চতুর্থ পরিচ্ছেদ : বন্দিনী
হুগলী জেলার জীবন পালের বাগানের নাম অনেকেই জানেন। অনেকেই জানেন, এক সময়ে সেই বাগানের নিকট দিয়া দস্যুভয়ে এমনকি দিবালোকেও কেহ যাইতে সাহস করিত না। আমরা যখনকার কথা বলিতেছি, তখন সেইদিক্টা এমন বনজঙ্গলাবৃত ছিল যে, দিবসেও সেখানে যখন- তখন দস্যুরা তাহাদিগের হত্যাকাণ্ড নির্ব্বিঘ্নে সমাধা করিত।
জীবন পালের বাগানের উত্তরপ্রান্তে একটি জীর্ণদশাগ্রস্ত, পুরাতন, পতনোন্মুখ ভাঙাবাড়ী ছিল। তাহার কোন কোন অংশ একেবারে ভাঙিয়া পড়িয়াছে, কোন অংশ পড়-পড়। ছাদের উপর বড় বড় বট, অশ্বত্থ মৌরসীপাট্টা লইয়া, পুত্র-পৌত্র-পরিবার-পরিবৃত হইয়া দখলীকার আছে। প্রকোষ্ঠ সকল ভগ্ন, মলিন, আবৰ্জ্জনাবহুল, মনুষ্যসমাগম-চিহ্নবিরহিত।
সেই নির্জ্জন ভাঙাবাড়ীর অপেক্ষাকৃত পরিষ্কার কোন একটা প্রকোষ্ঠে অনিন্দিতগৌরকান্তি স্নিগ্ধজ্যোতিৰ্ম্ময়রূপিণী অনতীতবাল্যা একটি বালিকা নীরবে অশ্রুবর্ষণ করিতেছিল। মণিষিক্তপদ্মবৎ তাহার মুখ অশ্রুপ্লাবনে একান্ত মলিন; তাহার লাবণ্যোজ্জ্বল দেহ কালিমাবৃত এবং কঙ্কালাবশেষ। কেশরাশি রুক্ষ, জড়িত এবং বিশৃঙ্খল। বালিকা নতমুখে এক-একটি নিঃশ্বাস অতিকষ্টে দুইবারে তিনবারে টানিতেছিল। বালিকার সেই পরমসুন্দর মুখখানি এক্ষণে কাঁদিয়া ম্লান হইলেও তাহার সেই আকর্ণবিশ্রান্ত ফুল্লেন্দীবরতুল্য চক্ষু, এবং সেই আয়ত চক্ষুর মধুরোজ্জ্বল লীলাচঞ্চল দৃষ্টি সেই ম্লানমুখখানিতে এক অননুভূতপূৰ্ব্ব সৌন্দর্য্য বিকাশ করিয়া রাখিয়াছিল। যে কক্ষে সেই বালিকা বসিয়াছিল, তাহা বাহির হইতে অবরুদ্ধ। বালিকা বন্দিনী।
অনেকক্ষণ কাঁদিয়া হৃদয়ের বেগ কিছু প্রশমিত হইলে বালিকা পশ্চিমদিকের একটা জানালার সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল। সেই জানালা পথে প্রবেশ করিয়া বায়ুপ্রবাহ বালিকার রাশীকৃত রুক্ষ কেশভার উড়াইয়া উড়াইয়া একবার তাহার সেই মুখখানির উপরে ফেলিতে লাগিল। পুনশ্চঃ উঠাইয়া ঘুরাইয়া ঘুরাইয়া সেই বিষাদমেঘাচ্ছন্ন মলিন অশ্রুবিবর্ণীকৃত মুখখানি ঢাকিতে লাগিল। এমন যে সুন্দর মুখ! এমন ম্লান? না দেখিয়া ঢাকিয়া রাখাই ভাল, ইহাই বুঝি, কি এই রকম কোন একটা বায়ুর উদ্দেশ্য। বায়ুর যে উদ্দেশ্যই হউক, বালিকা তাহাতে অত্যন্ত বিরক্ত হইতেছিল।
বালিকা একদৃষ্টে দেখিতেছিল, দৃষ্টি-সীমায় স্নিগ্ধোজ্জ্বল রক্তাভ-নীলিমাময় বেলাপ্রান্তে কেমন ধীরে ধীরে আরক্তরবি ক্রমশঃ ডুবিয়া যাইতেছিল; এবং আরও কিছুদূরে কি ভয়ঙ্কর মূর্তিতে নিবিড় মেঘমালা গোধূলির হেমকিরণপরিব্যাপ্ত দিক্চক্রবালে আকাশের সেই মধুর কোমলচ্ছবি ব্যাপিয়া, পুঞ্জীকৃত হইয়া, স্তূপীকৃত হইয়া অল্পে অল্পে চারিদিকে ছড়াইয়া পড়িতেছিল। বালিকার দৃষ্টি সেই সকলের উপরে নিস্পন্দ। অদূরস্থিত প্রচুর ভিন্ন জাতীয় সদ্যঃপ্রস্ফুট বন্যকুসুমের স্নিগ্ধ পরিমল একত্রে মিশিয়া, সেই সংমিশ্রণে আরও মধুর হইয়া, এক অপার্থিব উপহারবৎ নিদাঘসায়াহ্নসমীরণ বহিয়া যেখানে সেই রোরুদ্যমানা, ধূলিধূসরিতা, বিগলিতাশ্রনয়না, বিপদ্-বিহুলা বালিকা প্রস্তরগঠিতের প্রায় একখানি মূৰ্ত্তিমান্ দুঃখের জীর্ণ ছবিটির মত, নীরবে ঈষদুত্তোলিত মুখে দাঁড়াইয়া ছিল, সেইখানে সেই অলোকসম্ভবারূপিণী কিশোরীর চারিদিকে বিস্তৃত হইতেছিল। দূর বনান্তর হইতে কোন কোন মধুরকণ্ঠ পাখীর অমৃতবর্ষিণী কলকণ্ঠগীতি সেই বালিকার নিকটবর্ত্তী সকল স্থানই মুখরিত করিয়া রাখিয়াছিল। বালিকার সেইদিকে লক্ষ্য নাই। বালিকা সেইখানে সেইরূপ নিশ্চলভাবে পাষাণ- প্রতিমার মত অনেকক্ষণ হইতে দাঁড়াইয়া আছে।
ক্রমে অবসন্ন বনতলে ধূসরবসনা সন্ধ্যার অন্ধকার অল্পে অল্পে যখন ঘনাইয়া আসিতে লাগিল এবং তখন সেই আসন্ন সন্ধ্যার অল্প অল্প অন্ধকারে আর পশ্চিম গগনের নিবিড় জমাট মেঘের কাল ছায়ায় সায়াহ্নলীন অস্ফুট ম্রিয়মাণ দিবালোক আরও মলিন হইয়া আসিতে লাগিল, তখন বালিকার উদাসদৃষ্টি চঞ্চল হইয়া প্রকৃতির এক অপূর্ব্ব পরিবর্ত্তন পারম্পর্য্যে সবিস্ময়ে ফিরিতে লাগিল; সহসা সেই আসন্ন সন্ধ্যার অস্পষ্ট আলোকে কি দেখিয়া বালিকা শিহরিয়া উঠিল এবং মুখখানি শুকাইয়া এতটুকু হইয়া গেল! বিদ্যুৎ-স্পৃষ্টার ন্যায় চকিতে তথা হইতে সরিয়া গৃহকোণে গিয়া দাঁড়াইল দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া বালিকা সভয়ে কাঁপিতে লাগিল।