Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » মায়াবী || Panchkari Dey » Page 61

মায়াবী || Panchkari Dey

যখন দেবেন্দ্রবিজয়ের জ্ঞান হইল; দেখিলেন, তাঁহার সম্মুখে মুক্ত পৃথিবীর চারিদিক্ প্রভাতরবির হিরণ্য-প্রবাহে পুলকিত এবং প্রদ্যোতিত; তিনি নিস্তরঙ্গ নদীবক্ষে, নৌকার উপরে। দাঁড়িরা অদূরে বাসায় সশব্দে, দ্রুতহস্তে দাঁড় নিক্ষেপ করিয়া নৌকাখানাকে অত্যন্ত দ্রুতবেগে একদিক্ হইতে অপরদিকে লইয়া যাইতেছিল। নদীর দুই পার্শ্ব নীরব; কেবল দূর পল্লীমধ্য হইতে ক্রীড়াপরায়ণ বালকদিগের হাস্যকল্লোল এবং কোন নিদ্রোত্থিত দুগ্ধপোষ্যের রোদনধ্বনি এক একবার অস্ফুট শোনা যাইতেছিল। অনতিদূরস্থ একটি দেবদারুর শীর্ষদেশ হইতে করুণকণ্ঠ ‘বউ-কথা-কও’ পাখী, আলোকম্বরা ধরণীর নগ্ন বক্ষ শব্দ-তরঙ্গ প্লাবিত করিয়া অভিমানমৌন প্রিয়াকে অবিশ্রাম সপ্রেম-সম্ভাষণ করিতেছিল। তাহার সেই বেদনাগীতি, সেই শোভন স্তব্ধ, সুন্দর কিরোণোজ্জ্বল প্রভাতের অখণ্ড প্রশান্তির মধ্যে নিরতিশয় মধুর শুনাইতেছিল। এবং তটস্থ সঙ্গীহীন দীর্ঘ গাছগুলোর ছায়া দীর্ঘতর হইয়া নদীবক্ষে অনেকদূর অবধি প্রসারিত হইয়া পড়িয়াছিল।

দেবেন্দ্রবিজয় মুগ্ধ নেত্রে ও অতি বিস্ময়ের সহিত সেই সকল দেখিতেছিলেন ও শুনিতেছিলেন। কতক্ষণ পরে, কিরূপে তাঁহার চেতনা সঞ্চার হইল, তাহা কিছুতেই ঠিক করিয়া উঠিতে পারিলেন না; এমনকি তখনও তিনি যে সসংজ্ঞ হইয়াছেন, সে বিষয়েও তাঁহার মনে একটা দারুণ সন্দেহ হইতেছিল। মনে হইতেছিল, ইহাও একটা স্বপ্নের খেয়াল ব্যতীত আর কিছুই নহে।

তিনি কিছুতেই তাঁহার সেই ভয়ানক বিপদের কথা আগাগোড়া মনে করিয়া উঠিতে পারিতেছিলেন না। অতিকষ্টে তিনি সেইসকল একটু একটু স্মরণ করিতেছিলেন; তথাপি তখন সেই দস্যু-রমণী ও আশ্চর্য্য রোগীর মুখ ভাল রকমে তাঁহার মনে আসিতেছিল না; তাঁহার অবসন্ন দেহ, যে দীর্ঘাকৃতি অপরিচিত ব্যক্তি গৃহতল হইতে আপনার বুকে তুলিয়া লইয়াছিলেন, তাঁহার মুখ যদিও এক একবার মনে পড়িতেছিল, কিন্তু কিছুতেই তাহা বিশ্বাস করিতে পারিতেছিলেন না; একটা প্রহেলিকাম অপূৰ্ব্ব দৃশ্য যে, তখন হইতে এখন পর্যন্ত তাঁহার দৃষ্টি সম্মুখে অভিনীত হইতেছে, ইহাই যেন তাঁহার একান্ত বিশ্বাসের সহিত হৃদয়ঙ্গম হইতেছিল। এখনও যেন সেই ধূম, সেই উগ্রগন্ধ তাঁহার শ্বাসরোধ করিতেছে। তিনি অতিকষ্টে নিঃশ্বাস ফেলিতেছিলেন। মাথা ও বুক অত্যন্ত ভারী বোধ হওয়ায় তিনি চেষ্টা করিয়াও সোজা হইয়া বসিতে পারিতেছিলেন না;একটা দুবির্ষহ উন্মাদক নেশা তাঁহার মস্তিষ্ক পূর্ণরূপে অধিকার করিয়াছিল। তিনি সেই নেশার ঝোঁকে অস্ফুটস্বরে বলিলেন, “একি ভয়ানক জটিল রহস্য! স্বামী-স্ত্রীতে মিলিয়া এরূপ প্রবঞ্চনা করিয়াই কি তাহারা দিনতিপাত করে! সেই স্ত্রীলোকটি—কত সুন্দর দেখিতে সে! কে তাহাকে দেখিয়া বুঝিবে, তাহার হৃদয় এইরূপ কালকূটে ভরা; নিশ্চয় তাহারা দুইজনে মিলিয়া, আমাকে খুন করিয়া আমার নিকটে যা কিছু আছে, সমস্তই কাড়িয়া লইবে মনে করিয়াছিল;কিন্তু আশ্চর্য্য! কে আমায় সেই ভয়ানক মৃত্যু হইতে, আরও সেই ভয়ানক খুনীদের হাত হইতে উদ্ধার করিল? এখন আমি কোথায়? কোথায় যাইতেছি? এ নৌকার উপরেই বা আমাকে কে লইয়া আসিল?”

নৌকা দ্রুতগতিতে চলিতেছিল বলিয়া, নদীবক্ষের শীকরসিক্ত স্নিগ্ধ প্রতিকূল বায়ু দেবেন্দ্রবিজয়ের সর্বাঙ্গে প্রবলবেগে সঞ্চালিত হইয়া ক্ষণে ক্ষণে স্পষ্টরূপে তাঁহার দুর্বল মস্তিষ্কের বলিদান করিতেছিল। দেবেন্দ্রবিজয় একজন দাঁড়িকে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমরা আমাকে কোথায় লইয়া যাইতেছ, এ নৌকার উপরেই বা কে আমাকে লইয়া আসিল?”

নৌজীবীদের দল তাঁহার কথায় কর্ণপাত করিল না–ঝপ্ ঝপ্ শব্দে দাঁড় বাহিয়া সেইরূপ দ্রুততরবেগে অগ্রসর হইতে লাগিল।

দেবেন্দ্রবিজয় পূর্ব্বাপেক্ষা উচ্চকণ্ঠে পুনরপি জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমরা কোথায় আমাকে লইয়া যাইতেছ?”

নৌ-বাহকদের মধ্যে একজন বলিল, “আমরা আপনাকে ঠিক নিয়ে যাব, সেজন্য আপনার কোন চিন্তা নাই। আপনি একটু চুপ করে বসুন।”

দেবেন্দ্রবিজয় বিরক্ত হইয়া মনে করিলেন, কোথায়? যমপুরীতে না কি? সেই ভয়ানক মৃত্যুর পর কি এ-যমপুরী যাত্রা না কি; প্রকাশ্যে বলিলেন, “আমাকে কোথায় লইয়া যাইতেছ, না বলিলে আমি কিছুতেই তোমাদের সঙ্গে যাইব না। আমাকে এখানে নামাইয়া দাও।”

এরূপ গোলযোগ দেখিয়া মাঝি সেইখানে উপস্থিত হইল। এবং দেবেন্দ্রবিজয়কে বিনীতভাবে বলিল, “আপনার বাড়ীতেই আপনাকে নিয়ে যাব, আমরা আপনার ঠিকানা জানি, আপনি এখন ব্যস্ত হবেন না—একটু স্থির হ’য়ে বসুন। আপনার এখনও নেশা আছে।”

মাঝি যদিও কথাগুলি যতদূর সম্ভব মিষ্ট করিয়া বলিল, কিন্তু দূরদৃষ্টবশতঃ তাহা দেবেন্দ্রবিজয়ের নিতান্ত নীরস ও অস্থিদাহকারীবৎ বোধ হইল। তিনি ক্রুদ্ধ হইয়া সবেগে উঠিয়া মাঝিকে বলিলেন,

তোমার মাথা! মূর্খ, আমি কোথায় থাকি, তুমি কি তা’ জান যে, আমাকে বাড়ীতে নিয়ে যাবে?” এই বলিয়া উঠিতে চেষ্টা করিলেন; চেষ্টা করিলেন মাত্র, উঠিতে পারিলেন না; অর্দ্ধশায়িত অবস্থায় বসিয়া পড়িলেন। তখন তাঁহার মনে হইল, মাঝি যে তখনও তাঁহার নেশা আছে বলিয়া ক্রোধোদ্ৰেক করিয়াছিল, সেটা নিতান্ত মিথ্যাপবাদ নহে;নিঃসন্দেহ সত্য। তখনও তাঁহার মাথাটা বেশ ঘুরিতেছিল এবং পা দুখানি তাঁহার দেহভার বহনে অক্ষমতা প্রকাশ করিয়া অত্যন্ত টলিতেছিল। মাঝির মূর্খতা হইতে তাঁহার মূর্খতা যে বহুপরিমাণে অধিক, বুঝিতে পারিয়া সর্ব্বতোভাবে দুঃখিত হইলেন। হতাশভাবে একপার্শ্বে বসিলেন।

মাঝি দেবেন্দ্রবিজয়ের সেইরূপ ভাব দেখিয়া সেজন্য কিছুমাত্র বিস্ময় প্রকাশ না করিয়া বলিল, “আপনার বাড়ী ওপারে কামদেবপুরে; আপনার নাম ত অরিন্দমবাবু?”

দেবেন্দ্রবিজয় উত্তেজিত স্বরে উত্তর করিলেন, “আমার নাম অরিন্দমবাবু নয়—বাড়ীও কামদেবপুরে নয়।”

মাঝি বলিল, “তবে কি সেই ভদ্রলোকটি আমাকে মিথ্যা বলিলেন?” মাঝি মনে ভাবিল, “বাবুর এখনও বেশ নেশা আছে।”

দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “কে সে ভদ্রলোক? কে আমাকে নৌকায় তুলিয়া দিল? আমি কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না; তুমি এখনই আমাকে সব কথা খুলিয়া বল।”

মাঝি বলিতে লাগিল, “বাবু, আপনি কাল রাতে বড় মাতাল হ’য়ে পড়েছিলেন।’ এত মদ খেয়েছিলেন যে, আপনার একটুও জ্ঞান ছিল না। একটা বটগাছের তলায় মড়ার মত প’ড়েছিলেন। সে যাই হ’ক, তাতে আর হয়েছে কি, আজ-কাল অনেক ভদ্রলোকেরই এমন হ’য়ে থাকে। সেখানকার একটি ভদ্রলোক সেইরূপ অবস্থায় আপনাকে দেখতে পেয়ে আমাকে ডাকলেন। ডেকে বলেন, “মথুর, একটা কাজ কর্ দেখি, এই ভদ্রলোকটিকে বাড়ী পৌঁছে দিয়ে আয়। যদি কোন লোক দেখিতে পায়, তাহা হইলে এখনি ফাঁড়িতে টেনে নিয়ে যাবে। এ লোকটি কোথায় থাকে, আমি জানি এই চিঠিখানা জামার পকেটে পাওয়া গেছে, এই চিঠিতে ঠিকানা লেখা আছে।”

দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “কে সে ভদ্রলোক, তুমি তাকে চেন?”

মাঝি উত্তর করিল, “না বাবু, আমি চিনি না।“

দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “তবে সে কেমন করিয়া তোমার নাম ধরিয়া ডাকিল?”

মাঝি একটু ইতস্ততঃ করিয়া বলিল, “তা’ কি ক’রে জান্ত, বাবু—তার আগে সেই ভদ্রলোকটিকে আর কখনও কোথায় দেখেছি, আমার ত বাবু, ভাল মনে পড়ে না। কিন্তু তিনি আমাকে নিশ্চয়ই চিনেন, তা’ না হ’লে, কেমন ক’রে আমার নাম জানতে পারলেন। যাই হ’ক্, লোকটি নিতান্ত ভদ্রলোক, খুব দয়ার শরীরও বলতে হবে; নইলে আজ-কালকার বাজারে কে কাকে দেখে, বলুন দেখি? আপনার বাপ-ভাইকে কেউ দেখে না, তা’ পর। আপ্‌নার জন্য অনেক করেছেন! আপনাকে নিয়ে যাবার ভাড়টি পর্য্যন্ত তিনি নিজের কাছ থেকে আমাদের আগে চুকিয়ে দিয়েছেন।”

দেবেন্দ্রবিজয় জিজ্ঞাসা করিলেন, “সে ভদ্রলোকটির বয়স কত, কিরকম দেখতে—লম্বা না বেঁটে, মোটা না রোগা, দাড়ি গোঁফ আছে, না নাই ইত্যাদি অনেক প্রশ্ন। মাঝি সেইসকল প্রশ্নের যেরূপ উত্তর করিল, তাহাতে সর্ব্বতোভাবে গতরাত্রে সেই অদ্ভুত অদৃষ্টপূর্ব্ব রোগীকেই বুঝায়। দেবেন্দ্রবিজয় মাঝিকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি যে চিঠির কথা বলিতেছিলে, সে চিঠিখানা কোথায়? আমি সেখানা একবার দেখিতে চাই। আমাকে সেখানা দাও।”

মাঝি বলিল, “সে-চিঠি আপনার জামার পকেটে আছে, তিনি ঠিকানাটা আমাদের একবার প’ড়ে শুনিয়ে দিয়ে, তখনই আবার আপনার জামার পকেটে রেখে দিয়েছেন।”

পকেটে হাত দিয়ে দেবেন্দ্রবিজয়ের মুখ বিবর্ণ হইয়া গেল। উত্তেজিত কণ্ঠে বলিয়া উঠিল, “মাঝি, সর্বনাশ হয়েছে! তা’রা চোর তা’রা ডাকাত—তা’রা অতি ভয়ানক লোক—ঘোর বিশ্বাসঘাতক! তোমরাও সেই খুনীদের লোক দেখিতেছি। আমার হাতে কেহই নিস্তার পাবে না, এর ফল তোমরা কেহই নিস্তার পাবে না, এর ফল তোমরা নিশ্চয়ই পাবে।”

মাঝি সেকথার কোন অর্থ হৃদয়ঙ্গম করিতে না পারিয়া অত্যধিক বিস্মিত এবং কতক বা কৌতূহলাক্রান্ত হইয়া বলিল, “কি হয়েছে, বাবু? আমরা কিছুই জানি না।”

“সব জান তোমরা”, বলিয়া দেবেন্দ্রবিজয় মাঝির মুখ হইতে কথাটা যেন লুফিয়া লইলেন। ক্রোধভরে বলিলেন, “আমার ঘড়ি, চেন, হীরার আংটি, পকেটে নগদ তিনশতের অধিক টাকা ছিল, সব চুরি ক’রে নিয়েছে—তা’রা সহজ লোক নয়। এখানে যদি কোন থানা থাকে, আমাকে সেইখানে নিয়ে চল। এখনই ইহার একটা প্রতিকার করা চাই।”

দেবেন্দ্রবিজয় এ পকেট, সে পকেট করিয়া তিনখানি অদৃষ্টপূর্ব্ব পত্র বাহির করিলেন। তন্মধ্যে দুইখানি তাঁহার নামে লিখিত এবং বিভিন্ন হস্তাক্ষরে লিখিত। আর একখানির উপরে কামদেবপুরের ঠিকানা দিয়া অরিন্দমের নাম লিখিত ছিল। দেবেন্দ্রবিজয় অটল মনোযোগের সহিত তিনখানি পত্ৰই পাঠ করিলেন। পাঠশেষে তিনি মাঝিকে বলিলেন, “হাঁ, আমারই নাম অরিন্দম–আমার বাড়ী কামদেবপুর, যত শীঘ্র পার, সেইখানে নৌকা লইয়া চল।”

তাহাতে মাঝি কিছুমাত্র বিস্মিত হইল না;কারণ তখন্য তাহার একান্ত বিশ্বাসের সহিত বেশ মনে হইতেছিল, নেশাটা এখনও বাবুর মায়া একেবারে পরিত্যাগ করিতে পারে নাই।

নৌকা সেইরূপ সবেগে চলিতে লাগিল।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57 58 59 60 61 62 63 64 65 66 67 68 69 70 71 72 73 74 75 76 77 78 79 80 81 82 83 84 85 86

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress