পরদিন থানায়
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
পরদিন থানায় গিয়ে দারোগাবাবুর সঙ্গে দেখা করে আমার পরিচয় দিলাম।
তিনি আমায় সমাদর করে বসালেনআমায় বললেন, তাঁর দ্বারা যতদূর সাহায্য হওয়া সম্ভব তা তিনি করবেন।
আমি বললাম–আপনি এ-সম্বন্ধে কিছু তদন্ত করেছেন?
তদন্ত করা শেষ করেছি। তবে, আসামি বার-করা ডিটেকটিভ ভিন্ন সম্ভব নয় এক্ষেত্রে।
ননী ঘোষকে আমার সন্দেহ হয়।
আমারও হয়, কিন্তু ওর বিরুদ্ধে প্রমাণ সংগ্রহ করা সহজ হবে না।
ওকে চালান দিন না, ভয় খেয়ে যাক! খুনের রাত্রে ও অনুপস্থিত ছিল। কোথায় ছিল তার সন্তোষজনক প্রমাণ দিতে পারেনি।
আপনি ওকে চালান দিতে পরামর্শ দেন?
দিলে ভালো হয়। এর মধ্যে আর একটা উদ্দেশ্য আছে–বুঝেছেন নিশ্চয়ই।
দারোগাবাবু হেসে বললেন–এতদিন পুলিসের চাকরি করে তা আর বুঝিনি মশায়? ওকে চালান দিলে সত্যিকার হত্যাকারী কিছু অসতর্ক হয়ে পড়বে এবং যদি গা-ঢাকা দিয়ে থাকে, তবে বেরিয়ে আসবে–এই তো?
ঠিক তাই–যদিও ননী ঘোষকে আমি বেশ সন্দেহ করি। লোকটা ধূর্ত-প্রকৃতির।
কাল আমি লোকজন নিয়ে গ্রামে গিয়ে ডেকে বলব–ননীকে কালই চালান দেব।
চালান দেওয়ার সময় গ্রামের সব লোকের সেখানে উপস্থিত থাকা দরকার।
দারোগাবাবু বললেন–দাঁড়ান, একটা কথা আছে। হিসেবের খাতার একখানা পাতা সেদিন কুড়িয়ে পেয়েছিলাম গাঙ্গুলিমশায়ের ঘরে। পাতাখানা একবার দেখুন।
একখানা হাতচিঠে-কাগজের পাতা নিয়ে এসে দারোগাবাবু আমার হাতে দিলেন।
আমি হাতে নিয়ে বললাম–এ তো ননীর হাতের লেখা নয়!
না, এ গণেশের হাতের লেখাও নয়।
সরফরাজ তরফদারও নয়। কারণ, সে মারা যাওয়ার পরে লেখা। তারিখ দেখুন।
তবে, খুনের অনেকদিন আগে এ লেখা হয়েছে–চার মাসেরও বেশি আগে।
ব্যাপারটা ক্রমশ জটিল হয়ে পড়ছে মশায়। আমি একটা জিনিস আপনাকে তবে দেখাই।
দারোগাবাবুর হাতে কাঠের পাতটা দিয়ে বললাম–এ-জিনিসটা দেখুন।
দারোগাবাবু সেটা হাতে নিয়ে বললেন–কী এটা?
কী জিনিসটা তা ঠিক বলতে পারব না। তবে গাঙ্গুলিমশায়ের বাড়ির পেছনের জঙ্গলে এটা কুড়িয়ে পেয়েছি। আর একটা জিনিস দেখুন।
বলে শেওড়ালের গোড়াটা তাঁর হাতে দিতেই তিনি অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে চেয়ে বললেন–এ তো একটা শুকনো গাছের ডাল–এতে কী হবে?
ওতেই একটা মস্ত সন্ধান দিয়েছে। জানেন? যে খুন করেছে, সে ভোর রাত পর্যন্ত গাঙ্গুলিমশায়ের বাড়ি ছাড়েনি। ভোরের দিকে রাত পোহাতে দেরি নেই দেখে সরে পড়েছে। যাবার সময় অভ্যাসের বশে শেওড়াডালের দাঁতন করেছে।
দারোগামশায় হো হো করে হেসে উঠে বললেন–আপনারা যে দেখচি মশায়, স্বপ্নরাজ্যে বাস করেন! এত কল্পনা করে পুলিশের কাজ চলে? কোথায় একটা দাঁতনকাঠির ভাঙা গোড়া!
আমি জানি আমার গুরু মি. সোম একবার একটা ভাঙা দেশলাইয়ের কাঠিকে সূত্র ধরে আসামি পাকড়েছিলেন।
দারোগাবাবু হাসতে হাসতে বললেন– বেশ, আপনিও ধরুন না দাঁতনকাঠি থেকে, আমার আপত্তি কী?
যদি আমি এটাকে এত প্রয়োজনীয় মনে না করতাম, তবে এটা এতদিন সঙ্গে নিয়ে বেড়াই? যে দুটো জিনিস পেয়েছি, তাদের মধ্যে পরস্পর সম্বন্ধ আছে–এও আমার বিশ্বাস।
কীরকম?
যে দাঁতন কাঠি ভেঙেছে–তার বা তাদের দলের লোকেরা এই কাঠের পাতখানাও।
পাতাখানা কী?
সে-কথা পরে বলব? আর একটা সন্ধান দিয়েছে এই দাঁতনকাঠিটা।
কী?
সেটা এই: দোষীর বা দোষীর দলের কারো দাঁতন করবার অভ্যেস আছে। দাঁতন করবার যার প্রতিদিনের অভ্যেস নেই–সে এ-রকম দাঁতন নিপুণভাবে মোচড় দিয়ে ভাঙতে জানবে না। এবং সম্ভবত সে বাঙালি এবং পল্লিগ্রামবাসী। হিন্দুস্থানিরা দাঁতন করে, কিন্তু দেখবেন, তারা শেওড়াডালের দাঁতন করতে জানে না–তারা নিম, বা বাবলা গাছের দাঁতনকাঠি ব্যবহার করে সাধারণত। এ লোকটা বাঙালি এ-বিষয়ে ভুল নেই।
সেইদিনই আমি কলকাতায় মি. সোমের সঙ্গে দেখা করলাম। শেওড়ালের গোড়াটা আমি তাঁকে দেখাইনি–কাঠের পাতটা তাঁর হাতে দিয়ে বললাম–এটা কী বলে আপনি মনে করেন?
তিনি জিনিসটা দেখে বললেন–এ তুমি কোথায় পেলে?
সে-কথা আপনাকে এখন বলব না, ক্ষমা করবেন।
এটা আসামে মিসমি-জাতির মধ্যে প্রচলিত রক্ষাকবচ। দেখবে? আমার কাছে আছে।
মি. সোমের বাড়িতে নানা দেশের অদ্ভুত জিনিসের একটি প্রাইভেট মিউজিয়াম-মতো আছে। তিনি তাঁর সংগৃহীত দ্রব্যগুলির মধ্যে থেকে সেইরকম একটা কাঠের পাত এনে আমার হাতে দিলেন।
আমি বললাম–আপনারটা একটু বড়ো। কিন্তু চিহ্ন একই–ফুল আর শেয়াল।
এটা ফুল নয়, নক্ষত্র– দেবতার প্রতীক, আর নীচে উপাসনাকারী মানুষের প্রতীক পশু!
কোন দেশের জিনিস বললেন?
নাগা পর্বতের নানা স্থানে এ-কবচ প্রচলিত–বিশেষ করে ডিব্ৰু-সদিয়া অঞ্চলে।
আমি তাঁর হাত থেকে আমার পাতটা নিয়ে তারপর বললাম–এই শেওড়াডালটা ক দিনের ভাঙা বলে মনে হয়?
তিনি বললেন–ভালো করে দেখে দেব? আচ্ছা, বোসো।
সেটা নিয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকে একটু পরে ফিরে এসে বললেন–আট ন-দিন আগে ভাঙা।
আমি তাঁর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলাম নিজের বাসায়।
.
সপ্তম পরিচ্ছেদ
আমার মনে একটা বিশ্বাস ক্রমশ দৃঢ়তর হয়ে উঠছে। গাঙ্গুলিমশায়কে খুন করতে এবং খুনের পরে তাঁর ঘরের মধ্যে খুঁড়ে দেখতে খুনির লেগেছিল সারারাত। যুক্তির দিক থেকে হয়তো এর অনেক দোষ বার করা যাবে–কিন্তু আমি অনেক সময় অনুমানের ওপর নির্ভর করে অগ্রসর হয়ে সত্যের সন্ধান পেয়েছি।
কিন্তু ননী ঘোষকে আমি এখনও রেহাই দিইনি। শ্যামপুরে ফিরেই আমি আবার তার সঙ্গে দেখা করলাম। আমায় দেখে ননীর মুখ শুকিয়ে গেল–তাও আমার চোখ এড়াল না।
বললাম– শোনো ননী, আবার এলাম তোমায় জ্বালাতে-কতকগুলি কথা জিগ্যেস করব।
আজ্ঞে, বলুন!
গাঙ্গুলিমশায় যেদিন খুন হন, সে-রাত্রে তুমি কোথায় ছিলে?
ননীর মুখ বিবর্ণ হয়ে গেল। বললে, আজ্ঞে …
বলো কোথায় ছিলে। বাড়ি ছিলে না–;
আজ্ঞে না। সামটায় শ্বশুরবাড়ি যেতে যেতে সেদিন দেবনাথপুরের হাটতলায় রাত কাটাই।
কেউ দেখেচে তোমায়?
ননী বললে–আজ্ঞে, তা যদিও দেখেনি—
কেন দেখেনি।
রাত হয়ে গেল দেখে ওখানে আশ্রয় নিয়েছিলাম। তখন কেউ সেখানে ছিল না।
খেয়াঘাট পার হওনি দেবনাথপুরে?
হ্যাঁ বাবু। অনেক লোক একসঙ্গে পার হয়েছিল। আমায় তো পাটনি চিনে রাখেনি!
বাড়ি এসেছিলে কবে?
শনিবার দুপুর বেলা।
গাঙ্গুলিমশায় খুন হয়েচেন কার মুখে শুনলে?
আজ্ঞে, গাঁয়ে ঢুকেই মাঠে কাঁপালিদের মুখে শুনি।
কার মুখে শুনেছিলে তার নাম বলো।
আজ্ঞে, ঠিক মনে হচ্ছে না, বোধ হয় হীরু কাপালি–
তার কাছে গিয়ে প্রমাণ করে দিতে পারবে?
ননী ইতস্তত করে বললে– আজ্ঞে, ঠিক তো মনে নেই; যদি হীরু না হয়?
ননীর কথায় আমার সন্দেহ আরও বেশি হল। সে-রাত্রে ও ঘরে ছিল না, অথচ কোথায় ছিল তা পরিষ্কার প্রমাণও দিতে পারছে না। গোপনে সন্ধান নিয়ে আরও জানলাম, ননী সম্প্রতি কলকাতায় গিয়েছিল। আজ দু-দিন হল এসেছে। ননীকে জিজ্ঞেস করে কোনো লাভ নেই, ও সত্যি কথা বলবে না। একটা কিছু কান্ড ও ঘটাচ্ছে নাকি তলে তলে? কিছু বোঝা যাচ্চে না!
দু-দিন পরে শ্রীগোপাল এসে আমায় খবর দিলে, গ্রামের মহীন স্যাকরাকে সে ডেকে এনেচে–আমায় সঙ্গে দেখা করবে, বিশেষ কাজ আছে।
মহীন স্যাকরার বয়স প্রায় পঞ্চাশের ওপর। নিতান্ত ভালোমানুষ গ্রাম্য-স্যাকরা, ঘোরপ্যাঁচ জানে না বলেই মনে হল।
শ্রীগোপালকে বললাম–একে কেন এনেচ?
এ কী বলছে শুনুন।
কী মহীন?
বাবু, ননী ঘোষ আমার কাছে এগারো ভরি সোনার তাবিজ আর হার তৈরি করে নিয়েছে –আজ তিন-চারদিন আগে।
দাম কত?
সাতাশ টাকা করে ভরি, হিসেব করুন।
টাকা নগদ দিয়েছিল?
হ্যাঁ বাবু।
সে টাকা তোমার কাছে আছে? নোট, না নগদ?
নগদ। টাকা নেই বাবু, তাই নিয়ে মহাজনের ঘর থেকে সোনা কিনে এনে গহনা গড়ি!
দু-একটা টাকাও নেই?
না বাবু।
তোমার মহাজনের কাছে আছে?
বাবু, রানাঘাটের শীতল পপাদ্দারের দোকানে কত সোনা কেনা-বেচা হচ্ছে দিনে। আমার সে টাকা কী তারা বসিয়ে রেখেছে?
শীতল পোদ্দার নাম? আমার সঙ্গে তুমি চলো রানাঘাটে আজই।
.
বেলা তিনটের ট্রেনে মহীন স্যাকরাকে নিয়ে রানাঘাটে শীতল পোদ্দারের দোকানে হাজির হলাম। সঙ্গে মহীনকে দেখে বুড়ো পোদ্দারমশায় ভাবলে, বড়ো খরিদ্দার একজন এনেচে মহীন। তাদের আদর-অভ্যর্থনাকে উপেক্ষা করে আমি আসল কাজের কথা পাড়লাম, একটু কড়া–রুক্ষস্বরে।
বললাম– সেদিন এই মহীন আপনাদের ঘর থেকে সোনা কিনেছিল এগারো ভরি?
পোদ্দারের মুখ বিবর্ণ হয়ে উঠল ভয়ে–ভাবলে, এ নিশ্চয়ই পুলিশের হাঙ্গামা! সে ভয়ে ভয়ে বললে–হ্যাঁ বাবু, কিনেছিল।
টাকা নগদ দেয়?
তা দিয়েছিল।
সে টাকা আছে?
না বাবু, টাকা কখনো থাকে? আমাদের বড়ো কারবার কোথাকার টাকা কোথায় গিয়েছে!
আমিও ওকে দেখানোর জন্যে কড়া সুরে বললাম–ঠিক কথা বলো। টাকা যদি থাকে আনিয়ে দাও তোমার ভয় নেই! চুরির ব্যাপার নয়, মহীনের কোনো দোষ নেই। তোমাদের কোনো পুলিসের হাঙ্গামায় পড়তে হবে না– কেবল কোর্টে সাক্ষী দিতে হতে পারে। টাকা বার করো।
মহীনও বললে– পোদ্দারমশায়, আমাদের কোনো ভয় নেই, বাবু বলেচেন। টাকা যদি থাকে, দেখান বাবুকে।
পোদ্দার বললে–কিন্তু বাবু, একটা কথা। টাকা তো সব সমান, টাকার গায়ে কি নাম লেখা আছে?
সে-কথায় তোমার দরকার নেই। নাম লেখা থাক না থাক–টাকা তুমি বার করো।
.
অষ্টম পরিচ্ছেদ
শীতল পোদ্দার টাকা বার করে নিয়ে এল একটা থলির মধ্যে থেকে। বললে– সেদিনকার তহবিল আলাদা করা ছিল। সোনা বিক্রির তহবিল আমাদের আলাদা থাকে, কারণ, এই নিয়ে মহাজনের সোনা কিনতে যেতে হয়। টাকা হাতে নিয়ে দেখবার আগেই শীতল একটা কথা বললে– যা আমার কাছে আশ্চর্য বলে মনে হল। সে বললে–বাবু, এগুলো পুরোনো টাকা, পোঁতা-টোতা ছিল বলে মনে হয়, এ চুরির টাকা নয়।
আমি প্রায় চমকে উঠলাম ওর কথা শুনে! মহীন স্যাকরার মুখ দেখি বিবর্ণ হয়ে উঠেছে।
আমি বললাম–তুমি কী করে জানলে এ পুরোনো টাকা?
দেখুন আপনিও হাতে নিয়ে! পুরোনো কলঙ্ক-ধরা রুপো দেখলে আমাদের চোখে কি চিনতে বাকি থাকে বাবু। এই নিয়ে কারবার করচি যখন!
কতদিনের পুরোনো টাকা এ?
বিশ-পঁচিশ বছরের।
টাকাগুলো হাতে নিয়ে পরীক্ষা করে দেখলাম, বিশ বৎসরের পরের কোনো সালের অঙ্ক টাকার গায়ে লেখা নেই। বললাম–মাটিতে পোঁতা টাকা বলে ঠিক মনে হচ্চে?
নিশ্চয়ই বাবু। পেতলের হাঁড়িতে পোঁতা ছিল। পেতলের কলঙ্ক লেগেচে টাকার গায়ে।
আচ্ছা, তুমি এ-টাকা আলাদা করে রেখে দাও। আমি পুলিশ নই, কিন্তু পুলিশ শিগগির এসে এ-টাকা চাইবে মনে থাকে যেন।
শীতল পোদ্দার আমার সামনে হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে অনুনয়ের সুরে বললে- দোহাই বাবু, দেখবেন, যেন আমি এর মধ্যে জড়িয়ে না পড়ি। কোনো দোষে দোষী নই বাবু, মহীন আমার পুরোনো খাতক আর খদ্দের, ও কোথা থেকে টাকা এনেচে তা কেমন করে জানব বাবু, বলুন?
মহীনকে নিয়ে দোকানের বাইরে চলে এলাম। দেখি, ও ভয়ে কেমন বিবর্ণ হয়ে উঠেছে। বললাম–কী মহীন তোমার ভয় কী? তুমি গাঙ্গুলিমশায়কে খুন করনি তো?
মহীন বললে–খুন? গাঙ্গুলিমশায়কে? কী যে বলেন বাবু?
দেখলাম ওর সর্বশরীর যেন থরথর করে কাঁপছে।
কেন, ওর এত ভয় হল কীসের জন্যে?
আমরা ডিটেকটিভ, আসামি ধরতে বেরিয়ে কাউকে সাধু বলে ভাবা আমাদের স্বভাব নয়। মি. সোম আমার শিক্ষাগুরু–তাঁর একটি মূল্যবান উপদেশ হচ্ছে, যে-বাড়িতে খুন হয়েছে বা চুরি হয়েছে– সে বাড়ির প্রত্যেককেই ভাববে খুনি ও চোর। প্রত্যেককে সন্দেহের চোখে দেখবে, তবে খুনের কিনারা করতে পারবে–নতুবা পদে পদে ঠকতে হবে।
ননী ঘোষ তো আছেই এর মধ্যে, এ-সন্দেহ আমার এখন বদ্ধমূল হল। বিশেষ করে টাকা দেখবার পরে আদৌ সে-সন্দেহ না থাকবারই কথা।
কিন্তু এখন আবার একটা নতুন সন্দেহ এসে উপস্থিত হল।
এই মহীন স্যাকরার সঙ্গে খুনের কী কোনো সম্পর্ক আছে?
কথাটা ট্রেনে বসে ভাবলাম। মহীনও কামরায় একপাশে বসে আছে। সে আমার সঙ্গে একটা কথাও বলেনি–জানলা দিয়ে পান্ডুর বির্বণ মুখে ভীত চোখে বাইরের দিকে শূন্যদৃষ্টিতে চেয়ে আছে। মহীনের যোগাযোগে ননী ঘোষ খুন করেনি তো? দুজনে মিলে হয়তো এ-কাজ করেছে। কিংবা এমনও কী হতে পারে না যে, মহীনই খুন করেছে, ননী ঘোষ নির্দোষ?
তবে একটা কথা, ননী ঘোষের হাতেই খাতাপত্র–কত টাকা আসচে-যাচ্চে, ননীই তো জানত, মহীন স্যাকরা সে-খবর কী করে রাখবে!…
তখুনি একটা কথা মনে পড়ল। গাঙ্গুলিমশায় ছিলেন সরলপ্রাণ লোক, যেখানে-সেখানে নিজের টাকাকড়ির গল্প করে বেড়াতেন, সবাই জানে।
মহীনকে বললাম তোমার দোকানে অনেকে বেড়াতে যায়, না?
মহীন যেন চমকে উঠে বললে–হ্যাঁ বাবু।
গাঙ্গুলিমশায়ও যেতেন?
তা যেতেন বই কী বাবু।
গিয়ে গল্প-টল্প করতেন?
তা করতেন বই কী বাবু!
টাকাকড়ির কথা কখনো বলতেন তোমার দোকানে বসে?
সেটা তো তাঁর স্বভাব ছিল– সে-কথাও বলতেন মাঝে মাঝে।
ননী ঘোষের সঙ্গে তোমার খুব মাখামাখি ভাব ছিল?
আমার দোকানে আসত গহনা গড়াতে। আমার খদ্দের। এ থেকে যা আলাপ–তা ছাড়া সে আমার গাঁয়ের লোক। খুব মাখামাখি ভাব আর এমন কী থাকবে? যেমন থাকে।
তুমি আর ননী দু-জনে মিলে গাঙ্গুলিমশায়কে খুন করে টাকা ভাগাভাগি করে নিয়েচ– কেমন কী না?
এই প্রশ্ন করেই আমি ওর মুখের দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে চেয়ে দেখলাম। ভয়ের রেখা ফুটে উঠল ওর মুখে! ও আমার মুখের দিকে বড়ো বড়ো চোখ করে বললে–কী যে বলেন বাবু! আমি বেহ্মহত্যার পাতক হব টাকার জন্যে! দোহাই ধর্ম, আপনাকে সত্যিকথা বলছি বাবু!
কিছু বুঝতে পারা গেল না। কেউ-কেউ থাকে, নিপুণ ধরনের স্বাভাবিক অভিনেতা। তাদের কথাবার্তা, হাবভাবে বিশ্বাস করলেই ঠকতে হয়–এ আমি কতবার দেখেছি।
শ্যামপুরে ফিরে আমি গাঙ্গুলিমশায়ের ছেলে শ্রীগোপালের সঙ্গে দেখা করলাম। শ্রীগোপাল বললে–থানা থেকে দারোগাবাবু আর ইনস্পেক্টরবাবু এসেছিলেন। আপনাকে খুঁজছিলেন।
তুমি গহনার কথা কিছু বললে নাকি তাঁদের?
না। আমি কেন সে-কথা বলতে যাব। আমাকে কোনো কথা তো বলে দেননি?
বেশ করে।
ওঁরা আপনার সেই কাঠের তক্তামতো-জিনিসটা দেখতে চাইছিলেন।
কেন?
সে-কথা কিছু বলেননি।
তাঁরা ও দেখে কিছু করতে পারেন, আমি তাঁদের দিয়ে দিতে প্রস্তুত আছি, কিন্তু তাঁরা পারবেন বলে আমার ধারণা নেই।
বিকেলের দিকে আমি নির্জনে বসে অনেকক্ষণ ভাবলাম। … আমার দৃঢ় বিশ্বাস, মিসমিজাতির কাষ্ঠনির্মিত রক্ষাকবচের সঙ্গে এই খুনির যোগ আছে। সেই রক্ষাকবচ প্রাপ্তি এমন একটা অপ্রত্যাশিত ঘটনা যে, আমার কাছে সেটা রীতিমতো সমস্যা হয়ে উঠছে ক্রমশ।
ননী ঘোষের সঙ্গেও এর সম্পর্ক এমন নিবিড় হয়ে উঠেচে, যেটা আর কিছুতেই উপেক্ষা করা চলে না। শীতল পোদ্দারের দোকানের টাকার কথা যদি পুলিশকে বলি, তবে তারা এখুনি ননীকে গ্রেপ্তার করে। কিন্তু সেদিক থেকে মস্ত বাধা হচ্ছে, সে-টাকা যে ননী ঘোষ দিয়েছিল মহীনকে, তার প্রমাণ কী?
মহীনের কথার উপর নির্ভর করা ছাড়া এক্ষেত্রে অন্য কোনো প্রমাণ নেই!
শীতল পোদ্দারও তো ভুল করতে পারে!
হয়তো এমনও হতে পারে, মহীন স্যাকরাই আসল খুনি। তার দোকানে বসে গাঙ্গুলিমশায় কখনো টাকার গল্প করে থাকবেন–তারপর সুবিধে পেয়ে মহীন গাঙ্গুলিমশায়কে খুন করেছে, পোঁতা-টাকা পোদ্দারের দোকানে চালিয়ে এখন ননীর ওপর দোষ চাপাচ্ছে…
ননী ঘোষের সঙ্গে সন্ধ্যার সময় দেখা করলাম।
ওকে দেখেই কিন্তু আমার মনে কেমন সন্দেহ হল, লোকটার মধ্যে কোথায় কী গলদ আছে, ও খুব সাচ্চা লোক নয়। আমাকে দেখে প্রতিবারই ও কেমন হয়ে যায়।
লোকটা ধূর্তও বটে। ওর চোখ-মুখের ভাবেও সেটা বোঝা যায় বেশ।
ওকে জিজ্ঞেস করলাম–তুমি মহীনের দোকান থেকে তাবিজ গড়িয়েছ সম্প্রতি?
ননী বিবর্ণমুখে আমার দিকে চেয়ে বললে–হ্যাঁ–তা–হ্যাঁ বাবু—
অত টাকা হঠাৎ পেলে কোথায়?
হঠাৎ কেন বাবু! আমরা তিনপুরুষে ঘি-মাখনের ব্যাবসা করি। টাকা হাতে ছিল তা ভাবলাম, নগদ টাকা পাড়াগাঁয়ে রাখা—
টাকা নগদ দিয়েছিলে, না নোটে?
নগদ।
সব টাকা তোমার ঘি-মাখন বিক্রির টাকা?
হ্যাঁ বাবু।
ননীকে ছেড়ে দিয়ে গ্রামের মধ্যে বেড়াতে বেরোলাম। ননী অত্যন্ত ধূর্ত লোক, ওর কাছ থেকে কথা বার করা চলবে না দেখা যাচ্চে।
বেড়াতে বেড়াতে গাঙ্গুলিমশায়ের বাড়ির কাছে গিয়ে পড়েছি, এমন সময় দেখি কে একজন ভদ্রলোক গাঙ্গুলিমশায়ের ছেলে শ্রীগোপালের সঙ্গে দাঁড়িয়ে কথা কইছেন।
আমাকে দেখে শ্রীগোপাল বললে–এই যে! আসুন, চা খাবেন।
না, এখন খাব না। ব্যস্ত আছি।
আসুন, আলাপ করিয়ে দিই…ইনি সুশীল রায়, আর ইনি জানকীনাথ বড়ুয়া, আমাদের পাড়ার জামাই–আমার বাড়ির পাশের ওই বুড়ি-দিদিমার জামাই। উনিও একটু-একটু– মানে–ওঁকে সব বলেছিলাম।
আমি বুঝলাম, জানকী বড়ুয়া আর যাই হোক, সে আমার প্রতিদ্বন্দ্বী আর একজন প্রাইভেট ডিটেকটিভ। মনটা হঠাৎ যেন বিরূপ হয়ে উঠল শ্রীগোপালের প্রতি। সে আমার ওপর এরই মধ্যে আস্থা হারিয়ে ফেলেছে, এবং কোথা থেকে আর-একজন গোয়েন্দা আমদানি করে তাকে সব ঘটনা খুলে বলছিল, আমাকে আসতে দেখে থেমে গিয়েছে।
আমি জানকীবাবুকে বললাম–আপনি কী বুঝচেন?
কী সম্বন্ধে?
খুন সম্বন্ধে।
কিছুই না। তবে আমার মনে হয়–
কী, বলুন?
এখানকার লোকই খুন করেছে।
আপনি বলছেন–এই গাঁয়ের লোক?
এই গাঁয়ের জানাশোনা লোক ভিন্ন এ-কাজ হয়নি। ননী ঘোষের সম্বন্ধে আপনার মনে কী হয়?
আমি বিস্মিতভাবে জানকীবাবুর মুখের দিকে চাইলাম। তাহলে শ্রীগোপাল দেখচি ননী ঘোষের কথাও এই ভদ্রলোকের কাছে বলেচে! ভারি রাগ হল শ্রীগোপালের ব্যবহারে।
আমার ওপর তাহলে আদৌ আস্থা নেই ওর দেখছি।
একবার মনে হল, জানকীবাবুর কথার কোনো উত্তর আমি দেব না। অবশেষে ভদ্রতাবোধেরই জয় হল। বললাম–ননী ঘোষের কথা আপনাকে কে বললে?
কেন, শ্রীগোপালের মুখে সব শুনেছি।
আপনি তাকে সন্দেহ করেন?
খুব করি। তার সঙ্গে এখুনি দেখা করা দরকার। তার হাতেই যখন টাকার হিসেব লেখা হত…
দেখুন না, ভালোই তো।
হঠাৎ আমার দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে চেয়ে জানকীবাবু বলেন–আচ্ছা, আপনি ঘটনাস্থলে ভালো করে খুঁজেছিলেন?
খুঁজেছিলাম বই কী।
কিছু পেয়েছিলেন?
আমি জানকীবাবুর এ-প্রশ্নে দস্তুরমতো বিস্মিত হলাম। যদি তিনি নিজেও একজন গোয়েন্দা হন, তবে তাঁর পক্ষে অন্য-একজন সমব্যবসায়ী লোককে একথা জিগ্যেস করা শোভনতা ও সৌজন্যের বিরুদ্ধে, বিশেষত যখন আগে-থেকেই এ ব্যাপারের অনুসন্ধানে আমি নিযুক্ত আছি।
আমি নিস্পৃহভাবে উত্তর দিলাম–না। এমন বিশেষ কিছু না।
জানকীবাবু পুনরায় জিগ্যেস করলেন–তাহলে কিছুই পাননি?
কিছুই না তেমন।
কাঠের পাতের কথাটা জানকীবাবুকে বলবার আমার ইচ্ছে হল না। জানকীবাবুকে বলে কী হবে? তিনি কি বুঝতে পারবেন জিনিসটা আসলে কী? মি. সোমের সাহায্য ব্যতীত কি আমারই বোঝার কোনো সাধ্য ছিল? মি. সোমের মতো পন্ডিত ও বিচক্ষণ গোয়েন্দা খুব বেশি নেই এদেশে, এ আমি হলপ করে বলতে পারি।
জানকীবাবু চলে গেল আমি শ্রীগোপালকে বললাম–তুমি একে কী বলেছিলে?
কী বলব!
ননী ঘোষের কথা বলেচ?
হ্যাঁ, তা বলেছি।
আমি ওকে তিরস্কারের সুরে বললাম–আমাকে তোমার বিশ্বাস না হতে পারে–তা বলে আমার আবিষ্কৃত ঘটনা-সূত্রগুলি তোমার অন্য ডিটেকটিভকে দেওয়ার কী অধিকার আছে?
শ্রীগোপাল চুপ করে রইল। ওর নির্বুদ্ধিতায় ও অবিবেচকতায় আমি যারপরনাই বিরক্তি বোধ করলাম।
.
নবম পরিচ্ছেদ
সেদিন সন্ধ্যার কিছু আগে আনি মহীন স্যাকরার সঙ্গে আবার দেখা করতে গেলাম। মহীন আমায় দেখে ভয়ে-ভয়ে একটা টুল পেতে দিল বসবার জন্যে।
আমি বললাম–মহীন, একটা সত্যি কথা বলবে?
কী, বলুন!
তোমার সঙ্গে ননীর ঝগড়া-বিবাদ হয়েছিল কিছুকাল আগে?
মহীন আমার দিকে অবাক হয়ে চেয়ে থেকে বললে–ননী বলেচে বুঝি? সব মিথ্যে কথা ওর বাবু, সব মিথ্যে।
আমি কড়াসুরে বললাম–ঝগড়া হয়েছিল তাহলে? সত্যি বলো!
মহীন চুপ করে রইল অনেকক্ষণ, তারপর আস্তে-আস্তে বললে–হয়েছিল বাবু, কিন্তু আমার তাতে কোনো দোষ…
আমি সে-কথা বলিনি–ঝগড়া হয়েছিল কিনা জিজ্ঞেস করচি।
হ্যাঁ বাবু।
কী নিয়ে ঝগড়া হয়েছিল, বলো এবার!
সোনার দর নিয়ে বাবু।
আচ্ছা, তুমি শ্রীগোপালের কাছে ননী ঘোষের তাবিজ গড়ানোর কথা এইজন্যে বলেছিল –কেমন, ঠিক কিনা?
হ্যাঁ বাবু।
তুমি তখন ভেবেছিল যে ননী ঘোষই খুন করেছে?
তা—না–
ঠিক বলো।
না বাবু।
তাহলে তুমিও যে দোষী হবে আইনত; তাই ভাবচ বুঝি?
মহীন স্যাকরা ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপতে লাগল, বললে–বাবু, তা–তা—
তোমাকে গ্রেপ্তারের জন্যে থানায় খবর দেব!
মহীন আমার পা জড়িয়ে ধরে বললে– দোহাই বাবু, আমার সব কথা শুনুন আগে। আপনি দেশের লোক–আমার সর্বনাশ করবেন না বাবু-কাচ্চা-বাচ্চা মারা যাবে।
কী, বলো!
তখন আমিও লুটের টাকা বলে সন্দেহ করিনি। কী করে করব! বলুন বাবু, তা কি সম্ভব?
তবে, কখন সন্দেহ করলে?
বাবু, শ্রীগোপালই আমায় বললে, আপনি ননী ঘোষকে সন্দেহ করেন। তখন আমি ভাবলাম, গহনার কথাটা প্রমাণ না করলে আমি মারা যাব এর পরে। তাই বলেছিলাম।
শ্রীগোপালের নির্বুদ্ধিতা দেখছি নানা দিক থেকে প্রকাশ পাচ্ছে। যদি ওর বাবার খুনের আসামি ধরা না পড়ে, তবে সেটা ওর নির্বুদ্ধিতার জন্যেই ঘটবে।
.
দশম পরিচ্ছেদ
কথাটা শ্রীগোপালকে বলবার জন্যে তার বাড়ির দিকে চললাম।
রাস্তাটা বাড়ির পেছনের দিকে–শিগগির হবে বলে শট-কার্ট করে গেলাম বনের মধ্যে দিয়ে। সেই বন– যেখানে আমি সেদিন মিসমি-জাতির কবচ ও দাঁতনকাঠির গোড়া সংগ্রহ করেছিলাম।
অন্ধকারেই যাচ্ছিলাম, হঠাৎ একটা সাদা-মতো কী কিছু দূরে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম। জিনিসটা নড়চে-চড়চে আবার। অন্ধকারের জন্যে ভয় যেন বুকের রক্ত হিম করে দিলে।
এই বনের পরেই গাঙ্গুলিমশায়ের বাড়ি–গাঙ্গুলিমশায়ের ভূত নাকি রে বাবা!
হঠাৎ একটা টর্চ জ্বলে উঠল–সঙ্গেসঙ্গে কে কড়া-গলায় হাঁকলে, কে ওখানে?
আমিও তো তাই জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলাম– কে আপনি?
আমার সামনে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল একটা মনুষ্যমূর্তি এবং টর্চের আলো-আঁধার কেটে গেলে দেখলাম, সে জানকীবাবু ডিটেকটিভ!
বিস্ময়ের সুরে বললাম–আপনি কী করছিলেন অন্ধকারে বনের মধ্যে?
জানকীবাবু অপ্রতিভ সুরে বললেন–আমি এই—এই—
ও, বুঝেচি। কিছু মনে করবেন না। হঠাৎ এসে পড়েছিলাম এখানে।
না না, কিছু না।
তাড়াতাড়ি পাশ কাটিয়ে চলি এগিয়ে। ভদ্রলোক শুধু অপ্রতিভ নয়, যেন হঠাৎ ভীত ও ত্ৰস্তও হয়ে পড়েছেন। কী মুশকিল! এসব পাড়াগাঁয়ে শহরের মতো বাথরুমের বন্দোবস্ত না থাকাতে সত্যিই অনেকের বড়োই অসুবিধে হয়।
জানকী বড়ুয়া প্রাইভেট-ডিটেকটিভকে এই অন্ধকারে গাঙ্গুলিমশায়ের ভূত বলে মনে হয়েছিল ভেবে আমার খুব হাসি পেল। ভদ্রলোককে কী বিপন্নই করে তুলেছিলাম!
সেদিন সন্ধ্যার পরে শ্রীগোপালের বাড়ি বসে চা খাচ্ছি, এমন সময় জানকীবাবু আমার পাশে এসে বসলেন। তাঁকেও চা দেওয়া হল। জানকীবাবু দেখলাম বেশ মজলিশি লোক, চা খেতে খেতে তিনি নানা মজার মজার গল্প বলতে লাগলেন। আমায় বললেন–আমি তো মশায় গাঁয়ের জামাই, আজ চোদ্দো বছর বিয়ে করেচি, কাকে না চিনি বলুন গ্রামে, সকলেই আমার আত্মীয়।
আমি বললাম–আপনি এখানে প্রায়ই যাতায়াত করেন? তাহলে তো হবেই আত্মীয়তা!
আমার স্ত্রী মারা গিয়েচে আজ বছর তিনেক। তারপর আমি প্রায়ই আসি না। তবে শাশুড়িঠাকরুন বৃদ্ধ হয়ে পড়েছেন, আমায় আসার জন্যে চিঠি লেখেন, না এসে পারিনে।
ছেলেপুলে কী আপনার?
একটি ছেলে হয়েছিল, মারা গিয়েছে। এখন আর কিছুই নেই।
ও।
হঠাৎ জানকীবাবু আমার মুখের দিকে চেয়ে আমায় জিজ্ঞেস করলেন–আচ্ছা, গাঙ্গুলিমশায়ের খুন সম্বন্ধে পুলিস কোনো সূত্র পেয়েছে বলে আপনার মনে হয়?
কেন বলুন তো?
আমার বিশেষ কৌতূহল এ-সম্বন্ধে। গাঙ্গুলিমশায় আমার শ্বশুরের সমান ছিলেন। বড়ো স্নেহ করতেন আমায়। তাঁর খুনের ব্যাপারে একটা কিনারা না হওয়া পর্যন্ত আমার মনে শান্তি নেই। আমার মনে কোনো অহংকার নেই মশায়। আমি এ খুনের কিনারা করি, বা আপনি করুন, বা পুলিশই করুক, আমার পক্ষে সব সমান। যার দ্বারা হোক কাজ হলেই হল। নাম আমি চাইনে।
নাম কে চায় বলুন? আমিও নয়।
তবে আসুন-না আমরা মিলে-মিশে কাজ করি? পুলিশকেও বলুন।
পুলিশ তো খুব রাজি, তারা তো এতে খুব খুশি হবে।
বেশ, তবে কাল থেকে—
আমার কোনো আপত্তি নেই।
আচ্ছা, প্রথম কথা–আপনি কোনো কিছু সূত্র পেয়েছেন কিনা আমায় বলুন। আমি যা পেয়েছি আপনাকে বলি।
আমি এখানে এখন বলব না। পরে আপনাকে জানাব।
ননী ঘোষের ব্যাপারটা আপনি কী মনে করেন?
সেদিন তো আপনাকে বলেচি। ওকে আমার সন্দেহ হয়। আপনি ওকে সন্দেহ করেন?
নিশ্চয় করি।
আপনি ওর বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ পেয়েছেন?
সেই গহনা ব্যাপারটাই তো ওর বিরুদ্ধে একটা মস্ত বড়ো প্রমাণ।
তা আমারও মনে হয়েছে, কিন্তু ওর মধ্যে গোলমালও যথেষ্ট।
মহীন স্যাকরাকে নিয়ে তো? আমি মহীনকে সন্দেহ করিনে।
কেন বলুন তো?
মহীন তো খাতা লিখত না গাঙ্গুলিমশায়ের। ভেবে দেখুন কথাটা।
সে-সব আমিও ভেবেচি। তাতেও জিনিসটা পরিষ্কার হয় না।
চলুন না, দু-জনে একবার ননীর কাছে যাই।
তার কাছে আমি গিয়েছিলাম। তাতে কোনো ফল হবে না।
হিসেবের খাতাখানা কোথায়?
পুলিশের জিম্মায়।
আপনি ভালো করে দেখেচেন খাতাখানা?
দেখেচি বলেই তো ননীকে জড়াতে পারি নে ভালো করে।
কেন?
শুধু ননীর হাতের লেখা নয়, আরও অনেকের হাতের লেখা তাতে আছে।
কার কার?
জানকীবাবু ব্যথভাবে এ-প্রশ্নটা করে আমার মুখের দিকে যেন উৎকণ্ঠিত-আগ্রহে উত্তরের প্রতীক্ষায় চেয়ে রইলেন। আমি মৃত-মুসলমান ভদ্রলোকটির ও স্কুলের ছাত্রটির কথা তাঁকে বললাম। জানকীবাবু বললেন–ও, এই! সে তো আমি জানি–শ্রীগোপালের মুখে শুনেছি।
যা শুনেছেন, তার বেশি আমারও কিছু বলবার নেই।
পরদিন সকালে ননী ঘোষ এসে আমার কাছে হাজির হল। বললে–বাবু, আপনার সঙ্গে একটা কথা আছে।
কী?
জানকীবাবু এ-গাঁয়ের জামাই বলে খাতির করি। কিন্তু উনি কাল রাতে আমায় যে-রকম গালমন্দ দিয়ে এসেছেন, তাতে আমি বড়ো দুঃখিত। বাবু, যদি দোষ করে থাকি, পুলিশে দিন–গালমন্দ কেন?
তুমি বড়ো চালাক লোক ননী। আমি সব বুঝি। পুলিশে দেবার হলে, তোমাকে একদিনও হাজতের বাইরে রাখব ভেবেচ।
বাবুও কি আমাকে এখনও সন্দেহ করেন?
লোকটা সাংঘাতিক ধূর্ত। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এ-খুন যেই করুক, ননী তার মধ্যে নিশ্চয়ই জড়িত। অথচ ও ভেবেচে যে, আমার চোখে ধুলো দেবে!
বললাম–সে-কথা এখন নয়। এক মাসের মধ্যেই জানতে পারবে।
বাবু, আপনি আমাকে যতই সন্দেহ করুন, ধর্ম যতদিন মাথার উপর আছে—
ধূর্ত লোকেরাই ধর্মের দোহাই পাড়ে বেশি! লোকটার উপর সন্দেহ দ্বিগুণ বেড়ে গেল।
.সারাদিন অন্য কাজে ব্যস্ত ছিলাম।
সন্ধ্যার পরে আহারাদি সেরে অনেকক্ষণ বই পড়লাম! তারপর আলো নিবিয়ে দিয়ে নিদ্রা দেবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কেন জানি না–অনেক রাত পর্যন্ত ঘুম হল না এবং বোধ হয়
সেইজন্যই সেই রাতে আমার প্রাণ বেঁচে গেল।
ব্যাপারটা কী হল খুলে বলি।