মৃত্যুক্ষুধা – ২০
পরদিন যখন সন্ধ্যায় অন্ধকার বেশ গাঢ় হয়ে এসেছে তখন মেজোবউ গায়ে বেশ করে চাদর জড়িয়ে নাজির সাহেবের বাড়ির দিকে চলতে লাগল। কীসের যেন ভয়, কীসের যেন লজ্জা তার পা দুটোকে কিছুতেই ছাড়িয়ে উঠতে দিচ্ছিল না। গাঢ় অন্ধকারের পুরু আবরণও যেন তার লজ্জাকে ঢেকে রাখতে পারছিল না।
নাজির সাহেবের দ্বারে এসে হঠাৎ আনসারের স্বরে চমকিত হয়ে তার মনে হল, এখনই সে ছুটে পালিয়ে যেতে পারলে বুঝি বেঁচে যায়! তার আজকার এই পরিপাটি করে বেশবিন্যাস যেন তার নিজের চোখেই সবচেয়ে বিসদৃশ – লজ্জার বলে ঠেকল। কিন্তু তখন আর ফিরবার উপায় ছিল না।
আনসারের দৃষ্টি অনুসরণ করে লতিফা মেজোবউকে দেখতে পেয়েই ছুটে এসে তার হাত ধরে ভিতরে নিয়ে গেল। লতিফা কিছু বলতে পারলে না, কেবল তার চোখ কেন যেন ছলছল করে উঠল। মেজোবউও তার অশ্রু আর গোপন রাখতে পারলে না।
আনসার উদাসভাবে বুঝিবা অন্ধকার আকাশের লিপিতে তারার লেখা পড়বার চেষ্টা করছিল।
নাজির সাহেবকে লতিফার হুকুমেই প্রয়োজন না থাকলেও বাইরে যেতে হয়েছিল।
বহুক্ষণ নিঃশব্দে কেটে গেল। কেবল লতিফার করতলগত হয়ে মেজোবউয়ের উষ্ণ করতল পীড়িত হতে লাগল। সে যেন হাতে-হাতে কথা কওয়া।
লতিফা ধরা-গলায় জিজ্ঞাসা করল, “তোমার ছেলেদের আনলে না?” মেজোবউ সেই পুরানো মধুর হাসি হেসে বললে, “না। তাহলে কি আর বসতে দিত? এতক্ষণ তার দাদির কাছে যাওয়ার জন্য কান্নাকাটি লাগিয়ে দিত।” বলেই একটু থেমে আবার বললে, “কী ভয়ে ভয়েই না এসেছি ভাই। বাড়ির কাছটাতে এসে পা যেন আর চলতে চায় না।”
এইবার আনসার কথা বললে, “যাক, আপনার খুব সাহস আছে বলতে হবে। আমি তো মনে করেছিলাম আপনি আসতেই পারবেন না।”
লতিফা হেসে বললে, “দোহাই দাদু, ওকে আর ‘আপনি’বলে লজ্জা দিয়ো না।” তারপর মেজোবউয়ের দিকে ফিরে বলল, “কি ভাই, তুমি বোধ হয় আমার চেয়ে দু-এক বছরের ছোটো হবে, না?”
মেজোবউ হেসে ফেলে বললে, “আমি তোমার বড়োদিদির চেয়েও হয়তো বড়ো হব।”
আনসার হেসে বললে, “তোমাদের বয়সের হিসেবটা পরেই না হয় কোরো দাঁত-টাত দেখে। এখন কাজের কথা হোক।”
মেজোবউ একটু নিম্নস্বরে বলে উঠল, “কিন্তু কাজের কথা বলতে গিয়ে দাঁত বেরিয়ে কারুর যদি বয়স ধরা পড়ে যায়?”
আনসার হেসে ফেলে বললে, “ঘাট হয়েছে আমার। এখন বলো তো তোমার মতলব কী? তুমি কী করবে?”
মেজোবউ নখ দিয়ে খানিকক্ষণ মাটি খুঁটে মুখ নিচু করেই বলল, “করব আর কী! আমার যা করবার, তা তো এখন ঠিক করে দেবে ওই সায়েব-মেমগুলোই। তারা আমায় কালই বোধহয় বরিশাল বদলি করবে।”
লতিফা হয়তো একটু বেশি জোরেই মেজোবউয়ের হাত টিপে ফেলেছিল; মেজোবউ ‘উঃ’করে উঠল। লতিফা হেসে বললে, “এত অল্পতে তোমার বেশি লাগে, তবু তুমি আমাদের – তোমার এই চিরকেলে ভিটে ছেড়ে যেতে পারবে? তা ছাড়া, তুমি কি দারোগা-মুনসেফ যে তোমায় বদলি করবে?”
মেজোবউ কেমন একরকম স্বরে বলে উঠল, “দারোগা-মুনসেফ নই ভাই, চোরাই মাল। বদলি কথাটা ভুল বলেছিলাম, সাবধানের মার নেই, তাই একটু সামলে রাখছে আগে থেকেই।”
লতিফা হো হো করে হেসে বললে, “এরই মধ্যে চোরে-টোরে ঘরের বেড়া কাটতে আরম্ভ করেছে নাকি?” বলেই লজ্জা পেয়ে সপ্রতিভ হওয়ার ভান করে উঠে যেতে যেতে বলল, “একটু বসো, আমি একটু চা করে আনি। নইলে ওই লোকটির মেজাজকে তিনদিন ধরে জলে চুবিয়ে রাখলেও আর নরম হবে না।”
লতিফা চলে গেল। মেজোবউ গেল না, বা উঠে যাওয়ার চেষ্টাও করল না। তার সবচেয়ে বড়ো অস্বস্তির কারণ হয়ে উঠল তার সেদিনকার সুন্দর করে কাপড় পরার ঢংটা। সে বুঝতে পারছিল, তার যত্ন করে আঁকা বে-তিল গালে কাজলের তিলটুকুও যেন আনসার লক্ষ করছে!
আনসার হঠাৎ বলে উঠল, “তুমি আমার কথা রাখবে?”
মেজোবউ প্রথমে সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়লে। কিন্তু পরক্ষণেই লজ্জিত স্বরে বলে উঠল, “কিন্তু আমার ইচ্ছা থাকলেও তো রাখতে পারব না।”
আনসার মেজোবউয়ের মুখের দিকে খানিক তাকিয়ে থেকে বললে, “সত্যিই কি তুমি এদেশ ছেড়ে গিয়ে থাকতে পারবে?”
মেজোবউ আনসারের দিকে বড়ো বড়ো চোখ তুলে বললে, “আর দুদিন আগে গেলে হয়তো এত কষ্ট হত না! কিন্তু ইচ্ছা থাকলেও তো আমি ঘরে ফিরতে পারব না। আমি আবার মুসলমান হয়ে ফিরে আসি – আপনি হয়তো এই বলতে চাচ্ছেন, কিন্তু আমায় জায়গা দেবে কে?”
আনসার নির্বাক হয়ে বসে রইল। সত্যই তো, সে স্বধর্মে ফিরে এলে আরও অসহায় অবস্থায় পড়বে। তার শ্বশুর-বাড়ির কুটিরে তার আর স্থান হবে না। দুদিনের জন্য হলেও কথার জ্বালায় গঞ্জনার চোটে টিকতে পারব না।
হঠাৎ আনসার যেন অকূলে কূল পেল। সে সোজা হয়ে বসে উৎফুল্ল কণ্ঠে বলে উঠল, “তোমার যদি আপত্তি না থাকে, তুমি এইখানেই আলাদা ঘর বেঁধে থাক – আমি ব্যবস্থা করে দেব যাতে তোমার দিন নিশ্চিন্তে চলে যায়।”
মেজোবউ হেসে বললে, “আমায় আপনি আশ্রয় দিয়ে রেখেছেন জানাজানি হলে আমাদের কী অবস্থা হবে – বুঝেছেন? আমি না হয় সইলাম সেসব, কিন্তু আপনি –”
আনসার মেজোবউয়ের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললে, “সে-ভয় আমি করিনে। তা ছাড়া আমি তো এখানে চিরকাল থাকছিনে। বৎসরে-দু বৎসরে হয়তো একবার করে আসব। অবশ্য এমন ব্যবস্থা করে যাব, যাতে করে আমি যেখানেই থাকি তোমায় যেন কোনো কষ্টে না পড়তে হয়।”
মেজোবউয়ের চোখ জলে ঝাপসা হয়ে উঠল। এ তার দুঃখের অবসানের আনন্দে, না আনসারের অনাগত বিদায়-দিনের আভাসে – সে-ই জানে।
হঠাৎ মেজোবউ যেন জ্ঞান হারিয়ে ফেলল। কান্না-কাতরকণ্ঠে সে বলে উঠল, “যাবেই যদি তবে ঋণের বোঝা চাপিয়ে যেয়ো না। আমিও কাল চলে যাই, তুমিও চলে যাও।”
বলেই সে বাইরের অন্ধকারে মিশে গেল। আনসার একটা কথাও বলতে পারলে না। প্রস্তর-মূর্তির মতো বসে রইল। তার কেবলই মনে হতে লাগল, ওই দূর ছায়াপথের নীহারিকালোকের মতোই নারীর মন রহস্যময়।