বিংশ পরিচ্ছেদ : প্রাণনাশের চেষ্টা
দেবেন্দ্রবিজয় এতক্ষণে বুঝিতে পারিলেন, এ বিপদ্ হইতে উদ্ধারের আশামাত্র নাই। সেইখানে তাঁহাকে এমন সময়ে একটু সাহায্য করে, এমনও কেহ নাই।
রমণী চলিয়া যাইবার অল্পক্ষণ পরেই দেবেন্দ্রবিজয় একটা কি অনাঘ্রাতপূর্ব্বক অতি তীব্র গন্ধ অনুভব করিলেন। চারিদিক্ ভাল করিয়া নিরীক্ষণ করিয়াও কারণ নির্দ্দেশ করিতে পারিলেন না। ক্রমশঃ গন্ধ আরও তীব্র হইতে লাগিল; এমনকি শেষে এমন হইয়া উঠিল যে, সেখানে এক মুহূৰ্ত্ত অবস্থান করা মনুষ্য মাত্রেরই সাধ্যাতীত। শেষে দেখিলেন, কোন অদৃশ্য স্থান হইতে ধূমরাশি সেই ছোট রুদ্ধ ঘরের ভিতরে অল্পে অল্পে ঘনীভূত হইয়া উঠিতেছে। এদিকে ঘরের ভিতরে যত অধিক পরিমাণে ধূম সঞ্চিত হইতে লাগিল, সেই সঙ্গে সেই প্রাণান্তকর দুর্গন্ধও তীব্রতম হইয়া উঠিতে লাগিল। দেবেন্দ্রবিজয় প্রথমে ভাবিয়াছিলেন, কোন পার্শ্ববর্তী ঘরে আগুন লাগিয়াছে, অথবা সেই উপেক্ষিতা সর্পিণী স্ত্রীলোকটি সেই গৃহে অগ্নিসংযোগ করিয়া সেই অপমানের প্রতিশোধ লইতে অপমানকারীর মৃত্যুর পথ সহজ ও সরল করিয়া দিয়াছে, কিন্তু পরক্ষণেই সেধারণা দেবেন্দ্রবিজয়ের মন হইতে একেবারে তিরোহিত হইয়া গেল; কারণ ঘরে আগুন লাগিলে সে-ধূম এমন উত্তাপশূন্য, কিংবা এমন একটা উগ্র গন্ধযুক্ত হইত না। সে-গন্ধ অত্যন্ত বিষাক্ত সন্দেহ নাই;নতুবা তাঁহার মস্তিষ্কে ও হৃদয়ে প্রবেশলাভ করিয়া শাণিত ছুরিকার ন্যায় বিদ্ধ হইতে থাকিবে কেন? দেবেন্দ্রবিজয় তখন বুঝিলেন, আর নিশ্চিন্ত হইয়া চুপ করিয়া বসিয়া থাকিবার এ সময় নহে। তিনি উঠিয়া দ্বারের নিকটে গেলেন, এবং উপর্যুপরি পদাঘাত করিয়া দ্বার ভাঙ্গিয়া ফেলিবার চেষ্টা করিলেন—চেষ্টা ব্যর্থ হইল। তিনি বাহির হইতে না পারেন, নাই—নাই; তখন সেই নিবিড়তর ধূমরাশির কতকটা বাহির হইয়া গেলে, তিনি তখনকার সেই শ্বাস-রাহিত্যের অবস্থা হইতে মুক্তিলাভ করিতে পারিবেন এবং ইহার পর অদৃষ্টে যাহা ঘটিবার তাহা ঘটিবে, মনে করিয়া তাড়াতাড়ি রুদ্ধ গবাক্ষগুলি উন্মোচন করিতে গেলেন তাহাতেও তিনি ভগ্নমনোরথ হইলেন; সবগুলিই বাহির হইতে বন্ধ এরূপ দৃঢ়ভাবে বন্ধ যে, কিছুতেই খুলিল না। তখন তিনি একান্ত নিরাশ ও নিরুপায় হইয়া ছুটিয়া গিয়া, দেহের সমস্ত শক্তি একত্র করিয়া সেই রুদ্ধদ্বারে পদাঘাতের উপর পদাঘাত বর্ষণ করিতে লাগিলেন। ক্ষুদ্র গৃহ সেই পদাঘাতের শব্দে যেন ফাটিয়া পড়িবার মতন হইল, তথাপি সেই কঠিন কবাট জোড়াটা কঠোর ও অবিচলিতভাবে দাঁড়াইয়া সেই দুঃসহ পদাঘাতগুলো অনায়াসে সহ্য করিয়া, পূর্ব্ববৎ স্থির হইয়া রহিল।
এমন সময়ে বাহির হইতে কে বলিল, “বৃথা চেষ্টা—দেবেন্দ্র বৃথা চেষ্টা। স্ত্রীলোক উপেক্ষিতা হইলে পিশাচী অপেক্ষাও ভয়ঙ্করী হয়। বিধির লিখন, তোমার মৃত্যু এইরূপেই হবে। মরিতে বসিয়াছ, নিজে মর—কবাট জোড়াটার অপরাধ কি?”
তাহার পর খল খল্—কী ভয়ানক অট্টহাস্য!
সেই তীক্ষ্ণ শাণিত হাস্য বিদ্যুতের শিখার ন্যায় সেই ধূমময় ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিয়া পরক্ষণেই বাহিরের মুক্ত প্রকৃতির দূর দূরান্তরের কোন নিভৃত প্রদেশে ক্ষীণ—ক্ষীণতর হইয়া মিলাইয়া গেল। তারপর, সকলই নীরব।
দেবেন্দ্রবিজয় স্বর শুনিয়া বুঝিলেন, সেই তীব্র উপহাস এবং সেই উপহাসের অতি তীক্ষ্ণ শাণিত হাস্যকল্লোল আর কাহারও নহে—এ সেই দস্যু-রমণীর—সেই পিশাচীর!
রুদ্ধশ্বাসে সেই ক্ষুদ্র রুদ্ধকক্ষ মধ্যে দেবেন্দ্রবিজয় ইতস্ততঃ ছুটিতে লাগিলেন। পূৰ্ব্বেই নিশ্বাস বন্ধ হইয়া গিয়াছিল, এখন যে সামান্য জ্ঞান ছিল, তাহাও লুপ্ত হইয়া আসিতে লাগিল। সেই বিষাক্ত গন্ধ দেবেন্দ্রবিজয়ের সর্ব্বাঙ্গ ক্রমে অবশ করিয়া আনিল। তখন সেই দুর্গন্ধ ধূম গৃহের মধ্যে এত নিবিড় হইয়াছিল যে, তন্মধ্যে সেই দীপশিখা একান্ত ম্লান ও সঙ্কুচিত হইয়া গিয়াছিল; এবং তাহার ক্ষীণ আলোকরশ্মি তন্মধ্যেই সীমাবদ্ধ হইয়াছিল; চারিদিকে বিকীর্ণ হইয়া পড়িবার কোন সম্ভাবনাই ছিল না। সেই অন্ধকারাচ্ছন্ন গৃহটি দেবেন্দ্রবিজয়ের চোখে আরও অন্ধকার দেখাইতেছিল। তিনি সহনাতীত যন্ত্রণায় আকুল হইয়া উন্মত্তের ন্যায় ছুটাছুটি করিতে লাগিলেন, এবং বুকফাটা-কণ্ঠে চীৎকার করিয়া ডাকিতে লাগিলেন, “কে আছ, শীঘ্র এস, রক্ষা কর—বাঁচাও বাঁচাও —মৃত্যু—মৃত্যু ভয়ানক মৃত্যু!”
ক্রমে তাঁহার পদদ্বয় অবসন্ন হইয়া আসিল;তিনি মাতালের মত টলিতে টলিতে পড়িয়া গেলেন। দুইবার পড়িলেন, দুইবার উঠিলেন, তাহার পর আর উঠিতে পারিলেন না—সর্ব্বাঙ্গ ব্যাপিয়া বিষের হল্কা ছুটিতেছিল, তাই দুব্বিষহ যন্ত্রণায় কক্ষতলে পড়িয়া তিনি ছট্ফট্ করিতে লাগিলেন। এবং তাঁহার সংজ্ঞা বিলুপ্ত হইয়া আসিতে লাগিল।
সেই সময়ে তিনি স্বপ্নবৎ দেখিলেন, যেন একজন দীর্ঘাকৃতি অপরিচিত যুবক একটা অত্যন্ত শব্দ করিয়া সেই গৃহমধ্যে দ্রুত প্রবেশ করিয়া তাঁহাকে বুকে তুলিয়া লইল।
সেই সময় তিনি একেবারে নিঃসজ্ঞ হইয়া পড়িলেন; যেন তাঁহার ক্ষীণতম দৃষ্টির ও সেই অপরিস্ফুট দৃশ্যের মাঝখানে সমস্ত ঢাকিয়া একখানা মসীময় যবনিকাপাত হইল।