পঞ্চম খণ্ড : প্রতিহিংসা – রক্তে রক্তে : প্রথম পরিচ্ছেদ – ভীষণ আয়োজন
তাহার পর দুই মাস কাটিয়া গিয়াছে। এই দুই মাসের মধ্যে এমন কোন ভীষণ রোমাঞ্চকর ঘটনা ঘটে নাই, যাহাতে কোন পাঠকের সুপ্ত বিস্ময় বিচলিত হইয়া উঠিতে পারে। ইতোমধ্যে সিরাজউদ্দীনের সহিত কুলসমের বিবাহ হইয়া গিয়াছে, এবং তাঁহারা সুখে আছেন শুনিয়া সহৃদয় পাঠক পাঠিকা নিশ্চিন্ত হইবেন, আশা করি। এবং আরও আশঙ্কা করি, শুনিয়া দুঃখিত হইবেন যে, ফুলসাহেবের অন্বেষণে এই দীর্ঘ দুইটি মাস শ্রেষ্ঠ ডিটেকটিভ অরিন্দমের একান্ত নিষ্ফলে কাটিয়া গিয়াছে। যাহা হউক, তথাপি তিনি নিরুদ্যম বা ভগ্নোৎসাহ হইয়া পড়েন নাই; যত সময় যাইতেছে, ফুলসাহেবের জন্য অরিন্দম তেমনি অধীর হইয়া উঠিতেছেন। এই দুই মাস তাঁহার না আছে আহারের ঠিক, না আছে নিদ্রার ঠিক, না আছে মনের ঠিক এবং না আছে স্বাস্থ্যের দিকে দৃপাত্ত অথচ এত পরিশ্রমে কাজ কিছুই হইতেছে না।
এদিকে অরিন্দম ফুলসাহেবকে ধরিবার জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করিতেছেন। ঠিক এই সময়ে লোকালয়ের বহির্ভাগে এক গহন বনের মধ্যে তাঁহার মরণ আকাঙ্ক্ষা করিয়া একটা ভীষণ ষড়যন্ত্র হইতেছে।
যে বাড়ী হইতে অরিন্দম সিরাজউদ্দীনকে উদ্ধার করেন, তাহা অতিক্রম করিয়া পূর্ব্বোক্ত মুখে আরও অনেক দূরে যাইলে প্রকাণ্ড আমবাগান দেখিতে পাওয়া যায়। সে-জায়গাটার নাম কাঁপা। কাঁপার চারিদিকে বড় বড় গাছ, ঘন জঙ্গল এবং নিস্তব্ধতা। সেই নিস্তব্ধতা যেন সজীব, যেন চারিদিক্ ছম্ ছম্ করিতেছে।
রাত্রে চাঁদ উঠিয়াছে, কৃষ্ণাসপ্তমীর ম্রিয়মাণ চন্দ্র। তাহার আলো বনের ভিতরে তেমন আসিতে পারে না, এক-আধ জায়গায় একটু-আধটু; দেখিয়া একান্তই অনাবশ্যক বলিয়া বোধ হয়; কিন্তু সেই বনের পার্শ্বে যেখানে কালুরায়ের জীর্ণ মন্দির, সেখানের অনেকটা স্থান উন্মুক্ত থাকায় নির্বিঘ্নে সেখানে চাঁদের আলো একেবারে প্লাবিত হইয়াছে; কিন্তু সে ভীষণ স্থানে চাঁদের আল্যে যেন কেমন বড় ভয়ানক-ভয়ানক বলিয়া মনে হয়।
এই বনমধ্যস্থ নির্জ্জন মন্দিরটি একজন ডাকাইতের স্থাপিত। অনেকদিন পূর্ব্বে এই মন্দিরের মধ্যে অসংখ্য নরবলি এবং কত লোকের মাথাটা দেহ হইতে পৃথক্ করিবার মন্ত্রণা হইয়া গিয়াছে। আজও এই কৃষ্ণাসপ্তমীর মধ্যরাত্রে অনেকগুলি লোক একসঙ্গে জটলা করিয়া, কবাট বন্ধ করিয়া সেইরূপ একটা ভীষণ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। এবং সেই যড়যন্ত্রের মধ্যে পড়িয়া আপাততঃ রাশি রাশি তামাক ও গাঁজা মুহুর্মুহুঃ ভস্মীভূত হইতেছিল। চারিদিক্ বন্ধ থাকায় অনর্গল ধূম ভিতরে জমাট বাঁধিতেছিল। একপাশে একটি প্রদীপ জ্বলিতেছিল। এবং সেই ধূমরাশি ভেদ করিয়া আলোক বিস্তার করা দুরূহ ব্যাপার মনে করিয়া সেটা যেন ক্রমশঃ নিস্তেজ হইয়া পড়িতেছিল। এমন সময়ে বাহির হইতে রুদ্ধদ্বারে করাঘাতের শব্দে মন্দিরের মধ্যভাগ প্রতিধ্বনিত হইয়া উঠিল।
ভিতর হইতে একজন বলিল, “কে ও?”
বাহির হইতে উত্তর হইল, “আমি!”
বিকৃত মুখ আরও বিকৃত করিয়া দলের ভিতর হইতে একটি তীক্ষ্ণ মেজাজের লোক অতিশয় বিরক্তির সহিত উচ্চৈঃস্বরে বলিয়া উঠিল, “আরে বাপু, আমিও ত, আমি; নম্বর কত?”
“নম্বর ১।”
“আমাদের নিয়ে মোটের উপর?”
“১৩।”
মন্দিরের দ্বার উন্মুক্ত হইল, একটা লোক ভিতরে প্রবেশ করিল। লোকটা আমাদের অপরিচিত নহে—ফুলসাহেব
ফুলসাহেব নিজের নির্দিষ্ট স্থানে গিয়া বসিল। কেহ কোন কথা কহিল না। কিয়ৎপরে ধূমাচ্ছন্ন নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করিয়া ফুলসাহেব বলিল, “আমাদের সকলেই কি আসিয়াছে?”
একজন গণনা করিয়া উত্তর করিল, “হাঁ।”
ফুল। আমাদের উদ্দেশ্যটা কি, তা বোধ হয়, কাহারও জানিতে বাকী নাই?
সকলে। ঠিক প্রতিশোধ লওয়া।
ফুল। আমাদের লক্ষ্য কে?
সকলে। (সমস্বরে) অরিন্দম।
আবার সকলে নীরব।
বৃহৎ মন্দিরটা যেন গগম্ করিতে লাগিল।