মৃণালিনী – ০৩
তৃতীয় খণ্ড
প্রথম পরিচ্ছেদ : “উনি তোমার কে?”
যে কুটীরের নিকটস্থ বৃক্ষতলে বসিয়া হেমচন্দ্র বিশ্রাম করিতেছিলেন, সেই কুটীরমধ্যে এক পাটনী বাস করিত। কুটীরমধ্যে তিনটি ঘর। এক ঘরে পাটনীর পাকাদি সমাপন হইত। অপর ঘরে পাটনীর পত্নী শিশুসন্তান সকল লইয়া শয়ন করিত। তৃতীয় ঘরে পাটনীর যুবতী কন্যা রত্নময়ী আর অপর দুইটি স্ত্রীলোক শয়ন করিয়াছিল। সেই দুইটি স্ত্রীলোক পাঠক মহাশয়ের নিকট পরিচিতা; মৃণালিনী আর গিরিজায়া নবদ্বীপে অন্যত্র আশ্রয় না পাইয়া এই স্থানে আশ্রয় লইয়াছিলেন।
একে একে তিনটি স্ত্রীলোক প্রভাতে জাগরিতা হইল। প্রথমে রত্নময়ী জাগিল। গিরিজায়াকে সম্বোধন করিয়া কহিল, “সই?”
গি। কি সই?
র। তুমি কোথায় সই?
গি। বিছানাসই।
র। উঠ না সই!
গি। না সই।
র। গায়ে জল দিব সই।
গি। জলসই? ভাল সই, তাও সই।
র। নহিলে ছাড়ি কই।
গি। ছাড়িবে কেন সই? তুমি আমার প্রাণের সই-তোমার মত আছে কই? তুমি পারঘাটার রসমই-তোমায় না কইলে আর কারে কই?
র। কথায় সই তুমি চিরজই: আমি তোমার কাছে বোবা হই, আর মিলাইতে পারি কই?
গি। আরও মিল চাই?
র। তোমার মুখে ছাই, আর মিলে কাজ নাই, আমি কাজে যাই।
এই বলিয়া রত্নময়ী গৃহকর্মে গেল। মৃণালিনী এ পর্যন্ত কোন কথা কহেন নাই। এখন গিরিজায়া তাঁহাকে সম্বোধন করিয়া কহিল, “ঠাকুরাণি, জাগিয়াছ?”
মৃণালিনী কহিলেন, “জাগিয়াই আছি। জাগিয়াই থাকি |”
গি। কি ভাবিতেছিলে?
মৃ। যাহা ভাবি।
গিরিজায়া তখন গম্ভীরভাবে কহিল, “কি করিব? আমার দোষ নাই। আমি শুনিয়াছি, তিনি এই নগরমধ্যে আছেন; এ পর্যন্ত সন্ধান পাই নাই। কিন্তু আমরা ত সবে দুই তিন দিন আসিয়াছি। শীঘ্র সন্ধান করিব |”
মৃ। গিরিজায়া, যদি এ নগরে সন্ধান না পাই? তবে যে এই পাটনীর গৃহে মৃত্যু পর্যন্ত বাস করিতে হইবে। আমার যে যাইবার স্থান নাই।
মৃণালিনী উপাধানে মুখ লুকাইলেন। গিরিজায়ারও গণ্ডে নীরবস্রুত অশ্রু বহিতে লাগিল।
এমন সময় রত্নময়ী শশব্যস্তে গৃহমধ্যে আসিয়া কহিল, “সই! সই! দেখিয়া যাও। আমাদিগের বটতলায় কে ঘুমাইতেছে। আশ্চর্য পুরুষ!”
গিরিজায়া কুটীরদ্বারে দেখিতে আসিল। মৃণালিনীও কুটীরদ্বার পর্যন্ত আসিয়া দেখিলেন। উভয়েই দৃষ্টিমাত্র চিনিল।
সাগর একেবারে উছলিয়া উঠিল। মৃণালিনী গিরিজায়াকে আলিঙ্গন করিলেন। গিরিজায়া গায়িল,
“কণ্টকে গঠিল বিধি মৃণাল অধমে |”
সেই ধ্বনি স্বপ্নবৎ হেমচন্দ্রের কর্ণে প্রবেশ করিয়াছিল। মৃণালিনী গিরিজায়ার কণ্ঠকণ্ডূয়ন দেখিয়া কহিলেন, “চুপ, রাক্ষসী আমাদিগের দেখা দেওয়া হইবে না, ঐ উনি জাগরিত হইতেছেন। এই অন্তরাল হইতে দেখ, উনি কি করেন। উনি যেখানে যান, অদৃশ্যভাবে দূরে থাকিয়া উঁহার সঙ্গে যাও- এ কি! উঁহার অঙ্গ রক্তময় দেখিতেছি কেন? চল, তবে আমিও সঙ্গে চলিলাম |”
হেমচন্দ্রের ঘুম ভাঙ্গিয়াছিল। প্রাত:কাল উপস্থিত দেখিয়া তিনি শূলদণ্ডে ভর করিয়া গাত্রোত্থান করিলেন, এবং ধীরে ধীরে গৃহাভিমুখে চলিলেন।
হেমচন্দ্র কিয়দ্দূর গেলে, মৃণালিনী আর গিরিজায়া তাঁহার অনুসরণার্থ গৃহ হইতে নিষ্ক্রান্ত হইলেন। তখন রত্নময়ী জিজ্ঞাসা করিল, “ঠাকুরাণি, উনি তোমার কে?”
মৃণালিনী কহিলেন, “দেবতা জানেন |”
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ : প্রতিজ্ঞা-পর্বতো বহ্নিমান
বিশ্রাম করিয়া হেমচন্দ্র কিঞ্চিৎ সবল হইয়াছিলেন। শোণিতস্রাবও কতক মন্দীভূত হইয়াছিল। শূলে ভর করিয়া হেমচন্দ্র স্বচ্ছন্দে গৃহে প্রত্যাগমন করিলেন।
গৃহে আসিয়া দেখিলেন, মনোরমা দ্বারদেশে দাঁড়াইয়া আছেন।
মৃণালিনী ও গিরিজায়া অন্তরালে থাকিয়া মনোরমাকে দেখিলেন।
মনোরমা চিত্রার্পিত পুত্তলিকার ন্যায় দাঁড়াইয়া রহিলেন। দেখিয়া মৃণালিনী মনে মনে ভাবিলেন, “আমার প্রভু যদি রূপে বশীভূত হয়েন, তবে আমার সুখের নিশি প্রভাত হইয়াছে |” গিরিজায়া ভাবিল, “রাজপুত্র যদি রূপে মুগ্ধ হয়েন, তবে আমার ঠাকুরাণীর কপাল ভাঙ্গিয়াছে |”
হেমচন্দ্র মনোরমার নিকট আসিয়া কহিলেন, “মনোরমা-এমন করিয়া দাঁড়াইয়া রহিয়াছ কেন?”
মনোরমা কোন কথা কহিলেন না। হেমচন্দ্র পুনরপি ডাকিলেন, “মনোরমা!”
তথাপি উত্তর নাই; হেমচন্দ্র দেখিলেন, আকাশমার্গে তাঁহার স্থিরদৃষ্টি স্থাপিত হইয়াছে।
হেমচন্দ্র পুনরায় বলিলেন, “মনোরমা, কি হইয়াছে?”
তখন মনোরমা ধীরে ধীরে আকাশ হইতে চক্ষু ফিরাইয়া হেমচন্দ্রের মুখমণ্ডলে স্থাপিত করিল। এবং কিয়ৎকাল অনিমেষলোচনে তৎপ্রতি চাহিয়া রহিল। পরে হেমচন্দ্রের রুধিরাক্ত পরিচ্ছদে দৃষ্টিপাত হইল। তখন মনোরমা বিস্মিত হইয়া কহিল, “এ কি হেমচন্দ্র! রক্ত কেন? তোমার মুখ শুষ্ক; তুমি কি আহত হইয়াছ?”
হেমচন্দ্র অঙ্গুলি দ্বারা স্কন্ধের ক্ষত দেখাইয়া দিলেন।
মনোরমা তখন হেমচন্দ্রের হস্ত ধারণ করিয়া গৃহমধ্যে পালঙ্কোপরি লইয়া গেল। এবং পলকমধ্যে বারিপূর্ণ ভৃঙ্গার আনীত করিয়া, একে একে হেমচন্দ্রের গাত্রবসন পরিত্যক্ত করাইয়া অঙ্গের রুধির সকল ধৌত করিল। এবং গোজাতিপ্রলোভন নবদুর্বাদল ভূমি হইতে ছিন্ন করিয়া আপন কুন্দনিন্দিত দন্তে চর্বিত করিল। পরে তাহা ক্ষতমুখে প্রয়োগ করিয়া উপবীতাকারে বস্ত্র দ্বারা বাঁধিল। তখন কহিল, “হেমচন্দ্র! আর কি করিব? তুমি সমস্ত রাত্রি জাগরণ করিয়াছ, নিদ্রা যাইবে?”
হেমচন্দ্র কহিলেন, “নিদ্রাভাবে নিতান্ত কাতর হইতেছি |”
মৃণালিনী মনোরমার কার্য দেখিয়া চিন্তিতান্ত:করণে গিরিজায়াকে কহিলেন, “এ কে গিরিজায়া?”
গি। নাম শুনিলাম মনোরমা।
মৃ। এ কি হেমচন্দ্রের মনোরমা?
গি। তুমি কি বিবেচনা করিতেছ?
মৃ। আমি ভাবিতেছি, মনোরমাই ভাগ্যবতী। আমি হেমচন্দ্রের সেবা করিতে পারিলাম না, সে করিল। যে কার্যের জন্য আমার অন্ত:করণ দগ্ধ হইতেছিল-মনোরমা সে কার্য সম্পন্ন করিল-দেবতারা উহাকে আয়ুষ্মতী করুন। গিরিজায়া, আমি গৃহে চলিলাম, আমার আর থাকা উচিত নহে। তুমি এই পল্লীতে থাক, হেমচন্দ্র কেমন থাকেন, সংবাদ লইয়া যাইও। মনোরমা যেই হউক, হেমচন্দ্র আমারই।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ : হেতু-ধূমাৎ
মনোরমা এবং হেমচন্দ্র গৃহমধ্যে প্রবেশ করিলে মৃণালিনীকে বিদায় দিয়া গিরিজায়া উপবনগৃহ প্রদক্ষিণ করিতে লাগিলেন। যেখানে যেখানে বাতায়ন-পথ মুক্ত দেখিলেন, সেইখানে সাবধানে মুখ উন্নত করিয়া গৃহমধ্যে দৃষ্টিপাত করিলেন। এক কক্ষে হেমচন্দ্রকে শয়ানাবস্থায় দেখিতে পাইলেন; দেখিলেন, তাঁহার শয্যোপরি মনোরমা বসিয়া আছে। গিরিজায়া সেই বাতায়নতলে উপবেশন করিলেন। পূর্বরাত্রে সেই বাতায়ন-পথে যবন হেমচন্দ্রকে দেখা দিয়াছিল।
বাতায়ন-তলে উপবেশনে গিরিজায়ার অভিপ্রায় এই ছিল যে, হেমচন্দ্র মনোরমার কি কথোকথন হয়, তাহা বিরলে থাকিয়া শ্রবণ করে। কিন্তু হেমচন্দ্র নিদ্রাগত, কোন কথোকথনই ত হয় না। একাকী নীরবে সেই বাতায়ন-তলে বসিয়া গিরিজায়ার বড়ই কষ্ট হইল। কথা কহিতে পায় না, হাসিতে পায় না, ব্যঙ্গ করিতে পারে না, বড়ই কষ্ট-স্ত্রীরসনা কণ্ডূয়িত হইয়া উঠিল, মনে মনে ভাবিতে লাগিল-সেই পাপিষ্ঠ দিগ্বিজয়ই বা কোথায়? তাহাকে পাইলেও ত মুখ খুলিয়া বাঁচি। কিন্তু দিগ্বিজয় গৃহমধ্যে প্রভুর কার্যে নিযুক্ত ছিল-তাহারও সাক্ষাৎ পাইল না। তখন অন্য পাত্রাভাবে গিরিজায়া আপনার সহিত মনে মনে কথোকথন আরম্ভ করিল। সে কথোপকথন শুনিতে পাঠক মহাশয়ের কৌতূহল জন্মিয়া থাকিলে, প্রশ্নোত্তরচ্ছলে তাহা জানাইতে পারি। গিরিজায়াই প্রশ্নকর্ত্রী, গিরিজায়াই উত্তরদাত্রী।
প্র। ওলো, তুই বসিয়া কে লো?
উ। গিরিজায়া লো।
প্র। এখানে কেন লো?
উ। মৃণালিনীর জন্য লো।
প্র। মৃণালিনী তোর কে?
উ। কেউ না।
প্র। তবে তার জন্যে তোর এত মাথা ব্যথা কেন?
উ। আমার আর কাজ কি? বেড়াইয়া বেড়াইয়া কি করিব?
প্র। মৃণালিনীর জন্যে এখানে কেন?
উ। এখানে তার একটি শিকলীকাটা পাখী আছে।
প্র। পাখী ধরিয়া নিয়ে যাবি না কি?
উ। শিকলী কেটে থাকে ত ধরিয়া কি করিব? ধরিবই বা কিরূপে?
প্র। তবে বসিয়া কেন?
উ। দেখি, শিকল কেটেছে কি না।
প্র। কেটেছে না কেটেছে, জেনে কি হইবে?
উ। পাখীটির জন্যে মৃণালিনী প্রতিরাত্রে কত লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদে-আজি না জানি কতই কাঁদবে। যদি ভাল সংবাদ লইয়া যাই, তবে অনেক রক্ষা হইবে।
প্র। আর যদি শিকল কেটে থাকে?
উ। মৃণালিনীকে বলিব যে, পাখী হাতছাড়া হয়েছে-রাধাকৃষ্ণ নাম শুনিবে ত আবার বনের পাখী ধরিয়া আন। পড়া পাখীর আশা ছাড়। পিঁজরা খালি রাখিও না।
প্র। মর্ ভিখারীর মেয়ে! তুই আপনার মনের মত কথা বলিলি! মৃণালিনী যদি রাগ করিয়া পিঁজরা ভাঙ্গিয়া ফেলে?
উ। ঠিক বলেছিস সই! তা সে পারে। বলা হবে না।
প্র। তবে এখানে বসিয়া রৌদ্রে পুড়িয়া মরিস কেন?
উ। বড় মাথা ধরিয়াছে, তাই। এই যে মেয়েটা ঘরের ভিতর বসিয়া আছে-এ মেয়েটা বোবা-নহিলে এখনও কথা কয় না কেন? মেয়েমানুষের মুখ এখনও বন্ধ?
ক্ষণেক পরে গিরিজায়ার মনস্কাম সিদ্ধ হইল। হেমচন্দ্রের নিদ্রাভঙ্গ হইল। তখন মনোরমা তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেমন, ঘুম হয়েছে?”
হে। বেশ ঘুম হয়েছে।
ম। এখন বল, কি প্রকারে আঘাত পাইলে?
তখন হেমচন্দ্র রাত্রির ঘটনা সংক্ষেপে বিবৃত করিলেন। শুনিয়া মনোরমা চিন্তা করিতে লাগিল।
হেমচন্দ্র কহিলেন, “তোমার জিজ্ঞাস্য শেষ হইল। এখন আমার কথার উত্তর দাও। কালি রাত্রিতে তুমি আমার সঙ্গ পরিত্যাগ করিয়া গেলে যাহা যাহা ঘটিয়াছিল সকল বল |”
মনোরমা মৃদু মৃদু অস্ফুটস্বরে কি বলিল, গিরিজায়া তাহা শুনিতে পাইল না। বুঝিল, চুপি চুপি কি কথা হইল।
গিরিজায়া আর কোন কথা শুনিতে না পাইয়া গাত্রোত্থান করিল। তখন পুনর্বার প্রশ্নোত্তরমালা মনোমধ্যে গ্রথিত হইতে লাগিল।
প্র। কি বুঝিলে?
উ। কয়েকটি লক্ষণ মাত্র।
প্র। কি কি লক্ষণ?
গিরিজায়া অঙ্গুলিতে গণিতে লাগিল, এক-মেয়েটি আশ্চর্য সুন্দরী; আগুনের কাছে ঘি কি গাঢ় থাকে? দুই-মনোরমা ত হেমচন্দ্রকে ভালবাসে, নহিলে এত যত্ন করিল কেন? তিন-একত্রে বাস। চারি-একত্রে রাত বেড়ান। পাঁচ-চুপি চুপি কথা।
প্র। মনোরমা ভালবাসে; হেমচন্দ্রের কি?
উ। বাতাস না থাকিলে কি জলে ঢেউ হয়? আমাকে যদি কেহ ভালবাসে, আমি তাহাকে ভালবাসিব সন্দেহ নাই।
প্র। কিন্তু মৃণালিনীও ত হেমচন্দ্রকে ভালবাসে। তবে ত হেমচন্দ্র মৃণালিনীকে ভালবাসিবেই।
উ। যথার্থ। কিন্তু মৃণালিনী অনুপস্থিত, মনোরমা উপস্থিত।
এই ভাবিয়া গিরিজায়া ধীরে ধীরে গৃহের দ্বারদেশে আসিয়া দাঁড়াইল। তথায় একটি গীত আরম্ভ করিয়া কহিলেন, “ভিক্ষা দাও গো |”
চতুর্থ পরিচ্ছেদ : উপনয়-বহ্নিব্যাপ্যো ধূমবান্
গিরিজায়া গীত গায়িল,
“কাহে সই জীয়ত মরত কি বিধান?
ব্রজকি কিশোর সই, কাঁহা গেল ভাগই,
ব্রজজন টুটায়ল পরাণ |”
সঙ্গীতধ্বনি হেমচন্দ্রের কর্ণে প্রবেশ করিল। স্বপ্নশ্রুত শব্দের ন্যায় কর্ণে প্রবেশ করিল।
গিরিজায়া আবার গায়িল,
“ব্রজকি কিশোর সই, কাঁহা গেল ভাগই,
ব্রজবধূ টুটায়ল পরাণ |”
হেমচন্দ্র উন্মুখ হইয়া শুনিতে লাগিলেন।
গিরিজায়া আবার গায়িল,
“মিলি সেই নাগরী, ভুলি সেই মাধব,
রূপবিহীন গোপকুঙারী।
কো জানে পিয় সই, রসময় প্রেমিক,
হেন বঁধূ রূপকি ভিখারী ||”
হেমচন্দ্র কহিলেন, “এ কি! মনোরমা, এ যে গিরিজায়ার স্বর! আমি চলিলাম |” এই বলিয়া লম্ফ দিয়া হেমচন্দ্র শয্যা হইতে অবতরণ করিলেন। গিরিজায়া গায়িতে লাগিল,
“আগে নাহি বুঝনু, রূপ দেখি ভুলনু,
হৃদি বৈনু চরণ যুগল।
যমুনা-সলিলে সই, তব তনু ডারব,
আন সখি ভখিব গরল ||”
হেমচন্দ্র গিরিজায়ার সম্মুখে উপস্থিত হইলেন। ব্যস্ত স্বরে কহিলেন, “গিরিজায়া। এ কি গিরিজায়া! তুমি এখানে? তুমি এখানে কেন? তুমি এ দেশে কবে আসিলে?”
গিরিজায়া কহিল, “আমি এখানে অনেক দিন আসিয়াছি |” এই বলিয়া আবার গায়িতে লাগিল,
“কিবা কাননবল্লরী, গল বেঢ়ি বাঁধই,
নবীন তমালে দিব ফাঁস |”
হেমচন্দ্র কহিলেন, “তুমি এ দেশে কেন এলে?”
গিরিজায়া কহিল, “ভিক্ষা আমার উপজীবিকা। রাজধানীতে অধিক ভিক্ষা পাইব বলিয়া আসিয়াছি-
কিবা কাননবল্লরী, গল বেঢ়ি বাঁধই,
নবীন তমালে দিব ফাঁস |”
হেমচন্দ্র গীতে কর্ণপাত না করিয়া কহিলেন, “মৃণালিনী কেমন আছে; দেখিয়া আসিয়াছ?
গিরিজায়া গায়িতে লাগিল,
“নহে-শ্যাম শ্যাম শ্যাম, শ্যাম নাম জপয়ি,
ছার তনু করব বিনাশ |”
হেমচন্দ্র কহিলেন, “তোমার গীত রাখ। আমার কথার উত্তর দাও! মৃণালিনী কেমন আছে, দেখিয়া আসিয়াছ?”
গিরিজায়া কহিল, “মৃণালিনীকে আমি দেখিয়া আসি নাই। এ গীত আপনার ভাল না লাগে, অন্য গীত গায়িতেছি।
এ জনমের সঙ্গে কি সই জনমের সাধ ফুরাইবে।
কিবা জন্ম জন্মান্তরে, এ সাধ মোর পুরাইবে ||”
হেমচন্দ্র কহিলেন, “গিরিজায়া তোমাকে মিনতি করিতেছি-গান রাখ, মৃণালিনীর সংবাদ বল |”
গি। কি বলিব?
হে। মৃণালিনীকে কেন দেখিয়া আইস নাই?
গি। গৌড়নগরে তিনি নাই।
হে। কেন? কোথায় গিয়াছেন?
গি। মথুরায়।
হে। মথুরায়? মথুরায় কাহার সঙ্গে গেলেন? কি প্রকারে গেলেন? কেন গেলেন?
গি। তাঁহার পিতা কি প্রকারে সন্ধান পাইয়া লোক পাঠাইয়া লইয়া গিয়াছেন। বুঝি তাঁহার বিবাহ উপস্থিত। বুঝি বিবাহ দিতে লইয়া গিয়াছেন।
হে। কি? কি করিতে?
গি। মৃণালিনীর বিবাহ দিতে তাঁহার পিতা তাঁহাকে লইয়া গিয়াছেন।
হেমচন্দ্র মুখ ফিরাইলেন। গিরিজায়া সে মুখ দেখিতে পাইল না; আর যে হেমচন্দ্রের স্কন্ধস্থ ক্ষতমুখ ছুটিয়া বন্ধনবস্ত্র রক্তে প্লাবিত হইতেছিল, তাহাও দেখিতে পাইল না। সে পূর্বমত গায়িল,
“বিধি তোরে সাধি শুন, জন্ম যদি দিবে পুন,
আমারে আবার যেন, রমণী জনম দিবে।
লাজ ভয় তেয়াগিব এ সাধ মোর পুরাইব,
সাগর ছেঁচে রতন নিব, কণ্ঠে রাখব নিশি দিবে ||”
হেমচন্দ্র মুখ ফিরাইলেন। বলিলেন, “গিরিজায়া, তোমার সংবাদ শুভ। উত্তম হইয়াছে |”
এই বলিয়া হেমচন্দ্র গৃহমধ্যে পুন: প্রবেশ করিলেন। গিরিজায়ার মাথায় আকাশ ভাঙ্গিয়া পড়িল। গিরিজায়া মনে করিয়াছিল, মিছা করিয়া মৃণালিনীর বিবাহের কথা বলিয়া সে হেমচন্দ্রের পরীক্ষা করিয়া দেখিবে। মনে করিয়াছিল যে, মৃণালিনী বিবাহ উপস্থিত শুনিয়া হেমচন্দ্র বড় কাতর হইবে, বড় রাগ করিবে। কৈ, তা ত কিছুই হইল না। তখন গিরিজায়া কপালে করাঘাত করিয়া ভাবিল, “হায় কি করিলাম! কেন অনর্থক মিথ্যা কথা রটনা করিলাম। হেমচন্দ্র ত সুখী হইল দেখিতেছি – বলিয়া গেল – সংবাদ শুভ। এখন ঠাকুরাণীর দশা কি হইবে?” হেমচন্দ্র যে কেন গিরিজায়াকে বলিলেন, তোমার সংবাদ শুভ, তাহা, গিরিজায়া ভিখারিণী বৈ ত নয়-কি বুঝিবে? যে ক্রোধভরে, হেমচন্দ্র, এই মৃণালিনীর জন্য গুরুদেবের প্রতি শরসন্ধানে উদ্যত হইয়াছিলেন, সেই দুর্জয় ক্রোধ হৃদয়মধ্যে সমুদিত হইল। অভিমানাধিক্যে দুর্দম ক্রোধাবেগে, হেমচন্দ্র গিরিজায়াকে বলিলেন, “তোমার সংবাদ শুভ!”
গিরিজায়া তাহা বুঝিতে পারিল না। মনে করিল, এই ষষ্ঠ লক্ষণ। কেহ তাহাকে ভিক্ষা দিল না; সেও ভিক্ষার প্রতীক্ষা করিল না। “শিকলী কাটিয়াছে” সিদ্ধান্ত করিয়া গৃহাভিমুখে চলিল।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ : আর একটি সংবাদ
সেই দিন মাধবাচার্যের পর্যটন সমাপ্ত হইল। তিনি নবদ্বীপে উপস্থিত হইলেন। তথায় প্রিয় শিষ্য হেমচন্দ্রেকে দর্শনদান করিয়া চরিতার্থ করিলেন। এবং আশীর্বাদ, আলিঙ্গন, কুশলপ্রশ্নাদির পরে বিরলে উভয়ের উদ্দেশ্য সাধনের কথোপকথন করিতে লাগিলেন।
আপন ভ্রমণবৃত্তান্ত সবিস্তারে বিবৃত করিয়া মাধবাচার্য কহিলেন, “এত শ্রম করিয়া কতকদূর কৃতকার্য হইয়াছি। এতদ্দেশে অধীন রাজগণের মধ্যে অনেকেই রণক্ষেত্রে সসৈন্যে সেন রাজার সহায়তা করিতে স্বীকৃত হইয়াছেন। অচিরাৎ সকলে আসিয়া নবদ্বীপে সমবেত হইবেন |”
হেমচন্দ্র কহিলেন, “তাঁহারা অদ্যই এ স্থলে না আসিলে সকলই বিফল হইবে। যবনসেনা আসিয়াছে, মহাবনে অবস্থিতি করিতেছে। আজি কালি নগর আক্রমণ করিবে |”
মাধবাচার্য শুনিয়া শিহরিয়া উঠিলেন। কহিলেন, “গৌড়েশ্বরের পক্ষ হইতে কি উদ্যম হইয়াছে?”
হে। কিছুই না। বোধ হয়, রাজসন্নিধানে এ সংবাদ এ পর্যন্ত প্রচার হয় নাই। আমি দৈবাৎ কালি এ সংবাদ প্রাপ্ত হইয়াছি।
মা। এ বিষয় তুমি রাজগোচর করিয়া সৎপরামর্শ দাও নাই কেন?
হে। সংবাদপ্রাপ্তির পরেই পথিমধ্যে দস্যু কর্তৃক আহত হইয়া রাজপথে পড়িয়াছিলাম। এই মাত্র গৃহে আসিয়া কিঞ্চিৎ বিশ্রাম করিতেছি। বলহানিপ্রযুক্ত রাজসমক্ষে যাইতে পারি নাই। এখনই যাইতেছি।
মা। তুমি এখন বিশ্রাম কর। আমি রাজার নিকট যাইতেছি। পশ্চাৎ যেরূপ হয় তোমাকে জানাইব।
এই বলিয়া মাধবাচার্য গাত্রোত্থান করিলেন।
তখন হেমচন্দ্র বলিলেন, “প্রভু! আপনি গৌড় পর্যন্ত গমন করিয়াছিলেন শুনিলাম_”
মাধবাচার্য অভিপ্রায় বুঝিয়া কহিলেন, “গিয়াছিলাম। তুমি মৃণালিনীর সংবাদ কামনা করিয়া জিজ্ঞাসা করিতেছ? মৃণালিনী তথায় নাই |”
হে। কোথায় গিয়াছে?
মা। তাহা আমি অবগত নহি, কেহ সংবাদ দিতে পারিল না।
হে। কেন গিয়াছে?
মা। বৎস! সে সকল পরিচয় যুদ্ধান্তে দিব।
হেমচন্দ্র ভ্রূকুটি করিয়া কহিলেন, “স্বরূপ বৃত্তান্ত আমাকে জানাইলে, আমি যে মর্মপীড়ায় কাতর হইব, সে আশঙ্কা করিবেন না। আমিও কিয়দংশ শ্রবণ করিয়াছি। যাহা অবগত আছেন, তাহা নি:সঙ্কোচে আমার নিকট প্রকাশ করুন |”
মাধবাচার্য গৌড়নগরে গমন করিলে হৃষীকেশ তাঁহাকে আপন জ্ঞানমত মৃণালিনীর বৃত্তান্ত জ্ঞাত করিয়াছিলেন। তাহাই প্রকৃত বৃত্তান্ত বলিয়া মাধবাচার্যেরও বোধ হইয়াছিল; মাধবাচার্য কস্মিন্কালে স্ত্রীজাতির অনুরাগী নহেন-সুতরাং স্ত্রীচরিত্র বুঝিতেন না। এক্ষণে হেমচন্দ্রের কথা শুনিয়া তাঁহার বোধ হইল যে, হেমচন্দ্র সেই বৃত্তান্তই কতক কতক শ্রবণ করিয়া মৃণালিনীর কামনা পরিত্যাগ করিয়াছেন-অতএব কোন নূতন মন:পীড়ার সম্ভাবনা নাই বুঝিয়া, পুনর্বার আসনগ্রহণপূর্বক হৃষীকেশের কথিত বিবরণ হেমচন্দ্রকে শুনাইতে লাগিলেন।
হেমচন্দ্র অধোমুখে করতলোপরি ভ্রূকুটিকুটি ললাট সংস্থাপিত করিয়া নি:শব্দে সমুদয় বৃত্তান্ত শ্রবণ করিলেন। মাধবাচার্যের কথা সমাপ্ত হইলেও বাঙ্কনিষ্পত্তি করিলেন না। সেই অবস্থাতেই রহিলেন। মাধবাচার্য ডাকিলেন, “হেমচন্দ্র!” কোন উত্তর পাইলেন না। পুনরপি ডাকিলেন, “হেমচন্দ্র!” তথাপি নিরুত্তর।
তখন মাধবাচার্য গাত্রোত্থান করিয়া হেমচন্দ্রের হস্ত ধারণ করিলেন; অতি কোমল, স্নেহময় স্বরে কহিলেন, “বৎস! তাত! মুখ তোল, আমার সঙ্গে কথা কও!”
হেমচন্দ্র মুখ তুলিলেন। মুখ দেখিয়া মাধবাচার্যও ভীত হইলেন। মাধবাচার্য কহিলেন, “আমার সহিত আলাপ কর। ক্রোধ হইয়া থাকে, তাহা ব্যক্ত কর |”
হেমচন্দ্র কহিলেন, “কাহার কথায় বিশ্বাস করিব? হৃষীকেশ একরূপ কহিয়াছে। ভিখারিণী আর এক প্রকার বলিল |”
মাধবাচার্য কহিলেন, “ভিখারিণী কে? সে কি বলিয়াছে?”
হেমচন্দ্র অতি সংক্ষেপে উত্তর দিলেন।
মাধবাচার্য সঙ্কুচিত স্বরে কহিলেন, “হৃষীকেশেরই কথা মিথ্যা বোধ হয় |”
হেমচন্দ্র কহিলেন, “হৃষীকেশের প্রত্যক্ষ |”
তিনি উঠিয়া দাঁড়াইলেন। পিতৃদত্ত শূল হস্তে লইলেন। কম্পিত কলেবরে গৃহমধ্যে নি:শব্দে পাদচারণ করিতে লাগিলেন।
আচার্য জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি ভাবিতেছ?”
হেমচন্দ্র করস্থ শূল দেখাইয়া কহিলেন, “মৃণালিনীকে এই শূলে বিদ্ধ করিব |”
মাধবাচার্য তাঁহার মুখকান্তি দেখিয়া ভীত হইয়া অপসৃত হইলেন।
প্রাতে মৃণালিনী বলিয়া গিয়াছিলেন, “হেমচন্দ্র আমারই |”
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ : “আমি ত উন্মাদিনী”
অপরাহ্নে মাধবাচার্য প্রত্যাবর্তন করিলেন। তিনি সংবাদ আনিলেন যে, ধর্মাধিকার প্রকাশ করিয়াছেন, যবনসেনা আসিয়াছে বটে, কিন্তু পূর্বজিত রাজ্যে বিদ্রোহের সম্ভাবনা শুনিয়া যবনসেনাপতি সন্ধিসংস্থাপনে ইচ্ছুক হইয়াছেন। আগামীকল্য তাঁহারা দূত প্রেরণ করিবেন। দূতের আগমন অপেক্ষা করিয়া কোন যুদ্ধোদ্যম হইতেছে না। এই সংবাদ দিয়া মাধবাচার্য কহিলেন, “এই কুলাঙ্গার রাজা ধর্মাধিকারের বুদ্ধিতে নষ্ট হইবে |”
কথা হেমচন্দ্রের কর্ণে প্রবেশলাভ করিল কি না সন্দেহ। তাঁহাকে বিমনা দেখিয়া মাধবাচার্য বিদায় হইলেন।
সন্ধ্যার প্রাক্কালে মনোরমা হেমচন্দ্রের গৃহে প্রবেশ করিল। হেমচন্দ্রকে দেখিয়া মনোরমা কহিল, “ভাই! আজ তুমি অমন কেন?”
হে। কেমন আমি?
ম। তোমার মুখখানা শ্রাবণের আকাশের মত অন্ধকার; ভাদ্র মাসের গঙ্গার মত রাগে ভরা; অত ভ্রকুটি করিতেছ কেন? চক্ষের পলক নাই কেন-আর দেখি-তাই ত, চোখে জল; তুমি কেঁদেছ?
হেমচন্দ্র মনোরমার মুখপ্রতি চাহিয়া দেখিলেন; আবার চক্ষু অবনত করিলেন; পুনর্বার উন্নত গবাক্ষপথে দৃষ্টি করিলেন; আবার মনোরমার মুখপ্রতি চাহিয়া রহিলেন। মনোরমা বুঝিল যে, দৃষ্টির এইরূপ গতির কোন উদ্দেশ্য নাই। যখন কথা কণ্ঠাগত, অথচ বলিবার নহে, তখনই দৃষ্টি এইরূপ হয়। মনোরমা কহিল, “হেমচন্দ্র, তুমি কেন কাতর হইয়াছ? কি হইয়াছে?” হেমচন্দ্র কহিলেন, “কিছু না |”
মনোরমা প্রথমে কিছু বলিল না-পরে আপনা আপনি মৃদু মৃদু কথা কহিতে লাগিল। “কিছু না-বলিবে না! ছি! ছি! বুকের ভিতর বিছা পুষিবে!” বলিতে বলিতে চক্ষু দিয়া এক বিন্দু বারি বহিল;-পরে অকস্মাৎ হেমচন্দ্রের প্রতি মুখপ্রতি চাহিয়া কহিল, “আমাকে বলিবে না কেন? আমি যে তোমার ভগিনী |”
মনোরমার মুখের ভাবে, শান্তদৃষ্টিতে এত যত্ন, এত মৃদুতা, এত সহৃদয়তা প্রকাশ পাইল যে হেমচন্দ্রের অন্ত:করণ দ্রবীভূত হইল। তিনি কহিলেন, “আমার যে যন্ত্রণা, তাহা ভগিনীর নিকট কথনীয় নহে |”
মনোরমা কহিল, “তবে আমি ভগিনী নহি |”
হেমচন্দ্র কিছুতেই উত্তর করিলেন না। তথাপি প্রত্যাশাপন্ন হইয়া মনোরমা তাঁহার মুখপ্রতি চাহিয়া রহিল। কহিল, “আমি তোমার কেহ নহি |”
হে। আমার দু:খ ভগিনীর অশ্রাব্য-অপরেরও অশ্রাব্য।
হেমচন্দ্রের কণ্ঠস্বর করুণাময়-নিতান্ত আধিব্যক্তিপরিপূর্ণ; তাহা মনোরমার প্রাণের ভিতর গিয়া বাজিল। তখনই সে স্বর পরিবর্তিত হইল, নয়নে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নির্গত হইল-অধর দংশন করিয়া হেমচন্দ্র কহিলেন, “আমার দু:খ কি? দু:খ কিছুই না। আমি মণি ভ্রমে কালসাপ কণ্ঠে ধরিয়াছিলাম, এখন তাহা ফেলিয়া দিয়াছি |”
মনোরমা আবার পূর্ববৎ হেমচন্দ্রের প্রতি অনিমেষলোচনে চাহিয়া রহিল। ক্রমে তাহার মুখমণ্ডলে অতি মধুর, অতি সকরুণ হাস্য প্রকটিত হইল। বালিকা প্রগল্াভতাপ্রাপ্ত হইল। সূর্যরশ্মির অপেক্ষা যে রশ্মি সমুজ্জ্বল, তাহার কিরীট পরিয়া প্রতিভাদেবী দেখা দিলেন। মনোরমা কহিল, “বুঝিয়াছি। তুমি না বুঝিয়া ভালবাস, তাহার পরিণাম ঘটিয়াছে |”
হে। ভালবাসিতাম।
হেমচন্দ্র বর্তমানের পরিবর্তে অতীতকাল ব্যবহার করিলেন। অমনি নীরবে নি:স্রুত অশ্রুজলে তাঁহার মুখমণ্ডল ভাসিয়া গেল।
মনোরমা বিরক্ত হইল। বলিল, “ছি! ছি! প্রতারণা! যে পরকে প্রতারণা করে, সে বঞ্চক মাত্র। যে আত্মপ্রতারণা তাহার নিকট সর্বনাশ ঘটে |” মনোরমা বিরক্তিবশত: আপন অলকদাম চম্পকাঙ্গুলিতে জড়িতে করিয়া টানিতে লাগিল।
হেমচন্দ্র বিস্মিত হইলেন, কহিলেন, “কি প্রতারণা করিলাম?”
মনোরমা কহিল, “ভালবাসিতাম কি? তুমি ভালবাস। নহিলে কাঁদিলে কেন? কি? আজি তোমার স্নেহের পাত্র অপরাধী হইয়াছে বলিয়া তোমার ভালবাসা গিয়াছে? কে তোমায় এমন প্রবোধ দিয়াছে?” বলিতে বলিতে মনোরমার প্রৌঢ়ভাবাপন্ন মুখকান্তি সহসা প্রফুল্ল পদ্মবৎ অধিকতর পরিস্ফুট, আগ্রহকম্পিত হইতে লাগিল; বলিতে লাগিল, “এ কেবল বীরদম্ভকারী পুরুষদের দর্প মাত্র। অহঙ্কার করিয়া আগুন নিবান যায়? তুমি বালির বাঁধ দিয়া এই কূলপরিপ্লাবনী গঙ্গার বেগ রোধ করিতে পারিবে, তথাপি তুমি প্রণয়িনীকে পাপিষ্ঠা মনে করিয়া কখনও প্রণয়ের বেগ রোধ করিতে পারিবে না। হা কৃষ্ণ! মানুষ সকলেই প্রতারক!”
হেমচন্দ্র বিস্মিত হইয়া ভাবিলেন, “আমি ইহাকে এক দিন বালিকা মনে করিয়াছিলাম!”
মনোরমা কহিতে লাগিল, “তুমি পুরাণ শুনিয়াছ? আমি পণ্ডিতের নিকট তাহার গূঢ়ার্থ সহিত শুনিয়াছি। লেখা আছে, ভগীরথ গঙ্গা আনিয়াছিলেন; এক দাম্ভিক মত্ত হস্তী তাহার বেগ সংবরণ করিতে গিয়া ভাসিয়া গিয়াছিল। ইহার অর্থ কি? গঙ্গা প্রেমপ্রবাহস্বরূপ; ইহা জগদীশ্বর-পাদ-পদ্ম-নি:সৃত, ইহা জগতে পবিত্র – যে ইহাতে অবগাহন করে, সেই পূণ্যময় হয়। ইনি মৃত্যঞ্জয়-জটা-বিহারিণী; যে মৃত্যুকে জয় করিতে পারে, সেও প্রণয়কে মস্তকে ধারণ করে। আমি যেমন শুনিয়াছি, ঠিক সেইরূপ বলিতেছি। দাম্ভিক হস্তী দম্ভের অবতারস্বরূপ। সে প্রণয়বেগে ভাসিয়া যায়। প্রণয় প্রথমে একমাত্র পথ অবলম্বন করিয়া উপযুক্ত সময়ে শতমুখী হয়; প্রণয় স্বভাবসিদ্ধ হইলে, শত পাত্রে ন্যস্ত হয়-পরিশেষে সাগরসঙ্গমে লয়প্রাপ্ত হয়-সংসারস্থ সর্বজীবে বিলীন হয় |”
হে। তোমার উপদেষ্টা কি বলিয়াছেন, প্রণয়ের পাত্রাপাত্র নাই? পাপাসক্তকে কি ভালবাসিতে হইবে?
ম। পাপাসক্তকে ভালবাসিতে হইবে। প্রণয়ের পাত্রাপাত্র নাই। সকলকেই ভালবাসিবে, প্রণয় জন্মিলেই তাহাকে যত্নে স্থান দিবে; কেন না, প্রণয় অমূল্য। ভাই, যে ভাল, তাকে কে না ভালবাসে? যে মন্দ তাকে আপনা ভুলিয়া ভালবাসে আমি তাকে বড় ভালবাসি। কিন্তু আমি ত উন্মাদিনী।
হেমচন্দ্র বিস্মিত হইয়া কহিলেন, “মনোরমা, এ সকল তোমায় কে শিখাইল? তোমার উপদেষ্টা অলৌকিক ব্যক্তি |”
মনোরমা মুখাবনত করিয়া কহিলেন, “তিনি সর্বজ্ঞানী, কিন্তু_”
হে। কিন্তু কি?
ম। তিনি অগ্নিস্বরূপ-আলো করেন, কিন্তু দগ্ধও করেন।
মনোরমা ক্ষণেক মুখাবনত করিয়া নীরব হইয়া রহিল।
হেমচন্দ্র বলিলেন, “মনোরমা, তোমার মুখ দেখিয়া, আর তোমার কথা শুনিয়া, আমার বোধ হইতেছে, তুমিও ভালবাসিয়াছ। বোধ হয়, যাঁহাকে তুমি অগ্নির সহিত তুলনা করিলে, তিনিই তোমার প্রণয়াধিকারী |”
মনোরমা পূর্ববৎ নীরবে রহিল। হেমচন্দ্র পুনরপি বলিতে লাগিলেন, “যদি ইহা সত্য হয়, তবে আমার একটি কথা শুন। স্ত্রীলোকের সতীত্বের অধিক আর ধর্ম নাই; যে স্ত্রীর সতীত্ব নাই, সে শূকরীর অপেক্ষাও অধম। সতীত্বের হানি কেবল কার্যেই ঘটে, এমন নহে; স্বামী ভিন্ন অন্য পুরুষের চিন্তামাত্রও সতীত্বের বিঘ্ন। তুমি বিধবা, যদি স্বামী ভিন্ন অপরকে মনেও ভাব, তবে তুমি ইহলোকে পরলোকে স্ত্রীজাতির অধম হইয়া থাকিবে। অতএব সাবধান হও। যদি কাহারও প্রতি চিত্ত নিবিষ্ট থাকে, তবে তাহাকে বিস্মৃত হও |”
মনোরমা উচ্চহাস্য করিয়া উঠিল; পরে মুখে অঞ্চল দিয়া হাসিতে লাগিল, হাসি বন্ধ হয় না। হেমচন্দ্র কিঞ্চিৎ অপ্রসন্ন হইলেন, কহিলেন, “হাসিতেছ কেন?”
মনোরমা কহিলেন, “ভাই, এই গঙ্গাতীরে গিয়া দাঁড়াও; গঙ্গাকে ডাকিয়া কহ, গঙ্গে, তুমি পর্বতে ফিরে যাও |”
হে। কেন?
ম। স্মৃতি কি আপন ইচ্ছাধীন? রাজপুত্র, কালসর্পকে মনে করিয়া কি সুখ? কিন্তু তথাপি তুমি তাহাকে ভুলিতেছ না কেন?
হে। তাহার দংশনের জ্বালায়।
ম। আর সে যদি দংশন না করিত? তবে কি তাহাকে ভুলিতে?
হেমচন্দ্র উত্তর করিলেন না। মনোরমা বলিতে লাগিল, “তোমার ফুলের মালা কালসাপ হইয়াছে, তবু তুমি ভুলিতে পারিতেছ না; আমি, আমি ত পাগল-আমি আমার পুষ্পহার কেন ছিঁড়িব? ”
হেমচন্দ্র কহিলেন, “তুমি এক প্রকার অন্যায় বলিতেছ না। বিস্মৃতি স্বেচ্ছাধীন ক্রিয়া নহে; লোক আত্মগরিমায় অন্ধ হইয়া পরের প্রতি যে সকল উপদেশ করে, তন্মধ্যে ‘বিস্মৃত হও’ এই উপদেশের অপেক্ষা হাস্যাস্পদ আর কিছুই নাই। কেহ কাহাকে বলে না, অর্থচিন্তা ছাড়; যশের ইচ্ছা ছাড়; জ্ঞানচিন্তা ছাড়; ক্ষুধানিবারণেচ্ছা ত্যাগ কর; নিদ্রা ছাড়; তবে কেন বলিবে, ভালবাসা ছাড়? ভালবাসা কি এ সকল অপেক্ষা ছোট? এ সকল অপেক্ষা প্রণয় ন্যূন নহে-কিন্তু ধর্মের অপেক্ষা ন্যূন বটে। ধর্মের জন্য প্রেমকে সংহার করিবে। স্ত্রীর পরম ধর্ম সতীত্ব। সেই জন্য বলিতেছি, যদি পার, প্রেম সংহার কর |”
ম। আমি অবলা; জ্ঞানহীনা; বিবশা; আমি ধর্মাধর্ম কাহাকে বলে, তাহা জানি না। আমি এইমাত্র জানি, ধর্ম ভিন্ন প্রেম জন্মে না।
হে। সাবধান, মনোরমা! বাসনা হইতে ভ্রান্তি জন্মে; ভ্রান্তি হইতে অধর্ম জন্মে। তোমার ভ্রান্তি পর্যন্ত হইয়াছে। তুমি বিবেচনা করিয়া বল দেখি, তুমি যদি ধর্মে একের পত্নী, মনে অন্যের পত্নী হইলে, তবে তুমি দ্বিচারিণী হইলে কি না?
গৃহমধ্যে হেমচন্দ্রের অসিচর্ম ঝুলিতেছিল; মনোরমা চর্ম হস্তে লইয়া কহিল, “ভাই, হেমচন্দ্র, তোমার এ ঢাল কিসের চামড়া?”
হেমচন্দ্র হাস্য করিলেন। মনোরমার মুখপ্রতি চাহিয়া দেখিলেন, বালিকা!
সপ্তম পরিচ্ছেদ : গিরিজায়ার সংবাদ
গিরিজায়া যখন পাটনীর গৃহে প্রত্যাবর্তন করে, তখন প্রাণান্তে হেমচন্দ্রের নবানুরাগের কথা মৃণালিনীর সাক্ষাতে ব্যক্ত করিবে না স্থির করিয়াছিল। মৃণালিনী তাহার আগমন প্রতীক্ষায় পিঞ্জরে বদ্ধ বিহঙ্গীর ন্যায় চঞ্চলা হইয়া রহিয়াছিলেন; গিরিজায়াকে দেখিবামাত্র কহিলেন, “বল গিরিজায়া, কি দেখিলে? হেমচন্দ্র কেমন আছেন?”
গিরিজায়া কহিল, “ভাল আছেন |”
মৃ। গিরিজায়া, আমাকে প্রতারণা করিও না; হেমচন্দ্র কি ভাল হয়েন নাই? তাহা হইলে আমাকে স্পষ্ট করিয়া বল। সন্দেহের অপেক্ষা প্রতীতি ভাল।
গিরিজায়া এবার সহাস্যে কহিল, “তুমি কেন অনর্থক ব্যস্ত হও? আমি নিশ্চিত বলিতেছি, তাঁহার শরীরে কিছুই ক্লেশ নাই। তিনি উঠিয়া বেড়াইতেছেন |”
মৃণালিনী ক্ষণেক চিন্তা করিয়া কহিলেন, “মনোরমার সহিত তাঁহার কোন কথাবার্তা শুনিলে?”
গি। শুনিলাম।
মৃ। কি শুনিলে?
গিরিজায়া তখন হেমচন্দ্র যাহা বলিয়াছেন, তাহা কহিলেন। কেবল হেমচন্দ্রের সঙ্গে যে মনোরমা নিশা পর্যটন করিয়াছিলেন ও কাণে কাণে কথা বলিয়াছিলেন, এই দুইটি বিষয় গোপন করিলেন। মৃণালিনী জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি হেমচন্দ্রের সহিত সাক্ষাৎ করিয়াছ?”
গিরিজায়া কিছু ইতস্তত: করিয়া কহিল, “করিয়াছি |”
মৃ। তিনি কি কহিলেন?
গি। তোমার কথা জিজ্ঞাসা করিলেন।
মৃ। তুমি কি বলিলে?
গি। আমি বলিলাম, তুমি ভাল আছ।
মৃ। আমি এখানে আসিয়াছি, তাহা বলিয়াছ?
গি। না।
মৃ। গিরিজায়া, তুমি ইতস্তত: করিয়া উত্তর দিতেছ, তোমার মুখ শুক্নম। তুমি আমার মুখপানে চাহিতে পারিতেছ না। আমি নিশ্চিত বুঝিতেছি, তুমি কোন অমঙ্গল সংবাদ আমার নিকট লুকাইতেছ। আমি তোমার কথায় বিশ্বাস করিতে পারিতেছি না। যাহা থাকে অদৃষ্টে, আমি স্বয়ং হেমচন্দ্রকে দেখিতে যাইব। পার, আমার সঙ্গে আইস, নচেৎ আমি একাকিনী যাইব।
এই বলিয়া মৃণালিনী অবগুণ্ঠনে মুখাবৃত করিয়া বেগে রাজপথ অতিবাহন করিয়া চলিলেন।
গিরিজায়া তাঁহার পশ্চাদ্ধাবিতা হইল। কিছু দূর আসিয়া তাঁহার হস্ত ধরিয়া কহিল, “ঠাকুরাণি, ফের; আমি যাহা লুকাইয়াছি, তাহার প্রকাশ করিতেছি |”
মৃণালিনী গিরিজায়ার সঙ্গে সঙ্গে গৃহে ফিরিয়া আসিলেন। তখন গিরিজায়া যাহা যাহা গোপন করিয়াছিল, তাহা সবিস্তারে প্রকাশিত করিল।
গিরিজায়া হেমচন্দ্রকে ঠকাইয়াছিল; কিন্তু মৃণালিনীকে ঠকাইতে পারিল না।
অষ্টম পরিচ্ছেদ : মৃণালিনীর লিপি
মৃণালিনী কহিলেন, “গিরিজায়া, তিনি রাগ করিয়া বলিয়া থাকেন, ‘উত্তম হইয়াছে’; ইহা শুনিয়া তিনি কেনই বা রাগ না করিবেন?”
গিরিজায়ারও তখন সংশয় জন্মিল। সে কহিল, “ইহা সম্ভব বটে |”
তখন মৃণালিনী কহিলেন, “তুমি এ কথা বলিয়া ভাল কর নাই। এর বিহিত করা উচিত; তুমি আহারাদি করিতে যাও। আমি ততক্ষণ একখানি পত্র লিখিয়া রাখিব। তুমি খাইবার পর, সেইখানি লইয়া তাঁহার নিকট যাইবে |”
গিরিজায়া স্বীকৃতা হইয়া সত্বরে আহারাদির জন্য গমন করিল। মৃণালিনী সংক্ষেপে পত্র লিখিলেন।
“গিরিজায়া মিথ্যাবাদিনী। যে কারণে সে তোমার নিকট মৎসম্বন্ধে মিথ্যা বলিয়াছে, তাহা জিজ্ঞাসা করিলে, সে স্বয়ং বিস্তারিত করিয়া কহিবে। আমি মথুরায় যাই নাই। যে রাত্রিতে তোমার অঙ্গুরীয় দেখিয়া যমুনাতটে আসিয়াছিলাম, সেই রাত্রি অবধি আমার পক্ষে মথুরার পথ রুদ্ধ হইয়াছে। আমি মথুরায় না গিয়া তোমাকে দেখিতে নবদ্বীপে আসিয়াছি। নবদ্বীপে আসিয়াও যে এ পর্যন্ত তোমার সহিত সাক্ষাৎ করি নাই, তাহার এক কারণ এই, আমার সহিত সাক্ষাৎ করিলে তোমার প্রতিজ্ঞাভঙ্গ হইবে। আমার অভিলাষ, তোমাকে দেখিব, তৎসিদ্ধিপক্ষে তোমাকে দেখা দেওয়ার আবশ্যক কি?”
গিরিজায়া এই লিপি লইয়া পুনরপি হেমচন্দ্রের গৃহাভিমুখে যাত্রা করিল। সন্ধ্যাকালে, মনোরমার সহিত কথোপকথন সমাপ্তির পরে, হেমচন্দ্র গঙ্গাদর্শনে যাইতেছিলেন, পথে গিরিজায়ার সহিত সাক্ষাৎ হইল। গিরিজায়া তাঁহার হস্তে লিপি দিল।
হেমচন্দ্র কহিলেন, “তুমি আবার কেন?”
গি। পত্র লইয়া আসিয়াছি।
হে। পত্র কাহার?
গি। মৃণালিনীর পত্র।
হেমচন্দ্র বিস্মিত হইলেন, “এ পত্র কি প্রকারে তোমার নিকট আসিল?”
গি। মৃণালিনী নবদ্বীপে আছেন। আমি মথুরার কথা আপনার নিকট মিথ্যা বলিয়াছি।
হে। এই পত্র তাঁহার?
গি। হাঁ, তাঁহার স্বহস্তলিখিত।
হেমচন্দ্র লিপিখানি না পড়িয়া তাহা খণ্ড খণ্ড করিয়া ছিন্ন ভিন্ন করিলেন। ছিন্নখণ্ড সকল বনমধ্যে নিক্ষিপ্ত করিয়া কহিলেন, “তুমি যে মিথ্যাবাদিনী, তাহা আমি ইতিপূর্বেই শুনিতে পাইয়াছি। তুমি যে দুষ্টার পত্র লইয়া আসিয়াছ, সে যে বিবাহ করিতে যায় নাই, হৃষীকেশ তাহাকে তাড়াইয়া দিয়াছে, তাহা আমি ইতিপূর্বেই শুনিয়াছি। আমি কুলটার পত্র পড়িব না। তুই আমার সম্মুখ হইতে দূর হ |”
গিরিজায়া চমৎকৃত হইয়া নিরুত্তরে হেমচন্দ্রের মুখপানে চাহিয়া রহিল।
হেমচন্দ্র পথিপার্শ্বস্থ এক ক্ষুদ্র-বৃক্ষের শাখা ভগ্ন করিয়া হস্তে লইয়া কহিলেন, “দূর হ, নচেৎ বেত্রাঘাত করিব|”
গিরিজায়ার আর সহ্য হইল না। ধীরে ধীরে বলিল, “বীর পুরুষ বটে! এই রকম বীরত্ব প্রকাশ করিতে বুঝি নদীয়ায় এসেছ? কিছু প্রয়োজন ছিল না-এ বীরত্ব মগধে বসিয়াও দেখাইতে পারিতে। মুসলমানের জুতা বহিতে, আর গরিবদু:খীর মেয়ে দেখিলে বেত মারিতে |”
হেমচন্দ্র অপ্রতিভ হইয়া বেত ফেলিয়া দিলেন। কিন্তু গিরিজায়ার রাগ গেল না। বলিল, “তুমি মৃণালিনীকে বিবাহ করিবে? মৃণালিনী দূরে থাক, তুমি আমারও যোগ্য নও|”
এই বলিয়া গিরিজায়া সদর্পে গজেন্দ্রগমনে চলিয়া গেল। হেমচন্দ্র ভিখারিণীর গর্ব দেখিয়া অবাক হইয়া রহিলেন।
গিরিজায়া প্রত্যাগতা হেমচন্দ্রের মৃণালিনীর নিকট সবিশেষ বিবৃত করিল। এবার কিছু লুকাইল না। মৃণালিনী শুনিয়া কোন উত্তর করিলেন না। রোদনও করিলেন না। যেরূপ অবস্থায় শ্রবণ করিতেছিলেন সেইরূপ অবস্থাতেই রহিলেন। দেখিয়া গিরিজায়া শঙ্কান্বিত হইল-তখন মৃণালিনীর কথোপকথনের সময় নহে বুঝিয়া তথা হইতে সরিয়া গেল।
পাটনীর গৃহের অনতিদূরে যে এক সোপানবিশিষ্ট পুষ্করিণী ছিল, তথায় গিয়া গিরিজায়া সোপানোপরি উপবেশন করিল। শারদীয়া পূর্ণিমার প্রদীপ্ত কৌমুদীতে পুষ্করিণীর স্বচ্ছ নীলাম্বু অধিকতর নীলোজ্জ্বল হইয়া প্রভাসিত হইতেছিল। তদুপরি স্পন্দনরহিত কুসুমশ্রেণী অর্ধ প্রস্ফুটিত হইয়া নীল জলে প্রতিবিম্বিত হইয়াছিল; চারি দিকে বৃক্ষমালা নি:শব্দে পরস্পরাশ্লিষ্ট হইয়া আকাশের সীমা নির্দেশ করিতেছিল; ক্কচিৎ দুই একটি দীর্ঘ শাখা ঊর্ধ্বোত্থিত হইয়া আকাশপটে চিত্রিত হইয়া রহিয়াছিল। তলস্থ অন্ধকারপুঞ্জমধ্য হইতে নবস্ফুটকুসুমসৌরভ আসিতেছিল। গিরিজায়া সোপানোপরি উপবেশন করিল।
গিরিজায়া প্রথমে ধীরে ধীরে, মৃদু মৃদু গীত আরম্ভ করিল-যেন নবশিক্ষিতা বিহঙ্গী প্রথমোদ্যমে স্পষ্ট গান করিতে পারিতেছে না। ক্রমে তাহার স্বর স্পষ্টতা লাভ করিতে লাগিল-ক্রমে ক্রমে উচ্চতর হইতে লাগিল, শেষে সেই সর্বাঙ্গসম্পূর্ণ তানলয়বিশিষ্ট কমনীয় কণ্ঠধ্বনি, পুষ্করিণী, উপবন, আকাশ বিপ্লুত করিয়া স্বর্গচ্যুত স্বরসরিত্তরঙ্গস্বরূপ মৃণালিনীর কর্ণে প্রবেশ করিতে লাগিল। গিরিজায়া গায়িল-
“পরাণ না গেলো।
যো দিন পেখনু সই যমুনাকি তীরে,
গায়ত নাচত সুন্দর ধীরে ধীরে,
ওঁহি পর পিয় সই, কাহে কালো নীরে,
জীবন না গেলো?
ফিরি ঘর আয়নু, না কহনু বোলি,
তিতায়নু আঁখিনীরে আপনা আঁচোলি,
রোই রোই পিয় সই কাহে লো পরাণি,
তইখন না গেলো?
শুননু শ্রবণ-পথে মধুর বাজে,
রাধে রাধে রাধে রাধে বিপিন মাঝে;
যব শুনন লাগি সই, সো মধু বোলি,
জীবন না গেলো?
ধায়নু পিয় সই, সোহি উপকূলে,
লুটায়নু কাঁদি সই শ্যামপদমূলে,
সোহি পদমূলে রই, কাহে লো হামারি,
মরণ না ভেল?”
গিরিজায়া গায়িতে গায়িতে দেখিলেন, তাঁহার সম্মুখে চন্দ্রের কিরণোপরি, মনুষ্যের ছায়া পড়িয়াছে। ফিরিয়া দেখিলেন, মৃণালিনী দাঁড়াইয়া আছেন। তাঁহার মুখপ্রতি চাহিয়া দেখিলেন, মৃণালিনী কাঁদিতেছেন।
গিরিজায়া দেখিয়া হর্ষান্বিত হইলেন – তিনি বুঝিতে পারিলেন যে, যখন মৃণালিনীর চক্ষুতে জল আসিয়াছে – তখন তাঁহার ক্লেশের কিছু শমতা হইয়াছে। ইহা সকলে বুঝে না – মনে করে, “কই, ইহার চক্ষুতে ত জল দেখিলাম না, তবে ইহার কিসের দু:খ?” যদি ইহা সকলে বুঝিত, সংসারের কত মর্মপীড়াই না জানি নিবারণ হইত।
কিয়ৎক্ষণ উভয়েই নীরব হইয়া রহিল। মৃণালিনী কিছু বলিতে পারেন না; গিরিজায়াও কিছু জিজ্ঞাসা করিতে পারে না। পরে মৃণালিনী কহিলেন, “গিরিজায়া, আর একবার তোমাকে যাইতে হইবে |”
গি। আবার সে পাষণ্ডের নিকট যাইব কেন?
মৃ। পাষণ্ড বলিও না। হেমচন্দ্র ভ্রান্ত হইয়া থাকিবেন-এ সংসারে অভ্রান্ত কে? কিন্তু হেমচন্দ্র পাষণ্ড নহেন। আমি স্বয়ং তাঁহার নিকট এখনই যাইব-তুমি সঙ্গে চল। তুমি আমাকে ভগিনীর অধিক স্নেহ কর-তুমি আমার জন্য না করিয়াছ কি? তুমি কখনও আমাকে অকারণে মন:পীড়া দিবে না-কখনও আমার নিকট এ সকল কথা মিথ্যা করিয়া বলিবে না, ইহা আমি নিশ্চিত জানি। কিন্তু তাই বলিয়া, আমার হেমচন্দ্র আমাকে বিনাপরাধে ত্যাগ করিলেন, ইহা তাঁহার মুখে না শুনিয়া কি প্রকারে অন্ত:করণকে স্থির করিতে পারি? যদি তাঁহার নিজ মুখে শুনি যে, তিনি মৃণালিনীকে কুলটা ভাবিয়া ত্যাগ করিলেন, তবে এ প্রাণ বিসর্জন করিতে পারিব।
গি। প্রাণবিসর্জন! সে কি মৃণালিনী?
মৃণালিনী কোন উত্তর করিলেন না। গিরিজায়ার স্কন্ধে বাহুস্থাপন করিয়া রোদন করিতে লাগিলেন। গিরিজায়াও রোদন করিল।
নবম পরিচ্ছেদ : অমৃতে গরল-গরলামৃত
হেমচন্দ্রের আচার্যের কথায় বিশ্বাস করিয়া মৃণালিনীকে দুশ্চরিত্রা বিবেচনা করিয়াছিলেন; মৃণালিনীর পত্র পাঠ না করিয়া তাহা ছিন্ন ভিন্ন করিয়াছিলেন, তাঁহার দূতীকে বেত্রাঘাত করিতে প্রস্তুত হইয়াছিলেন। কিন্তু ইহা বলিয়া তিনি মৃণালিনীকে ভালবাসিতেন না, তাহা নহে। মৃণালিনীর জন্য তিনি রাজ্যত্যাগ করিয়া মথুরাবাসী হইয়াছিলেন। এই মৃণালিনীর জন্য গুরুর প্রতি শরসন্ধান করিতে প্রস্তুত হইয়াছিলেন, মৃণালিনীর জন্য গৌড়ে নিজ ব্রত বিস্মৃত হইয়া ভিখারিণীর তোষামোদ করিয়াছিলেন। আর এখন? এখন হেমচন্দ্র মাধবাচার্যকে শূল দেখাইয়া বলিয়াছিলেন, “মৃণালিনীকে এই শূলে বিদ্ধ করিব!” কিন্তু তাই বলিয়া কি, এখন তাঁহার স্নেহ একেবারে ধ্বংসপ্রাপ্ত হইয়াছিল? স্নেহ কি একদিনে ধ্বংস হইয়া থাকে? বহুদিন অবধি পার্বতীয় বারি পৃথিবী-হৃদয়ে বিচরণ করিয়া আপন গতিপথ নিখাত করে, একদিনের সূর্যোত্তাপে কি সে নদী শুকায়? জলের যে পথ নিখাত হইয়াছে, জল সেই পথেই যাইবে, সে পথ রোধ কর, পৃথিবী ভাসিয়া যাইবে। হেমচন্দ্র সেই রাত্রিতে নিজ শয়নকক্ষে, শয্যোপরি শয়ন করিয়া সেই মুক্ত বাতায়নসন্নিধানে মস্তক রাখিয়া, বাতায়ন-পথে দৃষ্টি করিতেছিলেন-তিনি কি নৈশ শোভা দৃষ্টি করিতেছিলেন? যদি তাঁহাকে সে সময় কেহ জিজ্ঞাসা করিত যে, রাত্রি সজ্যোৎস্না কি অন্ধকার, তাহা তিনি তখন সহসা বলিতে পারিতেন না। তাঁহার হৃদয়মধ্যে যে রজনীর উদয় হইয়াছিল, তিনি কেবল তাহাই দেখিতেছিলেন। সে রাত্রি ত তখনও সজ্যোৎস্না! নহিলে তাঁহার উপাধান আর্দ্র কেন? কেবল মেঘোদয় মাত্র। যাহার হৃদয়-আকাশে অন্ধকার বিরাজ করে, সে রোদন করে না।
যে কখনও রোদন করে নাই, সে মনুষ্যমধ্যে অধম। তাহাকে কখনও বিশ্বাস করিও না। নিশ্চিত জানিও, সে পৃথিবীর সুখ কখনও ভোগ করে নাই-পরের সুখও কখনও তাহার সহ্য হয় না। এমন হইতে পারে যে, কোন আত্মচিত্তবিজয়ী মহাত্মা বিনা বাষ্পমোচনে গুরুতর মন:পীড়া সকল সহ্য করিতেছেন, এবং করিয়া থাকেন; কিন্তু তিনি যদি কস্মিন্কালে, একদিন বিরলে একবিন্দু অশ্রুজলে পৃথিবী সিক্ত না করিয়া থাকেন, তবে তিনি চিত্তজয়ী মহাত্মা হইলে হইতে পারেন, কিন্তু আমি বরং চোরের সহিত প্রণয় করিব, তথাপি তাঁহার সঙ্গে নহে।
হেমচন্দ্র রোদন করিতেছিলেন – যাহাকে পাপিষ্ঠা, মনে স্থান দিবার অযোগ্যা বলিয়া জানিয়াছিলেন, তাঁহার জন্য রোদন করিতেছিলেন। মৃণালিনীর কি তিনি দোষ আলোচনা করিতেছিলেন? তাহা করিতেছিলেন বটে, কিন্তু কেবল তাহাই নহে। এক একবার মৃণালিনীর প্রেমপরিপূর্ণ মুখমণ্ডল, প্রেমপরিপূর্ণ কথা, প্রেমপরিপূর্ণ কার্যসকল মনে করিতেছিলেন। সেই মৃণালিনী কি অবিশ্বাসিনী? একদিন মথুরায় হেমচন্দ্র মৃণালিনীর নিকট একখানি লিপি প্রেরণ করিবার জন্য ব্যস্ত হইয়াছিলেন, উপযুক্ত বাহক পাইলেন না; কিন্তু মৃণালিনীকে গবাক্ষপথে দেখিতে পাইলেন। তখন হেমচন্দ্র একটি আম্রফলের উপরে আবশ্যক কথা লিখিয়া মৃণালিনীর ক্রোড় লক্ষ্য করিয়া বাতায়নপথে প্রেরণ করিলেন; আম্র ধরিবার জন্য মৃণালিনী কিঞ্চিৎ অগ্রসর হইয়া আসাতে আম্র মৃণালিনীর ক্রোড়ে না পড়িয়া তাঁহার কর্ণে লাগিল, অমনি তদাঘাতে কর্ণবিলম্বী রত্নকুণ্ডল কর্ণ ছিন্নভিন্ন করিয়া কাটিয়া পড়িল; কর্ণস্রুত রুধিরে মৃণালিনীর গ্রীবা ভাসিয়া গেল। মৃণালিনী ভ্রূক্ষেপও করিলেন না; কর্ণে হস্তও দিলেন না; হাসিয়া আম্র তুলিয়া লিপি পাঠপূর্বক, তখনই তৎপৃষ্ঠে প্রত্যুত্তর লিখিয়া আম্র প্রতিপ্রেরণ করিলেন। এবং যতক্ষণ হেমচন্দ্র দৃষ্টিপথে রহিলেন, ততক্ষণ বাতায়নে থাকিয়া হাস্যমুখে দেখিতে লাগিলেন। হেমচন্দ্রের তাহা মনে পড়িল। সেই মৃণালিনী কি অবিশ্বাসিনী? ইহা সম্ভব নহে। আর একদিন মৃণালিনীকে বৃশ্চিক দংশন করিয়াছিল। তাহার যন্ত্রণায় মৃণালিনী মূমূর্ষুবৎ কাতর হইয়াছিলেন। তাঁহার একজন পরিচারিকা তাহার উত্তম ঔষধ জানিত; তৎপ্রয়োগ মাত্র যন্ত্রণা একেবারে শীতল হয়; দাসী শীঘ্র ঔষধ আনিতে গেল। ইত্যবসরে হেমচন্দ্রের দূতী গিয়া কহিল যে, হেমচন্দ্র উপবনে তাঁহার প্রতীক্ষা করিতেছিলেন। মুহূর্তমধ্যে ঔষধ আসিত, কিন্তু মৃণালিনী তাহার অপেক্ষা করেন নাই; অমনি সেই মরণাধিক যন্ত্রণা বিস্মৃত হইয়া উপবনে উপস্থিত হইলেন। আর ঔষধ প্রয়োগ হইল না। হেমচন্দ্রের তাহা স্মরণ হইল। সেই মৃণালিনী ব্রাহ্মণকুলকলঙ্ক ব্যোমকেশের জন্য হেমচন্দ্রের কাছে অবিশ্বাসিনী হইবে? না, তা কখনই হইতে পারে না। আর একদিন হেমচন্দ্র মথুরা হইতে গুরুদর্শনে যাইতেছিলেন; মথুরা হইতে এক প্রহরের পথ আসিয়া হেমচন্দ্রের পীড়া হইল। তিনি এক পান্থনিবাসে পড়িয়া রহিলেন; কোন প্রকারে এ সংবাদ অন্ত:পুরে মৃণালিনীর কর্ণে প্রবেশ করিল। মৃণালিনী সেই রাত্রিতে এক ধাত্রীমাত্র সঙ্গে লইয়া রাত্রিকালে সেই এক যোজন পথ পদব্রজে অতিক্রম করিয়া হেমচন্দ্রকে দেখিতে আসিলেন। যখন মৃণালিনী পান্থনিবাসে আসিয়া উপস্থিত হইলেন, তখন তিনি পথশ্রান্তিতে প্রায় নির্জীব; চরণ ক্ষতবিক্ষত – রুধির বহিতেছিল। সেই রাত্রিতেই মৃণালিনী পিতার ভয়ে প্রত্যাবর্তন করিলেন। গৃহে আসিয়া তিনি স্বয়ং পীড়িতা হইলেন। হেমচন্দ্রের তাহাও মনে পড়িল। সেই মৃণালিনী নরাধম ব্যোমকেশের জন্য তাঁহাকে ত্যাগ করিবে? সে কি অবিশ্বাসিনী হইতে পারে? যে এমন কথায় বিশ্বাস করে, সেই অবিশ্বাসী-সে নরাধম, সে গণ্ডমূর্খ। হেমচন্দ্র শতবার ভাবিতেছিলেন, “কেন আমি মৃণালিনীর পত্র পড়িলাম না? নবদ্বীপে কেন আসিয়াছে, তাহাই বা কেন জানিলাম না?” পত্রখণ্ডগুলি যে বনে নিক্ষিপ্ত করিয়াছিলেন, তাহা যদি যেখানে পাওয়া যায়, তবে তাহা যুক্ত করিয়া যতদূর পারেন, ততদূর মর্মাবগত হইবেন, এইরূপ প্রত্যাশা করিয়া একবার সেই বন পর্যন্ত গিয়াছিলেন; কিন্তু সেখানে বনতলস্থ অন্ধকারে কিছুই পায়েন নাই। বায়ু লিপিখণ্ডসকল উড়াইয়া লইয়া গিয়াছে। যদি তখন আপন দক্ষিণ বাহু ছেদন করিয়া দিলে হেমচন্দ্র সেই লিপিখণ্ডগুলি পাইতেন, তবে হেমচন্দ্র তাহাও দিতেন।
আবার ভাবিতেছিলেন, “আচার্য কেন মিথ্যা কথা বলিবেন? আচার্য অত্যন্ত সত্যনিষ্ঠ-কখনও মিথ্যা বলিবেন না। বিশেষ আমাকে পুত্রাধিক স্নেহ করেন-জানেন, এ সংবাদে আমার মরণাধিক যন্ত্রণা হইবে, কেন আমাকে তিনি মিথ্যা কথা বলিয়া এত যন্ত্রণা দিবেন? আর তিনিও স্বেচ্ছাক্রমে এ কথা বলেন নাই। আমি সদর্পে তাঁহার নিকট কথা বাহির করিয়া লইলাম-যখন আমি বলিলাম যে, আমি সকলই অবগত আছি-তখনই তিনি কথা বলিলেন। মিথ্যা বলিবার উদ্দেশ্য থাকিলে, বলিতে অনিচ্ছুক হইবেন কেন? তবে হইতে পারে, হৃষীকেশ তাঁহার নিকট মিথ্যা কথা বলিয়া থাকিবে। কিন্তু হৃষীকেশই বা অকারণে গুরুর নিকট মিথ্যা বলিবে কেন? আর মৃণালিনীই বা তাহার গৃহ ত্যাগ করিয়া নবদ্বীপে আসিবে কেন?”
যখন এইরূপ ভাবেন, তখন হেমচন্দ্রের মুখ কালিমাময় হয়, ললাট ঘর্মসিক্ত হয়; তিনি শয়ন ত্যাগ করিয়া উঠিয়া বসেন; দন্তে অধর দংশন করেন, লোচন আরক্ত এবং বিস্ফারিত হয়; শূলধারণ জন্য হস্ত মুষ্টিবদ্ধ হয়। আবার মৃণালিনীর প্রেমময় মুখমণ্ডল মনে পড়ে। অমনি ছিন্নমূল বৃক্ষের ন্যায় শয্যায় পতিত হয়েন; উপাধানে মুখ লুক্কায়িত করিয়া শিশুর ন্যায় রোদন করেন। হেমচন্দ্র ঐরূপ রোদন করিতেছিলেন, এমন সময়ে তাঁহার শয়নগৃহের দ্বার উদ্ঘাটিত হইল। গিরিজায়া প্রবেশ করিল।
হেমচন্দ্র প্রথমে মনে করিলেন, মনোরমা। তখনই দেখিলেন, সে কুসুমময়ী মূর্তি নহে। পরে চিনিলেন যে, গিরিজায়া। প্রথমে বিস্মিত, পরে আহ্লাদিত শেষে কৌতূহলাক্রান্ত হইলেন। বলিলেন, “তুমি আবার কেন?”
গিরিজায়া কহিল, “আমি মৃণালিনীর দাসী। মৃণালিনীকে আপনি ত্যাগ করিয়াছেন। কিন্তু আপনি মৃণালিনীর ত্যাজ্য নহেন। সুতরাং আমাকে আবার আসিতে হইয়াছে। আমাকে বেত্রাঘাত করিতে সাধ থাকে, করুন। ঠাকুরাণীর জন্য এবার তাহা সহিব, স্থির সঙ্কল্প করিয়াছি |”
এ তিরস্কারে হেমচন্দ্র অত্যন্ত অপ্রতিভ হইলেন। বলিলেন, “তোমার কোন শঙ্কা নাই। স্ত্রীলোককে আমি মারিব না। তুমি কেন আসিয়াছ? মৃণালিনী কোথায়? বৈকালে তুমি বলিয়াছিলে, তিনি নবদ্বীপে আসিয়াছেন; নবদ্বীপে আসিয়াছেন কেন? আমি তাঁহার পত্র না পড়িয়া ভাল করি নাই।
গি। মৃণালিনী নবদ্বীপে আপনাকে দেখিতে আসিয়াছেন।
হেমচন্দ্রের শরীর কণ্টকিত হইল। এই মৃণালিনীকে কুলটা বলিয়া অবমানিত করিয়াছেন? তিনি পুনরপি গিরিজায়াকে কহিলেন, “মৃণালিনী কোথায় আছেন?”
গি। তিনি আপানর নিকট জন্মের শোধ বিদায় লইতে আসিয়াছেন। সরোবরতীরে দাঁড়াইয়া আছেন। আপনি আসুন।
এই বলিয়া গিরিজায়া চলিয়া গেল। হেমচন্দ্র তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ ধাবিত হইলেন।
গিরিজায়া বাপীতীরে, যথায় মৃণালিনী সোপানোপরি বসিয়া ছিলেন, তথায় উপনীত হইল। হেমচন্দ্রও তথায় আসিলেন। গিরিজায়া কহিল, “ঠাকুরাণী! উঠ। রাজপুত্র আসিয়াছেন |”
মৃণালিনী উঠিয়া দাঁড়াইলেন। উভয়ে উভয়ের মুখ নিরীক্ষণ করিলেন। মৃণালিনীর দৃষ্টিলোপ হইল; অশ্রুজলে চক্ষু পূরিয়া গেল। অবলম্বনশাখা ছিন্ন হইলে যেমন শাখাবিলম্বিনী লতা ভূতলে পড়িয়া যায়, মৃণালিনী সেইরূপ হেমচন্দ্রের পদমূলে পতিত হইলেন। গিরিজায়া অন্তরে গেল।
দশম পরিচ্ছেদ : এত দিনের পর!
হেমচন্দ্র মৃণালিনীকে হস্তে ধরিয়া তুলিলেন। উভয়ে উভয়ের সম্মুখীন হইয়া দাঁড়াইলেন।
এতকাল পরে দুইজনের সাক্ষাৎ হইল। যে দিন প্রদোষকালে, যমুনার উপকূলে নৈদাঘানিলসন্তাড়িত বকুলমূলে দাঁড়াইয়া, নীলাম্বুয়ীর চঞ্চল-তরঙ্গ-শিরে নক্ষত্ররশ্মির প্রতিবিম্ব নিরীক্ষণ করিতে করিতে উভয়ে উভয়ের নিকট সজলনয়নে বিদায় গ্রহণ করিয়াছিলেন, তাহার পর এই সাক্ষাৎ হইল। নিদাঘের পর বর্ষা গিয়াছে, বর্ষার পর শরৎ যায়, কিন্তু ইঁহাদিগের হৃদয়মধ্যে যে কত দিন গিয়াছে, তাহা কি ঋতুগণনায় গণিত হইতে পারে?
সেই নিশীথ সময়ে স্বচ্ছসলিলা বাপীতীরে, দুইজনে পরস্পর সম্মুখীন হইয়া দাঁড়াইলেন। চারি দিকে সেই নিবিড় বন, ঘনবিন্যস্ত লতাস্রগ্লবিশোভী বিশাল বিটপীসকল দৃষ্টিপথ রুদ্ধ করিয়া দাঁড়াইয়াছিল; সম্মুখে নীলনীরদখণ্ডবৎ দীর্ঘিকা শৈবাল-কুমুদ-কহ্লার সহিত বিস্তৃত রহিয়াছিল। মাথার উপরে চন্দ্রনক্ষত্রজলদ সহিত আকাশ আলোকে হাসিতেছিল। চন্দ্রালোক-আকাশে, বৃক্ষশিরে, লতাপল্লবে, বাপীসোপানে, নীলজলে-সর্বত্র হাসিতেছিল। প্রকৃতি স্পন্দহীনা, ধৈর্যময়ী। সেই ধৈর্যময়ী প্রকৃতির প্রাসাদমধ্যে, মৃণালিনী হেমচন্দ্র মুখে মুখে দাঁড়াইলেন।
ভাষায় কি শব্দ ছিল না? তাঁহাদিগের মনে কি বলিবার কথা ছিল না? যদি মনে বলিবার কথা ছিল, ভাষায় শব্দ ছিল, তবে কেন ইহারা কথা কহে না? তখন চক্ষুর দেখাতেই মন উন্মত্ত-কথা কহিবে কি প্রকারে? এ সময় কেবলমাত্র প্রণয়ীর নিকটে অবস্থিতিতে এত সুখ যে, হৃদয়মধ্যে অন্য সুখের স্থান থাকে না। যে সে সুখভোগ করিতে থাকে, সে আর কথার সুখ বাসনা করে না।
সে সময়ে এত কথা বলিবার থাকে যে, কোন্ কথা আগে বলিব, তাহা কেহ স্থির করিতে পারে না।
মনুষ্যভাষায় এমন কোন্ শব্দ আছে যে, সে সময়ে প্রযুক্ত হইতে পারে?
তাঁহারা পরস্পরের মুখ নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন। হেমচন্দ্র মৃণালিনীর সেই প্রেমময় মুখ আবার দেখিলেন – হৃষীকেশবাক্যে প্রত্যয় দূর হইতে লাগিল। সে গ্রন্থের ছত্রে ছত্রে ত পবিত্রতা লেখা আছে। হেমচন্দ্র তাঁহার লোচনপ্রতি চাহিয়া রহিলেন; সেই অপূর্ব আয়তনশালী, ইন্দীবর-নিন্দী, অন্ত:করণের দর্পণরূপ চক্ষুপ্রতি চাহিয়া রহিলেন-তাহা হইতে কেবল প্রেমাশ্রু বহিতেছে!-সে চক্ষু যাহার, সে কি অবিশ্বাসিনী!
হেমচন্দ্র প্রথমে কথা কহিলেন। জিজ্ঞাসা করিলেন, “মৃণালিনী! কেমন আছ?”
মৃণালিনী উত্তর করিতে পারিলেন না। এখনও তাঁহার চিত্ত শান্ত হয় নাই; উত্তরের উপক্রম করিলেন, কিন্তু আবার চক্ষু জলে ভাসিয়া গেল। কণ্ঠ রুদ্ধ হইল, কথা সরিল না।
হেমচন্দ্র আবার জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি কেন আসিয়াছ?”
মৃণালিনী তথাপি উত্তর করিতে পারিলেন না। হেমচন্দ্র তাঁহার হস্ত ধারণ করিয়া সোপানোপরি বসাইলেন, স্বয়ং নিকটে বসিলেন, মৃণালিনীর যে কিছু চিত্তের স্থিরতা ছিল, এই আদরে তাহার লোপ হইল। ক্রমে ক্রমে তাঁহার মস্তক আপনি আসিয়া হেমচন্দ্রের স্কন্ধে স্থাপিত হইল, মৃণালিনী তাহা জানিয়াও জানিতে পারিলেন না। মৃণালিনী আবার রোদন করিলেন-তাঁহার অশ্রুজলে হেমচন্দ্রের স্কন্ধ, বক্ষ: প্লাবিত হইল। এ সংসারে মৃণালিনী যত সুখ অনুভূত করিয়াছিলেন, তন্মধ্যে কোন সুখই এই রোদনের তুল্য নহে।
হেমচন্দ্র আবার কথা কহিলেন, “মৃণালিনী! আমি তোমার নিকট গুরুতর অপরাধ করিয়াছি। সে অপরাধ আমার ক্ষমা করিও। আমি তোমার নামে কলঙ্ক রটনা শুনিয়া তাহা বিশ্বাস করিয়াছিলাম। বিশ্বাস করিবার কতক কারণও ঘটিয়াছিল-তাহা তুমি দূর করিতে পারিবে। যাহা আমি জিজ্ঞাসা করি, তাহার পরিষ্কার উত্তর দাও |”
মৃণালিনী হেমচন্দ্রের স্কন্ধ হইতে মস্তক না তুলিয়া কহিলেন, “কি?”
হেমচন্দ্র বলিলেন, “তুমি হৃষীকেশের গৃহ ত্যাগ করিলে কেন?”
ঐ নাম শ্রবণমাত্র কুপিতা ফণিনীর ন্যায় মৃণালিনী মাথা তুলিল। কহিল, হৃষীকেশ আমাকে গৃহ হইতে বিদায় করিয়া দিয়াছে |”
হেমচন্দ্র ব্যথিত হইলেন-অল্প সন্দিহান হইলেন-কিঞ্চিৎ চিন্তা করিলেন। এই অবকাশে মৃণালিনী পুনরপি হেমচন্দ্রের স্কন্ধে মস্তক রাখিলেন। সে সুখাসনে শিরোরক্ষা এত সুখ যে, মৃণালিনী তাহাতে বঞ্চিত হইয়া থাকিতে পারিলেন না।
হেমচন্দ্র জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেন তোমাকে হৃষীকেশ গৃহবহিষ্কৃত করিয়া দিল?”
মৃণালিনীকে হৃদয়মধ্যে মুখ লুকাইলেন। অতি মৃদুরবে কহিলেন, “তোমাকে কি বলিব? হৃষীকেশ আমাকে কুলটা বলিয়া তাড়াইয়া দিয়াছে |”
শ্রুতমাত্র তীরের ন্যায় হেমচন্দ্র দাঁড়াইয়া উঠিলেন। মৃণালিনীর মস্তক তাঁহার বক্ষশ্চ্যুত হইয়া সোপানে আহত হইল।
“পাপীয়সি-নিজমুখে স্বীকৃতা হইলি!” এই কথা দন্তমধ্য হইতে ব্যক্ত করিয়া হেমচন্দ্র বেগে প্রস্থান করিলেন। পথে গিরিজায়াকে দেখিলেন; গিরিজায়া তাঁহার সজলজলদভীম মূর্তি দেখিয়া চমকিয়া দাঁড়াইল। লিখিতে লজ্জা করিতেছে-কিন্তু না লিখিলে নয়-হেমচন্দ্র পদাঘাতে গিরিজায়াকে পথ হইতে অপসৃতা করিলেন। বলিলেন, “তুমি যাহার দূতী, তাহাকে পদাঘাত করিলে আমার চরণ কলঙ্কিত হইত |” এই বলিয়া হেমচন্দ্র চলিয়া গেলেন।
যাহার ধৈর্য নাই, যে ক্রোধের জন্মমাত্র অন্ধ হয়, সে সংসারের সকল সুখে বঞ্চিত। কবি কল্পনা করিয়াছেন যে, কেবল অধৈর্যমাত্র দোষে বীরশ্রেষ্ঠ দ্রোণাচার্যের নিপাত হইয়াছিল। “অশ্বত্থামা হত:” এই শব্দ শুনিয়া তিনি ধনুর্বাণ ত্যাগ করিবেন। প্রশ্নান্তর দ্বারা সবিশেষ তত্ত্ব লইলেন না। হেমচন্দ্রের কেবল অধৈর্য নহে-অধৈর্য, অভিমান, ক্রোধ।
শীতল সমীরণময়ী ঊষার পিঙ্গল মূর্তি বাপীতীর-বনে উদয় হইল। তখনও মৃণালিনী আহত মস্তক ধারণ করিয়া সোপানে বসিয়া আছেন। গিরিজায়া জিজ্ঞাসা করিল, “ঠাকুরাণি, আঘাত কি গুরুতর বোধ হইতেছে?”
মৃণালিনী কহিলেন, “কিসের আঘাত?
গি। মাথায়।
মৃ। মাথায় আঘাত? আমার মনে হয় না।