সপ্তম পরিচ্ছেদ : যথাসময়ে জুমেলিয়া
ভিতরে যেমন দেবেন্দ্রবিজয়কে লইয়া এইরূপ যমে-মানুষে টানাটানি চলিতেছিল, ঠিক সেই সময়ে একটি স্ত্রীলোক সেই গৃহমধ্যে নিঃশব্দ পদবিক্ষেপে প্রবেশ করিয়া, অন্ধকূপের গুপ্তদ্বার-সম্মুখে একবার ঝুঁকিয়া দাঁড়াইল, এবং নীরব হাস্যের সহিত ক্ষণেক সেই অপূর্ব্ব লোমহর্ষক ব্যাপার দেখিয়া সংযতপদে চুপি চুপি বাহির হইয়া গেল—সে জুমেলিয়া।
জুমেলিয়া বাহিরে আসিয়া অতি মৃদুস্বরে একবার আপন মনে বলিল, “আচ্ছা!” সেই “আচ্ছা’ শব্দটা স্পষ্ট ধ্বনিত না হইয়া অনেকটা গভীর দীর্ঘনিঃশ্বাসের মত শুনাইল।
অরিন্দম অনেক কষ্টে দেবেন্দ্রবিজয়কে টানিয়া তুলিলেন। তখন দেবেন্দ্রবিজয়ের সংজ্ঞা নাই, অরিন্দম দেবেন্দ্রবিজয়ের মৃতকল্প দেহ একহস্তে বুকে চাপিয়া ধরিয়া যেমন উপরের দিকে এক পা উঠিতে যাইবেন, শাণিত ছুরিকার ন্যায় তীক্ষ্ণকণ্ঠে কে বলিল, “আমার হাতে দুইজনকেই আজ মরিতে হইবে। অরিন্দম, চাহিয়া দেখ, আমায় চিনিতে পার কি?”
অরিন্দম চকিতহৃদয়ে উপরের দিকে চাহিয়া বলিলেন, “কে তুমি?”
“বাঃ! তুমি আমায় চেন না?”
“না। কে তুমি?”
“আমি জুমেলিয়া। সেই তোমার পরিচিত মতিবিবি।”
সহসা সম্মুখে সর্প দেখিলেও লোকে এত চমকিত হয় না, অথবা সেই কক্ষমধ্যে সহসা বজ্রপাত হইলেও অরিন্দম বোধ করি এতদূর চমকিত হইতেন না, জুমেলিয়াকে দেখিয়া তিনি সেরূপ চমকিত হইলেন। দেখিলেন, সাক্ষাৎ মূৰ্ত্তিমতী শত বিভীষিকার ন্যায় জুমেলিয়া অবনতমস্তকে উপরে দাঁড়াইয়া, এবং তাহার প্রচুরায়ত কৃষ্ণনয়নে প্রদীপ্ত নরকাগ্নি জ্বলিতেছে—কি ভীষণ! অধিক, উন্মুক্ত কেশদামকৃষ্ণ, কুঞ্চিত, প্রচুর, সুদীর্ঘ, তেমনি ভীষণভাবে মুখের চারিপাশে ঝুলিতেছে। জুমেলিয়ার একহাতে একটা লণ্ঠন এবং অপর হাতে একটা ছোট শিশি; তন্মধ্যে লোহিত বর্ণের কি একটা তরল পদার্থ টল্ করিতেছে। কে জানে, পিশাচীর কি সঙ্কল্প!
নিজের অবস্থা স্মরণ করিয়া সত্যসত্যই অরিন্দম নিরতিশয় ভীত হইলেন। যদি দেবেন্দ্রবিজয় সে সময়ে মূর্ছিত না হইতেন, তাহা হইলেও সেই প্রলয়ঙ্করী পিশাচীর হাত হইতে পরিত্রাণ পাইবার একটু সম্ভাবনা থাকিত, এখন তিনি কি করিবেন? দেবেন্দ্রবিজয়কে সেরূপ অবস্থায় পরিত্যাগ করিতে পারেন না;ভাবিয়া অস্থির হইতে লাগিলেন। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করিলেন, “যদি দেবেন্দ্রবিজয় মরেন, তাঁহার সঙ্গে আমাকেও মরিতে হইবে।”
ঝটিকান্দোলিতজলোচ্ছাসকল্লোলতুল্য তরঙ্গায়িত হাস্যের সহিত জুমেলিয়া বলিল, “অরিন্দম, এখন আর তোমার ন্যায় বুদ্ধিমাকে বেশী করিয়া বুঝাইয়া বলিতে হইবে না যে, এখন একমাত্র আমার অনুগ্রহের উপর, করুণার উপর, ইচ্ছার উপর তোমাদের ন্যায় দুই-দুইটি বীরপুরুষের জীবন নির্ভর করিতেছে।”
যেরূপ স্বরে কথাগুলি জুমেলিয়ার মুখ হইতে বাহির হইল, তাহাতে সুস্পষ্ট বুঝিতে পারা যায়, জুমেলিয়া অত্যন্ত আহ্লাদের সহিত কথাগুলি বলিতেছিল।
অরিন্দম বলিলেন, “হাঁ, তাহাই বটে।”
জুমেলিয়া ঘাড় নাড়িয়া বলিতে লাগিল, “তবে অরিন্দম, আমার কাছে দয়া ভিক্ষা কর, প্রাণ ভিক্ষা কর—ক্ষমা চাও; যদি দয়া হয়—ক্ষমা করিলেও করিতে পারি।”
অরিন্দম বলিলেন, “পিশাচীর নিকটে দয়া-ভিক্ষা। জুমেলিয়া, এমন নির্ব্বোধ কে?”
তীব্রস্বরে জুমেলিয়া বলিল, “তবে মজাটা দেখ।”
অরি। কি করিবে তুমি? মনের কথাটা কি?
জুমে। মনের কথাটা তোমাকে হত্যা করিব—এখনই—এই মুহূর্ত্তে।
অ। কিরূপে?
জুমেলিয়া হাতের সেই শিশিটা উপরে তুলিয়া ধরিল! তাহার পর খলখল, অট্টহাসি হাসিয়া বলিল, “ইহার ভিতরে কি আছে জান? না, জান না। ইহার ভিতরে যা’ আছে, তাই তোমার গায়ে ঢালিয়া দিব, অগ্নিশিখার ন্যায় তোমাকে পোড়াইতে থাকিবে, গলিত সীসা অপেক্ষাও ইহা ভয়ঙ্কর, তুলনায় ইহার নিকটে তাহা বরফ বলিলেও চলে।”
অরিন্দম বলিলেন, “তোমার চিত্তবৃত্তিতে—তোমার কল্পনায়—তোমার নৃশংসতায় ও কুটিলতায় তুমি দানবী অপেক্ষাও ভয়ঙ্করী; তোমার যাহা ইচ্ছা হয় কর—আমি মরিতে প্রস্তুত।”
জুমেলিয়া বলিল, “শোনো অরিন্দম, মরণটা মুখে বলা যত সহজ, কাজে ঠিক তেমন সহজ হয় না। এ যে-সে মরণ নয়—জ্বলিয়া পুড়িয়া দন্ধিয়া মরণ। মর তবে, অরিন্দম। তুমি যন্ত্রণায় অস্থির হইয়া, ডাক্ ছাড়িয়া চীৎকার করিতে থাকিবে, আর তেমনই উচ্চকণ্ঠে আমি হাসিতে থাকিব– হো—হো—হো। কি মজা! তোমার চোখে দুই বিন্দু ঢালিয়া দিব, অন্ধ হইবে–চক্ষু উৎপাটন করিয়া ফেলিলেও সে যন্ত্রণা যাইবে না; তাহার পর মরিবে—ধীরে-ধীরে-ধীরে—ভয়ানক যন্ত্রণায় ভয়ানক মরণ!”
আবার জুমেলিয়া হাসিতে লাগিল। কি ভয়ানক অমঙ্গলজনক সেই তীব্র হাসি! সে-হাসি শুনিয়া অতি সাহসীরও বুক ভয়ে কাঁপিয়া উঠে।
অরিন্দমও ভয় পাইলেন। বুঝিলেন, জুমেলিয়া মুখে শুধু ভয়-প্রদর্শন করিতেছে না, কাজে সে ঠিক তাহাই করিবে। এ বিপদ্ হইতে পরিত্রাণের উপায় কি?
“এই দেখ, অরিন্দম” বলিয়া জুমেলিয়া অল্পে অল্পে শিশিটা কাৎ করিতে লাগিল। শিশির মুখের কাছে সেই তরল পদার্থ টল্ করিতে লাগিল। জুমেলিয়ার অলক্ষ্যে অরন্দিমের হাতে একবিন্দু পতিত হইল। গলিত সীসকের ন্যায় সেই একবিন্দু সেই স্থান দগ্ধ করিতে লাগিল। অরিন্দম নিজের অধরোষ্ঠ দংশন করিয়া, নীরবে নিঃশ্বাস রোধ করিয়া অতি কষ্টে সে যন্ত্রণা সহ্য করিতে লাগিলেন। যন্ত্রণাসূচক একটি মাত্র শব্দও তাঁহার মুখ হইতে তখন বাহির হইল না।
জুমেলিয়া বলিল, “দেখ অরিন্দম, আর বিলম্ব নাই, এই দেখ, ছিপি খুলিয়াছি, এখনই তোমার সৰ্ব্বাঙ্গে ঢালিয়া দিব; এখনও সময় আছে, প্রাণ ভিক্ষা চাও!”
অরিন্দম দৃঢ়স্বরে বলিলেন, “প্রাণ থাকিতে নহে। “
জুমেলিয়া বলিল, “আমি তোমাকে মুক্তি দিলেও দিতে পারি প্রাণ ভিক্ষা চাও।”
অরিন্দম বলিলেন, “তুমি পিশাচী।”
জুমেলিয়া মৃদুহাস্যের সহিত বলিল, “ছিঃ, অরিন্দম! চোখের মাথা একেবারে খাইয়াছ; এমন সুন্দরী আমি, এত রূপ আমার, আর আমি হ’লেম কি না পিশাচী!”
অরিন্দম কোন কথা কহিলেন না।
জুমেলিয়া বলিল, “আর বলিব না, এই শেষ বার; এখনও প্রাণ ভিক্ষা চাও
তোমার ন্যায় সুপ্রসিদ্ধ শ্রেষ্ঠ ডিটেটিভ যদি আমার কাছে প্রাণ-ভিক্ষা করিয়া লয়, আমি দ্বিরুক্তি না করিয়া সম্মত হইব, তা’তে আমার যথেষ্ট সম্মান আছে, তাই বলিতেছি।”
তথাপি অরিন্দম নীরব।