পৃথিবীর নানান জায়গা থেকে পঁয়তাল্লিশ জন লেখক
পৃথিবীর নানান জায়গা থেকে পঁয়তাল্লিশ জন লেখক একত্র হয়েছেন। সবাই পরিণত বয়স্ক। অনেকেরই চুল-দাড়ি ধবধবে সাদা। নিজেকে এদের মধ্যে খুবই অল্প বয়স্ক লাগছিল। যদিও ভালো করেই জানি মেঘে মেঘে অনেক বেলা হয়েছে। উনিশ বছরের যুক্তিহীন আবেগময় যৌবন পেছনে ফেলে এসেছি অনেক অনেক আগে।
লেখকদের কাউকেই চিনি না। কারো কোনো বইও আগে পড়ি নি। তবে ভাবভঙ্গিতে বুঝলাম যারা এসেছেন সবাই তাদের দেশের অতি সম্মানিত লেখক। সবার লেখাই একাধিক বিদেশী ভাষায় অনুবাদ হয়েছে। প্রোগ্রামটির পরিচালক প্রফেসর ক্লার্ক ব্লেইস নিজেও আমেরিকার নাম করা ঔপন্যাসিকদের একজন। তার একটি উপন্যাসের ওপর ভিত্তি করে আমেরিকার একটি বড় ফ্লিম কোম্পানি এই মুহূর্তে ছবি তৈরি করছে।
প্রফেসর ক্লার্ক বুড়ো মানুষ। ধবধবে শাদা দাড়ি–ঋষি ঋষি চেহারা। এক পর্যায়ে তিনি আমার কাছে এগিয়ে এসে আমাকে চমকে দিয়ে পরিষ্কার বাংলায় বললেন, কেমন আছ হুমায়ূন?
উত্তর দেব কি, হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছি। প্রফেসর ক্লার্ক আমার বিস্ময় খুব উপভোগ করলেন বলে মনে হলো। আমি কিছু বলার আগেই আমাকে আরো চমকে দিয়ে বললেন, আমি সম্পর্কে তোমাদের জামাই হই।
এর মানে কি? কি বলছেন উনি? আমাকে বেশিক্ষণ হতচকিত অবস্থায় থাকতে হলো না। প্রফেসর ক্লার্ক তার বক্তব্য ব্যাখ্যা করলেন। ইংরেজিতে বললেন, আমি একটি বাঙালি মেয়ে বিয়ে করেছি, কাজেই আমি তোমাদের জামাই। আমার স্ত্রীর নাম ভারতী মুখোপাধ্যায়। কোলকাতার মেয়ে।
বলো কি?
খুব অবাক হয়েছ?
তা হয়েছি।
বাংলাদেশের কোন জায়গায় তোমার জন্ম?
ময়মনসিংহ।
ভারতীর দেশও ময়মনসিংহ–মজার ব্যাপার না?
হ্যাঁ খুবই মজার ব্যাপার।
তোমার সঙ্গে আমার আরো কিছু মিল আছে। কাগজপত্র ঘেঁটে দেখলাম তুমি Ph.D করেছ নর্থ ডেকোটা থেকে। আমার জন্যও নর্থ ডেকোটায়। এসো আমরা কফি খেতে খেতে গল্প করি।
কফির মগ হাতে তিনি দল ছেড়ে বাইরে গেলেন, আমি গেলাম তার পেছনে পেছনে। তিনি গলার স্বর নামিয়ে বললেন, ওয়াশিংটন থেকে টেলেক্স করে তোমার পারিবারিক দুর্ঘটনার খবর আমাকে জানিয়েছে। আমি খুবই দুঃখিত। তবু তুমি যে এসেছ এতেও আনন্দ পাচ্ছি। বাংলাদেশ থেকে এই প্রথম ইন্টারন্যাশনাল রাইটিং প্রোগ্রামে কাউকে পেলাম।
আগে আর কেউ আসেন নি?
না। তবে তোমাদের কবি জসীমুদ্দিনের মেয়ে হাসনা ছিল। সে অবশ্য রাইটিং প্রোগ্রামে ছিল না। সে ছিল আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। তুমি কি তাকে চেনো?
না আমি চিনি না। আমার চেনাজানার গণ্ডি খুবই সীমিত।
ভারতীর সঙ্গে আমি তোমার পরিচয় করিয়ে দেব। ও এখন আছে ক্যালিফোর্নিয়ায়। সেও অধ্যাপনা করে। ভারতী এলে তোমাকে দেখিয়ে দেবে কোন গ্রোসারিতে হলুদ, মরিচ, ধনিয়া পাওয়া যায়। ও সব জানে।
ধন্যবাদ প্রফেসর ব্লেইস।
তুমি তো অনেক দিন পর এ দেশে এলে, কেমন লাগছে?
এখনো বুঝতে পারছি না।
খুব শীত পড়বে কিন্তু। গরম কাপড় কিনে নিও। কোনোরকম অসুবিধা হলে আমাকে জানিও। আমি জানি বাঙালিরা মুখচোরা ধরনের হয়। আমেরিকায় যতক্ষণ থাকবে ততক্ষণ আমেরিকানদের মতোই থাকবে।
আমরা লেখদের দলে ফিরে এলাম। লেখকদের মধ্যে একজন শাড়ি পরা মহিলা। সম্ভবত ভারতের কবি গগন গিল। এগিয়ে গেলাম–না গগন গিল নন ইনি শ্রীলংকার কবি জেন, উনি সঙ্গে তাঁর স্বামীকে নিয়ে এসেছেন। স্বামী বেচারাকে মনে হলো স্ত্রীর প্রতিভায় মুগ্ধ। হাঁ করে সারাক্ষণ স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। কবি জেন-এর কথা বলা রোগ আছে। মনে হয় অনেকক্ষণ কথা বলার কাউকে পাচ্ছিলেন না, আমাকে পেয়ে আনন্দে উচ্ছ্বসিত হলেন। কাঁধে ঝুলানো ব্যাগ খুলে এক তাড়া কাগজ বের করে বললেন আমি ‘গোয়া নিয়ে একটি কবিতা লিখেছি। এসো তোমাকে পড়ে শোনাই। শুনতে আপত্তি নেই তো?
প্রথম আলাপেই অভদ্র হওয়া যায় না, আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লাম। ভদ্রমহিলা সঙ্গে সঙ্গে আবৃত্তি শুরু করলেন ইংরেজি কবিতা। সেই কবিতাও মহাভারতের সাইজের, শেষ হতে চায় না। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে আমার পায়ে ঝি ঝি ধরে গেল। এ কি বিপদে পড়লাম। চোখে-মুখে আগ্রহের ভাব ধরে রাখতে হচ্ছে। যাতে আমাকে দেখে মনে হয় কবিতার প্রতিটি শব্দ আমাকে অভিভূত করছে। এ বড় কঠিন অভিনয়। এক সময় কাব্য পাঠ শেষ হলো। জেন উজ্জ্বল মুখে বললেন,
কেমন লাগল বলো তো?
অসাধারণ।
থ্যাংক ইউ। থ্যাংক ইউ। তোমার কি ধারণা কবিতাট: একটু অদ্ভুত?
কিছুটা অদ্ভুত তো বটেই।
সবাই তাই বলে। জানো, আমি সহজ করে লিখতে চাই কিন্তু মাঝামাঝি এসে সুররিয়েলিস্টিক হয়ে যায়। মনে হয় অন্য কেউ যেন আমার মাঝে কাজ করে। সে আমাকে দিয়ে কিছু লিখিয়ে নেয়।
ভদ্রমহিলার স্বামী বললেন, ওগো তুমি হুমায়ুনকে ঐ কবিতাটা শোনাও-ঐ যে কাফুর রাতে তুমি রাস্তায় হাঁটছিলে।
জেন সঙ্গে সঙ্গে দ্বিতীয় কবিতা বের করলেন। আয়তনে সেটি প্রথমটির দ্বিগুণ। দ্বিতীয় কবিতা শুনলাম তারপর তৃতীয় কবিতা শুনলাম এবং শুকনো মুখে বললাম আমি এখন একটু করিডোরে যাব। আমাকে সিগারেট খেতে হবে।
দ্রমহিলা এবং তার স্বামী কবিতার গোছা নিয়ে অন্য একজনের কাছে ছুটে গেলেন। আমি সিগারেট ধরিয়ে অলস ভঙ্গিতে করিডোর ধরে হাঁটছি। করিডোরের শেষ প্রান্তে বিরস মুখে দাঁড়িয়ে আছেন ইন্দোনেশীয় ঔপন্যাসিক তেহারি। আহমেদ তোহারি। ছোটখাটো মানুষ, দেখলেই স্কুলের নবম শ্রেণীর বালক বলে ভ্রম হয়। নতুন দাড়ি-গোফ গজানোর কারণে যে বালক বিব্রত এবং লোকচক্ষুর আড়ালে থাকার রোগ যাকে সম্প্রতি ধরেছে।
আহমেদ তোহারি তাঁর দেশে অতি জনপ্রিয়। তাঁর পাঁচটি উপন্যাস জাপানি ভাষায় অনূদিত ও সমাদৃত হয়েছে। সম্প্রতি তিনি তার দেশের সবচে বড় সাহিত্য পুরস্কারটি পেয়েছেন। বয়স ৪১, আমি নিজের পরিচয় দিতেই আনন্দিত হবার ভঙ্গি করলেন। তার ইংরেজি জ্ঞান, ইয়েস এবং নোর চেয়ে একটু বেশি তবে খুব বেশি না। নিজেকে প্রকাশ করতে তাঁর প্রচুর সময় লাগে। মনে হলো এই নিয়েও তিনি বিব্রত। নিজেকে অন্যদের থেকে দূরে সরিয়ে রাখার এটিও একটা কারণ হতে পারে।
আহমেদ তোহারি বললেন, তুমি কি আমাকে একটু সাহায্য করতে পারো?
আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, কি সাহায্য?
তুমি কি একটা ভালো কম্পাস কিনে দেবার ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করবে? কম্পাস না থাকায় নামাজ পড়তে অসুবিধা হচ্ছে। কাবার দিক ঠিক করতে পারছি না।
অবশই কম্পাস কেনার ব্যাপারে আমি তোমাকে সাহায্য করব। তবে আমি কি তোমাকে ছোট্ট একটা প্রশ্ন করতে পারি?
হ্যাঁ পারো।
তুমি যখন জাকার্তা থেকে বিমানে করে ওয়াশিংটন এসেছ তখন তোমাকে কুড়ি ঘন্টা বিমানে থাকতে হয়েছে। এই সময়ে কয়েকবার নামাজের সময় হয়েছে, কাবা শরীফ তখন ছিল তোমার নিচে। সেই সময় নামাজ কি ভাবে পড়েছ?
তেহারি জবাব না দিয়ে অত্যন্ত ব্যথিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। মুসলমান হয়ে এই কথা বলব তা তিনি সম্ভবত কল্পনা করেন নি। আমারো বেশ খারাপ লাগল। এই কূটতর্কের কোনোই প্রয়োজন ছিল না।
অপরাধ বোধ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে নিজেই একটা ভালো কম্পাস কিনে আনলাম। সেই রাতে লেখকদের সম্মানে ফার্স্ট ন্যাশনাল ব্যাংক বিশাল এক পার্টির আয়োজন করেছে। ফরম্যাল ডিনার। খানার চেয়ে পিনার আয়োজন বেশি। অবাক হয়ে দেখি আহমদ তেহারি রেড ওয়াইন নিয়ে বসেছেন এবং বেশ তাড়িয়ে তাড়িয়ে খাচ্ছেন। আমি তার পাশে জায়গা করে বসলাম এবং মধুর স্বরে বললাম, তুমি মদপান করছ ব্যাপারটা কি?
তোহারি বললেন, মদপান দোষের নয়। মওলানা জালালুদ্দিন রুমি মদপান করতেন।
ও আচ্ছা। আমাদের প্রফেট কিন্তু করতেন না।
তোহারি আমার কথাবার্তা পছন্দ করলেন না। গ্লাস নিয়ে উঠে চলে গেলেন। আমার অপমানিত বোধ করার কথা কেন জানি তা করলাম না। বরং মজা লাগল।
আমার বাঁ পাশে বসেছেন চৈনিক ঔপন্যাসিক জংইয়ং। দেখেই মনে হয় খুব হাসি-খুশি মানুষ। কথা বলতে গিয়ে দেখলাম তার ইংরেজি জ্ঞান ‘ইয়েসের মধ্যে সীমাবদ্ধ। ইয়েস’ ছাড়া অন্য কোনো ইংরেজি শব্দ তিনি এখনো শিখে উঠতে পারেন নি বলে মনে হলো। তার সঙ্গে কথাবার্তার কিছু নমুনা দেই।
আমার নাম হুমায়ুন। আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি। বাংলাদেশ–তোমরা যাকে বলে মানছালা।
ইয়েস। [মুখ ভর্তি হাসি। মনে হলো আমার পরিচয় পেয়ে খুব আনন্দিত।]
তুমি কি শুধু উপন্যাসই লেখো? না কবিতাও লেখো?
ইয়েস। [আবার হাসি, খুবই আন্তরিক ভঙ্গিতে।]
আজকের পার্টি তোমার কেমন লাগছে?
ইয়েস। ইয়েস। [হাসি এবং মাথা নাড়া। মনে হলো আমার সঙ্গে কথা বলে তিনি খুব আরাম পাচ্ছেন।]
ভারতীয় মহিলা কবি গগন গিলের সঙ্গে দেখা হলো এই পার্টিতেই। লেখকদের মধ্যে তিনিই সবচে’ কমবয়েসি। চব্বিশ-পঁচিশের বেশি হবে না। অত্যন্ত রূপবতী। মেরুন রঙের সিল্কের শাড়িতে তাঁকে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে। ভদ্রমহিলার হাতে মদের গ্লাস, নির্বিকার ভঙ্গিতে ভুসভুস করে সিগারেট টানছেন। শাড়ি পরা কোনো মহিলার মদ পান এবং সিগারেট টানার দৃশ্যের সঙ্গে তেমন পরিচয় নেই বলে খানিকটা অস্বস্তি লাগছে, যদিও জানি অস্বস্তি লাগার কিছুই নেই। পুরুষরা যা পারে ওরাও তা পারে ওরা বরং আরো বেশি পারে, ওরা গর্ভধারণ করতে পারে আমরা পুরুষরা তা পারি না।
পার্টির শেষে আমি আহমদ তেহারিকে কম্পাসটা দিলাম। তিনি বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইলেন। আমার কাছ থেকে এটা তিনি আশা করেন নি বলে মনে হলো। মানুষের বিস্মিত মুখের ছবি–বড়াই চমৎকার। আমার দেখতে খুব ভালো লাগে।
তোহারি তোমার জন্যে আমার সামান্য উপহার। উপহারটি কাজে লাগলে আমি খুশি হব।
লেখকরা খুব আবেগপ্রবণ হন এই কথা বোধ হয় মিথ্যা নয়, তেহারি ‘মাই ডিয়ার ফ্রেন্ড’ ‘মাই ডিয়ার ফ্রেন্ড’ বলে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। সবাই ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল, একজন পুরুষ অন্য একজন পুরুষকে জড়িয়ে ধরেছে এই দৃশ্য তাদের কাছে খুব রুচিকর নয়।
নিজের অস্তিানা ভুতুড়ে বাড়িতে ফিরছি তবে ভূতের হাত থেকে রক্ষা পাবার ব্যবস্থা করে ফিরছি। স্টিফান কিং-এর একটি ভৌতিক উপন্যাস কিনে নিয়েছি। বিষে বিষক্ষয়ের মতো ভূতে ভূতক্ষয়।
বাসায় ফিরে দেখি স্টিফান কিং-এর উপন্যাস কেনার দরকার ছিল না। ফিলিপাইনের ঔপন্যাসিক রোজেলিও সিকাটকে আমার এখানে দিয়ে গেছে। তিনিও দেরিতে এসেছেন বলে মে ফ্লাওয়ারে জায়গা হয় নি।
রোজেলিও সিকাটের বয়স পঞ্চাশ তবে দেখায় তার চেয়েও বেশি। মাথায় চুল সবই সাদা। দাঁত বাঁধানো। অল্প কিছু দাড়িগোঁফ আছে। মুখের গঠন অনেকটা আর্নেস্ট হেমিংওয়ের মতো। চেইন স্মোকার।
সিকাট ইউনিভার্সিটি অব ফিলিপাইনের ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক। নিজ দেশে তার খ্যাতি তুঙ্গ স্পর্শী। তাকে অত্যন্ত বিরক্ত মনে হলো। আমাকে বললেন, এদের কারবারটা দেখলে? এরা আমাকে মে ফ্লাওয়ারে জায়গা দেয় নি–এই বাড়িতে নির্বাসন দিয়েছে।
নির্বাসন বলছ কেন?
নির্বাসন না তো কি? সব লেখকরা দল বেঁধে মে ফ্লাওয়ারে আছেন আর আমি কি-না এখানে।
বাড়িটা কি তোমার পছন্দ হচ্ছে না?
পছন্দ হবে না কেন? পছন্দ হয়েছে। বাড়ি খুবই সুন্দর। কিন্তু প্রশ্নটা হলো নীতির। তুমি সম্ভবত জানো না এর আগে চারজন লেখককে এই বাড়িতে থাকতে বলা হয়েছিল। চারজনই অস্বীকার করেছেন।
তাই নাকি?
হ্যাঁ তাই। রোমানিয়ার কবি মির্চাকে (মির্চা কাক্টেরেষকু) এই বাড়ি দেয়া হলে তিনি ওদের মুখের ওপর বলেছেন–এটা একটা ‘Ghetto’। এই Ghetto-তে আমি থাকব না। আমাকে আপনারা বুখারেস্টের প্লেনে তুলে দিন।
তুমিও ওদের তাই বলো।
অবশ্যই বলব। রাগটা ঠিকমত উঠছে না। রাগ উঠলেই বলব। আমাকে দেখে মনে হয় না কিন্তু আসলে আমি খুবই রাগী মানুষ। জার্মানিতে আমি একবার মারামারি পর্যন্ত করেছি।
সে কি!
এক জার্মান যুবক আমাকে দেখে তামাশা করে কি সব বলছিল, দাঁত বের করে হাসছিল, গদাম করে তার পেটে ঘুসি বসিয়ে দিলাম। এক ঘুসিতে ঠাণ্ডা।
আমি অবাক হয়ে দ্রলোকের দিকে তাকিয়ে আছি। তিনি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, এখানে অবশ্য তেমন কিছু করা যাবে না।
করা যাবে না কেন?
করা যাবে না কারণ আসার আগে আমি আমার স্ত্রীর কাছে প্রতিজ্ঞা করেছি রাগারাগি করব না। আমি আবার তাকে খুবই ভালোবাসি।
তাই বুঝি?
হ্যাঁ। সে বড়ই ভালোমেয়ে এবং রূপবতী।
একই সঙ্গে রূপবতী এবং ভালোমেয়ে সচরাচর হয় না–তুমি অত্যন্ত ভাগ্যবান।
বুঝলে হুমায়ুন, আমার স্ত্রীর এক ধরনের ইএসপি ক্ষমতা আছে। আমি যখন লেখালেখি করি তখন সে বুঝতে পারে–কখন আমি কফি চাই, কখন খাবার চাই। ঠিক সময়ে কফি উপস্থিত হয়। ঠিক সময়ে খাবার।
বড় চমৎকার তো!
একবার সে কি করল জানো? তার সমস্ত জমানো টাকা এবং গয়না বিক্রির টাকা একত্র করে ফিলিপাইনের পাহাড়ি অঞ্চলে পাহাড়ের মাথায় ছোট্ট একটা বাড়ি কিনল। যাতে ঐ বাড়িতে বসে নিরিবিলি আমি আমার লেখার কাজ চালিয়ে যেতে পারি। আমি প্রতি বছর ঐ পাহাড়ি বাড়িতে একনাগাড়ে একা একা তিন মাস থাকতাম। নিজেই রান্না করে খেতাম সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত একনাগাড়ে লিখতাম।
তোমার স্ত্রী তোমার সঙ্গে খাকত না?
ও থাকবে কি করে? ওর ঘর-সংসার আছে না? ছোট ছোট ছেলেমেয়ে। ওদের কে দেখাশোনা করবে?
ঐ বাড়িটি কি এখনো আছে?
না বিক্রি করে দিয়েছি। এক সময় খুব অভাবে পড়লাম, বিক্রি করে দিলাম। এখনো ঐ বাড়ির জন্যে আমার মন কাঁদে। অনেকক্ষণ তোমার সঙ্গে গল্প করলাম। যাই এখন কাজ করি। আমি একটা জাপানি উপন্যাস টেগালগ ভাষায় অনুবাদ করছি–Snow country কাওয়াবাতার লেখা।
সিকাট টাইপ রাইটার নিয়ে বসলেন। তিনি টেগালগ ভাষায় লিখেন ঠিকই ব্যবহার করেন ইংরেজি টাইপ রাইটার। কারণ টেগালগ ভাষার নিজস্ব বর্ণমালা নেই। তাদের ভরসা রোমান হরফ। একই ব্যাপার তেহারির বেলাতেও। তিনিও নিজের ভাষাতে লেখেন ব্যবহার করেন ইংরেজি বর্ণমালা। অধিকাংশ আফ্রিকান দেশেই এই অবস্থা। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সমস্যা আরো গভীর। তারা সরাসরি ইংরেজি বা ফরাসি ভাষাতেই সাহিত্য চর্চা করেন। সেনেগালের শিশু-সাহিত্যিক লিখেন ফরাসি ভাষায়, কোনো আফ্রিকান ভাষায় নয়। শ্রীলংকার কবি জেন কখনো সিংহলি বা তামিল ভাষায় লিখেননি। লিখেছেন ইংরেজিতে। নাইজেরিয়ার নোবেল পুরস্কার বিজয়ী নাট্যকার ওলে সোয়েংকা (Wole Soyinka) লেখালেখি করেন ইংরেজি ভাষায়। নিজের ভাষায় না।
বাংলা ভাষার লেখক হিসেবে আমি মহাভাগ্যবান। অন্যের ভাষায় আমাকে লিখতে হচ্ছে না, অন্যের হরফ নিয়েও আমাকে লিখতে হচ্ছে না। আমার আছে প্রিয় বর্ণমালা। এই বর্ণমালা রক্ত ও ভালোবাসা দিয়ে পৃথিবীর বুকে গেঁথে দেয়া হয়েছে।