অষ্টম পরিচ্ছেদ : বিপৎকালে
জুমেলিয়া যখন দেখিল অরিন্দম কিছুতেই তাহার নিকট প্রাণ ভিক্ষা চাহিল না, দেখিয়া রাগিয়া যখন শিশি হইতে তরল অগ্নিবৎ ভিট্রয়েল ঢালিবার উপক্রম করিল, এমন সময়ে তাহার পশ্চাৎ হইতে একব্যক্তি সেই শিশিটা জোর করিয়া তাহার হাত হইতে ছিনাইয়া লইল। সেই সময়ে শিশি লইয়া কাড়াকাড়ি করিতে খানিকটা সেই তরলাগ্নি জুমেলিয়ার হাতে লাগিয়া গেল। যন্ত্রণায় চীৎকার করিয়া জুমেলিয়া ছুটিয়া সে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।
অরিন্দম কূপের ভিতর হইতে সেই অপ্রত্যশিতপূৰ্ব্ব ঘটনা দেখিয়া মনে মনে ঈশ্বরকে শতসহস্র ধন্যবাদ দিলেন। এত বড় একটা বিপদ্ যে, এত শীঘ্র এমন অল্পে অল্পে কাটিয়া যাইবে, এ কথা তিনি আগে মনেও স্থান দেন নাই। তিনি দেবেন্দ্রবিজয়ের মূর্ছিত দেহ বুকে লইয়া তাড়াতাড়ি উপরে উঠিয়া আসিলেন, এবং সেই বিপঞ্জন অপরিচিত লোকটির নিকটে যথেষ্ট কৃতজ্ঞতা স্বীকার করিলেন।
সেই অপরিচিত লোকটির বয়স সাতাশ বৎসর হইবে। তাঁহার দেহ সুগঠিত, দীর্ঘ ও প্রশস্ত। তাঁহার ভাবভঙ্গিতে মুখাকৃতি সকরুণদৃষ্টিতে, যে ভদ্রভাব লক্ষিত হয়, তাঁহার পরিহিত সেই মলিন বস্ত্র, মাথার উপর রুক্ষ শুষ্ক অতি দীর্ঘ চুলগুলো, চোখের পার্শ্ববর্তী কালিমা ও হস্তপদদ্বয়ের বড় বড় নখের সে ভাবটুকু অনতিবিলম্বে মন হইতে মুছিয়া যায়। আরও গায়ে স্থানে স্থানে শুষ্ক ময়লা জন্মিয়াছে; কানের নীচে, গলার চারি ধারে এবং কপালে এত ময়লা পড়িয়াছে যে, চিমটি কাটিলে খানিকটা উঠিয়া আসে। তাঁহার মুখ-চোখের ভাব দেখিয়া তাঁহাকে জাতিতে মুসলমান বলিয়া অরিন্দমের বোধ হইল। কে জানে, তবে কি ইনি ফুলসাহেবের কেহ?
যাহা হউক, উভয়ে মিলিয়া নিঃসংজ্ঞ দেবেন্দ্রবিজয়কে সসংজ্ঞ করিয়া তুলিবার জন্য যৎপরোনাস্তি চেষ্টা করিতে লাগিলেন। অনেক বিলম্বে তাঁহাদিগের চেষ্টা সফল হইল। দেবেন্দ্রবিজয় উঠিয়া বসিলেন।
অরিন্দম সেই অপরিচিত লোকটির পরিচয় লইবার জন্য ব্যগ্র হইয়া উঠিলেন। সেই লোকটাকে দেখিয়া অবধি তাঁহার মাথার ভিতরে একটা ঘোরতর সন্দেহ অত্যন্ত চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছিল। সেই সন্দেহটি যদি দৈবক্রমে সত্য হয়, তাহা হইলে তিনি জুমেলিয়া ও ফুলসাহেবকে ধরিবার জন্য যে কষ্টটা স্বীকার করিয়াছেন, তাহা কতক পরিমাণে বৃথা হয় না। তিনি আশান্বিত হৃদয়ে নাম জিজ্ঞাসা করিলেন। প্রত্যুত্তরে যে নামটি শুনিলেন, তাহাতে বাজীকরের ভোজদণ্ডপৃষ্ট এক গ্লাস মসীর, সহসা এক গ্লাস দুগ্ধমূর্তি ধারণের ন্যায় তাঁহার সমস্ত চক্ষু পালটিতে একেবারে অটল সত্যে পরিণত হইতে দেখিয়া, অতিমাত্র বিস্মিত হইয়া সবিস্ময়- দৃষ্টিতে তিনি তাঁহার আপাদ-মস্তক নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন। তাঁহার নাম সিরাজউদ্দীন; যাঁহার উদ্ধারের জন্য একদিন অরিন্দম কুলসমের নিকটে প্রতিশ্রুত হইয়াছিলেন।
সিরাজউদ্দীন বলিলেন, “আমি আপনাকে কখনও দেখি নাই; কিন্তু (দেবেন্দ্রবিজয়কে নির্দেশ করিয়া) এই ভদ্রলোকটিকে গত রাত্রে এখানে আর একবার দেখিয়াছিলাম। ধূমময় একটা রুদ্ধ গৃহের মধ্যে ইনি মৃত্যু-যন্ত্রণায় ডাক ছাড়িয়া চীৎকার করিতেছিলেন। সেই সময়ে আমি জানালা ভাঙিয়া ইঁহাকে উদ্ধার করি। আমি সেদিন সেই ঘরের পাশের ঘরেই বন্দী ছিলাম; নতুবা সেইদিন জুমেলিয়ার হাতে ইঁহার জীবন শেষ হইত।”
অরিন্দম সিরাজউদ্দীনকে বলিলেন, “আপনি বলিলেন, সেই সময়ে আপনি পাশের ঘরে বন্দী ছিলেন। কে আপনাকে বন্দী করিয়া রাখিয়াছিল?”
সিরাজ। ফুলসাহেব
অরি। কোন্ অভিপ্রায়ে ফুলসাহেব আপনাকে বন্দী করিয়া রাখিয়াছিল, সে সম্বন্ধে কিছু জানেন?
সিরাজ। না, তা’ জানি না, তবে ফুলসাহেব যেরূপ ভীষণ প্রকৃতির লোক তাতে বোধ হয় তার সেই রকমের একটা কোন ভীষণ অভিপ্রায় অবশ্যই ছিল।
অরি। আজ আপনি কিরূপে মুক্তি পাইলেন?
সিরাজ। আজও আমি দ্বিতলের একটা রুদ্ধগৃহে আবদ্ধ ছিলাম, একখানা ভাঙা খাটিয়ায় শুয়ে নিজের অদৃষ্ট চিন্তা করিতেছিলাম, এমন সময়ে ঘরের বাহিরের কোণে কাহার পায়ের শব্দ শুনিতে পাইলাম; সেই কোণে একটি ছোট দরজা ছিল, সেটা সহসা খুলিয়া গেল এবং জুমেলিয়া ঘরের মাঝ প্রবেশ করিল, আমি সেই পিশাচীকে দেখিয়া নিদ্রার ভান করিয়া পড়িয়া রহিলাম। সে অনেকক্ষণ ধরিয়া চুপ করিয়া আমার ঘরে বসিয়া রহিল। তাহার পর একবার সেই ছোট দ্বার দিয়া ঘরের বাহিরে গেল, আবার ফিরিয়া আসিল; আবার গেল, আবার ফিরিয়া অসিল, তিন-চারিবার এইরূপ করিয়া সে আর আসিল না। জুমেলিয়াকে এরূপ ব্যস্ত-সমস্ত-ভীত অবস্থায় আর কখনও দেখি নাই। মনে একটু সন্দেহ হইল অবশ্যই আজ আবার একটা নূতন রকমের একটা -না-একটা -কিছু ঘটিয়াছে, অথবা ঘটিবার সূচনা হইতেছে। যখন দেখিলাম, জুমেলিয়া আর ফিরিল না; তখন আমি ধীরে ধীরে উঠিলাম, দেখিলাম জুমেলিয়া চলিয়া যাইবার সময়ে ঘরের কোণের সেই ছোট দরজাটি বন্ধ করিয়া যাইতে ভুল করিয়াছে;জুমেলিয়ার সেই ভুলে আমার অনেকটা আশা হইল, মনে হইল, এই সুযোগে যদি দুৰ্ম্মদ ফুলসাহেব এবং দানবী জুমেলিয়ার অসাক্ষাতে পলাইতে পারি। এই মনে করিয়া আমি সেই দরজা দিয়া, ঘর হইতে বাহির হইয়া অত্যন্ত অন্ধকারে পড়িলাম। সেখানে এমন অন্ধকার যে, নিজেকে নিজেই সেই অন্ধকারের ভিতরে হারাইয়া ফেলিলাম। তখন জুমেলিয়ার সেই ভুলটাকে আর ভুল মনে না করিয়া আপনার কর্তব্য ভাবিতে লাগিলাম। অনুভবে ঠিক করিলাম, জুমেলিয়া আমাকে সে ঘর হইতে এই অন্ধকার ঘরে আবদ্ধ করিবার জন্য এরূপ করিয়া থাকিবে; তথাপি সাহসে ভর করিয়া অগ্রসর হইয়া চলিতে লাগিলাম। খুব সঙ্কীর্ণ পথ, ঠিক মাঝখানে দাঁড়াইয়া, দুই হাত বাড়াইয়া, দুই পার্শ্বের দেয়াল এক সঙ্গে সহজে স্পর্শ করা যায়। মাথার উপরে ছাদ কিংবা একটা কিছু ছিদ্রশূন্য আবরণ ছিল। আমি কিছুদূরে আসিয়া সম্মুখে বাধা পাইলাম। ধীরে ধীরে তাহার উপরে আঘাত করিয়া দেখিলাম, সেটা দেওয়াল নহে, একটা কাঠের কবাট; কিছুতেই ধাক্কা দিয়া, ঠেলিয়া সেটি খুলিতে পারিলাম না; কিন্তু সম্মুখের দিকে একটু জোর দিয়া টানিতেই সেটা খুলিয়া গেল, এবং দিনশেষের ম্লান আলো আসিয়া চোখে লাগিল। আমি তখন তন্মধ্য হইতে বাহির হইয়া আর একটা ঘরে পড়িলাম; তখনই সেই কবাট আপনি বন্ধ হইয়া গেল। তেমন আশ্চর্য ধরনের কবাট আমি আর কখনও দেখি নাই; বাহিরে আসিয়া ফিরিয়া দেখি, যে-দরজা দিয়া বাহির হইলাম, সেটি একটি আলমারীতে পরিবর্ত্তিত হইয়া গিয়াছে। যাই হ’ক্, সেই ঘরে কেহই ছিল না। আমি তখনই নীচে নামিয়া আসিলাম। বাহির হইতে এই ঘরের সমুদয় ব্যাপার প্রত্যক্ষ করিয়া স্তম্ভিত হইলাম। ছুটিয়া আসিয়া জুমেলিয়ার হাত হইতে শিশিটা কাড়িয়া লইলাম।
অরিন্দম বলিলেন, “আপনি আমাদের যে উপকার করিলেন, তাহা আজীবন স্মরম থাকিবে। আপনি না আসিলে জুমেলিয়া নিশ্চয়ই ভিট্রয়েল দিয়া আমাদের দুইজনকেই পুড়াইয়া মারিত আপনি কুলসমকে চিনেন?”
অরন্দিমের মুখে সহসা কুলসমের নাম শুনিয়া সিরাজউদ্দীন যেন কেমন একরকম হইয়া গেলেন। ক্ষণপরে বলিলেন, “কে কুলসম?”
অরি। কেন, তমীজউদ্দীনের কন্যা।
সিরা। জানি;কিন্তু এই ফুলসাহেবের হাত হইতে তাঁহাদের কেহ যে রক্ষা পাইয়াছেন, এমন বোধ হয় না।
অ। কুলসম রক্ষা পাইয়াছে। কুলসমের পিতা আর জীবিত নাই।
সিরা। এ কথা আমি এখানে ইহাদের মুখে কিছু-কিছু শুনিয়াছিলাম। আরও শুনিয়াছি, অরিন্দম নামে কোন্ ডিটেক্টিভ না কি এদের সকল ষড়যন্ত্র ভাঙিয়া দিয়াছেন; আর তাঁহারই ভয়ে ইঁহারা এখানে লুকাইয়া রহিয়াছে। যাই হ’ক্, কুলসমের সংবাদ আপনি আর কিছু জানেন? কুলসমের সংবাদ আপনি কোথায় পাইলেন? শুনিলাম, সেই ডিটেক্টিভ না কি কুলসমকে রক্ষা করিয়াছেন। সত্য কি?
অ। আমারই নাম অরিন্দম। কুলসম নিরাপদে আছে, সেজন্য আপনি উদ্বিগ্ন হইবেন না।
তাহার পর কুলসম ও ফুলসাহেব সম্বন্ধে অরিন্দম যাহা জানিতেন, সংক্ষেপে সমুদয় বলিলেন।
সিরাউদ্দীন বলিলেন, “এখন ফুলসাহেব ও জুমেলিয়াকে গ্রেপ্তার করিবার কোন উপায় ঠিক করিয়াছেন?”
অরিন্দম বলিলেন, “জুমেলিয়াকে যে আজ আর ধরিতে পারিব, এমন বোধ হয় না। ফুলসাহেবকে গ্রেপ্তার করিয়া উপরের ঘরে রাখিয়া আসিয়াছি। যখন তাঁহাকে গ্রেপ্তার করি, সে নিজের বিষ-কাঁটা নিজের হাতে বিদ্ধ করিয়াছিল, এতক্ষণে তাহার মৃত্যু হইয়াছে, বোধ করি। চলুন, তিনজনে উপরে যাই।”
তিনজনে ফুলসাহেবকে দেখিতে চলিলেন। অরিন্দম ফুলসাহেবকে যে ঘরে হাতকড়ি ও বেড়ি লাগাইয়া ফেলিয়া রাখিয়া গিয়াছিলেন, এখন সেই ঘরে তিনজনে প্রবেশ করিলেন।
সকলেই অতিশয় বিস্ময়ের সহিত দেখিলেন, ফুলসাহেব নাই। দেখিয়া শুনিয়া—বিশেষতঃ অরিন্দম যেন একেবারে বোকা-বনিয়া গেলেন।