগল। সে মুগ্ধ বিস্ময়ে বলল, দেখো দেখো প্রতিটি কবরের সামনে, ফুলের গুচ্ছ। এরা কি রোজ এসে ফুল দিয়ে যায়?

যায় নিশ্চয়ই। নয়তো ফুল আসবে কোত্থেকে? কিংবা হয়তো কোনো ফুলের দোকানকে বলে দিয়েছে তারা প্রতিদিন ফুল দিয়ে যাচ্ছে।

নিশ্চয়ই খুব খরচান্ত ব্যাপার। রোষ্ট্র একগুচ্ছ ফুল।

গুলতেকিনের এই কথায় খটকা লাগল। তাই তো এমন খরচান্ত ব্যাপারে এরা যাবে? মৃতদের প্রতি তাদের কি এতই মমতা? বাবা-মা বুড়ো হলে যারা তাদের ফেলে দিয়ে আসে ওল্ড হোমে…। আমি এগিয়ে গেলাম এবং গভীর দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করলাম সবই প্লাস্টিকের ফুল। খুবই সুন্দর আসল-নকলে কোনো ভেদ নেই কিন্তু প্লাস্টিকের তৈরি। একবার এসে রেখে গেছে বছরের পর বছর অবিকৃত আছে। মন খুব খারাপ হয়ে গেল। এই চমৎকার ফুলে ফুলে সাজানো কবরখানা আসলে মেকি ভালোবাসায় ভরা। এরা যখন কোনো মেয়ের সঙ্গে ডেট করতে যায় তখন হাতে এক গুচ্ছ ফুল নিয়ে যায়। সেই ফুল আসল ফুল। প্লাস্টিকের ফুল নয় কিন্তু মৃতদেহের বেলায় কেন প্লাস্টিকের ফুল? আমার মনটাই খারাপ হয়ে গেল।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress