Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » মায়াবী || Panchkari Dey » Page 6

মায়াবী || Panchkari Dey

দ্বিপ্রহর রাত্রি। অবিশ্রান্ত ঝড় বৃষ্টিতে সে রাত্রি আরও কী ভয়ানক! আকাশের মুখে কৃষ্ণাবগুণ্ঠন আকাশের এক প্রান্ত হইতে অপর প্রান্ত পর্য্যন্ত মেঘ করিয়াছে; সে মেঘ নিবিড়, ছিদ্রশূন্য, অন্ধকারময় ভূতল হইতে আকাশতল পর্য্যন্ত অন্ধকার যেন জমাট বাঁধিয়া রহিয়াছে। মুহুর্মুহু বজ্ৰ গৰ্জ্জিতেছে; সে গৰ্জ্জন এমন বিকট এবং এমন ভীতিপ্রদ যে শুনিয়া অতি সাহসীরও বুক কাঁপিয়া উঠে। এক-একবার বিদ্যুৎ ঝলকিতেছে বটে; কিন্তু সেই আলোকের অপেক্ষা আঁধার অনেক ভাল। এই ঘোরতর দুৰ্য্যোগে ঝটিকাময়, শব্দময় এবং নানা বিভীষিকাময়, জনশূন্য, তারকাশূন্য ও দিদিগন্তশূন্য সেই অন্ধকারের মধ্য দিয়া একটি চতুৰ্দ্দশ বর্ষীয়া বালিকা এক বিস্তৃত প্রান্তর অতিক্রম করিতে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটিতেছিল। যখন তীব্রভাবে বিদ্যুৎ ঝলকিতেছিল, তখন বালিকা সভয়ে প্রান্তরের একবার এদিক্ একবার সেদিক্ করিয়া চারিদিকেই চাহিয়া দেখিতেছিল;ভয় হইতেছিল, পাছে কেহ তাহাকে সেই আলোকে দেখিতে পায়। আলো নিবিয়া গেলে, অন্ধকার পাইয়া বালিকা যেন তখন কতকটা নিঃশঙ্কচিত্তে আবার কিছুদূর অগ্রসর হইতেছিল। এই বিদ্যুচ্চকিত, মেঘকৃষ্ণ, বর্ষা-প্লাবিত নিশীথে জনহীন প্রান্তরে কে ঐ বালিকা?

জানি না, কতক্ষণ সেই বালিকা এইরূপ কষ্টভোগ করিতেছিল; কিন্তু তখন সে একান্তই ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছিল। এবং তাহার নাসারন্ধ্র ও মুখবিবর দিয়া ঘন ঘন শ্বাস বহিতেছিল। চেষ্টা করিয়া কিছুদূর কিছু দ্রুত চলিতেছিল, কিন্তু পরক্ষণেই সে গতির দ্রুততা আবার কমিয়া আসিতেছিল—আর পারে না। পা আর চলে না—যেন ভাঙিয়া পড়িতেছে। বালিকা সেই বিস্তৃত প্রান্তর অতিক্রম করিতে কতবার ভূতলাবলুণ্ঠিত হইয়া পড়িল—কতবার পড়িতে পড়িতে রহিয়া গেল, এবং ঝড়ে জলসিক্ত অঞ্চলও পায়ে-পায়ে জড়াইয়া বালিকাকে কতবার ভূতলে নিক্ষেপ করিল। উপরে মেঘ ছুটিতেছে—মেঘের পশ্চাতে মেঘ ছুটিতেছে—মেঘে মেঘে মিশিয়া মেঘ আরও নিবিড় হইয়া ছুটিতেছে; তাহার নীচে ঝড় ছুটিতেছে—ঝড়ে ঝড়ে মিশিয়া ঝড় আরও ভয়ানক বেগে ছুটিতেছে, তাহার নীচে সেই অসহায়া বালিকা প্রাণভয়ে প্রাণপণে ছুটিয়াছে।

প্রান্তরের প্রান্তে আসিয়া বালিকা একখানি ছোট গ্রাম দেখিতে পাইল; কিন্তু সে-গ্রামও তখন মৃতবৎ পড়িয়া রহিয়াছে—জনপ্রাণীর অস্তিত্বের কোন চিহ্নই নাই। গ্রামের প্রান্তে আসিয়া, বালিকা হতাশ হইয়া সেই মৃতবৎ গ্রামের চারিদিকে সতৃষ্ণনয়নে চাহিতে লাগিল। ক্রীড়াশীল বিদ্যুৎ সেই মৃতকল্প বালিকার হতাশদৃষ্টির সম্মুখে এক-একবার সেই মৃতবৎ গ্রামের ছবিখানি ধরিয়া কি রঙ্গ করিতেছিল, জানি না;কিন্তু তাহাতে বালিকার অবসন্ন, ক্লিষ্ট হৃদয় অনেকটা আশ্বস্ত হইল। সে সত্বর গ্রামমধ্যে প্রবেশ করিল।

বালিকা অনেকক্ষণ জলে ভিজিয়াছে, এবং অসহ্য শীতে তাহার আপাদমস্তক কাঁপিতেছে। উজ্জ্বল গৌরবর্ণ দেহ ও মুখশ্রী এখন পাণ্ডুর। সকল ইন্দ্রিয় এখন অবসন্ন, এবং আর্দ্র স্তূপীকৃত কৃষ্ণকেশদাম পৃষ্ঠে, বক্ষে, অংসে ও বাহুতে গুচ্ছে গুচ্ছে জড়াইয়া লুটিতেছে।

বালিকা গ্রামের মধ্যে আসিয়া দেখিল, কিছুদূরে একটি গৃহে তখনও আলো জ্বলিতেছে। এই একমাত্র দীপালোক লক্ষ্য করিয়া বালিকা নূতন বলে আরও দ্রুত চলিতে লাগিল। নিকটে আসিয়া দেখিল, সেটি, একটি মুদীর দোকান। তথায় চারি-পাঁচজন বসিয়া তাস পিটিতেছে, তামাক টানিতেছে, হাসিতেছে, গল্প করিতেছে, এবং অন্যমনে গুন-গুন্ করে গীত গায়ি’তেছে। যাহার দোকান, সে লোকটাও ঐ তাসখেলার দলের মধ্যে মিশিয়াছে তাহার নাম বলাই মণ্ডল। আর তিন-চারিজন সেই পাড়ার; এই দুর্য্যোগে মুদী খদ্দেরের আশায় জলাঞ্জলি দিয়া আর সেই অপর তিন-জন ঝড়বৃষ্টিতে ঘরে ফিরে যাওয়া দুঃসাধ্যবোধে অনন্যোপায় হইয়া তাসখেলায় মনোনিবেশ করিয়াছে। খেলা এখনও চলিতেছে এবং বেশ জমিয়াও আসিয়াছে।

যখন খেলাটা বেশ জমিয়াছে, সেই বালিকা তথায় আসিয়া কম্পিতকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিল, “তোমরা কেউ জান গা—এখানে গোস্বামীপাড়া কোথায়?”

প্রথমে কেহই উত্তর করিল না। যে তাস পিটিতেছিল, তাহার তাস পেটা বন্ধ হইল; যে তামাক টানিতেছিল, তাহার হাতের হুঁকাটা কাঁপিতে কাঁপিতে শব্দ করিয়া পড়িয়া গেল; যে গল্প করিতেছিল, সে তখন একটা ভূতের গল্পের অর্দ্ধেকটা বলিয়াছিল, তাহার গল্প বলা ঘুরিয়া গেল; এবং যে অন্যমনে গুন-গুন্ করিয়া গান করিতেছিল, সমের মাথায় আসিবার পূর্ব্বে তাহার গান থামিয়া গেল এবং সকলেই অবাঙ্মুখে সেই বালিকার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল।

বালিকা আবার জিজ্ঞাসা করিল। তথাপি কেহ উত্তর করিল না। বিশেষতঃ যে ভূতের গল্প করিতেছিল, কিছুদিন আগে অমাবস্যার রাত্রে কোথায় সে স্বচক্ষে প্রেতিনী দেখিয়াছিল, সেই অদ্ভুত কাহিনী অতি সাহসের সহিত বলিতেছিল, ভয়ে তাহার হৃৎকম্প হইতে লাগিল; এবং বুকের রক্ত উত্তপ্ত হইয়া ফুটিতে লাগিল। সুতরাং সে তখন মনে মনে অনতিপরিস্ফুটস্বরে আত্ম-সংরক্ষণে মন্ত্রপাঠ করিতে লাগিল।

বালিকা কার্য্যে পুনরপি জিজ্ঞাসা করিল, “এখানে গোস্বামীপাড়া কোথায়?

তাহাদিগের মধ্যে বলাইচন্দ্র বেশী সাহসের পরিচয় দিয়া প্রথম বানিষ্পত্তি করিল, “কে তুমি? কোথা থেকে আছ?”

বালিকা সে-কথার কোন উত্তর না করিয়া বলিল, “আমার বড় কষ্ট হইতেছে, আমি দাঁড়াইতে পারিতেছি না, যদি গোস্বামীপাড়া জানো, কোন্ দিকে—শীঘ্র আমাকে বলিয়া দাও। আমি বড়ই বিপদে পড়িয়াছি।”

বলাইচাদের সাহস দেখিয়া হলধর নামে তথায় আর একজন ছিল, তাহারও সাহস শেষ সীমা অতিক্রম করিয়া উঠিল। সে তখন একবার তাহার অতি সাহসের পরিচয় দিয়া প্রেতিনী-অনুমিত বালিকার সহিত কথা কহিল, “গোস্বামীপাড়ায় কার কাছে যাবে?”

বালিকা একবার ইতস্ততঃ করিল; নাম বলিল না।

হলধরের নাম জানিবার তেমন বিশেষ কোন আবশ্যক ছিল না; সে বালিকার সহিত কথা কহিয়া, কেবল তাহার সঙ্গীদিগকে নিজের অতুল সাহস-বিক্রমের পরিচয় দিয়া চমৎকৃত ও মুগ্ধ করিতে চেষ্টা করিতেছিল মাত্র। বালিকাকে নীরব থাকিতে দেখিয়া সে তখন তাহার অমানুষিক সাহসের পরিচয় দিল, “গোস্বামীপাড়া এখান থেকে অনেকদূর। এই দিকের দীঘিটির পাড় দিয়া বরাবর দক্ষিণে প্ৰায় তিন-পো পথ গেলে—তার পর গোঁসাইপাড়া। এই ঝড় বৃষ্টিতে তুমি একা যেতে পারবে না, কোথায় পথ ভুলে বেঘোরে প’ড়ে প্রাণটা হারাবে।”

বালিকা আর কোন কথা না কহিয়া চকিতে তথা হইতে বাহিরে আসিল। সেই ঝড়বৃষ্টি মাথায় করিয়া দক্ষিণ মুখে আবার চলিতে আরম্ভ করিল।

এ বালিকা কে?

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57 58 59 60 61 62 63 64 65 66 67 68 69 70 71 72 73 74 75 76 77 78 79 80 81 82 83 84 85 86

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress