ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ : উপেক্ষিতা
দেবেন্দ্রবিজয়ের হৃৎপিণ্ডের মধ্যে উত্তপ্ত রক্ত ফুটিতে লাগিল। তিনি একবার ঘৃণাপূর্ণ দৃষ্টিতে সেই রমণীর মুখের দিকে চাহিলেন। তাহার পর সেই ঘর হইতে বাহিরে আসিবার জন্য দ্বারের দিকে অগ্রসর হইলেন। দেবেন্দ্রবিজয় ঘর হইতে বাহির হইবার পূর্ব্বেই রমণী দ্বারবন্ধ করিয়া তদুপরি পিঠ দিয়া দাঁড়াইল। এবং কটাক্ষের পর কটাক্ষ বিক্ষেপ করিয়া মৃদুহাস্যে বলিতে লাগিল, “আমার মুখে আগুন! তাই এখন একটা নিষ্ঠুর অরসিককে দেখিয়া আপনা ভুলিয়াছি!”
দেবেন্দ্রবিজয় কর্কশকণ্ঠে বলিলেন, “পথ ছাড়ুন,—আমাকে বিপদে ফেলিবেন না।”
রমণী দৃঢ়স্বরে উত্তর করিল, “কখনই না—যাইতে হয়, আমাকে খুন করুন। (বস্ত্রাভ্যন্তর হইতে একখানি বড় ছুরিকা বাহির করিয়া, দেবেন্দ্রবিজয়ের সম্মুখে ফেলিয়া দিয়া) এই ছুরি নিন্—আমাকে খণ্ড খণ্ড করিয়া কাটিয়া ফেলুন। এখানে কেহ আসিবে না—কেহ কিছু জানিবে না—কোন ভয় নাই তাহার পর আপনার যেখানে ইচ্ছা চলিয়া যান, আমি বাধা দিতে আসিব না। দেবেন্দ্রবাবু, আপনি কেমন জানি না;কিন্তু এরূপ আত্মহারা স্ত্রীলোককে প্রত্যাখ্যান করা অপরের পক্ষে বড়ই কঠিন বোধ হইত।” এই বলিয়া সেই লীলাবতী সুন্দরী আবার দেবেন্দ্রবিজয়ের হস্ত ধারণ করিয়া, যতদূর সম্ভব নিকটবর্ত্তিনী হইয়া দাঁড়াইল।
এদিকে সেই ব্যাকুলা সুন্দরীর অবৈধ আব্দার ও অনুচিত দাবী যত সীমা অতিক্রম করিয়া উঠিতে লাগিল, ওদিকে তেমনি আবার দেবেন্দ্রবিজয়ের অত্যধিক ঘৃণা ও বিরক্তি ততোধিক সীমাতিক্রম করিয়া ক্রমে ক্রোধে পরিণত হইল। ক্রোধভরে দেবেন্দ্রবিজয় তাহাকে দূরে নিক্ষেপ করিয়া অত্যন্ত রুক্ষস্বরে বলিলেন, “তুমি পিশাচী, দূর হও—আমাকে স্পর্শ করিও না। “
রমণী আবার ছুটিয়া আসিয়া দেবেন্দ্রবিজয়ের হাত ধরিল। অবিচলিতভাবে বলিল, “ওঃ- দেবেন, তুমি কি নিষ্ঠুর! পুরুষ মানুষ এতদূর নিষ্ঠুর হইতে পারে, তা’ আমি জানিতাম না।”
দেবেন্দ্রবিজয় পূর্ব্বাপেক্ষা সজোরে তাহাকে দূরে নিক্ষেপ করিয়া বলিলেন, “আমি তোমাকে অত্যন্ত ঘৃণা করি।”
তথাপি সে আবার ছুটিয়া আসিয়া, সেইরূপ আগ্রহভরে দেবেন্দ্রবিজয়ের হাত ধরিয়া, একটা বিদ্যুন্ময় সুতীব্র কটাক্ষপাত করিয়া নম্রস্বরে বলিল, “তথাপি আমি তোমাকে সেইরূপ অত্যন্ত ভালবাসি।”
রমণীর বক্ষের বসন শ্লথ হইয়া পড়িয়াছে; দীপলোকে তাহার পীবর যৌবনভারাবনত দেহ অনাচ্ছন্ন অবস্থায় অতিশয় সৌন্দর্য্যময় বোধ হইতে লাগিল। উন্মুক্ত কেশদাম বিশৃঙ্খলভাবে তাহার চোখ, মুখ, বুক ও পিঠের কোন অংশ ঢাকিয়া ও কোন অংশ কিঞ্চিন্মাত্র উন্মুক্ত রাখিয়া আর একটা অপূর্ব্ব শোভাময় প্রদীপের ক্ষীণালোকপূর্ণ সেই গৃহটি এককালে আলোকিত করিয়া তুলিল। সহনাতীত উৎকণ্ঠায় তাহার ললাটে স্বেদস্তুতি এবং ঘনশ্বাসে তাহার অনাবৃত পীবরোন্নত বক্ষঃস্থল ঘন ঘন পরিস্পন্দিত হইতে লাগিল। সেই উপেক্ষিতা রমণী নিরুপেক্ষিত ও অনপ্রতিভভাবে দেবেন্দ্রবিজয়ের মুখের উপরে তাহার দীপ্ত কৃষ্ণকায় চোখ দুটির চঞ্চল দৃষ্টি স্থির রাখিয়া স্মিতমুখে বলিল, “দেবেন্দ্রবিজয়, তুমি যতই আমাকে ঘৃণা কর না কেন, আমি তোমাকে সর্বান্তকরণে ভালবাসি; কিন্তু আশা করি নাই, আমার এই স্বার্থশূন্য ভালবাসা তোমার হাতে এরূপ কঠোরভাবে পুরস্কৃত ও উপেক্ষিত হইবে!”
দেবেন্দ্রবিজয় ক্রোধে অন্ধপ্রায় হইলেন। “কুলটা, তোমাকে স্পর্শ করিতেও পাপ আছে,” বলিয়া তিনি সেই রমণীকে দুই হাতে এরূপ সজোরে ধাক্কা দিলেন, সে একরকম প্রহার করা;সুতরাং রমণী তাহা সাল্লাইতে পারিল না; ঘরের কোণে গিয়া পড়িল, এবং দেওয়ালে মাথা ঠুকিয়া অত্যন্ত আঘাত পাইল। তখন সে লাঙ্গুলাবসৃষ্টা সর্পীর ন্যায় গৰ্জ্জন করিয়া উঠিল। তাহার প্রচুরায়ত রোষরক্ত চক্ষুদুটি উল্কাপিণ্ডবৎ অতি তীব্রভাবে জ্বলিয়া উঠিল, এবং তন্মধ্য হইতে যেন জ্বলন্ত বহ্নিশিখা বাহির হইতে লাগিল। সেই বিভীষিকাময়ীর মূর্ত্তি দেখিয়া দেবেন্দ্রবিজয় স্তম্ভিত হইলেন, মুখে কোন কথা সরিল না। রমণী তীব্রকণ্ঠে বলিল, “নারকি, আপনার মৃত্যু আপনি ডাকিয়াছ, এ অপমানের প্রতিশোধ এইরূপেই হইবে।” এই বলিয়া তখনই পরিত্যক্ত দীর্ঘ শাণিত ছুরিখানা ভূপৃষ্ঠ হইতে উঠাইয়া লইল। এবং দেবেন্দ্রবিজয়ের বুকে তাহা আমূল বিদ্ধ করিবার জন্য সবেগে ঊর্ধ্বে উত্তোলন করিল। তৎক্ষণাৎ দেবেন্দ্রবিজয় দৃঢ়মুষ্টিতে তাহার হাত চাপিয়া ধরিলেন, এবং ছুরিখানা কাড়িয়া লইয়া রমণীকে পুনরায় ঠেলিয়া ফেলিয়া দিলেন।
রমণী তখনই সবেগে উঠিয়া ঘরের বাহিরে আসিল। বাহির হইতে বলিল, “তথাপি তোমার মৃত্যু অনিবার্য্য।” বাহির হইতে দ্বারে শিকল লাগাইয়া দিল।
দেবেন্দ্রবিজয় দ্বার উদ্ঘাটনের কোন উপায় পাইলেন না। তিনি সেই নির্জ্জন গৃহের মধ্যে এইরূপে বন্দী হইলেন।